অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি কাঁদব। খুব জোরে বিলাপ করে যদি নাও হয়, অন্তত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তো কাঁদতেই পারি? কত কিছুতেই তো আমি কেঁদে ভাসাই- অথচ আজ যখন এক পলকে শেষ হয়ে গেল জীবনের এতবড় অধ্যায়-
অধ্যায়ই তো, ডাকনামটাই তো তাঁর দেওয়া। বংশের উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে অপারগ বাবা- মা যখন কোলে করে আমায় নিয়ে প্রথম প্রবেশ করে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, সবথেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছিল সে। দিদিভাইয়ের ডাক নাম ছিল রুনু, ছন্দ মিলিয়ে নাম রেখেছিল ঝুনু।
আঠারো মাস বয়স অবধি না কথা বলতে পারতাম, না দাঁড়াতে পারতাম। কোথাও বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল ঈশ্বর স্বয়ং। আশা ছাড়েনি সে। ভোর ভোর ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিত টিনের মিটসেফটার গায়ে ঠেস দিয়ে। মিটসেফের মাথার ওপর বেজে চলত সন্তোষ রেডিওর বিবিধ ভারতী। টলটল করতে করতে পড়ে যাবার উপক্রম হলেই পুনরায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত সে। তারপর শুরু করত বকবক। বোবা বাচ্ছার সাথে এত কি বকবক করতে তুমি জ্যাঠাইমা? আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠা হাসির অর্থ কি ভাবে ধরতে তুমি জ্যাঠাইমা?
হাঁটতে শিখলাম, মুখে খই ফুটল। বাবা-মা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরীর নার্সারিতে। ভোর ভোর ইস্কুল। ঘুম থেকে তুলে জামা পরিয়ে কোলে করে ঘর থেকে বের হত মা। তারপর কোলে তুলে নিত পিসি। গোটা দোতলার দালান আর সিঁড়ি পিসির কোলে চেপে নামার সাথেসাথেই, খপ করে কোলে তুলে নিত জ্যাঠাইমা। একতলার দালান থেকে বেরিয়ে, রোয়াক টপকে, চারটে সিঁড়ি ভেঙে, বিশাল উঠোনকে কোণাকুণি পার করে, দেড়শ বছরের সদর দরজাটার সামনে এসে তুলে দিত বাবার কোলে।
ছোটবেলায় মা বলেই তো ডাকতাম, আর জন্মদাত্রীকে বলতাম মানা। কবে থেকে যে বদলে ফেললাম সম্বোধন, তা আর আজ মনে পড়ে না। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর আরও বেশী আঁকড়ে ধরেছিল জ্যাঠাইমা-
ভোরবেলা ঘুম ভাঙত জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়ার গন্ধে, আর সন্তোষ রেডিওর “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়” শুনে। যে টিনের মিটসেফের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছিলাম, ডিঙ্গি মেরে তার মাথায় উঁকিঝুঁকি মারতাম বেলা নটায় বিবিধ ভারতীর রঙ্গারঙ্গ কার্যক্রম শোনার লোভে। ভারত বিস্কুটের সেই বিজ্ঞাপনটা আজও মনে আছে, “কি গো নাতনী, আমায় বিয়ে করবে নাকি? ইশ্ তুমি বুড়ো। ” শেষে ভারত বিস্কুট প্রাপ্তির লোভে যেখানে শিশুকন্যাটি রাজি হয়ে যেত বুড়োকে নিকে করতে। অথবা চেশমি গ্লিসারিন সাবানের বিজ্ঞাপন। আর হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স? শনিবারের বারবেলা শুনতে শুনতে আরো তলিয়ে যেতাম জ্যাঠাইমার ভুঁড়ির তলায়।
বাবামায়ের রক্তচক্ষুর আড়ালে প্রথম চায়ের কাপ তো জ্যাঠাইমাই ধরিয়েছিল। বড় বেশী ন্যাওটা ছিলাম যে, যখন যাই করত পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। বিকালের চায়ের কাপটা কবে যে টুকুস করে তুলে নিলাম আর বিদায় জানালাম দুধের কাপকে আজ আর মনেও নেই।
কানে খোল জমেছে কিনা, আর মাথায় উকুন হয়েছে কিনা, দেখা ছিল জ্যাঠাইমার নেশা। ধরতে পারলেই কোলে ফেলে কানে ফোঁটা ফোঁটা সর্ষের তেল ঢেলে, হেয়ারপিন নিয়ে লেগে পড়ত কান সাফ করতে। জীবনের প্রথম শাড়ি, উপহার পেয়েছিলাম জ্যাঠাইমার থেকে। চুনেহলুদ রঙের খোলে জরির বুটি আর সবুজ পাড়। দ্বিতীয় বছর কমলা খোলের ওপর বেগুনী রঙা সুতোর কাজ। আজও চোখে ভাসে শাড়ি দুটো।
জ্যাঠাইমার হারমোনিয়ামটা ছিল সত্যি সত্যি পদী পিসির বর্মী বাক্স। সন্ধ্যে নামলেই গলা সাধতে বসত জ্যাঠাইমা। যেদিন অনুগ্রহ করে স্পর্শ করতে দিত,সেদিন যে কি ফূর্তি-।
শালকিয়ায় স্বর্গীয় অনল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে যেত জ্যাঠাইমা। শিখে আসা গান, দোতলায় রেওয়াজ করতে বসলেই, একতলার উঠোনে ভ্যাঙাত বাবা। বাবার ভয়ে “পিলে পিলে হরিনাম কা প্যায়ালা” তোলেনি জ্যাঠাইমা। অনলদাকে বলেছিল, “এই গানটা ধরলে আমার মেজো দেওর আর আস্ত রাখবে না আমায়। দিনরাত ঐ গান গেয়ে ঘুরবে আমার পিছু পিছু। ” এই গল্পটা বাড়ি এসে বলাটাই কাল হল। কতদিন যে বাবা জ্যাঠাইমাকে দেখলেই প্যারডিটা গাইত তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে পাওয়া জ্যাঠাইমার সার্টিফিকেট গুলো সযতনে বাঁধিয়ে রেখেছিল জেঠু। আর ছিল একটা সাদাকালো ছবি, জেঠু-জ্যাঠাইমা আর নেতাজীর মত পোশাকপরা ছোট্ট দিদিভাই। দোতলায় উঠলেই চোখে পড়ত- বহুদিন বন্ধ ঐ তরফের অংশটা। উই ধরে গেছে নির্ঘাত।
সিনেমা দেখার কি নেশা ছিল জ্যাঠাইমার। প্রতি শুক্রবার স্কুল থেকে ফেরার পর, জিজ্ঞাসা করত জ্যাঠাইমা- নবরূপমে কি সিনেমা চলছে রে? আর শ্রীরূপায়? সিনেমা দেখার তাড়নায় কতবার যে দুপায়ে দুরকম চপ্পল পরে চলে গেছে জ্যাঠাইমা। সেসব ইতিহাস আজও গুমরে গুমরে ঘোরে চাটুজ্জে বাড়ির বন্ধ অংশটায়।
একবারই পুরী নিয়ে গিয়েছিল জেঠু। বাড়ি থেকে রওণা দেবার সময় ঠ্যাং ছড়িয়ে কেঁদেছিলাম আমি, “ও জ্যাঠাইমা, তুমি যেও না গো। ” আর হাওড়া স্টেশনে কেঁদেছিল মুনাই, আমার একমাত্র বোনঝি তথা জ্যাঠাইমার প্রাণাধিক নাতনী। পরিণতি কি হয়েছিল বলুন তো? জবরদস্তি বেড়াতে নিয়ে আসার অপরাধে গোটা পুরী ট্রিপে জেঠুর গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছিল জ্যাঠাইমা। কোথাও নামেনি, কোথাও যায়নি। শুধু একগাদা উপহার কিনে এনেছিল সবার জন্য। বাড়ি ফিরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল জেঠু, “এই মহিলাকে নিয়ে? আর কোত্থাও নয় বাবা। ”
তখন বোধহয় ষষ্ঠ শ্রেণী, মস্ত অপারেশন হয়েছিল জ্যাঠাইমার। বেডে যখন দিল, তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে অস্ফুটে ডেকে চলেছে দিদিভাইকে। হাত ভর্তি কাঁচের সোনালী সবুজ চুড়িতে ঝিলিক মারছিল নার্সিং হোমের টিউবলাইটের আলো। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই দৃশ্যটা। দিন তিনচার পর দেখতে গেছি জেঠু আর আমি, ও হরিঃ, বেড ফাঁকা। আয়া মেয়েটিকে পটিয়ে পাটিয়ে রিক্সা ডাকিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে জ্যাঠাইমা। "নার্সিংহোমে আবার কেউ থাকে? ম্যাগো।" বাপরেঃ কি ডানপিঠে মহিলা-
কি যে অসম্ভব ভালো পিঠে পায়েস বানাত জ্যাঠাইমা। আর নবান্ন? সে তো অতুলনীয়। আমার হাতের যে লাল পায়েস খেয়ে মোহিত হয়ে পড়ে আমার শ্বশুর থেকে বর,মায় মেয়েটাও, তাতো জ্যাঠাইমার কাছেই শেখা। নিজে হাতে আমার বিয়ের শ্রী গড়েছিল জ্যাঠাইমা। ভেজেছিল আনন্দনাড়ু। বরণ করেছিল শৌভিককে। আর বিয়ের আগের রাতে যখন আলোকমালায় সজ্জিত চাটুজ্জে বাড়ি, শাঁখাপলা পরিয়ে নিয়ে এল দিদিভাই, সেই দৃশ্য দেখে সে কি কান্না জ্যাঠাইমার। “রুণা চলে যাবার পর, তোকে বুকে নিয়ে সামলেছিলাম এতদিন, এবার তুইও-”।
আমি তো কোথাও যাইনি জ্যাঠাইমা, সরকারী ভাবে আমার ঠিকানা যাই হোক না কেন, হৃদয়ের আস্তানা আজও ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। নাকে আজও তোমার, দিদির আর মায়ের আঁচলের গন্ধ। আজও তোমার হাতে বানানো পায়েস পিঠে মালপো নাড়ুর কথা ভাবলে জিভে জল আসে। আজও প্রাণ চায় তোমার সন্তোষ রেডিওতে বিবিধ ভারতী শুনতে। জানি হবেই দেখা আবার। হয়তো অন্য কোন খানে, অন্য কোন সময়। মাঝে শুধু কয়েকটা বছরের প্রতীক্ষা মাত্র।
পুনশ্চঃ আজ দুপুর দুটো নাগাদ যখন দিদিভাইয়ের ফোনটা এল, একেবারেই সিরিয়াসলি নিইনি। ও মাঝেমাঝেই অমন ফোন করে, যখনই জানতে পারে নতুন কোন তথ্য বা টোটকা, ফোন করে জানায়। ভেবেছিলাম তেমনি- চমক ভাঙল, বুকফাটা হাহাকার শুনে, “মা অার নেই রে বোন। টিভি দেখতে দেখতে, তিনটে হেঁচকির মত- ব্যাস সব শেষ হয়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না আমি। ” এর থেকে বড় মিথ্যে হতে পারে না দিদিভাই, তুমি যে সেবা করেছ নিজের বাবা-মায়ের, চাটুজ্জে বাড়ির কোন মেয়ে আজ অবধি করতে পারেনি। অবশ্যই দিদি থুড়ি পিসিকে ছাড়া। তবে সেই সময়টাও তো ছিল অন্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি বিচার করতে হয়, তো আমি জোর গলায় বলতে পারি,তুমি অনন্যা। সত্যি আমি তোমার ছোটবোন। তোমার শিক্ষার্থী। ছবিতে পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বাড়ির রোয়াকে, পেতে রাখা চেয়ারে তিনজন-জ্যাঠাইমা,বুুল্লু বাবু আর পুঁচকেটা আমার তুত্তুরী। এদৃ্শ্য আর কখনই দেখা যাবে না। এই গল্পের এখানেই যবনিকা পাত।
চিত্র সৌজন্য- শ্রীঅয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment