Wednesday, 26 May 2021

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২১

 

'I set out on a narrow way many years ago,

Hoping I would find true love along the broken road.

But I got lost a time or two,

Wiped my brow and kept pushing through.

I couldn't see how every sign pointed straight to you'


আজ আমার বিয়ের দিন। ধুর কি ভুলভাল বকছি, বিয়ে তো হয়ে গেছে মাস তিনেক আগেই, সরকার বাহাদুরের ছাপ মারা, আগমার্কা বিয়ে। আজকেরটা তো বাবার মন রাখতে নিছক লোকাচার। গতপরশু থেকে গমগম করছে বাড়িটা, রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাপের পর কাপ চা করেই চলেছে সেজোমাসি। অকারণে সারা বাড়ি চরকি পাক খাচ্ছে জ্যাঠাইমা। ভাঁড়ার সামলাচ্ছে বড়মাসি। অগোছালো বাড়িটা গুছিয়ে গুছিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ছোটমাসি, দীপু আর ছুটকি। বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছে না টুলটুল দাদা, খালি ‘কাকা এটা একবার দেখে নিন। ওটা একবার দেখে নিন’ করে করে পাগল করে ছাড়ল লোকটা।  কোন বাড়ির বড় জামাই, তার খুড়তুতো শালির বিয়েতে এমন কুলিকামিনের মত কোমর বেঁধে খাটে শুনি? 


কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে কণিকা মাসি।আলো ফোটার আগেই খেয়ে নিতে হবে দধিকর্মা। হাতে বোনা আসনে বসে আধঘুমন্ত অবস্থায় কি যে খেলুম,মনে নেই। জ্যাঠাইমা তো কেঁদেই হাট করল। মা আর জ্যাঠাইমা গতকাল থেকেই কেঁদে হাট করছে।  আগের দিন সন্ধ্যাবেলা যখন কদমতলা বাজার থেকে দুহাত ভর্তি শাঁখা-পলা আর লোহার কড় পরিয়ে নিয়েএল দিদিভাই, উঠোন পেরিয়ে লাল রোয়াকে পা রাখতেই  হু হু করে কেঁদে ভাসিয়েছিল জ্যাঠাইমা। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর, আমাকে নিয়েই ভুলে ছিল, এবার যে আমার যাবার পালা।   


নীলপাড় হলুদ রঙের হলহলে একটা সিল্ক পরে একা বসে আছি ঘরে। গায়ে হলুদ এসেছে। জানি সঙ্গে এসেছে আমার দুই দেওর, এক ননদ, আর শৌভিকের পিসেমশাই। কি পাঠিয়েছে তাও জানি। নিজেরাই ঘুরে ফিরে পছন্দ করে কিনেছি যে। যা চেয়েছি, যা ভালো লেগেছে অকাতরে কিনে দিয়েছেন শ্বশুরমশাই। শুধু সাজানোটা দেখিনি। শৌভিকের পিসির ননদ, নাকি অতি যত্ন করে অতি উত্তম রূপে সাজিয়েছেন সবকিছু। সেটাও দেখেই ফেলতাম, যদি বিয়ের দিন চারেক আগে উত্তমমধ্যম ঝগড়াটা না হত। 


তত্ত্ব দেখে সবাই  উচ্ছ্বসিত। আমি ঘরে বন্দী। ওরে আমাকেও কেউ ডেকে দেখা রে বাপ। আমার দুই প্রাণাধিকা সহচরী সঞ্চিতা আর পম্পা একবার ঘরে ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। কিন্তু আমার এখনও মঞ্চে প্রবেশের সময় হয়নি। দিদিভাই এসে ধরে নিয়ে গেল,ফিসফিস করে বলল, একটু লাজুকলতা হতে।হ্যাংলার মত যেন তত্ত্ব আর মিষ্টি দেখতে না বসে যাই। সাজিয়ে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসতে গিয়েও, অতি সন্তর্পণে, অতি যতনে বসার চেষ্টা করলাম। সামনে একটি লাজুক লাজুক পুঁচকে মেয়ে। তারপাশে ভয়ানক গাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের উমার ভাবী বর, শ্রীমান টুকলু অর্থাৎ শৌভিকের সহোদর। তার পাশে বিগলিত মুখে আরেক দেওর শ্রীমান সুশান্ত। তারপাশে এক ভয়ানক সুদর্শন ব্যক্তি। তিনি ঠিক কোন পক্ষের লোক বলা মুস্কিল, দিব্যি একহাতে আমার বাবা অপরহাতে আমার মাকে বগলদাবা করে  বলছেন, ‘আমি তো এবাড়ির লোক। কি করতে হবে বলুন শুধু,ব্যাস। ’ এটা আবার কে? আর পিসেমশাইটা গেল কোথায়? যাকে শৌভিকরা ডাকে ছোটেকাকা? বাঙালী বাড়ির বিখ্যাত অবাঙালী জামাই। 

গোটা বাড়ির লোকের সাথে গপ্প করে বরের বাড়ির লোকজন বিদেয় হল।  এবার গায়ে হলুদের পালা। আমার  বৌদিরা এখনও এল না। উফঃ কথাই বলব না আজ ব্যাটাদের সাথে। মানছি দুটো বাচ্ছা নিয়ে নাজেহাল, তাই বলে একমাত্র ননদের বিয়েতে এত দেরী কেউ? ওদের বিয়ের সময় ১০সেকেণ্ডের জন্যও ওদের একলা ছেড়েছি আমি? উফঃ আর কি সেজেগুজে এসেছে মাইরি। বিয়েটা কার? ভাবছে, সরি বললে, আর জড়িয়ে ধরলেই গলে যাব বুঝি। এত সহজে রাগ কমে নাকি? 


এক গা হলুদ মেখে স্নানে ঢুকেছি, জল চলে গেল। কি জ্বালা রে ভাই। সমানে দরজা পিটছে ছোটমাসি,‘বেরো রে। কতক্ষণ ধরে চান করবি?’ জল না এলে কি করব? স্নান না করেই বেরিয়ে যাই? ‘অ্যাই’ ধমকে উঠল ছোট। নতুন বউকে অমন কটকট করে কথা বলতে নেই। 


ঘরের দরজা বন্ধ করে জবরদস্তি চারটে লুচি তরকারী মুখে ঠুসে দিল দিদিভাই। সেই মধ্যরাতের আগে আর খেতে পাব না। পেটে না ঢুকলেও খেতে হবে। এবার সাজার পালা। কনে সাজাতে নাকি অনেকক্ষণ লাগে। ছোটমাসি পইপই করে বলে দিল, বেশী সাজের দরকার নেই।  বিকাল বিকাল যেন পৌঁছে যাই দেবকন্যায়। বড় ব্যাগে বেনারসী, আর গয়নাগাঁটি ভরে টুলটুল দাদার সাথে রওণা দিলাম দিদিভাইয়ের বাড়ি। যেবাড়িতে একদিন কনে সেজে ঢুকেছিল চাটুজ্জে বাড়ির বড় মেয়ে,সেখান থেকেই আজ কনের সাজে বের হবে ছোট মেয়ে।  


আমার সাজ শুরু হবার আগেই ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর সোনার চেনে সেজে গুজে প্রস্তুত দাদাভাই। টুলটুল দাদার দাদা, দিদিভাইয়ের ভাসুর যাবে আমার বর আনতে। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের বুকে গায়ে প্রস্তুত মস্ত বড় কালো টয়োটা কোয়ালিস। সময় গড়াচ্ছে, বাইরে জমছে মেঘের পর মেঘ।  কি যেন একটা ঝড় আসবে, নাম তার আইলা। 


বাবার ধমক খেতে খেতে যখন দেবকন্যায় এসে নামলাম, জড়ো হয়েছেন বেশ কিছু অতিথি। রবিবার হওয়া সত্ত্বেও দল বেঁধে হাজির আমার ব্যাচমেটরা।  দেবু-সুকন্যা-সঞ্জয়-সজল। উপস্থিত খড়্গপুরের আমার তৎকালীন ইন্সপেক্টর আর স্টাফের দল। ধীরে ধীরে বাড়ছে লোক সমাগম। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ের দাপট। 


অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামল শৌভিক। কেলেঙ্কারির একশেষ, উল্টো ধুতি পরে বসেছিল ভুল করে, ভাগ্যিস দাদাভাই গিয়েছিল বর আনতে। তাই না আবার খুলিয়ে পরিয়েছে। বৃষ্টি মাথায় বরণ করতে ছুটল জ্যাঠাইমা। পিছনে চোরের মত মা। হবু জামাইকে বরণ করার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে-। মাথার ওপর বড়দার ধরে মস্ত ছাতা, চূড়ান্ত নার্ভাস মুখে ধুতি সামলাতে সামলাতে স্কুলবয়ের মত ঢুকল শৌভিক। 


পিঁড়িতে বসে, লাল সিঁদুরকৌঠো হাতে, জোড়া পানপাতায় মুখ ঢেকে বরকে প্রদক্ষিণ, শুভদৃষ্টি, মাল্যদান আরো কত কি অনুষ্ঠান ঘটে চলে একের পর এক। ‘ছাউনি নাড়া ফুল’ নিয়ে পাগল হয়ে ওঠে জ্যাঠাইমা। খুব যত্ন করে রাখতে হয় নাকি ঐ ফুল, তারপর খুব বিশ্বস্ত কারো হাত দিয়ে তাকে বিসর্জন দিতে হয় গঙ্গায়। হেসে উঠতে গিয়ে ধমক খেলাম বেজায়। অথচ শৌভিককে কেউ বকছে না কেন? একটাও মন্ত্র পড়ছে না ব্যাটা। কেবল ফিসফিস করে গল্প করে চলেছে আমার সাথে। দুবার ধরিয়ে দিল বড়বৌদি, দুমিনিট গম্ভীর ভাবে মাথাও নাড়ল শৌভিক, তারপর আবার যেই কে সেই। কি দারুণ মেরুন রঙের ধুতি পরে রাজার মত বসে আছে টুকলু।পাশেই লাঠি হাতে, ধপধপে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর কাঁধে বসে আছে আমার বড় জেঠু। রূপে আলোকিত গোটা মণ্ডপ। রাজার রাজা। একমনে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটা লোকাচার। 


সঞ্চিতার পা মচকেছে, এবেলা আর আসতে পারেনি। কাকুকাকিমা এসে আশীর্বাদ করে গেলেন। রূপালী পাড় কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত বেনারসি দিয়ে। রাত বাড়ছে, ঝড় বাড়ছে। দেবকন্যা থেকে আবার ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি।  বাসর ঘরে গান ধরল খুড়তুতো ভাই অয়ন। কি যে ভালো গায় ছেলেটা। খালি গলাতেই মাত। দুচারটে ছুটকো মস্করা করার চেষ্টা করল কারা যেন। কি গম্ভীর বর বাপরেঃ। তেমনি তার দুই বন্ধু। তিনটে আপদে মাটি করল আমার বাসর। 


রাত অনেক, বাইরে ফুঁসছে ঝড়। জানলার কাঁচে আছড়ে পড়ছে বারি ধারা। কাল আয়লা আসবে যে-। অঘোর ঘুমে তলিয়ে গেছে বাসরতুলুনির দল। নিদ্রাহীন শুধু দুটি প্রাণ। এ রাত যে শুধুই কানাকানির। এ রাত যে অাঙুলে আঙুল জড়িয়ে, কানে কানে  বলার- ‘ every long lost dream led me to where you are-/ Others who broke my heart, they were like Northern stars,

Pointing me on my way into your loving arms/This much I know is true

That God blessed the broken road

That led me straight to you.'

No comments:

Post a Comment