Tuesday 21 September 2021

অনির ডাইরি ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২১

 


গাঙ্গেয় বঙ্গের খাওয়া-দাওয়ার সাথে যে মেদিনীপুরের খাবার তথা রন্ধনশৈলীর বেশ খানিকটা ফারাক আছে, তা আমাদের সাড়ে চার বছর পশ্চিম মেদিনীপুর বাসের সময়ই বেশ স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল। গাঙ্গেয় বঙ্গ বলতে অনুগ্রহ করে মহানাগরিক উন্নাসিকতা ভাববেন না আবার। আমি মোটেই মহানাগরিক নই, আমি হাওড়ার মেয়ে এবং তার জন্য অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। আসলে আমি হাওড়া এবং মুর্শিদাবাদ জিলার সঙ্কর উৎপাদন। জননীর দৌলতে আমার হেঁসেলে হাওড়াকে কোঁৎকা মেরে মুর্শিদাবাদই বিজয়ী।  পেঁপে পোস্ত বা ঝিঙে দিয়ে ডিমের ঝোল বা রসুন দিয়ে পোস্তর বড়া এসবের আস্বাদই পেতাম না যদি না জীবনের প্রথম পোস্টিং খড়্গপুর হত। 


মেদিনীপুরের আরো একখান বৈশিষ্ট্য আছে, যা কেবল আমাদের মত বদলীর চাকরীওয়ালা সরকারী লোকজনই জানে, তা হল, ‘একবার মেদিনীপুর তো বারবার মেদিনীপুর। ’ আমার প্রাণাধিকা সহচরী সুকন্যাকেই ধরুন, ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক হয়ে মেদিনীপুর, চাকরী বদলে সহশ্রম কমিশনার হয়ে ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম তখনও পশ্চিম মেদিনীপুরেরই অঙ্গ ছিল, যেই জেলা আলাদা হল, মহানগর থেকে বদলী হয়ে সু আবার গেল মেদিনীপুর। যাই হোক, ‘সু-চর্চা’ তো চলতেই পারে দিনরাত ধরে,  কিনা বড্ড গালাগাল খেতে হবে আবডালে। কাজেই ঐ প্রসঙ্গ থাকুক। তো যা বলছিলাম আর কি, মেদিনীপুর কানেকশন যে কতখানি অব্যর্থ তা প্রমাণ করে শৌভিকের আরেকবার পশ্চিম মেদিনীপুর হল না বটে, ঘুরে এসে পড়ল পূর্ব মেদিনীপুরে। এক্কেবারে আগ মার্কা মেদিনীপুর যারে কয়- 


সেই সত্তরের দশকের অন্তিমপর্বে শ্বশুরমশাইয়ের যখন বীরভূম পোস্টিং হয়েছিল, রন্ধনে দ্রৌপদী আমার স্বর্গীয়া দিদিশাশুড়ী যেভাবে কেঁদে আকুল হয়েছিলেন, তাঁর আদরের বাবলু(অর্থাৎ শ্বশুরমশাই) এ যাত্রা বোধহয় অভুক্তই মারা পড়বে ভেবে, ততোটা না হলেও বেশ খানিকটা কেঁদেছিলাম আমিও শৌভিকের বদলীর খবর পেয়ে। ‘হ্যাঁ গা, তুমি কি খাবে? কে তোমায় রেঁধে দেবে আমার মত করে-’। 


জবাব পাই, কেন সতী দেবী আছেন তো। সতীদেবীর নামটা বদলে দিলাম যদিও শুনলাম তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ তমলুকের মহকুমা শাসকদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তা বেশ। জানতে চাই, ‘হ্যাঁ গো, সতীদেবী রাঁধেন কেমন?’ জবাব আসে, মন্দ কি?ভালোই তো।  শৌভিকের এই জবাবে আমি মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারি না। শাশুড়ী মাতার সুপুত্তুরকে যাই বেড়ে দেবেন, তাই সোনামুখ করে খেয়ে নেন। নুন- মিষ্টি-ঝাল কম হলেও বলবে না। চাইবেও না। বাসি-পচা দিলেও বুঝবে না। মানতেও চাইবে না। তে-বাসটে রুটিও ভেজে দিলে পবিত্র করে খেয়ে নেবে, বরং ফেলে দিলেই চিল্লিয়ে মাৎ করবে- ‘খাবার নষ্ট করলি কেন?’ সবটুকুই অতসী দেবী থুড়ি শাশুড়ি মাতার অবদান তথা সুশিক্ষা। সাড়ে বারো বছরেও বিগড়াতে পারিনি তাঁর পুত্তুরকে। 


তমলুকে গিয়ে খেতে বসে দেখি পদ বেশ অনেকগুলিই। গরম ভাত-ডাল-কিছু একটা ভাজা-তরকারী এবং মাছ। শুনলাম রোজই নাকি এমনিই রান্নাবান্না করে দেন সতীদেবী। মানে যতক্ষণ  বাজার থাকে। বাজার আনার দায়িত্ব শৌভিকের ড্রাইভারের। যাই হোক, ডালটা আমাদের স্বাদের তুলনায় বা বলা চলে ভাতের ডালের হিসেবে বেশ মিষ্ট। মানতে বাধ্য হচ্ছি মিষ্টি মিষ্টি ডাল দিয়ে নোনতা নোনতা ভাজা মন্দ না। শুধু চিনতে পারলাম না,ভাজা বস্তুটা আদতে কি? শুনলাম কুঁদরি। রাতে রুটির সাথে আবার পেলাম কুঁদরি ভাজা। পর দিন আবার। পর রাতে আবার। যেদিন কুঁদরি অনুপস্থিত থাকেন,অর্থাৎ ফুরিয়ে যান, সেদিন পাত আলো করে থাকেন কাঁকরোল ভাজা। কটকটে বীজ সমেত চাকা চাকা কাঁকরোল ভাজা। 


শৌভিক দেখলাম অতীব যত্নে একটি একটি করে বীজ ছাড়িয়ে পাতের পাশে ছোট্ট টিলা বানাল। ঐ ভাবে খেতে না পারার জন্য, ‘তোরা না,অতি নিন্দুক’  শুনতে হয় তুত্তুরী আর আমাকে। একই বিশেষণে ভূষিত হই, পোস্তকে না চিনতে পারার গর্হিত অপরাধে। পোস্তই বলুন বা সর্ষে ভালো করে বাটলে যে তা আটা বা ময়দা গোলার মত খেতে হয় তাও অাবিষ্কার করলাম। এহেন সর্ষে বাটা দিয়ে মাছ খেয়ে শৌভিক অনুরোধ করে, ‘ওকে একটু কালো জিরে-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাছটা শিখিয়ে দিয়ে যাস তো।’ তা শেখাই। বাধ্য ছাত্রীর মত, তিনি শেখেনও। তবুও শাশুড়ী মা ছাড়ুন এমনকি আমার হাতেরও সোয়াদও তো আসে না। যেমন রসুনের গন্ধ না ছড়িয়ে মাখামাখা লালচে ডিমের ঝোল রাঁধতে শেখালাম, তিনি দিলেন তাতে চিনির কৌটো উল্টিয়ে, ‘কচি খাবেনি!’ কচি অর্থাৎ ছিমতী তুত্তুরী, তাঁর যদি ঝাল লাগে-। রান্নার তরিকা বা সোয়াদে হেরফের থাকতেই পারে আবেগের ভাষা তো জেলা ভেদে একই। 


যাই হোক সতী দেবী বা পলাশ ড্রাইভারের চব্য পরে হবে, কি ভাবে তাঁরা আমাদের সোমরা( পড়ুন পাঁচফোড়ন) দিয়ে বীচে কলা আর বেগুনের ঘন্ট খাইয়ে মোহিত করেছিলেন বা ঘন দুধ আর সামান্য আদা দেওয়া নারকেলের মিষ্টি খাইয়ে আমাদের হৃদয় হরণ করেছিলেন, কি ভাবে তাঁরা আমাদের থোড়-বেগুনের ঘন্ট তথা আরো কি কি খাওয়াবার ভয় দেখিয়েছিলেন সে চব্য পরে হবে খন, আপাততঃ ফিরে যাই মাননীয় মহকুমা শাসকের কাছে।  


বৎসরান্তে জন্মদিন তো একবারই আসে, এ তো আর আমাদের বিয়ে নয় যে ঘুরে ফিরে দুবার আসবে, আর যাঁর জন্মদিন তাঁকে ছাড়া চলে কি করে? ঐ দিনটিতে শুধু আসুক, তারপর না হয় আর সারা মাস কোন আব্দার করব না আমরা। (চলবে?)

No comments:

Post a Comment