Tuesday 21 September 2021

ইতি অনিন্দিতা

 তাম্রলিপ্ত,         সোমবার, ৫ই আশ্বিন, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ


প্রিয় এষা,

তুমি কি জানো, যে গতকাল রাতে শ্রীমতী তুত্তুরী, তোমার আদরের কুট্টুসকে মখমলি চিকেন চাখিয়েছে? ‘মখমলি চিকেন’ বলতে বুঝলে না তো?  ঐ যে তোমার দাদা, লাল টমেটো না হলদে খরগোশ, কোথা থেকে যেন যেটা আনিয়েছিল।  যাদের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ডেলিভারি করতে বলা হয়েছিল আর রাত পৌনে নটার সময় তাদের ডেলিভারি কাকু তার মান্ধাতার আমলের সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এক প্যাকেট ভর্তি কি সব নিয়ে এসেছিল। কি প্রচণ্ড ক্ষেপেছিল শৌভিক। রেগে গিয়ে গোঁ ধরেই বসেছিল, লোকটা এলে, খাবারের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দেবে। মূল্য দূরস্থান, এমনকি ডেলিভারি চার্জটাও দেবে না। নেহাৎ আমি নিজেই পেশায় গায়েগতরে খেটে খাওয়া শ্রমিক,তাই অনেক বলে কয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করেছিলাম।


তবে তীব্র কেওড়া গন্ধী মাংসটা চাখার পর, মনে হয়েছিল শৌভিককে না আটকালেই ভালো করতাম। তুত্তুরী বলল,এমনকি শ্রীমান কুট্টুসও নাকি বার তিনেক ঘুরে, ঘুরে এসে শুধুই শুঁকেছিল,হয়তো শুঁকে বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছিল, এই মালটা আসলে কি! তুত্তুরীর বয়ান অনুসারে শেষমেশ অবশ্যি পেটে চালান করে। বিগত তিন বেলায়, তুত্তুরী দিদি তার কুট্টুস ভাইয়ের আরও যে এমনি কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আমার ধারণা ধীরে ধীরে জানতে পারব আমরা। ক্রমশঃ প্রকাশ্য ব্যাপারস্যাপার আর কি- 


রবিবার ভোর ভোর তোমরা যখন বেরোলে দেবী বর্গভীমা সন্দর্শনে, শ্রীমতী তুত্তুরী স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নিল, তোমাদের অনুপস্থিতিতে কুট্টু বাবুর রক্ষণাবেক্ষণের ভার। সেই মোতাবেক ঢাকঢোল পিটিয়ে শ্রীমান কুট্টুসকে নিয়ে গেল ছাতে পায়চারি করতে, যাতে সেই মওকায় গাড়িতে সওয়ার হয়ে কেটে পড়তে পারো তোমরা দোঁহে। কুট্টু বাবু চতুষ্পদী হলেও এতই কি বোকা রে ভাই? যেই অর্জুন গাড়ির দরজা খুলেছে, তিনতলার ছাত থেকে তুত্তুরীর হাত ছাড়িয়ে হুড়মুড় করে দৌড়ে এল কুট্টুস বাবু। অবোলা জীব হলেও তোমাদের এক ঝলক দেখার জন্য ওর আর্তি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমরা। তুত্তুরীর প্রবল চিৎকারে সচকিত হয়ে আপ্রাণ শক্তিতে বাইরের দরজাটা চেপে ধরেছিলাম যে আমি-। যেই তোমাদের তুলে পলাশের গাড়ির চাকা গড়াল, দরজার হাতল ছাড়লাম আমি, ওমনি বুলেটের মত ছুট্টে বেরিয়ে এল কুট্টুস। তারপর খানিক গোল গোল করে ঘুরল গাড়ি বারন্দার নীচে, বোধহয় তোমাদের গায়ের গন্ধ শুঁকল আর দৌড়ল গাড়ির পিছন পিছন।প্রহরারত সিভিক ভলান্টিয়ার ছেলেটির এমনিতেই সারমেয় ভীতি আছে, কুট্টুসের ঐ দৌড় দেখে সে তো একলাফে পগার পার। ভাগ্যে শ্রীমতী তুত্তুরী ছিল, রীতিমত জাপটে ধরে, পরম স্নেহে  ‘ঘরে চল না। আসবে, আসবে এখুনি এষা পিসিরা ফিরে আসবে’ বলতে বলতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল কুট্টু বাবুকে।  দুজনের সম্পর্কের বাঁধুনিটা কখন যে আমাদের অসাক্ষাতে এত জবরদস্ত হয়ে উঠেছে, তাই বোধহয়, তুত্তুরীদিদির সাথে শোবে বলে গতরাতে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন শ্রীমান কুট্টুস। 


কি ভালো নামে চেনে ও তোমাদের। চেনে তুত্তুরীকেও। এমনিতে শ্রীমান কুট্টুস বাস্তবিকই শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে,তবে সাময়িক ভাবে ওকে ত্যাগ করার ক্ষোভেই বোধহয় সেদিন পাগলের মত বাগানে ছোটাছুটি করছিল আর ঘাস চিবাচ্চিল।তুত্তুরী তো বেশ কয়েকবার বলেই ফেলল, 'ওরে, তুই ছাগল নস। তুই হলি কুতুয়া। কুতুয়ারা ঘাস খায় না।' 


শেষমেশ শৌভিক ঘাড় ধরে এনে বারন্দার গ্রীলে বেঁধে রাখল কিয়ৎক্ষণ। তখন অবশ্যি দিব্যি ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পারার মত মুখ করে বসেছিল। দিব্যি পোজও দিল ভালো মানুষের মত মুখ করে। তারপর আমায় দেখে সটান উঠতে চাইল আমার কোলে। জানে আমি ভয় পাই। কোলে নিতে না পারার অপরাধবোধেই খানিক প্রজাপতি বিস্কুট দিয়েছিলাম খেতে। বেশী না একটা ছোট্ট টুকরো, সেটা কুট্টুস খায়ও নি। অথচ যখন বমি করল, তখন সটান দাদা আর তুত্তুরী আমার ওপর চড়াও হল, আমার দেওয়া বিস্কুটের জন্যই নাকি কুট্টুস বমি করেছে। ঘাস খাওয়া বা তোমাদের ওপর আক্রোশ বশতঃ নয়। তোমাদের ওপর এত আক্রোশ, অথচ যেই তোমরা ফিরে এলে, ওমনি কেমন ভালো ছেলের মত,তোমার পায়ের কাছে শুয়ে তোমার পদযুগল আঁকড়ে ধরল, যাতে আর না ছেড়ে যেতে পারো ওকে। মায়া কিছু কাড়াতে পারে বটে তোমাদের কুট্টুস বাবু। 


যাই হোক, যে কথা বলার জন্য এত্ত বড় প্রস্তাবনা,  তা হল, আশা করি তোমার মনে আছে, গতকাল রাতে শ্রীমান কুট্টুসের নৈশভোজ দেখে আমি হুমকি দিচ্ছিলাম, এবার থেকে যাদের প্রতি আমার প্রেম উছলিয়া উঠবে তাদের ডেকে কুট্টু ভোজ খাওয়াব- আহাঃ কি অনুপমই হবে সে ভোজ।তৈলহীন, লবণ বিহীন মাংসের খিচুড়ির সাথে সীতা ভোগ আর রসোগোল্লার চটকানি। সমগ্র ব্যাপারখানা পর্যবেক্ষণ করে, আমাদেরই ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছিল,আর ও তো বেচারী নেহাৎ পুঁচকে ছানা। 


আজ এদিকে উপুর্যান্তে বৃষ্টি পড়ছে, নৈশভোজ বলতে রুটি গতকাল রাতে তোমাদের জন্য রান্না করা সতীদেবীর মাংস থুড়ি সতীদেবীর রান্না করা মুর্গির মাংস। অথচ ঝুপঝুপে বৃষ্টি আর ঝোড়ো শীতল হাওয়ার এমন রাত কি জমে খিচুড়ি ছাড়া। যথারীতি রান্না করতে গিয়ে দেখি সবকিছুই বাড়ন্ত। তখন মনে পড়ল কুট্টুস ভোজের কথা। শুকনো খোলায় হাল্কা করে ভাজা মুগ ডাল(সোনা নয়, ইমিটেশন মুগ) আর সুফল বাংলার সিদ্ধ চাল, পরিমাণ মত লবণ আর হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে, তার সাথে মিশিয়েছি সতীদেবীর মাংস থুড়ি রান্না করা মুর্গির মাংস। মেশানোর আগে আলাদা কড়ায় ফুটিয়ে ফুটিয়ে বেশ ঘন তথা থকথকে বানিয়ে নিয়েছিলাম দুচার টুকরো আলু সমেত মাংটাকে। চুপি চুপি বলি, শনিবার রাতে রান্না করা পনীরের কয়েকটা টুকরো লুকিয়েছিল ফ্রীজের কোন গহীন কোণায়, তাদেরও মিশিয়ে দিয়েছি কুট্টু ভোজে। সব  মিলেমিশে, সিদ্ধ হবার মিলিয়ে নিয়েছি শুধু নুন আর মিষ্টির ভারসাম্যটুকু। আর ছড়িয়েছি পর্যাপ্ত ঘি-গরম মশলা। আমাদের তো আর কুট্টু বাবুর মত লোম ঝরে যাওয়ার ভয় নেই। বিশ্বাস করো খেতে জব্বর হয়েছিল। গতকাল রাতে এই নিয়ে তোমার আর অর্জুনের খিল্লী করার জন্য যৎপরনাস্তি দুঃখিত মাইরি। কুট্টুসের খাবারটা মোটেই খুব খারাপ নয়। 


পুনশ্চঃ- ডেজার্টে ছিল অর্জুনের আনা সীতাভোগ। যা দোকান চেঁচে মাত্র চারশগ্রাম আনতে পেরেছে বলে দুঃখে অর্জুনের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল, অথচ তোমরা কেউ চারচামচও খেয়ে আমায় উদ্ধার করোনি। আজ ফ্রিজ সাফ করতে গিয়ে সন্ধ্যা বেলায় তিনি এবং গোটা দুই পুঁটকে রসোগোল্লা উদ্ধার হয়।ঠান্ডা আলমারিতে রাত্রিবাসের দরুন সীতাভোগটা কেমন যেন ফাটা পায়ের মত দেখতে লাগছিল মাইরি।   কুট্টু ভোজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, মাইক্রোওয়েভ সেফ বোওলে পর্যায়ক্রমে ছানার পোলাও আর রস সমেত রসোগোল্লাদ্বয় মিশিয়ে ভালো করে ঘেঁটে দেড় থেকে দু মিনিট মাইক্রোওয়ভে ফুটিয়ে নিয়েছি। মন্দ হয়নি কিন্তু ব্যাপারটা। পরের বার এলে অবশ্যই খাওয়াব, শুধু তোমাদের। গতরাতে যাদের খাওয়াব মনস্থ করে লিস্টি বানিয়েছিলাম, তাদের আপ্যায়নের জন্য দেখছি অন্য রেসিপি খুঁজতে হবে। ইতিমধ্যে যদি তেমন কিছু তোমরা আবিষ্কার করো, তো অবশ্যই জানিও। যা দেখা তো দূর শুনলেই ক্ষুধামান্দ্য অবধারিত। 

 অনেক ভালোবাসা রইল,পারলে আবার এসো। জলদি জলদি। 


ইতি 

অনিন্দিতা(দি)

No comments:

Post a Comment