Tuesday 9 August 2022

অনির ডাইরি ৫ই আগস্ট, ২০২২

 


জানলার বাইরে ডুবিছে দিনমণি। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সপ্তাহটা। এই তো মনে হয় একটু আগেই বলছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘বুঝলে, আমাদের দুই পুত্রবধূই খুব চটপটে।’ ঠিক সেই মুহূর্তেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দইবড়া ভাগ করছিলেন শাশুড়ী মাতা, সেই দইবড়া যা আনানো হয়েছে শুধুই আমার তরে। আগাম সতর্ক করে রেখেছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘যখন থেকে শুনেছে তুমি আসছ, একটাই কথা বলে গেছে, মেয়েটা অতদূর থেকে আসবে, ভাতও খাবে না, তাহলে ওকে যে কি খেতে দিই। তোমার জন্যই বিল্ডিং এর  সিকিউরিটি গার্ডকে দিয়ে আনিয়েছে। প্লিজ খেয়ে নিও। না বলো না। যা অভিমানী তোমার শাশুড়ী মাতা।’ শাশুড়ী মাতা আর তাঁর দুর্জয় অভিমান উভয়কেই বড় ভয় পাই আমরা দুই বউ, ভয় পায় আমাদের প্রিয় শ্বশুরটাও। শাশুড়ী মাতার মন এবং মান রাখতে ভাত খাবার অনুরোধ এবং আব্দার বেশ কয়েকবার করেছিলেন শ্বশুরমশাইও, শুনতে এবং রাখতে পারিনি। ভাগ্যে পারিনি, নাহলে এই সাড়ে চারটের সময় ভাত খেতে হত বাপ মেয়ে থুড়ি শ্বশুর পুত্রবধূকে। 


শ্রীমতী তুত্তুরীর সঙ্গে ভাত খেয়ে, তাঁকে ইস্কুলে পাঠিয়ে বেলা দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম তাম্রলিপ্ত নগরী থেকে।  মধ্যাহ্নে মহানগরে পৌঁছে, শ্বশুরমশাইকে বগল দাবা করে রওণা দিয়েছিলাম নিউ টাউনের টাটা মেডিকেল ক্যান্সার হাসপাতালে। বেশ কিছুকাল যাবৎ পারিবারিক ডাক্তার বাবু সন্দেহ করছিলেন, যে পুনরায় বুঝি কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে বৃদ্ধের উদরে। কর্কট ব্যধি আর আমাদের শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক অবশ্য নবীন নয়, ইতিমধ্যেই দু বার সোজা ব্যাটে খেলে তাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন ভদ্রলোক। প্রথমবার আমাদের বিয়ের অব্যবহিত পূর্বে, পাকস্থলীতে নন হজকিন্স লিম্ফোমা নামক ব্যামো ধরা পড়ে। কেটে বাদ দেওয়া হয় বেশ খানিকটা পাকস্থলী। নিতে হয় গোটা ছয়েক কেমো। তার জেরে আমাদের বিয়ের দিনই অনুপস্থিত ছিলেন বৃদ্ধ। সেজ জেঠু, ফুল কাকা, মণিকাকার আশির্বাদ আর ভালোবাসায় ভিজতে ভিজতেও নতুন কনে আমার দুই চোখ খুঁজছিল এক রুগ্ন ক্ষীণজীবী বৃদ্ধকে। হাতে হাত রেখে মন্ত্র পড়ার ফাঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাবা আসেনি?’ 


এর ঠিক সাত বছর বাদে, আবার কর্কটের কামড় পড়ে বৃদ্ধের উদরে। এবার আক্রান্ত হয় কোলন। সে যাত্রা অবশ্যি কেমো নেবার দরকার পড়েনি। তারপর আবার ঠিক বছর সাতেক বাদে পুনরায় কর্কটের পদধ্বনি। বাড়ির ডাক্তার তো হাত গুটিয়ে নিলেন, পাঠিয়ে দিলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি দেখলেন বেশ ভালো করে টিপেটুপে। প্রেসক্রিপশনে লিখলেনও NAD অর্থাৎ নাথিং অ্যাডভার্স ডিটেক্টেড। আরও একটা কি যেন লিখলেন যার অর্থ নো লিম্ফ নোড ডিটেক্টেড। তাহলে কি তিনি আসেননি এবার? এটা কি নিছক নিশির ডাক। পুঁচকে ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘সেটা এখনই বলা যাবে না। আমরা এথিক্যালি পারি না।’ দিলেন গুচ্ছের রক্তপরীক্ষা। প্রত্যেকটা পরীক্ষায় ফুল মার্ক পেয়ে পাশ করেও গেল মাইরি শ্বশুরটা। তাও কেউ বলল না, বাড়ি যান মশাই। আপনি, বিলকুল সুস্থ আছেন। বরং বলা হল, পেট সিটি স্ক্যান করতে হবে। 


ছুটি নিয়ে গিয়ে স্ক্যানটাও করিয়ে আনল শৌভিক। এবার রিপোর্ট নেওয়া আর ডাক্তারবাবুকে দেখানোর পালা। ছুটির দিন বা সপ্তাহান্তে বসেন না ডাক্তারবাবু, শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রের পক্ষেই আপাততঃ আরোও একটা কর্মব্যস্ত দিনে ছুটি চাওয়া বা পাওয়াটা বেশ জটিল। উমারাণী তো নড়তেই পারছে না আমাদের দুমাসের প্রাণপুতলী শ্রীমতী ফুলঝুরিকে ছেড়ে। অবশিষ্ট রইলাম আমি। এসব ব্যাপারে আমাকে যে এবাড়ির কেউ ভরসা করে না, অপ্রাপ্তবয়স্ক গোবলু গোবিন্দ বলে মনে করে, তা আমি বেশ বুঝি। তাও নিরূপায় হয়ে আমার সাথেই যেতে হয় বৃদ্ধকে।


রিপোর্টে অবশ্য তেমন কিছু মেলেনি। ডাক্তারবাবু থুতনি চুলকে বললেন, ‘পেট সিটিতে ছোট কিছু তো ধরা পড়ে না। কিছু অ্যানোম্যালি আছে বটে আপনার ফুসফুস গহ্বরে। একটু বুক আর পেটের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে নিন বরং। তারপর যদি কিছু পান, আসবেন-’। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে হাঁপানিতে ভুগছেন শ্বশুরমশাই। ওণার ফুসফুস জোড়া এমনিতেই ভয়ানক ঘায়েল। মোদ্দা কথা ইনি কিছু পেলেন না।


 রীতিমত কাল্পনিক ব্যাণ্ডপার্টি বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরলাম আমরা শ্বশুর আর পুত্রবধূ। মনের খুশিতে আমাকে লুকিয়ে একখান সিঙ্গল মল্টই কিনে ফেললেন বৃদ্ধ। কোন বন্ধুর সাথে কি সব যেন সিনেমা দেখতে যাবেনও ঠিক করে ফেললেন।


 তারপর আর কি, বৃদ্ধকে তাঁর বৃদ্ধার জিম্মায় পৌঁছিয়ে, তাঁর আদরের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ থুড়ি কন্যাকে খবর দিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। আসার আগে অবশ্য খেতে হল দইবড়াটা। মাইরি বলছি, এতটুকুও আপত্তি করিনি আমি। শাশুড়ী মায়ের নিজের হাতে বেড়ে দেওয়া দই বড়া, যা বৃদ্ধা আনিয়েছে শুধুই আমার তরে,এ জিনিস কি সহজে ছাড়া যায়। ভাবলাম ছবি তুলে উমারাণীকে পাঠাই, ‘এই দ্যাখ।আমার জন্য এনেছে, আমায় খাইয়েছে। তোকে দেয়নি, দুয়ো দুয়ো।’ তারপর মনে হল বয়স বাড়ছে, এতটা ছ্যাবলামো করাটা বোধহয় যুক্তিযক্ত হবে না। এইসব করি বলেই এরা আমায় প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করে না মাইরি। তারওপর ওসব দেখে উমারাণী যা হাত পা ছুঁড়বে। নির্ঘাত কথা বলাই বন্ধ করে দেবে কিছুদিনের জন্য।  তাই দইবড়ার ছবি আর তুললাম না, বৃদ্ধের সঙ্গেই একটা ছবি তুললাম। সেটা অবশ্যি উমা রাণীকে পাঠালাম, ওতে তেমন দোষ নেই, বোধহয়। ছবিটা যদিও তেমন ভালো হয়নি,সারাদিনের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে দুজনেরই মুখে চোখে তাও বেশ পছন্দ হল উমারাণীর। প্রচুর ভালোবাসা পেলাম হোয়াটস্অ্যাপ মারফৎ। দইবড়ার গল্পটা অবশ্য চেপে গেলাম চুপচাপ-। প্রাপ্তবয়স্ক হতে গেলে ওটুকু তো করতেই হয়

No comments:

Post a Comment