“ডাক্তার কি না দেখালেই নয়?” ফোনের ওপার থেকে তিতকুটে স্বরে জানতে চায় বাবা। মাস খানেক আগে ভাইরাল জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে পড়েছিল বাবা। জ্বর তো ছিল মাত্র দিন দেড়েক, কিন্তু তার জের আর কাটতেই চাইছে না।
যাবতীয় সমস্যা ঢেকে রাখা, চেপে রাখা,পারলে উহ্য বা লুপ্ত রাখাটা আমার বাবার প্রিয় অভ্যাস। বেচারী আমার মা, সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যদিও বা আমাকে জানাতে চায়, রক্ত চক্ষু প্রদর্শন করে বাবা। “ওদের একদম বিব্রত করবে না। ওরা প্রাণ ভরে বাঁচুক। নিজেদের তুচ্ছ সমস্যা আমরা দিব্যি সামলে নিতে পারব।” মুস্কিল হল সমস্যা তুচ্ছ বা শিশু অবস্থায় জানালে তাকে প্রতিরোধ করাটা আমার পক্ষে যতটা সহজ হয়, তিনি যৌবনে পদার্পণ করলে তার মোকাবিলা করাটা হয়ে পড়ে ততোটাই দুঃসাধ্য। এ কথা বারংবার বলা সত্ত্বেও কেন যে বোঝে না আমার বাপ।
এবারেই ধরুন না, আমাকে শুধু বলা হয়েছিল বাবার একটু জ্বরজ্বর ভাব, সামান্য গা ছ্যাঁকছ্যাঁক, অল্প একটু মাথা ধরা, ব্যাস ঐ টুকুই। ক্যালপল খেয়ে, অক্সিমিটারে অক্সিজেন মেপে সেরে উঠেছে বাবা। ফোনে শুনে তাই বিশ্বাস করেছিলাম আমি, ভেবেছিলাম হয়তো নিছক মরশুম বদলের পরিণাম। ভয়ানক অবাধ্য যে লোকটা,যখন তখন স্নান করে, গরম লাগলেই স্নান করে। চান ঘরে পাখা চালিয়েও স্নান করে চোরাগোপ্তা। এমন তো হবারই কথা। বাবাও বলল, ‘ হ্যাঁ। হ্যাঁ একদম ঠিক আছি আমি।’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমারও। তারপর নিত্য কথা হয়, সকালে আমার সাথে রাতে তুত্তুরীর সাথে। ‘ইলেকট্রিক বিলটা দিয়ে দাও’, ‘মায়ের ফোনে রিচার্জ করে দাও’, ‘টাটা স্কাইয়ের বিলটা কবে ডিউ দেখে সময়মত দিয়ে দাও’ ইত্যাদি প্রভৃতি হাজার খানেক ফরমাইশ করে ফোন করে বাবা। প্রতিটা বিল দেবার পর পাঠাতে হয় স্ক্রিনশট। সেই টাকাটা যত্ন করে খামে ভরে লাল-গোলাপী-সবুজ কালিতে লিখে রাখে বাবা। বেশি টাকা জমে গেলেই তাড়া দেয়,গিয়ে নিয়ে নেবার জন্য। তেমনি তাড়া খেয়ে কোন এক সপ্তাহান্তে গিয়ে দেখি পুরো ধুঁকছে আমার বাপ। অপরিসীম দুর্বলতা, কোন মতে পায়ের আগে পা ফেলে হাঁটছে, রাস্তায় বেরোনো তো বন্ধ করেই দিয়েছে, বেশী ক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। খাবার দাবারে ঘোর অরুচি। প্রোটিন জাতীয় কোন কিছুই খাচ্ছে না। মাংসে গন্ধ, ডিমে কোন স্বাদ নেই। খুব ছোট্ট মাছের টুকরো মুচমুচে করে ভেজে দিলে খাচ্ছে বটে, সেও আলে কালে। এতকিছুর পরও ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হল না বাবা। ‘কেন যাব?’ দুর্বলতার জন্য কি কেউ ডাক্তার দেখায়? পারিবারিক ডাক্তারের কাছে রুটিন চেক আপে যাবার সময় এখনও আসেনি। তাছাড়া তার আগে তো তার দেওয়া গুচ্ছ খানেক টেস্ট করাতে হবে। টেস্টের নামে যত ভয় বাবার। কারণ টেস্ট করলেই যে ধরা পড়বে কড়া নিষেধ সত্ত্বেও অপরিমিত ধুমপান এবং শর্করা সেবন।
বাপরে কি ডানপিটে বুড়ো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই পারলাম না। সে যাত্রা শৌভিকের পরামর্শ মত খাবারে নানা রদবদল করে, প্রোটিন বিস্কুট, প্রোটিন ড্রিঙ্ক খাইয়ে কোন মতে খাড়া করা হল বৃদ্ধকে। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন উপসর্গ, কানে তালা ধরা। কখনও ধরছে, কখনও ছাড়ছে। বুঝতে পারছি চৃড়ান্ত অস্বস্তির মধ্যে আছে বৃদ্ধ তাও ডাক্তার দেখাতে যাবে না। ওসব নাকি এমনিই সেরে যাবে। বাধ্য হয়ে পাড়ারই এক শুভাকাঙ্ক্ষীকে ফোন করে অ্যাপো বুক করিয়েছি আমি। সেটাও তেমন পছন্দ হয়নি বৃদ্ধের।
‘আর কত দৌড়বি আমাদের জন্য? এই তো গত শনিবার তুত্তুরীকে নিয়ে এলি,রবিবার আবার তমলুক ফিরে গেলি, সোমবার আবার কলকাতা এলি শ্বশুরকে ডাক্তার দেখাতে, আবার ফিরে গেলি। বুধবার বিকালে আবার আসবি, আবার বৃহস্পতিবার ফিরে যাবি। কত পরিশ্রম করবি আর আমাদের জন্য? বুড়ো বাপ মায়ের জন্য আর কত দৌড়বি?’ মনের খেয়ালে বলে চলে বৃদ্ধ।
শুনতে শুনতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোন এক রবিবারের দুপুর। একটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে গোলপার্ক থেকে ভিড়ে ঠাসা পাঁচ নম্বর নাকি ছয় নম্বর স্টেট বাসে উঠেছি। বসার জায়গা তো সবই ভর্তি, ভদ্র ভাবে দাঁড়ানোটাও মুস্কিল। কোন ভাবে গোঁতাগুঁতি করে লেডিজ সিটের সামনে একটু জায়গা পেয়ে সিটের ওপরের রডটাকে চেপে ধরেছি ব্যালান্সের জন্য। ধরতে গিয়ে সামনে বসা মেয়েটির কয়েকটি চুলও ধরে ফেলেছি অজান্তে। মেয়েটি একবার চোখ তুলে তাকালো, তারপর চুলটা সরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে দিকে। এক পলকের একটু দেখাতেই দিব্য চিনতে পারলাম মেয়েটিকে, জনৈক সুন্দরী সহপাঠিনী। বিদ্যালয় জীবন শেষ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই তবে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি যে একে অপরকে চিনতে অপারগ হব আমরা। তাও সে চিনল না।
গায়ে পড়ে পরিচয় দেবার মত আত্মবিশ্বাসটাও কেন জানি না খুঁজে পেলাম না সেদিন। মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় টপকে সকলেই ততোদিনে কোন না কোন পেশায় জমিয়ে বসেছে, যারা পেশা নিয়ে ভাবিত ছিল না তারা হয় পাড়ি দিয়েছে নয়তো পাড়ি দিতে চলেছে সংসার নামক সমুদ্রে। পড়ে রয়েছে আমার মত গুটি কয়েক হতভাগ্য যাদের না হয়েছে ঝিনচ্যাক্ কেরিয়ার না জুটেছে বর বা বয়ফ্রেন্ড। কয়েকদিন আগেই তেমন এক পরিচিতার মন্তব্য কানে এসেছে ঘুর পথে, 'আমাদের মধ্যে অনিন্দিতাটারই কেবল কিছু হল না।’ বাবা অবসর নিয়েছে, মায়ের অবসর নিতে বছর পাঁচ কি ছয় বাকি, এমতবস্থায় আমার কিছু হচ্ছে না বা হবে না এই চিন্তায় আমি নিজেই যথেষ্ট পঙ্গু, তারওপর এই অযাচিত খাঁড়ার ঘা যে কতখানি ঝাঁঝরা করে দেয় নিছক "সাধারণ মেয়ে"দের আত্মবিশ্বাস তা কেন যে এরা বোঝে না-।
এমনিই ঝাঁঝরা জর্জরিত আত্মবিশ্বাসের ওপর যেন অ্যাসিড প্রলেপ দিল হঠাৎ বাসে দেখা হয়ে যাওয়া সহপাঠিনী। প্রায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মিশে যেতাম বাসের ভিড়ে ঠাসা মাটিতে, যদি না আচমকা নাকে আসত চেনা সিগারেটের গন্ধটা। আমি যত ব্যর্থ, যত অপদার্থই হই না কেন, আমার বাপের জন্য যে আমিই তার সূর্য। ভিড় কাটিয়ে সেই সূর্যেরই গায়ের কাছে সরে সরে এসেছে আমার বাপ। বয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত সিটের মায়া ত্যাগ করে সরে এসে দাঁড়িয়েছে লেডিজ সিটের গা ঘেঁষে। শুধু আমারই জন্য।
গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করতে করতে বাড়ি ফিরেছিলাম বাপ আর মেয়েতে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে একটিবারও জানতে চায়নি বাবা। ভালো হয়ও নি। রেলের পরীক্ষা ছিল আজও মনে আছে। পাইও নি। তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দুঃখ পায়নি বাবা, বুক বাজিয়ে বলে গেছে, ‘তুই চাসনি,তাই পাসনি। তুই যা চাইবি, সব পাবি। সঅঅব পাবি। সেদিন হয়তো আমি থাকব না, কিন্তু তুই পাবি, পাবিইইই।’ পেয়েছি তো। শেষ পর্যন্ত লেবার সার্ভিসকে বেছে নিয়েছি বটে,তবে মাইরি বলছি পেয়েছিলাম আরো এক ডজন সরকারী চাকরী। ভট্টাচার্য বাড়ির সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছি, শৌভিক, তুত্তুরী, উমাকে পেয়েছি। আরোও কত কিই যে পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পাবার পথটা দুর্গম ছিল, সহায় সম্বলও ছিল না তেমন, তাই বলে হাতটা তো ছেড়ে দেয়নি বৃদ্ধ আমার। তাহলে আজ যখন আমার হাত ধরার পালা এত মাতব্বরী করে কেন বৃদ্ধ কে জানে? এত কথা আর বললাম না, কারণ বাবা শুনবে না। কারণ বাবা শুনতে ভালোবাসে না, শুধু বলতে ভালোবাসে।
তাই জব্বর ধমকটমক দিয়ে হাওড়ায় তো পৌঁছালাম, পৌঁছে শুনি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কি যেন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে,তিনি এই সপ্তাহটা বসতে অপারগ। পাড়াতুতো ভাইটি বলল,‘দিদি আমি অন্য ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি খন, আপনি ছুটি নিয়ে এসেছেনই যখন-’। আবার বেঁকে বসল বৃদ্ধ, তিনি দেখালে ঐ ডাক্তারকেই দেখাবেন। অন্য ডাক্তারের কাছে কিছুতেই যাবেন না। হোক না এক হপ্তা দেরী।
হার মেনে ফিরে এলাম তমলুক। শুধু শুধু আর অফিস ছুটি নিয়ে কি করব? গোঁজ হয়ে বসেছিল বাবা। বেরোচ্ছি যখন, উদাস স্বরে বলল, ‘চলে যাচ্ছ? হ্যাঁ যাও। তুত্তুরী না হলে একা থাকবে। তবে তুমি চলে যাবে ভাবলেই কেন যে মনটা এত খারাপ হয়ে যায়। আজও-’। একটু বেশিই ডানপিটে বটে বৃদ্ধ, তবে আজও আমিই এই লোকটার সূর্য।
No comments:
Post a Comment