Monday 7 February 2022

অনির ডাইরি ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২২

 


কি ভীষণ মিস করছিলাম আমার পুরাণ টিমকে। কি বড় উৎসব হত আজকের দিনটায়। সকাল থেকে নির্বিকার মুখে ঘুরে বেড়াত সবাই, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেই না কেউ। কিন্তু আমার হ্যাংলা মন টের পেত ঠিকই, যে কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে ব্যাটারা।  ঠিক বেলা একটা-দেড়টা নাগাদ সদলবলে ঢুকে আসত সবাই। আমার ঠিক ডান পাশে রাখা সবুজ তোয়ালে ঢাকা কাঠের চেয়ারটায় বসতে বসতে তাড়া লাগাতেন বর্মন সাহেব, ‘এই রমেশ, কৌশিক, ধীমান জলদি এসো সব।’ 

টেবিলের উল্টোদিকে আমার ঠিক সামনের চেয়ার গুলো বরাদ্দ থাকত আমার ইন্সপেক্টরদের জন্য। ডানদিকেরটায় বসত নির্মল। মাঝে সঞ্চিতা আর কৌশিক। বাঁদিকে অরুণ বাবু। একটু পিছিয়ে রাখা একটা চেয়ারে আরাম করে হেলে বসত চঞ্চল। দেওয়ালে সাঁটানো চেয়ার গুলোতে ঘড়ির কাঁটার দিকে বসত সোমনাথ, ধীমান, প্রীতি, ঝুমা, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, শুভজিৎ আর তার পাশে দর্প। দরজার কাছের চেয়ারে এসে বসত রেশমা আর চন্দ্রা। বিদ্যুৎ জীবনেও বসত না। আর বসত না রমেশ। সব কিছুর তদারকি যে ও করত। কেক কিনে আনা,আমার ড্রয়ার হাঁটকে মোমবাতি থুড়ি রঙ মশাল খোঁজা, বর্মন সাহেবের কাছ থেকে লাইটার চাওয়া এবং রঙ মশাল ধরানো। প্রতিবারই ভয় পেতাম আমি, দিল আমার টেবিল বা গোটা কয়েক ফাইল পুড়িয়ে। 


ছুরি ধরার সাথে সাথেই মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যেত রমেশ আর সোমনাথ। ‘হ্যাপি বাড্ডে টু ইউ’ একসাথে শুরু তো করত সবকটা। শেষ পর্যন্ত গাইত কেবল দুজন এএলসি সুখেন বর্মন আর সিকেসিও সোমনাথ হাঁসদা। কাটতে শুরু করার পর ধীমান আলমারি খুলে বার করত এক দিস্তা কাগজের প্লেট।  অতঃপর মাথা পিছু হিসেব করে বাকি কেকটা কেটে বিতরণ করত রমেশ।বাদ যেত না তুত্তুরীও। ওর জন্য বড় একটা টুকরো কেটে, একটা কৌটো করে সরিয়ে রাখত রমেশ। তার আগে মিটে যেত উপহার প্রদান পর্ব। কত কি যে পেতাম। আরএলও চুঁচুড়া থেকে দিত, রমেশ একটা দিত, ঝুমা দিত, প্রিয়াঙ্কা দিত, প্রদীপ তাদের খেতের ঝাঁকা ভর্তি টাটকা সব্জি দিত, লাজুক বিদ্যুত লুকিয়ে মস্ত ক্যাডবেরি অরিও রেখে যেত ড্রয়ারে আর মাম্পি দিত গাছ। পাগলী মেয়েটার জন্য গাছে গাছে ভরে উঠত আমার ফ্ল্যাটের ছোট্ট ব্যালকনি বাগিচা। 


ঠিক বেলা দেড়টা নাগাদ ফোন করল সঞ্চিতা, ‘হ্যাপি বাড্ডে ম্যাডাম। যদিও বিলেটেড। কাল আর ফোন করিনি, জানতাম আপনি ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন।’ ফোন কেড়ে কথা বলল কৌশিকও। পুরাণ দিন, সোনালী দিনের গল্প হল খানিকক্ষণ। সঞ্চিতা বলল, ওরা আমায় মিস করছে, আমি বললাম আমি ওদের মিস করছি। কে বেশী মিস করছে এই নিয়ে চাপানউতোর অন্তে যখন ফোন রাখলাম, তখনও জানি না কি চলছে আমার নতুন আপিসে। দিব্যি গম্ভীর মুখে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে। পাঁচ কেজি বেনিফিট নিয়ে এসে চেক করাল শান্তনু আর জসূয়া। গুগল শিট আপডেট করলাম। কি সব রিপোর্টে কি যেন গরমিল পাওয়া গেছে তাই নিয়ে খুব এক চোট চেঁচামিচি করলাম। কলকাতায় ফোন করে দুবার সুকন্যা আর দুবার শ্যামাপ্রসাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করলাম। 


তিনটে নাগাদ খেতে গেলাম। তুত্তুরীর সঙ্গে রুটি আর ওলকপির ঘ্যাঁট খেয়ে সাড়ে তিনটেয় আবার আপিসে ঢুকলাম। কি অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে লোকজন, জহর বাবু এসে চা দিয়ে গেলেন। ঘড়ি বলল, চারটে বাজে হে, জানলার বাইরে আড়ামোড়া ভেঙে পাটে চললেন সূর্যদেব, হঠাৎ দেখি প্রকাণ্ড একখান কেক এসে বসল আমার সামনে। হুড়মুড় করে ঢুকল শেখর বাবু, জসূয়া, রাজীব, শুভাশিস, শান্তনু, সৌমেন, হকবাবু, আশিস, রবি বাবু, অরূপ, জহর বাবু আর যেন কারা, কারা। ‘হ্যাপি বাড্ডে ম্যাডাম।’ 


জাঁদরেল, রাগী, খাণ্ডারনি আধিকারিক হঠাৎ করে হয়ে গেল লাজুক ষোড়শী কিশোরী। আরে ভাই তোমরা জানলে কি করে? কোথা থেকে যেন খসে গেল যাবতীয় ঝুটো সফিস্টিকেশন, বোকার মত বলে বসলাম, ‘ভীষণ ভীষণ মিস করছিলাম আমার পুরাণ টিমকে। সবে তো মাস দুয়েক হল এখানে এসেছি,  তার মধ্যেই তোমাদের এত উষ্ণতা, এত ভালোবাসা কয়েক মুহূর্ত আগেও ছিল কল্পনাতীত। মনেই হচ্ছে না চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি।’ 


শান্তনুর তোলা কেক কাটার ভিডিও খানি রাতে শৌভিককে দেখাচ্ছিলাম, ‘দ্যাখ মাত্র দুমাসেই এরা আমায় কত ভালোবেসে ফেলেছে।’ দেখতে দেখতে এল আমার অমোঘ বাণী, 'মনেই হচ্ছে না চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি'। প্রবল ধমক খেলাম, মাননীয় মহকুমা শাসকের কাছে। ‘এরকম করে কেউ বলে? এরা কি ভাববে? এরা এত কিছু করল, তাও সেই চুঁচুড়া-’। কি করি, কি ভাবে বোঝাই, তাম্রলিপ্ত আমার বর্তমান ঠিকই, অতীতটা যে মাখামাখি চুঁচুড়ার সাথে। এত দ্রুত ওদের ভুলে যাই কি করে? আমার মন কি এতই ছোট যে একদলকে জায়গা দিতে সরে যেতে হবে আরেক দলকে। তার থেকে দুদলই থাকুক না বাপু, চুঁচুড়াও থাকুক আর তাম্রলিপ্তও থাকুক। যে যেখানেই থাকুক, শুধু খুব ভালো থাকুক, আমার অতীত ও বর্তমান সমস্ত টিম মেম্বারদের জন্য জন্মদিনে এটাই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।

No comments:

Post a Comment