Monday 28 February 2022

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২

 



#তাম্রলিপ্তকড়চা 


ভীম দেখবেন নাকি দাদা দিদিরা? চলুন, চলুন আজ আপনাদের ভীম দেখিয়ে আনি। এই তমলুক শহরের সবথেকে বড় ভীম। ব্যবত্তার ভীম।  

যবে থেকে ই জেলায় বসতি স্থাপন করেছি, ব্যবত্তার ভীম বাবাজীর প্রশস্তি শুনে আসছি। কে না করেছে ব্যবত্তা নিবাসী মধ্যম পাণ্ডবের জয়গান, বাংলোতে ঘাস ছিঁড়তে আসা মাসির দল, বাংলোর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ছেলে দুটি, রান্নার দিদি এবং তার কন্যা, বাসন মাজার দিদি এবং তার ছানাপোনা, শৌভিকের ড্রাইভার, আমার ড্রাইভার সবার মুখে এক কথা, ‘ভীম তো ভীম, ব্যবত্তার ভীম।’ 


ভীম নয়তো রাজা বিশেষ। ভয়ানক জাগ্রত ব্যবত্তার ভীম সেন। মাঘী পূর্ণিমার আগে যে একাদশী, যার পোশাকী নাম ভীম একাদশী, সেই দিনই অভিষিক্ত হন ভীম সেন, আর সেইদিন কম করে হলেও লাখ পাঁচেক মানুষ সমবেত হন ভীম সেনের দরবারে। ভীম সেনের গলায় ঝোলে টাকার মালা আর থাকে বাতাসার মালা। যার এক একটি বাতাসা হাতের পাঞ্জা এমনকি বড় থালার মাপেরও  থাকে। সবই মানত পূরণের পরিণাম। যার যেমন সামর্থ মানত করে লোকজন। কেউ বাতাসা তো কেউ পুঁচকে ভীম। মাথার মুকুট, কানপাশা, রূপা/ সোনার চোখ এমনকি গদাও মানত করে মানুষ। সোনা-রূপা- কাঁসা-পিতলের গদা, যার যেমন সামর্থ। 


শৌভিকের ড্রাইভার তো প্রথম দিনেই আমাদের নিয়ে যেতে ব্যগ্র ছিল, ব্যগ্র ছিল তুত্তুরী আর তার মাসিও। লাখ পাঁচেক দর্শনার্থীর ভয়ে পিছ পা ছিলাম আমি খোদ। হাল ছাড়েনি পলাশ, প্রতিদিনই শৌভিককে নিয়ে আপিস যাবার সময় বলে যেত, ফিরে এসে আমাদের লিয়ে যাবে। এও বলে যেত, মন্দির অবধি গাড়ি যাবেনি। সরু রাস্তা। খানিকটা হাঁটতে হবে, নাহলে টোটো যায় অবশ্য। এক সপ্তাহের বেশীই থাকেন ব্যবত্তার ভীম, বসে জমজমাট মেলা, কিন্তু নানা কারণে যাওয়া আর  ওঠে না। 


ভেবেছিলাম এ যাত্রা বোধহয় আর হলনি। সেদিন ব্যবত্তাতেই গিয়েছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে। ব্যবত্তা পুর্ব এবং ব্যবত্তা পশ্চিম হল নন্দকুমার ব্লকের দুটি পঞ্চায়েত। ভাগ্যক্রমে একই দিনে ক্যাম্প পড়েছে দুটি পঞ্চায়েতে। ব্যবত্তা পশ্চিমের ক্যাম্পেই প্রথম গেলাম। যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম সুপ্ত বাসনা, যদি দেখা হয় তাঁর সাথে। মুখ ফসকে বলে ফেলতেই আঁতকে উঠল  আমাদের উত্তমকুমার, ‘ঐ দেখেন ম্যাডাম, কি ভিড়।’ সত্যিই সারি বেঁধে এগিয়ে চলেছে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষদের দল।  


তাহলে বোধহয় আর হল না। ক্যাম্প দর্শন সেরে আপিস ফিরতে যাচ্ছি, ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, ‘ব্যবত্তা পূর্বে যাবেন নি ম্যাডাম? ঐ তো রাস্তার ও পাড়ে।’ পাশ থেকে আমাদের এসএলও শিবু বলল,‘আর ভীম দেখবেননি ম্যাডাম? এত কাছে এলেন-।’ বললাম আমি তো যেতেই পারি রে বাপ, কিন্তু আমাদের উত্তমকুমার যা ভয় দেখাচ্ছে, আর সত্যিই রাস্তা বেশ সরু এবং বেশ ভিড়। শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হুঁ না’ র ঢঙে শিবু আশ্বস্ত করল,‘ চলুন। চলুন আমিও যাচ্ছি। আমি গেলে সবাই রাস্তা ছেড়ে দেবে।’ 


শিবুর চাপাচাপিতে গাড়ির চাকা তো ঘুরল ব্যবত্তার ভীমের মন্দিরের পানে, তবে এগোল না বটে। যেমনি সরু রাস্তা, তেমনি দর্শনার্থীদের ভিড়। তার ওপর ভিড় দুয়ারে সরকার থেকে ফিরতি জনগণ। গাড়ির কাঁচ তোলা, বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাও দরদর করে ঘামছে উত্তম। পাড়ার বউদি,মাসিমারা হাতপা নেড়ে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করছে, চুনোপুঁটি গুলো মহানন্দে বনেটে তবলা বাজাচ্ছে এবং শিবু গাড়ি থেকে নেমে চিল্লাচ্ছে। অন্তত মিনিট পনেরো এই নাটকের পর, বাহুবলীর শিব লিঙ্গ তোলার মত, রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা গুটি কয়েক সাইকেলকে শিবু যখন তুলে পাশের ধানক্ষেতে নিক্ষেপ করল, পলকে একটু ফাঁকা হল বুঝি রাস্তা। 


তারপর! তারপর আর কি, আমরা ঝাঁ করে পৌঁছে গেলাম মেলার মাঠে। গাড়ি থেকে নামলাম, শিবুকে অনুসরণ করে মন্দিরে ঢুকলাম, আশ মিটিয়ে ভীমের ছবি তুললাম। শিবুর ‘হেড ম্যাডাম’ শুনে কতৃপক্ষ কয়েকজন বেশ খাতির করে সবকিছু দেখাল। গল্প শোনাল যে এ বছর কম করে লাখ তেরো টাকার মালা ঝুলেছে ভীমের গলে আর জমা পড়েছে শ পাঁচেক পুঁচকে ভীম। পুজো শেষ হলে, বিসর্জন যাবে এই পাঁচশত পুঁচকে ছোঁড়া ভীম। ধুয়ে ফেলা হবে বড় ভীমের গায়ের মাটিও। তবে কাঠামোটা থেকেই যাবে। শিবুর বড় দিদিমণির জন্য দুপ্যাকেট খাস পুজোর ফুল আর জাম্বো বাতাসার মালাও দিয়েছিল কতৃপক্ষ, যার একটি গোটা প্যাকেটই আমি ধরিয়ে এসেছি ইন্সপেক্টর সাহেবকে। আর বকেছি খুব। আজব ছেলে মাইরি তুমি, আমি না হয়  হাওড়ার মেয়ে, তুমি তো খাস এই জেলার ছেলে। এদ্দিনেও ভীম দেখোনি! ভাগ্যে আমি এলাম। শুধু কাজ করলে হবে?  


 দ্বিতীয় প্যাকেটটা উত্তম, আমি, বাংলোর সিকিউরিটি অমিত, এমনকি শ্রীমতী তুত্তুরীর সৌজন্যে বাংলোর পিঁপড়ে গুলো মিলে ভাগ করেও শেষ করতে পারিনি। কে যেন শিখিয়েছিল মা, নাকি ঠাকুমা, প্রসাদ যত ভাগ করে খাবে, ততো বাড়বে তার প্রসাদগুণ, শ্রীমতী তুত্তুরী তাকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছে আর কি।

No comments:

Post a Comment