#HappyWomensDay2022 #তাম্রলিপ্তকড়চা
আজ যা হল, তা আমার এত বছরের সরকারী কর্মজীবনে কখনও হয়নি। বেলা তখন কত, একটা, খুব জোর দেড়টা হবে। কি যেন কাজ করছিলাম, কারা যেন দেখা করতে এসেছিল- হঠাৎ করে অতিরিক্ত জেলা শাসক ম্যাডামের ফোন,‘ আপনি কি অফিসে? সেমিনার হলে মিটিং চলছে, একবার আসতে পারবেন?’ খাতাপত্র গুছিয়ে, চোখে চশমা এঁটে রওণা দিলাম, যাবার আগে আমার টিমকে বলে গেলাম, দাঁড়াও আমার ভাগের বকাটা খেয়ে আসি,তারপর খুব বকব সবকটাকে।
মস্ত সেমিনার হল, জমিয়ে চলছে মাসিক উন্নয়নের মিটিং। জেলার প্রতিটি প্রান্ত থেকে বিডিও সাহেবেরা এসেছেন, এসেছেন জেলার হোমরাচোমরা অফিসার কুল। উঁচু মঞ্চে বসে আছেন ডিএম সাহেব, পাশাপাশি এডিএম স্যার এবং ম্যাডামেরা, আছেন তিনজন মহকুমা শাসকও। অনুপস্থিত কেবল আমার ব্যক্তিগত মহকুমা শাসকটাই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক পারিবারিক বিপর্যয়ের জন্য আপাততঃ ভাগ করে অফিস করছি আমরা। আজ যেমন আমি তমলুক, আর শৌভিক মহানগর।
দুয়ারে সরকারের ফলাফল নিয়ে গম্ভীর ভাবে কি যেন বলছেন ডিএম সাহেব। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে পোস্টানো আজকের মিটিং এর অর্ডারটা আবার ভালো করে পড়লাম, নাঃ লেবার তো নেই আজ। তাহলে? যাই হোক, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, মুস্কিল হল আমার নিজের মহকুমার রিপোর্টটুকু আমার ঠোঁটস্থ, জেলার রিপোর্ট তো নয়। হে ঠাকুর দয়া করে পোর্টালটা খুলিয়ে দাও।
কি ভাগ্যি আমার বড় সাহেবের আইডি পাসওয়ার্ডটা কি কারণে যেন দিয়েছিলেন স্যার কিছুদিন আগে, তাই দিয়ে ঢুকে ডাউনলোড করতে দিলাম রিপোর্ট। একটা নয় দু- দুই খান এক্সেল, তাও এই ঘোর কর্মব্যস্ত সময়ে। একি আর আজ নামবে? হে মা বর্গভীমা, হে বাবা ব্যবত্তার ভীম, হে মা নাচিন্দা নামিয়ে দাও মা। আরও কারো নাম কি দেখেছি কোন রিক্সা বা টোটোর গায়ে, মনে করতে পারলাম না। যাই হোক, এই সব দেবদেবীদের ত্র্যহস্পর্শে অবশেষে নামল রিপোর্ট। টুকেও নিলাম খাতায়। ভালো করে মুখস্থও করে নিলাম। ডিএম সাহেব প্রশ্ন করলেই এমন ধ্যাড়াই আমি। এত তোতলাতে থাকি,যে ওণার নির্ঘাত মনে হয়, ব্যাটা এক নম্বরের ফাঁকিবাজ।
সব তথ্য জলের মত মুখস্থ করে, শতকরা কষে, গ্রাফ এঁকে যখন রেডি করেছি, একগাদা ফুল আর ব্যাগে করে কি সব যেন এসে ঢুকল মিটিং হলে। এই রে, কলকাতা থেকে নির্ঘাত কোন বড় সাহেব এসেছেন। রাজ্যের রিপোর্টটাও নির্ঘাত লাগবে। মেল খুলে তড়িঘড়ি সেটা খুঁজতেই যাচ্ছিলাম এমন সময় বোমা ফাটালেন ডিএম সাহেব, ‘আজ বিশ্ব নারী দিবস, আসুন আমরা সম্মান জানাই আমাদের লেডি অফিসারদের।’ সম্মানই বটে, ফুল-চকলেট তো ছিলই, তার সাথে ছিল, ‘মন কি বাত।’ ধুর আকাশবাণীর মন কি বাত নয়,আমাদের ঘরোয়া মনের কথা।
ডিএম সাহেব শুনলেন প্রতিটি মহিলা অফিসারদের অনুভব এবং অভিজ্ঞতা। শুধু মেয়েরাই নয়, পুরুষ অফিসাররাও ভাগ করে নিলেন তাঁদের মনোভাব। কি ভাবেন তাঁরা নারী তথা নারী দিবস নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল এক মহিলা অফিসার থেকে আরেক মহিলা অফিসার, জানতাম আমার পালা আসবেই, কি বলি! সবই তো বলে দিয়েছেন আমার পূর্বসুরীরা, ছুঁয়ে গেছেন কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে শিশু নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য থেকে যৌন হয়রানি হয়ে পণপ্রথা। আর বাকি রইল কি?
সেটাই বললাম, আর বললাম যে অনেক শিক্ষা দিয়েছি আমরা আমাদের মেয়েদের, এবার একটু ছেলেগুলোকে মানুষ করার সময়। ছোট স্কার্ট পরাটা সমস্যা নয়, সমস্যা স্কার্টটাকে ছোট করে দেখাটা। আর এই শিক্ষা কে দিতে পারে বলুন তো, দিতে পারে কেবল একজন নারী। উঁহু যে সে নারী নয়, সেই নারী, যিনি শেখান শিশুকে তার প্রথম পাঠ, যাঁকে আমরা মা বলে এক ডাকে চিনি। মায়েরা যত শিক্ষিত হবে, ততো শিক্ষিত হবে আমাদের ছেলেরা। মায়েরা যত সবলা হবে, ততো সবল হবে আমাদের সমাজ। তারপর আবার এমন ভাবে একদিন সমবেত হব আমরা, ‘লিঙ্গ নিরপেক্ষ দিবস’ পালনে।
বাড়ি ফিরে আজকে পাওয়া সমস্ত উপহার তুলে দিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীর হাতে। আর জনৈক রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য কোট করে বললাম, ‘জগৎটা তোমাদের, জগৎটা আমাদেরও। কিন্তু তোমরা হলে সকাল বেলা আটটা নটার সূর্য।’ আমি যতই বলি, খবরদার লক্ষ্মী মেয়ে হোস না বাবু, লক্ষ্মী বাঈরা কোনদিন লক্ষ্মী মেয়ে হয় না।
No comments:
Post a Comment