সকালের চায়ের কাপ হাতে আলোচনা করছিলাম দোঁহে, কে কবে কোথায় যাব। দুজনে এক সঙ্গে একই ক্যাম্পে না গিয়ে পৌঁছাই, সে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে বটেক। ‘দুয়ারে সরকার আবার হবে নাকি?’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। যুগলে ঘাড় নাড়ি, হবে মানে, আজ থেকে তো শুরু। অতঃপর অনুযোগের সুরে, ‘তুমি তো আমায় জানাওনি মা?’ এবার বিস্মিত হবার পালা আমার। খামোখা তোকে জানাব কেন রে বাপ, এতো নৈমিত্তিক অফিসের কাজ। কটা দিন একটু দৌড়ঝাঁপ বেশী হবে এই যা। ‘আমার বাবা-মা যে আগামী কটা দিন আমাকে মোটেই পাত্তা দেবে না, এটা আমায় জানতে হবে তো-’। ক্ষুব্ধ স্বরে জানায় কন্যা। কত কিছুর জন্যই যে মায়েরা অপরাধী হয়।
বেলা এগারোটা নাগাদ বেরোলাম। ঠিক করেছিলাম আজ পাঁশকুড়া ব্লক, পাঁশকুড়া পৌরসভা আর শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে যাব। আপিস গ্রুপে ফুটে ওঠা প্রথম ছবিটা এল তমলুক ব্লক থেকে। অন্ধকার এবং বেশ ঝাপসা ছবি। এরা ভয়ানক বাধ্য এবং কর্মঠ। শেখার ইচ্ছেও প্রবল কিন্তু ছবি তুলতে একদম পারে না। চায়ও না হয়তো। টিম চুঁচুড়ার দুয়ারে সরকারের ছবি ভিডিও গুলো ফেসবুক হোটাস্অ্যাপ থেকে নামিয়ে এদের দেখিয়েছি, কেমন তুলতে হয় ছবি, কেমন করে করতে হয় এডিট তাও শেখে না ব্যাটারা। এদের সেলফি তোলারও ইচ্ছে নেই, মাঝে মাঝে সত্যিই দুঃখ হয়, এ আমি কোথায় এলাম।
যাই হোক, যত কালোই ছবি হোক, তিন সেট ফিল্টার মারলে একটু ধলা হয়েই যাবে। তবে ফার্স্ট বয় তো বটে। গোটা তাম্রলিপ্ত টিমের মধ্যে সর্বপ্রথম এরাই কাউন্টার খুলে বসেছে এবং ছবি পাঠিয়েছে। পাঁশকুড়া যাবার পথেই পড়বে বোধহয় জায়গাটা, ঠিক করলাম ওদের ওখান থেকে ঘুরেই যাই নাহয়। ইন্সপেক্টরকে ফোনে বললাম, ‘তুমি ফার্স্ট বয় কিনা, তাই তোমার ক্যাম্পেই সবার আগে যাব।’ খুশি হল কিনা বুঝতে পারলাম না, উল্টে জানতে চাইল, ‘আমি ফার্স্ট হলাম কি করে-’।
অত কথা বলতে পারব না বাপ, বল যাব কি করে? আমতা আমতা করে ফোনটা ধরিয়ে দিল স্থানীয় এসএলওকে। সত্যিই ইন্সপেক্টরের পক্ষে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের লোকেশন বলে বোঝানো সম্ভব নয়। স্থানীয় ভদ্রলোক অবশ্য ভালোই বোঝালেন, আর গুগলও দেখলাম চেনে জায়গাটাকে। আমাদের উত্তম কুমারকে বললাম, ‘বুঝেছ তো। তাহলে তুমি চালাও আমি একটু বাড়িতে ফোন করেনি।’ হাইরোড দিয়ে হুহু করে দৌড়চ্ছে গাড়ি, পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করছে বাবা। যত বলি, কটা দিন আমাদের কাছে এসে থাকতে, পৈতৃক ভিটে ছেড়ে, কিছুতেই আমার কাছে আসবে না বৃদ্ধ। কি জেদ বাপরে। তেমনি গলার জোর। ঘুরিয়ে আমি একটু গলার জোর দেখালেই শুরু করে দেয় সেন্টু দেওয়া। সঙ্গতে থাকেন আমার গর্ভধারিণী। ‘লোকটা তোকে এত ভালোবাসে আর তুই কিনা তাকেই মেজাজ দেখাচ্ছিস, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ যেন আমি তো লোকটাকে ভালোই বাসি না।
যে যা পারে করুক, বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেখি গুগলের দেখানো রাস্তা ছেড়ে আমরা অন্য বাঁকে ঢুকে বসে আছি। আমাদের উত্তম কুমারকে নাকি স্থানীয় এসএলও এই রাস্তাই বলেছে। গুগল ঠিক নয়,এসএলওই ঠিক। তাই সই। কিন্তু সে কি রাস্তা রে ভাই, বড় জোর টোটো গলতে পারে, গাড়ির পক্ষে বড়ই সংকীর্ণ। গোটা রাস্তা আমার মুণ্ডপাত করতে করতে গেল উত্তম,‘এত ভেতরে আর কোন ক্যাম্পে যাবেননি ম্যাডাম। অমুক স্যার তো গেতেননি। তমুক স্যার তো গেতেননি।’ অপরাধীর মত মুখ করে বসে আছি আমি, আর উত্তম কুমার বকেই চলেছে,‘এখানকার মানুষ গুলোকে দেখুন, রাস্তার উপ্রে বাড়ি বানিয়েছে, বাড়ির সামনে গজাল পুঁতছে, যাতে গাড়ির চাকা ওর আঙনায় না উঠে পড়ে। দেখছেননি ম্যাডাম। অয় দেখুন বাড়ির সামনে কেমনি কাঠের ঢাঁই রেখেছে, অয় দেখুন ইঁটের পাঁজা রেখেছে গাড়িটা আমি চাপব কেমনে বলুন। এখন উল্টো দিক থিকে কোন গাড়ি না আসলেই বাঁচি। ’
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়, বাঁক নিলাম আর সামনে দাঁড়িয়ে একখান টোটো। টোটো ভর্তি গ্যাস সিলিণ্ডার। এই যাঃ এবার কি হবে? হর্ন বাজিয়েই যায়, বাজিয়েই যায় উত্তম। টোটোওয়ালা বেপাত্তা। গাড়িকে ঘিরে ভিড় জমায় আসেপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা গুড়গুড়েদের দল। রগড় আরো কত জমত কে জানে, এমন সময় দৌড়ে এল বর্ষীয়ান টোটোওয়ালা এবং অসীম দক্ষতার সঙ্গে টোটোটাকে একটা বাড়ির একফালি উঠোনে ঢুকিয়ে দিল। টোটোকে টাটা করে একটু এগিয়েছি হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন ইনি, উত্তম আর আমি যুগপৎ হাঁ হয়ে গেলাম,এমন অজ গাঁয়ে, এমন ঘিঞ্জি পরিবেশে এত ভালো, এমন সুউচ্চ মন্দির টো বানাইল কে? যানজট খানিক হল বটে, উত্তম কুমার আরেক চোট গজগজও করল, তাও নেমেই পড়লাম, এমন মন্দিরের একটা ছবি না তুললে হয়?
No comments:
Post a Comment