Tuesday, 22 December 2020

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর ২০২০

 


ঈশ্বরপ্রীতি অবশ্য আমারও ঐ বয়সে ভয়ানক রকমের ছিল। আহাঃ বেঁচে থাকুক বাঙালীর বারো মাসে তের পার্বণ, আরো উপোস তিরেস করুক মা- ঠাকুমা-পিসি, দিনান্তে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হোক উপাদেয় নানা পদ। যেমন জয় মঙ্গলবারের ফলার- উঃ ভাবতেই জিভে জল আসে। চিঁড়ে, দুধ, চিনি, আম আর কলা একসাথে মেখে যে কি অমৃত তৈরি হয়, তা যারা ঠাকুমার হাতের ফলার খায়নি জানতেও পারবে না।


 অথবা জ্যাঠাইমার হাতের সাবু মাখা। রাত ভর ভিজিয়ে রাখা উড়ের দোকানের সাবুতে চটকানো হত কড়ে আঙুলের মাপে কাঁঠালি কলা, নারকেল কোরা আর বাতাসা। সাবু নিয়ে অবশ্য রীতিমত অবসেসড্ ছিল জ্যাঠাইমা। পার্বণে হয় সাবু মাখা নয়তো সাবুর খিচুড়ি তো হতই, এর বাইরেও কারো হাঁচি কাশি পেটগরম হলেই বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি দুধ সাবু নিয়ে হাজির হয়ে যেত জ্যাঠাইমা। সাবু খেলে নাকি পেট ঠান্ডা হয়, তাই বেহারী গোয়ালার জল ঢালা ট্যালটালে দুধকে একটু বেশী ফুটিয়ে ঘন করে, তাতে এলাচ আর তেজপাতা দিয়ে প্রস্তুত হত মিষ্টি মিষ্টি দুধসাবু। আজ লিখতে লিখতে জিভে জল এলেও সেদিন ছুঁয়েও দেখতাম না। 


জ্যাঠাইমার সাবু আর ঠাকুমার বার্লি দুটোকেই সমান ভয় পেতাম আমরা। আর ভয় পেতাম পিসির দশহরার দিন ঘুম ভাঙিয়ে কাঁচা দুধ আর কাঁচা উচ্ছে খাওয়ানো। বাপরেঃ সে যে কি অসীম যাতনা। না খেলে নাকি মনসা দেবী চটে যাবেন- সাংঘাতিক ভিড় হত সেদিন গলির মনসা তলায়। কবেকার বুড়ো ফণিমনসা গাছের নাতির নাতির চরণে জমা হত পুজোর নানা উপাচার। কথিত আছে বড় জাগ্রত এই মনসাতলা। নিঃসন্তান দম্পতিরা পুত্রার্থে (সন্তানার্থেই হয়তো) মানত করত ক্ষীরের পুতুল। মনসাতলায় ক্ষীরের পুতুল থেকেই আমাদের গলির নাম ক্ষীরেরতলা। বুড়ি মনসা এখনও আছেন বটে, তবে উল্টোদিকে কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এক বুড়ো শিব, তাঁর গ্ল্যামার অার ঐশ্বর্যের কাছে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে সাবেকী বাংলার ছাপোষা লোকদেবী।  


মোটকথা আমার মেয়েবেলায় ঈশ্বর আর সুখাদ্যের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক।  ঈশ্বরচেতনার অনেকটা জুড়েই বিরাজ করত আটা বা ময়দার সিন্নি, লাল আটার ফুলকো লুচি, ফলার, খিচুড়ি, গলির মুখের ঘোষ ব্রাদার্সের নারকেল ছাপা, চন্দ্রপুলি, দানাদার। তাছাড়া পায়েস, মালপো, পিঠেপাটালি ছিল তো ছিলই।  


নিছক নিম্ন মধ্যবিত্তের হেঁসেল থেকে আসা এইসব অমৃত আজ নিজে বানালে কেমন যেন পানসে লাগে, তাও বানাই মেয়ের সাথে নিজের মেয়েবেলার কিছুটা আস্বাদ ভাগ করে নিতে। আর মেয়ে কি করে? স্বকর্ণে শুনুন না মশাই। দিবারাত্র বাড়িতে গুঞ্জরিত হয় দুর্গাস্তোত্র। আপিস থেকে ফিরে জুতো খুলে মুখ হাতপা ধুতে যাবার আগেই একবার শুনতে হয় দশ মহাবিদ্যা উপাখ্যান। তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরও বিশদে শুনতে হয়- তারপর আরো বিশদে- আরো- আরোও। 


দশভূজার গুঁতোয় অতিষ্ঠ হয়ে  যদি প্রকাশ পায় সামান্যতম উষ্মা, ছলছল আঁখি আর ধরা অভিমানী ফোন যায় অদূর হাওড়ায়। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে আক্রমণাত্মক বৃদ্ধা আর আহত বৃদ্ধের স্বর, “বড় নিঃসঙ্গ ও।” বুঝতে পারি, শুধু তুত্তুরী নয়, নিঃসঙ্গ ওরা তিনজনাই। আমার জীবনে যা ভয়ানক দুর্লভ, ওদের জীবনে তারই প্রাচুর্য। সময় অঢেল নেই শুধু যোগাযোগের সুযোগ। দূরভাষই রচনা করে  একমাত্র সেতু। আর সেই দূরভাষ আর অনেকটা সময়জুড়ে বিরাজ করেন এই কাল্পনিক রমণী। আমার চোখে যিনি উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট বা নারী স্বশক্তিকরণের প্রতিভূ।  তবে সে গল্প অন্য কখনও হবে না হয়। আপাততঃ যাই সবার মান ভাঙাই।

No comments:

Post a Comment