অগ্নিসাক্ষী করে বিয়েটা হয়েছিল নিছক বাবার শখে। মাত্র মাস সাত আট আগেই মস্ত বড় অপারেশন হয়েছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বাদ গিয়েছিল খানিকটা পাকস্থলী, তারওপর পর পর তিন-তিনটে কেমো। এমতাবস্থায় লোকাচার মেনে জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেওয়ার ধকলটা ওণাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। যদি না, আমার কাকা-পিসে শ্বশুর আর শাশুড়ি মাতারা সবাই মিলে বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এত গূঢ় তথ্য অবশ্য জানত না বাবা।
যাই হোক অগ্নিসাক্ষীর বিয়ে নিয়ে শৌভিকের সবথেকে বড় টেনশন ছিল ধুতি পরা। আর আমার? পিঁড়িতে চেপে শৌভিককে প্রদক্ষিণ করা। কে চাগিয়ে তুলবে আমায়? তার থেকে না হয় আমি এমনি পায়ে হেঁটেই--। ছিঃ আমরা না এদেশীয়, পিঁড়িতে চেপে, পান পাতায় মুখ ঢেকে মণ্ডপে প্রবিষ্ট হয় আমাদের বাড়ির মেয়েরা। বিয়ের দিন, আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি, পরদিন আসার কথা আয়লার। ওই দুর্যোগ মাথায় নিয়েও কোথা থেকে যে জড় হয়েছিল, এতজন ভাই, দাদা আর মামা। গোলাপি চেলি পরে, পান পাতার আবরণে মুখ ঢেকে পিঁড়িতে চেপে দিব্যি বনবন করে ঘুরলাম শৌভিককে মাঝে রেখে। শূণ্যে দুলতে দুলতেই, নির্দেশমত পান পাতা সরালাম মুখের ওপর থেকে। বিয়েবাড়ির রোশনাই, সানাই, ফুল আর পারফিউমের তীব্র সুগন্ধ ছাপিয়ে, সার্চ লাইটের মত আছড়ে পড়ল একজোড়া পরিচিত চোখের খর দৃষ্টি। চারচক্ষুর মিলনে কতটা পুলক জেগেছিল আজ আর মনে নেই, তবে মণ্ডপে উপস্থিত নরনারীগণ যে আমোদে উছলে উঠেছিল তা সম্মিলিত তরল হাসি আর উলুধ্বনির প্রাবল্যে বেশ বুঝতে পারছিলাম।
এবার মালা বদলের পালা। বিকেল বিকেল সেজেগুজে সিংহাসনে বসার আগে, শালপাতার ডালা খুলে মালাটা সুকন্যাই পরিয়েছিল আমায়। শৌভিককে কে পরিয়েছিল জানি না। জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক বলে, ‘নিজের বিয়ের কথা কারো এত মনে থাকে?’
যাই হোক এবার আমায় মালা পরানোর পালা। বর এবং কনে পক্ষের মধ্যে এইসময় মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল মার্কা বৈরিতা প্রকট হয়ে ওঠে। ছড়া কাটে নাপিত। সম্ভবতঃ মেজদা চমকে রেখেছিল আমাদের তরফের নাপিতকে, 'এই ব্যাটা অশ্লীল ছড়া কাটলেই পেটাবো।' আমার কয়েক মাসের আইনসিদ্ধ বাসী বর, তাও এত সহজে মালা পরাতে দেবে নাকি, আমাদের বাড়ির লোকেরা। মালা নিয়ে শৌভিক এগোতেই, সটান শূণ্যে তুলে ধরা হল আমায়। সবার মাথার ওপর উঠতে গিয়ে, এমনআর একটু হলেই, ঝপাং করে গড়িয়ে পড়তাম শৌভিকের ঘাড়ে। হৈচৈ এর মধ্যেই কোনমতে সামলে বসছি পিঁড়ির ওপর, শৌভিক বিড়বিড় করে বলল, ‘এত গুলো আইবুড়ো ভাত!’।
আমার আইবুড়ো ভাত খাওয়া নিয়ে বরাবরই স্পর্শকাতর শৌভিক। সত্যিই কতগুলো যে আইবুড়ো ভাত খেয়েছিলাম, আজ আর মনেও পড়ে না। প্রতিটা নিমন্ত্রণের পর, কি খেলাম তার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দিতাম হবু বরকে, আর শৌভিক বলতো, ‘পরেরটায় আর যেতে হবে না। এই গরমে শেষে বিয়ের দিন পেটখারাপ বাঁধিয়ে বিয়েটাই পণ্ড করবি তুই।'
বেশীর ভাগ নিমন্ত্রণই থাকত দিনের বেলা। শুধু দিদিভাইদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল সন্ধ্যাবেলা।২০০৯ সালের মে মাস। গরম পড়েছে ফাটিয়ে, তার ওপর আগের রাত থেকে বিদ্যুৎ বিহীন হাওড়া নগরী। অনুরোধ করেছিলাম, যদি পিছিয়ে দেওয়া যায় ব্যাপারটা। এই গরমে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামবে? শুনেই এমন ধমক মারল টুলটুল দাদা। দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়, আমি তিন পেরিয়ে চারের পথে। ফলে জামাইবাবু থুড়ি টুলটুল দাদার চোখে আমি শালী নই, কন্যাসমা। একে টুলটুল দাদায় রক্ষে নেই, আছে তাঁরও দাদা। আমাদের দাদাভাই। সকাল থেকে দুইভাই মিলে বাজার করেছে আর দুই বউ রান্না করেছে, এরপরও যদি না যাই, তাহলে যে কুরুক্ষেত্র বাঁধবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন বেরোলাম আমি আর ছুটকি, পথঘাট তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছুটকির পরিচয় দিতে গেলে যে বিশেষ্য প্রয়োগ করতে হয়, সম্পর্কটা ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুচ্ছ গৃহশ্রমিক নয়, ছুটকি ছিল আমার ছোটবোনের মত। যতটা ভালোবাসতাম, তার থেকে অনেক বেশী ভালোবাসত মেয়েটা আমাকে।
যাইহোক, বেরোবার সময় জ্যাঠাইমা পইপই করে বলে দিল,গলি নয় বড় রাস্তা ধরতে। আমাদের হাওড়ার গলি বিখ্যাত। ধুর কে আর রাজপথ ধরছে। এই অন্ধকারে রাজপথও যা আর গলিও তাই। উল্টে গলি দিয়ে পৌঁছান যাবে চটজলদি। টর্চওলা মোবাইল তখনও স্বপ্ন, হাতে বাবার দুব্যাটারির সরু টর্চ নিয়ে সৎসঙ্গের পাশ দিয়ে, গয়লাপাড়ার ভিতরের সরু গলি দিয়ে কালিপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন।কেষ্ট কাকুর দোকান ছাড়িয়ে, প্রাক্তণ এমএলএ যুগল মণ্ডলের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কদমতলা বাজার। ঘুটঘুটে অন্ধকার পথঘাট, মাঝে মাঝে উল্টো দিক থেকে আসা বাইকের উজ্জ্বল আলো, আর রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে জ্বলতে থাকা দেওয়াল গিরির আলোআঁধারীতে পথঘাট কেমন যেন থমথমে রহস্যময়। সমস্ত বাড়ির জানলা খোলা, সমস্ত রোয়াকে, বারান্দায় বসেছে জমজমাট আড্ডা। প্রতিটা বাড়ির ছাদে চক্কর কাটছে প্রমিলাবাহিনী।
দিদিভাইদের বাড়িতে প্রবেশ করার অনেক গুলো দরজা। বিশাল জমির উপর সুদৃশ্য বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। বাড়ি নয়তো হাওয়ামহল। চতুর্দিকে গুচ্ছগুচ্ছ জানলা আর দরজা। ইমার্জেন্সি লাইট গুলোর চার্জ প্রায় তলানিতে, যেটুকু আছে শুধু আমাদের খাবার জন্য রেখে, সারা বাড়িতে গুটি কয়েক মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাই বসেছিল আমাদের প্রতীক্ষায়।
ও বাড়ির আতিথেয়তা প্রায় প্রবাদপ্রতিম। কত যে ব্যঞ্জন বানিয়েছিল দিদিভাই আর সোমাদি তার ইয়ত্তা নেই। পোলাও, এই দামড়া ফিশফ্রাই, ইয়া বড় বড় চিংড়ি, খাসির মাংস আর কি কি ছিল আজ আর মনে নেই। তবে ভুরিভোজের থেকেও বেশী জমজমাট হয়েছিল, টিমটিমে মোমবাতির আলোয় গা ছমছমে ভূতের গপ্প। দেশভাগের আগুনে বলি হওয়া বহু মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল নাকি ছিল, অদূরের মজে যাওয়া ডোবাটা। তাদের কারো কারো অস্তিত্ব নাকি টের পাওয়া যায় গভীর রাতে। বাড়ি ভর্তি জাঁদরেল সারমেয়র দল, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনালেই আর ছাতে থাকতে চায়না কেউ। বেঁধে রেখে আসলেও হু হু করে কাঁদে আর কাকুতি-মিনতি করে নীচে নিয়ে যাবার জন্য।
কোনটা সত্যি, কোনটা নিছক গল্প, আজ সবই কেমন যেন আলোআঁধারিতে ঢাকা। সেই বাঙলো প্যাটার্নের ছিমছাম বাড়িটাও আজ আর নেই। হয়তো নেই তেনারাও। অথবা আছেন। ভুরিভোজ সেরে হলুদ পিওর সিল্কের শাড়ি বগলে আবার সেই অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে ফেরা। আজ এই প্রায় গৃহবন্দী দশায় ভাবতে বসলে তাজ্জব লাগে, কতটা খোলামেলা, কতটা নিরাপদ, কতটা ঘরোয়া ছিল আমাদের শহরটা। অতরাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল দুটি অল্পবয়সী মেয়ে, এক পলকের জন্যও হয়নি কোন অস্বস্তি, লাগেনি কোন ভয়। বাড়ি ফিরলাম যখন, রাত তখন দশটা। অন্ধকার রোয়াকে চেয়ার পেতে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে জ্যাঠাইমা। অদূরে আরেকটি চেয়ারে রাজার মত বসে বড় জেঠু। একতলার বসার ঘরে মোমবাতির আলোয় কি যেন লেখাপড়া করছে বাবা আর উল্টোদিকে গালে হাত দিয়ে বসা মা- সবাই কেবল আমারই প্রতীক্ষায়।
খুঁটিয়ে বলতে হল সবার সামনে, কি খেলাম, কি পেলাম, কেন মা এবং জ্যাঠাইমার যুগপৎ নিষেধ সত্ত্বেও ছাঁদা বেঁধে আনলাম। যেন আমি আনব না বললেই দিদিভাই ছেড়ে দিত। গলা অবধি খাইয়ে,বাড়ির সবার জন্য বেঁধে দেওয়া যে ঐ বাড়ির ট্রাডিশন সবাই জানে, তবুও দফায় দফায় ঝাড় খেয়ে যখন শুতে গেলাম ঘড়ি বলছে রাত এগারোটা। তখনও নিষ্প্রদীপ হাওড়া নগরী। পাওয়ার হাউস থেকে পাওয়া শেষ খবর অনুসারে, আজ রাতেও ফিরবে না বিদ্যুৎ। লাল মেঝেতে জলের ছিটে দিয়ে, তার ওপর বালিশ নিয়ে শুয়ে মোবাইলের কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা শেষ ১৫-১৭ শতাংশ চার্জটুকুর সদ্ব্যবহার করব এবার। সারাদিন কথা হয়নি তেমন। ঝটপট করে শোনালাম কি খেলাম, কি পেলাম, কি কি গল্প শুনলাম।খুকিখুকি নাকে কান্নাটা সবার শেষে। কারেন্ট না এলে, ঘুমোব কি করে। উফঃ কি গরম। বাপরে। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল অমৃতবাণী,‘এখুনি চলে আসবে কারেন্ট দেখ না।’ হ্যাঃ কচু আসবে। কতবার যে বাবা ফোন করেছে সিইএসসি দপ্তরে, বারবার শুনতে হয়েছে একই কথা। আজ আর আসবে না। বলতে না বলতেই, ঘটঘট করে উঠল মাথার ওপরের পাখা। হো-হো রব ভেসে এল চারিদিক থেকে- বাবা আর ছোটকাকু উল্লাসে একসাথে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে এসেছে রে। এসেছে। ’ একই কথার উল্লাসিত প্রতিধ্বনি ভেসে এল আসেপাশের বাড়ির ছাত থেকে। আর ফোনের ওপারে মৃদু হাসি, ‘বলছিলাম না। ’
No comments:
Post a Comment