Sunday, 27 December 2020

অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০



সাতসকালে ঢুলঢুলে মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে, কোনমতে দুটো মেরি বিস্কুট খাইয়ে, হাওড়ায় রেখে অফিস যাওয়াটা তুত্তুরী এবং আমার কাছে যেন রূপকথা। সারাদিন ধরে একছত্র রাজত্ব চালায় তুত্তুরী। ঝিম মেরে থাকা দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা যেন জেগে ওঠে মন্ত্রবলে। আজব যত আব্দার করে তুত্তুরী। সাজতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা। আর বড় মামি ভালোবাসে সাজাতে। কখনও লক্ষ্মীঠাকুর সাজে তুত্তুরী, তো কখনও সাজে পরী।  হাতের কাজ সেরে সাজাতে বসে চৈতি। আগামী কাল বড়দিন কি না, তাই বোধহয় নিজের সাদা সালোয়ার আর পাথর বসানো গয়নায় পরী সাজায় তুত্তুরীকে। তুত্তুরীর শহর জুড়ে নামে বুঝি রূপকথার মরশুম- 


দেবানন্দপুরের চাটুজ্জেদের বাড়ির আনাচেকানাচে নেচে বেড়ায় ফরিদপুরের ভট্টচার্য বাড়ির পরী। আজ তার সাতখুন মাপ। আজ যে আমি দিনান্তে ফিরব নিজের শহরে। শহরটা অবশ্যি বদলে গেছে অনেকটাই। বহিঃরঙ্গে লেগেছে প্রসাধনের প্রলেপ। দিদিমণি যেদিন থেকে গঙ্গা পেরিয়ে বাসা গড়েছেন এইপাড়ে, ল্যাদ খাওয়া চেনাছন্দ ভুলে, রীতিমত তন্বী হয়ে উঠছে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা। রাজপথ যেন আজকাল অনেক বেশী তকতকে। নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত। পাইকারি হারে স্যাঁৎসেতে ড্যাম্পধরা সাবেকী বাড়ি ধুলিসাৎ করে মাথা চাড়া দিচ্ছে ফ্যান্সি বহুতলের সারি। পথেঘাটে বাড়ছে অবাংলা ভাষীদের ভিড়। কে জানে হয়তো নিজ ভূমে ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি আমরা মুষ্টিমেয় আঞ্চলিক বাঙালী। 


 গলির ভেতর অবশ্য একই আছে শহরটা। ওঠে একই রকম শীতের আদুরে পশমী রোদ। আছে ড্রেন, আছে খানাখন্দ, আছে উপচে পড়া ভ্যাট,গোছা গোছা ফেতি কুতুয়া, আছে পাড়ার  মাঠে একই রকম ভাবে বল পেটানো ছন্নছাড়া ছেলেছোকরার দল। আছে চায়ের ঠেক, আছে জগতের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন  জটলা পাকানো বয়ঃজ্যেষ্ঠদের দল। সব মিলিয়ে সময় যেন আজও থমকে আছে সহস্রাব্দের ওপারে- 


যেখানে আজও সারা দুপুর জেগে নারকেল কুরিয়ে রাখে মা। ঝোলা ভরে বুম্বার দোকান থেকে আখের গুড় নিয়ে আসে বুল্লুবাবু। পরীর সাজ খুলে, মস্ত স্টিলের গামলায় হাপুসহুপুস করে কুরানো নারকেল আর গুড় চটকায় তুত্তুরী। হাত লাগাতে গেলে ধমকে ওঠে মা, আঃ ও করতে চাইছে, ওকে বাধা দেওয়া কেন বাপু? সাধে শৌভিক বলে, “ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ সাপের কটা পা। ও বলবে পাঁচটা। ” 


 কড়ায় অল্প ঘি মাখিয়ে নারকেল আর গুড়ের মিশ্রণ ঢেলে, গ্যাস কমিয়ে চায়ের গ্লাস হাতে সিরিয়াল দেখতে বসে মা। দাদার সাথে খেলতে চলে যায় তুত্তুরী। চায়ের কাপে ঠোঁট চুবিয়ে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা। যদি ধরে যায়। তাড়ু না মারলে আবার নাড়ু হয় গা? তাড়ু মানে খুন্তি চালানো। খুন্তি চালানোর পারিশ্রমিক হল অঢেল অর্ধপক্ক গুড়-নারকেল। একটু সামলে খেতে হয় এই যা, নইলে যুগপৎ হাত এবং জিভ পুড়ে কাঠকয়লা।  



“এঁটো করে খাস না যেন-” টিভি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক সুরে হাঁকে মা। ভুলে গিয়েছিলাম, এবাড়িতে এঁটোকাটার বাছবিচার বড় কঠিন। আমাদের মধ্য হাওড়ায় ভাতের এঁটোকে এককালে বলা হত 'সকড়ি'- এখনও বলে কি, কে জানে? 


বড়দিনের সকাল মানেই ঘরে তৈরি কেক। অন্তত আমার মেয়ের কাছে।  আবাসনের রাজা ঘরে তৈরি কেক বিক্রি করে, বড় দাম কিন্তু অসম্ভব ভালো খেতে।  এই পরবের সময় কয়েক দিনই বানায় ওরা। যা বানায় অর্ধেক স্বামীস্ত্রী নিজেরাই খেয়ে নেয়। বাকি অর্ধেক পড়তে পায় না। ঐ কেক কিনে আনলেই ল্যাটা চুকে যেত- তা না।  


বৃদ্ধ দাদুর ঘাড়ে চেপে গুচ্ছ খানেক কাজু, কিশমিস, ড্রাই ফ্রুট আর কুমড়ো মেঠাই কিনিয়ে আনে তুত্তুরী। ওগুলোকে একরাত রামে ভিজিয়ে রাখলে নাকি দুর্ধর্ষ স্বাদ হয়। কিন্তু তাঁকে কোথা পাই? মা যে রাম-লক্ষ্মণ- হনুমান জাতীয় যাবতীয় পানীয় ভজনার ঘোরতর বিরোধী। তাছাড়া রাম দিয়ে কেক বানালে তো সেটা তুত্তুরীর ভাষায় “অ্যাডাল্ট কেক” হয়ে যাবে না?


 ওভেন নেই। মস্তবড় প্রেশার কুকার বার করে দেয় মা। কুকারের তলায় নুন ছড়িয়ে, তারওপর বসাতে হবে সেপারেটর এর বাটি। বাটিতে ঢালতে হবে কেকের মিশ্রণ। ব্রাউন পেপার নেই, কুছ পরোয়া নেই, বাটির গায়ে হাল্কা করে মাখন মাখিয়ে, পাতা হয় বাবার মস্ত প্যাডের চারখানা পাতা। পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে অভিযোগের সুরে নতুন প্যাডের ফরমাইশ করে বাবা। 


চিনি গুঁড়ো করে মেশাতে হয় ডিম আর ভ্যানিলা এসেন্সের সাথে। অর্জুন পিসের নিষেধ আছে, ফ্রিজের শীতল ডিম দেওয়া যাবে না। কেক তাহলে খুব নরম হয় না। ডিমকে কি করে গরম করা হবে,সেই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তুত্তুরী আর তুত্তুুরীর দাদু। তবে কি গরম জলে কয়েক মিনিট ভিজিয়ে রাখা হবে ডিমগুলোকে? বা হালকা করে একটু ফুটিয়ে নিলে- 



কেক বানাতে বানাতে গড়ায় বেলা। জন্মদিনের খাওয়াটা বাকি আছে বাবার। মাটন বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও। বেহরুজে কিলোদরে বিক্রি হয় বোনলেস মাটন বিরিয়ানি। সাথে পুদিনা গন্ধী রায়তা আর ঘিগন্ধী ক্ষীরের পান্তুয়া থুড়ি গুলাবজাম ফ্রি। মায়ের মত যারা শুকনো বিরিয়ানি খেতে নারে, তাদের জন্য খুব অল্প টাকায় দারুণ মির্চি কা সালান বানায় ওরা। 


ধনেপাতা ছড়ানো বাসমতী চাল আর বোনলেস মাটনে বিমোহিত হয়ে যাই তুত্তুরী আর আমি। পেট ভরে,মন জুড়ায় কই? "মন্দ কি" বলতে বলতে নিরাসক্ত হয়ে কাঠের চামচে দিয়ে আলু খোঁজে বাবা। বিরিয়ানিতে আলু নেই? হতভম্ব হয়ে পড়ে মা।  ডিমও নেই? নেই সুবাসী আতর? তাহলে এই মাংসের ঝোল মাখা ভাতের এত দাম কেন? বিষম খেয়ে অওধী বিরিয়ানি আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির তফাৎ বোঝাই। ভাতের আবডালে লুকোচুরি খেলা বেরেস্তা খুঁজে এনে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বৃথা চেষ্টা করি। “কেক বানালে আর বিরিয়ানি বানানো যায় না বুঝি?” গম্ভীর মুখে জানতে চায় মা? “তোর বানানো বিরিয়ানিটাই সবথেকে ভালো লাগে আমাদের-”। সমালোচনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসায় দ্রবীভূত হয়ে যাই আমি। সত্যি এ শহরের সবটুকু জুড়ে আজ রূপকথার মরশুম- 


“মামমাম তোমার লিপস্টিক আছে, মা আনতে ভুলে গেছে?” চিৎকার করে ওঠে তুত্তুরী। হেসে উঠি, ভদ্রমহিলা জীবনে ওসব রঙ মাখেননি আর এখন তো-। হাসি দেখে রেগে যায় মা। তারপর বেতো হাঁটু নিয়ে, বাক্সপ্যাঁটরা ঘেঁটে বার করে আনে, এল এইট্টিনের কবেকার লালচে রঙা লিপস্টিক। শুকিয়ে গেছে ভিতরের জোজবা অয়েল। ভেঙে গেছে মাঝখান থেকে। তবুও বাকরহিত হয়ে পড়ি আমি। এতো আমার আইবুড়ো বেলায় কেনা ৬০/৮০টাকার লিপস্টিক। এত বছর ধরে এত যত্নে তুলে রেখেছে মা? বললে রেগে যায় মা। “কে বলেছে তোর? এটা আমি আনিয়েছিলাম তোর বাবাকে দিয়ে।” কথা বাড়াই না। সত্যিই তো বাবাকে দিয়ে কাশি মামুর দোকান থেকে কিনে আনিয়ে দিয়েছিল মা, কোন সে রূপকথার যুগে। যখন বুঝি আকাশে উড়ত পক্ষীরাজ আর গপ্প শোনাত ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। নাঃ এ শহর জুড়ে আজ শুধুই গোলাপী রূপকথা- 


আজ বাড়ি ফেরার দিন। সকাল সকাল জলখাবারে লাল আটার গোলগোল পরোটা বানায় মা। সাথে খোসা সমেত আলুর তরকারী। “তোমরা কত ভালোমন্দ জায়গায় খেয়ে বেড়াও- গরীবের লাল আটার পরোটা কি আর তোমাদের মুখে রোচে?” অভিমানী সুরে শোনায় বাবা। প্রতিবার চলে আসার সময় এমন অভিমান করে বাবা। ফোলায় ঠোঁট। মান ভাঙাতে বেশী ক্ষণ লাগে না আমাদের। যাব বটে, আবার তো ফিরে আসব। আবার। আবার।বারে-বারে--। এ শহর ছেড়ে যাই কোথা? এ শহরের যে মজ্জায় মজ্জায় রূপকথা।


খুশি হয়ে অভিমান ভুলে সাদা আলুর তরকারীর রেসিপি শেখায় বাবা। খোসা সমেত আলুকে কেটে নুন জলে সিদ্ধ করে, বড় হাতায় পরিমাণ মত তেল, জিরে, অল্প হিং আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ফুটিয়ে  সিদ্ধ আলুর ঝোলে মিশিয়ে দিতে হবে। হলুদ দিতে নেই। হলুদে নষ্ট করে দেয় খোসা সমেত সিদ্ধ আলুর সুবাস। উপর থেকে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে দিলে তো পুরো অমৃত। যুগপৎ হাঁটুর ব্যথা অার ঠাণ্ডায় কাবু হয়েও অমৃতই তো বানায় মা। 


বেলা বাড়ে, ব্যাগ গোছাই আমি। তুত্তুরীকে বগলদাবা করে রেশন দোকান যায় বাবা। যেমনি যেতাম আমি। মস্ত বড় দাঁড়িপাল্লায় খালি তেলের টিনে মস্ত বড় হাতায় করে চাল, গম বা চিনি ঢেলে ওজন করা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় তুত্তুরী। যেমনি যেতাম  আমি। গমকলে গিয়ে তাজা গমভাঙা গন্ধে নির্বাক হয়ে পড়ে তুত্তুরী। যেমনি যেতাম আমি। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ গো তোমাদের দোকানে প্যাকেট করা মাল পাওয়া যায় না?”  বৃদ্ধ মালিকের পুত্র কিণ্ডারগার্টেনে আমার সহপাঠী ছিল, তাঁর গৃহেও বিরাজমান এমন একখানি নমুনা, তাই বুঝি হেসে ওঠেন তিনি। সবিনয়ে জানান, “না মা। এটা যে রেশন দোকান।”


বাড়ি ফিরে সহর্ষে রেশন দোকান আর গমকলের গল্প শোনায় তুত্তুরী। দোতলার দালানে সার সার ফেঞ্চ উয়িন্ডো দিয়ে চুঁইয়ে আসা সোনালী পশমী রোদ বাদামী রঙা মেঝেতে কাটে অচেনা আঁকিবুকি। সুযোগ বুঝে রান্নাঘরের জানলা গলে মুখ গলায় বুল্লুর আদরের বেড়ালিনী কালি- পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসে অচেনা এক জোড়া পাখি। খাঁচায় বসে ঢোলে মায়ের আদরের ককটেল- শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে গোলাপি রূপকথা।

No comments:

Post a Comment