Sunday 24 September 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ #অনিরডাইরি

 


পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একতলা বাংলো। সরকারি বাংলো যেমন হয় আর কি, আহামরি কিছু না। বাংলোর সামনে দিনে একবার এসে থামে মস্ত সরকারি বাস। দু চার জন ঢুলন্ত যাত্রীকে নামিয়েই কোথায় যে হারিয়ে যায়। বাকি দিন জুড়ে বিরাজ করে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। আজ এখানে তুষারপাত হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস তাই বলেছে। পুরো "রোজা জানে মন" গানের দৃশ্যাবলীর মত শুভ্র চাদরে নিজেকে মুড়ে নেবে চরাচর। মুঠোফোন নিয়ে প্রস্তুত আমিও, তুষার স্নান করার জন্য, এমন সময় বেজে উঠলো অ্যালার্ম।


তুত্তুরীর পরীক্ষা চলছে, ষাণ্মাসিক। তাকে স্কুলে ছাড়তে, রোজ যে কেন আমাকেই যেতে হয়? গজগজ করতে করতে উঠেই পড়লাম। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা যার পোষায় সেই দেখুক। ঘুম ভেঙেছে তারও, তবুও তিনি উঠবেন না। চাদর মুড়ি দিয়ে ঝগড়া করবেন গলা ফাটিয়ে, তবুও না। মেয়ে যেন আমার একার।

এত ভোরেও শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে আলো জ্বলছে, উঁকি মেরে দেখি শাশুড়ি মাতা নিদ্রিতা, নিঃসঙ্গ শ্বশুরমশাই ডুবে আছেন বইয়ে। স্বল্পদিন হল ওনাদের কাঁথিতে নিয়ে এসেছে শৌভিক। শাশুড়িমাতা বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখনও যে সম্পূর্ণ সুস্থ তা নয়, সারাদিন কেমন যেন ঝিমোচ্ছেন। যখনই শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছি, সেই কথাই হচ্ছে দুজনে। যে মহিলাকে উনি এবং ওনার দুই পুত্রবধূ যমের মত ডরায়, তিনি এমন নিস্তেজ হয়ে পড়লে কি করে চলবে। ছায়ার সাথে তো আর যুদ্ধ করা চলে না।


"মাসি! মাসি!" করে ডেকেই চলেছে তুত্তুরী। গত রাতের বাসি বিনুনীর উপর চিরুনি বুলিয়ে, ঝুরো চুলে দুটো ক্লিপ আটকাতে হবে। এটা রোজ মোলায়েম হাতে মাসিই করে দেয়। আজ মাসি বড় ব্যস্ত সকাল থেকে। ঠাম্মা দাদুর চা, সময়ে প্রাতঃরাশ, আমাদের অফিস টাইমের ভাত, দুপুরের টিফিন- মাসির নাকের জলে,চোখের জলে অবস্থা। সরকারী সহযোগী একজন আছেন বটে, তাঁর আসতে সাড়ে সাতটা বেজে যায়। বার দুয়েক মৃদুভাবে বললাম," আয় আমি করে দিই।" শুনলে না। এরা বাপ-মেয়ে কেউ ভালো কথা শোনার পাত্র নয়। অগত্যা রুদ্রমূর্তি ধরতেই হয়। বৃদ্ধ - বৃদ্ধার উপস্থিতিতে গলার আওয়াজ চড়াতে পারি না, তাতেও কোন সমস্যা নেই। নীরবে কিভাবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া করতে হয়,বিগত এক যুগের মাতৃত্ব আমায় ভালোভাবেই শিখিয়ে দিয়েছে।


মেয়েকে গাড়িতে তুলছি যখন, মাসি ছুটতে ছুটতে এল, "তোমার মাসি তোমারই থাকবে সোনা মা। কেউ তাকে চুরি করছে না।" এতক্ষণে হাসি ফুটল তার মুখে। বয়স বাড়ছে, মাথাটা যে কবে বাড়বে মেয়েটার।এখন ভালো করে পরীক্ষাটা দিলে বাঁচি। যেটা নিয়ে সামান্যতম বাক্যব্যয়েও তিনি উৎসাহী নন। বাসা থেকে ইস্কুল গোটা পথটা তিনি উল্টে আমার পড়া ধরতে ধরতে গেলেন।" মা একজন ফুটবলারের নাম বল তো?" এত সকালে যার কথা প্রথম মনে পড়ল, তাই বললাম। "সুব্রত ভট্টাচার্য।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, " থাক।বুঝেছি। আমি নাম বলছি, তুমি বলো তুমি এদের চেনো কি না?" অতঃপর একে একে গাড়িতে সওয়ার হলেন পুসকাস, প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার, মালদিনি, পেরলো সহ আরো ৪১ জন।


বাড়ি ফিরে আরেকবার মেসেজাঘাত করলাম আমার টিমকে, "সবাই পাক্কা দশটার মধ্যে ঢুকে যেও বাবা।" ডি এম সাহেবকে নিয়ে আমাদের বন্ধন ও শ্রম সখ্য উৎসব শুরু হবে পাক্কা সাড়ে বারোটায়।  শেষ মুহূর্তে সবকিছু ঝালিয়ে নিতে হবে আরো একবার। বড় সাহেবের আজ মহানগরের মিটিং,  ওনার অনুপস্থিতি আরো ঘাবড়ে দিচ্ছে আমাদের।


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই কেন যে সন্ধ্যা হয়। কাঁথির কুখ্যাত জ্যামে আটকে যখন অফিস ঢুকলাম, সোয়া দশটা। বার বার মিলিয়ে নিতে থাকি সবকিছু। কোথাও কিছু ভুলে যাইনি তো -। কিছু বাকি থেকে যায়নি তো? হল, ফ্লেক্স, লোকজন, চা, জল, টিফিন, ভিআইপি ফোল্ডার, ফোল্ডারে দেওয়ার রিপোর্ট, প্রেস নোট - রেডি আছে তো সব? আর রাখি? অনুষ্ঠানের জন্য স্থানীয় এক প্রতিবন্ধী মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর থেকে সুদৃশ্য পাটের রাখি আমরা আগেই কিনে রেখেছিলাম।গত সন্ধ্যায় নভোনীল বাবু প্রস্তাব দিলেন, আমাদের স্কিমের নামওয়ালা রাখি বানালে কেমন হয়? রাখির আগের সন্ধ্যায় কে রাখে আমাদের আব্দার? অগত্যা চালাও পানশি কোলাঘাট। 


সাড়ে দশটা, নাগাদ দেখি,SLO প্রণব বাবুর কন্যা বানিয়ে এনেছে গোটা ১৫ রাখি, যাদের ওপর সুন্দর করে লেখা আছে কি করি আমরা। ডিএম সাহেবের মণিবন্ধে মঙ্গলসূত্র বাঁধবে কে, এই নিয়ে ধন্ধে ছিলাম আমরা। আজ সেই ধন্ধের অবসান হল। স্রষ্টাই বাঁধুক তার সৃষ্টি। 


পৌনে এগারোটার সময় হক বাবু এসে খবর দিলেন,"ম্যাডাম একটু সমস্যা হইছে। SLO রা বুঝতে পারছে না, কখন আসবে। আমায় বেশ কয়েকজন ফোন করছে।" কি সর্বনাশ, অত করে বললাম যে সাড়ে এগারোটার মধ্যে হল ভরে যাওয়া চাই। 

সাড়ে এগারোটা, হলে যাব বলে বেরোতে যাচ্ছি,দল বেঁধে ঢুকল ডিএম অফিসের সুইপার দিদিরা। কব্জিতে বেঁধে দিল সুগন্ধী ফুলের রাখি। হাতে ধরিয়ে দিল এক বাক্স মিষ্টি। 

বেলা বারোটা নাগাদ সেমিনার হলে প্রবেশ করে মাথা ঘুরে গেল।লোক কই? হল তো অর্ধেক ও ভরেনি। যাঁরা এসেছেন তাঁরাও একে অপরকে রাখি বাঁধতে ব্যস্ত। কি বকান বকলাম সবকটাকে, প্রধান অতিথি অনুপস্থিত আর আপনারা রাখি বেঁধে ফেললেন? উনি এসে দেখে কি ভাববেন? আমি নিজে খুলে এসেছি প্রিয় ফুলের রাখি খানা।বাড়িতে কাউকে নিমন্ত্রণ করে, আগে কি নিজেরা খেয়ে নেন?  আর লোকজন অনুপস্থিত কেন? হলের পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকবেন ডিএম সাহেব, আর ঢুকে দেখবেন পিছন দিকটাই গড়ের মাঠ? দপ্তরের মান ইজ্জত বলেও তো কিছু আছে নাকি?


সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভদীপ্ত যখন খবর দিল, ডিএম স্যার চেম্বারে ঢুকেছেন, নভোনীল বাবু আর হক বাবু তখন সামনে বসা লোকজনকে ফাঁক ফাঁক করে বসাচ্ছেন। যাতে হলটা ভরাট লাগে। প্রথা মাফিক ডিএম স্যারকে ডাকতে গিয়ে দেখি, ইলেকশন কমিশন থেকে কারা যেন এসেছেন। ভয়ানক ব্যস্ত ডিএম স্যার। আমায় দেখে বললেন," তোমরা শুরু করে দাও। আমি একটা সোয়া একটা নাগাদ যাব। অসুবিধা হবে কি?"


ঐ মুহূর্তে এর থেকে বড় সুবিধে আর কি হতে পারে? লোকজন এসেই যাচ্ছে, হল ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। সুইপার দিদি গুলোকেও ডেকে নিয়েছি আমরা। ওদের সবার বই আছে। ওরা সবাই আমাদেরই তো লোক। ঠিক একটা পাঁচে ডিএম স্যার যখন এলেন, হল তখন কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে। আমার ছেলেগুলোর আর বসার জায়গা নেই।

বলেছিলেন ৫ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না, কার্যক্ষেত্রে আধ ঘন্টারও অনেক বেশি ডিএম স্যার আমাদের জন্য ব্যয় করলেন। রাখি পরলেন, শ্রমিকদের হাতে বেনিফিট তুলে দিলেন, মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিলেন। উনি চলে যাবার পর শুরু হল আমাদের রাখি উৎসব। আগামীকাল থেকে শুরু হতে চলেছে দুয়ারী সরকার। মারাত্মক চাপে থাকবে সবাই। আসতে চলেছে নতুন প্রকল্প। তার আগে একটা দিন সবাই প্রাণ খুলে আনন্দ তো করুক।  সবার আগে মার্জনা চেয়ে নিলাম, খুব বকেছি না?  তমলুক ব্লকের দুই বয়ঃজ্যেষ্ঠা কালেক্টিং এজেন্ট এসেছিলেন, যাবার সময় বলে গেলেন," আমরা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি ম্যাডাম।কবে আপনি ডাকবেন।"


এত ভালো দিনটায় এক ফোঁটা চোনার মত ছিল বড় সাহেবের অনুপস্থিতি। মহানগরের মিটিং সেরে উনি যখন ঢুকলেন, ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে। স্যার বলেছিলেন বটে, সবাইকে ছেড়ে দিতে, আমাদের মেয়েগুলো কেউ ফিরে যায়নি। হোক না আমার ছোট্ট চেম্বার, তাও পুষ্পস্তবক-উত্তরীয় দিয়ে বরণ করা হল, রাখি বাঁধা হলো প্রথা মাফিক।


সব মিটলে ভেবেছিলাম টুকুস করে পালিয়ে আসব। কাল তুত্তুরীর দুটো পরীক্ষা। কার্যক্ষেত্রের তিন দফা ভি সি সেরে বাড়ি ঢুকলাম যখন, ঘড়িতে রাত আটটা। তুত্তুরীর মুখ ভার। বলেই দিল," আমার পরীক্ষার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।"


অভিমানী মেয়ে বলতেই পারে, কিন্তু ভাবতে যে আমাকে হবেই। ভাবতে হবে, দিনের এই শেষ কয়েক ঘন্টার মধ্যে কতখানি সময় বরের সাথে কফি কাপ নিয়ে গুলতানি করে কাটাব, কতটা সময় শাশুড়ির পাশে বসে সারা দিনের তত্ত্বতালাশ করব। শ্বশুরমশাই এর সাথে দেশদুনিয়ার চর্চা করব, তারপর গান শুনতে শুনতে সান্ধ্যভ্রমণের নাম করে মেয়েটাকে টেনে আনব বাগানে। কৃষ্ণ প্রতিপদের বুড়ি চাঁদের আলোয়, বকুল-গুলঞ্চ আর কামিনী ফুলের দম বন্ধ করা সৌরভী বাতাস ফুসফুসে ভরতে ভরতে কায়দা করে জানতে চাইব, কেমন হয়েছে আজ সকালের পরীক্ষা? কেমন হবে আগামী কালকের পরীক্ষা?  ভাবতে আর পারতে যে আমাকে হবেই। মায়েদের যে না পারলে চলে না।

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


তাম্রলিপ্ত নগরীতে পা রাখার সাথে সাথেই সকলে সাবধান করেছিল,“আর যেখানেই যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার-” অমুক জায়গায় যেন যেও না খবরদার। অমুক হল এমন একটা পঞ্চায়েত, যেখানে নাকি বৃষ্টির মত পটকা পড়ে। হাতা-খুন্তির মত ঘরে ঘরে অস্ত্র রাখা থাকে। ওখানকার মেয়েরা নাকি পুরুষদের থেকেও বেশি লড়াকু এবং দুর্ধর্ষ। ব্রুস লির থেকেও দ্রুত গতিতে আঁশ বটি চালায়।


বহিরাগত কেউ সেথায় পা রাখলেই হল, আসুনD পথ দেখিয়ে দিই বলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে বাড়িতে। তারপর দরজা জানলা বন্ধ করে প্রশ্ন করবে, “বল কোন পার্টি করিস?” এবার কি জবাব দেবেন আপনি? ধরুন “দাদা আমি এখনও যে ইস্কুলে পড়ি” অর্থাৎ অরাজনৈতিক বললেন। অমনি ঘচাং ফুঃ। Rধরুন আপনি সত্যিই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন এবং কোন বিশেষ দলের সমর্থক। তাই বললেন  বুক ফুলিয়ে। যদি মিলে যায়, জামাই আদরে পৌঁছে দিয়ে আসা হবে আপনার গন্তব্যে। আর যদি না মেলে? এই প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকেK সবাই। সচেতন ভাবে তৈরি করে ভয়ের আবহ। 


গল্প শোনায় আপনি একবার ইউট্যুব খুলে সার্চ করেননি, Dদেখবেন কেবল মারামারির ভিডিও। গল্প শোনায় ওই সালে,  ডিএম সাহেবের গাড়ি আটকে দিয়েছিল কারা যেন। সেই সালে এসপি সাহেবেরR গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। জাতীয় স্তরের তমুক নেতার গাড়ি ঘিরে সবাই মিলে তবলা বাজিয়েছিল।এছাড়া ঐ দলের পদাধিকারীকে এমন ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তমুক দলের পদাধিকারীকে সপরিবারে উচ্ছেদ Kকরা হয়েছে এসব তো আছেই। 


তমলুকে এটা আমার পঞ্চম দুয়ারে সরকার। প্রায় সব ব্লকের সব পঞ্চায়েতের ক্যাম্পে পা রাখলেও আজ অবধি ওখানে যাওয়া হয়নি। আমি এমনিতে বেশ ডাকাবুকো। যেতেও ইচ্ছুক, এমন বীর এবং বীরাঙ্গনাদের স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে উদগ্র। কিন্তু প্রতি বার বেঁকে বসেন ইন্সপেক্টর সাহেব। “না ম্যাডাম। যেনে শুনে আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারি না।”


 Dবাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, ইন্সপেক্টর যত বলে, SLO কুল চিৎকার করে তার দেড় গুণ। “না ম্যাডাম, ওখানে যাবেন নি।” পাশের, তার পাশের পঞ্চায়েতের SLOরা গল্প শোনায়, ‘জানেন ম্যাডাম, ঐ দুয়ারে সরকারে স্যার তো আমাদের ডিউটি দিয়েছিলেন। গিয়ে দেখি যে স্কুলে ক্যাম্প, তার গেটে তালা। সব শুনশান। হেড স্যারR পাশেই ভাড়া থাকেন, তার দরজা পিটিয়ে তাঁকে ডেকে তুললাম। তিনি Kকইলেন,‘ আজ নাকি? অ। তা তুমরাই চাবি নিয়ে গিয়ে খুলে বসো।’


 আর একজন বলে,‘ সেই যে সে বার, স্যার বললেন, তুমিও যাও। স্থানীয় SLO একা সামলাতে পারবেনি। তো গ্যালাম ভগবান ডাকতে ডাকতে। গিয়ে দেখি,যে স্কুলে ক্যাম্প, তার পাশের মাঠে বাইক রাখতে হয়। সেখানে একটা গুমটিতে একটা লোক বসে বসে পেটো বাঁধছে। আমার তো আত্মারাম খাঁচছাড়া। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘ ভাই মোটর সাইকেল এখেনে রেখে যাব? কিছু হবেনি তো? আমি গরীব মানুষ, অনেক কষ্টে কিনিছি।’ তো লোকটা পেটো বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় তুলে কইল,‘যাও যাও। আমি দেখব তোমার মোটর সাইকেল।’


ক্যাম্প শেষে, ইষ্ট নাম জপ করতে করতে গ্যালাম মাঠে। দৃঢ় বিশ্বাস যে আমার মোটর সাইকেল এতক্ষণে উড়ে গেছে। গিয়ে দেখি লোকটা তখনও পেটো বাঁধছে। আমার সাইকেল অক্ষত। আমাকে দেখে হেসে বলল,‘এ নাও গো। তোমার সাইকেল। এটা অমুক জায়গা, এখেনে আমরা পেটোও বাঁধি আবার সাইকেলও রাখি।”


গতকাল আড়াইটে নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেব যখন মেসেজ করলেন,‘ম্যাডাম আজ আমি ঐ ক্যাম্পে। যা ভিড়। সব রেকর্ড ব্রেক করে দিল। সিস্টেম না ভেঙে পড়ে হুড়মুড়িয়ে।” হেব্বি রাগ হল। আরে আমায় বলবি তো। আম্মো যেতাম। রাত পৌনে আটটা নাগাদ, আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে গ্রুপে একটি ভিডিও পোস্ট করল স্থানীয় SLO ছেলেটি। শেয়ার করছি না। ছেলেটি এবং ইন্সপেক্টর সাহেবের পরিচয় প্রকাশ করার কোন ইচ্ছে নেই বলে। 


ভালো করে দেখলাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, কই কেউ তো বোমা, পেটো নিয়ে আসেনি। ছুরি-ছোরা, ঘোড়া-পিস্তল,আঁশবটিও তো নেই। আর পাঁচটা ক্যাম্পে ভিড় করে আসা মানুষ জনের সঙ্গে কোন প্রভেদই তো নেই এণাদের। বললামও কথাটা। স্থানীয় ছেলেটি বলল,‘ তবেই বুঝুন ম্যাডাম। কেমন অপপ্রচার চালায় লোকজন। বাঁধছে আতশ বাজি এরা তাকে পেটো ভেবে ভয়েই অস্থির হয়ে যায়। ”


কে জানে, কোনটা সত্যি, কোনটা (অপ)প্রচার। সব ছাপিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার ইন্সপেক্টরটাকে, আমার SLOদের। ক্যাম্পের সময় সীমা কখন পেরিয়ে গেছে। পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। তাও ক্যাম্প গুটিয়ে ওঠেনি ওরা। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে কাজ করছে। যতদূর ভদ্রভাবে পারা যায়, ফর্ম দিচ্ছে, নিচ্ছে।তথ্যের আদানপ্রদান করছে। 


কাল ঘোষণা হবে চূড়ান্ত সফল দুয়ারে সরকার। বাহবা কুড়োবেন আসল রণাঙ্গন থেকে অনেক অনেক উঁচুতে আলোকবর্তিকায়  বসবাসকারী কিছু মানুষ। আসল সৈনিকদের কথা ভাবার মত অবকাশ তাঁদের কই। হুকুমের চাবুক, সমালোচনার ভর্ৎসনা  থামিয়ে একটু প্রশংসা,দু- একটা মিষ্টি কথা, অতিরিক্ত একটাকা সাম্মানিকও জুটবে না মোদের কপালে। আমাদের জন্যই যে বজায় থাকে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক রূপ, রাষ্ট্র সে কথা ভাবে না।  নাগরিকগণ ভাবেন কি? দূর। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, সরকারী কর্মীদের মুণ্ডপাতে। নামি সাহেবী ইস্কুল থেকে পাশ করা, দামী প্রাইভেট হাসপাতালে প্রাক্টিস করা জনৈক ডাক্তার বাবু যেমন সেদিন চিবিয়ে চিবিয়ে কইছিলেন, “... private healthcare is a lucrative business arena now, but the basic flaw lies in the govt. sector with no work culture..esp. in Eastern India।" সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,  “বলেছিলাম ওদের ভালো হোক। ” এত ঐশ্বর্য, এত উপার্জনের পরেও দরিদ্র সরকারী লোকজনের প্রতি এত অসুয়া, এত মাৎসর্য যখন, কুছ তো বাত হ্যায়, যা হয়তো আমরাই দেখতে পাই না।

অনির ডাইরি ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি, মুখ হাতটা ও ভালো করে ধুইনি, এক মুঠো খুচরো পয়সা, দু চারটে ভাঁজ করা ময়লার নোট আমার সামনে ফেলল তুত্তুরী। "মা এতে ১১৩ টাকা আছে, তুমি খুচরো গুলো নিয়ে আমাকে গোটা নোট দিতে পারবে?" সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন রে? আর তুই এত টাকা পেলি কোথা থেকে?" সামান্য নার্ভাস হয়ে বার কয়েক নাক চুলকে তিনি জবাব দিলেন," ওই যে তোমরা মাঝেমধ্যে টাকা দাও না, স্কুলে যদি কোন দরকার পড়ে বা কিছু কিনে খেতে ইচ্ছে করে-সেটাই জমিয়ে রেখেছিলাম। রথের দিনও কিছু টাকা পেয়েছিলাম।" 


আবার প্রশ্ন করি, "তুই এই টাকাটা নিয়ে করবি কি?" জবাব আসে, স্কুলে কোন এনজিও থেকে এসে বলেছে কিছু চাঁদা তুলে দিতে, দাতব্য বৃদ্ধাবাস বানানো হবে। যারা ১০০ বা তার বেশি তুলবে তাদের কোন ফুটবলারের অটোগ্রাফ দেওয়া হবে যেন। চোখের সামনে থেকে সরে যায় না জানি কতগুলো বছর, ভেসে ওঠে সাদাকালো কিছু দৃশ্য। এমনই একটা এনজিও এসেছিল আমাদের স্কুলেও। এমনি মাত্রা ধার্য হয়েছিল চাঁদার। মাত্রা ছাড়াতে পারলে জুটত তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অটোগ্রাফ। পেয়েও ছিলাম আমি, লম্বা সাদা কাগজে পাশাপাশি দুটো কলামে বারো জন ক্রিকেটারের নাম আর স্বাক্ষরের সস্তা ফটোকপি। আজও রাখা আছে কাগজটা, যত্ন করে হাওড়ার বাড়িতে।


খানিক কথা বলেই বুঝলাম, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া”। বললাম, বৃদ্ধাবাসের জন্য চাঁদা তোলা তো খুব ভালো কথা, তো চাদা তুললেই তো পারিস। জমানো ব্যাঙের আধুলি খরচা করছিস কেন? "কার থেকে চাঁদা চাইব মা? কিভাবে চাঁদা চাইব মা?" কাতর স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। বাইরের ঘরে বসে সকালের বাসি সংবাদ পত্রখানা রিভিশন দিচ্ছিলেন শ্বশুরমশাই, ইশারাতে বললাম, "ধর দাদুকে।"


সঠিক পথ দেখিয়েছি, অচীরেই বুঝতে পারলাম। পিতামহ শুধু নিজে দিলেন তাই না, পিতমহীর নামেও দিলেন। সেই খবর মুঠোফোনে যখন হাওড়া পৌঁছালো, তুত্তুরীর মাতামহ জানতে চাইল, "দাদু কত দিয়েছে? আচ্ছা, ওর ডবল তুমি আমার নামে লেখো। আচ্ছা, ঠাম্মার নামেও দিয়েছে! তুমি আমার পাশাপাশি মামমাম (দিদা), দিদি (পিসি), আর লক্ষ্মীর (আয়া দিদি) নামও লেখো।" নাম লেখা তো হল, টাকাটা হাওড়া থেকে আসবে কি করে? দাদু উদার স্বরে বলল, " তোমার মাকে দিয়ে দিতে বল। হাওড়া এলে আমি দিয়ে দেব। এমনি দেবে না, আমার মেয়েটা যা কিপটে, বলো তোমারটাও দাদু দিয়ে দেবে বলেছে।" 


গল্প এখানেই থামল না রোজ বাড়ি ফিরি আর দেখি উত্তরোত্তর বাড়ছে চাঁদা দেওয়া লোকের সংখ্যা। তুত্তুরী মুখ ফুটে না চাইতেই বাড়ছে, শাশুড়ি মায়ের জন্য যে আয়া দিদিকে রাখা হয়েছে, তিনি দিয়েছেন। বাংলায় রান্না করে যে ছেলেটি, সে আর তার চার দিদি দিয়েছে। তুত্তুরীর মাসি, তার দুই মেয়ে, জামাই, নাতি সবার নাম লেখা রয়েছে কাগজে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চাঁদার অঙ্ক। চওড়া হচ্ছে মেয়ের মুখের হাসি। বুঝতে পারি পাশ করে গেছি পরীক্ষায়। 


দিন কয়েক পরের কথা, অফিস থেকে ফিরেছি, দেখি মেয়ের মুখ ভার। চোখ ছলছল। "তোমার কি একটু সময় হবে?" কান্না চেপে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। ১৫০ কিলোমিটারের দৈনন্দিন যাতায়াত, গুচ্ছের দপ্তরী ঝামেলা আর জটিলতায় জেরবার হয়ে বিকট তিতকুটে মুডে সদ্য বাড়িতে পা রেখেছি। কয়েক মুহূর্ত আগেও শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক তিক্ততায় ভেঙ্গে পড়তে চাইছিল শরীর, মেয়ের অবস্থা দেখে কোথায় যেন উবে গেল সব ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা। অফিসের ঘেমো পোশাক, নোংরা হাতপায়েই ধপ করে বসে পড়ি, "কি হয়েছে বাবু?" বিশদে শুনি, শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছে তুত্তুরীর ক্লাশ। তাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে স্কুলের সব স্যার আর ম্যাডামদের। ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান-আবৃত্তি-শ্রুতিনাটকে ঠাসা জমজমাট অনুষ্ঠান। ইংরেজি-বাংলা দুটোই ভালো বলতে পারে বলে, ক্লাসের সর্বসম্মতিক্রমে এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা বর্তেছে তুত্তুরীর ওপর। কাজটা খুব পছন্দ ওর। আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হঠাৎ তার অডিশন নিতে আসেন কোন স্যার। তিনি যখন আসেন, টিফিন খেয়ে হাত ধুতে গিয়েছিল তুত্তুরী। ক্লাস যে চার পাঁচজন ছেলেমেয়েকে সিলেক্ট করেছে, ও ছাড়া বাকিরা কপাল গুণে ক্লাসেই ছিল। তারা অডিশন দিয়েওছে, সব শেষে স্যার যখন জানতে চেয়েছেন, আর কেউ দেবে কি না, তখন কয়েকজন তুত্তুরীর নাম বলেছে, আর একজন বলেছে, "ওর অডিশন নেবার দরকার নেই স্যার, ও খুব একটা স্মার্ট নয় আর একটু তোতলায়।" সেই শুনে স্যার, আর অপেক্ষা করেননি, চলে গেছেন। 


যে মেয়েটি বলেছে,আজ সকালেও তার গুণমুগ্ধ ছিল তুত্তুরী। তার মুখে এই কথা তুত্তুরীর কাছে চরম বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। " মা তুমি বলো, আমি কি তোতলাই? ও কেন এমন করল মা?" ক্রন্দসী কন্যাকে কি বলে সান্ত্বনা দিই খানিক মাথায় আসে না। বুঝতে পারি এবারের পরীক্ষা বেশ কঠিন। "ওকে তো আমি ভালো বন্ধু ভাবতাম মা। গত বছর নভেম্বরে যখন ভর্তি হলাম, ও আমাকে ওর সব খাতা দিয়েছিল। আমিও দিই। টিফিন ভাগ করে খাই আজও -"। বলতে ইচ্ছে করে, এই তো জীবন কালিদা। এটাই মানবচরিত্র। বলতে ইচ্ছে করে, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতি পদে তুমি এমন মানুষ পাবে। 


বলি না। কি দরকার, কয়েকটা পুঁচকে ছেলেমেয়ের ঝামেলায় নাক গলিয়ে, কি দরকার এত অল্প বয়সে মেয়ের মন বিষিয়ে দিয়ে। বরং স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দিই। ঢোঁক গিলে বলি, “ব্যাপারটা কি তোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ?” জোরে জোরে মাথা নাড়ে তুত্তুরী। তাহলে তো তোর জন্য, তোকেই লড়তে হবে। স্যারকে গিয়ে বলতে হবে, “আমাকে অডিশন দেবার একটা সুযোগ দিন।” তারপর উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। ব্যাপারটা বেশ মনে ধরে তুত্তুরীর, সাময়িক ভাবে মনে হয় পাশ করে গেছি, ভুল ভাঙে, পরদিন প্রভাতে। 


ভোর বেলা ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছি, অন্যমনস্ক ভাবে তুত্তুরী বলল, “ধর মা, স্যার আমার অডিশন নিলেন, নিয়ে আমায় সিলেক্ট করলেন, তাহলে তো আমার জন্য আমার অন্য বন্ধুরা বাদ পড়ে যাবে, ওদের ও বিশ্বাসভঙ্গ হবে। তখন ওরাও তো ওদের মায়েদের কাছে আমার নামে একই কথা বলবে, তাই না?” ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে কয়েক ঘা বেত্রাঘাত করে জাগিয়ে, সামান্য ভেবে বলি, সে সিদ্ধান্ত তো তোমাকেই নিতে হবে সোনা। যদি মনে করো, এটা তোমাকে পেতেই হবে, তাহলে লড়ো, আর যদি মনে করো, তোমার জন্য তোমার বন্ধুদের হৃদয় ভঙ্গ হবে, তাহলে লড়ো না। সমস্যাটা তোমার, তুমি যাই সিদ্ধান্ত নেবে, তাকেই আমি সম্মান করব। বিন্দুমাত্র ‘জাজ’ করব না। “থাঙ্কু মা” বলে এক গাল হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায় তুত্তুরী। 


 দুপুর তিনটে নাগাদ সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছি, মাসির মোবাইল থেকে উত্তেজিত তুত্তুরীর ফোন, “মা, মা আমি চান্স পেয়ে গেছি।” মেয়ের চিৎকারে বিষম খেয়ে খানিক কেশে বললাম, “আর বন্ধুরা?” তুত্তুরী বলল, “তুমি জানো, আমার জন্য ওরা কত বড় সাক্রিফাইজ করতে যাচ্ছিল, ওরা দল বেঁধে স্যারকে বলতে যাচ্ছিল, আমাদের চাই না, পুরোযাকে একটা সুযোগ দিন। যে বলেছিল আমি তোতলাই, সেও এসে ক্ষমা চাইল। আমি বললাম, ঠিক আছে, কাউকে কারো জন্য সাক্রিফাইজ করতে হবে না। চল সবাই মিলে গিয়ে স্যারকে বলি, মে দা বেস্ট ওয়ান উইন।” ফোন রেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, না তুত্তুরী নির্বাচিত হয়েছে, তাই জন্য নয়, মা হিসেবে পাশ করেছি বলে। যেদিন থেকে মাতৃত্বের শিরোপা পরেছি, এটাই তো করে আসছি। কত রকম যে পরীক্ষা দিয়ে চলেছি, প্রতিটা মুহূর্তে, কখনও পাশ করছি, কখনও ডাহা ফেল। তিনি আমার সূর্য, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে আমার জীবন। প্রতিটা দিন, রাত, মুহূর্ত জুড়ে রাজত্ব করেন কেবল তিনি। আর আপনারা বলেন কেবল আজ নাকি কন্যা দিবস।

Saturday 19 August 2023

অনির ডাইরি ৬ই আগস্ট, ২০১৫

 


তখন আমি খুব ছোট, বাক্য রচনা করতে শিখেছি বটে, তবে কলম ব্যবহার করার অনুমতি পেতে আরো এক- দু বছর দেরি, বাবা  একটা মোটকা লাল ডায়েরি দিয়েছিল,  রোজনামচা লেখার জন্য।  বাবা দুঃখ পাবে বলে মাঝেসাঝে যে লিখতাম না তা নয়, তবে তাতে  ছিটেফোঁটাও মাধুর্য থাকত না।  শেষে হতাশা হয়ে বাবা ডাইরি লেখার হাত থেকে  আমায় অব্যাহতি দেয়।  হাঁপ  ছেড়ে বাঁচি।  আজ হঠাৎ  আবার নতুন করে লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে।  আসলে  “পরকীয়া” পড়ে আমার আণবিক পাঠককুলের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমি নিজেই খানিকটা  আন্দোলিত । চিন্তাসূত্র কিছুটা এলোমেলো ।  না না অনুগ্রহ করে ক্ষুব্ধ হবেন না।  শুধু আপনাদের সন্দেহ অবিশ্বাস নয়, সান্যাল বাবুর ও বিরাট অবদান রয়েছে এর পিছনে। আপনারা হলেন আমার পরম হৈতেষী পাঠক ।  আপনাদের মতামত শিরোধার্য। সুতরাং নির্দ্ধিধায় বলতে পারি  গল্পটা আধখেঁচড়া থেকে যাওয়ার জন্য দায়ী শুধুই সান্যাল বাবু। 


কিন্তু কে এই  সান্যাল বাবু ? উনি আমার সহযাত্রী ।  রোজ একই চার্টার্ড বাসে আমরা অফিস যাই।  সান্যাল বাবু বেশ মজলিসি লোক।  দরাজ গলায় প্রাণখোলা হাসি ওণার ইউ এস পি।  আমাদের বাসে নিত্যদিন ভোজ লেগেই থাকে।  এই আয়োজনের দায়িত্বে সবসময়ই থাকেন সান্যাল বাবু। আমরা শুধু টাকা দিয়েই খালাস।  খুঁজে খুঁজে কোথায় কালিকার চপ্ , পুিটরামের সিঙারা, বৃন্দবাদন গুঁই এর বোঁদে, আলিয়ার ফিরনি ইত্যাদি আনা এবং সরবরাহ করা কি মুখের কথা??  কিন্তু  সান্যাল বাবু সাগ্রহে এবং সানন্দে এই কাজটি করেন।


এ হেন সান্যাল বাবু কাল বাড়ি ফেরার সময় আমার পাশের সিটে বসেছিলেন।  সামান্য সময় ব্যাপী মুষলাধার বৃষ্টির ফলে কলকাতা প্রায়  অবরুদ্ধ  হয়ে পড়েছিল কাল।  এক ঘন্টার  পথ পেরোতে লেগে যাচ্ছিল আড়াই ঘন্টা ।  আমি দিব্যি মোবাইলে গল্প লিখছিলাম, কিন্তু  এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে সান্যাল সাহেবের বোধহয় বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।  খানিক উকিঝুঁকি মেরে বললেন,“বাঃ বাংলা টাইপ করছেন!”  হেসে মাথা নাড়িয়ে আবার লিখতে শুরু করলাম।  উনি উসখুস  করে বললেন,“ কি কাউকে টেক্সট্ করছেন নাকি?” সলজ্জ ভাবে মাথা নাড়লাম।  উনি চোখ গোলগোল করে চেঁচিয়ে উঠলেন,“গল্প লিখছেন?”  লজ্জায় বেগুনী  হয়ে সায় দিলাম।  উনি ফিস্ ফিস্ করে বললেন, “ জানেন আমিও লিখছি।  তবে আপনার মত অনুগল্প নয়।  ৬০০ পাতার উপন্যাস । ” এবার আমার চোখ গোলগোল করার পালা।  উনি সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করলেন,“কিসের  ওপর জানেন? ” কি করে জানব? উত্তর  উনিই দিলেন,“ নাৎসি হোলোকাস্ট নিয়ে।  ”


একজন বঙ্গসন্তান উপন্যাস লিখছে হলোকাস্ট নিয়ে, এককথায় অভাবনীয় ।  উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,“রিসার্চ করেছেন নিশ্চয়? ” 

“ অবশ্যই।  ছয় বছর ধরে রিসার্চ করেছি ম্যাডাম।  বহু বই পড়েছি।  নেট ঘেঁটেছি।  ৪০ টার ওপর সিনেমা দেখেছি। ”

 বললাম,  “ শ্লিনডার্স লিস্ট ?”

 উনি ফোঁৎ করে শব্দ করে বললেন,“ জঘন্যতম। একদম দেখবেন না। ” আমি দেখতে পারিনি।  ঐ বিভৎসতা  অসহনীয় বিশেষতঃ একজন মায়ের পক্ষে ।  উনি হাসলেন,“চোদ্দ  বছরের নিচের শিশুগুলোকে ওরা নেরে ফেলত ম্যাডাম।  সের্ফ মেরে ফেলত।  ১৪-৬০ বছরের নারী পুরুষ গায়ে গতরে খাটতে পারত বলে বাঁচিয়ে রাখা হত।  তাদের ও মারত তবে রয়ে সয়ে।  ” ওনার গল্পের প্লট উনি অনেকটাই বলেছেন, কিন্তু  তা আর শেয়ার করছি না।  ঈশ্বরেরদয়ায় ওনার প্রচেষটা সফল হোক।


জমা জল, গুমোট গরম, যান জট, নাগরিক কোলাহল  থেকে বহু দূরে কোথায়  যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।  শুধু  কানে আসছিল ওনার জলদ গম্ভীর  স্বর,“ মাত্র সত্তর বছর আগে , ম্যাডাম, এত গুলো মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হল অথচ কতটুকুই বা আমরা জানি সেই নিশংসতার? আউৎসভিৎসে দৈনিক মানুষ মারার লক্ষমাত্রা ছিল কত জানেন?” একটু দম নিয়ে বললেন, “দশ হাজার”।  আঁতকে উঠলাম।  উনি বলেই চলেন, “ মারতে হত না।  ওরা নিজেরাই অনেক সময় লড়ে মরত।  দশ ঘন্টার  পাথর ভাঙা আর এক বাটি স্যুপ্। প্রাণ বাঁচাতে বা বলা যায় জঠরাগ্নি নেভাতে পুরুষ গুলো কুত্তার মত লড়ে মরত। আর মহিলারা কি করত জানেন, ওরা আপোসে ঠিক করেছিল ওরা শুধু রাতে খাবে। যাতে অন্তত ঘুমটা হয়।  আর দিনের বেলা ওরা শুধু খাবার গল্প করত।  কার বড়িতে কবে কে কি রান্না করেছে সেই গল্প করে পেট ভরাতো ওরা।” মুগ্ধতার মধ্যেই কখন আমার স্টপ এসে গেছে খেয়ালই করিনি, নামতে যাব, উনি বললেন,“ ম্যাডাম, এটা শুনে যান, একটা চোদ্দ   বছরের ছেলে গ্যাস চেম্বারে যাবার আগে কিছু কবিতা লিখে একটা কৌটো করে মাটিতে পুঁতে রেখে গিয়েছিল।  বহু বছর বাদে তা আবিষ্কৃত হয়।  তার দুটি   লাইন বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, 

 

‘আমাদের এখানে একটাও প্রজাপতি নেই।  

কি করেই বা থাকবে? সব ফুলগুলি যে আমরা উদরস্থ  করেছি—’। ”

অনির ডাইরি ১৮ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #গুরুচন্ডালী


অতঃপর অতসী দেবী ওরফে শাশুড়ী মাতা কহিলেন," না বাপু তোমরা যতই বলো। আমি আর লোক রাখব না।" অতসী দেবীর ভার্টিগো আছে, আছে কানের সমস্যা। কান টানিলে মাথা আসার মতই বধিরতার পিছু পিছু আসিছে  ভারসাম্যহীনতা। মাঝেমধ্যেই ভূপতিত হন, চোট পান হেথাহোথা। বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই একাকী চাগিয়ে তুলিতেও পারেন না সবসময়। ভদ্রমহিলার মানসিক জোর সাংঘাতিক। ভূপতিত অবস্থায় স্বয়ং চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, প্রয়োজনে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়াও উঠে দাঁড়ান।‌ খানিক উপরওয়ালার মুণ্ডপাত করেন, দশ-বিশ-তিরিশ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে চল্লিশ বৎসর পূর্বেও কৃত কোন অপরাধের জন্য শ্বশুরমশাইকে সামান্য তিরস্কার করেন এবং পুনরায় ব্যাপৃত হন গৃহকর্মে।


ভদ্রমহিলা রূপ এবং গুণ, দুদিকেই মা লক্ষ্মী। এই মধ্যসত্তরেও গলানো মাখন এর মতন গায়ের রং, মসৃণ ত্বক বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে গ্ল্যামার। কোমর ছোঁয়া ঢেউ খেলানো কালো চুলের ঢল, যার ফাঁকেফাঁকে উঁকি মারা রূপোর তারের মতন পক্ক কেশ গুচ্ছ, ওনার সৌন্দর্য বাড়ায় বৈ কমায় না। দাঁতগুলিও মোটামুটি অক্ষুন্ন আছে দু একটি বাদে। আর অক্ষুন্ন আছে ওনার ব্যক্তিত্ব। দুই ছেলে না ডরালেও, শ্বশুরমশাই এবং আমরা দুই পুত্র বধূ যমের মতন ভয় পাই ওনাকে। অগোচরে আমরা ওনার নাম রেখেছি, "শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী।"


তো এহেন "সুন্দরী প্রেয়সী"র কাছে একটু আগেই বকা খেয়েছি আমি। ওনাকে একটা ভালো শাড়ি পরতে বলার অপরাধে। নববর্ষের সন্ধ্যা। দীর্ঘ দেড় মাস বাদে বাড়ি ফিরেছি আমরা। কর্মসূত্রে শ্বশুর মশাইয়ের দুই পুত্র মহানগর থেকে বহুদূরের দুই জেলার বাসিন্দা। দীর্ঘ অদর্শনে জমে উঠেছে গল্পের পাহাড়। জমে উঠেছে নতুন বছরের প্রথম সন্ধ্যার আড্ডাটাও। অপূর্ণতা বলতে কেবল আমার দেওর- জা আর দেওর ঝির অনুপস্থিতি। 


দিন কয়েক আগে যে আছাড় খেয়েছিলেন শাশুড়ি মা, তার সৌজন্যে একটা পায়ের পাতা এখনও ফুলে আছে। নড়তে চড়তেও সমস্যা হচ্ছে সামান্য। যদিও রান্না করা এবং বাসন মাজার লোক আছে তবুও একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী বড় প্রয়োজন। টুকটাক সংসারের কাজ কি কম।


সেই কথাটা বলেই কেলো করেছে আমার বর। এরকম একটি মেয়েকে রাখা হয়েছিল কিছুকাল আগে, তাকে নিয়ে শাশুড়ি মাতার অভিযোগের অন্ত নেই। সে নাকি গূড়াকু বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে দাঁত মাজত এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়ে কালো কালো দাগ টানত। উনি নিজে প্রতিদিন স্নান করতে গিয়ে স্কচব্রাইট দিয়ে তা ঘষে ঘষে তুলতেন। 


পাত্তা না দিয়ে আমার বর বলল," তা মাজতেই পারে। তুমি ফিরোজাকে নিষেধ করলেই পারতে।" আরো চটে গেলেন শাশুড়ি মাতা। ওদিকে শ্বশুরমশাই ইশারায় আমায় বলেই চলেছেন, "আর একবার বলো না যদি শাড়িটা-"। 

সত্যি আমরা সকলেই হয় নতুন, নয়তো পুরানো হলেও বাইরে পরা যায় এমন পোশাক পরেছি। কেবল ওনার পরনেই একটা ঘরে পরার ন্যাতানো শাড়ি। তাতেও বোধহয় উনি আমাদের সবার থেকে বেশি সুন্দর। বৃদ্ধের মন রাখতে বলতে গিয়েও, গিলে ফেললাম কথাটা। থাক বাবা, যার প্রেয়সী তিনি বলুন। আমার ঘাড়ে মাথা একটাই। বন্দুক আমার কাঁধে না চালান করতে পেরে, শেষে বৃদ্ধ স্বয়ং বললেন, "হ্যাঁগো, শুনছ। শাড়িটা পাল্টে এসো না।"


শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে, এক ঝলক অগ্নিবর্ষণ করে, ন্যাতা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ গলার ঘাম মুছে, সুন্দরী বললেন," পারবো না।" অতঃপর জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,"তুই জানিস না আর কি করেছে? ইয়ে করে ইয়ে করেনি জানিস।"

কিয়ে করে, কিয়ে করেনি, প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখি শ্বশুরমশাই দুই আঙুলে নাক টিপছেন। শাশুড়ী মাতাকে তখন থামায় কে। "এই লোকটা। এই যে এই লোকটাই সব লোককে মাথায় তোলে।" 


আমার জায়ের নাম উমা। আমি আদর করে বলি উমারানী। যুগপৎ গরম এবং ছুটি না পাওয়ার জন্য দুর্গাপুর থেকে এবার আসতে পারেনি উমা। তাই সান্ধ্যকালীন আড্ডার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে শয়তানটা। সত্বর মেসেজ পাঠালাম," বাবা লোকজনকে মাথায় তুলছে। তাই মা ক্ষেপে ব্যোম।" ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব এল, " কিঃ"। পোষাকপরিচ্ছদ, জুতো সমেত চল্লিশ কেজি ওজন হলে বর্তে যায় যে লোকটা, সে কাউকে চাগিয়ে মাথার উপর তুলবে, ব্যাপারটা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য।


আরো হয়তো কিছু বলত উমা, তার আগেই বললাম, "দাঁড়া, দাঁড়া।আরেকটু কাল্টিভেট করতে দে ব্যাপারটাকে। ফিরোজা যেন কি করে, কি করেনি।" উমা বলল, "এটা জানি।" পরপরই ঢুকল 💩 ইমোজি। মনে মনে কপাল চাপড়ালাম আমি, সর্বনাশ! অতসী দেবীর পরিচ্ছন্নতা বোধ প্রবাদপ্রতিম। বেতো হাঁটু আর টলটলে ভারসাম্য নিয়েই তকতকে রাখেন সারা বাড়ি। এই বাড়িতে কোথাও নূন্যতম নোংরা পাবেন না। সেই বাড়িতে ইয়ে করে ফ্ল্যাশ না করা, নিঃসন্দেহে ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। 


শাশুড়ি মায়ের ক্রোধ তখনও অপ্রশমিত। "ফিরোজা আমাকে মানসিক ভাবে চুরমার করে দিয়েছে। আমাকে আর লোক রাখতে তোরা বলিস না। এত বড় মেয়ে, একে তো বড় কাজ করে ফ্ল্যাশ না করা,তারওপর আবার ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় আমার তিনটে বাটি চুরি করে পালানো। বলতে পারিস স্টিলের বাটি, কিন্তু ওগুলো সব তোর অন্নপ্রাশনে পাওয়া উপহার। এত বছর আমি নিজে হাতে মেজে, ধুয়ে, শুকনো করে মুছে ব্যবহার করেছি। ঝকঝক করত বাটি গুলো -।" 


ওনার গলা ধরে যায়, জ্যেষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশনে পাওয়া তিনটি বাটির শোকে। বসার ঘরে, সাময়িক ভাবে নেমে আসে স্তব্ধতা। মাথার ওপর কেবল ঘড়ঘড়ে পাখার আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ নেই। মেসেজ পাঠালাম, " শাশুড়ি মায়ের চোখ ছলছল।" ফোনের এপারে আমার কন্যা তুত্তুরী আর ওপারে সুদূর দুর্গাপুরে উমা, ব্যোমকে গেল দুজনেই। শ্বশুর মশাই অকারণেই কানের লতি ধরে টানলেন কয়েকবার,তারপর গলা খাঁকড়ে বললেন, " আহাঃ আজকের দিনে ওসব কথা থাক না।" অতঃপর, ঢোক গিলে বললেন, " শাড়িটা পাল্টে এলেই তো পারো।" " ধুর বাপু" বলে সোফা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন শাশুড়ী মাতা। আরোও হয়তো কিছু জুটত অমৃতবচন, যদি না সঠিক সময়ে বেজে উঠত ফোনটা।

নববর্ষের শুভেচ্ছাজ্ঞাপক ফোন। যিনি করেছেন, তিনি শাশুড়ীমাকেও চাইলেন। " এই ফোনটায় ভালো শুনতে পাই না," বলতে বলতে ফোন ধরেন শাশুড়ী মাতা। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বোধহয় প্রণাম জানান। প্রাণ খুলে আশির্বাদ করেন অতসী দেবী। "ভালো থেকো। সুখে থেকো" ইত্যাদি, প্রভৃতি। থমথমে মেঘলা ছিল যে আকাশ, রৌদ্র স্নান করে পলকে। 


দরজার ঘন্টি বাজিয়ে খাবার দিয়ে যায় জ্যোমাটোওয়ালা। " কি দিয়ে গেল, ও দিদিভাই" বলতে বলতে লাফায় উমা। মেন্যু শুনে মন খারাপ করে উমা, " আমাকে বাদ দিয়ে খাবে? ইশ। কেমন খেতে গো মাছের প্রিপারেশনটা......"। 


আবহাওয়া "কখনও মেঘে ঢাকা, কখনও আলো মাখা" র মধ্যেই একসাথে নৈশ ভোজ সারি সবাই। শ্বশুর মশাই বিড়বিড় করেন, " এ সব হোটেল রেস্তোরাঁর থেকে বাড়ির মাছের ঝোল ভাত অনেক ভালো।" তর্ক জোড়ে ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্র, " তুমি কি বলতে চাইছ? তোমাদের সাকিনা (রান্নার দিদি) এর থেকেও ভালো মাছ রাঁধে? এটা ভূতেও বিশ্বাস করবে?"  রাত গড়ায়। নিশি পোহালেই মহানগর ছাড়তে হবে আমাদের, ফিরতে হবে সুদূর কাঁথি নগরীতে।  ঘুমাতে যাবার আগে বেলা শেষের গোছগাছে মন দিই আমরা। আচমকা চটক ভাঙে শ্বশুর মশাইয়ের চিৎকারে। আবার পড়ে গেছেন শাশুড়ী মা। এবার একেবারে চিৎপটাং। 


আমার বর দৌড়ে গিয়ে তুলে, ধরে ধরে সোফায় বসায়। মাথার পিছনটা পলকে ফুলে আবের মত হয়ে যায়। আতঙ্কে নড়তে পারি না আমি আর তুত্তুরী। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শ্বশুরমশাই। অকুতোভয় কেবল অতসী দেবী। সামান্য লজ্জিত এই যা। তীব্র বেদনার মধ্যেও সংকুচিত হয়ে বললেন, " তোরা চিন্তা করিস না। পেন কিলার খেলেই সেরে যাবে।"


কি আতঙ্কে যে কাটল নতুন বছরের প্রথম রাতটা। কে জানে কি সন্দেশ বহন করে আনে ২রা বৈশাখের সকাল। সকাল হতেই ফিট অতসী দেবী। সেই শ্বশুর মশাইকে ভর্ৎসনা, সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রের সাথে দ্বন্দ্ব, দিনরাতের লোক উনি কিছুতেই রাখবেন না।সে যদি আবার ওই ফিরোজার মত গুণধরী হয়।তখন কে সামলাবে? 


সকাল গড়ায় দুপুরের দিকে, দুপুর গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। আমাদের প্রত্যাবর্তনের সময় সমাগত। প্রতিবারের মত আশ্বাস দিই, আমরা কেবল একটা ফোনের ওপারে। সমস্ত খুঁটিনাটি যেন রিপোর্ট করা হয় আমাদের। সামান্যতম অসুবিধা হলেও যেন জানাতে দ্বিধা না করেন বৃদ্ধ। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেন, সমস্যা দেখা দিলেই জানাবেন। আপাতত পশ্চিম সীমান্তে বিরাজমান অখণ্ড নীরবতা। আর অতসী দেবী কইলেন, " ওরে আমি ঠিক আছি,তোরা নিশ্চিন্তে যা। মাথার ফোলাটাও অনেক কমেছে। পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পাবার থেকে মাথায় চোট পাওয়া অনেক ভালো বুঝলি। কাজ করতে কোন সমস্যা হয় না।" 


এহেন অতসী দেবী ওরফে শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী ওরফে শাশুড়ী মাতার ৭৫ তম জন্মদিন ছিল কাল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, খুব খুব ভালো থাকুন শাশুড়ি মাতা। সুস্থ থাকুন আর এমনিই থাকুন শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমা আর আমাদের মধ্যমণি হয়ে আরো বহু বহু বছর।

অনির ডাইরি ১৭ ই আগস্ট, ২০২৩

  

#অনিরডাইরি 


অনেকদিন পর ফোন করেছিলাম মেয়েটাকে। কর্মসূত্রে আলাপ হলেও, এককালে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলাম একে অপরের। তারপর যা হয় আর কি, দীর্ঘ অদর্শনে ধুলো জমেছে সেই সব উষ্ণ স্মৃতির সরণীগুলোয়। কি যেন ঘটনা প্রসঙ্গে হঠাৎই মনে পড়ে গেল আজ।


পুরাণ নম্বরটা দেখলাম অবিকৃত আছে। ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল ওপাশের মুঠোফোন। ভেসে এল ক্লান্ত অথচ উষ্ণ আওয়াজ,"কেমন আছেন ম্যাডাম?" হেসে জবাব দিলাম, ভালো আছি। এবার আমার কুশল সংবাদ সংগ্রহের পালা, জিজ্ঞাসা করলাম তুমি/তোমরা কেমন আছ?


দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলল," আমি একদম ভালো নেই ম্যাডাম। আমার সংসার, আমার জীবন সবকিছু বদলে গেছে বিগত এক বছরে।ওলটপালট হয়ে গেছে সবকিছু। রোজ ভাবতাম, আপনাকে ফোন করব। আপনি লেখেন তো-"। 


কি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে মেয়েটা! কাঠবাঙাল, তাই বরাবরই সাংঘাতিক আবেগপ্রবণ এবং বেশ ছিঁচকাঁদুনে ছিল মেয়েটা। আপনজনদের কারো কিছু হলে আর দেখতে হত না। কেঁদে ভাসাত। তেমনি কিছু হয়েছে নিশ্চিত।কিন্তু তার সাথে আমার লেখালেখির কি সম্পর্ক? গলায় একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করি, কি হয়েছে?


মেয়েটা বলে," কাউকে বলিনি এতদিন ম্যাডাম, কি ব্যথা যে বুকে চেপে আছি। কাঁদতেও পারিনি। আপনি বলতেন না, আমি ছিঁচকাঁদুনে, গত এক বছরে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলিনি, ফেলতে পারিনি ম্যাডাম। সব সময় উৎকণ্ঠায় থেকেছি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে আমার বরকে পাশে না পেলেই মনে হত ওকে হারিয়ে ফেললাম বুঝি, চিরতরে।"


ধুমকে উঠি আমি, কি আজেবাজে কথা বলছ! মেয়েটা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনাকে বলতে গিয়ে আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেবল মনে হত, ও সুইসাইড করল বুঝি।"  নির্বাক আমি, মাথার উপর বনবন করে ঘোরে পাখাটা, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় সৌম্য, " ম্যাডাম, ফাইনাল পেমেন্টগুলো নিয়ে আসি?" ইশারায় বলি ৫ মিনিট, তারপর তোমায় ডাকছি।


ঘর ফাঁকা হতে গলা ঝেড়ে আবার বলি, কি যাতা বলছ? মেয়েটা বলে, " যাতা নয় ম্যাডাম, একদম সত্যি। জানেন, আমার বরের নামে থানায় নালিশ করা হয়েছিল যে, ও, ওর এক মহিলা সহকর্মীকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে--।" ঘরে সেই মুহূর্তে বাজ পড়লেও বুঝি এত চমকাতাম না। হতভম্ব হয়ে বলি কি বলছ? তোমার বর-।  কথা শেষ করতে দেয় না মেয়েটা, জোর গলায় বলে ওঠে " হ্যাঁ ম্যাডাম। গত পুজোর ঘটনা। এখন কোর্টে কেস চলছে। আমি ঠিক করেছিলাম, কেস মিটলেই আপনাকে ফোন করব।" 


কি বলি বুঝতে না পেরে নীরব থাকি। ব্যাপারটা গলা দিয়ে নামতেই চায় না,  মাথায় বসতেই চায় না। মেয়েটাও থমকে থাকে খানিকক্ষণ, হয়তো কিছুটা গুছিয়ে নেয় নিজেকে। তারপর বলে, " যে ভাষায় নালিশ করেছে ম্যাডাম, আমি আপনাকে বলতে পারব না। পড়তে গিয়ে গা গুলিয়ে বমি আসে। দৈহিক সৌষ্ঠবের এমন বাজারী বিবরণ দিয়েছে, রগরগে ভাষায় লিখেছে কিভাবে আমার বর আর ওর অন্য এক সহকর্মী মিলে ওকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে।"


"আসলে কি হয়েছে জানেন তো, বড় দাদা ধরে চাকরি পেয়েছে মেয়েটা। যখন খুশি অফিসে আসে যখন খুশি বেরিয়ে যায় একটা কাজ দিলে পারেও না, করেও না। যতক্ষণ অফিসে থাকে মোবাইলে গান শুনে আর না হলে এর-ওর টেবিলে আড্ডা মেরে বেড়ায়। ওকে বদলি করার একটা চেষ্টা কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত পুজোর আগে অর্ডারও এসে গেল অথচ মেয়েটা গেলই না। জাস্ট গেল না। এত বড় ধৃষ্টতা যে রিলিজ অর্ডারটাও নিল না। আগের মতোই নিজের ইচ্ছেয় আসত, যেত, অ্যাটেনডেন্স খাতায় সই করত। 

আমার বর একদিন রেগে গিয়ে করল কি, হাজিরার সময় উত্তীর্ণ হতেই, খাতাটা তুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল। মেয়েটা ওর সময় মতন এসে যখন দেখল সই করতে পারছে না, সোজা নিকটবর্তী আইন রক্ষকদের কাছে গিয়ে লিখিত নালিশ করে বসল। 


এই অবধি শুনেই থামিয়ে দিলাম আমি, " Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013" প্রায় কণ্ঠস্থ আমার এবং তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বা নির্যাতন সংক্রান্ত নালিশ সর্বাগ্রে করতে হয় Internal Complaints Commttee বা ICCর কাছে। নিয়ম অনুসারে প্রতিটি অফিসে এমন একটি কমিটি গড়ার কথাও আইনেই বলা আছে। যদি না থাকে, বা যদি নালিশ খোদ নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধেই হয়, তবে তা করতে হবে জেলাশাসক কর্তৃক গঠিত Local Complaints Committeeর কাছে। তারাই সমগ্র কেসটা তদন্ত করে শাস্তি বিধান করবেন। প্রয়োজনে তাঁরাই আইন রক্ষকদের দ্বারস্থ হওয়ার  সুপারিশ করবেন। তাহলে সেই মেয়েটির নালিশ গ্রাহ্য হল কেন?


চিড়বিড়ে তিতো গলায় মেয়েটি বলল, "জানি না ম্যাডাম। হয়তো ওর দেশওয়ালি ভাই বন্ধু কেউ ছিল। সোজা কেস ঠুকে দিয়েছে।" পরক্ষণেই ভারী হয়ে আসা গলায় মেয়েটি বলে, " পুজোর আগে কার যে নজর লাগল আমার সংসারে। গোটা অফিস ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমিও। তাসত্ত্বেও এত ভেঙে পড়েছিল আমার বর কি বলব। রাতের পর রাত ঘুমাতো না, অফিস যেতে চাইত না, কুঁকড়ে বসে থাকত ঘরের এক কোণায় আর কেবল বলত, 'এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই।' বলতো,' আমি মরি না কেন'। রাতের অন্ধকারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদত। কি দিন যে গেছে ম্যাডাম।"


আমি ব্যথিত। আমি নির্বাক। আমি বাকরুদ্ধ। আমি ক্রুদ্ধ। ভাঁওরি দেবী প্রকাশ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, নিজের দপ্তরী কাজটুকু করতে গিয়ে। বিচার পাননি কোথাও। ভবিষ্যতের ভাঁওরি দেবীদের নররাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন আনে ভারত সরকার। তাও হয়তো আনত না। যদি না নতুন করে গণধর্ষিত হতো ২২ বছরের জ্যোতি সিং, যাকে তদানীন্তন ভারতবাসী আদর করে নাম দিয়েছিল নির্ভয়া। সেই আইনের অপব্যবহার মানে প্রতিটি ধর্ষিত, নির্যাতিত নারীকে পুনরায় নতুন করে, জনসমক্ষে বেআব্রু করে দেওয়া। কোন নিন্দা, কোন ধিক্কারই এর জন্য যথেষ্ট নয়।


মেয়েটি বলে, "জানেন ম্যাডাম,এখন ওই মেয়েটা চায় মিটমাট করে নিতে। আমাদের উকিলের কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছে, ও রাগের মাথায় কাজটা করে ফেলেছে। এখন কেসটা তুলে নিতে চায়। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। কিছুতেই না।একজন সমর্থ পুরুষ মানুষকে কাঁদতে দেখা যে কি মর্মান্তিক ম্যাডাম,বিশেষ করে সে যদি আপনার প্রিয়জন হয়। আমার বরের প্রতিটা ফোঁটা চোখের জল আমি ওর থেকে উসুল করব। চলুক মামলা।" 


আর আমি বলি, লড়ো। লড়ে যাও ভালোবাসার মানুষটির জন্য।  ছেড়ো না মেয়েটিকে। এই আইনের অবমাননা করার এত বড় ধৃষ্টতা হয় কি করে? এই কেস তো তোমরা জিতবেই, আমার পূর্ণ শুভেচ্ছা রইল। তারপরেও থেমে যেও না যেন। মানহানির মামলা অবশ্যই দায়েব করো। এমন নজির সৃষ্টি করো যে দ্বিতীয়বার এই আইনকে খেলো করার সাহস যেন কেউ না পায়। তারপর দেখা করো আমার সাথে।  সেদিন আর গোপন রাখবো না তোমাদের পরিচয়। নাম-ধাম-ছবিসহ ডায়েরি লিখব আমি। অনির নয়, তোমাদের ডাইরি। এক সারভাইভার দম্পতির ডাইরি। সেই দিনের অপেক্ষাতেই রইলাম।

অনির ডাইরি ১৬ই আগস্ট, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


"Veni, vidi, vici" বোধহয় একেই বলে। পূব মেদিনীপুর জেলার নিয়ম হল ঘড়ি ধরে পাক্কা নটায় পতাকা উত্তোলন করেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর পতাকা তোলেন মহকুমা শাসক এবং অন্যান্য আধিকারিক বৃন্দ। সেই মোতাবেক পতাকা উত্তোলিত হল, গাওয়া হল সম্মিলিত জাতীয় সঙ্গীত। এবার মহকুমা শাসক মহোদয়ের বক্তব্য রাখার পালা। তারপর শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 


বক্তব্য তো রাখবে কিন্তু মাইক কোথায়? খবর আসে মাইকওয়ালা দীর্ঘ ক্ষণ আটকে আছে ট্রাফিক জ্যামে। জ্যাম তো হবেই। আজ স্বাধীনতা দিবস আর এটা পূব মেদিনীপুর। দেশপ্রেম আর আবেগের বন্যায় নাকানিচোবানি খাচ্ছে প্রতিটি জনপদ। কাঁথি নগরীর প্রতিটি শিরা উপশিরা জুড়ে চলছে প্রভাত ফেরি। কুৎসিত ডিজে নয়, বাজছে বিউগল আর ড্রাম। পাঁজি মতে ভাদ্র মাস না পড়লেও, তাল পাকানো গরম। দরদর করে ঘামছে সবাই। তারমধ্যেই কচিকাঁচা গুলো গলা চিরে ফেলছে পথে পথে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে। এযেন আমার ফেলে আসা হাওড়া। আজ সকালেই মন খারাপী সুরে বাবা বলছিল, "আজকাল কেউ প্রভাত ফেরি করে না। আজকাল আর কারো তেমন আবেগ নেই আজকের দিনটাকে ঘিরে।" বৃদ্ধকে যদি একটি বার আনতে পারতাম - 


মোদ্দা কথা, মাইকয়ালা নেহি আয়া। তাহলে কি হবে? বক্তৃতা হবে নি? শৌভিক সেই বস্তাপচা কথাটা আবার বলল, ও এতটাই অমায়িক, যে ওর আর মাইক লাগবে না। খালি গলায় বলল, তাও বিন্দুমাত্র পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া। একটি বারও দম নিল না, থমকালো না, তোতলাল না, একটাও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলল না। একটি বারও টলমলাল না আত্মবিশ্বাস, বলল - 


"আজ থেকে ছিয়াত্তর বছর আগে, মধ্যরাত্রে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু সদর্পে আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় এবং বিভিন্নভাবে এই স্বাধীনতার স্বরূপ এবং সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, যে সত্যি সত্যি এই স্বাধীনতা আমাদের সাধারণ জনগণের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। তারা কতটা মুক্ত হতে পেরেছেন, প্রান্তিক জনগণ এই স্বাধীনতার কতটা সুফল উপভোগ করেছে, সত্যি সত্যি তাদের জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা ইত্যাদি প্রভৃতি। এই ধরনের আলোচনা সবসময়ই স্বাগত। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার মানে, মাথা উঁচু করে, নিজের শর্তে দেশ শাসন এবং দেশ গঠনের অধিকার। 


আজকে এই স্বাধীনতার ৭৬ বছর উত্তীর্ণ, আমাদের দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের তিন চতুর্থাংশ বা তার থেকেও বেশি, স্বাধীন ভারতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা পরাধীনতার গ্লানি জানেন না। অন্তত বিদেশী শাসনের নীচে থাকার যে গ্লানি, যে অপমান, তা তাদের সহ্য করতে হয়নি। ফলে স্বাধীনতা তাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা জিনিস। 


একটা প্রচলিত গান আছে , "স্বাধীন থাকা তোমার রোজের রুটিন, স্বাধীন থাকা আমার রোজের রুটিন"। তো সেই স্বাধীন থাকা আমাদের দেশের জনগণের কাছে আজকে একটা স্বাভাবিক রুটিন। যেটা খুব স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় তার গুরুত্ব আমরা অনেক সময়ই অনুধাবন করতে পারি না। এই যে আমরা বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন নিচ্ছি, তার জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে আমরা কখনওই দু'দণ্ড সময় দিই না। তেমনি স্বাধীনতাকে আমরা সেভাবে সচেতনভাবে উপলব্ধি কখনই করতে পারি না।


তদসত্ত্বেও আমরা এই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলি আনুষ্ঠানিকভাবেই পালন করি। এটা অনেকটা পুজোর উপাচারের মতো হয়ে গেছে। এখন এটা ঘটনা যে পুজোর সঙ্গে উপাচার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় দেখা যায় যে উপাচারটা পূজোর থেকেও বড় হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সেরকম যেন না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকে আমরা এমন একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক, আর্থিক ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তচিন্তা লঙ্ঘিত হচ্ছে।


 কাঁথিবাসীরা নিশ্চয়ই স্মরণ করবেন স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকার কথা, তাঁরা নিশ্চিত ভাবে তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং মনে রাখবেন কি চরম আত্মবলিদান এর মাধ্যমে এখানকার অগ্রণী নেতারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তো আজ এই পুণ্য লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখছি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদান আমরা কিছুতেই বিফলে যেতে দেব না। এই কঠিন সময়ে তাঁদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে, তাঁদের দেখানো পথে আমরা মুক্তমনে মুক্ত চিন্তায় এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।"


শুনতে শুনতে ভীষণ মিস করছিলাম, সুদূর মহানগরবাসী, দুবার কর্কট বিজয়ী এক হেঁপো বৃদ্ধকে। আহা শ্বশুর মশাই শুনতে পেলে কতই না খুশি হতেন। এই চেতনা থেকে শব্দ ভাণ্ডার, এই আত্মবিশ্বাস সবই তো ওনারই দান। উনিই তো আদর্শ আমার বরের। ওনার ছেড়ে যাওয়া পদচিহ্নই তো অনুসরণ করে আমার বর।