Wednesday 2 December 2020

পায়ের তলায় সর্ষে, ড্যামচি বাবুর দেশে-

 #ড্যামচি_বাবুর_দেশে 1

প্রৌঢ় পাথরের পাঁজরে ব্যথা জাগিয়ে খিলখিল করে হেসে দৌড়ল নদী, যেন প্রথম প্রেম প্রস্তাব পাওয়া সদ্য কিশোরী। জানেই না, জীবন পেতে রেখেছে কতবড় ফাঁদ। ঝপাং করে ঝাঁপ দিল নদী। পড়তে পড়তেও ধরে রাখল মুখের হাসি। কিন্তু সে অার কতকক্ষণ?

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10216355866716479&id=1449214651

খালি পায়ে এদের ওপর দিয়ে যেতে হবে,উশ্রী ফলসের ওপরে,রোমাঞ্চকর, কি বলুন?

পায়ের তলায় সর্ষে-

#ড্যামচি_বাবুর_দেশে -২

ঝাঁপিয়ে তো পড়ল নদী, কিন্তু এবার কি?

জীবন বড় রুক্ষ, নদী তা তো জানত না। 

অকালেই বৃদ্ধ হল,ভাঙল নদীর বুক। 

ক্লান্ত নদী বয়ে চলে, বদলে যায় ঋতু,

পাঁচটা ঋতু বদল হলে,হঠাৎ আসে সে। 

দামাল ছেলে বর্ষার তখন সোহাগ দেখে কে?

শরমে মরে নদী, খুশিতে মেশে ভয়, 

এই বুঝি সাড়ম্বরে শরৎ এসে হাজির হয়। 

উৎসবে মজে দুই পাড়,শুধু নদীর চোখে জল-

হাত ছাড়িয়ে বর্ষা বলে, “আমি তোমারই, আসব আবার কাল”।

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10216361556298715&id=1449214651


উশ্রী ফলস

তাহলে শেষ থেকেই শুরু করা যাক। এই মুহূর্তে আমরা বসে আছি,মধুপুরের লীলাকমল গেস্ট হাউসে। আসার পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘদিনের। জনৈক বন্ধুর মুখে বছর খানেক আগে শোনা ইস্তক আমার বরের আসার ইচ্ছা। প্রথম চোটে যাদের সাথে আসার কথা ছিল, আমাদের উভয়ের অনুজ প্রতিম এক দম্পতি, কিছু ব্যক্তিগত  সমস্যার জন্য তারা আর শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী হতে পারল না। বদলে যারা হল, তাদেরও কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য আসার পরের দিনই ফিরে যেতে হল। ফলতঃ আপাততঃ আপনি আর কপনি সম্বল। 


মধুপুর ঠিক সফিস্টিকেটেড ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয়। কে যেন শৌভিককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে,মধুপুরে আবার মানুষ আসে? তাতে আমার বর বেশ আহত। সত্যিই তো মধপুরে কেন আসবেন বলুন তো? পাঁচতারা বাদ দিন গোটা দুয়েক তারার হোটেলও মধুপুরে বিরল। নেই দাক্ষিণাত্যের  চকচকানি, বা উড়িষ্যার গৌরব। নেই হিমালয়ের উন্নাসিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নেই সমুদ্র। নেই কোন মল-মাল্টিপ্লেক্স বা নিদেন ঝাঁ চকচকে মার্কেট। 

তাহলে মধুপুরে কেন আসবেন? আসবেন তখনি যদি আপনি শৌভিক বা অনির মত গবেট হন। আসবেন যদি ছোটবেলায় পড়া এবং সাদাকালো সিনেমায় দেখা বাঙালীর পশ্চিমের প্রতি আপনার দুর্বোধ্য টান থাকে। ব্যোমকেশ থেকে বরদা, প্রিয়তম শরদ্বিন্দু থেকে হাটেবাজারের বনফুল হয়ে বুদ্ধদেব বাবুর ঋজুদা, আমাদের ছোটবেলাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পশ্চিম। কত গল্প,কত স্মৃতি। মধুপুর জুড়ে এখনও বহু পুরাণো দিনের বাড়ি,যাদের মাথায় বা দরজার পাশের ফলকে বাঙলা হরফে লেখা বাড়ির নাম। সামনে সুদৃশ্য গাড়িবারন্দা। দেখলেই মনে হবে, আরাম কেদারায় বসে চা খাচ্ছেন স্বয়ং ছবি বিশ্বাস। পাশে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন ছায়াদেবী। এই তো চাদর জড়িয়ে আড্ডা দিতে যাচ্ছেন সদাহাস্যময় পাহাড়ি সান্যাল। ঐ দেখুন ধুতি পাঞ্জাবি পরে পাশ দিয়ে চলে গেলেন সৌমিত্র।শমিত ভঞ্জকে দেখে ঘোমটা টেনে সলজ্জ হেসে সন্ধ্যাদীপ দিচ্ছেন সন্ধ্যা রায়। দুদিকে বিনুনী দুলিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসছে তরুণী মহুয়া রায়চৌধুরী। মোদ্দা কথায় মধুপুর মানে এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া। 


যাই হোক ফিরে আসি লীলাকমলের ঘরে, এ ঘরে কোন বাহুল্য নেই। আসবাব বলতে একটি কিং সাইজের খাট, তাতে একটি ছোবড়ার গদি আর একটি তোশকের ওপর পাতা একটি চাদর। তিনটি পুঁচকে বালিশ,দুটি কম্বল। আলমারি একটি আছে বটে, তাতে তালা দেওয়া। দেওয়ালে তিনটি তাক, তাতেই আমাদের ঘড়ি-মোবাইল কানের দুল, বডি লোশন,চিরুনি ইত্যাদি রাখা। আর আছে তিনটি বেতের চেয়ার,একটি প্লাস্টিকের চাকা লাগানো টেবিল। লাল সিমেন্টের মেঝে। বাথরুমের মেঝেও লাল। বাথরুমের সাইজ আমাদের থ্রী বি এইচ কের মাস্টার বেডরুমের দেড়া। ঘরের লাগোয়া আর একটি ঘর। সেটিতে খাবার প্লাস্টিকের চেয়ার টেবল আছে বটে,তবে এরা চা ছাড়া ঘরে কোন খাবার দেয় না। খেতে হলে নীচের দালানে পেতে রাখা খাবার টেবিলে যেতে হয়। বড় ভালোবেসে খাওয়ান এরা। 

আমাদের ঘরের বৈশিষ্ট্য হল,ঘরের বাইরে বিশাল ছাত। এখানে লোডশেডিং হয়। এই মুহূর্তে যেমন আমরা তিনজন নিকষ আঁধারে শুয়ে বসে আছি। কলকাতায় লোডশেডিং দুর্লভ বলেই হয়তো এত ভালো লাগছে এই আঁধার। বাইরের ছাতে চাঁদের আলোয় বান ডেকেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রচ্চারণের মৃদু আওয়াজ। আজ গুরুপূর্ণিমা বলে কোথাও পুজো হচ্ছে। একটু আগে ঐ মন্ত্রের সুরে মিশেছিল সন্ধ্যাকালীন নামাজের সুর। বড় ভালোলাগল জানেন। যাই একটু ছাত থেকে ঘুরে আসি। বাতাসে কি অসম্ভব মিষ্টি একটা ঠাণ্ডা। আজই মধুপুরে আমাদের শেষ রাত। কাল ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ফিরব কি করে?একটু আগে মেসেজ ঢুকল,আমাদের কষ্টের কথা ভেবে ভারতীয় রেলের দুঃখের সীমা নেই,কারণ আমাদের ট্রেন ক্যান্সেল। 

পায়ের তলায় সর্ষে

ড্যামচি বাবুর দেশে ৪

তো যা বলছিলাম আর কি, ছাঁদা বেঁধে বেলা দুটোর পাটনা হাওড়া জনশতাব্দী ধরে মধুপুর যখন নামলাম ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়ের ঘরে ঢুকেছে বা ঢুকব ঢুকব করছে। মধুপুর স্টেশন থেকে লীলাকমল গেস্ট হাউস মাত্র এক কিলোমিটার। খবর দিলে ওণারাই গাড়ি পাঠান। স্করপিও গাড়ির ভাড়া পড়ে ১৫০টাকা। 

পশ্চিমে ঠাণ্ডা সদ্য পড়ছে,শহর জুড়ে নামছে হৈমন্তী কুয়াশা। রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাড়িঘোড়া নেই বললেই হয়। স্টেশনের ধারে দু চারটি মাত্র দোকান খোলা রয়েছে। যার একটিতে গরম গরম পকৌড়া ভাজা হচ্ছিল,এরা বলে পকোড়ি।হাল্কা শীতে গরম পকোড়ি, লোভ সামলানো দুষ্কর। পাশে এক চুপড়ি গরম নমকিন রাখা। সদ্য নেমেছে কড়া থেকে। সরু, সরু লম্বা লম্বা, অায়তাকার। খেতে অনেকটা আমাদের খাস্তা নিমকির মত, সাথে ইমলি আর মির্চার চাটনি। 

লীলাকমলের বিশাল গ্রীলের গেটের ভিতর অনেকটা বাগান। মূলতঃ গোলাপের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন বর্ণ এবং সাইজের গোলাপ। এছাড়াও নানা রকম ফুলের সমাহার। ফুলের পিছনে লুকিয়ে আছে ফুলকপি। শুনলাম এবারে বর্ষার হাল শোচনীয় বলে অনেক কম গাছ লাগানো হয়েছে। অন্যান্য বার নাকি গোলাপের সাথে ফুলকপি, আলু,পেঁয়াজের চাষ হয় দেখার মত। 

ঘরের কথা আগেই বলেছি। লীলাকমলের একতলার ঘরগুলির সাবেকী বিন্যাসের জন্য ভাড়া মাথাপিছু ৭০০টাকা। আর দোতলার গুলির মাথাপিছু ৬০০টাকা।  বাচ্ছাদের ভাড়া অর্ধেক। আমাদের ঘরের লাগোয়া ছাতের জন্য আমাদের ঘরটি দোতলায় হওয়া সত্ত্বেও ভাড়া ছিল ৭০০টাকা। দাঁড়ান এক্ষেত্রে ভাড়া মানে থাকা খাওয়া সমেত। সকালে এক কাপ চা আর বিস্কুট, প্রাতরাশে লুচি,হয় আলু চচ্চড়ি নয়তো ছোলার ডাল আর রসগোল্লা বা পান্তুয়া, দুপুরে ভাত, ডাল,একটা সব্জি,পাঁপড় ভাজা,আর মাছ/চিকেন/মাটন যেমন ফরমাইশ করবেন। সাথে জিভে জল আনা জলপাইয়ের চাটনী। সন্ধ্যায় আবার চা বিস্কুট। রাতেও দিনের মতই মেনু,তবে ভাতের বদলে রুটিও খেতে পারেন। শৌভিক জানিয়ে রেখেছিল রাতে খাসির মাংস খাবে। রান্না তুলনাহীন। গরম গরম পরিবেশন। রন্ধনশৈলীতে মেলবন্ধন ঘটেছে বাংলার সাথে ঝাড়খণ্ডের, সবকিছুই অতীব সুস্বাদু।  বিশেষতঃ ওদের বেগুন ভর্তার কোন তুলনা হয় না। 

দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৩/১১/১৮ সকাল সকাল পেট ভরে লুচি তরকারি খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব্য উশ্রী ফলস্,খাণ্ডুলী লেক আর বুড়া পাহাড়। আরও দুটি ট্যুরিস্ট স্পট আছে, এই পথে,সেগুলি হল তোপচাঁচী লেক আর বাকুলিয়া ফলস্। কিন্তু অপ্রতুল বর্ষার ফলে বাকুলিয়া ফলস্ শুকিয়ে গেছে। তোপচাঁচী লেক হয়ে দাঁড়িয়েছে এঁদো পুকুর। উশ্রী হল বরাকরের একটি উপনদী,গিরিডি থেকে ১৩কিলোমিটার দূরে গহিন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত উশ্রী ফলস এখনও মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা।তেনারা নাকি এখনও লুকিয়ে চুরিয়ে নজর রাখেন পর্যটকদের ওপর। ছবি তোলার ব্যাপারে একটু সাবধান থাকবেন। যদি ড্রাইভার নিষেধ করেন, না তোলাই ভালো। আমাদের ড্রাইভার যেমন না জেনে একবার একদল পর্যটক নিয়ে হাজির হয়েছিল উশ্রী,সেইসময় তেনাদের মিটিং চলছিল। কিছু করেনি অবশ্য কারণ ড্রাইভারের গল্প অনুসারে মাওবাদীদের সাথে নিকটবর্তী এলাকার গ্রামবাসীদের একটা চুক্তি আছে।  এখানে আগত ট্যুরিস্টদের ওরা পরম যত্নে ধরে ধরে ফলস দেখায়। জলে নামায়। বদলে কিছু টাকা পয়সা পায়। এটাই ওদের রুজি। সাধারণ মানুষের পেটে লাথ মারে না মাওবাদীরা। 

 ৩৯ফুট উঁচু থেকে উশ্রী তার জলরাশি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নীচে, চতুর্দিকে গোল নড়বড়ে মসৃন পাথর। গেলে কেটস্ বা স্নিকার পরে যাওয়াই শ্রেয়। নইলে পা মচকানো অবধারিত। স্থানীয়রা আপনাকে নিয়ে যাবে পাহাড়ের ওপরে,যেখানে নদী আপাত শান্ত। তবে জুতো খুলে চড়তে হবে। জুতা রক্ষার দায়িত্বও ওণাদের। এই শেষ নভেম্বরেও ভালো জল আছে উশ্রীতে। শুনলাম আর একমাস পরেই এই  অঞ্চল অগম্য হয়ে পড়বে। কারণ একে তো শুকিয়ে আসবে নদী,তারওপর পিকনিক পার্টির অত্যাচারে নোংরা পুতিগন্ধময় হয়ে পড়বে পরিবেশ। বিগত বছরের পিকনিকের শোলার থালা আমরাও দেখে এলাম,হাওয়ায় উড়ছে এপাশ ওপাশ। 

লীলাকমল গেস্ট হাউস, মধুপুুুর
কমে অাসছে জল,উশ্রী ফলস্ , গিরিডি

এখানে নির্জনতা চিরবিরাজমান। শব্দ করার অধিকার শুধু নদীর। আরেকবার উশ্রী। 

পায়ের তলায় সর্ষে

ড্যামচি বাবুর দেশে ৫

পরবর্তী গন্তব্য খাণ্ডুলি লেক। পশ্চিমের অন্যান্য লেক যেমন বুরুডি বা মাসাঞ্জোরের মতই খাণ্ডুলি। তবে জাঁকজমক অনেক কম। ভিড়ও কম। গোলাকার লেকের জল নীল। জলে ঝাঁক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরো শীত পড়লে নাকি ভিড় আরো বাড়ে। গাড়ি থেকে নামলেই ট্যাক্স দিতে হয়। গাড়ির জন্য কুড়ি টাকা। আর মানুষ পিছুও সম্ভবত গোটা কুড়ি টাকা করে। বাচ্ছাদের লাগে না। লেকের পাড়ে একটা ছোট্ট অ্যামিউজমেন্ট পার্ক আছে। তেমন কিছু না। আমাদের রথের মেলার মত। যদিও সেটা বন্ধ। উশ্রীর উত্তেজনার পর বেশ হতাশ লাগছিল। লেকের উল্টোদিকে গোটা দুই ওয়াচটাওয়ার। যার একটিতে সহজেই ওঠা যায়। অন্যটা পাহাড়ের গায়ে,ভালো চড়াই, তবে সিঁড়ি আছে। সর্বোপরি ঐ সিঁড়ির মুখে পৌঁছতে গেলে বিশাল পাইপ ডিঙোতে হয়। ভাগ্যিস সবাই পশ্চিমী পোশাকে সজ্জিত। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে গিয়ে বুঝলাম উচ্চতার জন্য এ পথ কেউ তেমন মাড়ায় না। সিঁড়ি ভেঙেছে,সর্বত্র ঘাস। নোংরাও বটে। জন্মে কেউ সাফ করে না। তবে ভিউ দুর্ধর্ষ। একদিকে ঘন নীল লেক, পাশ দিয়ে গোল করে লালচে মেটে পথ চলে গেছে,অন্যদিকে ধান ক্ষেত। যার রঙ কোথাও হলুদ,কোথাও হাল্কা সবুজ,কোথাও বা ন্যাড়া ধুসর জমি। আর গোটা মাঠ ঘিরে অসংখ্য পায়ে চলা লাল মাটির পথ। ওপর থেকে পরিযায়ী পাখিদের অলস জলকেলি বড়ই চিত্তাকর্ষক। দেখতে গেলে বাঁধের লাল মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হয়। সদ্য পড়া পশ্চিমা শীতের আদুরে রোদে ঐ পথ ধরে হেঁটে চলার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশে আমি অক্ষম। 

বাঁধের পথে যাওয়ার মুখে বেশ কয়েকটি চাটের দোকান। দেখে জিভে জল আসে। অন্য সময় হলে ঐ মেঠো ধুলো পড়া জিনিস খাব বললে নির্ঘাত শৌভিক তালাক দেবার হুমকি দিত। হয়তো আবহাওয়ার গুনেই নিষেধ করলনা। মা মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। দশটাকায় ছটি ফুচকা। আলুর সাথে অনেকটা ঘুঘনি মিশিয়ে তেলতেলে ফুচকায় ঠুসে পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি ছড়িয়ে তেঁতুল জলে চুবিয়ে খেতে দিল। খেয়ে সত্যিই বলছি তেমন ভালো লাগেনি। আরো খারাপ ওদের পাপড়ি চাট। পাপড়ি চাটে পাপড়ি তো থাকে,দই থাকে না। বদলে দেয় একগাদা ঘুঘনি ঢেলে। ওপরে পেঁয়াজ কুচি,এক খাবলা ঝুরি ভাজা আর লাল লোকাল টমেটো সস্ ছিটিয়ে ধরিয়ে দেয়। মূল্য তিরিশ টাকা। ঐ সব খেয়েও মরিনি বা গরহজম হয়নি কারো,আশা করি মধুপুরের জলের এর থেকে ভালো বিজ্ঞাপন হতে পারে না। 



ওয়াচটাওয়ারের পথে-

ওয়াচটাওয়ার থেকে এক ঝলক খাণ্ডুলি লেক-

ওয়াচটাওয়ার থেকে এক ঝলক খাণ্ডুলি লেক-

মেঠো বাঁধের ওপর থেকে নীলচে খাণ্ডুলি লেক-
খাণ্ডুলিতে নিরুপদ্রব পরিযায়ী পাখির দল-
সবে তো আনাগোনা শুরু,শীত যত বাড়বে,পাল্লা দিয়ে এনাদের ভিড় বাড়বে- 

পায়ের তলায় সর্ষে

ড্যামচি বাবুর দেশে -৬

পরবর্তী গন্তব্য বুড়া পাহাড়। এটা ছোটনাগপুর জনাব, এখানে তো সব পাহাড়ই বুড়া। তাহলে আর যাব কেন? এদিকে বেলা দুটো বাজে, ফিরে গিয়ে লাঞ্চ করতে হবে, ড্রাইভার বিড়বিড় করে বলল,“সবাই আসে তো। ভালো লাগবে। বুড়া বাবার মন্দিরও আছে। ” অগত্যা উপরোধে ঢেঁকি গেলা।  

শেষ নভেম্বরের মিষ্টি রোদের হাল্কা ওমে গাড়িতে বসে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচমকা প্রচণ্ড ঝাঁকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঢালু এবড়োখেবড়ো পথে গড়াতে গড়াতে গাড়ি যেখানে এসে থামল, নেমে মন ভরে গেল। এইরজায়গার নমষহওয় উচিত শান্তিনিলয়।  চারপাশে সত্যিই বুড়োহাবড়া ক্ষয়া ক্ষয়া পাহাড়। পাহাড়ের পাথর গুলো সময়ের আঁচড়ে ফোঁপরা হয়ে গেছে স্পঞ্জের মত। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কয়েকটি নিঃসঙ্গ নারকেল গাছ আর পটে আঁকা ছবির মত রাস্তা।  এণাদের মধ্যে যিনি বৃহত্তম,তাঁর বুকের ভিতর সযত্নে রক্ষিত একটি টলটলে পুষ্করিণী।বাঁধানো গোল সিঁড়ি সভয়ে স্পর্শ করেছে পুষ্করিণী পবিত্র অঙ্গ। সমগ্র অঞ্চল জুড়ে বিরাজমান অখণ্ড নিস্তব্ধতা আর শান্তি। অদূরেই বুড়াই বাবার মন্দির,বুঝতেই পারছেন আশা করি বুড়াই বাবা কে? আমাদের ভোলা মহেশ্বর। 

বুড়া পাহাড়ের কোলে,ঐ বাঁধানো পুকুর ঘাটে সারাদিন বসে থাকা যায়। প্রচণ্ড গরমেও নাকি এখানে শীতল বাতাস বয়। জনবিরল।বুড়ো পুরোহিত যদিও বললেন,সামনের মাসের তিন চার তারিখে ওখানে বিশাল মেলা বসে। তখন এত ভিড় আর নোংরা হয় বুড়াপাহাড়,যে না যাওয়াই মঙ্গল। 

লীলাকমলে যখন ফিরলাম প্রায় পৌনে চারটে। মুখ হাত ধুয়েই খেতে বসতে হল,খেয়ে উঠে পাথরোল কালি বাড়ি যেতে হবে। স্থানীয় পাঁচশ বছরের পুরাণো কালি মন্দির। খাবার বলতে গরম ভাত,মুসুর ডাল, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধা কপির তরকারি,পশ্চিমী মসলা পাঁপড় ভাজা, সর্ষে আর ধনে পাতা বাটা দেওয়া কাতলা মাছের অতীব সুস্বাদু ঝাল আর হাল্কা গুড়ের ছৌঁকা দেওয়া জলপাইয়ের জিভে জল আনা মিষ্টি চাটনী। 

খেয়ে যখন বের হলাম,সূর্য ঢলতে শুরু করেছেন পশ্চিমে। পাথরোল কালি বাড়ি আর পাঁচটা কালিবাড়ির মতই। গোলাকার চত্বরকে ঘিরে অনেকগুলি মন্দির। লোকজনের ভিড় তেমন নেই। মন্দির গাত্রে অসংখ্য লম্বাটে লালচে আঙুলের ছাপ। পুরোহিত মশাই বাঙালী।  ভাঙা বাংলায় বললেন,দিওয়ালির সময় স্থানীয় রমণীরা নতুন সিঁদুর কৌটো খুলে প্রথমে মন্দির গাত্রে পরায়, তারপর সারা বছরঐ সিঁদুরই রঞ্জিত করে সিমন্ত। পাথরোলের মায়ের মূর্তিটি বড় অদ্ভুত। চোখ গুলি রূপোর বলে কি না জানি না,কেমন যেন ধকধক করছে। অবশ্য কম আলোয় ভুলও দেখে থাকতে পারি। সন্ধ্যা নামছে,ঘরে ফেরার পালা। কাল যাব দেওঘর। বাঁদর আর হনুমানের মস্তানির আখড়া। এসে ইস্তক শুনছি তাদের অত্যাচারের উপাখ্যান। ক্যামেরা মোবাইল মায় ব্যাগটুকুও বোধহয় গাড়িতে রেখে যেতে হবে। তুত্তুরীকে চেপে ধরে থাকতে হবে,না হলে নাকি বাঁদরে আপনজন মনে করে টানাটানি করবে।  তবে সে গল্প আবার পরে,সুযোগ পেল বলা যাবে খণ। আপাততঃ গরম ভাত আর ঝাল ঝাল দেশী মোরগের ঝোল আমাদের প্রতীক্ষারত। সাথে ডাল,আলু পটল আর সেই মনমোহিনী বেগুন ভর্তা- উলস্। 

বুড়াই বাবার মন্দির।
বুড়ো পাহাড়ের ছোট্ট পুকুর।
এই জায়গায় নাম হওয়া উচিত শান্তিনিলয়।
বুড়াই বাবার মন্দিরের উল্টোদিকের পাহাড়ের মাথায় একাকী দেউল। কে জানে কার অধিষ্ঠান সেখানে?
বুড়া পাহাড়ের ফোঁপরা পাথর
পাথরোল কালিবাড়ির মা কালী।
পাথরোল কালিবাড়ি
পাথরোল কালিবাড়ি।

পাথরোল কালিবাড়ি।

পায়ের তলায় সর্ষে
#ড্যামচি_বাবুর_দেশে -৭
যবে থেকে মধুপুরে পা রেখেছি,শুনে আসছি বাঁদর আর হনুমানের উৎপাতের না না কিস্যা। ত্রিকূট পাহাড়ে যাবার নাম করতেই ড্রাইভার সাহেব বললেন,“স্যার,ওখানে কিন্তু ক্যামেরা লিয়ে যাবেন না। ম্যাডাম ব্যাগও গাড়িতে রেখে যান। আর বাবুকে চেপে ধরে রাখবেন।”কেন রে বাবা?সে বিষয়ে পরে জানাব-আপাততঃ রইল ত্রিকূট পাহাড়ে রোপওয়ে চড়ার ভিডিও। পারলে শুনে দেখুন গাইড কি বলছে-  বান্দরসেনা নিয়ে। শৌভিক প্রশ্ন করছে, ওপরে বাঁদর আছে কি না। কারণ নীচে যাকে বলে থিকথিক করছে গিজগিজ করছে লালমুখো বাঁদরের দল। গাড়ির দরজা খুলে টুক করে নেমে পড়েই ধড়াম করে দরজা বন্ধ করতে হল। নইলে তারা নাকি দল বেঁধে ঢুকে পড়ে। গাইড নিতেই হয়। কারণ বাঁদর বাহিনী ভয় পায় কেবল, গাইডকুলকে। তাদের প্রতেকের হাতে সদ্য ভাঙা গাছের ডাল এবং বাঁদর দেখলেই, সপাং-শব্দে পশ্চাতদেশে এক বাড়ি মারে। বাঁদরকুল ঐ বাড়ি খেয়ে পগার পার। তবে অনুগ্রহ করে গাইড বাবুকে নকল করার চেষ্টা করবেন না। ঐ ঠেট দেহাতী ভাষায় উদোম খিস্তি মারতে ভালো,নাহলে কিন্তু বাঁদরে প্রথমে ঝাঁপিয়ে আপনার লাঠি কেড়ে নেবে,তারপর ঘ্যাঁক করে দেবে কামড়ে। তারপর সদ্ব্যবহার করবে ঐ লাঠির। কি দরকার বাপু?

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10216390750308547&id=1449214651

পায়ের তলায় সর্ষে

#ড্যামচি_বাবুর_দেশে-৮

তপোবন কেন যাব? ওখানে কি আছে?প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার সাহেব,গাড়ি চালাতে চালাতে রজনীগন্ধা পানমশলার ভুরভুরে সুগন্ধ ছড়িয়ে বললেন,“তেমন কিছু না বউদি। ঐ কয়েকটা মন্দির আছে।”এদিকের মন্দির মানে সবই বুড়া পাহাড়ের মন্দিরের মত আভরণহীন, একচালা সিমেন্টের মন্দির। ইতিমধ্যে নওলখা মন্দির,বালানন্দ আশ্রম, অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম দেখে ক্লান্ত। আবার মন্দির? এমনিতে দেওঘর আসার আমার তেমন ইচ্ছা ছিল না। এসেছি শৌভিক আর তুত্তুরীর চাপাচাপিতে। ত্রিকূট পাহাড়ে নাকি রোপওয়ে চালু হয়েছে,সেই রোপওয়ে চড়বার প্রলোভন দেখিয়েই মূলতঃ তুত্তুরীকে আনা হয়েছে মধুপুর। আর শৌভিকের কাছে দেওঘর মানে পিওর নস্টালজিয়া। সেই কোন সুদূর শৈশবে এসেছিল, শ্বশুরমশাই তখন বীরভূমে মহম্মদবাজারের বিডিও। আড়াই তিন বছর বয়সী শৌভিক বাবার হাত ধরে ত্রিকূট পাহাড়ে চড়েছিল,সেই স্মৃতিই দেওঘর টেনে আনার মূল চালিকা শক্তি। 

তপোবনের সামনে গাড়ি থামতেই গোটা দুয়েক লোক এসে গাড়িকে ঘিরে ধরল, এরা হকার। হনুমানের খাবার বিক্রি করে। তপোবনে গিজগিজ করছে হনুমান। হকারদের সাথে এদের কনট্র্যাক্ট  আছে, খাবার দিয়ে দিলে আপনাকে বিব্রত করবে না। নাহলেই-

দুপ্যাকেট খাবার কিনে আমরা রওণা দিলাম। পথে বাজারের মধ্যে খুলে রাখতে হল জুতো। এক বয়স্ক ব্যক্তি পরম যত্নে আমাদের পথ দেখাতে লাগলেন। পরে বুঝেছিলাম উনি গাইড। এখানে গাইডরা আগে থেকে পরিচয় না, এমনি এমনি সহযাত্রী হয়ে পড়ে। পথের শেষে আপনি এমন ফাঁসবেন,যে ঐ গাইডই হবে আপনার ত্রাতা। 

প্রথমেই সাক্ষাৎ হয় একপাল হনুমানের সাথে। গাইডই বলে দেয়,“দিন। দিন খাবার দিন। ”শৌভিকের হাতের প্যাকেটটা একটা হনুমান এসে নিয়ে গেল। বেচারা তুত্তুরী, ওর হাতের প্যাকেটটাও বাড়িয়ে দিয়েছিল,হনুমানটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেল। আমার মেয়ে তারপর বেশ কয়েকটা হনুমানকে সাধল,“খাবি?খাবি?”কেউ খেল না গো। গাইড বলল,“দিল ছোটা মত করো জী। পেট ভরা হুয়া হ্যায় ইনলোগন কা। ” অতঃপর অনেক উঁচু থেকে একজন নেমে এসে হাত বাড়ালেন। তুত্তুরী তার হাতে ধরিয়ে দিল খাবার প্যাকেট, নিয়েও তিনি গেলেন না। সোজা এসে খপ করে জড়িয়ে ধরলেন শৌভিকের হাঁটু। তারপর করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার বরের দিকে। কোথা থেকে দৌড়ে এল পেঁড়াওলা। “দিজিয়ে সাব। দিজিয়ে। উসকো মিঠা খানা হ্যায়। ”থ্যাবড়া আটার গুলির মত দেখতে প্যাড়া কিনে দিতে হল। বিক্রেতাকেই বলা হল,পয়সা দিচ্ছি বাপ,তুই দিয়ে দে। হনুমান নাকি হনুমতী তাকে পাত্তাই দিল না। পাকদণ্ডীর ফুটপাতে বসে হাত বাড়াল শৌভিকের দিকে। বিক্রেতা এবং গাইড বলল,“সাব উহ আপকে হাতসে খায়েগা।” কি আব্দার মাইরি।

তপোবনের হনুমানকুল। এত সুসভ্য হনুমান কোথাও দেখিনি। হকার এবং গাইডকুলের চূড়ান্ত বশংবদ
সাব উসকো মিঠা খানা হ্যায়। আপনে হাত সে খিলাইয়ে-
অবশেষে তুত্তুরীর ভাগ্য শিকেয় ছিঁড়ল।

তপোবনের রাস্তা-

তপোবনের মাথা থেকে পরিপার্শ্ব-

পায়ের তলায় সর্ষে

ড্যামচি বাবুর দেশে-৯

কি ভাবছেন?মন্দির দেখলাম আর তপোবন দেখা শেষ?আজ্ঞে না স্যার। পিকচার আভি বাকি হ্যায়। যে পথে উঠেছিলাম,বেশ খাড়াই হলেও,বাঁধানো সিঁড়ি আছে। যদি গাইড না নিতাম তাহলে হয়তো আবার ঐ পথেই নেমে আসতাম আর জানতেই পারতাম না যে জীবনের অন্যতম অ্যাডভেঞ্চার হেলায় হারালাম। 

তপোবনের মাথায় চড়ে ঢালু পাহাড়ের কিনারে ঠ্যাং দুলিয়ে যথেচ্ছ সেল্ফি তুলে এবার যখন ফিরে আসব,গাইড বললেন,“ সাব,একঠো গুম্ফা হ্যায়। দেখিয়েগা?”ঐ গুহায় নাকি বালানন্দ মহারাজ তপস্যা করেছিলেন। বেশ চলো দেখি। পাহাড়ের মাথায় মন্দিরের মেঝেতে একটি ক্ষুদ্র আয়তাকার ছিদ্র আছে। ঐটি দিয়ে নেমে,ঘাড় বেঁকিয়ে দুই ধাপ সিঁড়ি টপকে,সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হড়কে নামতে হয়,গুহায়। আমার ব্যাগ আর শৌভিকের ক্যামেরা কেড়ে নিল গাইড। নিয়ে পাশের জানলা দিয়ে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল। 

ভাবলাম গেল সব। কোনমতে কোমর বেঁকিয়ে দুধাপ নেমে,শুয়ে পড়ে,পিছন ঘষে হড়কে যেখানে নামলাম সেটি একটি ছোট ঘর। ছাত বেশ নীচু। স্বামী বালানন্দের ছবি আছে। সামনে থালা। যদি কিছু দান করতে চান। পাশে একটি খুপরি জানলার মত ফাঁক। গাইড ওখান থেকে চিৎকার করছে,হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হবে। বুড়ো বয়সে হামা টানতে আপত্তি নেই,তবে যা চেহারা আমার,যদি আটকে যাই?

বেরোবার পর শৌভিক বলল,মন্দ না। এবার ফেরার পালা। গাইড বলল,“সাব সিঁড়িসে উতরিয়ে গা,ইয়া ফির জঙ্গলকে রাস্তে সে?এই তরফ  এক অওর গুম্ফা হ্যায়। অউর সঙ্কটমোচন হনুমানজীকা মন্দির ভি হ্যায়। ” চলো তাহলে জঙ্গলের পথ ধরি। ভুলে যাবেন না, পা কিন্তু খালি- জুতো রেখে এসেছি অনেক নীচে বাজারের একটি মিষ্টির দোকানে। কোন দোকান?সে কি আর মনে রেখেছিরে ভাই-

গুহা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরানো-
এবার এই পথে নামতে হবে-

খালি পায়ে উচ্চাবচ পাকদণ্ডী,তাও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে-আরে ডরিয়ে মাৎ। আশুন তো সহি, না পারবেন তো হামি আপনাকে কোলে করে নিয়ে যাব-


No comments:

Post a Comment