Friday 25 December 2020

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি,১৪ই নভেম্বর, ২০২০

 


মাঝে মাঝে মনে হয় হাতটা বেঁকিয়ে নিজের নিজের পিঠটা চাপড়ে দি খানিক। বাপরেঃ জীবন যে এত ঘোল খাওয়াবে কোনদিন স্বপ্নে ভেবেছিলাম? সাতসকালে উঠে, স্নান আহ্নিক সেরে, ঝক্কাস সাজুগুজু করে, সুপ্তোত্থিত কন্যাকে বগল দাবা করে সোজা হাওড়া- বাবা-মায়ের ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে সোজা চুঁচুড়া। সারাদিন ঝঞ্ঝাটের মিটিং সেরে, রঙ্গোলি আর প্রদীপ হাতে ছবি, গ্রুপ ছবি তুলে রাত আটটায় আবার হাওড়া। বাড়ি ঢুকে চা- জলখাবার খেয়ে আবার স্নান সেরে লক্ষ্মী ঠাকুর পাতা। পাততে পাততে মনে হচ্ছিল ঢুলেই পড়ে যাব বোধহয়। যদিও ঘুমোতে ঘুমোতে রাত বারোটা, আহাঃ পুজো শেষে জমজমাট পারিবারিক আড্ডাটাকে তো মিস্ করতে পারি না। 

পরদিন পুনরায় ঢুলঢুলে মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে তুলে, ওলা ধরে বেলা দশটার মধ্যে বাড়ি। আজ কালিপুজো। কাল সকাল দশটা পঞ্চাশে আমাদের ফ্লাইট। ভেবেছিলাম, মানে শৌভিকের সাথে কথা হয়েছিল যে দিনের বেলা হাটারি থেকে খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে, আহাঃ কতদিন ওদের ড্রামস্ অব হেভেন আর রাইজ নুডলস্ খাইনি। খাবার আনিয়ে নিলে আর রাঁধতে হয় না। গোছগাছ  তো সবই বাকি। 


ভাবি এক আর হয় এক। আটদিন থাকব না, ফ্রিজে যা জমে আছে শেষ তো করতে হবে রে বাবা। খাবার নষ্ট তো আর করতে পারি না। সত্যিই ঐ রোগেই বাঙালী মরেছে। শৌভিকের গতকালের অভুক্ত ভাতকে মাখন,পেঁয়াজ, টমেটো আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে টমেটো রাইজ বানিয়ে জলখাবার সারলাম আমরা মা মেয়েতে, তারপরও দেখি বাস্কেটের ভিতর থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বেশ কিছু সব্জি। অগত্যা- থাকুক হাটারি এবেলা।  


পথশ্রমের ক্লান্তিতেই বোধহয় অথবা বাবামাকে নিভৃত দাম্পত্যালাপের সুযোগ করে দিতে কালিপুজোর দিন মাঝ সকালে নাক ডাকাতে লাগল তুত্তুরী। একটু বেলা করে রান্না বসালেও তো চলবে আজ- জমে আছে কত যে কথা- 


বেলা একটা নাগাদ রান্না করতে করতে হঠাৎ মনে হল, ফোনটা চার্জে বসানো দরকার এবং সেটা করতে গিয়ে দেখি চার্জার খানা রয়ে গেছে হাওড়াতেই। বাঃ! সাধে কি বললাম, কব্জি বেঁকিয়ে চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজেরই পিঠ। আপনারা কি ভাবলেন? এমন আপদ ফোন, যাতে লাগে না অন্যান্য ফোনের চার্জার। কি হবে এখন? কাছাকাছি ফোনের দোকান বলতে হাঁটা পথে মিনিট বিশেক। তার নম্বরও নেই আমার কাছে। একটু আগে দেখলেও নির্ঘাত এনে দিত শৌভিক। কিন্তু সদ্য একগাদা বিস্কুট আর কিছু ওষুধপত্র কিনে এনে স্নানে ঢুকেছেন তিনি। এখন বললে নির্ঘাত গালমন্দ-  


নাঃ আমার বর কখনই বকে না। কখনই রেগে যায় না। হয়তো এককালে যেত, দীর্ঘ একযুগ ধরে গিন্নীর ন্যাদশপনা সহ্য করতে করতে আজকাল আর কিছুই বলে না। বরং পাশে থাকার চেষ্টা করে। সহমর্মিতা  দেখায়। যেমন আজ এগিয়ে দিল ফোনের দোকানের কার্ডটা। ঘড়িতে বেলা দুটো। তিনবার ফোন করেছি,ধরছে না লোকটা। ধর বাপ!প্লিজ ধর। আট-নদিন ফোন ছাড়া থাকা? উফঃ ভগবান।  


আড়াইটে নাগাদ ফোন ধরল লোকটা। জানাল চার্জার পাওয়া যাবে বটে তবে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে তিনটের সময়। শৌভিক জামা গলাতে গলাতে বলল, “আমি এখুনি যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে খেতে তো দে।”ওঃ হরি, রান্নাই তো শেষ হয়নি এখনও। সাধে কি বলি নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করে। 


আবার ফোন করলাম লোকটাকে ভয়ে ভয়ে,  দাদা ওবেলা কি দোকান খুলবেন? জানতাম জবাব কি আসবে। আরেঃ আজ কালিপুজো। আজ কখনও কেউ সন্ধ্যেবেলা দোকান খোলে। ওপাশ থেকে হাসি ভেসে এল,“অবশ্যই খুলব। সন্ধ্যে ছটা থেকে দোকান খোলা। আরেঃ আমাদের বয়সে আবার কালিপুজো কি?” কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত হামি খেতাম লোকটাকে। 


দুপুরের খাওয়া মিটতে মিটতে বেলা তিনটে গড়িয়ে গেল। গড়িয়ে পড়ল শৌভিকও। ছোট্ট করে দিবানিদ্রা আর কি। গড়াবার তাল করছিল তুত্তুরীও। মামদো বাজি আর কি? সেই চুঁচুড়া থেকে কিনে এনেছি রঙ্গোলী বানানোর হরেক রঙ। কিনে এনেছি টিলাইট ক্যাণ্ডেল, মাটির প্রদীপ,ফ্লোটিং ক্যান্ডেল। বানাবে কে আর সাজাবে কে? 


মেয়ের সাথে খুনসুটি করতে করতে রঙ্গোলী যখন সেজে উঠল সন্ধ্যা নামছে কলকাতার বুকে। জ্বলে উঠেছে আবাসনের লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলোর মালা। কফি বানিয়ে মুখের কাছে ধরল শৌভিক, এমন বর না থাকলে আমার যে কি হত? 


রঙ্গোলী প্রস্তুত। বাতি, প্রদীপ, সলতে,তৈল সাজানো শেষ,এবার সাজুগুজু করার পালা। তুত্তুরীর লাল কোল্ড শোল্ডার ড্রেস আর আমার টিয়াপাখি সবুজ খোলের কাঞ্জিভরম। যার লাল পেটা জরির পাড়ে ঝিলিক মারে আলো। একযুগ পূর্বে ফুল শয্যার তত্ত্বে সেজে এবাড়িতে এসেছিল শাড়িটা। সেই থেকে পরাই হয়নি। আজ পরবই। বাজার যাবার ফ্যাকাশে গেঞ্জি গলিয়ে চার্জার আনতে যাওয়া শৌভিক, হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন? কে দেখবে”। কেন তুমি দেখবা না? আহাঃ না হয় আমি পুরানো বউ, তাই বলে সাদা কালো নাকি। তোমায় অত ভাবতে হবে না,তুমি এগোও। আমার টিকলিটা কোথায় যে গেল- 


সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আতসবাজি বিহীন দীপাবলী। খসখসে শাড়ি সামলে বাতি জ্বালাতে গিয়ে গোলাপ গাছের কাঁটায় হাত ছড়ে গেল। পোড়েনি তাও ভালো। চার্জার নিয়ে শৌভিক ফিরে আসার পর খেয়াল হয়েছে, “হ্যাঁ গো, মাছ গুলোকে ওবাড়ি দিয়ে আইলে না?” মাছ আইজ্ঞা। তুত্তুরীর আদরের পপি আর টফি? তেনাদের তো এই সপ্তাহে ঠাম্মা আর দাদুর কাছে থাকার কথা। তবে যে তারা দিব্যি টিভির সামনের টেবিলে খেলে বেড়াচ্ছে? 


বিনা বাক্যে মাছ নিয়ে দৌড়ল শৌভিক, যাবার আগে হিমশীতল কণ্ঠে শুধু বলে গেল, প্যাকিংটা কিন্তু এবার করতে হবে। প্যাকিং? ও হ্যাঁ প্যাকিং। তাই তো। কাল যে সকাল পৌনে এগারোটায় ছাড়বে আমাদের বিমান। এখনও গোছগাছ হয়নি কিছুই। মাগোঃ সাধে কি চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজের পিঠ। 


রাত নটার মধ্যে ঝড়ের গতিতে সারা প্যাকিং। আটদিনের জন্য, প্রতি দুদিন পিছু একটা করে জামা ধরে চারটে সেট। শুধু তুত্তুরীর জন্য দুটো অতিরিক্ত, তেনার আবার গাড়িতে উঠলে ইয়ে করার অভ্যেস আছে না। যাঃ ভুল হয়ে গেছে কটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিতে হবে মনে করে। এতকিছু কি আর এই গোল মাথায় থাকে। যা গম্ভীর মুখে ম্যাগি বানাচ্ছে শৌভিক, চুপচাপ খেয়ে আজ রাতের মত ঘুমিয়ে পড়াই বোধহয় ভালো। কাল নটার মধ্যে বেরোতে হবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কাল সকালে শ্যাম্পু করতে হবে। ঐটা করতে আমার আবার বড় সময় লাগে কিনা। আগে সালফেট ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে দুবার মাথা ধুয়ে, তারপর হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করা, ঝক্কি কি কম। এসব নিয়ে আপাততঃ নীরব থাকাই ভালো। শৌভিক আপাততঃ ভুরু কুঁচকে সুটকেসের লাগে লাগেজ ট্যাগ লাগাচ্ছে। ফেভিস্টিক দিয়ে যতবার আটকাচ্ছে হড়কে নেমে আসছে প্রিন্ট করা লাগেজ ট্যাগ। দুবার শূণ্যে হাত ছুড়ল শৌভিক, “এই বাড়িতে কি একটা ঢঙের আঠাও থাকে না?” ওসব কথায় কান দিতে নেই, আঠা তো আমি নষ্ট করি না, করে ওর মেয়ে। আপাততঃ ঘুমিয়ে পড়ি, কাল আবার শ্যাম্পু করতে হবে, তারপর পাড়ি দেব হিন্দুস্তানের দিল দেখতে- 

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি, ১৫ই নভেম্বর, ২০২০

আদতে প্লেনটার কলকাতা ছাড়ার কথা ছিল সকাল নটা পঞ্চাশে। সেই মত দিন-ঘন্টা-সেকেন্ড গুনছিলাম আমি, এটা আমার বরাবরের অভ্যেস। কোন বিশেষ ঘটনা ঘটার আগে প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব রাখি আমি। প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে মনে করাই, আর তো ব্যাস এত ঘন্টা- এত মিনিট আর এত সেকেণ্ড। আর তারপর- 


সব হিসেব গুলিয়ে প্লেনটা পিছিয়ে গেল পাক্কা একটি ঘন্টা। অর্থাৎ গোয়ালিয়রে পৌঁছাতে বেলা একটা। পরবর্তী গন্তব্য শিবপুরী। গোয়ালিয়র থেকে সড়কপথে ঘন্টা আড়াই থেকে তিন। অর্থাৎ কিনা বিকাল চারটে নাগাদ পৌঁছাব শিবপুরী। মাঝ নভেম্বরের কলকাতায় চারটে মানে ধূপছায়া। সুদূর পশ্চিমে হয়তো আরেকটু বেশী থাকবে আলো।  তবুও- কিই বা দেখা যাবে তাতে? নষ্টই হল আজকের দিনটা। 


গেল বারও অবশ্য তাই হয়েছিল। বেলাবেলি নেমেছিলাম ইন্দোরে, আর ওঁঙ্কারেশ্বর পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যা পেরিয়ে। বাকিটা অবশ্যি ছিল নিখাদ স্বপ্ন।  গেল বারের মতই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গাড়ি আর ড্রাইভার এবারেও থাকবে আমাদের প্রতীক্ষায়। এয়ারপোর্ট থেকে তুলে আটদিন বাদে আবার এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেওয়ার চুক্তি ওদের সাথে। গেল বার তো সরকারী বোর্ড লাগানো গাড়ি দিয়েছিল ওরা, এবার অবশ্য একটা এজেন্সীর সাথে বন্দোবস্ত, সেই এজেন্সীর মালিক এবং গাড়ির ড্রাইভার ত্যাগীজী গত কাল থেকে বার তিনেক ফোন করেছে শৌভিককে। যতই বিমারু রাজ্য বলে তাচ্ছিল্য করি আমরা, ভীষণ ভদ্র এদিকের মানুষজন। 


ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে, হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়াল সাড়ে নয়। রাগে থমথম করছে শৌভিকের মুখ। সবকিছুর জন্য নাকি আমি দায়ী। বেড়াতে যাবার দিন কেউ শ্যাম্পু করে? নেহাৎ আমাদের বাড়ি থেকে বিমানবন্দর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নইলে নির্ঘাত ভস্ম হয়ে যেতাম। প্লেনে ওঠা নিয়ে কিঞ্চিৎ আতঙ্কে ছিলাম আমরা, নতুন কোভিড বিধি কি চালু হয়েছে ভালো জানতাম না। কার্যত দেখা গেল, ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোন পরিবর্তন আসেনি। শুধু বিমানবন্দরে প্রবেশের পূর্বে ব্যাগপত্তর গুলিকে ভালো করে স্যানিটাইজ করে দেওয়া হচ্ছে। স্যানিটাইজারের দাপটে স্যুটকেস ভিজে জবজবে। শৌভিকের সাধের লাগেজ ট্যাগ খসে পড়ল টুপটাপ- 


ফাঁকায় ফাঁকায় সিকিউরিটি চেকিং সেরে, এয়ারলাইন্স কতৃপক্ষের প্রদত্ত মাস্ক এবং ফেসশিল্ড পরে বাসে চেপে যখন প্লেনের সামনে গিয়ে নামলাম, হাসি পেল। এমন একখান এরোপ্লেন তো তোলা আছে, আমাদের আলমারির মাথায়। তুত্তুরীর অন্নপ্রাশনের উপহার।  পুঁচকে প্লেনে সওয়ার হতে পারে মেরেকেটে জনা পঞ্চাশ যাত্রী। ওঠার জন্য লাগানো সিঁড়িটিও ছোট্ট।  ধাপ বড়জোর গোটা চার। 


বেলা পৌনে একটা নাগাদ গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়া রাজে সিন্ধিয়া এয়ার টার্মিনালে নামার কথা। কিন্তু কেন জানি না প্লেন আর নামেই না। প্রায় পৌনে একঘন্টা গোয়ালিয়রের আকাশে চক্কর কেটে প্লেন যখন নামাল তখন বাজে বেলা পৌনে দুটো।


 ছোট্ট প্লেনের মতই ছোট্ট এয়ারপোর্ট। প্লেনে থাকাকালীন একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে সতর্কতা বার্তা- এটি মিলিটারি এয়ারপোর্ট। এখানে সারাদিনে নামে কেবল হাতে গোণা কয়েকটি প্লেন। ছবি/ভিডিও তোলা ঘোরতর ভাবে নিষিদ্ধ। 


ছোট্ট উঠোনের মত রানওয়ে। পেরিয়ে যাওয়া যায় একদৌড়ে, তবুও প্লেন থেকে নামার পর লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হল মিনিট খানেক, কারণ সামনে দাঁড়ানো প্লেনটি ব্যাক করছিল যে। 


ভিতরে একটিই কনভেয়ার বেল্ট। আমি আর তুত্তুরী দাঁড়ালাম লাগেজ নেবার জন্য আর শৌভিককে লেখাতে হল আমাদের বিশদ পরিচয়, কোথায় যাব, কেন এসেছি ইত্যাদি। আর্মির এয়িরপোর্ট যে। অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত করপোরেট লুক নেই, তবে সাফসুতরো। বাইরের বাগানগুলিও অনেকটা আমাদের সরকারী অাপিসের বাগানের মত। যত্ন আছে, তবে আরেকটু যত্ন নিলে মন্দ কি?


ত্যাগীজীর গাড়িতে চেপে প্রবেশ গোয়ালিয়র শহরে। রাজাদের শহর। সব কিছুই বড় জমকালো এথা।   বড় বড় স্কুল, কলেজ, ইনস্টিটিউশন সবকিছুই সিন্ধিয়াদের নামে। দীপাবলীর পরদিন বলেই হয়তো বন্ধ অধিকাংশ দোকানপাট, রাস্তায় বিরল মানুষজন।  ত্যাগীজী জানালেন, এদিকে করোনা সচেতনতার হার প্রায় শূণ্য। আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গতকাল ভোর রাত অবধি দেদার বাজি পুড়িয়েছে গোয়ালিয়রবাসী। সেই ক্লান্তিতেই আপাততঃ গৃহবন্দী নগরবাসী। 


কোন সকালে খেয়ে আসা পাউরুটি, দুধ আর ডিম হজম হয়ে গেছে কখন। কিছু খেতে হবে। নেমে খেতে গেলেই নষ্ট হবে সময়। স্যান্ডউইচ জাতীয় কিছু কিনে নিতে পারলে ভালো হয়। এদিকে বন্ধ সব দোকানপাট। ভারী আকাশের মুখ। অচীরেই শুরু হল টিপটাপ বর্ষণ। বর্ষা আমার প্রিয়তম ঋতু। তাই বলে এই হেমন্তের শেষে বেড়াতে এসে আলাপ করতে আগ্রহী অকালবর্ষণ, অসহ্য।  ভিজতে ভিজতে স্টেশন লাগোয়া আধ খোলা বাজারের কফি হাউস থেকে চটজলদি কেনা ডিম স্যান্ডউইচ থুড়ি সিদ্ধ ডিম আর পাঁউরুটি খেতে খেতে ভিজে রাজপথ দিয়ে ছুটল গাড়ি শিবপুরীর দিকে। ত্যাগীজী জানালেন এদিকে কমার্সিয়াল গাড়ির গতিসীমা বাঁধা আশি কিমি/ঘন্টায়। ফলে উনি চাইলেও বাড়াতে পারবেন না গতি। পৌঁছাতে পৌঁছাতে নামবে বিকেল। তেমন কিছুই দেখা হবে না আজ। তবে পথেই পড়বে সিন্ধিয়াদের ছত্রী ওটা দেখে নিতে পারি আমরা। আর দেখতে পারি ভদাইয়া কুণ্ড।  


বিকাল চারটে নাগাদ গাড়ি গিয়ে থামল সিন্ধিয়াদের ছত্রীতে। ছত্রী বলতে সমাধি সৌধ। মুখোমুখি দুটি অনুপম সৌধ- একটি রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার স্মরণে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র মহারাজ মাধো রাও সিন্ধিয়া। অপরটি রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র তথা উত্তরাধিকারী রাজা জিভাজী রাও সিন্ধিয়া। দুটি ছত্রীর মাঝে খনন করা এক অনুপম পুষ্করিণী। সমগ্র আঙিনাটি শ্বেত পাথরে মোড়া। আছে ঘন সবুজ কেয়ারি করা বাগিচা। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে প্যারিতে মারা যান রাজা মাধোরাও সিন্ধিয়া। তাঁর সমাধিতে আছে আটখানা সলিড রূপার দরওয়াজা। ছাত থেকে ঝুলছে ভারি ভারি রূপার ঝাড়লণ্ঠন। ইতালীয়  মার্বেলের দেওয়ালে নানা সেমি প্রেশিয়াস স্টোনের অনুপম নক্সা কাটা। পাতি মোবাইল ক্যামেরায় একখান ভিডিও তুলেছিলাম- যদি দেখতে চান- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222306300273599&id=1449214651

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার মূর্তি -

ভদাইয়া কুন্ড

গুগলে শিবপুরী লিখলেই প্রথমে যে ছবি ফুটে ওঠে, তা হল একতলা এক মন্দির যার মাথার ওপর থেকে আছড়ে পড়ছে প্রবল জলধারা। বড় মনোরম দৃশ্য। এই ভদাইয়া কুণ্ডের পাশেই ট্যুরিস্ট ভিলেজে আজ রাত কাটাব আমরা। খুব অল্প টাকার টিকিট কেটে বেশ খানিকটা নীচে নেমে ভদাইয়া কুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হতাশ হলাম। এবার বর্ষা ভালো হয়নি। ফলে তিরতির করে ক্ষীণ জলধারা ঝরে তো পড়ছে ভদাইয়া কুণ্ডের মাথা থেকে। তাতে খুলছে না রূপ। ভিতরের মন্দিরে ঢোকাও আপাততঃ নিষিদ্ধ। শ্যাওলায় আছাড় খেয়ে নাকি বড় আহত হয় পর্যটকরা। তাই বন্ধ ভিতরের কুঠুরি। 


ভদাইয়া কুণ্ডের উল্টো দিকে অবশ্য নয়ন জুড়ানো শাক্যসাগর লেক। টলটলে তার জল। পাড়ের কাছে ফুটে আছে সহস্র শতদল। অদূরে শাখা বিস্তার করেছে মাধো ন্যাশানাল পার্ক। কাল ভোর-ভোর দেখতে যাব আমরা। আপাততঃ দুদণ্ড জিরিয়ে নিই এই অনুপম লেকের ধারে। ফুসফুসে ভরেনি টাটকা জলো বাতাস। কানের পর্দায় সুড়সুড়ি দিক অখণ্ড নীরবতা, মাঝে মাঝে জলের ছলাৎ ছলাৎ আর সন্ধ্যে নামার মুখে কুলায় ফেরা পাখিদের কূজন। 

(ক্রমশঃ)

(ক্রমশঃ) 


No comments:

Post a Comment