বাবার ডাইরি থেকে ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
শুভ মহালয়া
(১ম কিস্তি)
১৯৭১ সাল। সে বছর মহালয়া পড়েছিল ১৮ই সেপ্টেম্বর। তার আগের রাত, অর্থাৎ ১৭ তারিখে হামলা হয় আমাদের বাড়ি।
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায় রয়েছে। সর্বত্রই অন্যান্য রাজনৈতিক দল আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। আর আরবান নকশালরা গড়ে তুলছে মুক্তাঞ্চল। গণ সমর্থনও পাচ্ছে ভুরি ভুরি। মূলতঃ গ্রামের দিকেই আন্দোলন ছিল অধিক সক্রিয়। শহর- নগরেও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল তার আগুন। স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে, নিপাত্তা হয়ে যাচ্ছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। শাসক দলও শুরু করেছে নিপীড়ন, নির্যাতন।
এদিকে হাওড়া থেকে ডোমজুড়, তারপর সামান্য অংশ ছেড়ে ওদিকে আমতা পর্যন্ত তখন পুরোপুরি মুক্তাঞ্চল। সেটা আগস্ট মাস, শাসক দলের দুজন নেতা, নাম উহ্য থাকুক,হঠাৎ গোপনে আমার সাথে যোগাযোগ করল, ‘এখনও এখানে খুনোখুনি শুরু হয়নি, চেষ্টা করিস এখানে যেন ওসব না হয়।’ কথা হল, কোন পক্ষই হিংসার আশ্রয় নেবে না। সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ছাড়া হবে, যারা গণ সমর্থন বেশী হবে, এলাকা তারই থাকবে।মিটে গেল যাবতীয় সমস্যা, আমিও আবার চেনা রুট দিয়ে আপিস যেতে শুরু করলাম।
এর কিছুদিন পর,স্থানীয় এমপি তথা কংগ্রেসের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা স্বর্গীয় যুগল কিশোর মণ্ডল একদিন বাড়িতে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে বলল,‘ বড়দা আপনার মেজ ছেলেকে একবার আমার সাথে দেখা করতে বলুন। কিছু একটা চলছে তলায় তলায়-’। হাওড়া ময়দানে কল্পনা সিনেমার ওপরে একটা কংগ্রেসের পার্টি আপিস ছিল। চতুর্দিকে হিন্দিভাষী মেহনতি মানুষের বসবাস,আমার পক্ষেও বেশ নিরাপদ,সেফ জোন। কিন্তু আমি গেলাম না।
এর কয়েকদিন পর আমাদের চাটুজ্জে বাড়ির বড় তরফের যে সবথেকে ছোট মেয়ে, তোরা বলিস খুকী পিসি আমরা বলতাম খুকনি। খুকনি প্রায় দিনই দুপুর বেলা আমাদের বাড়ি চলে আসত তোর পিসিদের সাথে আড্ডা দিতে। সে এসে তোর ঠাকুমাকে খবর দিল, অমুকবাবুর বাড়িতে গোপনে বিরাট পার্টি মিটিং চলছে। তাতে আমাদের ছোট পিসিমা, আর ছোটপিসিমার ছেলে তপনও আছে। খুকনি পিছনের জানলার আড়ি পেতে শুনেছে ওরা আমাদের বাড়িতে দল বেঁধে হামলার প্ল্যান করছে। মূল লক্ষ্য আমাকে আর অসিত(ছোটকাকু)কে মার্ডার করা।
এর কিছুদিন পর আমার সোর্স মারফৎ খবর এল, আমাদের বাড়ির পূব দিকের খিড়কির দরজার উল্টোদিকের দোতলা বাড়ির বারন্দায় একটা ছেলে সবসময় বসে থাকে আর আমাদের বাড়ির দিকে নজর রাখে। তপন দুপুর বেলা প্রায়ই আসে তার কাছে আর দুজনে মিলে আমাদের বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কিসব কথাবার্তা বলে ফিসফিস করে। খবর মোতাবেক একদিন নির্দিষ্ট সময়ে যেই খিড়কির দরজা খুলেছি দেখি তপন উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা অচেনা ছেলের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখেই সুট্ করে ঢুকে গেল।
খুকনি আর আমার সোর্সের খবর মিলে গেল। আমরা আভাস পেয়ে গেলাম যে শীঘ্রই আমাদের বাড়ি হামলা হতে চলেছে। আরোও খবর আসতে লাগল, আমাদের পিছন দিকে পবিত্রদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন নতুন ভাড়াটে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন দিদিমণি আছেন। তিনি কোন স্কুলে পড়ান, কখন বেরোন কেউ জানে না। কিন্তু তাঁর কাছে অনেক ছেলের আসাযাওয়া লেগেই থাকে। সবই অচেনা এবং ষণ্ডামার্কা ছেলে। ভদ্রমহিলা পরে দমদম থেকে শাসক দলের এমপিও হন। নাম যাই হোক সবাই ডাকত বউদি বলে। এই বৌদির কথাই যুগল মণ্ডল আমায় বলতে চেয়েছিল। এই বৌদি প্রথমে নিজে ঢুকেছেন তারপর হার্মাদ বাহিনীকে ঢুকিয়েছেন একে একে।
আমরা আন্দাজ করলাম, পুজোর মধ্যেই হামলা হবে। মহালয়ার আগের দিনই সব টাকাপয়সা যোগাড় করে, রেশন তুলে আমরা ঠিক করলাম গা ঢাকা দেব। রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন। তারপর যা হোক একটা টিকিট কেটে রাত নটার দুন এক্সপ্রেসে চড়ে বসব। তারপর যা হয়-
মহালয়ার আগের রাত, আমি আর অসিত খেতে বসেছি, হঠাৎ বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী তারি পিসি ছুটে এসে মাকে খবর দিল, “ তোমাদের বাড়ি থেকে আর বেরোনোর কোন রাস্তা নেই বৌদি। শাসক দলের কয়েক হাজার ছেলে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বাড়িটাকে। সঙ্গে পুলিশ ও আছে। আর আছে সিআরপি। তারি পিসি আমাদের বাড়ির পিছন দিকে একটা পোড়ো ঘর বানিয়ে থাকত, তারি পিসি তড়িঘড়ি বলল, ‘তোমাদের কাছে যদি কিছু থাকে আমায় দিয়ে দাও। আর্মস্ আর অ্যামুনিশন কিছু তো ছিলই। ভালোমতই ছিল। তারি পিসি সব নিয়ে গিয়ে তার ঘরে লুকিয়ে রাখল। কপালের এমন গেরো প্রথম হামলাটা ওরা করল তারিপিসির পোড়ো ঘরে-
(চলবে?)
বাবার ডাইরি থেকে, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
(কিস্তি -২)
শুভ প্রতিপদ
তারি পিসির সাহস ছিল দুর্ধর্ষ। আমার ঠাকুমার (প্রপিতামহী) অন্যতম স্নেহের পাত্রী ছিল, বাবাকে(দাদু) দেবতার মত শ্রদ্ধা করত বৃদ্ধা, ডাকত ‘বড়দা’ বলে। বৃদ্ধা সেদিন ওদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘দেখো বাবারা আমি গরীব গয়লানি। লোকের বাড়ি দুধ বেচে খাই। তোমাদের যা দেখার দেখো, যা খোঁজার খোঁজো, শুধু আমার ঘরটা নষ্ট করো না।’ কোথায় যে লুকিয়েছিল তারি পিসি জানি না,তবে ওরা কিছু খুঁজে পায়নি। ওরা চলে যেতেই তারি পিসি সেসব জিনিস পত্তর তাঁর লুকানো স্থান থেকে বের করে সোজা পাতকুয়ায় ফেলে দিয়েছিল।
এবার হামলা হল সামনে থেকে। পুলিশ,সিআরপি আর কয়েক হাজার হার্মাদ বাহিনী। বাড়িতে সবাই সন্ত্রস্ত। অসিতকে ছাতের সিঁড়িতে তুলে দিয়ে শিকল তুলে দেওয়া হল। বন্ধ সদর দরজার ওপার থেকে হুমকি আসতে লাগল, দরজা খুলতে হবে। বাড়ি সার্চ করবে ওরা। মজার কথা হল, পুলিশ কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব ছিল, যাবতীয় আদেশ,নির্দেশ, হুমকি সবই আসছিল পার্টির ছেলেদের থেকে। আমরা বন্ধ দরজার এপার থেকে বলছিলাম, “ঠিক আছে। তবে এত জন নয়। দুচারজন আসুন।” এই সব কথাবার্তার মধ্যেই সাত আটজন ছেলে করল কি বাইরের বাগানে একটা মস্ত শালবল্লা পড়ে ছিল, সেটা তুলে এনে সেটা দিয়ে সদর দরজায় ঘা মারতে লাগল।
দেড়শ বছরের বুড়ো সেগুন কাঠের দরজা, কতক্ষণ আর সেই অভিঘাত নিতে পারে। খুলে পড়ল একটা প্ল্যাঙ্ক আর সেই ফাঁক গলে ঢুকে দরজা খুলে দিল কেউ। এক পলকে গোটা উঠানটা হয়ে গেল জনসমুদ্র। ঢুকেই দাদার(জেঠু) গালে দুই চড়। বুড়ো, শারীরিক ভাবে অক্ষম রাজা কাকাকে(বাবার মেজকাকা) অশ্রাব্য গালিগালাজ। চোখের পলকে বৈঠকখানা, রান্নাঘর, ঠাকুরঘর, শোবারঘরগুলো তছনছ করে ফেলল ওরা। পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ। আজও মনে আছে বৃদ্ধ রাজাকাকার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর,‘কি চাইছ, কি চাইছ কি তোমরা?’ বলতেই সপাটে চড়।
ততক্ষণে দোতলায় উঠে গেছে আরেকদল। দোতলার ঘর গুলোর অবস্থাও একতলার মতই হল।সমস্ত আলমারি,শোকেস, ঠাকুদার আমলের কর্পূরকাঠের সিন্দুক, তোরঙ্গ, খাট বিছানা ওলটপালট করেও কিছু পাওয়া গেল না। যে ছেলেগুলো ছিল, তাদের অনেকেই অসিতের(ছোটকাকু) বন্ধু, আগের দিন রাতেও একসাথে আড্ডা মেরেছে পাড়ার চায়ের দোকানে।
ওরা যখন হতোদ্যম হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে, আচমকা ভাবীর(জ্যাঠাইমা) দিকে চোখ পড়ল। হামলা হতে পারে জানার পর চুনু-লক্ষ্মীকে ( অবিবাহিতা ন এবং ছোট পিসি) আগেই সরিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। ভাবীকেও বলা হয়েছিল বাপের বাড়ি চলে যেতে। ভাবী বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। ওরা কুৎসিৎ কিছু গালমন্দ করে বলল, ‘নির্ঘাত এই মেয়েছেলেটা শাড়ির মধ্যে আর্মস্ লুকিয়ে রেখেছে। শাড়ি খুলে সার্চ করব।’
পুলিশ চুপ থাকলেও, ঠিক এই সময় গর্জে উঠল সিআরপির জাঠ ড্রাইভারটা। তার কাঁধেও একটা ফায়ার আর্মস্ ছিল, আচমকা সেটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘মেয়েদের গায়ে হাতে দিলেই আমি গুলি চালাব। জানানাকে সার্চ করতে হলে একজন জানানাকে ডেকে আনুন।’ পাশের বাড়ি থেকে একজন মহিলাকে ধরে আনা হল,সে মাঝের ঘরে ভাবীকে ঢুকিয়ে ভালো করে তল্লাশী নেবার পর জানাল,‘ নাঃ কিছু পাওয়া যায়নি।’
সাময়িক ভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়ল ওরা। কয়েকজন বেরিয়েও গেল বাড়ি ছেড়ে। কয়েকজন আবার ভঙচুর করতে লাগল নিষ্ফল ক্রোধে। বাইরের ঘরে একটা সুন্দর জার্মান ঝাড় বাতি ছিল। বাবার(দাদু) ভীষণ পছন্দের জিনিস। মাঝেমাঝে বাবা বৈঠকখানার তক্তোপোষে শুয়ে এক দৃষ্টিতে ঐ ঝাড়বাতিটার দিকে তাকিয়ে থাকত। বিভৎস উল্লাসে সেটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল ওরা। ঠাকুরদার (প্রপিতামহ) যে দেওয়াল জোড়া পোর্টেটটা ছিল, সেটাকে আছড়ে আছড়ে ভেঙেও শান্তি হল না। শেষে বল্লম দিয়ে খোঁচাতে লাগল।
অসিত(ছোটকাকু) এতক্ষণ ছাতের সিঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। হট্টোগোলের আওয়াজ কিঞ্চিৎ স্তিমিত হয়ে পড়ায়, আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেই দোতলার বারন্দা দিয়ে উঁকি মারতে গেছে অমনি ওদের নজরে পড়ে গেল। ‘ঐ তো অসিত। মার শালাকে-’ বলতে বলতে তৎক্ষণাৎ দোতলার দিকে দৌড়ল গোটা বিশেক ছেলে। তারপর অসিতকে প্রায় চ্যাং দোলা করে এনে ফেলল উঠোনে।
এতক্ষণে পুলিশকে নড়তে দেখা গেল, ওসি ছিল গোপাল ভড়, সে বলল ‘অ্যারেস্ট করে নিয়ে চল।’ দুজন বাঙালী পুলিশ দুদিক থেকে আমার হাত চেপে ধরল, অসিতকে আর আমাকে নিয়ে চলল পুলিশ ভ্যানের দিকে। ভ্যানটা ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়েছিল যুগল মণ্ডলের বাড়ির সামনে অর্থাৎ আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ছয়-সাতশ মিটার দূরে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের সরু গলিটা দিয়ে আমাদের যখন বড় রাস্তার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমার হাত ধরে থাকা একজন বাঙালী পুলিশ হঠাৎ বলল,‘আপনার চশমাটা খুলে আমাকে দিন। আমি বুক পকেটে রাখছি। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। চশমাটা ভেঙে কাঁচ চোখে ঢুকে যেতে পারে।’
চশমা খুলে দেওয়াটা ভালো হল না মন্দ হল জানি না, কারণ আমার সামনের কিছুই আর আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। বড় রাস্তায় ওঠার সাথে সাথেই শুরু হল মার। চোখে ঝাপসা দেখার জন্য আমি বুঝতে না পারলেও অসিত পুলিশ ভ্যানটা দেখতে পেয়েছিল। মার খেতে খেতেই টেনে দৌড় মারল অসিত, সোজা গিয়ে উঠে বসে পড়ল পুলিশের জিপে, আর তারপর শুরু করল অসিতের পাল্টা গালাগাল। ‘দাঁড়া শালারা, মামার বাড়ি যাচ্ছি বটে,চিরদিন তো আর আটকে রাখতে পারবে না। ফিরে আসবই, আর ফিরে এসে তোদের সবকটাকে দেখে নেব।’
আমি পালাতে পারিনি, ফলে অঝোর কিল,চড়, ঘুঁষি,লাঠি, রডের বাড়ি পড়তে লাগল আমার ওপর।মার খেতে খেতে রক্তাক্ত অবস্থায় যখন লুটিয়ে পড়েছি, তখনও পুলিশ ভ্যানটা আরও দু- আড়াইশ মিটার দূরে। ওখানেই মেরে ফেলত আমায়,যদি না একজন সিআরপি আচমকা পিছন থেকে আমায় তুলে কাঁধে ফেলে দৌড়ত পুলিশ ভ্যানের দিকে।
ব্যাঁটরা থানার লক আপে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমাদের। অসিত দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ফুঁসতে লাগল। আমার আর বসার ক্ষমতা ছিল না। আমি নেতিয়ে পড়লাম। যে বাঙালী পুলিশটা আমার চোখ থেকে চশমাটা খুলে বুক পকেটে রেখেছিল, সে কখন যেন এসে আবার পরিয়ে দিয়ে গেল চশমাটা। চেতনা কখনও আসছিল, কখনও চলে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে শুনতে পেলাম পার্টির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা শিবপ্রসাদ ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) এসেছে আমাদের দেখতে। দাঁতে দাঁত চেপে ওসি গোপাল ভড়কে বলছে,‘একেবারে মেরে ফেলতে পারেননি?’ গোপাল ভড় মিনমিন করে বলছে, ‘ভ্যানটা তো অতদূরে রেখেছিলাম। হাঁটিয়ে তুলেছি। আপনার পার্টির ছেলেরা তার মধ্যে মেরে ফেলতে পারল না? ওরা না পারলে,পুলিশ কি করে সর্বসমক্ষে পিটিয়ে মারবে?’
সেই সময় থানার উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে শক্তি রায় বলে একটা ছেলে থাকত। শক্তি কলেজে স্টুডেন্ট ফেডারেশন করত বটে, পরে কংগ্রেস হয়ে যায়। তখন মাঝ রাত, কয়েকজন নকশাল ধরা পড়েছে শুনে শক্তি দেখতে এসেছিল থানায়, যে কারা ধরা পড়েছে। শক্তির সঙ্গেই এসেছিল পিযুষ গাঙ্গুলী বলে একটা ছেলে। পিযুষের বাবা ছিল আইবির মস্ত অফিসার। পিযুষের সৌজন্যেই শক্তির থানায় অবাধ প্রবেশ ছিল। পিযুষ আর শক্তিও সেদিন শিবপ্রসাদ রায় আর গোপাল ভড়ের গোপন বার্তালাপ শুনে ফেলে। তারপর ওরা চলে যেতে পিযুষই একজন লোক্যাল ডাক্তারকে তুলে আনে। তাঁরই চিকিৎসায় আর পিযুষের উদ্যোগে বলতে পারো সেদিন প্রাণ বেঁচেছিল আমাদের। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন পূব আকাশে লেগেছে লালচে রঙের ছাপ,থানার বড় রেডিওটা থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর, " আজি আশ্বিনের শারদ প্রাতে -"।
(শেষ)
অনির ডাইরি ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
"তুই এলি কেন?" ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় আমার বর। বেতন ঢোকার মেসেজটা পেয়ে বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এটিএম এ গিয়েছিলাম একবার, এটিএমটা শৌভিকের অফিসের পাশেই। এখানে ঐ একটিই স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম আছে। আমাদের অফিসের আসে পাশে বলতে বাজারের মধ্যে একটা টাটার কি যেন আছে, তাতে চার হাজার টাকা তুলতে দেয় কেবল, তাও কেঁদে ককিয়ে। ঐ কটা টাকায় হবে কি? কাল হয়ে শারদীয়া ছুটি পড়ছে, তুত্তুরীর মাসির পুজোর বেতন, বোনাস, তুত্তুরীর দিদিমণির ফিজ এগুলো তো দিতে হবে। কেন যে ব্যাটারা অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে চায় না।
তমলুকে টাকা তোলাটা বেশ চাপের। নিমতৌড়ি থেকে ঠেঙিয়ে যেতে হয় নিমতলা। ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার করে দিতে পারলে ল্যাটা চুকে যায়। বলাতে খিলখিল করে হাসছিল মাসি। আর তুত্তুরীর দিদিমণি পচুর ঢোঁক গিলে বলেছিল, ‘থাক না ম্যাডাম। পুজোর পরই দেবেন খন।’ আজব মেয়ে তো, তুমি পুজোর পর টাকা নিয়ে কি করবে বাপু? নিজে যে কটা দিন টিউশনি করেছি, কি হ্যাংলার মতই না তাকিয়ে থেকেছি ঐ কটা টাকার দিকে। বিশেষতঃ পুজোর মাসের টাকাটা তো পুরোটাই খরচ করতাম বাবা-মায়ের পোশাক কেনায়। নিজের উপার্জনে বাবা বা মাকে কিছুু কিনে দেবার আনন্দ যে কি পরম, যারা পারে তারাই জানে। খুব সস্তার কিছু কিনতাম হয়তো, তাই কি খুশি হয়ে যেত বাবা। মা মুখে কিছু বলত না বটে, ভালোলাগাটা টের পেতাম রাতে খেতে বসে। ছাপোষা রুটি- তরকারির পাশে সেদিন শোভা পেত গরম গরম একখানা ডিম ভাজা।
এই দেখুন কথা হচ্ছিল শৌভিকের বিরক্তি নিয়ে, সেখান থেকে পৌঁছে গেলাম মায়ের হাতের ডিম ভাজায়। মাঝখান থেকে বেশ খানিকটা করকর করে উঠল চোখ। বয়স বাড়ছে মশাই। তো যাই হোক, এটিএমের পাশেই আমার বরের আপিস, ছুটির ঘন্টা তো বেজেই গেছে, তাই ভাবলাম যাই মাননীয় মহকুমা শাসককে বগলদাবা করে বাড়িই নিয়ে যাই বরং ফিরতি পথে। দুদিন ধরে জ্বরে কোঁ কোঁ করছিলেন ভদ্রলোক, আর ক্যালপল গিলছিলেন গপ্ গপ্ করে। আমার গুঁতোয় যে ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছিল, তিনিও ভুগছিলেন ঐ একই ব্যাধিতে। বললেন, এটা নাকি ‘কলকাতা ফিভার’। জেলার লোক কলকাতা গেলেই হচ্ছে। আমরাও গিয়েছিলাম বৈকি গত সপ্তাহান্তে।
আজ জ্বর নামতেই আপিস গেছে, ডাক্তারবাবু এবং আমার আপত্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে। ‘আমার কাজ গুলো কি তুই গিয়ে করবি?’ তা বটে। গিয়ে দেখি তিনি এক গাদা জাতিগত শংসা পত্র সই করতে বসেছেন। এরপর এক পাহাড় ডাক দেখবেন। এক ঝলক তাকানো ছাড়া কোন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল না। বেশ খানিক চুপ করে বসে রইলাম। শৌভিক সই করছে আর নাক টানছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, গা সামান্য উত্তপ্ত হলেও জ্বর নেই।
পাশেই রাখা দুখানা বড় বড় মনিটর। এসডিও অফিসের ভিতরে,বাইরে, কোণে কোণে যতগুলি সিসিটিভি লাগানো আছে, সবকটার ফিড দেখা যাচ্ছে মনিটর দুটোয়। হ্যাংলার মত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি যে আসছি, দেখতে পেয়েছিলি?’ কেজো জবাব এল, ‘খেয়াল করিনি।’ একনাগাড়ে কাঁহাতক সিসিটিভি দেখা যায়, উঠে খানিক পায়চারি করলাম। অতঃপর ভাবলাম যুগলের একখান ছেল্ফি তুলি, বলা মাত্রই ভস্ম করে দিল শৌভিক। ‘না অফিস চেম্বারে কোন সেল্ফি তোলা যাবে না।’ খানিক থতমত খেয়ে গেলাম, এর আগেও তো তুলেছি, তখন অবশ্য সিসিটিভির দৌরাত্ম্য ছিল না। এখানেও কি সিসিটিভি লাগিয়েছে নাকি? উপযাচক হয়েই বললাম,‘চেম্বারে কিন্তু ভুলেও সিসিটিভি লাগাস না। নাক- কান চুলকালেও তখন চুলকাতে পারবি না। দাঁতও খোঁটা যাবে না। হেব্বি চাপ।’
‘উফঃ ভগবান’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শৌভিক। জানায় চেম্বারে ওসব নেই। তাহলে? সেল্ফি তোলার সমস্যা কোথায়? কথা হয়তো আরও বাড়ত,দরজা খুলে মুখ বাড়াল নবেন্দু, ‘ম্যাডাম চা খাবেন?’ ভয়ে ভয়ে তাকালাম মহকুমা শাসকের দিকে,‘হ্যাঁ গো, চা খাবে?’ বেশ কয়েকবার নাক টেনে, শৌভিক বলল, ‘খাওয়া যেতে পারে।’ দুটো কাপে গরম জল আর গ্রীন টি ব্যাগ এসে হাজির হল। সাথে একটা করে সুগার কিউব। আর দুটো প্লেটে চারটে পুঁচকে পুঁচকে বিস্কুট। চিনিটা না মিশিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। একটা পুঁচকে বিস্কুট মুখে দিতেই গলে গেল। কি ভালো খেতে।
শৌভিককে বললাম,‘হ্যাঁ গো, একটা সাদা খাম হবে?’ অন্যমনস্ক ভাবে জবাব এল,হতেই পারে, তবে ওণার কাছে নেই, সেকশন থেকে চাইতে হবে। অতঃপর চটক ভেঙে, নৈর্ব্যক্তিক স্বরে,‘কেন?’ বললাম, আমার ভাগের তিনটে বিস্কুট আর চিনির কিউবটা বাড়ি নিয়ে যাব। প্রায় লাফিয়ে উঠল শৌভিক, এতক্ষণের ঘ্যাম, ঘাম হয়ে ঝরে পড়ল। কাকুতি মেশানো আতঙ্কিত স্বরে অনুরোধ করল, ‘এই না। এসব করিস না। প্লিজ। কেমন। ল্যাবেঞ্চুষ কিনে দেব। ঐ বিস্কিটটাই তোকে কিনে দেব। কেমন।’ বেল বাজিয়ে নবেন্দুকে ডেকে জিজ্ঞাসাও করল, এই বিস্কুটটা কোন দোকান থেকে কেনা। ফেরার পথে সেটা পড়বে কি না। ইত্যাদি। প্রভৃতি।
আমি ততোক্ষণে মহকুমা শাসকের প্রিন্টার হাঁটকাতে লেগেছি। খাম তো দেবে না, একটা সাফ কাগজ পেলে তাতেই নিয়ে নেব খন। নবেন্দু দেখি চায়ের কাপ প্লেট তুলতে লাগল। দৌড়ে গিয়ে নিজের বিস্কুটের প্লেটটা হাতে নিলাম। যেন এখুনি খাব, এমন ভান করে টুক করে তুলে নিলাম চিনির কিউবটাও। শৌভিক গাঢ় লাল থেকে বেগুনি হয়ে গেল। দুই চোখে কাতর মিনতি।
ভালো কাগজ নেই একটাও, অগত্যা নিজের ব্যাগ থেকে একটা সাফ কাগজ বার করে পাকিয়ে নিলাম বিস্কুট আর চিনি। ‘কেন? কেন? কেন?’ বলতে থাকা শৌভিক কোনদিনও বুঝবে না, মায়েরা কেন এমন করে। মুখের খাবার কেন ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যায় বাড়ি। যার জন্য চুরি করলাম,তিনি অবশ্যি মোটেই আমায় চোর বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘আমায় খাইয়ে দেবে মা? আমি মেহেন্দি পরেছি কি না। দেখো মা, কেমন লাগছে।’ শুনতে শুনতে, দুটো চুরি করে আনা বিস্কুট খাওয়তে খাওয়াতে কেন যে হঠাৎ করকরিয়ে উঠল চোখ।
শুভ তৃতীয়া🙏🏼।
অনির পুজোর ডাইরি, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
(আজ চতুর্থী)
‘ম্যাডাম,দেরী হয়ে যাচ্ছে, লোকগুলো কিন্তু সকাল থেকে এসে বসে আছে।’ একসাথে তাড়া দিল সৌরভ আর যোসুয়া। পুজোর ছুটির আগে আজই শেষ কর্মদিবস। কোথাও ঢাক বাজছে না, তবুও কেন যে, মাথার মধ্যে অনর্গল গান গেয়ে চলেছেন সনৎ সিংহ, “ চণ্ডী তলায় ঢাকের আওয়াজ মিষ্টি মধুর!/জাগিনা, তাক্ তা ধিনা, তাক্ তা ধিনা/গুরু গুর গুরুর গুরুর তাক্ !‘ যার মানসিক অবস্থা পাঠশালার ঐ ছাত্র গুলোর মত, তাকে কিনা অবতীর্ণ হতে হবে ‘চশমাটি আঁটসাঁট’ গুরুমশাইয়ের চরিত্রে।
আজ আমাদের বেনিফিট ডিসট্রিবিউশন প্রোগাম। বিশেষ কিছু না, গুটি কতক পেনশনের পিপিও, কয়েকটা সামাজিক মুক্তিকার্ড, কিছু ফাইনাল পেমেন্ট।তাও সবাইকে ডাকতে হলে সংখ্যটা চার পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে সহজেই, বেছে বেছে প্রতিটা ব্লক এবং পুরসভা থেকে দুই-তিনজন করে ডেকেছি আমরা। মূল অনুষ্ঠানটা সাড়ে বারোটা থেকে ছিল, ঝপ করে একজন ইন্সপেক্টরের অনলাইন ট্রেনিং পড়ে যাওয়ার জন্য এক ঘন্টা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। সেই মর্মে জানানোও হয়েছিল, তাও সবাই বারোটার মধ্যেই এসে উপস্থিত হয়েছে।
বাতানুকূল চেম্বারে বসে বেনিফিট ছাড়তে একদম ভালো লাগে না আমার। তাই সুযোগ পেলেই ডেকেনি মানুষগুলোকে। শুনি তাদের সুখ দুঃখের কথা। চাকরী জীবনের শুরুতে জনৈক সিনিয়র দাদা বলেছিলেন, ‘মানুষের সরকারী দপ্তর গুলোর বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কারণ আমরা কিছু শুনতে চাই না। মানুষ সবসময় সুরাহা বা প্রতিকার চায় না। তারাও জানে তোর সীমাবদ্ধতা। শুধু শুনলেই দেখবি, অর্ধেক সমস্যা মিটে যাবে।’
সাধ্যমত চেষ্টা করি শোনার। শুধু শোনা নয়, আমার তো ওঁদের দেখতেও ভালো লাগে। চেম্বারের বাইরে পর্দা লাগানোর জন্য ঝোলাঝুলি করেছিল এই অফিসের সাপ্লায়ার, ‘এই বিল্ডিং এ সব অফিসারদের ঘরের সামনে পর্দা আছে। আপনিও লাগিয়ে নিন। উটকো পাবলিক ঢুকবে না।’ আমি লাগাইনি। পাবলিক কেন ঢুকবে না? পাবলিক সার্ভিস দেব বলেই তো বসে আছি।
তো যাই হোক, এমনি গুটি কয়েক মানুষকে দেখা এবং তাদের কথা শোনার জন্য আজকের অনুষ্ঠান। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সোহাগ করে যার নাম দিয়েছে, 'শারদ শ্রমাঙ্গনে'। বেনিফিট তুলে দেবার জন্য হোমরাচোমরা কেউ এ যাত্রা আসছে না বলে সামান্য দোনামোনা ছিল আমার টিমের মধ্যে। উড়িয়ে দিয়েছি আমি। আরে ভাই আমার চোখে তো তোমরাও সবাই হোমরাচোমরা। কাজ তো তোমরাই করো। ইন্সপেক্টররা- সিকেসিওরা- গ্রুপ সি/ ডিরা- এজেন্ট/ এসএলওরা থাকলেই হবে। আমরাই তো উপলক্ষ্য। আমরাই ভিআইপি।
ছুটি পড়ার আগের দিন বলে সবাই ভেবেছিল লোকজন তেমন হবে না। হক বাবু মাথা গুণে জানিয়ে গেলেন একশ তেত্রিশ জন সমবেত হয়েছে আজ।
যাক সেজেগুজে আসা সার্থক। কালো ধনেখালি শাড়িটা সম্ভবতঃ চুঁচুড়া থেকে বদলির অর্ডার বেরোনোর পর উপহার দিয়েছিল ধনেখালির অমৃতা আর কৌশিক। আজ ভাঙব, কাল ভাঙব করে আর ভাঙাই হয়নি। বছর ঘুরে আজ ভেঙেছি। হুগলী এনসিএলপি ম্যানেজার ঝুমা শিখিয়েছিল, আগের দিন রাতে কুঁচি আঁচল ঠিক করে সামান্য ইস্ত্রি বুলিয়ে নিলেই আর তাঁতের শাড়ি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। সেই মোতাবেক গত রাতে শাড়িটা পরে, গোটা চারেক সেফটি পিন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলাম কুঁচি আর আঁচল। আজ হাল্কা করে ইস্ত্রিও বুলিয়ে নিয়েছি সক্কাল সক্কাল। মুখ ব্যাদান করছিল বটে শৌভিক,পাত্তা দিইনি। আজকের দিনে ওসব দেখতেও নেই।
ডিএম সাহেবের মিটিং হল কানায় কানায় ভর্তি আজ। রোল কল করার মত করে তত্ত্বতালাশ করি আমি, চণ্ডীপুর এসেছে? আর কোলাঘাট? তমলুক পুরসভা? নাম ডাকার সাথে সাথেই একযোগে উঠে দাঁড়ায় ঐ ব্লক বা পুরসভা থেকে আগত আমাদের লোকজন আর অসংগঠিত শ্রমিকেরা। কোলাঘাটের দীপালীদিকে জব্বর বকেছিলাম আমি। তারপর বেশ কিছু মিটিং এ আসেননি উনি। প্রতিবারই আলদা করে ওণার খোঁজ নিতাম আমি। ইন্সপেক্টরের মুখে শুনতাম ওণার স্বামী খুব অসুস্থ। আজ দেখি হাজির হয়েছেন দীপালী দিও। আমার ওপর আর রাগ নেই তো, মাইকেই জানতে চাই আমি। দীপালি দি একগাল হেসে বলেন, ‘আপনি আমাদের যতটা ভালোবাসেন, আমরাও আপনাকে ততোটাই ভালোবাসি ম্যাডাম। বর অসুস্থ ছিল বলে আসতে পারিনি। এই দেখুন একটু সুস্থ হতেই এসেছি। বরকেও সঙ্গে করে এনেছি। আপনার সাথে আলাপ করাব বলে। ’
আবার বকব কিন্তু, হুমকি দিতে দিতে ময়নায় পৌঁছে যাই আমি। ‘ময়না? ময়না?’ হাঁকতে থাকি। সবাই এ ওর মুখ চায়। ময়নার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর ভাবুক হয়ে পড়ে, ময়না থেকে কেউ আসেনি দেখে। আজকের দিনে আবার কেউ মন খারাপ করে নাকি? সব মনখারাপ জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিই আমি। ধুর, ময়না আসেনি তো কি? পুজোর ছুটির পর আপিস খুলতে দাও, আমরাই গিয়ে হাজির হব ময়নায়। অন্য ব্লক থেকে আসা লোকজন চিৎকার জোড়ে,‘ আমরাও যাব। আমাদের ও নিয়ে যাবেন ম্যাডাম।’ সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে ভেসে আসে পুরসভার সুতপার গলা। ‘স্যার/ম্যাডাম এই দেখুন মিনুদি এসেছেন ময়না থেকে।’ ‘বাসটা লেট করলনি’ বলতে বলতে একগাল হেসে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসেন মিনুদি, আমি বলি, তা হোক, তবুও বাপু আমরা ময়না যাবই।
অনষ্ঠান এগোয়, সঞ্চালনার দায়িত্ব দারুণ ভাবে সামলায় কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্য। একেক জনের নাম ধরে ডাকে সৌম্য, জানায় তিনি কি পাচ্ছেন বা পেতে চলেছেন। গুড়গুড় করে এগিয়ে আসেন সেই শ্রমিক, আমি চিৎকার করি আমার টিমের কোন সদস্যের নাম ধরে, পিছন দিকে বসে জমিয়ে আড্ডা মারা শুভদীপ্ত,সৌমেন, শুভাশিসকে আড্ডা ফেলে উঠে আসতে হয় সার্টিফিকেট বা পিপিও তুলে দিতে। চায়ের হিসেব ফেলে এগিয়ে আসেন হক বাবু। তেমনি নাম পড়েছে সৌম্য, রোগা ছোট্টখাট্ট চেহারা, গলায় কণ্ঠি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন স্টেজের দিকে। ওণার পেনশন ঢুকেছে প্রথম বার। আমাদের রবি বাবু ওণার হাতে তুলে দেবেন পিপিও। স্বভাববশতঃ বলে যাই আমি, ‘ যত্ন করে রাখবেন। অবশ্যই ল্যামিনেট করিয়ে নেবেন। আর প্রতি নভেম্বরে এসে লাইফ সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন।’ পিপিও পেয়েও, যান না ভদ্রমহিলা। নীচে থেকে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন দুটো হাত। শিরা ওঠা রুগ্ন দুটো হাত চেপে ধরে আমার হাত, বিড়বিড় করে কি সব যেন বলতে থাকেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী ছুটে আসেন পিছন বেঞ্চ থেকে। ভদ্রমহিলা ততক্ষণে হাত বাড়িয়েছেন আমার মাথার দিকে।
এতক্ষণে চিনতে পারলাম ওণাকে, এই আপিসের চার্জ নেবার পরপরই এসেছিলেন দোঁহে। ওণার পেনশনের আবেদন করার পর কেটে গেছে বেশ অনেকগুলি দিন। আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারপর কেউ বোধহয় বুদ্ধি দেয় আমার সঙ্গে এসে দেখা করার। তিনতলা সিঁড়ি ভেঙে এসে মুখচোখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল দুজনের। সব শুনে, শান্তনু আর তৎকালীন ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলে বুঝেছিলাম, ওণারা যতদিন বলছেন বা ভাবছেন ততোদিন পড়ে নেই, কিছু কাগজপত্র নিয়ে সমস্যা ছিল বটে, তাই হয়তো কয়েকবার হিয়ারিং এ ডেকেছিলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। অতঃপর তিনি তাঁর কাজটা করে রেকমেণ্ডেশন সমেত জমা করেছেন আমাদের দপ্তরে। আমাদের দপ্তরে আরেক প্রস্থ ঝাড়াইবাছাই করে, আরোও গুটি পঞ্চাশ আবেদনের সঙ্গে তা অচীরেই পাঠানো হবে কলকাতা। সেই মত সব বলে, বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। পেনশন পাবেনই এটা জোর দিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই। বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে যদি পান, তো দেরী নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, নির্দিষ্ট দিন থেকেই পাবেন এবং পাইপয়সা সমেত পাবেন।
আর একটা কাজ করেছিলাম, দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে লিফটে তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমার কাছে আর আসার দরকার নেই, আর যদি আসেনই তাহলে যেন অবশ্যই লিফটে চড়ে আসেন। সেটা ভোলেন নি ওণারা। অনষ্ঠান শেষেও অনেক আশির্বাদ করে গেলেন ভদ্রমহিলা। থুতনি ধরে চুমুও গেলেন বেশ কয়েকটা চকাস্ চকাস্ করে। গতকালই শারদ শ্রমাঙ্গনে নিয়ে কোন এক গ্রুপে জনৈক সহকর্মী প্রশ্ন করেছিল, ‘দিদি তুমি এইসব করছ অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে, আর আমাদের কি হাল। কেউ ভাবে আমাদের কথা?’ স্যাড ইমোজি ছাড়া কিছু দিতে পারিনি ছেলেটাকে। ভুল তো কিছু বলেনি, চাওয়া-পাওয়ার অঙ্কটা বড় জটিল, হাতে পেন্সিল থেকে যাবার সম্ভবনা প্রবল। হয়তো সবই ভুল, সবই অর্থহীন, তাই বলে অঙ্কটা না কষে ছেড়ে তো দিতে পারি না। দেখাই যাক না-। আমি বাপু ভয়ানক আশাবাদী। হয়তো মধ্যমেধার সেটাই বৈশিষ্ট্য।
অনির পুজোর ডাইরি, ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
পর্ব- ২
(আজ চতুর্থী)
বিয়ের আগেই বলে রেখেছিলাম, পুজো মানেই আমার শহর। কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে বলেই, তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে, উৎসবের দিনে ঘর অন্ধকার, মুখ কালো করে বসে থাকবে আমার বুড়ো বাপ-মা, তা হবে না বাপু। বরের সাথে তো সারা বছর কাটাই, গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি তুলি, শৌভিক আর একটু নমনীয় হলে আরও বেশি তুলতাম, পুজোর কটা দিন অন্তত অর্ধেকটা না হয় নাই থাকলাম একসাথে। অঞ্জলি দিয়ে যেখানে বলবে,বাধ্য স্ত্রীর মত অনুগামিনী হব খন।
অঞ্জলি কিন্তু আমার পাড়ায়। আমাদের পাড়ার ঠাকুরকে ছাড়া অঞ্জলি অকল্পনীয়। ভাবতেই পারি না। আমি এবং তুত্তুরীও বলে, আমাদের ‘আসল মা’ তো তিনিই। প্রাণের স্পন্দন কেবল তাঁর বিভঙ্গেই টের পাই যে। নেহাৎ ছাপোষা প্যাণ্ডেল করত হাওড়া মিলনী। গলি জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ঝুলত কয়েকটা টিউবলাইট। চতুর্থীর ভোরে আসত ঠাকুর। তখনও পূব আকাশ থাকত ঘোর কৃষ্ণ, গলির মুখে এসে থামত ঠাকুর ভর্তি লরি, অতঃপর প্রবল শোরগোল করতে করতে প্রায় বাচ্ছাদের মত পাড়ার কাকু/জেঠু/দাদাদের কোলে চেপে মণ্ডপে যেত লক্ষ্মী-সরস্বতী-কেতো আর গণাই। মাকে চাগাতে দম বেরিয়ে যেত সবার।
সাবেকীয়ানায় জবজবে ঠাকুর হত আমাদের। ঝুটো জরির ফুল বসানো টকটকে লাল বেনারসী পরা রণরঙ্গিণী মূর্তি অথচ স্নেহার্দ দুই চোখ, ওষ্ঠাধরে স্মিত হাসি। বাবরি চুল, লালচে চোখ, সবজে গায়ের রঙ,পেশী ফোলানো ইয়া ষণ্ডা মার্কা অসুর, আমরা বলতাম চোরা। পাটের কেশর লাগানো হলদে সিংহটাকে দেখে তো রীতিমত ভয়ই লাগত ছেলেবেলায়। সবুজ বেনারসিতে মা লক্ষ্মী , আর নীল বেনারসি পরিহিতা মা সরস্বতী। ঘিয়ে রঙের ধুতিতে কার্তিক আর গণু। সপ্তমীতে লাল পাড় কোরা সাদা শাড়িতে এসে হাজির হত কলা বউ। দুর্গা আর লক্ষ্মীর গায়ের রঙ কাঁচা সোনার মত। কেতো আর গণা একটু গোলাপী ঘেঁষা আর সরস্বতীর গায়ের রঙ হত ধপধপে সাদা। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই চিন্ময়ী মূর্তি। অঞ্জলির সময় কি জানি কি মন্ত্র পড়তেন বৃদ্ধ পুরোহিত, আমার মন্ত্র ছিল একটাই, ‘আই লাভ ইউ মা। প্লিজ আর কটা দিন থেকে যাও।’ মন্ত্রের ফাঁকে অনুযোগ করতাম, ‘মাঝে মাঝে তো আসতে পারো মা। বুড়ো বরের প্রতি কিসের এত সোহাগ বাপু?’ সেদিন আর নেই, আমাদের পাড়ার ক্লাবেও আজকাল লেগেছে থিমের হাওয়া। পাশের ক্লাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আজকাল থিমের ঠাকুর হয় আমাদের। হয় থিমের প্যাণ্ডেল। গলি জুড়ে ঝিকিমিকি আলোর রোশনাই। শুধু আমারই যে কেন সেই আসল মায়ের জন্য মন কাঁদে কে জানে!
আজ চতুর্থী। আজ হয়েই ছুটি পড়ছে, মানে মানে আজকে আপিসটা সেরেই বোঁচকাবুঁচকি আর মেয়ে বগলে পাড়ি দেব হাওড়ার উদ্দেশ্যে।
গলির মুখে মস্ত সুটকেশ আর গোটা তিনেক পুঁচকে ব্যাগ নামাতে নামাতে আঁতকে ওঠে উত্তম কুমার, ‘ম্যাডাম চলুন আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আপনারা পারবেননি।’ কে পারবে না? আমরা? তুমি বাড়ি যাও বাপু, আমাদের মা-মেয়েকে তুমি এখনও চিনতেই পারোনি। হিড়হিড় করে ভারী সুটকেসটা টানতে থাকি আমি, তুত্তুরী কাঁধে আর হাতে নেয় গুটি কতক ঝোলা। ভুরভুরে গন্ধওয়ালা মাধবীলতার ঝোপে ঢাকা দরজাটা খুলতে খুলতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি আমি, ‘মা, বাবা, দিদি(পিসি) আমরা এসে গেছি।’
ব্যাগপত্তর নামিয়েই মাঠের ঠাকুর দেখতে দৌড়য় তুত্তুরী। বাবা বলে, ‘ থাকবি তো তিন, চারদিন। এত মাল কেউ আনে?’ মুখহাত ধুয়ে পোশাক বদলে মায়ের হাতের চা আর টিফিন খেতে খেতে জমে ওঠে পারিবারিক আড্ডা। ঠাকুর দেখে অখুশি নয় তুত্তুরী, শুধু বলে সিংহটাকে কুতুয়া বানিয়ে দিয়েছে নাকি। এক্কেরে কুট্টুস যেন।
গল্প গড়ায়, রাত বাড়ে। মা জানতে চায়, ‘আমার পেনশনটা তুই তুলে দিবি তো?’ মায়ের পেনশনের এটিএম কার্ডটা তো আনন্দের চোটে তমলুকেই ফেলে এসেছি আমি। এদের যাবতীয় ব্যাঙ্কের কাগজপত্র সবই আমার জিম্মায় থাকে। যদিও আমি জন্ম বাউণ্ডুলে, তবুও তেমনি নির্দেশ আমার বাপের। হুকুম মত টাকা তুলে বা ভরে দিই আমি। তাছাড়া আর উপায়ই বা কি, কিছুদিন আগে জনৈক ব্যক্তি পোস্ট অফিস থেকে বলছি বলে মাকে ফোন করে মায়ের পেনশন অ্যাকাউন্টের হালহদিশ জানতে চায়, মাও ওমনি গড়গড় করে তাকে সব তথ্য বলে দেয়। কার্ডের নম্বর, নামের বানান, সিভিভি ইত্যাদি। আশ্চর্যের কথা হল তারই দিন তিনেক আগে নতুন কার্ডটা পেয়েছিল মা। লোকটা এত গূঢ় খবর জানল কি করে, তা ওপরওয়ালাই জানেন।
এত সহজে কার্য সিদ্ধি হওয়ায় সেই পোস্টাফিসের ভুয়ো বাবুর এত আনন্দ হয় যে এবার তিনি প্রশ্ন করেন, মায়ের অন্য কোন অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সেই কার্ডের নম্বর কি, সিভিভি কি ইত্যাদি প্রভৃতি। এত প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে মা এবার ফোনটা দেয় বাবাকে। বাবা তাকে বলে, ‘ভাই কার্ড তো আমার মেয়ের কাছে।’ তিনি বলেন মেয়েকে ফোন করে কার্ডের ডিটেলস্ জানতে এবং জানাতে, তিনি অত্যন্ত বিজি মানুষ বটে, তবে বৃদ্ধের জন্য ততক্ষণ তিনি ফোন ধরে আমাদের উদ্ধার করতে প্রস্তুত।
বাবাও সুবোধ বালকের মত আমায় ফোন করে নির্দেশ দেয়,‘ আমার এটিএম কার্ড গুলোর নম্বর গুলো একটু বলো তো। পোস্ট অফিস থেকে জানতে চাইছে।’ শনিবারের দুপুর, সদ্য নিজের হাতে রান্না করা লড়াই চিকেনের ঝোল আর ভাত খেয়ে একটা ক্ষুদ্র দিবানিদ্রা দেবার তোরজোড় করছিলাম শৌভিক আর আমি। ঢুলু ঢুলু মস্তিষ্কে যেন বাজ পড়ল, ‘পোস্ট অফিস কেন ফোন করে ব্যাঙ্কের কার্ড ডিটেলস্ চাইবে। ব্যাঙ্কেরই তো চাইবার এক্তিয়ার নেই রে বাবা। নির্ঘাত ফ্রড। এখুনি ঐ ফোনটা কাটো।’ কানে কম শোনে বলে বাবা বোধহয় স্পিকারে রেখেছিল ফোনদুটোই, আমি ব্যাপারটা ধরতে পারায় প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন বাবু মশাই,চিল চিৎকার জোড়েন ফোনের অন্য পাড় থেকে ‘আপনাদের সব টাকা কেটে নেবে ব্যাঙ্ক তখন বুঝবেন। দিনে ১২হাজার কাটবে তখন---’। কথাটা আর শেষ করতে পারেননি ভদ্রলোক কারণ তার আগেই আমার গলাবাজির চোটে ঐ ফোনটা কেটে দেয় বাবা।
তবে এত কষ্ট করেও কোন টাকা তুলতে পারেনি লোকটা কারণ মা যে নতুন পাওয়া এটিএম কার্ডের বিশদ তথ্য দিয়েছিল, সেটিকে তখনও অ্যাক্টিভেট করিয়ে উঠতে পারিনি আমি। তো যাই হোক এই কারণে সব কার্ড আমার কাছে থাকে, প্রতিমাসেই মা আব্দার করে তার পেনশনটা তুলে দিতে হবে আর প্রতিবারই বাগড়া দেয় বাবা। ‘নাঃ মাসে একটা তো দিন, যাও না। গিয়ে তোলো। একটু শরীর চর্চাও তো হয়। দুটো লোকের সাথে দেখাও তো হয়। চারটে কথাও তো বলো, যেদিন পারবে না, সেদিন দেখা যাবে।’ মা প্রবল রাগ দেখাতে লাগল কার্ড না আনার জন্য আর বাবা আর তুত্তুরী মাকে চমকাতে লাগল। ‘যেতে তোমাকে হবেই মামমাম। আমি যাব তোমার সঙ্গে। তোমার হাত ধরে নিয়ে যাব কাল।’ রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে মা, এই তো সেদিন হল মেয়েটা,এর মধ্যে এত বড় হয়ে গেল যে দিদিমাকে হাত ধরে পেনশন তুলতে নিয়ে যাবে-। বিগলিত হয়ে পড়ল মা, তারপর অবশ্য ঝুলি থেকে বেরোল বিড়াল।‘ যাতায়াতের পথে কয়েকটা ঠাকুরও দেখে নেব তোমাতে- আমাতে, বুঝলে মামমাম।’
অনির পুজোর ডাইরি, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
(আজ পঞ্চমী)
পর্ব -১
জীবনের সরণি ধরে না জানি কতটা পথ পেরিয়ে এলাম, তবুও ঠাকুর দেখা নিয়ে আমার উন্মাদনা আজও অটুট। ঠাকুর দেখতে আজও আমার বড় ভালো লাগে। রাত জেগে, মেয়ের হাত ধরে, বন্ধুদের সাথে মহানগরের অলিগলিতে ঠাকুর দেখে বেরানোর মধ্যে কেন জানি না জীবনের সৌরভ পাই আমি।
জীবনের প্রথম ঠাকুর দেখা বলতে অবশ্যই ‘হাওড়া মিলনি।’ আমাদের পাড়ার ক্লাব। মহালয়ার দিন কয়েক আগে যখন মাঠে বাঁশ পড়ত, উদ্দাম উল্লাসে ফেটে পড়তে চাইত আমাদের কচি হৃদয়। সূয্যি মামা পাটে বসার উদ্যোগ নিলেই মাঠে সমবেত হত কচিকাচার দল। অতঃপর সে কি হুল্লোড়। কেউ শিম্পাঞ্জির মত প্যাণ্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুলত, কেউ বা জুতো চপ্পল খুলে প্রতিমার জন্য নির্মিত মঞ্চে চড়ে জুড়ে দিত উদ্দাম নৃত্য। আবার কেউ বা অকারণেই নির্মিয়মান প্যাণ্ডেলটাকে ঘিরে গোল করে ঘুরত চরকির মত।
দেখতে দেখতে এসে পড়ত তৃতীয়ার রাত। রীতিমত যুদ্ধে যাবার মত দামামা বাজিয়ে ঠাকুর আনতে রওণা দিত পাড়ার মাতব্বর কাকু, জেঠু, দাদুর দল। চতুর্থীর ভোরে সবৎসা জননী এসে যখন পৌঁছাতেন তখনও পূব আকাশের মুখে থাকত অন্ধকারের অবগুণ্ঠন। তখনও জননী থাকতেন নিরস্ত্র এবং নিরাভরণ। চতুর্থীর রাত বাড়ার সাথে সাথে মায়ের মাথায় চাপত মুকুট, অঙ্গে নানা ভূষণ। পিছনে খাড়া করা হত ঝকমকে চালচিত্র। দশ হাতে ধরানো হত দশ রকম অস্ত্র। মা লক্ষ্মীর কাঁকে ঢুকত কুনকে বা ঝাঁপি, গণেশের হাতে সোনালী ঢাল ইত্যাদি।
পঞ্চমীর দিন ছুটি পড়ত আমাদের স্কুলে। বছরে এই রকম দু একটি দিনই মহানন্দে স্কুল যেতাম আমরা। একে তো সামনে লম্বা এক মাসের ছুটি, তারওপর ছুটি পড়ার দিন থাকত না ইউনিফর্ম পরার বাধ্যবাধকতা। রঙবেরঙের পোশাকে, শাড়িতে এক ঝাঁক উড়ন্ত প্রজাপতির মত হাজির হতাম আমরা। চেনা বন্ধুকেও মায়ের শাড়িতে কেমন যেন অন্যরকম অনুপমা লাগত সেদিন। একটু দামী শাড়ি, সামান্যতম প্রসাধনের ছোঁয়া লাগত দিদিমণিদেরও অঙ্গে। রাগীতম দিদিমণিও সেদিন থাকতেন খুশির মেজাজে। নাম ডাকতে এসে জুড়তেন খোশ গপ্প, তরল স্বরে প্রশ্ন করতেন, ‘কি রে, কটা জামা হল?’ 'কে বা আগে প্রাণ, করিবেক দান' এর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে জবাব দিতাম আমরা।
কতগুলো যে জামা হত, হিসেব রাখা দুষ্কর ছিল। বাবা একাই দিত পাঁচটা। এর বাইরেও জেঠু দিত, কাকু দিত, দিদিভাই দিত। বড় মাসি দিত, সেজ মাসি দিত। ছোট মাসি প্রথম চোটে একটা বিশাল দামী জামা কিনে আনত অতঃপর মায়ের ধমক খেয়ে পাল্টে দুটো বা তিনটে জামা আনত। চাকরী পাওয়া ইস্তক জামা এবং জুতো কিনে দিত বড়দা। ছোটদা খুনসুটি করে বলত, ‘তোর চওড়া কপাল’। পঞ্চমীর সন্ধ্যেয় পিসির কাছে চুল বেঁধে, অপেক্ষাকৃত কম ঝলমলে জামাটা পরেই দৌড়তাম মাঠে। অতঃপর সে কি হুড়োহুড়ি। দুমদাম করে ক্যাপ ফাটাত দুষ্টু ছেলেগুলো।অন্য দিন ল্যাম্প পোস্টের টিমটিমে আলোয় প্রায়ান্ধকার থাকা গলিটা সেদিন ঝকমক করত টিউবলাইটের মালায়। লাউডস্পিকারে গান ধরতেন কিশোর কুমার, ‘আমা-আ-আর পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝ না-’।
সন্ধ্যা গড়িয়ে নামত রাত। কোলে করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেত বাবা। ষষ্ঠীর ভোরে রওণা দেব আমরা, বাকি পুজোটুকু কাটবে দিদার বাড়িতে। স্বর্গীয় মাতামহ নিষ্পুত্রক ছিলেন বলে, মায়ের পিত্রালয়কে আমরা পাঁচ মাসতুতো ভাইবোন দিদার বাড়ি বলেই ডাকতাম। আজও ডাকি। উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা ছোট্ট একটা গাঁয়ে একাকী থাকত আমার দিদা। গাঁয়ের নাম রামনগর। বছর ভর দিন গুণত শারদোৎসবের জন্য। বছরে এই একটি বার সমবেত হত দিদার চার কন্যা, তিন জামাতা আর পাঁচ নাতিনাতনি।
সেজ-ছোট মাসি নিয়মিত গেলেও, মা বছরে একবারই পিত্রালয়ে যেত। প্রথমদিকে তাই পাক্কা একমাসের ছুটি নিত মা। পঞ্চমীর রাতে ব্যাগ গোছানোর উন্মাদনাই ছিল আলাদা। আংটা লাগানো চামড়ার সুটকেসে ঠেসে ঢোকান হত জামাকাপড়। চেন টানা ঢাউস লাল লেদার ব্যাগে ঢুকত হরেক রকম কৌটোবাটা। দিদার নিঃসঙ্গ ভাঁড়ারে কি থাকে, কি থাকে না। তাই গুছিয়ে সব নিয়ে যেত মা আর বড়মাসি। বাবা নিত নতুন হ্যারিকেন, হ্যাজাক ইত্যাদি। আমার শৈশবের রামনগর ছিল নিষ্প্রদীপ। বিদ্যুত বাতি আসতে বাকি আরও এক দশক। গোছগাছ শেষ হলে টিফিন বানাতে যেত মা। তিন থাক অ্যালুনমিনিয়ামের কৌটো ভর্তি করে নেওয়া হত লুচি, আলুভাজা বা তরকারি আর পাড়ার দোকানের দানাদার। সাকুল্যে বার জন একসাথে যাব যে রামনগর, ঝলমলিয়ে উঠবে, কলকলিয়ে উঠবে দিদার দোতলা মাটির বাড়ি।
পরদিন ভোরে বামাল সমেত আমরা যখন বেরোতাম সদ্য ঘুম ভেঙে আড়ামোড়া ভাঙতেন দিনমণি। পূব আকাশে যেন কেউ ছড়িয়ে দিত এক মুঠো কমলা- লাল আবির। গলির মুখ থেকেই হলুদ ট্যাক্সি ধরত বাবা। গন্তব্য শিয়ালদহ ইষ্টিশন। পুজোর মাসে অকারণ অর্থ ব্যয়ের জন্য গোঁসা করত মা, ‘ময়দান থেকে সাউথ বেঙ্গলের বাস ধরলেই তো হয়’। কিসব সোহাগী কথা বলে মান ভাঙাত বাবা। উড়ন্ত ট্যাক্সির খোলা জানালা দিয়ে অবাক চোখে ঘুম ভাঙা মহানগরকে প্রত্যক্ষ করতাম আমি। বুড়ি হলেও শহরটার একটা জেল্লা আছে যাই বলেন। সাধে কি, হতদরিদ্র হয়েও ইনি তিলোত্তমা। কলেজ স্ট্রিটের ক্রশিংয়ে গড়াগড়ি যেত পাহাড় প্রমাণ সবুজ ডাবের গুষ্টি। দেওয়ালে চিটানো মস্ত সিনেমার পোস্টার থেকে হাসি মুখে হাত নাড়ত মীণাক্ষী শেষাদ্রি, শ্রীদেবী,জয়া প্রদা, কিমি কাটকারের দল।
শিয়ালদহ ইষ্টিশনে মোলাকাৎ হত মাসি, মেসোমশাই, দাদাদের সাথে। হুইসল্ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকত লালগোলা এক্সপ্রেস। কুলিদের সাথে আগেই ব্যবস্থা করে রাখত বাবা। সুটকেস সমেত ছুটন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠত কুলি, পিছন পিছন বাবা। তার পিছনে দাদারা। ট্রেন থামলে জানলার ধারে বসা নিয়ে ছোটদার সাথে এক প্রস্থ মুষ্টিযুদ্ধ হত আমার। কুঝিকঝিক করতে করতে দৌড়ত ট্রেন। মায়ের আনা লুচি, বড়মাসির বানিয়ে আনা খাবার পড়েই থাকত। হ্যাংলার মত ঝালমুড়ি, ডালমুট, গরম সিদ্ধ ডিম, কাঁচের বাক্স করে বিক্রি করতে আসা ছানার মিষ্টি খাবার বায়না জুড়তাম আমরা। রাণাঘাটে বদল হত ইঞ্জিন। ডিজেল ইঞ্জিনকে আলবিদা জানিয়ে এবার এসে জুড়ত কয়লার ইঞ্জিন।
ধিকিধিকি করতে করতে ট্রেনটা যখন পলাশী স্টেশনে নামাত ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে বেলা। অতঃপর রিক্সায় চেপে পলাশীর আমবাগানের ভিতর দিয়ে রামনগর সুগারমিলকে ডাঁয়ে রেখে সোজা গঙ্গার ঘাট। হাতে টানা নৌকায় পেরোতে হত গঙ্গা। মাঝিদের কেউ মায়ের সহপাঠী ছিল, তো কেউ মাসিদের। খোশগল্প করতে করতে নদী পেরিয়ে ওপারে বিধান দাদু বা নারাণ ঘোষের দোকানে চা আর জিভে জল আনা ছানার রসগোল্লা খেয়ে আরও সোয়া কিলোমিটার হাঁটতে হত। রাস্তা প্রথমে খানিকটা পাকা। বাকিটা পুরো কাঁচা। আগের দিন বৃষ্টি হয়ে থাকলে কাদা মেখে ভূত হয়ে যেতাম সব। একবার তো বড়দার কিনে দেওয়া নতুন জুতো এমন কাদায় বসে গিয়েছিল যে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলতে হয়েছিল। তাও আমি পারিনি। তুলেছিল, গ্রাম তুতো এক মামা। গ্রামের ওটাই তো বৈশিষ্ট্য,সবাই সবার আপনজন। আবার পরিস্থিতি পাল্টে গেলে কেউ কারো না।
রামনগর গাঁয়ে তখন দুটোই পুজো হত। একটা পাশেই বাঁড়ুজ্জেদের বাড়িতে আর একটা শিবতলায়। একচালা মাটির ঠাকুর। যত উৎসব, উন্মাদনা সবই দিনের বেলা। রাত নামলেই অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে নিত গ্রামটা। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল দিদার বারন্দার হ্যাজাক। ঐ নিকষ অন্ধকারে সে কি রোশনাই।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর আর ভালো লাগত না ছিমছাম গ্রামের পুজো। হ্যাজাকের আলোও যেন হারিয়ে ফেলেছিল রোশনাই। দাদারা একে একে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল পুজোয়। জীবিকার টানে তুতো মামাদের অনেকেই নাম লিখিয়েছিল আর্মিতে। তুতো মাসিরা এমনকি তাদের বান্ধবীরাও বিয়ে করে পাড়ি দিয়েছিল অন্য মুলুক। ফলে রামনগরের পুজো হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রাণ। মাসি,মেসোমশাইরা অবশ্য সবাই যেত। আর যেত বড়দা। বড় নাতি, দিদার প্রাণপুতুলী নয়নমণি ছিল যে।
সপ্তম শ্রেণী থেকে আর পুজোয় রামনগর যাইনি আমরা। কিন্তু ইত্যবসরে হাওড়ার পুজোও কেমন যেন বদলে গিয়েছিল।পাড়ার মাঠে এতদিন যাদের সঙ্গে খেলে বড় হয়েছি, তারাও যেন হঠাৎ করে কেমন পাল্টে গেল। অনেকগুলি মেয়ের বিয়েই হয়ে গেল দেখতে দেখতে। অবশ্যই পালিয়ে গিয়ে। কেউ কেউ চলে গেল মহল্লা ছেড়ে। শিং ভেঙে নতুন প্রজাপতির দলে ঢুকতে পারলাম না আমি। ফলে ঠিকানা হল পূবের বারন্দা আর অন্ধকার ছাত। ঠাকুর দেখার সঙ্গী বলতে বাবা আর মা। সেখানেও বাঁধল গোল। রামনগর যাওয়া হবে না বলে আর ছুটি নিত না মা। ডাক বিভাগে কাউন্টার ডিউটি, ছুটি থাকত কেবল অষ্টমী আর দশমী। বাবার সপ্তমী থেকে ছুটি থাকত বটে, তবে পুজোয় বাবাকে পেতাম কোথায়। সকাল থেকেই বাবাকে পাকড়ে নিয়ে যেত বন্ধুদের দল। চলত অনন্ত আড্ডা। বাবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে নামত রাত। অফিস ফেরৎ রান্না সেরে সারাদিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ত মাও। খেতে বসে কান্না জুড়তাম আমি। পুজো এসেছে, ঠাকুর দেখব না? একমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে নৈশাহার সেরে প্রায় মাঝরাতে ঠাকুর দেখতে বেরোত বাবা মা। ঠাকুর দেখার পরিধি অবশ্য সীমাবদ্ধ থাকত মধ্য হাওড়ার মধ্যেই। বাবা মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরোনোর স্মৃতি আজও আমার শৈশবের প্রিয়তম স্মৃতিগুলোর অন্যতম। কটা ঠাকুরই বা দেখতাম আমরা, হাতে গুণে গোটা দশেক। সবশেষে একটা তিনশ মিলিলিটারের থামস্ আপ বা গোল্ডস্পট বা একটা কোয়ালিটির টুইনওয়ান কাপ আইসস্ক্রিম খেয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি। দশম শ্রেণী অবধি এটাই ছিল আমাদের পুজোর রুটিন। বন্ধুদের সাথে প্রথম ঠাকুর দেখা একাদশ শ্রেণী থেকে- সে গল্প অন্য দিন হবে খন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment