একটা গরম সিঙারা, একটা নিমকি, একটা মোতিচুরের লাড্ডু, দুটো সন্দেশ আর এক বড় কাঁচের গ্লাস ভর্তি মাজা। আমাকে নাকি খেতেই হবে। ঘড়ি বলছে সাড়ে বারোটা, বাইরে রূপোর থালার মত চকচকে চোখ ধাঁধানো রোদ। বাড়ির ভেতরটা অবশ্যি খুব ঠাণ্ডা। আজ দুয়ারে সরকারের দ্বিতীয় দিন।কোলাঘাট হয়ে এসেছিলাম শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে।প্রতিদিন প্রতিটা ব্লকে দুটো করে ক্যাম্প হচ্ছে, বিভিন্ন পঞ্চায়েতে। মাতঙ্গিণী ব্লকের দ্বিতীয় ক্যাম্পটা যে স্কুলে পড়েছে, আমাদের উত্তম কুমার নাকি ঐ স্কুলেরই ছাত্র।
স্কুল থেকে বেরোতেই উত্তম ঘোষণা করল, ‘বাড়ি চলুন ম্যাডাম।’ এই ঘোরতর মধ্যাহ্নে কোন গেরস্তর বাড়ি গিয়ে তাঁদের বিব্রত করতে আমি মোটেই ইচ্ছুক নই, কিন্তু গাড়ির স্টিয়ারিং কি আর আমার হাতে। গ্রামের মধ্যে খালের ধারে, গাড়ি দাঁড়াল। বাকি পথটুকু পদব্রজে যেতে হবে বলে সংকুচিত বোধ করছিল উত্তম, বাকি পথ বলতে একটা না দুটো বাড়ি। সব বাড়ির সামনে ছোটখাট সব্জি বাগান, ধরে আছে থোকা থোকা কাঁচা টমেটো। ফুলের গাছও প্রচুর। হরেক রকম গোলাপ গাছের টবে শোভা পাচ্ছে এত্ত বড় বড় হরেক রঙের গোলাপ।
দরজার কড়া নাড়তেই শোনা গেল কচি গলার প্রবল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। ‘বাবা এসেছে, বাবা এসেছে।’ অচীরেই বুঝলাম, বাবার থেকেও বড় কথা, ‘ফোন এসেছে। ফোন এসেছে।’ বক্তার বয়স মাত্র চার, প্রায়শই তাঁর গপ্প শোনায় তার বাবা। বলে,‘উরি বাপরে ম্যাডাম, কি দুষ্টু, কি দুষ্টু। কারো বাড়িতে লিয়ে যাই না আমরা ওকে, বাচ্ছা মানুষ, কি টানবে, কি ফেলবে। দরকার নেই বাপ, বড় হোক আগে।’ আমি এও জানি, এহেন দস্যু রত্নাকর জব্দ শুধু ফোনের কাছে। ফোন দিয়ে দিলেই, পশ্চিম সীমান্তে নেমে আসে অখণ্ড শান্তি। প্রত্যক্ষ করলামও তাই। অসময়ে বাবা বাড়ি ফেরার প্রাথমিক উত্তেজনা টুকু কাটতেই তিনি একটা চেয়ার দখল করে বসে গেছেন ফোন ঘাঁটতে।
উত্তমের মা এত আনন্দিত আমাকে পেয়ে, যে কিছুতেই জুতো খুলতে দেবেন না। ওণাদের নিকানো চকচকে লাল সিমেন্টের দালানে জুতো পরেই ঢুকতে হল আমায়। খোলার চেষ্টা করেছিলাম ধর্মাবতার কিন্তু পর্যায়ক্রমে উত্তমকুমার এবং তাঁর পিতামাতার যুগপৎ তথা সম্মিলিত আপত্তিতে আবার বকলেস লাগিয়ে নিলাম।
উত্তমের মুখে শুনেছিলাম, ওদের একফালি জমিতে সম্বৎসরের ধান চাষ করেন ওর বাবা। আর সেই ধান সিদ্ধ করা থেকে বাকি সব কাজ করেন ওর মা আর বউ। বউটি বাচ্ছা মেয়ে, তার ওপর চার বছরের দুর্ধর্ষ ছানার জননী, সে যতটা পারে শাশুড়ীর সঙ্গে হাত লাগায়, তবে মূল কাজটা ওর মা’ই করেন। সে কথা বলেই প্রমাদ গুনলাম, উত্তমের মা আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল দোতলায়। এবারেও প্রবল আপত্তি ছিল জুতো খোলায়, আমি আর গ্রাহ্য করতে পারিনি।
লাল চকচকে সিমেন্টের সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় লাল সিমেন্টের দালান। উত্তমের মা আমাকে জবরদস্তি প্রতিটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, কোন ঘরে সপরিবারে উত্তম থাকে, কোন ঘরটা ওর ভাইয়ের। উনি বললেন,‘বড় কচি আর ছোট কচি।’এই জেলায় শিশুদের কচি বলে সম্বোধন করা হয়। তুত্তুরীকে যেমন বাংলোয় কাজে আসা মাসিরা কচি বলে ডাকে। ঘরদোর অগোছাল বলে বারংবার দুঃখ করছিলেন ভদ্রমহিলা, আশ্বস্ত করলাম,এ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আমি স্বয়ং চূড়ান্ত অগোছাল এবং অলবড্ডে প্রকৃতির। তুত্তুরী তো আরেক কাটি সরেস।
ঝাড়াই ধানের বস্তার পাহাড় দেখলাম। উত্তম এবং তার জননী জানালো এটা অর্ধেক কেবল। বাকি ইতিমধ্যেই উদরস্থ হয়েছে। উত্তমের মা খুশি হয়ে বললেন,‘দাঁড়াও এবার ধান উঠুক, আপনাকে পাঠায়ে দিব।’ নীচের বাগানে চটের বস্তায় ধান শুকাচ্ছে, দেখতে নিয়ে গিয়ে জানালেন, ‘এই গুলা দিয়ে মুড়ি ভাজা হবে। তাই সিদ্ধ করে নুনাইছে।’ নুনাইছে মানে বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম। আমার ধারণা ছিল ভাতের আর মুড়ির চাল আলাদা গোত্রের হয়, উত্তমের মা আর বউ তো হেসেই খুন। বউটি বুঝিয়ে দিল, একই চাল দিয়ে সব হয়, তবে সিদ্ধ করার ধরণ আলাদা হয়। আর নুনাইছে মানে নুন মাখানো হয়েছে। নুন মাখিয়ে রোদে শুকানোকেই নুনাইছে বলে।
অতঃপর উত্তমের মায়ের সঙ্গে ওদের ঠাকুর ঘর দেখে, বললাম এবার উঠি। বলার সাথে সাথেই সমানে এনে রাখা হল, এত্ত কিছু। খেতেই হবে, না খেলে গেরস্থের অকল্যাণ হবে। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আমিও তো সাড়ে দশটায় ভাত খেয়েই বেরিয়েছি দিদি। সে কথা কে শোনে। ভদ্রমহিলা এবং তাঁর লক্ষ্মীমন্ত পুত্রবধূ একসাথে বললেন,‘আমরা মানুষ খুব ভালোবাসি, যখন ইচ্ছে আসবেন। ঘরের চালের ভাত আর ভাজা মুড়ি সবসময় পাবেন।’ এগুলো না বললেও বুঝতেই পারছিলাম এণারা কতটা অতিথি বৎসল। তবুও এত খাবার উদরস্থ করা অসম্ভব। মার্জনা চেয়ে শুধু সিঙারাটা তুলে নিলাম। হাঁ হাঁ করে উঠল উত্তমের মা,‘লাড্ডুটা আমার গোপালের প্রসাদ। ওটা খেতেই হবে। নাহলে খুব বকব। আর শোনো এই সন্দেশ দুটোও তুমি খুব খেতে পারবে, দেখো না। আর ঐ নিমকিটাও-’।
হাসব না কাঁদব বুঝলাম না। পলকের আলাপে আমায় এত ভালোবেসে ফেলেছেন যে প্রথম আলাপের ‘ম্যাডাম আপনি’র সম্ভ্রম কখন যেন বাতাসে মিশে গেছে। এত ভালোবাসায় আমি আপ্লুত, কিন্তু তাহলেও এত খেতে পারব না দিদি। অনেক অনুনয় বিনয় করে ছুটি তো পেলাম, কথা দিয়ে আসতে হল, অচীরেই আবার যেতে হবে এবং এবার ভাত খেতেই হবে। ভাত না খাওয়ালে কি আর অতিথিকে যথোচিত আপ্যায়ন করা হয়? কারা যেন বলে, এপার বাংলার মানুষ অতিথি আপ্যায়ন জানে না, প্লিজ একবার মেদিনীপুরে আসুন দিকি।
পুনশ্চঃ-ছবিতে উত্তমকুমারদের গাঁয়ের ভীম। উত্তম বলে ভীষণ জাগ্রত। ভীম একাদশীর দিন থেকে নাকি দিন সাতেক এর মেলাও বসে ।
No comments:
Post a Comment