Sunday, 30 May 2021

অনির ডাইরি ২৯শে মে, ২০২১

 



তুত্তুরীর টিন এজটাকে বড় ভয় আমার। কে জানে কেমন হবে তখন মেয়েটা।  কতটা বনবে আমার সাথে। এখনও যে খুব একটা বনে তা নয়। অবশ্য তাতে আমার অবদানও খুব একটা কম কিছু নয়।  যেমন আজ সকালে, কি যে আজব ভাষায় গান গাইছিল  মেয়েটা। যার না আছে মাথা না মুণ্ড। 'আ লাড়ুম। ইরঙ্গল তুনিড়োরে, পাদঙ্গল তিমিরোড়ে, সি রঙ্ঘলওয়া‘ রঙ্গলওয়া, রঙ্গলওয়া। ভূরি। কড়াঙ্গল দিদু উঙ্গল, কালাম্বিনী মেদুনি আপ্পা, বিদপো, ভিদমনি-’।’ 


 সাধ করে বাংলা তর্জমা করেদিলাম, ‘আয় নাড়ু। আকাশে তিমি ওড়ে, দঙ্গল বেঁধে তিমি ওড়ে। কড়ে আঙুলে দিদু ওড়ে। সি মঙ্গলবার, বুধবার, বিষ্যুৎবার। ভুঁড়ি। ’ ভেবেছিলাম খুশি হবে, খুশি তো হলেই না, উল্টে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতে দৌড়ল শ্রীমতী তুত্তুরী। এরা বাপ-মেয়েতে যে তলে তলে যুক্ত ফ্রন্ট খুলেছে তা আমি দিব্য বুঝতে পারি। কাল যখন মনের ভুলে, নুনের কৌটো ফ্রিজে তুলে সারা বাড়ি তোলপাড় করছিলাম আমি, তখনও এরা খুঁজে দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, দল বেঁধে আওয়াজ দিচ্ছিল। 


 এই তো সেদিন পর্যন্তও মেয়েটা বলত,  ‘আমি দিদিকে বিয়ে করব।’ দিদি অর্থাৎ আমার বাবার দিদি। এষার সাথে আলাপ হওয়ার পর, ঠিক করেছিল এষা পিসিকেই বিয়ে করবে। উমা বিয়ে হয়ে আসার পর, এষা পিসিকে ত্যাগ করল না বটে, তবে কাকিমা এবং এষা পিসির মধ্যে রইল দোদুল্যমান হয়ে। প্রায়ই প্রশ্ন করত, দুটো বিয়ে কি একেবারেই করা যাবে না?  তাহলে বিয়েটা ঠিক কাকে করবে? নাকি বড় মামিকেই শেষ পর্যন্ত? বর্তমানে পাত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কেবল বাবা। দিনান্তে বাবার কান মুলতে মুলতে বা চুল টানতে টানতে, আব্দেরে গলায় ফরমাইশ করে তুত্তুরী, ‘বাবা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব, কেমন?’ 


একই দাবী অবশ্য আমিও করতাম। কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে, ঘুম পাড়াতে উদ্যত মায়ের গলা জড়িয়ে একই রকম আব্দেরে সুরে বলতাম, ‘মা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব। ’ মা হবার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় মজা, আরেকবার ফিরে যাওয়া যায় নিজের শৈশবে। কে জানে হয়তো একই অনুভূতি অনুভব করে বাবারাও। বারো বছরের দাম্পত্যের উপান্তে এসে তাই বুঝি মাঝেমাঝেই  বড় বেশী বাবা-মা হয়ে উঠি আমরা। তক্কে তক্কে থাকা, চুরি করে পাওয়া, হাতে গোণা একান্ত নিভৃত মুহূর্তে আলোচনা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আলোচনা করে ফেলি তাঁরই কথা। দেশ-দুনিয়ার রাজনীতি, অতিমারি, বই, সিনেমা, অ্যামাজন-না নেটফ্লিক্স ইত্যাদি গুরুগম্ভীর তত্ত্বালোচনা বা নিছক দ্বৈরথের মধ্যেও অনায়াসে ঢুকে পড়েন তিনি। এমনকি কথাবার্তাও তাঁরই ভাষাতেই বলি  আজকাল আমরা। যেমন সেদিন আমার জন্মদিনে উপহার পাওয়া কাঠের যোগাভ্যাসরতা কন্যাটিকে খণ্ডবিখণ্ড করার পর তিনি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, ‘লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে’। তারপর থেকে যেকোন জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, বরবাদ হয়ে গেলে আমরা বলি, ‘ওটা লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে। ’  যেমন রেগে গেলে তিনি বলেন ,' গররর্'। একটু আগে, ‘এনে ভুঁড়ি’ গেয়ে তুত্তুরীকে বিরক্ত করার পর শৌভিকও এসে বলে গেল, ‘গররর্’।


 কাল পর্যন্ত আমার সামান্য স্পর্শ, একটু সময় আর একটা আলগা চুম্বনের জন্য তৃষিতের মত প্রতীক্ষা করা বাচ্ছা মেয়েটা, আজকাল বড় বেশি বাবার অনুরাগিনী। বাপ-মেয়ের এই সখ্যের দাপটে মাঝেমাঝেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায় আমার। প্রায় সমবয়সী দম্পতি আমরা, খুনসুটি থেকে বালিশ নিয়ে উদোম ঝাড়পিটে লুকিয়ে বাড়ে প্রেম। মুস্কিল হচ্ছে আজকাল শৌভিকের সাথে তর্কাতর্কি হলেই, কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসেন তিনি। বাবার সাথে ঝাড়পিটের মধ্যে কামড়েও দেন ঘ্যাঁক করে। কবে যে মেয়েটা বাবাকে তার রোল মডেল ঠাওরাল ভাবতে বসে তাজ্জব হয়ে যাই আমি।  মাঝে মধ্যে তীব্র অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে আঁখি। পরমুহূর্তেই উপলব্ধি করি, এটাই তো হবার ছিল। এটাই তো আমার কর্মফল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক বাবার মেয়ে ছিলাম আমি। কবে কোন দাম্পত্যকলহে মাকে সমর্থন করেছি মনেই পড়ে না। বাবা মানে অগাদ প্রশ্রয়। বাবা মানে জীবনের একমাত্র পুরুষ, যার চোখে আমি যথার্থই অনিন্দিতা। আর মা মানে, এক অনন্ত শিক্ষয়িত্রী। বেশ জাঁদরেল  ব্যপারসাপার। কেবলই শিক্ষা দিত মা। ‘ তরকারি থেকে বেছে বেছে কুমড়োগুলো ফেললে কেন? অত জোরে হাসবে না। অত বেশি টিভি দেখবে না। অমন ধড়াম করে দরজা বন্ধ করবে না। রাগ হলে অমন দুমদাম করে চলবে না। মুখে মুখে চোপা কাটবে না। বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে না। ’ সর্বোপরি 'পড়তে বসো, পড়তে বসো এবং পড়তে বসো।'  এগুলো কে বলত? এগুলো কে বলে? মা না আমি? তারুণ্যে সবথেকে কঠোর সমালোচক ছিলাম যার, তবে কি, ঠিক তারই মত হয়ে উঠছি আমি? 


 আজ সকাল থেকে বায়না জুড়েছেন,  রান্না করতে চান শ্রীমতী তুত্তুরী। নাঃ মোটেই গরম জলে ম্যাগি দেবার মত, বা গলে যাওয়া মাখনে পোচ বানানোর মত সহজসরল কোন রান্না নয়, জম্পেশ করে কোন পদ বানাতে চায় তুত্তুরী। ঠিক যেমন ঐ দাদাটা বানিয়েছে। দাদাটার নামটা না হয় উহ্যই থাকুক, তার মা কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমার সহপাঠিনী ছিল। যেমন অতুলনীয়া গুণবতী জননী, তেমনি তাঁর সুযোগ্য পুত্র। মা রন্ধনে দ্রৌপদী, পুত্রও তাই। কতই বা বড় হবে ছেলেটা, তুত্তুরীর থেকে বছর দুই? নাকি তাও নয়। এইটুকু পুঁচকে একটা ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরোয়, সে তার মায়ের জন্মদিনে উপলক্ষে যে সব পদ বানিয়েছিল,তা দেখে আমাদেরই চক্ষুচড়কগাছ তো তুত্তরী তো নেহাত ছেলেমানুষ। 


সেই থেকে বায়না জুড়েছে তুত্তরী, জমিয়ে কিছু রান্না করবেন তিনিও। শুধু গ্যাস জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া যেখানে থাকবে না আমার কোনই ভূমিকা। এতো বেশ আনন্দের কথা। তা রাঁধুক না, আমি নাহয় দাঁড়িয়ে থাকব, চৌকাঠের এপারে। আধ ঘন্টার তীব্র হুমহাম (চিন্তান্বিত মুখে পায়চারি করাকে শাশুড়ি মাতা যে নামে সম্বোধন করেন আর কি) অন্তে করুণ সুরে এসে জানাল তুত্তরী, 'মা কি রাঁধব একটু বলে দাও না।' 


সত্যি কথা বলতে কি,  কালিয়া-কাবাব বানাতে যে সব সামগ্রী লাগে, তাদের লিস্ট একখান যোগাড় করেছি বটে, তবে হাতের কাছে সামান্য গরম মশলা ছাড়া নেই প্রায় কোন উপকরণই। 


তখনই মনে পড়ল পালং চিংড়ির কথা। কোন একটা গ্রুপে পড়েছিলাম। রান্না করাও সহজ, লাগেও যৎসামান্য উপকরণ, আর তা মজুতও আছে ঘরে।  পালং শাককে সামান্য নুন দিয়ে সিদ্ধ করে মিক্সিতে বেটে নিতে হয়। বাটার সময় তার সাথেই পরিমাণ বুঝে একখান মাঝারি বা বড় পেঁয়াজ, গোটা তিন/চার কোয়া রসুন, সামান্য আদা, গোটা দুয়েক কাঁচা লঙ্কা বেটে নিতে হয়। এই বাটা মসলাটাই এত সুগন্ধি হয়, যে মনে হয়, শুধু ওটা দিয়েই খেয়ে নেওয়া যায়, এক থালা ভাত।  


ভাজার আগে, সামান্য নুন-হলুদ জলে ভাপিয়ে নিতে হয় চিংড়ি মাছগুলি। না হলে তেলে দিলেই বড় শক্ত হয়ে যায়। গরম তেলে, ভাপানো মাছগুলো অল্প নাড়াচাড়া করে তুলে নিয়ে, ঐ তেলেই পাঁচফোড়ন, ২টি শুকনো লঙ্কা, তেজ পাতা ফোড়ন সহ শাক বাটাটা দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজা ভাজা করে, তাতে হলুদ গুঁড়ো, সামান্য লঙ্কা গুঁড়ো, টমেটোর রস, একটু জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে  কষতে কষতে তেল ছাড়লে, ভাজা চিংড়ি মাছ গুলি দিয়ে, পরিমাণ মত নুন-মিষ্টি চেখে, সামান্য ফুটিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। জল দিতে নেই। মানে দেওয়াই যায়, দিলে বড় তরল হয়ে যায় ব্যাপারখানা। নামানোর একটু আগে অল্প কসুরি মেথি ছড়িয়ে দিলে এমনিই সৌরভে মথিত হয় গোটা বাড়ি।


বলা যত সহজ, ব্যাপারটা মোটেই অত সহজ হয়নি শ্রীমতী তুত্তুরীর পক্ষে। প্রথমতঃ কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধেই তিনি ছুট্টে পগার পার। শাক সিদ্ধ এবং বাটার পর যখন পুনরায় মঞ্চে প্রবিষ্ট হলেন, গরম তেলে মাছ ছাড়তে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলেন তিনি। যত বলি, হাত নামিয়ে তেলের কাছে এনে টুপ করে ছাড় মাছটা, ততো ভয়ে থরথর করেন তিনি। ছপাৎ করে একখান ছাড়লেন বটে, খানিক তেল গিয়ে পড়ল পাশে রাখা নুনের কৌটোর ঢাকায়।


অগত্যা বলতেই হল, ঢের হয়েছে মা, এবার ক্ষ্যামা দাও।  তুমি বরং তোমার ঐ গানটাই গাও। আমি আর বাংলা তর্জমা করব না। আর আমায় শান্তিতে রাঁধতে দাও। যার কাজ তাকেই সাজে। বলতে গিয়ে মনে হল,  এর আগেও কোথায় যেন শুনেছি কথাটা, অন্য কোন সাদাকালো দশকে, জনৈকা জাঁদরেল ভদ্রমহিলার মুখে।  এই রে, আমি সত্যিসত্যিই ‘মা’ হয়ে উঠছি- সামনে তাহলে বাকি এখনও বহু যুদ্ধ।

No comments:

Post a Comment