Sunday 24 September 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ #অনিরডাইরি

 


পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একতলা বাংলো। সরকারি বাংলো যেমন হয় আর কি, আহামরি কিছু না। বাংলোর সামনে দিনে একবার এসে থামে মস্ত সরকারি বাস। দু চার জন ঢুলন্ত যাত্রীকে নামিয়েই কোথায় যে হারিয়ে যায়। বাকি দিন জুড়ে বিরাজ করে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। আজ এখানে তুষারপাত হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস তাই বলেছে। পুরো "রোজা জানে মন" গানের দৃশ্যাবলীর মত শুভ্র চাদরে নিজেকে মুড়ে নেবে চরাচর। মুঠোফোন নিয়ে প্রস্তুত আমিও, তুষার স্নান করার জন্য, এমন সময় বেজে উঠলো অ্যালার্ম।


তুত্তুরীর পরীক্ষা চলছে, ষাণ্মাসিক। তাকে স্কুলে ছাড়তে, রোজ যে কেন আমাকেই যেতে হয়? গজগজ করতে করতে উঠেই পড়লাম। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা যার পোষায় সেই দেখুক। ঘুম ভেঙেছে তারও, তবুও তিনি উঠবেন না। চাদর মুড়ি দিয়ে ঝগড়া করবেন গলা ফাটিয়ে, তবুও না। মেয়ে যেন আমার একার।

এত ভোরেও শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে আলো জ্বলছে, উঁকি মেরে দেখি শাশুড়ি মাতা নিদ্রিতা, নিঃসঙ্গ শ্বশুরমশাই ডুবে আছেন বইয়ে। স্বল্পদিন হল ওনাদের কাঁথিতে নিয়ে এসেছে শৌভিক। শাশুড়িমাতা বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখনও যে সম্পূর্ণ সুস্থ তা নয়, সারাদিন কেমন যেন ঝিমোচ্ছেন। যখনই শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছি, সেই কথাই হচ্ছে দুজনে। যে মহিলাকে উনি এবং ওনার দুই পুত্রবধূ যমের মত ডরায়, তিনি এমন নিস্তেজ হয়ে পড়লে কি করে চলবে। ছায়ার সাথে তো আর যুদ্ধ করা চলে না।


"মাসি! মাসি!" করে ডেকেই চলেছে তুত্তুরী। গত রাতের বাসি বিনুনীর উপর চিরুনি বুলিয়ে, ঝুরো চুলে দুটো ক্লিপ আটকাতে হবে। এটা রোজ মোলায়েম হাতে মাসিই করে দেয়। আজ মাসি বড় ব্যস্ত সকাল থেকে। ঠাম্মা দাদুর চা, সময়ে প্রাতঃরাশ, আমাদের অফিস টাইমের ভাত, দুপুরের টিফিন- মাসির নাকের জলে,চোখের জলে অবস্থা। সরকারী সহযোগী একজন আছেন বটে, তাঁর আসতে সাড়ে সাতটা বেজে যায়। বার দুয়েক মৃদুভাবে বললাম," আয় আমি করে দিই।" শুনলে না। এরা বাপ-মেয়ে কেউ ভালো কথা শোনার পাত্র নয়। অগত্যা রুদ্রমূর্তি ধরতেই হয়। বৃদ্ধ - বৃদ্ধার উপস্থিতিতে গলার আওয়াজ চড়াতে পারি না, তাতেও কোন সমস্যা নেই। নীরবে কিভাবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া করতে হয়,বিগত এক যুগের মাতৃত্ব আমায় ভালোভাবেই শিখিয়ে দিয়েছে।


মেয়েকে গাড়িতে তুলছি যখন, মাসি ছুটতে ছুটতে এল, "তোমার মাসি তোমারই থাকবে সোনা মা। কেউ তাকে চুরি করছে না।" এতক্ষণে হাসি ফুটল তার মুখে। বয়স বাড়ছে, মাথাটা যে কবে বাড়বে মেয়েটার।এখন ভালো করে পরীক্ষাটা দিলে বাঁচি। যেটা নিয়ে সামান্যতম বাক্যব্যয়েও তিনি উৎসাহী নন। বাসা থেকে ইস্কুল গোটা পথটা তিনি উল্টে আমার পড়া ধরতে ধরতে গেলেন।" মা একজন ফুটবলারের নাম বল তো?" এত সকালে যার কথা প্রথম মনে পড়ল, তাই বললাম। "সুব্রত ভট্টাচার্য।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, " থাক।বুঝেছি। আমি নাম বলছি, তুমি বলো তুমি এদের চেনো কি না?" অতঃপর একে একে গাড়িতে সওয়ার হলেন পুসকাস, প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার, মালদিনি, পেরলো সহ আরো ৪১ জন।


বাড়ি ফিরে আরেকবার মেসেজাঘাত করলাম আমার টিমকে, "সবাই পাক্কা দশটার মধ্যে ঢুকে যেও বাবা।" ডি এম সাহেবকে নিয়ে আমাদের বন্ধন ও শ্রম সখ্য উৎসব শুরু হবে পাক্কা সাড়ে বারোটায়।  শেষ মুহূর্তে সবকিছু ঝালিয়ে নিতে হবে আরো একবার। বড় সাহেবের আজ মহানগরের মিটিং,  ওনার অনুপস্থিতি আরো ঘাবড়ে দিচ্ছে আমাদের।


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই কেন যে সন্ধ্যা হয়। কাঁথির কুখ্যাত জ্যামে আটকে যখন অফিস ঢুকলাম, সোয়া দশটা। বার বার মিলিয়ে নিতে থাকি সবকিছু। কোথাও কিছু ভুলে যাইনি তো -। কিছু বাকি থেকে যায়নি তো? হল, ফ্লেক্স, লোকজন, চা, জল, টিফিন, ভিআইপি ফোল্ডার, ফোল্ডারে দেওয়ার রিপোর্ট, প্রেস নোট - রেডি আছে তো সব? আর রাখি? অনুষ্ঠানের জন্য স্থানীয় এক প্রতিবন্ধী মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর থেকে সুদৃশ্য পাটের রাখি আমরা আগেই কিনে রেখেছিলাম।গত সন্ধ্যায় নভোনীল বাবু প্রস্তাব দিলেন, আমাদের স্কিমের নামওয়ালা রাখি বানালে কেমন হয়? রাখির আগের সন্ধ্যায় কে রাখে আমাদের আব্দার? অগত্যা চালাও পানশি কোলাঘাট। 


সাড়ে দশটা, নাগাদ দেখি,SLO প্রণব বাবুর কন্যা বানিয়ে এনেছে গোটা ১৫ রাখি, যাদের ওপর সুন্দর করে লেখা আছে কি করি আমরা। ডিএম সাহেবের মণিবন্ধে মঙ্গলসূত্র বাঁধবে কে, এই নিয়ে ধন্ধে ছিলাম আমরা। আজ সেই ধন্ধের অবসান হল। স্রষ্টাই বাঁধুক তার সৃষ্টি। 


পৌনে এগারোটার সময় হক বাবু এসে খবর দিলেন,"ম্যাডাম একটু সমস্যা হইছে। SLO রা বুঝতে পারছে না, কখন আসবে। আমায় বেশ কয়েকজন ফোন করছে।" কি সর্বনাশ, অত করে বললাম যে সাড়ে এগারোটার মধ্যে হল ভরে যাওয়া চাই। 

সাড়ে এগারোটা, হলে যাব বলে বেরোতে যাচ্ছি,দল বেঁধে ঢুকল ডিএম অফিসের সুইপার দিদিরা। কব্জিতে বেঁধে দিল সুগন্ধী ফুলের রাখি। হাতে ধরিয়ে দিল এক বাক্স মিষ্টি। 

বেলা বারোটা নাগাদ সেমিনার হলে প্রবেশ করে মাথা ঘুরে গেল।লোক কই? হল তো অর্ধেক ও ভরেনি। যাঁরা এসেছেন তাঁরাও একে অপরকে রাখি বাঁধতে ব্যস্ত। কি বকান বকলাম সবকটাকে, প্রধান অতিথি অনুপস্থিত আর আপনারা রাখি বেঁধে ফেললেন? উনি এসে দেখে কি ভাববেন? আমি নিজে খুলে এসেছি প্রিয় ফুলের রাখি খানা।বাড়িতে কাউকে নিমন্ত্রণ করে, আগে কি নিজেরা খেয়ে নেন?  আর লোকজন অনুপস্থিত কেন? হলের পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকবেন ডিএম সাহেব, আর ঢুকে দেখবেন পিছন দিকটাই গড়ের মাঠ? দপ্তরের মান ইজ্জত বলেও তো কিছু আছে নাকি?


সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভদীপ্ত যখন খবর দিল, ডিএম স্যার চেম্বারে ঢুকেছেন, নভোনীল বাবু আর হক বাবু তখন সামনে বসা লোকজনকে ফাঁক ফাঁক করে বসাচ্ছেন। যাতে হলটা ভরাট লাগে। প্রথা মাফিক ডিএম স্যারকে ডাকতে গিয়ে দেখি, ইলেকশন কমিশন থেকে কারা যেন এসেছেন। ভয়ানক ব্যস্ত ডিএম স্যার। আমায় দেখে বললেন," তোমরা শুরু করে দাও। আমি একটা সোয়া একটা নাগাদ যাব। অসুবিধা হবে কি?"


ঐ মুহূর্তে এর থেকে বড় সুবিধে আর কি হতে পারে? লোকজন এসেই যাচ্ছে, হল ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। সুইপার দিদি গুলোকেও ডেকে নিয়েছি আমরা। ওদের সবার বই আছে। ওরা সবাই আমাদেরই তো লোক। ঠিক একটা পাঁচে ডিএম স্যার যখন এলেন, হল তখন কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে। আমার ছেলেগুলোর আর বসার জায়গা নেই।

বলেছিলেন ৫ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না, কার্যক্ষেত্রে আধ ঘন্টারও অনেক বেশি ডিএম স্যার আমাদের জন্য ব্যয় করলেন। রাখি পরলেন, শ্রমিকদের হাতে বেনিফিট তুলে দিলেন, মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিলেন। উনি চলে যাবার পর শুরু হল আমাদের রাখি উৎসব। আগামীকাল থেকে শুরু হতে চলেছে দুয়ারী সরকার। মারাত্মক চাপে থাকবে সবাই। আসতে চলেছে নতুন প্রকল্প। তার আগে একটা দিন সবাই প্রাণ খুলে আনন্দ তো করুক।  সবার আগে মার্জনা চেয়ে নিলাম, খুব বকেছি না?  তমলুক ব্লকের দুই বয়ঃজ্যেষ্ঠা কালেক্টিং এজেন্ট এসেছিলেন, যাবার সময় বলে গেলেন," আমরা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি ম্যাডাম।কবে আপনি ডাকবেন।"


এত ভালো দিনটায় এক ফোঁটা চোনার মত ছিল বড় সাহেবের অনুপস্থিতি। মহানগরের মিটিং সেরে উনি যখন ঢুকলেন, ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে। স্যার বলেছিলেন বটে, সবাইকে ছেড়ে দিতে, আমাদের মেয়েগুলো কেউ ফিরে যায়নি। হোক না আমার ছোট্ট চেম্বার, তাও পুষ্পস্তবক-উত্তরীয় দিয়ে বরণ করা হল, রাখি বাঁধা হলো প্রথা মাফিক।


সব মিটলে ভেবেছিলাম টুকুস করে পালিয়ে আসব। কাল তুত্তুরীর দুটো পরীক্ষা। কার্যক্ষেত্রের তিন দফা ভি সি সেরে বাড়ি ঢুকলাম যখন, ঘড়িতে রাত আটটা। তুত্তুরীর মুখ ভার। বলেই দিল," আমার পরীক্ষার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।"


অভিমানী মেয়ে বলতেই পারে, কিন্তু ভাবতে যে আমাকে হবেই। ভাবতে হবে, দিনের এই শেষ কয়েক ঘন্টার মধ্যে কতখানি সময় বরের সাথে কফি কাপ নিয়ে গুলতানি করে কাটাব, কতটা সময় শাশুড়ির পাশে বসে সারা দিনের তত্ত্বতালাশ করব। শ্বশুরমশাই এর সাথে দেশদুনিয়ার চর্চা করব, তারপর গান শুনতে শুনতে সান্ধ্যভ্রমণের নাম করে মেয়েটাকে টেনে আনব বাগানে। কৃষ্ণ প্রতিপদের বুড়ি চাঁদের আলোয়, বকুল-গুলঞ্চ আর কামিনী ফুলের দম বন্ধ করা সৌরভী বাতাস ফুসফুসে ভরতে ভরতে কায়দা করে জানতে চাইব, কেমন হয়েছে আজ সকালের পরীক্ষা? কেমন হবে আগামী কালকের পরীক্ষা?  ভাবতে আর পারতে যে আমাকে হবেই। মায়েদের যে না পারলে চলে না।

No comments:

Post a Comment