Tuesday 1 December 2020

অনির ডাইরি ১লা ডিসেম্বর, ২০২০

 

মারি ম্যাম জানতে চাইছেন, “ আপনাদের কোন প্রশ্ন আছে কি? বা কোন মতামত? পরামর্শ?” সবাই চুপ। কম্প্যুটরের ওপাশে মারি ম্যামের পেলব ত্বকে পিছলে যাচ্ছে আলো। নাঃ আমার কোন প্রশ্ন নেই, তবে কিছু বলার আছে। বলতে দিচ্ছে কই তুত্তুরী? বলতে গেলে স্পেস বারে আঘাত করে আনমিউট করতে হবে তো নিজেকে। আষ্টেপৃষ্ঠে আমার আঙুলটাকে চেপে ধরে আছে তুত্তুরী। এই মেয়েটার সবে তে মাতব্বরী। 


একটু আগে পোশাক বদল করা নিয়েও আমার পিছনে পড়েছিল বাপ আর মেয়ে। ভার্চুয়াল পেরেন্টস্ টিচার মিটিং এর জন্য খামোখা কেন ভালো জামা পরছি? ছেঁড়া নাইটি পরে বসলেই বা কি? বড়জোর মধ্যপ্রদেশ অবধি দেখা যাবে তো কেবল-। ঠিক যেমন জুম ক্লাসে বসে তুত্তুরী। ধোপদুরস্ত সাদা শার্ট, গলায় টাই আর তলায় ইজের। আজও তেমনি বসেছে আপদটা। অথচ ম্যামের সুস্পষ্ট নির্দেশ, বাচ্ছারা যদি আপাদমস্তক স্কুল ড্রেস না পরে, তাহলে এই মিটিং এ বাবা-মাদের প্রবেশ নিষেধ। 


মারি ম্যাম বড় ভালো কি না। ফিরিঙ্গি ভাষায় হলেও, কেমনি মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলেন, তাই এই ডেঁপোগুলো ওণাকে পাত্তাই দেয় না। কতবার বলেছেন ম্যাম মাথায় সাদা কাপড়ের হেয়ার ব্যাণ্ড পরে তবে জুম ক্লাসে আসতে, অথচ রোজই উকুনে বুড়ির মত এক মাথা উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে ক্লাস করতে বসে তুত্তুরী। ম্যাম যখন জানতে চান,“হোয়্যার ইজ ইয়োর ব্যাণ্ড পুরোযা?” পুরোযা ওরফে তুত্তুরী নির্বিকার চিত্তে ভুলভাল ফিরিঙ্গি ভাষায় জানায়, "আমার মা কোথায় যেন রেখেছে, আর খুঁজে পাচ্ছি না।" বোঝ! 


আর ম্যামও তেমনি ভালো,  বলেন,“ নো প্রবলেম চাইল্ড।” তারপর অনুমতি দেন, যেটা খুঁজে পাচ্ছ,সেটাই পরে আমায় ধন্য করো মা। বড় বড় ঝুটো লাল গোলাপ ফুল ওয়ালা ব্যান্ড পরে ক্লাস করে তুত্তুরী। এরপর যদি ক্লাসের ছেলেরা ওকে “ফুলটুসি” বলে খ্যাপায়,তো নালিশ করে তুত্তুরী। ভাগ্যে খ্যাপায়, তাই না মা জানতে পারে, কি গর্হিত অপরাধে অপরাধী তিনি। 


সত্যি বলছি, এমনি পড়াশোনাই যাও বা মাথায় ঢোকে, এই অনলাইন পড়াশোনা  আমার মাথার বেশ কয়েক ফুট ওপর দিয়ে যায়। ছকে বাঁধা প্রশ্ন, তার ছকে বাঁধা উত্তর, সেই উত্তর লিখে সবার ফুল মার্কস পাওয়া- ভাগ্যে বড় মেসোমশাই জীবিত নেই, থাকলে নির্ঘাত বলতেন “ফুঃ ভজহরিঃ।” 


আচ্ছা আমরা কিন্তু ফুলমার্কস্ পাই না হ্যাঁ! আমি এবং তুত্তুরী।  আমরা ব্যাপক চেষ্টা করি, উত্তরপত্র স্ক্যান করার পূর্বে চেক করে আপলোড করি, তাও, ভুল হয় বানান। কাটা যায় অঙ্ক। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত হয় দাম্পত্যকলহ। হোক না চতুর্থ শ্রেণীর খেলনা পরীক্ষা, তাও, আমি কেন মিসের আগে তুত্তুরীর খাতা চেক করব? এই নিয়ে ভয়ানক উষ্মা প্রকাশ করে শৌভিক। এতো জুয়াচুরি। 


পুজোর আগের পরীক্ষাটায় তাই আর করিনি, অনেকগুলো পেপারে ২৫এ ২২/২৩ পেয়েছে তুত্তুরী।তাতেই হেব্বি খুশি আমরা, শতাংশের হিসেব যদি কষি, জীবনে এত নম্বর পেয়েছি আমরা দোঁহে? তবে ড্রয়িংটা করে দিতে হয়েছিল আমায়। সেকি জ্বালা বাপস্। 


পুজোর ছুটি পড়ার এক হপ্তা আগে শেষ পরীক্ষা, তাও আবার ড্রয়িং। মেয়ে বেঁকে বসল, অনেক পড়িচি, আর না। এমনিতেও তুত্তুরী ছবি আঁকলে D- থেকে C+ এর মধ্যে কিছু একটা পায়। মা আর কত খারাপ আঁকবে? ম্যাম তো দুটো টপিক দিয়েই রেখেছে, যে কোন একটা আঁকতে দেবে, “তুমি চিকেনটাই এঁকে রাখো মা। আই লাভ চিকেন-”। 


সে তো চিকেন আমারও মন্দ লাগে না। তাই বলে আপিস থেকে গলদঘর্ম  হয়ে ফিরে মস্ত বড় মুর্গি আঁকতে কার ভালো লাগে? শুধু মুর্গি আঁকলেই হবে না, পাশে কুঁড়েঘর, গাছপালা,গাছে ঝুলন্ত পাকা আম, ঢেউ খেলানো দিগন্তরেখা, নীলচে আকাশ, তাতে সোনার থালার মত সূয্যি মামা,পেঁজা তুলোর মত কয়েক খণ্ড মেঘ এবং পরিশেষে একজোড়া  উড়ন্ত মুক্ত বিহঙ্গও আঁকতে হবে। মা গো!


কি যে আঁকলাম জানি না, প্রথম চোটে মুর্গিটা কেমন যেন পেট মোটা হাতির ছানা হয়ে গেল, তারপর উড়ন্ত আপ্পু হল- সেই দেখে বাপ আর মেয়ের কি হাসি! শুধু আঁকলেই তো হল না, রঙ করা, মার্জিন কাটা সব করে দেবার পর, তিনি ট্যারাব্যাঁকা হস্তাক্ষরে নিজের নাম-ক্লাস-রোল নং লিখে আমাদের যুগপৎ ধন্য করলেন। অতঃপর স্ক্যান করে পিডিএফ বানিয়ে ঘুমাতে গেলেন।  


পরদিন পরীক্ষায় এল মৎস শিকারী সারস। ছিমতী তুত্তুরী তখনও যোগনিদ্রায় সমাহিত। ঘাড় করে ঘুম থেকে তোলার পর তিনি সারা বাড়ি কাঁপিয়ে গর্ গর্ গর্ করে গজরে বেড়ালেন মিনিট দশ। অতঃপর বসলেন আঁকতে। তারপর কি হল জানি না, কারণ আপিসটাকে তো রাখতে হবে- 


সেই আর্ট পরীক্ষায় সম্প্রতি B+ পেয়েছে তুত্তুরী। যে ছবি এঁকে রঙ করতে আমার পাক্কা সোয়া দুই ঘন্টা লেগেছিল, তিনি সেই কাজ কি করে যে পৌনে ঘন্টায় সারলেন তা এক বিস্ময় বটে। আসলে বিস্ময় নয়, সমস্তটুকুই স্যার এবং ম্যামদের কারসাজি। বহুদূরে বসেও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দ্বারাও যেভাবে ওণারা স্পর্শ করে চলেন আমার সন্তানের মন আর মাথা, কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। আমি তো একটি নিয়েই গলদঘর্ম , আর ওণারা এত গুলো পগেয়া পাজিকে একসাথে নিয়ে চলেন-তুত্তুরীর হাত ছাড়িয়ে, কবেকার তারাসুন্দরীর আধো আধো ইংরেজিতে সেটাই জানালাম ম্যামকে, “অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। এই মনখারপের বছরেও ভাগ্যিস আপনারা পাশে আছেন। ”

No comments:

Post a Comment