দুয়ারে সরকারে আমি আর কি করি। কিছুই করি না, শুধু পটের বিবির মত সেজেগুজে যাই, ক্যাম্পের দরজার বাইরে থেকে বরকর্তার মত অভ্যর্থনা করে নিয়ে যায় আমার ইন্সপেক্টর/ সিকেসিও বা ক্ষেত্র বিশেষে এসএলও। জনসমুদ্রের মাঝখান দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমাদের দপ্তরের টেবিলে গিয়ে পৌঁছাই, দেখামাত্র কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায় বাকিরা। আমিও হেব্বি মাতব্বরী করে জিজ্ঞাসা করি, কটা ডিএস পড়ল? আর কটা পড়তে পারে ইত্যাদি। ইন্সপেক্টর সাহেব কাচুমাচু মুখে বলে, ‘আরও পড়ত, দুয়ারে সরকারটা যদি জানুয়ারীতেই হত। পিছিয়ে গিয়েই মুস্কিল হয়েছে। এরা আগে ভাগেই সব পাশবই রিনিউ করিয়ে বসে আছে।’
অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছবি তুলে, দুটো শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গ্রামের ছোট্ট নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে সেন্টারে পড়েছে, আসতে জিভ বেরিয়ে গেছে আমাদের। সরু ঢালাই রাস্তা দিয়ে কোনমতে গাড়ি নিয়ে এসেছে আমাদের উত্তমকুমার। এসে থেকে জনে জনে শুধিয়ে বেড়াচ্ছে, বের হবার অন্য কোন রাস্তা আছে কি না, ঐ রাস্তায় আবার গাড়ি ঢোকাতে হলেই চিত্তির।
ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখি, গাছের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে আমাদের নিঃসঙ্গ গাড়িটা, উত্তমকুমার বেপাত্তা। আমার কোন হেলদোল নেই, ইন্সপেক্টর সাহেব ক্রমেই হয়ে উঠছে অধৈর্য। আমাকে বিদায় করার কি উদগ্র বাসনা মাইরি। তিনবার ফোন করে ফেলল, এর মধ্যে। একটি বারও বাজল না ফোনটা। বাজবে কি করে, প্রথমতঃ উত্তমকুমার তাঁর মহার্ঘ ফোনটি গাড়িতে রেখেই বেরিয়েছেন আর দ্বিতীয়তঃ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারো ফোনে কোন টাওয়ার নেই। মাঝে মাঝে চপলার মত ঝিলিক মারছে দুটি টাওয়ারের দাঁড়ি। তাতে ফোন যায়ও না আর আসেও না।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল, উঠে বার কয়েক হর্ন বাজাতে না বাজাতেই উদয় হলেন উত্তমকুমার। জানতাম, গাড়ি খোলা রেখে গেছে তো হর্নের আওয়াজে ছুটে আসবেই। আসতে না আসতেই চড়াও হল ইন্সপেক্টর সাহেব, ‘ম্যাডমকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?’ রাস্তা দেখতে গিয়েছিল উত্তম। কোন দিশা পায়নি, আবার সেই সরু ঢালাই রাস্তা, আবার সেই নড়বড়ে সেতু-। এবারের গন্তব্য রাণীহাটি প্রাইমারি স্কুল। বললাম, ওখানকার ইন্সপেক্টরকে একবার ফোন করি, উত্তমকুমার শুনলে তো। ‘আপনি বসুন না, আমি ঠিক চলে যাব।’
হাইরোডে এসে উঠলাম আমরা, আবার বললাম, একবার ফোন করি রে বাপ। নাঃ উত্তমকুমার সব চেনে। যখন বলবে তখন ফোন করতে হবে। যদি বলে, তবেই গুগল ম্যাপ অন করতে হবে লতুবা নয়। ফাঁকা হাইওয়ে, দুদিকে ঘন সবুজ ধান জমি, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ‘ঐ ধান ক্ষেতে আপনি যেতে পারবেননি ম্যাডাম,’ বলল উত্তম। কচি ধানগাছের পাতা নাকি ব্লেড-ছুরির মত ধারালো হয়। উত্তমদের আছে একফালি জমি, সেখানে ওর বাবা ধান বোয়। ‘বাবাই সব করে ম্যাডাম, আমরা ঐ ধান মাড়াইতে যাই। গেলে কি ব্যথা হয় ম্যাডাম গায়ে, জানেন নি। ইদিকে আর ধান জমি পাবেননি, জমি থাকলেই সব ঝিল হয়ে যায়। আমাদেরও কত বলেতেছে লোকে,টাকা লিয়ে এইছে। বাবা রাজি হয়নি। একটা জল জমি আছে, মানে নীচু জমি বুজলেননি, ঐ তে বছরের ধানটা হয়ে যায় ম্যাডাম। সারা বচ্ছর আমাদের ভাত আর মুড়ির ব্যবস্থা টুকুন হই যায়।’
ধান চাষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে করতে যেখানে এসে থামলাম জনমানবশূন্য। ‘এবার ইন্সপেক্টর সাহেবকে ফোন করুন’-হুকুম করে উত্তম। করে কি বলব?তেপান্তরের মাঠে এনে ছেড়ে দিয়েছে উত্তমকুমার, তুমি এসে উদ্ধার করো? কোথায় আছি জিজ্ঞাসা করলে কি বলব রে বাপ? যাই হোক তাও করলাম, ইন্সপেক্টর সাহেবও তেমনি, বলল,‘এগিয়ে আসুন।’ কোনদিকে এগোব, সামনে না পিছনে? এতো দিকশূণ্যপুর। বিস্তারিত কথাবার্তা এবং অতিকষ্টে হদিস পাওয়া এক সাইকেল আরোহীকে পাকড়াও করে আমরা বুঝলাম আমরা সম্পূর্ণ উল্টোদিকে এগোচ্ছিলাম। আমাদের যেতে হবে প্রতাপপুরের মোড়। তা আরো কিলোমিটার পাঁচ দশেক তো হবেই।
গাড়ি ঘুরিয়ে পুনরায় আমরা ফিরে গেলাম ধান চাষের বিশদ ব্যাখ্যায়। চাষ শেষে ধান যখন বস্তায় উঠছে, গাড়ি এসে প্রতাপপুরের মোড়ে এসে দাঁড়াল। উত্তম বলল,‘ভীম দেখবেননি ম্যাডাম?’ ভীম অর্থাৎ মধ্যম পাণ্ডব হলেন এই জেলার অন্যতম আরাধ্য দেবতা। ভীম একাদশীর দিন শুধু যে বড় করে ভীম পুজো হয় তাই নয়, মেলাও বসে বিভিন্ন এলাকায়। আত্মীয় কুটুম্বরাও আসে। উত্তমকুমারদের বাড়িতেই নাকি গিজগিজ করছে কুটুম্বদের দল।
প্রসাদগুণ অনুসারে সবথেকে জাগ্রত হল নন্দকুমার ব্লকের অন্তর্গত ব্যবত্তার ভীম,তারপর আসে তমলুক ব্লকের নিমতৌড়ির ভীম,শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকে উত্তমদের গ্রামের ভীম ইত্যাদি। ইনি অবশ্য অমন জমকালো বা কুলীন ভীম নন। এণাকে কেন্দ্র করে বসেনি কোন মেলা, তবুও ভীম তো রে বাবা। আমার দেখা প্রথম ভীম। হোক না বাজারের ভিতর একচালা পাকা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ভীম। ভদ্রলোককে কিন্তু হেব্বি মিষ্টি দেখতে যাই বলেন। আমার দেখা প্রথম ভীম বলে কথা-
No comments:
Post a Comment