#তুত্তুরী_আর_ফুলঝুরির_গপ্প - ৩
আমাদের বাড়ির ছিরি কেষ্ট (অন্য কারো মুখ কল্পনাপটে ভেসে উঠলে, লেখিকা দায়ী নহে)। কারাগারে অবশ্য জন্মাননি, নগর কলিকাতার সবথেকে মূল্যবান হাসপাতালেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি শ্রীমান নন, শ্রীমতী বটেক। তাতে কি? শ্রীকৃষ্ণ তো অখণ্ড প্রেমের আধার, ইনিও তাই। হোক না মেয়ে, শ্রীরাধিকার মত পরপুরুষে মন মজিয়ে, বিরহানলে দগ্ধে মরার থেকে পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ হওয়া ঢের ভালো। অসি আর বাঁশি দুইয়েতেই সমান পারদর্শী হোক। রাজা হয়ে সিংহাসনে বসার দরকার কি, রাজা হলে মুকুট পরার যাতনাটাও যে ভুগতে হবে, তার থেকে ওর অঙ্গুলিহেলনে তৈরি হউক রাজা।
তো, আমাদের কেষ্ট বাবু ভূমিষ্ঠ হবার দিন দুয়েক আগেও শ্রীমতী উমারাণী হুমকি দিয়েছিল, ‘হলে তোমাদের দিয়ে দেব। তুমি আর দাদা মানুষ করবে।’ বেজায় হেসেছিলাম মেসেজ খানা পড়ে, যেন সত্যিই প্রাণে ধরে দিয়ে দিতে পারবে! আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে, শ্রীমতী উমারাণী আজকাল দিনরাত মেয়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ফুলঝুরি কি রকম করে তাকাচ্ছে, ফুলঝুরি কিসে বিব্রত হচ্ছে, কি নিয়ে ফুলঝরি তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে ইত্যাদি প্রভৃতি। রোজ ঘুরে ফিরে মেসেজ করে উমা, ‘দিদিভাই, এমন সুন্দর সময়ের মধ্যে যাচ্ছি ওকে নিয়ে যে মনে হচ্ছে সময় বড় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, বড় হয়ে যাচ্ছে আমার ছোট্ট মেয়েটা দেখতে দেখতে। মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম ছোট্টটি থাকলে বেশ হত।’
পড়ি আর হাসি, হাসি নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। ঠিক এমন চিন্তা আসত আমারও মাথায়। শ্রীমতী তুত্তুরী যখন মাত্র চার মাস বয়স, ওকে আমার মায়ের জিম্মায় রেখে যোগ দিতে হয়েছিল চাকরীতে। অফিস সেই খড়্গপুর। আবাস বলতে মাদপুর নামক অজ গাঁয়ের বিডিও কোয়ার্টর।ইচ্ছে থাকলেও শ্রীমতী তুত্তরীকে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। আমাদের আপিস টাইমে মেয়েকে সামলাবে এমন বিশ্বস্ত তথা পরিচ্ছন্ন লোক পেলাম কোথায়। সবথেকে বড় কথা কেয়ার্টারটা ছিল চতুর্দিকে ধান জমি আর জলা জমি দিয়ে ঘেরা। আমরা যে নেহাৎ ভাড়াটে তা প্রতিপদে বুঝিয়ে দিত বাড়ির মালিক ওরফে টিকটিকি, আরশোলা, গুচ্ছ গুচ্ছ পোকা আর ধেড়ে ইঁদুরের দল। তাই সাহস করে মেয়েকে আর আনতে পারিনি। বদলির আবেদন করে একাকি ফিরে গেলাম খড়্গপুর। কখনও যাতায়াত করে নিতাম, কখনও থাকতে বাধ্য হতাম। যাই করি না কেন প্রতি রাতে শৌভিকের বুকে মাথা রেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতাম,আর বলতাম, ‘কি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে ও, এইভাবে দেখতে দেখতে ওর ৩০বছর বয়স হয়ে যাবে, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার মেয়েকে আমি আর কাছে পাব না।’
সেটা ২০১১সাল, রাজনৈতিক পালাবদলের সময়, বিডিওদের ওপর উত্তাল চাপ, তারই মধ্যে আমার কান্নাকাটি গুলো ছিল আমার বরের একমাত্র বিনোদন। আমার আজগুবি কথাবার্তা আর হুহু করে কান্না দেখে হেসে অস্থির হত শৌভিক। বাবাদের যে ভেঙে পড়লে চলে না।
একই পথের পথিক বলেই উমারাণীর মনের অবস্থা তাই আমার থেকে ভালো কে বোঝে! অতীত খুলে বসলেই উমারাণী বলে, ‘বিয়েই দেব না দুটোর। আমাদের কাছে থাকবে। ও দিদিভাই এদের বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমরা বাঁচব কি নিয়ে গো?’ ওর ইনিংস সবে শুরু, এসব চিন্তা আসা খুব সাধারণ। এই পথে বেশ খানিকটা হেঁটে এসে আজ আমি জানি কি নিয়ে বাঁচব, বাঁচব এইসব অমূল্য মুহূর্তের স্মৃতিগুলো নিয়ে, বাঁচব ওদের গরবে গরবিনী হয়ে, ওদের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে, ওদের সাথে পড়ে, ওদের সাথে উঠে, ওদের গায়ের গন্ধ মেখে। ঠিক যেমন ভাবে শত সহস্র বছর আগে বেঁচেছিল দেবকী আর যশোদা মা, মায়েদের যে বেঁচে থাকতেই হয়।
শুভ জন্মাষ্টমী 🙏🏼🙏🏼
No comments:
Post a Comment