Sunday 24 September 2023

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


তাম্রলিপ্ত নগরীতে পা রাখার সাথে সাথেই সকলে সাবধান করেছিল,“আর যেখানেই যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার-” অমুক জায়গায় যেন যেও না খবরদার। অমুক হল এমন একটা পঞ্চায়েত, যেখানে নাকি বৃষ্টির মত পটকা পড়ে। হাতা-খুন্তির মত ঘরে ঘরে অস্ত্র রাখা থাকে। ওখানকার মেয়েরা নাকি পুরুষদের থেকেও বেশি লড়াকু এবং দুর্ধর্ষ। ব্রুস লির থেকেও দ্রুত গতিতে আঁশ বটি চালায়।


বহিরাগত কেউ সেথায় পা রাখলেই হল, আসুনD পথ দেখিয়ে দিই বলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে বাড়িতে। তারপর দরজা জানলা বন্ধ করে প্রশ্ন করবে, “বল কোন পার্টি করিস?” এবার কি জবাব দেবেন আপনি? ধরুন “দাদা আমি এখনও যে ইস্কুলে পড়ি” অর্থাৎ অরাজনৈতিক বললেন। অমনি ঘচাং ফুঃ। Rধরুন আপনি সত্যিই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন এবং কোন বিশেষ দলের সমর্থক। তাই বললেন  বুক ফুলিয়ে। যদি মিলে যায়, জামাই আদরে পৌঁছে দিয়ে আসা হবে আপনার গন্তব্যে। আর যদি না মেলে? এই প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকেK সবাই। সচেতন ভাবে তৈরি করে ভয়ের আবহ। 


গল্প শোনায় আপনি একবার ইউট্যুব খুলে সার্চ করেননি, Dদেখবেন কেবল মারামারির ভিডিও। গল্প শোনায় ওই সালে,  ডিএম সাহেবের গাড়ি আটকে দিয়েছিল কারা যেন। সেই সালে এসপি সাহেবেরR গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। জাতীয় স্তরের তমুক নেতার গাড়ি ঘিরে সবাই মিলে তবলা বাজিয়েছিল।এছাড়া ঐ দলের পদাধিকারীকে এমন ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তমুক দলের পদাধিকারীকে সপরিবারে উচ্ছেদ Kকরা হয়েছে এসব তো আছেই। 


তমলুকে এটা আমার পঞ্চম দুয়ারে সরকার। প্রায় সব ব্লকের সব পঞ্চায়েতের ক্যাম্পে পা রাখলেও আজ অবধি ওখানে যাওয়া হয়নি। আমি এমনিতে বেশ ডাকাবুকো। যেতেও ইচ্ছুক, এমন বীর এবং বীরাঙ্গনাদের স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে উদগ্র। কিন্তু প্রতি বার বেঁকে বসেন ইন্সপেক্টর সাহেব। “না ম্যাডাম। যেনে শুনে আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারি না।”


 Dবাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, ইন্সপেক্টর যত বলে, SLO কুল চিৎকার করে তার দেড় গুণ। “না ম্যাডাম, ওখানে যাবেন নি।” পাশের, তার পাশের পঞ্চায়েতের SLOরা গল্প শোনায়, ‘জানেন ম্যাডাম, ঐ দুয়ারে সরকারে স্যার তো আমাদের ডিউটি দিয়েছিলেন। গিয়ে দেখি যে স্কুলে ক্যাম্প, তার গেটে তালা। সব শুনশান। হেড স্যারR পাশেই ভাড়া থাকেন, তার দরজা পিটিয়ে তাঁকে ডেকে তুললাম। তিনি Kকইলেন,‘ আজ নাকি? অ। তা তুমরাই চাবি নিয়ে গিয়ে খুলে বসো।’


 আর একজন বলে,‘ সেই যে সে বার, স্যার বললেন, তুমিও যাও। স্থানীয় SLO একা সামলাতে পারবেনি। তো গ্যালাম ভগবান ডাকতে ডাকতে। গিয়ে দেখি,যে স্কুলে ক্যাম্প, তার পাশের মাঠে বাইক রাখতে হয়। সেখানে একটা গুমটিতে একটা লোক বসে বসে পেটো বাঁধছে। আমার তো আত্মারাম খাঁচছাড়া। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘ ভাই মোটর সাইকেল এখেনে রেখে যাব? কিছু হবেনি তো? আমি গরীব মানুষ, অনেক কষ্টে কিনিছি।’ তো লোকটা পেটো বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় তুলে কইল,‘যাও যাও। আমি দেখব তোমার মোটর সাইকেল।’


ক্যাম্প শেষে, ইষ্ট নাম জপ করতে করতে গ্যালাম মাঠে। দৃঢ় বিশ্বাস যে আমার মোটর সাইকেল এতক্ষণে উড়ে গেছে। গিয়ে দেখি লোকটা তখনও পেটো বাঁধছে। আমার সাইকেল অক্ষত। আমাকে দেখে হেসে বলল,‘এ নাও গো। তোমার সাইকেল। এটা অমুক জায়গা, এখেনে আমরা পেটোও বাঁধি আবার সাইকেলও রাখি।”


গতকাল আড়াইটে নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেব যখন মেসেজ করলেন,‘ম্যাডাম আজ আমি ঐ ক্যাম্পে। যা ভিড়। সব রেকর্ড ব্রেক করে দিল। সিস্টেম না ভেঙে পড়ে হুড়মুড়িয়ে।” হেব্বি রাগ হল। আরে আমায় বলবি তো। আম্মো যেতাম। রাত পৌনে আটটা নাগাদ, আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে গ্রুপে একটি ভিডিও পোস্ট করল স্থানীয় SLO ছেলেটি। শেয়ার করছি না। ছেলেটি এবং ইন্সপেক্টর সাহেবের পরিচয় প্রকাশ করার কোন ইচ্ছে নেই বলে। 


ভালো করে দেখলাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, কই কেউ তো বোমা, পেটো নিয়ে আসেনি। ছুরি-ছোরা, ঘোড়া-পিস্তল,আঁশবটিও তো নেই। আর পাঁচটা ক্যাম্পে ভিড় করে আসা মানুষ জনের সঙ্গে কোন প্রভেদই তো নেই এণাদের। বললামও কথাটা। স্থানীয় ছেলেটি বলল,‘ তবেই বুঝুন ম্যাডাম। কেমন অপপ্রচার চালায় লোকজন। বাঁধছে আতশ বাজি এরা তাকে পেটো ভেবে ভয়েই অস্থির হয়ে যায়। ”


কে জানে, কোনটা সত্যি, কোনটা (অপ)প্রচার। সব ছাপিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার ইন্সপেক্টরটাকে, আমার SLOদের। ক্যাম্পের সময় সীমা কখন পেরিয়ে গেছে। পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। তাও ক্যাম্প গুটিয়ে ওঠেনি ওরা। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে কাজ করছে। যতদূর ভদ্রভাবে পারা যায়, ফর্ম দিচ্ছে, নিচ্ছে।তথ্যের আদানপ্রদান করছে। 


কাল ঘোষণা হবে চূড়ান্ত সফল দুয়ারে সরকার। বাহবা কুড়োবেন আসল রণাঙ্গন থেকে অনেক অনেক উঁচুতে আলোকবর্তিকায়  বসবাসকারী কিছু মানুষ। আসল সৈনিকদের কথা ভাবার মত অবকাশ তাঁদের কই। হুকুমের চাবুক, সমালোচনার ভর্ৎসনা  থামিয়ে একটু প্রশংসা,দু- একটা মিষ্টি কথা, অতিরিক্ত একটাকা সাম্মানিকও জুটবে না মোদের কপালে। আমাদের জন্যই যে বজায় থাকে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক রূপ, রাষ্ট্র সে কথা ভাবে না।  নাগরিকগণ ভাবেন কি? দূর। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, সরকারী কর্মীদের মুণ্ডপাতে। নামি সাহেবী ইস্কুল থেকে পাশ করা, দামী প্রাইভেট হাসপাতালে প্রাক্টিস করা জনৈক ডাক্তার বাবু যেমন সেদিন চিবিয়ে চিবিয়ে কইছিলেন, “... private healthcare is a lucrative business arena now, but the basic flaw lies in the govt. sector with no work culture..esp. in Eastern India।" সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,  “বলেছিলাম ওদের ভালো হোক। ” এত ঐশ্বর্য, এত উপার্জনের পরেও দরিদ্র সরকারী লোকজনের প্রতি এত অসুয়া, এত মাৎসর্য যখন, কুছ তো বাত হ্যায়, যা হয়তো আমরাই দেখতে পাই না।

No comments:

Post a Comment