Tuesday, 22 February 2022

অনির ডাইরি ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



শুনলাম ছেলেটা কোল্ড ড্রিঙ্কস্ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে চিকেন-মটন বা ভালো মাছের মুখরোচক পদ সমূহ। দুচক্ষে দেখতে পারে না কেবল দুধ আর ডাল-ভাত- নৈমিত্তিক তরিতরকারি। সকাল বিকেল ছেলেকে খাওয়াতে জিভ বেরিয়ে যায় মায়ের। মুখে ভাত নিয়ে চুপ করে বসে মোবাইল ঘাঁটে,মোবাইল কেড়ে নিলে তিড়িং বিড়িং করে নেচে বেড়ায়, মুখ ভর্তি মাখা ভাত নিয়ে। গলায় আটকে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে মা-ঠাকুমা-দাদু। 

আমি অসময়ের অতিথি, এসেছিলাম দুয়ারে সরকারে, ছেলেটার বাবার নিমন্ত্রণে একটি বারের জন্য এসেছি তাঁকে দেখতে। যাঁর দর্শনের অভিলাষ এসে এসেছি, তিনি অবশ্যি আমায় পাত্তাই দিলেন না। জবরদস্তি তাঁকে আমার পাশে এনে বসানো হয়েছে বটে, তিনি মগ্ন মুঠো ফোনে। বাড়ির আদরের কচি, এই জেলা শিশুদের ঐ নামেই সম্বোধন করে। ছেলেটির নাকের ডগা দিয়ে আমার সামনে এক প্লেট মিষ্টি আর এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় রাখা হল। আমিও খাব না, ছেলেটির মা ঠাম্মাও ছাড়বে না। উভয় পক্ষের দর কষাকষির ফাঁকে তিনি দৌড়ে এলেন খপ করে আমার পানীয়ের গ্লাসে একটা আঙুল ডুবিয়ে সটান চুষে নিলেন আঙুলটা। পরের বার ডোবানোর তাল করেছিলেন বটে, কিন্তু তার আগেই খপ করে নড়া ধরে টেনে নিয়ে গেল মা। ঠাকুমা-দাদু-বাবা-কাকা লজ্জায় লাল। আর আমি তো হেসেই খুন। 


ওকে না দেওয়া হলে আমিও খাব না। আমার এবং কচির যুগপৎ জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে একটা স্টিলের পুঁচকে গ্লাসে অল্প একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক ঢেলে দেয় ওর মা। পিছনের জানলা দিয়ে কে যেন জানতে চায়, ‘গোলাপ গুলা কি তুমি ছিঁড়তেছ কচি?’ কচি ততোক্ষণে হারিয়ে গেছে মুঠো ফোনের দুনিয়ায়। স্নেহান্ধ ঠাকুমা বলল, ‘না না। ও ছিঁড়েনি।’ তুলনায় অনেক বাস্তববাদী মা, জানাল পুঁচকেটা ঐ দিকে ঘুরঘুর করছিল বটে, ছিঁড়েছে কি না সে জানে না। তাকিয়ে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটে আছে।  দেখে আমারই লোভ লাগল আর ও তো বাস্তবিকই কচি।  


যাদের গোলাপ ছিঁড়েছে, তারা দেখলাম খুব একটা কিছু বলল না, বার দুয়েক মজা করে শূন্যে ঘুঁষি দেখিয়েই ক্ষান্ত দিল। যাকে দেখাল সে গ্রাহ্যই করল না, করলে বিপদ ছিল। ছেলেটির বাবা হেসে কইল,‘ওনারা সব আমাদেরই জ্ঞাতি ম্যাডাম। আমার দাদুরা চার/পাঁচ ভাই। সবাই ওকে(কচিকে) খুব ভালোবাসে। ওকে আমরা বকলে/মারার ভয় দেখালে ওণারা এসে ঝগড়া করেননি। ছেলেটা যখন হাসপাতালে ছিল, ওদের সবার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল।’


আঁতকে উঠলাম, এইটুকু ছেলে হাসপাতালে কেন ভর্তি হয়েছিল? ছেলেটির বাবা বলল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম, একবার তো আমাদের চোখের সামনেই ধপাস করে পড়ে গেল। আমরা খেতে বসিছি, ওর খাওয়া হয়ে গেছে ও নেচে বেড়াইছে। ঠাকুরের সামনে জলছড়া দিয়েছিল মা,তাইতে পা হড়কে এমন পড়ল-। তখুনি কিছু বোঝা গেলনি, আমরা তো তাড়াতাড়ি মাথায় বরফ-টরফ দিলাম। তখন কিছু বোঝা গেলনি বটে, রাতে দেখি মাথা ফুলে ঢোল। আর ছেলেও কেমন ঝিমিয়ে পড়তেছে। কোন মতে রাতটা কাটিয়েই ছেলেকে নিয়ে দৌড়লাম তমলুক সদর হাসপাতালে। যে ডাক্তার পাব, তাকেই দেখাব। তো যে ডাক্তার পেলাম, তিনি বললেন বাবুর মাথার পিছনে রক্ত বেরিয়ে জমে গেছে। অপারেশন করে সিরিন(সিরিঞ্জ)ফুটিয়ে বার করতে হবে। বারো হাজার টাকায় রফাও হল আমার সাথে। তারপর আমার কি মনে হল, আমি ছেলেকে লিয়ে পাল্যে আসলাম। এইটুকুন ছেলের মাথায় অপারেশন করবে কি বলুন ম্যাডাম।’ 


কি বলি আমি,শুনেই তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তবে সে যাত্রা জনৈক অন্য ডাক্তারবাবুর ওষুধে বিনা অপারেশনেই সুস্থ হয়ে ফেরে কচি এবং তার মা-ঠাকুমার বয়ানানুসারে দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ছেলেটির বাবা বলে,‘ওর থিকেও সাংঘাতিক কি হয়ছিল জানেন নি ম্যাডাম?বাড়িতে কি যেন একটা কাজ চলতেছিল, সবাই তাতেই ব্যস্ত। সেই ফাঁকে ও করছে কি, বড় লোহার মুড়ির টিনের মধ্যে মাথা খানা গলাই দিছে।’ আঁতকে উঠি আমি। বাবা গো, কি ডানপিটে হোঁদল-কুৎকুতে ছেলে বাপু তুই কচি। 


ওর বাবা বলে,‘শুনেননি ম্যাডাম, মাথাটা বার করতে গিয়ে তলার ঠোঁটের ভিতর দিকটা কেটে গেল ছেলেটার। সে কি রক্ত!বন্ধই হয় না। আমি ছেলে কোলে দৌড়লাম তমলুক হাসপাতাল। ডাক্তারবাবু দেখে ভিতরে তিনটে সিলাই করদিলেন। ছেলে সমেত বউকে আমি ওদের মামার ঘরে রেখে এলাম। বাড়িতে থাকলে তো বউকে সংসারের কাজও করতে হয় টুকটাক, তাই আর কি। বাকি দিনটা ঠিকই কাটল, রাত আড়াইটে নাগাদ বউয়ের ফোন,বাবু ঘুমোচ্ছে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর বালিশ।’


‘ সে যে কি রাত কেটেছে ম্যাডাম আপনি জানেননি। আমি বউকে বললাম,রাতটা যাহোক করে কাটাও কাল সকাল হলেই যাচ্ছি। ভোর পাঁচটার সময় বেরোলাম, সাড়ে ছটার মধ্যে ছেলেকে নেয়ে হাসপাতাল। আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে ছেলেকে ওটিতে ঢুকাল। ভিতর থেকে তারস্বরে কাঁদছে বাবু আর বাইরে আমরা দুজন।’ শুনতে শুনতে কখন ভিজে গেছে আমার দুচোখ। 


‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর, পুরাণো সেলাই কেটে নতুন করে সেলাই করে ছাড়ল বাবুকে ম্যাডাম। সে রক্ত আর বন্ধ হয় না। পাগলের মত ছেলেকে নিয়ে ছুটিছি আমরা এ ডাক্তার থিকে সে ডাক্তার।’ শুনতে শুনতে কেমন যেন সন্দেহ হল, এ ব্যধি আমার চেনা। জানতে চাইলাম বাচ্ছাটার কি রক্তের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য  আছে? জবাব এল, জবাব প্রত্যাশিত, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি। রক্তের এক বিশেষ ধরণের ব্যধি,যেখানে জমাট বাঁধতে চায় না রক্ত। জানতে চাইলাম এমন জটিল জেনেটিক ব্যধি শিশুটি পেল কি করে, জবাব পেলাম নীলরতন সরকার মেডিকেল  কলেজের বোর্ড কিসব বিশদ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানিয়েছে যে শিশুটির মাতৃকুলে কারো ছিল এই অসুখটি। পরবর্তী বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে ছেড়ে কচির ঘাড়ে চেপেছেন তিনি। 


হিমোফিলিয়া এমনিতে তেমন ঘাতক নয়, শুধু রক্তক্ষরণ যত দূর সম্ভব এড়িয়ে গেলেই মঙ্গল। আজকাল চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়ে গেছে, আমাদের শৈশবে দেখা একমাত্র হিমোফিলিয়া আক্রান্ত পাড়া তুতো দাদুটি তো আশি পার করেছিলেন হাসতে হাসতে। শুধু যখনই রাস্তায় বেরোতেন দেখতাম আপাদমস্তক ঢেকে বেরোতেন। ঘোর গ্রীষ্মেও পায়ে থাকত মোজা। যাতে কোন পেরেক না ফুটে যায়। সেই কথাটাই বললাম শিশুটির পিতামাতাকে। চার বছরের কচির জনকজননী তাতে কতটা আশ্বস্ত হল জানি না। শুধু বলল,‘ তাই আশির্বাদ করেননি ম্যাডাম।’ প্রাণ ভরে আশির্বাদ করে এলাম শ্রীমান কচিকে, খুব ভালো থাক, চুটিয়ে দস্যিবৃত্তি কর, শুধু একটু সাবধানে থাকিস বাবা।

No comments:

Post a Comment