Thursday, 9 September 2021

ইতি অনিন্দিতা।

 তাং- ২৪শে ভাদ্র, ১৪২৮


ইয়ে বলছি কি না,


কালকের কথা গুলো আজ কেমন যেন বাসি হয়ে যায়, না বলা কথা গুলো কিছুতেই আর বলা হয়ে ওঠে না নৈমিত্তিক ব্যস্ততার চাপে। কখনই তাল মিলিয়ে আসে না অবকাশ উভয়ের দ্বারে। কখনও পরিবৃত থাকো তুমি, তো পর মুহূর্তে একই গল্প শোনাই আমি। এত কাজ বাপের জন্মে করেছি? কান্না পায় মাঝেমাঝে। অথচ কিছুই যেন গুছিয়ে করে উঠতে পারি না, অগোছালোই থেকে যায় সবকিছু। কিছুই কেন যে তোমার মত পারি না আমি।


সকালে ঘুম ভেঙেই যখন ফোন করেছিলে তুমি, তখন দম ফেলার ফুরসৎ ছিল না আমার। বিছানা তোলা, স্নান করতে যাওয়া, বাজার করার সাথে মিলেমিশে ঘন্ট পাকাচ্ছিলো শ্রীমতী তুত্তুরীর সিলেবাসের পাওয়ার পয়েন্ট-আবহাওয়া ও জলবায়ু আর গড়ের অঙ্ক। সামান্য যোগে ভুল করার  ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে মাথা গরম করে, তোমাকে বলা হল না, ঠিক সেই মুহূর্তেই কি দারুণ সোনালী রোদ এসে পড়ছিল তোমার পূবের বারান্দায়। তোমায় জানানো হল না, আমার শুকিয়ে যাওয়া অপরাজিতা গাছে নতুন করে ডানা মেলেছে কিছু কচি সবুজ পাতা। তোমার কাছে অনুযোগ করা হল না, তোমাদের আবাসনের দুষ্টু কাঠবিড়ালি কি ভাবে সব পাতা ছিঁড়ে উলঙ্গ করে দিয়েছে আমার সাধের সিক্স মর্নিং গাছটাকে। কি সুন্দর ফুল ফোটাচ্ছিল কচি গাছটা। আক্ষেপ করা হল না তোমার কাছে, যে দৈনন্দিন ব্যস্ততায় কতদিন হয়ে গেল গাছে সার দেবার সময় হচ্ছে না আমার। তোমাকে দেখানো হল না, যখন ফোনটা রেখে দিলে তুমি, ঠিক তখনই আমাদের দাম্পত্য আলাপ শুনবে বলে ছাত থেকে টেলিফোনের তার বেয়ে সুড়সুড় করে নেমে আসছিল একটা ধেড়ে ইঁদুর। 


অফিস যাবার পথে যখন দুদণ্ড সময় পেয়ে ফোন করলাম তোমায়, আপাদমস্তক কাজে ডুবে তুমি। কতজন অপেক্ষা করছে তোমার একটু খানি সময়ের জন্য। চটজলদি ফোন রাখার চক্করে তোমায় শোনানোই হল না, আমার প্রিয়তমা বান্ধবীর সরকারি আবাসের দোতলার বাথরুমে হঠাৎ ঢুকে পড়া গোখরো সাপের কথা। বর্ষাকালে ব্যাঙ উঠত বটে, জলের পাইপ বেয়ে, পিছু-পিছু যে তিনিও আসবেন এটা কে জানত? তোমাকে শোনানোই হল না, আতঙ্কিত গিন্নিকে ছেড়ে অনুপ্রবেশকারী সাপের কুশল সংবাদ জানতে চাওয়ার অপরাধে বরটাকে ত্যাগই করবে বলে মনস্থ করেছে ও, ঐ যেমন মনস্থ আমরা দিনে অন্তত আড়াই বার নিয়ম মেনে করি আর কি-।


 এই তো সেদিনও প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ শোনাতাম তোমায়, তীব্র অনাসক্তিতে বেঁকে যেত তোমার ভ্রু, ফুলে উঠত দুই গাল। করুণ চোখে অপেক্ষা করতে, কখন শেষ হবে আমার দৈনিক বৃত্তান্ত। আজ এই মধ্যরাতে, সুপ্ত কন্যার পাশে শুয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে চিঠি লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, কে জানে সেটা কোন যুগ ছিল সত্য, দ্বাপর না ত্রেতা! 


তোমায় জানানোই হল না, কাজের দরকারে করা ফোন না তোলায়, কাকে যেন কোন গ্রূপে 'পাক্কা হারামজাদা' বলেছি আমি। যাকে লিখলাম, সে দেখার আগেই প্রত্যক্ষ করলাম, সর্বপ্রথম মেসেজটার পাঠিকাও আমি স্বয়ং। কন্যা বিদ্যা গজগজ হবে বলে, সরকারী ফোনটা বাড়িতে রেখে আসি যে। ক্লাস করার নামে তিনি সারাদিন কি করেন,হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মাইরি। অবিলম্বে যাবতীয় বন্ধুদের গ্রূপ থেকে নিজেকে থুড়ি নিজের ওই নম্বরটাকে হঠাতে হবে। মা হয়েছি বলে কি, প্রাণ খুলে দুটো বাজে কথাও বলা যাবে না মাইরি। কাল থেকে যদি বিশুদ্ধ তথা সংস্কৃত ভাষায় সংস্কৃতিমনস্ক আঁতেলদের মত বার্তালাপ করা শুরু করি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যে তৎক্ষণাৎ আমায় ত্যাগ করবে গো- 


তোমার আদরের দুলালী,তুমি বদলী হয়ে যাবার পর থেকে যিনি ক্রমাগত ছাগলের মত, 'ব্যা-ব্যা' করেই চলেছেন, পড়তে বসতে বললেই, ছলছল আঁখি নিয়ে যিনি আপন মনে গুনগুন করেন, ' বাবার জন্য আমার আজ খুব মনটা খারাপ', সেই তিনি শুধু যে আমার একার ফোনটারই বারোটা বাজাচ্ছেন, তাই নয়, দায়িত্ব সহকারে আমার বাবা এবং মায়ের ফোনেরও যাবতীয় দৈনিক ডেটা খতম করছেন। দিনভর ফোন গুলি যে তাঁরই কুক্ষিগত থাকে, তা আমি বেশ বুঝতে পারি, যখনই, যে নম্বরেই ফোন করি, এ বাড়িতে ফোন তোলেন কেবল একজনই। 


 তোমাকে শোনানো হল না,  অফিস ফেরৎ মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার গল্প। মাকে কেমন ধমকাল মায়ের ডাক্তার। যাকে ধমকালেন তিনি তো দিব্যি হাসাহাসি মুখে বসে রইলেন, মাঝখান থেকে আমি কেমন ব্যোমকে গিয়ে বেমালুম ফিজ না দিয়েই, আচ্ছা আসি বলে বেরিয়ে আসছিলাম। বকাবকি করে ক্লান্ত উনিও বলেই ফেলেছিলেন, 'হ্যাঁ আসুন।ভালো থাকবেন'।  ভাগ্যে মা বলল, ফিজটা দিতে। পথে শুনতে হল, 'মাথাটা কার খারাপ? আমার না তোর? পাগলের ডাক্তার কাকে দেখানো দরকার বলতো?'  


ভাবছ বোধহয় আজকের গল্প এইটুকুই, আজ্ঞে না স্যার, এখনো তো তোমায় শোনানোই হয়নি, জনৈক পুলিশের সাথে আমার আদরিণী ইন্সপেক্টরের ঝাড়পীঠের গল্প।' কিভাবে তিনটি জেলা দূর থেকে ফোনেই তার নিষ্পত্তি করলাম,তাও শোনাতে পারলাম না তোমায়। বাড়ি ফেরার পথে ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশকে সামলে আমার লোকজনকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলাম,তারপরও মা বলে কি না, 'পাগলের ডাক্তার কাকে দেখানো দরকার বল তো?' এত অপমান ধর্মে সইবে মাইরি? 


ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতি ছাড়ালো। কাল আবার সাড়ে ছটায় দরজা পিটবে, আমাদের সোফিয়া মাসি। বাবা যার নাম দিয়েছে সোফিয়া লরেন। দরজা না খুলতে পারলে, ঝাড়পোঁছ এর দায়িত্বটাও চাপবে আমার ঘাড়ে। তোমার মেয়ের আর কি,ধুলো মেঝেতেই গড়াগড়ি যাবে। সারাদিন হয় নাচ্ছেন নয়তো মাটিতে গড়াচ্ছেন। আপাততঃ ঘুমাতে যাই। তুমি বোধহয় গভীর ঘুমে। চলো শুভরাত্রি। 


ইয়ে জানো তো, সায়নী বলেছে আমাকে বিনি পয়সায় একখান খরগোশ দেবে। এক জোড়া কিনেছিল, দেড় দু  মাস অন্তর পাঁচটা করে বাচ্ছা দিয়ে এখন সাকুল্যে পঁচিশ খান হয়েছে। তার থেকে একটা আমাকে ভালোবেসে দিতে চাইছে। তুত্তুরীও সেই শুনে ধেইধেই করে নাচ্ছে, তোমার অনুমতি নেওয়া হল না, হ্যাঁ গো, আনব নাকি একখান? 


ইতি 

অনিন্দিতা।

No comments:

Post a Comment