বর্ষার কলকাতা আর চুঁচুড়ার অকথ্য জ্যাম কাটিয়ে, একরাশ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আজ। পরশু এক হাঁটু জল ঠেলে বাড়ি ফিরে, এখনও বেদনা জর্জরিত প্রতিটি পেশী। সাঁতরে যে ফিরতে হয়নি, এই আমার বাবার ভাগ্যি। যে রাস্তার নামই ভি আই পি রোড,সে রাস্তায় এমন অসভ্যের মত জল জমে কেন কে জানে? আর আপদ জমা জল নামে নাই বা কেন? গত পরশুর বর্ষনের জলে আজও বানভাসি আমাদের এলাকা। আজ বা কাল যদি আরো বৃষ্টি হয়, আপিস যাব কি করে? আর আমার অনুপস্থিতিতে ঘুড়ি উৎসবই বা হবে কি করে?
কার যে নজর লাগল আমাদের ঘুড়ি উৎসবে। চুঁচুড়ায় তো আজ সারাদিন মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। চুঁচুড়া স্টেশনের কাছে পাক্কা এক হাঁটু জল। কত সাধ করে বুক করেছিলাম জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের মাঠটা। এটা ওদের অন্যতম সেরা মাঠ, আমাদের অনুরোধ ফেলতে না পেরে বিনি পয়সাতেই দিতে রাজি হয়েছেন ওণারা। প্রতি বছরই দেন, কিন্তু এই মাঠটা দেন না। বুক করতে গিয়ে রীতিমত জেরার মুখে পড়েছে আমাদের বিদ্যুৎ। ‘হ্যাঁ বাবা, তা তোমরা আবার বাঁশ-টাঁশ পুঁতবে না তো? মাইক কটা লাগবে বাবা?' ইত্যাদি প্রভৃতি। মাঠ ভর্তি কচি সবুজ ঘাস। ক্রিকেটের মরসুমে ফাঁকাই পাওয়া যায় না মাঠটা। পাছে গরু ঢুকে ক্রিজের ঘাস খেয়ে যায়, তাই রীতিমত তালাচাবি দিয়ে রাখেন ওণারা। আমাদের বেলাতেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমরা মাঠে ঢুকে গেলেই, তালা দিয়ে দেবেন প্রবেশ পথে। তাতে গরু আর উটকো লোক ঢুকতে পারবে না কেউই। শুনে হেসে বাঁচি না। তাহলে তো ঘুড়ির সাথে এডাল্ট ডাইপার ও দিতে হয় লোকজনকে। আমাদের সমীর তো বলেই রেখেছে, মাঠে এবার একাধিক জলের ড্রাম রাখতে। ফি বছর কটা ঘুড়ি ওড়ে আর কটা ঘুড়ি কাটা হয় জানি না বটে, তবে মাঠ জুড়ে প্রবল ছোটাছুটি করে জনগণ।
আর ভগবান না করুক কারো যদি ইয়ে মানে বড় বাইরে যেতে ইচ্ছে-টিচ্ছে করে? শুনেই চঞ্চল হয়ে ওঠে নির্মল, 'একটা টয়লেটওয়ালা মাঠ চান তাহলে ম্যাডাম'। 'টয়লেট ওয়ালা মাঠ' ব্যাপারটা কেমন যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা না? আমাদের সেই সাধের ঘন সবজে মাঠ, অন্যদিন যার মাথার ওপর নীল সাদা চাঁদোয়া টাঙায় আকাশ, নির্ঘাত আজ এক হাঁটু কাদায় ভরে গেছে। কাল যে কি হবে?
যা হয় হবে, আপাততঃ বাঙালীর নিজস্ব শ্রমদিবসের প্রাক্কালে সেজে উঠছে চুঁচুঁড়া শ্রম দপ্তর। দপ্তরের আবার সাজ কি মশাই? সরকারী আপিস মানেই তো সেই, হাতলভাঙা চেয়ার, সানমাইকা ওঠা টেবিল, চোকলা ওঠা কাঁচের গোল কাগজচাপা, পেনদানীতে রাখা কালি ফুরিয়ে যাওয়া পেন, যত্রতত্র ঝুলে থাকা ঝুল আর ধুলোপড়া দস্তাবেজের ডাঁই।
জোর গলায় বলতেই পারতাম, ওসব পাবেন না আমাদের দপ্তরে, পারব না শুধু একটাই কারণে, রদ্দি আর দস্তাবেজের ডাঁই কিছু কম নেই আমাদের আপিসে। কোথা থেকে যে রাতারাতি জড় হয়ে যায়, এত নথি আর কাগজ। যতই বলি, ফেলে দিন, ততই আঁকড়ে ধরে সবাই। ওরে বাপরেঃ সরকারী দস্তাবেজ, ইঁদুরে খাক তবু ভালো, একযুগের আগে বাতিল করা যায় নাকি? তাহলে গোছানো তো যায়? বিশেষতঃ এমন শুভ দিন যখন সমাগত?
বুড়ো অজিতদা প্রতিবারই বলেন বলল, “ও আমি একাই সব গুছিয়ে দেব ম্যাডাম। কোন চিন্তা নেই।” প্রতিবারই আমরা বলি, ও আপনার একার কম্ম নয়, শোনে কে? এবারে আর আপত্তি করেনি অজিত দা, সময় ক্রমশঃ থাবা বসাচ্ছে বৃদ্ধের দেহেও, ভারী জিনিস আর তেমন নড়াতে চড়াতে পারেন না আজকাল। আমাদের ধীমান, প্রিয়াঙ্কা,প্রীতি, সোমনাথ, সায়নী, রমেশ, শুভজিৎ, সমীর এরা আছে তো। লেবার আপিসে, আবার লেবারের অভাব? ভাগাভাগি করে সব হয়ে যাবে।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই অজিতদাকে ভ্যাকসিনের শেষ ডোজ আনতে পাঠিয়ে ঝাড়ু হাতে নেমে পড়েছিল পুরো চুঁচুড়া টিম। বাতিল ধুলো পড়া টেবিল চেয়ার, সবেধন নীলমণি গুটি কয়েক কম্পিউটার কে ঝকঝকে করে ঝেড়েমুছে বারান্দা বাগান থেকে গুচ্ছ খানেক টব নিয়ে এসে কেমন যেন পলকে ভোল বদলে ফেলল চেনা আপিসটা।
চাইলে আমরা কি না করতে পারি। দরকার শুধু সদিচ্ছা আর সামান্য ভালোবাসা। দিনের গরিষ্ঠাংশ যেখানে কাটাবেন, যাদের সাথে কাটাবেন, তাদেরকে যদি ভালো না বাসতে পারেন,বিশ্বাস না করতে পারেন, সেই জায়গাটাকে যদি আপন করে নিতে না পারেন, তাহলে জব স্যাটিসফ্যাকশন তো দূরের কথা, আপিসের নাম শুনলেই কান্না পাবে।
আপিসটাকে ভালোবাসি, তাই না, কিলো খানেক ধুলো ঘেঁটেছি আমরা। সুদিনের আশায়, তাই না যত্ন করে আল্পনা দিয়েছে আমাদের সিকেসিও প্রীতি আর এসএলও প্রিয়াঙ্কা। ডানা মেলে ওড়ার জন্য আমাদের ধীমান নিয়ে এসেছে নীল-গোলাপি ঘুড়ি। ছুটির ঘন্টা বাজতে না বাজতেই, দখল হয়ে গিয়েছে আমার চেম্বার, অজিতদার মুছে দেওয়া মাটিতে বাবু হয়ে বসে ঘপাঘপ্ ছাপ পড়েছে প্রতিটি ঘুড়ির বুকেপিঠে-। কেটে গিয়ে লাট খাবে যখন, উড়ে পড়বে কোন অচীন পাড়ায়, অথবা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালাবে কোন পথশিশু, যেন চোখে পড়ে, এই ঘুড়ির সত্ত্ব শুধুই চুঁচঁড়া শ্রমদপ্তরের। গোটা গোটা অক্ষরে ফুটে ওঠে বেগুনী বরণ “বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা-”। আর তাপ্পর? তারপর কত্ত কি- এখনও তো বাকি আমাদের সংগ্রামের দশকর্মার ফর্দ, ফুল, ফল, মিষ্টি। আপিসের ভাড়ার গাড়ি থেকে আমাদের ফটোকপিয়ার মেশিন হয়ে আধবুড়ো কম্পিউটার, এমনকি পোর্টালগুলো পূজিত হয় এই অফিসে। আহাঃ ওদের ভরসাতেই না চলে আমাদের দপ্তর। এক দিন না হয় একটু বেশীই খাতির করলাম ব্যাটাদের। চল বাবা, ধন্নুর নাহয় একটু জোরেই দৌড়লি।
এত আয়োজন, এত উদ্দীপনা কিন্তু চুঁচুড়ার মাথার ওপরে যে ঘনিয়ে এসেছে কৃষ্ণমেঘের চাঁদোয়া। বুড়ো কালেক্টরেটের পিচচট লাগানো ছাতের ওপর ঘুঙুর বেঁধে নেচেই চলেছে ভাদ্র মাসের বর্ষা, জেলা স্পোর্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে জমেছে এক হাঁটু জল আর প্যাচপ্যাচে কাদা। কি হবে এবার? দুয়ারে সরকারের অকথ্য পরিশ্রমের পর, সবে বইতে শুরু করেছিল খুশির হাওয়া, আমাদের আচ্ছে দিন কি সত্যিই আর আসবে না? যদি নাও আসে, যে দিন আসবে, তাকেই 'আচ্চে' বানিয়ে নেব আমরা।এটুকু বিশ্বাস আছে নিজের ওপর আর তার থেকেও অনেক অনেকটা বেশি নিজের টিমের ওপর।
No comments:
Post a Comment