কেস মিটে যাবার পরও লোক গুলো কেন যে আসে? বারবার আসে, শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়, চেম্বারের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারে, তারপর একফাঁকে সাহস জুটিয়ে গলিয়ে দেয় মুণ্ডু,“ম্যাডাম আসব?”
তা মশাই কেন আসবেন না? আসতেই পারেন, আপনাদের জন্যই বসে আছি, তবে অনুগ্রহ করে এটা ভেবে নেবেন না যে আমি আপনাকে দত্তক নেব বা নিয়েছি। একবার আপনার কর্মসিদ্ধি হয়েছে বলে কর্মক্ষেত্রের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সমস্যা নিয়ে আমাকে জেরবার করতে করাটা কিন্তু মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। নাঃ বলি না এই কথাগুলি, তবে ভাবি বটে।
বিশেষতঃ অমুক বাবুকে দেখলেই এটা ভাবি, বহুযাতনায় ওণার কাজটা ফেরৎ দিতে পেরেছিলাম। তারজন্য উচ্চ আদালতের জনৈক অ্যাডভোকেটের প্রচুর আইনি গালি খেতে হয়েছিল বই কি, তবে ভদ্রলোকের কার্যোদ্ধার হয়েছিল। আগেও লিখেছিলাম বোধহয় ওণার গল্পটা, ছোট কোন আধা সরকারী দপ্তরে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার পদাসীন ছিলেন ভদ্রলোক। তহবিল তছরুপের অভিযোগে রাতারাতি ওণাকে বরখাস্ত করা হয়।
তখন আনলক ডাউনের প্রথম অধ্যায়, আপিস প্রায় জনশূণ্য। বাজারের থলে ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে উনি এসেছিলেন আমার দপ্তরে। পদের সাথে ম্যানেজার শব্দটি জুড়ে দিলেই তিনি আর শ্রম আইনের অাওতায় পড়েন না। সম্ভবতঃ আইন প্রণেতারা ধরেই নিয়েছিলেন যে ম্যানেজার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’রা মোটেই শ্রমিক ক্যাটেগরিতে পড়েন না, তাই শ্রম আইনের নিরাপত্তা তাদের জন্য নয়। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও। চোখের সামনে তাদের শোষিত হতে দেখলেও হাত-পা বাঁধা আমাদের।
ফিরে যাই অমুক বাবুর গল্পে, ওণার পদের সাথে ম্যানেজার লেজুড় থাকলেও,বেতন যে কোন সিকিউরিটি গার্ডের সমান। যুগপৎ ওণার কাগজের দিস্তা ঘেঁটে বার করা নথি ঘেঁটে যা দেখলাম, ওণার দপ্তর ওণাকে লিখিত নির্দেশনামা দিয়েছিল, ই ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করা যাবে। লকডাউন ঘোষণার দিন উনি লাখ দশ-পনেরোর একটি দপ্তরী চেক নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করেন, চেকটার ফটোকপিতে স্পষ্ট যে উচ্চ পদাধিকারীদের সই থাকলেও, ক্রশ করা ছিল না।
সেইসময় ব্যাঙ্কের ওপর যে অসীম চাপ ছিল হয়তো সেই কারণে অথবা জানি না কেন চেকটি দপ্তরের অ্যাকাউন্টে না ক্রেডিট হয়ে অমুকবাবুর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ক্রেডিটেড হয়। তারপর করোণার দাপটে ঘুমিয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। টানটান লকডাউনের আড়ামোড়া ভাঙা মাত্রই আপিসে গিয়ে সমগ্র ব্যাপারটা বুঝতে পারেন অমুক বাবু। সেইদিনই সমগ্র টাকাটা আবার দপ্তরী অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেন এবং সততার পরাকাষ্ঠা হয়ে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট তুলে সমগ্র ব্যাপারটা দপ্তরের গোচরে আনেন। তার পরের দিনই ওণার চাকরী যায় এবং শুরু হয় আমার দপ্তরে আনাগোণা।
নাই পড়ুক ব্যাপারটা শ্রমআইনে, কোন কর্মচারী যদি কাজ হারিয়ে আমার দ্বারস্থ হন, তাঁকে দেখা আমার কর্তব্য। সেই মোতাবেক ওণার চিঠির কপি ওণার দপ্তরে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, কেসটা কি? বাঁধাগতে জবাব পেলাম তহবিল তছরূপের অভিযোগে ওণার চাকরী গেছে ইত্যাদি।
পরের ধাপে ডেকে পাঠানো হল ঐ সংস্থার সচীব এবং সভাপতিকে। সচীব এলেন না বটে, সভাপতি এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোক সত্তরোর্দ্ধ, এককালে সরকারী কর্মচারী ছিলেন। একবাক্যে মেনে নিলেন, ছাঁটাই সম্পূর্ণ বেআইনি। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলেই কাজ হারিয়েছেন অমুক বাবু। নাঃ লাল-নীল-কমলার দ্বন্দ্ব নয়, সবাই একই রঙের অনুগামী নিছক গ্রাম্য দলাদলী রাজনীতির বলি অমুক বাবু।
বললাম, লিখে দিতে পারেন, যে কাজটা অনৈতিক হয়েছে? আধঘন্টার মধ্যে কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে চিঠি লিখে আনলেন বৃদ্ধ। ভাবলাম কেল্লা ফতে! সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার আগেই এল মোটকা চিঠির বাণ্ডিল, যাতে সংস্থার বর্তমান ম্যানেজার জানালেন যে, ঐ সভাপতি বা সচীবের কথার কোন গুরুত্ব আজ আর নেই, কারণ বোর্ড ভেঙে গেছে। নতুন বোর্ড না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রশ্ন নেই।
খোঁজ পত্তর করে দেখা গেল জনৈক জেলাস্তরীয় অফিসার আপাততঃ ঐ সংস্থার দায়িত্বে। তাঁকেই চিঠি লিখে জানানো হল, ব্যাপারটা একটু দেখুন। এইভাবে রাতারাতি মুখের কথায় কাউকে বিতারণ করা যায় নাকি? আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো দিতে হত? যথোপযুক্ত এনকোয়ারি করতে হত। চুরির অভিযোগ হলে পুলিশে জানাতে হত, তারপর না হয় আপনাদের নিজস্ব আইনানুসারে ওণার বিচার হত।
আমার চিঠিটাই ঐ সংস্থায় পাঠান জেলার অফিসার, সাথে সাথে নির্দেশ দেন অমুক বাবুর চাকরী যাওয়া বেআইনি, অবিলম্বে ওণাকে পুনর্বহাল করতে হবে। ভাবলাম মধুরেন সমাপয়েৎ। তারপরই উচ্চ আদালতের অ্যাডভোকেট মহাশয়ের শাসানি চিঠি। “একদম আপনার এক্তিয়ার বহির্ভূত ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ফের যদি নাক গলিয়েছেন ভালো হবে না কিন্তু। ”পত্রপাঠান্তে জনৈক ব্যাচমেটের কথা মনে পড়ছিল, যে কোন এককালে অমন শাসানি চিঠি সম্পর্কে বলেছিল,“ওগুলো তো ট্রফি রে-।”
আমি ট্রফি পেলাম,উনি কাজ ফেরৎ পেলেন। আবার কি চাই? জীবন এগিয়ে চলছিল নিজের মত। তারপরও দুবার তিনবার এসেছিলেন অমুক বাবু, নালিশ করছিলেন না না সমস্যা নিয়ে। উনি পুলিশকে জানিয়েই কাজে যোগ দিতে যান, তাও ওণার নামে পুলিশে নালিশ করতে যায় ওণার দপ্তর। ওণাকে কোন কাজ দেওয়া হচ্ছে না, সই করা নিয়ে নিত্য অশান্তি চলছে ইত্যাদি।
প্রতিবারই এক কথা বলতাম, এগুলো সত্যিই আমার এক্তিয়ার বহির্ভূত। আপনি জেলার অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন। প্রতিবারই উনি বলতেন, “গিয়েছিলাম তো ম্যাডাম। উনি প্রতিবারই এককথা বলেন, ‘আমি কি করব? আপনি বরং ম্যাডামের কাছেই যান। যা করার উনিই করতে পারবেন-’। ” এতো মহাজ্বালা!
সম্প্রতি আবার এসেছিলেন ভদ্রলোক, আরো অনেকটা কৃশ হয়েছেন। গাল ভর্তি দাড়ি। উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ। সেই থেকে বেতন পাননি। আপিসে নিত্য অশান্তি। হতাশ হয়ে বললেন, “আমাকে ওরা নেবে না ম্যাডাম। জলে বাস করে আর কতদিন কুমীরের সাথে লড়ব? ভাবছি ছেড়েই দেব কাজটা। ” শুনলাম সেই থেকে বেতন পাননি ভদ্রলোক।
আমার সমস্ত মেহনত, মস্তানি, খিস্তি খাওয়া সব ব্যর্থ হয়ে গেল হয়তো, তবে কাজ করবেন কি ছেড়ে দেবেন ওণার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও বললাম, খোদ রাজ কর্মচারীর ফরমান ওণার পক্ষে, আরেকবার তাঁকে গিয়েই বলুন না হয়। জবাব পেলাম, উনি হয় বলেন সবুরে মেওয়া ফলবে নয়তো আমায় দেখান। ভালো জ্বালায় পড়েছি তো। সাধে দত্তক নেবার কথাটা মাথায় আসে। তাহলে তো একটাই রাস্তা খোলা, ন্যায়ালয়ের শরণাপন্ন হয়ে দেখুন। এক্ষেত্রে সবাই একই কথা বলেন, আদালতের চক্করে পড়ার মত সময় বা অর্থবল থাকে না এদের। জেলা আইনি সহায়তা কেন্দ্রের আইনজীবি বিনা মূল্যে কেস লড়েন বটে, তবে যদি বাদী মহিলা হন। সংরক্ষিত জনজাতি বা পিছড়ে বর্গের জন্যও বোধহয় নানা আইনি সুযোগ আছে। হয়তো সাধারণ শ্রেণীর জন্যও কিছু থাকতে পারে, ওদের কাছে গিয়েই দেখুন না। তাও যাবেন না অমুক বাবু।
“আমায় চোর বদনাম দিয়ে তাড়িয়ে দিল, কেউ পাশে থাকেনি। আপনি কেবল আমার কথা শুনেছেন। আপনার চেষ্টায় কাজ ফেরৎ পেয়েছি। বেতন না পেয়েও আপনার কাছেই ছুটে এয়েছি। যা করার আপনিই করুন। দয়া করে ফিরিয়ে দিয়েন না ম্যাডাম। ” এতো মহাজ্বালা! যে রাজনৈতিক ঘুর্ণির মধ্যে পড়তে চাই না, তাতেই টেনে নিয়ে যাবে লোকটা।
বেতন না পাওয়াটা অবশ্য সত্যিই আমি দেখতে পারি। “বেতন পাচ্ছি না ম্যাডাম” আমাকে উদ্দেশ্য করে বাংলা হরফে লেখা চিঠিটা পাঠিয়ে জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গোচরে আনার চিঠি করে বললাম, এতে কিছু হবে বলে মনে হয় না। আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার কিন্তু আদালতই ভরসা-
গতকাল মেলার তাড়া তাড়া চিঠিপত্র নিয়ে ব্যস্ত, ছুটে এল ধীমান,“ম্যাডাম, অমুক বাবুর এই চিঠিটা কি নেবো?” আবার কি চিঠি দেয় রে বাবা লোকটা। এদের চিঠির দাপটে পাগল হয়ে যাব যে, চোখ বোলাতে গিয়ে দেখি, এটা উনি লেখেননি, লিখেছেন জেলার অফিসার। লিখেছেন অমুক বাবুর দপ্তরকে, আমায় কপি দিয়েছেন কেবল। চিঠিতে আমার পুরানো চিঠির অংশবিশেষ তুলে ধরে গোটা গোটা মোটা মোটা কালিতে অফিসার মশাই লিখেছেন,“ উনি বলার পর, আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম অমুক বাবুকে চাকরীতে পুনর্বহাল করার। করেননি কেন? ওণাকে বেতন দেননি কেন? অবিলম্বে অমুকবাবুর সমস্ত বেতন প্রদান করে আমাকে জানান। ”
বুঝতে পারলাম না, এতে আমার সমস্যা মিটবে না বাড়বে। হয়তো আবার শমন পাঠাবেন কোন উকিল মহোদয়, এক্তিয়ারের লক্ষণরেখা পার করার অনুযোগ তুলে। হয়তো আসবে কোন ভারী রাজনৈতিক ফোনও। অথবা ফোন যাবে আমার অনেক ওপরতলায়- যা হবার হবে, হোক। অত ভাবলে কি আর লেবারগিরি করা যায়! মুখে যাই বলি, কলম যাই বলুক, আবার যদি এমন কেউ এসে আমার দ্বারস্থ হন, আমার সর্বশক্তি নিয়ে আমি আবার তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব- অতঃপর যা হবে, দেখা যাবে। দত্তক নেবার কথাটা বোধহয় তাই মাথায় আসে। যাই হোক শুভ বড়দিন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল। খুব ভালো থাকুন সকলে।
No comments:
Post a Comment