Saturday 19 August 2023

অনির ডাইরি ২৪শে জুলাই,২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


বকবক লগ্নে জন্ম আমার, জীব হোক বা জড়, সুখ হোক বা অসুখ কথা আমায় বলতেই হবে। মায়ের ওপর রাগ করে, প্রেশার কুকারটাকেই একচোট ধমকালাম এখুনি, "কখন থেকে গ্যাসপে বৈঠায়া, সিঁটি বাজায় গা, কে নেহি বাজায় গা।" মায়ের ওপর রাগ না ধরাটাই অস্বাভাবিক। এমনিতে ফোন করে মায়ের সাথে কথা না বললে মায়ের দুর্জ্ঞেয় অভিমান হয়। আবার কথা বলতে গেলেও তিন বা চারটির বেশি বাক্য ব্যয় করে না মা। তার সবটুকু জুড়ে থাকি কেবল আমরা। তুত্তুরী স্কুলে গেল কিনা,কাজের খুব টেনশন আছে কি না, আমরা ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছি কি না এবং তুত্তুরীর পড়াশোনা কেমন চলছে। এর বাইরে মায়ের আর কোন কথা নেই। 


আরে ভাই, এগুলো তো রোজই শুধাও, এবেলা - ওবেলা শুধাও। অন্য কিছু তো বলো। তোমার খবর তো কিছু দাও। বললেই ভদ্রমহিলার এক কথা,"আমার আবার কি খবর? আমি ঠিকই আছি।" বুঝতে পারলাম পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা মেরেছি, হাল ছেড়ে জানতে চাইলাম, বাবা কোথায়? বাবার সাথে উল্টো কেস হয় সাধারণত, বাবার গল্পের ভাণ্ডার অফুরন্ত। প্রায় জোর করে ফোন কাটতে হয়। 


অন্য দিন মায়ের হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনতাই করে নেয় বাবা, আজ তিনি অনুপস্থিত কেন? জবাব পেলাম, বাবা নাকি ঘুমাচ্ছে। এই রবিবারের বারবেলায় ঘুমাচ্ছে? শঙ্কিত হয়ে জানতে চাই, শরীর ভালো আছে তো? দায়সারা উত্তর পাই, "ওই একটু জ্বরজ্বর ভাব, গা ম্যাজম্যাজ,অরুচি, কাশি। কাল রাতে কাশির দমকে ঘুমাতে পারেনি। কথা শোনে না। সিগারেটের পর সিগারেট টেনেই যায়।" এরপর গরম হলে মাথার কি আর দোষ থাকে? এইটা তো আগে বলবে নাকি। বললাম বাড়িতে প্যারাসিটামল আছে কিনা দেখো, সেরকম হলে যেন একটা খেয়ে নেয়। ডাক্তার না দেখিয়ে, ওষুধ না খেয়ে, আর একটু সয়ে দেখি বলে যেচে যাতনা ভোগ করাটা চাটুজ্জেদের মজ্জাগত। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। 


আমার যাবতীয় উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে উল্টে মা বলল, " তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। এখানে লক্ষ্মী (মায়ের care giver) আছে, তপন ( পাড়াতুতো ইন্দ্রনাথ বলতে পারেন। ফোন করলেই ছুটে আসে, ডাক্তারের সাথে appointment বুক করে দেয়, টোটো ঠিক করে বাড়ির সদর দরজায় পাঠিয়ে দেয়, স্যাম্পল কালেক্ট করে যাবতীয় ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে দেয়, দরকার হলে পরীক্ষার রিপোর্ট গুলো বগলদাবা করে ডাক্তারকে দেখিয়ে ও আসে) আছে, তোকে তিনশ মাইল দৌড়ে আসতে হবে না।" মাইল নয় কিলোমিটার, তিনশ নয়, যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ। তাহোক, বাবাটা তো আমার। অসুস্থ বৃদ্ধকে নিছক লক্ষ্মী - তপনের ভরসায় ছাড়তে পারি নাকি!


বসার ঘরে বসে বসে দাড়ি চুলকাচ্ছিল শৌভিক, বেচারী প্রেশার কুকারের ওপর করা হম্বিতম্বি শুনে দৌড়ে এল, "কেয়া হুয়া"? সুখ, দুঃখ থেকে দাম্পত্য আলাপ, দিদার ভাষাতেই জমে আমাদের। স্বর্গীয়া সুনীতিরাণী ঘোষ, ওরফে আমার দিদা দারুণ হিন্দি বলত। দিদার বলা কিছু কিছু হিন্দি বাক্য বলতে পারেন অমর হয়ে রয়ে গেছে আমাদের পরিবারে। হিন্দি কথনে লালমোহন বাবা ওরফে জটায়ুকে গুণে গুণে এগারোটা গোল দিতে পারত দিদা। দিদার বোধহয় ধারণা ছিল বাংলা বাক্যের সাথে হ্যায় লাগালেই তাহা রাষ্ট্র ভাষায় রূপান্তরিত হয়। যেমন ধরুন বড় মাসির বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখল, গলির মুখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত একটা ঠেলা গাড়ি। দিদা অমনি ঠেলাওয়ালাদের ধমকে দিল, " আই, তুম ইতনা ছোটো গলি মে, এত্ত বড় ঠেলা ঢুকিয়েছ কেন হ্যায়?" 


মা - মাসি বা অন্য দাদারা দিদার হিন্দি অতটা খেয়াল না করলেও, দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ সমেত রেকর্ড করে নিত সেজদা। তারপর রবিবার সন্ধ্যা বেলা, বড় মাসির বাড়ির টিভির ঘরে, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর আমতেল দিয়ে মাখা এক গামলা মুড়ি সহ জমে উঠত দিদার "হিন্দি পে চর্চা"। সেই যে রোটাং পাশ না কোথায় যাবার সময়, কোন হোটেলের কোন তরকারিতে যেন নুন কম হয়েছিল। সেই নিয়ে সেজদা মৃদু অনুযোগ করায়, ওয়েটারকে বেদম বকেছিল দিদা, "এই, তুম তরকারি মে নুন নেহি দিয়া? আমার ছেলেকো নুন কম লাগতা হ্যায় কাহে?" ছেলে অর্থাৎ বাচ্ছা।আমার মুর্শিদাবাদী মা-মাসি-দিদা সবাই বাচ্ছাদের ছেলে বলত। মা তো এখনও তুত্তুরীর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ছেলে শব্দটা প্রয়োগ করে, " ছেলেকে দেখো। ছেলে যেন পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করে" ইত্যাদি প্রভৃতি।


১৯৯৮ সালে অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছে দিদা। ছোট্টখাট্টো, সাদা শাড়ি পরা, তামুক পাতা চিবানো চিনির পুঁটলিটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। একমাত্র নাতনী বলে একটা ভয়ানক আদরের নাম ছিল আমার, দিদা চলে যাবার পর আর কেউ কখনও সেই নামে ডাকেনি। দিদা হয়তো নেই, দিদার হিন্দি গুলো আজও রয়ে গেছে আমার সাথে। আজও যখনই রেগে যাই, খুব খুশি হয়ে যাই, সোহাগে উথলে উঠি, "ষড়া অন্ধা অছি" র মত বিশুদ্ধ দিদার রাষ্ট্র ভাষাই বেরোয় আমার মুখ দিয়ে। বিগত সাড়ে চোদ্দ বছরে শৌভিক ও দেখি দিব্যি রপ্ত করে ফেলেছে আমার দিদার বুলি। 


 বাবার অসময়ে ঘুম, মায়ের বেশি কথা না বলার পাশাপাশি অনুযোগ করলাম প্রেশার কুকারের নামেও। বলতে বলতে মনে পড়ে গেল সিদ্ধ ডিম গুলো ছাড়াতে হবে। এই কাজটা শৌভিক খুব ভালোবাসে, লাফাতে লাফাতে করতে আসে। তাই বললাম, " তুম সিদ্ধ ডিম ছাড়ায়েগা কে নেহি? কখন সে সেদ্ধ হোকে বৈঠা হ্যায়, দু দুটো ডিম।" শাশুড়ির ওপর ক্ষুণ্ন বউয়ের রুদ্র রূপ দেখে সুড়সুড় করে ডিম ছাড়াতে এল শৌভিক। হতভাগা সিঁটি আর ওঠে না। বিরক্ত হয়ে বরের কাছে অনুযোগ করলাম, " এ হতভাগা প্রেশার কুকার কো, লাগতা হ্যায় ম্যায় পছন্দই নেহি হ্যায়। মুঝ কো দেখকে সিঁটিই নেহি বাজাতা। বুজুকো( তুত্তুরী) বুলা কে দেখতা হুঁ। শায়দ ও পছন্দ হো যায়।"


 শৌভিক এক মনে ডিম ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, "নেহি নেহি, ইয়ে না, সাত্ত্বিক প্রেশার কুকার হ্যায়।" কচু পোড়া হ্যায় বলে যেই বেরিয়ে এলাম, পি করে সিঁটি বেজে উঠল। হতভাগা প্রেশার কুকারের লাগতা হ্যায় ওরিয়েন্টেশন ম্যেই গণ্ডগোল হ্যায়। এবার থেকে শৌভিককেই রাঁধতে পাঠাব। যদি একটু তাড়াতাড়ি হয়। 


আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গল ভয়ানক মন খারাপি খবরে, গতকাল রাতে মাতৃহারা হয়েছে জনৈকা বন্ধু। পাশাপাশি পাড়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা। খবরটা পড়া ইস্তক, আশৈশব দেখে আসা কাকিমার মুখটা কেবলই ভাসছে চোখের সামনে। খুব ভাব ছিল মায়ের সাথে। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলেই জমে উঠত আড্ডা। দুজনকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসা হত দায়। মায়ের কাছে প্রায় অনুযোগ করতেন কাকিমা, "দেখেছ ওরা কেমন আড্ডা মারে, আমাদেরও ওমন একটা হলে হত তো।" মা বলেও ছিল কথাটা আমাদের। লুফেও নিয়েছিলাম আমরা।বাবা - মায়েদের নিয়ে গেট্টু। তারপর যা হয় আরকি, আজ হবে, কাল হবে করে আর হয়ে ওঠেনি। হুড়মুড় করে চলে এসেছে অতিমারি, বদলে দিয়েছে জীবনের ধাঁচ- 


আমার কেমন যেন ধারণা ছিল ছোটবেলায়, যে বড় হয়ে গেলে হয়তো বাবা মায়ের সাথে বিচ্ছেদটা আর অত কষ্টকর হবে না। বড়দের তেমন ভাবে কাঁদতে দেখিনি যে। আজ প্রতি পদে মনে হয় কি চরম বোকা ছিলাম আমি। বয়স যত বাড়ছে, প্রতিটা মুহূর্তে আরো আরো বেশি করে যেন আঁকড়ে ধরছি ওদের। বিচ্ছেদের কথা ভাবতেও বন্ধ হয়ে আসে দম। অন্ধকার হয়ে পড়ে চরাচর। 


সেই কথাই বলছিলাম মাকে। কাল নীরবতার জন্য ধমক খেয়েছে বলে নাকি হঠাৎ চলে যাওয়া পাড়াতুতো সহেলীর প্রতি স্মৃতিমেদুরতার জন্য জানি না, আজ মনে হল মাকে কথায় পেয়েছে। প্রায় সাত আট মিনিট স্বর্গীয় কাকিমার কথাই বলে চলল। মুঠো ফোনে কারো এত বড় প্রশস্তি, মায়ের পক্ষে এটা বিশ্বরেকর্ড বটে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাওয়া মোরগের মত উল্টো দিকে ঘুরে গেল মা, " এই জানিস, আমাদের আজ সকাল থেকে কি দুর্বিপাক -"। 


চলন্ত বাহনের জানলা গলে যেন পলকে ঢুকে এল একরাশ উৎকন্ঠার মেঘ, কি হল আবার? মাকে আজ যেন গপ্পে পেয়েছে, "শোন না, সে কি বিপদ! আমি তো আজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠেছি।" অধীর হয়ে বললাম, "আরে ইতিহাস পরে শুনব, আপাতত কি হয়েছে সেটা তো বলো -"। "এই বলছি শোন না। উঠে দেখি, বাইরের আবহাওয়া তেমন ভালো নয়। মেঘ করে আছে, টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়ছে। তারই মধ্যে গেলাম সদর দরজা খুলতে।"


 আবার বললাম, এবার বেশ খানিকটা গলা তুলে, "আরে হয়েছেটা কি?" ফোনের ওপারে ব্যঙ্গ করে "হেহেঃ" হেসে উঠল একবার বাবা। মায়ের কোন হেলদোল নেই, " শোন না, তোর বাবার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না বলে, আজ আর উঠতে দিইনি, আমিও আর শুইনি। কাজের মেয়েটা আসবে বলে, একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে রোয়াকেই বসে রইলাম। ভাগ্যে বৃষ্টিটা থেমে ছিল। বসে বসে ঢুলচি -"। 


আরে ধুৎ,  আসল কথাটা তো বলো। বাবা আবার আওয়াজ দিল, "হোহো রাজা খাঃ"। এর মানে কি তার উত্তর কেবল আমার পিতৃদেবই জানেন। মায়ের অবস্থা সত্যি "ছুট‌লে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?" বলেই চলে, " তিনি আসলেন বেলা সাড়ে সাতটায়। এসে দুমিনিটে তার ঝাঁট দেওয়া, মোছা হয়ে গেল। দুমদাম করে বাসন মাজল, চলে যাচ্ছে যখন বললাম, একটু দোতলা টা ঝাঁট দিয়ে আয় না। আমায় মুখ বেঁকিয়ে বলল, ' আজ পারবুনি -'।" স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, " আচ্ছা এটাই তাহলে তোমার দুর্বিপাক।" 


"নাঃ, নাঃ। শোন না।" উদ্বেগ মেশানো পান চিবানো আড্ডার মেজাজে বলে মা। " তারপর তোর বাবা উঠল,উঠেই এক কাপ চা চাইল। বাসি জামাকাপড় ছেড়ে, পুজো করলাম। চা বানালাম -"। গাড়ির কাঁচে ঠকঠক করে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললাম, দোহাই মা, এবার তো বলো কি হয়েছে। আর উত্তেজনা সইতে পারছি না। আরো মিনিট খানেক এমন অনির্বচনীয় যাতনা দেবার পর, অবশেষে জানা গেল,যুগলে চা পান সমাপন করে, মেশিনে বাসি কাপড় কাচতে গিয়ে মা আবিষ্কার করেছে, ট্যাংকের সব জল কিভাবে যেন শেষ হয়ে গেছে। 


সত্য যখন উদ্ঘাটিত হয়েছে, ততক্ষণে রীতিমত মাথা ঘুরছে, বাস্তবিক ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কোনমতে শুধু বললাম, ঘাট হয়েছে, বেশি কথা বলো না বলে কাল তোমায় বকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। এবারের মত মার্জনা করে দাও মা জননী। ভুলে গিয়েছিলাম, বয়স যতই বাড়ুক, মা চিরকাল মা'ই থাকে। এক উচ্চতর জীব, যার পদাঙ্ক তো অনুসরণ করা যায়, কিন্তু যাকে কখনও ছাপিয়ে যাওয়া যায় না।

অনির ডাইরি ১৮ই জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জানলার বাইরে ঘনাচ্ছে সন্ধ্যা। একে একে জ্বলে উঠছে রাজ সড়কের সোনালী নিয়ন আলো গুলো।পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্ব মিটিয়ে সপ্তাহান্তে সপরিবারে মহানগর ফিরছি আমরা। বাপ মেয়ের খুশির সীমা নেই। এক আমারই হৃদয় ভারাক্রান্ত। খুব রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। তার থেকেও বেশি হচ্ছে লজ্জা আর অপরাধ বোধ। এখুনি ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, আমি আসছি কি না জানতে। জয়ন্ত বাবু পেশায় আমাদের SLO। আজ ওনার মেয়ের বিয়ে, এটি দ্বিতীয়া।


 প্রথমার শুভ বিবাহেও সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল আমার। তখন সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী। কিছুই চিনি না।কাউকেই চিনি না। সংশ্লিষ্ট ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম, CKCO কে জিজ্ঞাসা করলাম সঙ্গী হবে কি না। কেউই রাজি হল না। দুজনেরই অন্য কোথাও নিমন্ত্রণ ছিল। একা যাবার সাহস জোটাতে পারিনি। সেবারও বিয়ের দিন সন্ধ্যা বেলায় জয়ন্ত বাবু ফোন করেছিলেন। জানতে চাইছিলেন, "ম্যাডাম কখন আসছেন, কচি ( তুত্তুরী) কে নিয়ে আসবেন কিন্তু -"। যেতে পারছি না বলার সময়, আক্ষরিক অর্থেই মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হলে মন্দ হত না। 


দ্বিতীয়ার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে যখন এলেন, লাফিয়ে পড়ে বললাম, "এবার আমি যাবোই। কেউ যাক আর নাই যাক, আমি যাব।"অথচ এবারেও কথা রাখতে পারলাম না। প্রায় দেড় মাস পর বাড়ি ফিরছে আমার বর। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তাকে তো সঙ্গ দিতেই হয়।  


বাড়িরও অভিমান থাকে, ফাঁকা ঘর গুলোও ভোগে নিঃসঙ্গতায়। প্রতি বার মহানগরে প্রত্যাবর্তন পূর্বক ফ্ল্যাটের দরজাটা খুললেই টের পাই, অভিমানে ভারী বাতাস। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। বড় সাধ করে ফ্ল্যাটটা কিনেছিল আমার বর। তাও বিয়ের ছ মাসের মাথায়। বিয়ের আগে থেকেই বলতো, "নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট চাই। আমাদের নিজস্ব বাড়ি"। অঞ্জন দত্তের সেই অমর লাইন," সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে তোমার আমার লাল নীল সংসার।"


 যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা আমার রক্ষণশীল মন, ছিছি করে উঠেছিল। হায় হায়, বিয়ে হতে না হতেই শাশুড়ি মায়ের সোনার সংসারে ভাঙ্গন ধরাব কিনা আমি। ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে আমার থেকেও বেশি আপত্তি ছিল আমার বাবার। শ্বশুরমশাই কে সেটা জানতেও দ্বিধা বোধ করেনি বাবা। এত বড় পরিবার আমাদের আর ওদের, বিয়ে হতে না হতেই আলাদা হয়ে গেলে লোকে কি বলবে।


হবু শ্বশুর বাড়ির বাইরের ঘরে বসে আড্ডা হচ্ছিল, শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, " আজ নয় টুকলু ( আমার দেওর) খুব ছোট, ওর বিয়ের কথা ভাবা যায় না। কাল তো যাবে। এই তিন কামরার ফ্লাটে দুই ছেলে দুই পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে থাকা যায় না।" আর শাশুড়ি মা বলেছিলেন," এই ফ্লাট আমার জিনিসপত্রেই ভর্তি, ও বিয়ে হয়ে এলে ওরও তো কিছুটা নিজস্ব জায়গা আর প্রাইভেসি দরকার।"


শর্ত একটাই ছিল,ফ্ল্যাটটা হতে হবে আমার শ্বশুর বাড়ির ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। যাতে সকাল বিকাল বৃদ্ধবৃদ্ধাকে দেখে আসতে পারি আমরা। কার্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, মহানগরের এই "nouveau riche" এলাকায় এমন ফ্ল্যাট কিনতে চাওয়া আর ফ্ল্যাট কেনার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। 


নেহাৎ কপাল জোরেই ফ্ল্যাটটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল বলতে পারেন। শৌভিক তখন প্রবেশনার, আলিপুরের কোন এক সিনিয়র অফিসারের ঘরে কি যেন কাজে গিয়ে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ। অমায়িক পরোপকারী বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা। অবসর গ্রহণের পর ইউনেস্কোর কি যেন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই কাজের সূত্রে আলিপুরের জেলা শাসকের কারণে পদার্পণ। ভয়ানক আড্ডাবাজ বৃদ্ধ প্রথম দর্শনে শৌভিকের সুহৃদ এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েন। তারপর যখন জানা যায় যে উভয়ে একই আবাসনের বাসিন্দা আরো দৃঢ় হয় বন্ধন। সদ্য বিবাহিত শৌভিককে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই প্রস্তাব দেন," আমার পাশের ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে আছে, মালিক কোনদিন থাকেনি। আর এখন তো ওরা সল্টলেকে একটা বাড়ি না ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। এটা বেচতে চায়,আমাকেই খরিদ্দার খুঁজে দিতে বলেছে, দেখো যদি তোমার পছন্দ হয়।"


ফ্ল্যাট দেখতে শৌভিকের সঙ্গে গিয়েছিলেন শাশুড়ি মাতা। তখন লিফট ছিল না, হাঁটুর ব্যথা তুচ্ছ করে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে ওঠেন চার তলায়। পরোপকারী বৃদ্ধ নিজেই চাবি খুলে ঘুরিয়ে দেখান ফ্ল্যাটটা। অতঃপর জোর করে ওনার ফ্ল্যাটে, ধরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ান। ফ্ল্যাট এবং প্রতিবেশী উভয়ই ভয়ানক পছন্দ হয়ে যায় শাশুড়ি মাতার। তৎকালীন মালিকের সাথে বাকি কথা বলে নেন প্রতিবেশী বৃদ্ধ আর শ্বশুরমশাই। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। যে দামে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন তার ওপর তৎকালীন ফিক্সড ডিপোজিট এর সুদ ধরে অংক কষে মূল্য নির্ধারণ করেন। আজকের বাজারদরে শুনলেও হাসি পাবে হয়ত, কিন্তু সদ্য চাকরিতে ঢোকা এক সরকারি কর্মচারীর পক্ষে তা তখন বেশ অনেকটাই বেশি ছিল।


লোন তো নিতেই হত, কুড়ি বছরের লোনের প্রথম মাসিক কিস্তি দেবার পরই আমরা অনুভব করলাম," পাগলা খাবি কি?"ফ্ল্যাট তো কেনা হল, বসবাস আর করা হল কই। ততদিনে পশ্চিম মেদিনীপুরে বদলি হয়ে গেল শৌভিক। আমাদের "লালনীল" সংসার হল বটে, তবে মহানগরের অঞ্চল ছায়ায় নয়, মাদপুর নামের গাঁয়ে, ধান ক্ষেত আর পুকুরে মোড়া বিডিও কোয়ার্টারে।


ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু হতে লাগল আরও বছর পাঁচেক। ততদিনে বদলে গেছে প্রতিবেশী। সহৃদয় বৃদ্ধ সপরিবারে সরে গেছেন অন্য কোথাও। তাও গৃহ প্রবেশের দিন তাকে ফোন করেছিল শৌভিক। গৃহপ্রবেশই বা সেই ভাবে হয়েছিল কোথায়, আমি লতা দি আর তুত্তুরী হাওড়া থেকে মালপত্র নিয়ে পৌঁছিয়ে ছিলাম। শৌভিক তখন মগরাহাটের বিডিও। ব্লক সামলে বেশ অনেক রাতে ফিরেছিল সেদিন বউ বাচ্ছার কাছে, নিজের ফ্ল্যাটে। 


 পুজো আচ্ছা সেভাবে কিছুই হয়নি, শৌভিক একে তো নাস্তিক তায় পেশাদারী ব্যস্ততা আর শ্বশুরমশাইয়ের অসুস্থতা মিলিয়ে কিছুই আর করা হয়নি। হাওড়া ছেড়ে আসার সময় দুটি ঠাকুর মূর্তি উপহার দিয়েছিল আমার পিসি, সাথে ধূপ, মোমবাতি, সিঁদুর আর মিছরি ইত্যাদি। বিয়ের দানের চৌকিতে তেনাদের বসিয়ে ধূপ, দীপ, সিঁদুর দিয়ে ওই তেল সিঁদুরই ঈশ্বরের নামে সব দরজায় ফোঁটা দিয়েছিলাম। ন বছর আগের সেই তেল সিঁদুরের ফোঁটা গুলো ধুলিমলিন হয়েছে বটে, টিকে আছে আজও। 


ইন্টিরিয়র ডিজাইনার দিয়ে সাজানো ছিল সাধ্য এবং কল্পনাতীত। নিজেদের মত করেই তাই সাজিয়েছিলাম ফ্ল্যাটটাকে। বারান্দা থেকে শোবার ঘর সর্বত্র সবুজ আর সবুজ। বাদ যায়নি শৌচাগার দুটিও। ফেলে দেওয়া কাঁচের বোতলে সাঁতার কাটা মানি প্লান্ট বসানো ছিল সিস্টার্নের ওপর।শৌভিক মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে বলত, "মনে হচ্ছে, জঙ্গলে বাস করছি।"


 বসার ঘরের এক দিকের দেওয়াল জুড়ে টাঙিয়ে ছিলাম শুধুই তুত্তুরীর বেড়ে ওঠার ছবি। বাবার কাঁধে মাথা রাখা ঘাড় না শক্ত হওয়া পুঁচকে তুত্তুরী, মুখে ভাতের দিন সকালে দিদার কোলে লাল চেলি, চন্দন, ফুলের মুকুট পরা তুত্তুরী, বুল্লু দাদার সাথে দোল খেলতে ব্যস্ত নেড়িমুন্ডি তুত্তুরী, প্রথম বার সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পরে ঠাম্মার কাঁধে হাত দিয়ে কেত মেরে দাঁড়ানো তুত্তুরী ইত্যাদি প্রভৃতি। ছবির তুত্তুরীদের বয়স থমকে গেছে বছর এগারোয় এসে। তারপরই তো ফ্ল্যাটটা ফেলে চলে আসি আমরা।


বদলির চাকরি,এই নিয়ে আর অনুযোগ কি। তমলুক থাকতে তাও হয়তো কিছুটা ঘনঘন যাওয়া হত, কাঁথি আসার পর চুকেছে সে পাট। যত দূরত্ব বাড়ছে, ততোই বাড়ছে বাড়ির অভিমান। প্রতিবারই নতুন নতুন উপদ্রব করছেন তিনি। কখনও খারাপ হয়ে বসে থাকছে কলিং বেল, তো কখনও পুটটি খসিয়ে উলঙ্গ হয়ে পড়ছে জানলার কাঁচ। কখনও জল আসছে না বাথরুমের কলে, তো কখনও ফুটো হয়ে যাচ্ছে রান্না ঘরের পাথরের সিঙ্ক। এমতবস্থায় ফুরিয়ে যাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বা AMC পুনর্নবীকরণ না করানো ওয়াটার পিউরিফায়ার যে কি বিভীষিকা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। 


প্রতিবার ফ্ল্যাটের তালা খুলেই বাজারে ছোটে শৌভিক, কফি আর বিস্কুট আনতে। এক কেজি চাল আর খানিক ডাল ছাড়া মুদি খানার কোন জিনিসই আমরা রেখে যাই না। নষ্ট হয়ে যায়। প্লাস্টিকের কৌটোর গন্ধ ছেড়ে যায়। এমনকি খারাপ হয়ে যায় সর্ষের তেল ও। কেমন যেন বোঁটকা তেলচিটে গন্ধ হয়ে যায়। গরম করলেও যায় না সেই গন্ধ। এবারে তাই কফি আর বিস্কুট নিয়েই এসেছি কাঁথি থেকে। খালি পায়ে গোটা ফ্ল্যাটে তুরতুর করে ঘোরে তুত্তুরী, পোশাক বদলে গেরস্থালির কাজে লেগে পড়ি দোঁহে। জানলা দরজা খুলি, পর্দা সরাই, এসি টাকে চালিয়ে রাখি যাতে  দূষিত হাওয়া বেরিয়ে যেতে পারে। গত বারের ঘরে পরা জামাকাপড় গুলো মেশিনে কাচতে দেয় শৌভিক। আমি ঢুকি রান্না ঘরে। আগে জল ভরবো। তারপর সসপ্যান,কাপ, চামচ ইত্যাদি মেজে কফির জল চড়াব। তারপর রাতের খাবার বাসন মাজব। প্রতিবার মেজে রেখে যাওয়া হয় সবকিছু, তাও - 


রান্না ঘরে পা দিতেই ছপাস করে উঠল জল। কি সর্বনাশ মাটিতে এত জল এল কোথা থেকে। জানলা খুলে গিয়েছিল নাকি? আমার হাউমাউ শুনে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক, ওই আবিষ্কার করল ব্যাপারটা। কল থেকে আকোয়া গার্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল যে পাইপটা, সেটি খুলে পড়ে গেছেন। ফলে না জানি কবে থেকে জল থৈথৈ সর্বত্র। 

দেখা গেল পাইপের মুখটা ফাটা। আগের বার সার্ভিস করতে আসা ছেলেটি বলেছিল বটে, তালা বন্ধ ফ্ল্যাট, আলো হাওয়া খেলে না, পাইপটা ঘনঘন পাল্টানো উচিৎ। তাই বলে এমন হবে তা কে জানত। অনলাইন কল বুক করে শৌভিক, আর আমি কোমর বাঁধি সাফাই কার্যে। এই তো জীবন কালি দা। মনের মধ্যে কেবল খচখচ করতে থাকে একটাই কাঁটা, জয়ন্ত বাবুকে দেওয়া কথার খেলাপ না করলে হয়তো এমন টা হত না। অথবা হত। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন বড্ড জটিল। পেশাদার আর সাংসারিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ চাপের। যারা পারেন তাঁদের কুর্নিশ। কেন যে আমি কোনটাই ভালো পারি না -

Tuesday 18 July 2023

অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি


ATM ব্যাপারটা মন্দ না হলেও, PTM শুনলেই আমার পিলে চমকায়। আমি সেই সব সংখ্যালঘু অপদার্থ মায়েদের মধ্যে পড়ি, যাদের সাধারণত স্কুল বা শিক্ষক(ইকা)দের বিরুদ্ধে কোন অনুযোগ/অভিযোগই থাকে না। নাই থাকে স্কুলকে সুপরামর্শ দেবার মত জ্ঞান। মহানগর থেকে কাঁথি পর্যায়ক্রমে তিনটে স্কুল পাল্টেছে তুত্তুরী, প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে এই স্কুলটা তো বেশ ভালো। প্রতিবার,প্রতিটি ক্লাস টিচারকে দেখেই আক্ষরিক অর্থে গলে গেছি আমি। মনে হয়েছে আমি "একটি নিয়েই গলদঘর্ম" আর এই মহাপুরুষ/মহীয়সী নারী একসাথে এতগুলি মনুষ্য শাবকরূপী জন্তুকে সামলান, তাও নামমাত্র ঠেঙিয়ে অথবা বিন্দুমাত্র না ঠেঙিয়ে , কি করে পারেন? এনাকে তো টুপি খুলে কুর্নিশ জানানো উচিৎ রে বাবা। তাই লিখে এসেছি প্রতিবার কমেন্ট বক্সে। শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছি আগামী দিনগুলির জন্য। 


তাই পেরেন্টস টিচার মিটিং এ টিচারের সাথে বাক্যালাপ করতে আমার কোন সমস্যা হয় না। ভয় লাগে অন্য পেরেন্টসদের দেখে। আসলে ভয় নয় বলতে পারেন লজ্জা। রীতিমত হীনমন্যতায় ভুগি অন্যান্য অভিভাবকদের সিরিয়াসনেস দেখে। তাই শনিবার যখন PTM এর নোটিফিকেশন এল, সোজা তা পাঠিয়ে দিলাম শৌভিকের মুঠোফোনে। তুই যা ভাই, আমায় এবারের মত খ্যামা দে। বহুৎ নির্যাতন সয়েছি বিগত কয়েক বছরে, আর নয়।


ও বাবা, তিনি নির্বাচনের কাজে নাকি এমনি ব্যস্ত যে ঘন্টা দুয়েকের জন্য মেয়ের ইস্কুলে যেতে পারবেন না। বাড়ি ফিরে আমায় বললেন, " ছেড়ে দে। কাউকেই যেতে হবে না। ও সোমবার গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে নেবে।" প্রস্তাবটা অপছন্দ হল না। রেজাল্ট অর্থাৎ ইউনিট টেস্টের রেজাল্ট, তাতে যে তিনি বেশ কয়েক বস্তা নম্বর পাবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিৎ। যা সিরিয়াস পূব মেদিনীপুরের ছেলেমেয়েরা, তাদের বাবামায়েদের সামনে ওই রেজাল্ট আনতে না যাওয়াই ভালো, ভেবে ঠিক করলাম আর যাবোই না।কিন্তু এমন ইমোশনাল অত্যাচার করতে শুরু করলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, যে যেতেই হল। 


আটটা থেকে দশটা দুঘন্টার PTM, এতক্ষণ বাঁচলে হয়। স্কুলের মস্ত গেটটা দিয়ে যখন ঢুকলাম, জনৈক স্টাফ এগিয়ে এসে কোন ক্লাস, সেকশন জেনে, জানাল তুত্তুরীর ক্লাস তিনতলায় হচ্ছে। অতঃপর চেহারা দেখে করুণা হল বোধহয় বলল, "এদিক দিয়ে যান, লিফট আছে।" প্যাঁচার মত বেশ খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর ভাবে বললাম, আমি সিঁড়ি ভাঙতে পারি। ছেলেটি এক গাল হেসে বলল, "ও পারেন-"। আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে সিঁড়ি ধরলাম। শুরুটাই যদি এমন হয়-


উঠতে গিয়ে বুঝলাম,ছেলেটা আমার মতই তলা আর ফ্লোরে গুলিয়েছে। থার্ড ফ্লোর অর্থাৎ চার তলায় বসেছে মিটিং। বাতানুকুল ঘর, সৌম্য দর্শন স্যার খোশ মেজাজে কি যেন বলতে শুরু করেছেন। অনুমতি নিয়ে বলির পাঁঠার মত ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম। ঘর ভর্তি নারী-পুরুষ। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় যদিও একজন অভিভাবককে আসতে বলা হয়েছে, অনেকেই যুগলে এসেছেন। জীবনেও একটা PTM অ্যাটেন্ড করেনি আমার বর। পাক্কা ইয়ে একটা, মনে মনে টিপিক্যাল হাওড়ার গালাগাল দিয়ে, একদম প্রথম বেঞ্চের এক কোণায় বসলাম। 


বসার সাথেসাথেই পাশে বসা বোরখাওয়ালি, মুখমণ্ডল অনাবৃত করে শুধাল, " এই, কম্পিউটারে কোন কোয়েশ্চন আনসার করিয়েছে গো?" প্রমাদ গুনলাম। রোজই অফিস থেকে ফিরে তুত্তুরীর স্কুলের গপ্প শুনি, তার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে বন্ধুদের সাথে কথোপকথন। ক্লাসে কি পড়াল, সাধারণত সে প্রসঙ্গ তোলেই না তুত্তুরী। আমিও খোঁচাই না। যেহেতু তুত্তুরীর পড়াশোনার দায়িত্ব টা আমরা দুজনে ভাগাভাগি করে বহন করি, তাই প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি যে ও শিখছে। আবার কি চাই। কাজেই এই প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। 


 বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলে মাথা এমন ভাবে নাড়লাম, যার অর্থ হ্যাঁ বা না দুই হতে পারে। উনি নাই ধরলেন, এবং সোচ্চারে ক্লাস টিচারের কাছে অনুযোগ করলেন, কেন করানো হয়নি। কম্পিউটার স্যারকে তলব করা হল। দেখা গেল তিনি অনুপস্থিত। অন্য ক্লাসের কম্পিউটার স্যার ছুটে এসে আশ্বাস দিলেন, তিনি নিজে ব্যাপারটা দেখবেন। অবশ্যই দেখবেন যাতে প্রশ্নোত্তর করানো হয়। তিনি বিদায় নেবার সাথে সাথেই তিনজন অভিভাবক নালিশ করলেন, ক্লাশে অত্যাধিক ভায়োলেন্স এবং গালিগালাজ চলে। এটা অবশ্য সত্যি, রোজই তুত্তুরী অভিযোগ করে, ছেলেগুলো নাকি খুব মারপিট করে, তাও মেয়েদের দেখিয়ে দেখিয়ে। একে অপরের অস্থানে কুস্থানে লাথি ঘুঁষি মারে আর "স্কুইশু" বলে চিৎকার করে। গালিও দেয়। কয়েকটা গালি শিখে এসে আমাদেরকেও শুনিয়েছে তুত্তুরী। শুনে বেশ আশাহত হয়েছি,আমাদের সমসাময়িক আমাদের জেলার ছেলেরা ছাড়ুন, মেয়েরাও এদের থেকে ভালো খিস্তিখেউর করত। 


বেচারী স্যার দেখলাম খুব দুঃখিত ভাবে মাথা নাড়লেন, আশ্বস্ত করলেন ভবিষ্যতে খিস্তি করা ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন রে বাপু, এই বয়সের ছেলেপুলে দুটো গালমন্দ, একটু আধটু ঝাড়পিঠও করতে পারবে না? তাহলে বয়ঃসন্ধি কালের হর্মন গুলো ক্ষরিত হবে কিভাবে, বলতে গিয়েও বললাম না। কয়েকজন মা সোচ্চারে ফিসফিসিয়ে বললেন, " আর ওইটা স্যার। ওইটা একটু দেখবেন, আমরা খুব ভয়ে আছি।" ব্যাপারটা কি জানতে উৎসুক হলাম, কিন্তু স্যার দেখলাম সুকৌশলে ধামাচাপা দিয়ে দিলেন। 


মিটিং গড়ালো,তলব করা হতে লাগল একের পর এক বিষয়ের স্যার/ম্যামকে।যত চুলচেরা চর্চা হতে লাগল প্রতিটা বিষয়, প্রতিটা চ্যাপ্টার নিয়ে, ততো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম আমি। কি খারাপ মা আমি, কি অপদার্থ মা যে কোন খবরই রাখি না। এমনকি মেয়ের রোল নম্বরটাও জানি না। ঘন্টা দুয়েক পরেও মিটিং শেষ হবার কোন লক্ষণ দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে রীতিমত মাথা ঘুরছে আমার। পাশের বোরখাওয়ালি দেখলাম উঠে পড়লেন, ওনার আরেকটা বাচ্ছা ক্লাস থ্রি তে পড়ে, ওই ক্লাসের PTM এও খানিকটা সময় দেবেন বলে। পিছন পিছন লাইন দিলাম আমিও। 


রিপোর্ট কার্ড নেবার কাগজে সই করছি যখন, তখনও চলছে বিশ্লেষণ। অন্যদের কথা শুনতে শুনতে স্যার শুধালেন, " আপনার কোন বক্তব্য নেই?" অসহায় ভাবে ঘাড় নেড়ে মনে পড়ল, ওনার হয়তো আছে, মানে যদি কিছু থাকে যেমন ধরুন - তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা টাইমে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে না, সর্বক্ষণ কথা বলে, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা,খাতা বই ঠিকঠাক নিয়ে আসে না,অঙ্ক খাতায় ভূগোলের হোমওয়ার্ক করে, বন্ধুদের ভেংচি কাটে ইত্যাদি প্রভৃতি। থাকতেই পারে কারণ তুত্তুরী এই সবগুলোই করে। 


উনি কিছু বললেন না যদিও, খোদা হাফিজ জানিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চেপে প্রথমেই মেসেজ করলাম প্রিয় বন্ধুদের গ্রুপে, "PTM থেকে ফিরলাম। রীতিমত অসুস্থ বোধ করছি। মানুষ এত প্রশ্ন করতে পারে 😔। বাপরে বাপরে বাপ।" চার মিনিটের মাথায় মেসেজ করল এক বন্ধু, "ফেরাটা একটা achievement বটে। গত ১৭ তারিখে আমাদের PTM ছিল, গিয়ে বুঝতে পারলাম,ভগবান কিছু অদ্ভুত জীব তৈরি করেছে মাইরি। একদল বলে মাঠে খেলায় না তাহলে গেমস এর টাকা নেয় কেন? আর একদল বলে আমার ছেলেকে রোদ্দুরে দাঁড় করিয়ে রাখা চলবে না। একজন পেরেন্ট তো বাথরুম ইন্সপেকশন করতে যেতে চাইছিল জানো।" 


হ্যা হ্যা করে এমন সজোরে হেসে উঠলাম যে নূপুর বাবু গাড়ি চালাতে চালাতে চমকে পিছন ফিরে তাকালেন। হাসি চেপে জানতে চাইলাম, কেন খামোখা বাথরুম ইন্সপেকশন করতে চাইল? জবাব এল, "ওনার সু পূত্তুর বলেছে বাথরুম নোংরা থাকে।" এটা অবশ্য কমন প্রবলেম। আমাদের ইস্কুলের বাথরুমের কথা ভাবলে এখনও বিবমিষা জাগে। তুত্তুরী তো ছোটবেলায় স্কুলের বাথরুমে পা রাখতেও চাইত না। রীতিমত মেরে ধরে বোঝাতে হয়েছে স্কুল বা গণ শৌচালয় কখনই বাড়ির মত সাফ থাকে না। এই ভীতি একবার জন্মে গেলে আর জীবনেও কাটে না। খেটে খাওয়া মানুষদের অত নেকুপুসু হলে চলে না। বন্ধুটিও সহমত জানালো দেখলাম। বলল," আমি বসে বসে কোল্ড ড্রিংক খেয়ে আর জ্ঞান শুনে চলে এলাম। ভাবছিলাম বলবে আপনার বাচ্ছা টাইমে টাইমে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে না, সর্বক্ষণ কথা বলে, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা,খাতা বই ঠিকঠাক নিয়ে আসে না-।" আরেক বন্ধু বলল, " ওরে আমিও আছি তোমাদের দলে -"। 


 শুনতে শুনতে মনে হল এতো পুরো আমার আর তুত্তুরী গল্প। বললাম, আয় ভাই বুকে আয়, রতনে যথার্থই রতন চেনে মাইরি। নাহলে আমাদের এত ভাব হয় কি করে। যাদের মা গুলোই এমন গুণধরী, তাদের বাচ্ছা গুলো আর মানুষ হয় কি করে। নাই বা হল মানুষ, সবাই যদি মানুষ হবে তাহলে দুনিয়াটা চলবে কি করে। হোক না দুচারটে আমাদের মত সংখ্যালঘু, অপগণ্ড, অপদার্থ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঁদুর দৌড়ে অংশ না নিয়ে, প্রাণ ভরে বাঁচুক না আমাদের ছানাগুলো। জীবন এটাই তো শিখিয়েছে, এই পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ উপভোগ করে প্রতিটা মুহূর্ত আশ মিটিয়ে বাঁচাটাই আসল, বাকি হিসেব ঠিক মিলেই যায় সময়ের সাথে সাথে।

তুত্তুরী উবাচ, ১৩ই জুলাই,২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻-(অন্যমনস্ক ভাবে, ভূগোল বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে) মস্কো শহরটা নিশ্চয়ই অনেক বড়। নাহলে একটা শহরে একশটা মিউজিয়াম থাকে কি করে। 

👩🏻-(বিরক্ত হয়ে) পড়তে বসে যত অপ্রাসঙ্গিক কথা। পড়া হয়ে গেলে দাদুকে জিজ্ঞাসা করিস। 

👧🏻-(উৎসুক স্বরে) দাদু মস্কো গিয়েছিল। 

👩🏻-(হাসি চেপে) তা যায়নি বটে, তবে দাদু কর্মনিষ্ঠ ছিল কি না। আর মস্কো হল কর্মনিষ্ঠদের জন্ম-কম্মভূমি। 

👧🏻-(বিস্ফোরিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে, অনুধাবন পূর্বক) ও দাদু কম্যুনিস্ট। আগে আমি কম্যুনিস্ট আর কম্যুনাল শব্দ দুটোতে খুব গুলিয়ে ফেলতাম। (বোঝাতে উদ্যত হতেই,আতঙ্কিত হয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে দু হাত তুলে) এখন বুঝি। এখন বুঝি। তুমি আবার বোঝাতে এস না।

অনির ডাইরি ৯ই জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


আসছে, আসবে করতে করতে শেষ পর্যন্ত এসেই পড়ল ভোটটা। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা, দুপুর দুপুর মেসেজ পাঠাল শৌভিক, আজই শেষ বেলায় ঘোষণা হতে চলেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট। ফরওয়ার্ড করে দিলাম টিম তাম্রলিপ্তর অফিসিয়াল গ্রুপে। একরাশ হতাশা নিয়ে জানতে চাইল সৌম্য, "ম্যাডাম চাইল্ড লেবারের অনুষ্ঠানটা কি আর করা ঠিক হবে?"


 দুদিন বাদেই ১২ই জুন, বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস। সেই উপলক্ষে মেছেদা বাসস্ট্যান্ডে বড় অনুষ্ঠান করতে চলেছিলাম আমরা। মহকুমা শাসক তথা পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, অসুস্থ অবস্থাতেও আমাদের এক অনুরোধে বাউল গানের টিম ঠিক করে দিয়েছিলেন জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক। শিশুশ্রম বিরোধী গানও লিখে ফেলেছিলেন কবি সৌম্য মুখোপাধ্যায় ওরফে আমাদের সৌম্য।  ছাপতে চলে গিয়েছিল ফ্লেক্সও, সৌম্যরই লেখা নাটকের রিহার্সালও দিয়ে ফেলেছিল দুই শান্তনু, মণীশ আর যশুয়া। সেখান থেকে পিছু হঠা যে কি মনখারাপি ব্যাপার। কিন্তু আমরা নিরুপায়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষা করার জন্যই তো সরকারি কর্মচারীদের জন্ম।


নির্বাচনী ঘোষণার সাথে সাথেই ব্লকের ইন্সপেক্টরদের তুলে নেওয়া হল। সবাই কোন না কোন সেলের ইনচার্জ অথবা সহকারী পঞ্চায়েত রিটার্নিং অফিসার অথবা সেক্টর অফিসার হয়ে বসল। আমার সবথেকে গোবলু ইন্সপেক্টরটা তো একসাথে একাধিক দায়িত্ব পেয়ে গেল। একই অঙ্গে এত রূপ, সামলাবি কি করে বাপ, বলা ছাড়া কিছুই করার ক্ষমতা নেই আমার। অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেল আমার অফিস। দুই পুরসভার ইন্সপেক্টর, আরএলও ইন্সপেক্টর আর সিকেসিওদের নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল অফিস। 


 সেই বা কতদিন,ওদেরও পোলিং ডিউটি পড়ল বলে। কিন্তু CKCO রা তো কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ। ওদের কি আদৌ এই ডিউটি পড়তে পারে? ফাঁকা অফিসে বিতর্ক জমে ওঠে। সঞ্জয় জোর গলায় দাবি করতে থাকে, "পড়বে না ম্যাডাম। কিছুতেই পড়তে পারে না।" আর শান্তনু বলে, "অবশ্যই পড়বে ম্যাডাম। আগের বারও পড়েছিল।"


দেখতে দেখতে প্রথম ট্রেনিংয়ের নোটিশ চলে আসে। ঝেঁটিয়ে ডিউটি পড়ে সবার। নেহাৎ জহর বাবু অবসরপ্রাপ্ত, না হলে হয়তো আমাকেই তালা খুলতে হত অফিসের। প্রথম ট্রেনিংটা শনিবার পড়েছিল এই রক্ষা, অবস্থা দেখে দ্বিতীয় ট্রেনিং এর কয়েকদিন আগেই অফিসের বাইরে নোটিশ টাঙাই আমরা, "অমুক তারিখে এই দপ্তরের সব কর্মচারীর ইলেকশন ট্রেনিং থাকার দরুণ, স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে।" এমনিতেও লোক কমই আসছে আজকাল, চড়চড়িয়ে সর্বত্র চড়ছে উত্তেজনার পারদ। এই পরিস্থিতিতে যারা আসছেন তারাও কাজ মিটিয়েই জুড়ছেন খোশ গল্প। কি হতে চলেছে আসন্ন নির্বাচনে, তাই নিয়েই চলছে গবেষণা, পাল্টা গবেষণা। 


  দ্বিতীয় ট্রেনিং এর আগেই ডিএম অফিসের কাকে যেন পটিয়ে, কার কোথায় ডিউটি পড়তে চলেছে সেই লিস্ট জোগাড় করে ফেলে শান্তনু। দেখা যায় রবিবাবু আর শান্তনুর একই স্কুলে ট্রেনিং পড়েছে। সে কি আনন্দ দুজনের। রবিবাবুর হাসি আর ধরে না, শান্তনু তো আনন্দের চোটে নেচেই নেয় কয়েক পাক। একসাথেই থাকবে, একসাথেই ডিউটি করবে দুজনে, যেন একই বুথে দেবে দুটোকে। ভোট মিটলে দীঘা ঘুরতে যাবে মানিকজোড় ইত্যাদি প্রভৃতি। চিরকাল দেখে আসছি, ভোটের ডিউটি পড়লেই সবার পিলের ব্যথা ওঠে, এতো উল্টোপুরাণ।  দিন-দুপুরে গাজা খেয়েছ দুজনে, বলে খেপাই আমি। 


রবি আর শান্তনুর আনন্দ দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। ভেঙে যায় জুটি যখন দ্বিতীয় ট্রেনিংয়ের আগের সন্ধ্যায় মেসেজ ঢোকে, কন্ট্রাকচুয়াল কর্মচারীদের অব্যাহতি দেওয়া হল পোলিং ডিউটি থেকে। উচ্চ আদালতে হুকুম নামা অনুসারে অফিস মাস্টারদের নির্দেশ দেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ সবাইকে জানাতে, যাতে ভুল করেও কোন কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ ট্রেনিংয়ে চলে না যায়। চটজলদি সবাইকে সচেতন করি আমি। আওয়াজ দেয় সঞ্জয়, "দেখলেন ম্যাডাম,  বলেছিলাম না। গরীবের কথা -"। এত রাতে করা Whatsapp এর ওপর ভরসা না করে, সবাইকে ফোন করে সচেতন করার দায়িত্বটা শান্তনুকেই দিই। যথারীতি দেখা যায় সুরজিৎ আর সৌমেন হোয়াটসঅ্যাপ খুলেও দেখেনি। শান্তনুর ফোন পেয়ে আকাশ থেকে পড়ে, দুটোয়, "সত্যি বলছু? কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবেনি তাহলে?" 


দিন এগোয়,পারদ চড়ে। নতুন করে নোটিশ ধরানো হয় শান্তনুর হাতে। ৫ম পোলিং অফিসারের দায়িত্বভার অর্পিত হয় ওর ওপর। ৫ম পোলিং কি বস্তু,খায় না মাখে বুঝে উঠতেই পারি না আমরা। বিন্দুমাত্র হেল্প করতে পারে না গুগল না ইউটিউব। জনৈক জেলাতুতো আধিকারিককে ভয়ে ভয়ে ফোন করে শুধাই আমি, এটা কি বস্তু। জবাব পাই, ৫ম আসলে রিজার্ভ পোলিং অফিসার। তবে ভোট করার লোকের সংখ্যা এতই কম যে একজনও আর রিজার্ভ পড়ে থাকবে না।প্রত্যেককেই সম্ভবত ডিউটি করতে হবে।


দুদিন আগেও টাট্টু ঘোড়ার মতন লাফিয়ে বেড়ানো ছেলেটা মুখ শুকনো করে ঘোরে আর বলতে থাকে, "বহুৎ না ইনসাফী হ্যায়। আমার একারই কেন অর্ডার এল বলুন তো ম্যাডাম। শুভাশিসদার ও এলে ভালো হত। দাঁড়ান ওকে একটু ফোন করে ভয় দেখাই-"। ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই ভয় পেয়ে যায় শান্তনু। ছেলের অসুস্থতার জন্য সেদিন একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল শুভাশিস। রাস্তাতেই ওকে প্রথমে ফোন, তারপর হোয়াটসঅ্যাপ করে অর্ডার ধরানো হয়েছে। সেই কি যেন গায়ে মাখলেও,  কে যেন ছাড়ে না কেস। একবার ছেড়ে দিয়েও আবার কেন ধরা হল, প্রশ্ন করলে শুনতে হয় লোক কোথায়? ভোটটা তো করতে হবে। সত্যিই তো ভোট করার জন্যই তো সরকারি কর্মচারীদের জন্ম,  তিনি স্থায়ী না অস্থায়ী কি যায় আসে তাতে।


ভোটের আগের দিন DC। ভোর ৭:০০ টায় রিপোর্ট করতে হবে সবাইকে। তার আগের দিন একটু তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিই সবাইকে, শর্ত একটাই, আমার সঙ্গে খেতে হবে এক কাপ চা। জহর বাবুর হাতের হাকুচ তেতো চায়ের কাপে ওঠে তুফান। অভিজ্ঞরা জ্ঞান দেয় নবীনদের। ভাগ করে নেওয়া হয় পূর্বের বিভিন্ন নির্বাচনী অভিজ্ঞতা। সবাই কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন, কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ। পেশাদারী কর্তব্য সেরে, অক্ষত দেহে, প্রিয়জনের কাছে ফিরতে উন্মুখ। ভরসা দিই আমি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, এত শিক্ষিত জেলা। মামলাবাজ হতে পারে, বর্বরদের মত ক্যালাক্যালি নির্ঘাত করবে না। 


ভুল ভাঙায় নন্দন। বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা শোনায়। চোখের সামনে দেখা মারামারি, খিস্তি খেউড়, মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া। এক থালা মাংস ভাত, এক প্যাকেট বিরিয়ানি, এক বোতল মদের জন্য নির্বিচারে মারধর, অসভ্যতা, অভব্যতা। দেখেও না দেখা আধিকারিক, প্রতিবাদ করে অপসৃত হওয়া পুলিশ, বাসি গল্প গুলো ধুলো ঝেড়ে নতুন করে উঠে আসে স্মৃতির পিছন পাতা থেকে। 


সময় থমকে দাঁড়ায় না, DC শুরু হয়ে যায়। বেলা গড়ায়, ব্যস্ততা চরমে ওঠে। ভোটের জিনিস পত্র বগলে নিজ নিজ বুথের দিকে রওনা হয় আমার টিম। সন্ধ্যা নামে, রাত গাঢ় হয়। খবর আসে,কেন্দ্রীয় বাহিনী আসেনি এখনও। তাদের ছাড়া পোলিং পার্টিকে বুথে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কোন কোন জায়গায়। সকাল থেকে জমানো সংযম ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মত। ফোন করি আমার ছেলেগুলোকে, ওরা ঠিক আছে তো। শৌভিক ধমকায়, "ওদের এখন অনেক কাজ, অনেক চাপ,ফোন করে জ্বালাতন করিস না।" 


সৌরভ, সঞ্জয়, শুভাশিস বা শান্তনুর সাথে কথা বলে মনে হয় না ওরা বিরক্ত হল। সবাই বেশ খুশি খুশি হয়েই কথা বলল। শান্তনু বলল, " ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ম্যাডাম জানেন তো। এমন সময় দরজায় কে যেন ঠকঠক করল। ব্যালট গুলো তো আমাদের সঙ্গেই আছে, আমরা তো ভয়েই অস্থির। সবার আগে ব্যালট গুলোকে ঝাপটে ধরিছি, তারপর দেখি সেক্টর অফিসার আসতেছে সিসিটিভি লাগাতে। তখন ধড়ে প্রাণ এল।" 


আজ সকাল থেকে দূরদর্শনের পর্দা জোড়া ঘটনা গুলি দেখতে দেখতে প্রতিটা মুহূর্তে একটা কথাই মনে হচ্ছিল  দূতের মত এই ভোট কর্মীরাও তো অবধ্য। নিখাদ পেটের দায়ে আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে ডিউটি করতে গেছে ওরা। 


এখন রাত সোয়া একটা, একের পর এক মেসেজ করছে আমার টিমের সদস্যরা, কেউ সেক্টর অফিসার হিসেবে পোলিং পার্টি তুলছে, কেউ বা পোলিং অফিসার হিসেবে বসে আছে কখন সেক্টর অফিসার বাস পাঠাবে। কেউ RC তে মাল পত্র জমা করবে বলে লাইন দিয়েছে তো কেউ RC র কাউন্টার ইন চার্জ হিসেবে জমা নেওয়া মাল পত্রের হিসেব রাখছে। কারো ছাড়া পেতে কাল সকাল নয়টা বাজবে, কেউ বা রিলিজ পেয়ে এত রাতেও ঘরমুখী। যত রাতই হোক, যত বেলাই হোক, যত হয়রানিই হোক ঘরে ফিরুক সবাই। অক্ষত দেহে ফিরে যাক প্রিয়জনদের কাছে এটাই আপাতত প্রার্থনা।

Saturday 1 July 2023

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

ভোর বেলা বুঝতেই পারিনি যে দিনটা এমন তুফান আনতে চলেছে। আর পাঁচটা দিনের মতই ভোর থেকে বাজা অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠা। "একটু জলদি নড় বাবা" বলে তুত্তুরীকে তাড়া দেওয়া। গোছানো স্কুলের ব্যাগ হাঁটকে বই খাতা  বার করে বিশেষ বিশেষ চ্যাপ্টার গুলোর ছবি তুলে রাখা। মেয়েকে স্কুলের দরজার সামনে ছেড়ে বাড়ি ফিরেই সারাদিনের পড়াশোনার হিসেব করা। তমলুকে একজন দিদিমণি ছিলেন,এখানে আর কাউকে রাখার ভরসা পাইনি আমরা। কে জানে, ক ঘন্টা আছি মোরা এথায়। ফলে মেয়ের পড়াশোনার পুরো দায়িত্বটাই ভাগ করে পালন করি আমরা। সব বিষয় পড়ানো, বোঝানো, রিভিশন করানোর দায়িত্ব আমার। ইংরেজি আর ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর গুলো লিখে এবং দেখে দেয় শোভিক। দু একটা বাদে প্রায় সব বিষয়েরই সিলেবাস শেষ করে ফেলেছি আমি আর তুত্তুরী। এবার রিভিশন দেবার পালা। তাই জন্যই ছবি তুলে নিই, ওকে স্কুলে ছেড়ে এসে ওই ছবি দেখে দেখে হোম ওয়ার্ক দিই আমি। 


গুচ্ছের হোম ওয়ার্ক দিয়ে,বরের সাথে খানিক ভিজে বাগানে হেঁটে, বাড়িতে ফোন করে বাবার প্রভাতী নিঃসঙ্গতা খানিক কাটিয়ে,স্নান, পুজো সেরে, ধড়াচূড়া পরে যখন খেতে বসি, আক্ষরিক অর্থেই গাইতে ইচ্ছে করে, " আমি সকল কাজের পাই যে সময়" ভালো করে খেতে পাইনে। রোজই মনে হয়, ইশ আমরাও যদি জাবর কাটতে পারতাম,তাহলে কি ভালোই না হত। তাড়াহুড়ো করে খাবার গুলো গলায় ঢেলে বেরিয়ে পড়তাম, বাসে বসে বসে আয়েস করে চিবিয়ে খেতাম। এমনিতেও তো গিলতেই হয়, চিবানোর অবকাশ পাই কোথায়। টাইম ম্যানেজমেন্ট ব্যাপারটা মোটেই আমার জন্য নয়। 


চিরুনি, ফেস পাউডার আর লিপস্টিক ব্যাগেই থাকে, মহকুমা শাসকের নিবাস থেকে রূপশ্রী বাইপাস যাবার পথে ঝটপট করে চুল আঁচড়ে, লিপস্টিক লাগিয়ে নিই। ফেস পাউডার অধিকাংশ দিনই আর লাগানো হয় না। দূর কে দেখবে।


আজ মাসের শেষ দিন, মায়ের পেনশনটা তুলে দিয়ে আসতে হবে। যদিও বাবা বলেই যাচ্ছে, তাড়া নেই। আমি জানি, মাসের শেষ দিন, খুব জোর হলে পয়লাতেই সবার বেতন দিয়ে দেয় বাবা। টাকাটা না  তুলে দিয়ে এলে চলবে কেমনে। বড় সাহেবকে বলে দ্বিতীয়ার্ধ ছুটি নিয়ে যখন বেরোলাম রোদে ফাটছে তাম্রলিপ্ত নগরী। রাস্তার ধারের টলটলে নয়ানজুলি ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে গতকালও মেঘের বালাপোশ মুড়ি দিয়ে ছিল শহরটা। পথে মেছেদায় থামলাম টাকা তুলব বলে। মায়ের নতুন পেনশনের এটিএম কার্ড এক্টিভেট করলাম। পেনশন তুললাম। এবার আমার টাকা তোলার পালা। বেশ কিছু টাকা দেবার আছে বাবাকে। তুলতে গিয়েই হোঁচট খেলাম, বলে কি, "non-operative account।"


বারো মাস এই একাউন্ট থেকেই টাকা তুলি, অনলাইন কেনাকাটা করি, গত কাল রাতেই তো টাকা ট্রান্সফার করেছি,কি যেন কিনেওছি, তাহলে non-operative হয় কি করে। এই সংক্রান্ত কোন মেল/ মেসেজও তো পাঠায়নি। বার তিনেক চেষ্টা করলাম, টাকার পরিমাণ কমিয়ে বাড়িয়ে। OTP ও এল, দিলাম ও,ফলাফল সেই এক। কেবল বলে হোম ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। হোম ব্রাঞ্চ তো সেই মহানগরে, মহাকরণের পিছনে। অবর বর্গীয় সহায়ক (এলডিসি) ছিলাম যখন, তখনই খোলা। সেখানে যাওয়া কি মুখের কথা। ছুটি নিয়ে যেতে হবে। ততোদিন আমার চলবে কি করে?


ওখানে দাঁড়িয়ে চুল ছিঁড়ে লাভ নেই, হাওড়া তো যেতেই হবে। হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সবার আগে অনলাইন ব্যাঙ্কিং একাউন্টটা খুলে দেখলাম, টাকাপয়সা গুলো আছে, নাকি -। হিসেব মিলে যেতে সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শান্তনুকে ফোন করলাম, আমাদের অফিসের যাবতীয় লেনদেন হয় যে ব্রাঞ্চ থেকে,তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখুক,যদি ওরা কোন হেল্প করতে পারে। তিন মিনিট বাদে শান্তনু ফোন করে বলল, "ম্যাডাম ওরা কেউ নেই। সবার ইলেকশন ডিউটি পড়েছে। সবাই ট্রেনিং নিতে গেছে। ব্রাঞ্চে তালা।" কি সর্বনাশ। 

গুগল দেখে হোম ব্রাঞ্চে ফোন করলাম, ল্যান্ড ফোন বেজেই গেল। অগুনতি বার ফোন করে করে ক্লান্ত হয়ে শেষে হেল্পলাইনে ফোন করলাম। অল্পবয়সী একটি ছেলে বলল, " বলুন ম্যাডাম আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি," সব জানিয়ে বললাম, একটু ঠিক করে দে বাবা। স্যালারি একাউন্ট নন অপারেটিভ হলে খেয়ে পড়ে বাঁচব কি করে। ছেলেটা কি সব খুটখাট করে বলল, " ম্যাডাম আমার লগ ইনে দেখাচ্ছে আপনার KYC পেন্ডিং।" কি মস্করা হচ্ছে, পদবী বদল, ঠিকানা বদল, আধার,প্যান লিঙ্ক হাবিজাবি কারণে কতবার তো করা হয়েছে KYC। ছেলেটি প্রশিক্ষিত দায়সারা  উত্তর দিয়ে ছেড়ে দিল, মোদ্দা কথা ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। 


চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কাঁদ কাঁদ সুরে যখন শৌভিক কে ফোন করলাম, ও তখন ট্রেনিং ভেনু ঘুরে দেখছে। ওই ব্যস্ততার মধ্যেই সব শুনল,বলল, "হাওড়া তো যাচ্ছিসই, একবার ব্যাংক ঘুরে আয়। দেখ কি সমস্যা।" ব্যাংকে গেলেই বা কি, আধার/ভোটার কার্ড, পাশ/চেক বই কিছুই  তো নেই। মোবাইলে আধার স্ক্যান করানো আছে কেবল কাকে যেন পাঠিয়ে ছিলাম। শৌভিক বলল, "ওটাই দেখিয়ে দিবি। গিয়েই দেখ না।" 


ভাবলাম গিয়েই দেখি, গুগল ম্যাপ বলল, ব্যাংক বন্ধ হয় বেলা তিনটায় আর তুমি যত জলদিই ছোট, সাড়ে তিনটার আগে পৌঁছাবে না। কি করি, ধরিত্রী কেন যে এই সব মুহূর্তে দ্বিধা হয় না। তখনই এক খুড়তুতো ননদের কথা মনে পড়ল, আমার পরিচিত এই একজনই আছে যে এখনো ব্যাংকে আছে। ভট্টাচার্য বাড়ির বিদুষী নক্ষত্র,শৌভিক গর্ব করে বলে ওর এই বোন একটা দিনের জন্য বেকার থাকেনি। মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোনোর সাথে সাথেই ব্যাংকের চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। একাধিক বড় ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের পদ সামলেছে দায়িত্ব নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, একটু ভয়ই পাই এই ননদিনীকে। আমার বিয়ে/ বৌভাতের দিন যে পুঁচকে মেয়েটা আমার পিছন পিছন ঘুরত সে এখন মস্ত অফিসার। তাও ভয়ে ভয়ে ফোনটা করেই ফেললাম, ভেবেছিলাম তুমি বলে সম্বোধন করব, ওর গলার উষ্ণতায় গলে গেল সঙ্কোচের বরফ। খুলে বললাম সমস্যার কথা। শ্রীমতী অসীমা ভট্টাচার্য সব শুনে বললেন, " অব্যশই যাও ব্যাংকে। চারটে অবধি তোমাকে ঢুকতেই দেবে। একটু এদিক ওদিক হলেও চিন্তা নেই,বললে ওরা হেল্প করে দেবে। বললে প্রিন্ট ও করে দেবে। বলেই দেখো না। " 


কি করে জানব আজই অফিস পাড়ার সবথেকে ধনী ব্রাঞ্চে যেতে হবে, গয়ংগচ্ছ ভাবে বেরিয়েছি, পরেছি একটা সস্তা সুতির সালোয়ার কামিজ। তেলে ভাজা পাঁপড়ের মত মুখ, ব্যাগ হাঁটকে একটা লিপস্টিক ও খুঁজে পেলাম না আজ। ঢুকতে দিলে হয়।ব্যাংকে যখন পৌঁছলাম, আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। ব্যাংকের মধ্যে ছোটখাট জনজোয়ার। আজ মাস কাবার কিনা। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। অনুসন্ধান লেখা কাউন্টারে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,সমস্যার কথা। টেবিলের উল্টো দিকে বসা রূপসী মেয়েটি, কি সব খুটখাট করে বলল, " আপনার একাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।শুধু টাকা ঢুকতে পারে,বেরোবে না।" মানে? সেই একই কথা KYC নেই। এর বেশি কথা উনি বলতে না শুনতে অক্ষম। বললেন সার্ভিস ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে। 


তাঁর কিউবিকলের সামনে বিরাট লাইন। লাইন দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। উনি কম্পিউটার ঘেঁটে বললেন, "২০১৪ য় করেছিলেন। আপনি বেঁচে আছেন কি না ব্যাংক বুঝবে কি করে? আবার করুন। যান ফর্ম তুলে আনুন।" বললাম আমার কাছে কোন ডকুমেন্ট হার্ড কপি নেই। শোনার সময় নেই বুঝতে পারলাম।


ফর্ম তুলে আবার গেলাম, ভদ্রলোক হাত থেকে ফর্ম কেড়ে নিয়ে চার জায়গায় টিক মেরে বললেন, "ভরে আনুন।" ভরে আবার লাইন দিলাম। উনি হাত নেড়ে ডেকে নিলেন আগে, বললেন," আধার দেখান।" মোবাইল খুলে স্ক্যান করা ছবিটা দেখলাম, একটা যন্ত্র এগিয়ে বললেন," আঙ্গুল ঠেকান"। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ঠেকালাম, কিছুই হল না। বুঝতে পেরে,ভালো করে গায়ে মুছে চাপ দিলাম। কিছুই এলো না। কি সর্বনাশ। ক্রিম মেখে মেখে ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে গেল নাকি?  তুত্তুরীর ছোটবেলায় বানানো আধারে যেমন নটা আঙ্গুলের ছাপ ছিল।দশমটা জাস্ট ওঠেনি,হাজার চেষ্টা করেও। আমার কি এই ধেড়ে বয়সে তাই হল?  লোকটা খানিক ক্ষণ তাকিয়ে দাড়ি চুলকে বলল, "অন্য আঙ্গুল দিন তো দেখি।" তর্জনী অবশ্য আমায় ব্যর্থ করল না। 


ফর্ম নিয়ে এই ওই সেই কাউন্টার ঘুরে, অনেক দফা অনুমোদন নিয়ে যখন লক খুলল তখন বৃষ্টি ভেজা মহানগরে নামছে বিকেল। ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকের দরজা। বলা হল,আরো একদফা কি যেন অনুমোদন লাগবে, ফলে এখুনি না পারলেও, কাল টাকা তুলতে পারব। এত দেরি হবে ভাবিনি। আপিস টাইমের ভাত ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি, এতটা পথ যাতায়াত করব বলে জল ও খাইনি তেমন। কে জানত দিনটা এমন গোবর মার্কা হতে চলেছে।


 হাওড়ায় আর বসার সময় নেই। আজই ফিরব কাঁথি। মায়ের পেনশন মায়ের হাতে দিয়ে, মায়ের হাতের পুঁই শাকের চচ্চড়ি আর ডবল ডিমের ঝাল দিয়ে কয়েক চামচ ভাত গিলতে গিলতে আবার মনে হল, জাবর কাটা ব্যাপারটা মন্দ নয়। কেমন সুন্দর এখন গিলে নিতাম আর কাঁথি যেতে যেতে চিবাতাম। দুটো কথা তো বলতে পারতাম আমার বুড়োবুড়ির সাথে।

অনির ডাইরি ২৯ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি


ব্যাগ গোছাচ্ছি, জহর বাবু দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম চলি যাচ্ছেন?" ঘাড় নেড়ে জানালাম হ্যাঁ। আজ উল্টোরথ, 'জগু এন্ড কোং'কে ফেরত আনতে হবে মাসির বাড়ি থেকে। নাহলে আমার যা গুণধরী মেয়ে, এই বৃষ্টিতে আজ আর আনতে যাব না, বলে বসে থাকবে। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছি। জহর বাবু আবার প্রশ্ন করলেন, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো?" হেসে বললাম, "হ্যাঁ, কাল ঈদুজ্জোহা তো। আপনি আবার ভুলে গিয়ে, অফিস খুলে বসে থাকবেননি যেন।" একাধিক বার ওমন করার রেকর্ড আছে ভদ্রলোকের। শুনে একগাল হাসলেন জহর বাবু, তারপর  জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম, তাহলে হক বাবু খাওয়াবেন তো?" প্রশ্নের গুঁতোয় হাসি চাপা দায়। জহর বাবু একটু খেতে ভালোবাসেন, একদম আমারই মতো।  হক বাবু এই কিছুদিন আগের ঈদেই সবাইকে পেট পুরে খাইয়েছেন। আবার খাওয়াতে বললে নির্ঘাত মারবেন।সেটাই জানালাম বৃদ্ধকে।


ঘন মেঘে ঢাকা হাই রোড ধরে বাড়ি ফিরছি, উপর্যুপরি বৃষ্টিতে ঝাপসা জানলার কাঁচ। একই প্রশ্ন করল উত্তমকুমার, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো? নাকি কোথাও বেরোবেন?" ঈদের দিন আবার কোথায় বেরোবো রে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না জেনে রাখতেছি। আসলে কালকের দিনটা একটা ছুটি নিব আর কি, কুরবানি করব তো।"

বিষম খেয়ে বললাম, তুমি কুরবানী করবে? মানে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না না আমি না। আমার এক বন্ধু করবে।ওদের কি নিয়ম আছে, কুরবানীর পর মাংস বিলি করে গরীব-দুঃখীকে, পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়, কিছুটা ফ্রিজে রেখেও ৩-৪ কিলো মতো থেকে যায়। ওটাই বন্ধুরা সবাই মিলে রেঁধে খাই। ওদের ভাড়া বাড়ির ছাদে প্লাস্টিক টাঙানো হয়ে গেছে। কড়া-খুন্তি-হাতা ভাড়া করে নিই আমরা, বাজারে বলাও হয়ে গেছে। ও কুরবানী করে মাংস বিলি করতে যায়, আমরা বাকি বন্ধুরা মিলে রান্না করি।  শুধু মাংস আর ভাত, আর কিচ্ছু নয়। মাথা পিছু সাত আট পিস করে হয়, দুপুর বেলা সবাই মিলে ওদের ছাদে বসে একসাথে খাই।"


মাংস বিলি করার ব্যাপারটা আগের দিনই হক বাবু বোঝাচ্ছিলেন বিশদে। দুদিন ছুটি চাইতে এসেছিলেন ঈদ উপলক্ষে, আমিই প্রশ্ন করেছিলাম কি কুরবানী দেন আপনারা? চার্চ লেনের বুড়ো হুসেন মিঞা বলত, সবাই গরু দেয় না। যার যেমন সামর্থ্য তেমনি দেয়। ধনীরা উট বা দুম্বা দেয়, ভেড়াও দেয় বোধ হয়। ছাগল দেয়। গরু ও দেয়। হুসেন মিঞার বক্তব্য অনুসারে, গাঁয়ের গরিবগুর্বো মানুষজন বেশ কয়েকজন মিলে একটা গরু দেয়। একে তো সস্তা হয়,তারওপর মাংসটাও একটু বেশি পাওয়া যায়। এই আর কি-। 


সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হক বাবুকে জিজ্ঞাসা করছিলাম। হক বাবু বললেন,' আমি দিই না ম্যাডাম। আমার দাদার ঘরে দেওয়া হয়।ওখানেই যাব। ছাগলই দেওয়া হয়।" জিজ্ঞাসা করলাম, ছাগল ছাড়া এখানে আর কি কুরবানি দেয় লোকজন। উট দেয় কি? হক বাবু বললেন," উট তেমন প্রচলিত নয় এদিকে। কেন বলুন তো, এখানে যে উটগুলো বেচতে আসে সেগুলো এমনিতেই বাতিল। অকর্মণ্য। বুড়ো উট। কেবল লোক দেখাতেই কেনা আর বেচা। আমি একবারই খেয়েছিলাম, ভালো লাগেনি। আমার দুম্বাও এমন আহামরি লাগে না। দিশি ছাগল দেয়, আর বড় বড় ছাগল যেগুলোকে রামছাগল বলে ওগুলো দেওয়া হয়।"


একটু থেমে বললেন, " ম্যাডাম, আমাদের নিয়ম কি জানেন! কুরবানী হয়ে গেলে মাংসটা তিনভাগ করা হয়। একভাগ বিলি করা হয় গরিব-দুঃখীদের, একভাগ যায় পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজনদের,  বাকিটা আমরা খাই। সেই জন্যেই ম্যাডাম, এই ঈদে আমি কাউকে বাড়িতে ডাকি না। এত মাংস আসে, গরুও আসে, যদি মিলেমিশে যায়।"


শুনতে শুনতে চার্চ লেনের নাজিম সাহেবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঈদ এলেই খাওয়াতেন নাজিম সাহেব, কিন্তু মুর্গি। আর প্রতিবারই জনৈক বৃদ্ধবড়দা, "বড়খাসি" খাওয়ানোর জন্য ঝোলাঝুলি করতেন। প্রতিবারই এক কথা বলতেন নাজিম সাহেব, "কেন গো, আপনাদের ধর্মে এই একটা জিনিসই তো খেতে নিষেধ আছে, সেটাই মানুন না। তাছাড়া আমার ধর্মেও নিষেধ আছে। কাউকে জোর করে বা না জানিয়ে খাওয়াতে নেই।" 


তাই জন্যই বোধহয় মইনুদ্দিন মামা মাংসের ঝোলাটা মায়ের হাতে ধরিয়েই বলতেন, " এটা কিন্তু খাসির মাংস।" মায়ের সহকর্মী ছিলেন ভদ্রলোক,  গোঁড়া বিহারী মুসলমান। পূর্বপুরুষ খাস সৌদি আরব থেকে এসেছিলেন বলে দাবি করতেন। নিয়মিত ইসলামী তত্ত্ব আর ইসলামী শাস্ত্র চর্চা করতেন আমার মায়ের সাথে। সুদূর মুর্শিদাবাদের রামনগর হাই স্কুলের ছাত্রী আমার মায়ের মাথার উপর দিয়ে যেত সেই সব জটিল তত্ত্ব। আকারে, ইঙ্গিতে, চিল্লিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে, চেয়ার নিয়ে সটান ঘুরে বসে, এমনকি ওনার স্ত্রীর কাছে নালিশ করে তা প্রকাশও করত মা। তাও দমানো যেত না বুড়োকে। ধর্মচর্চা না করলেই অংক করাতেন,  রীতিমতো বেত্রাঘাত করে। ওনার অংকের গুঁতোয় কি যেন একটা ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা এক লপ্তেই পাশ করে গিয়েছিল মা। 


এহেন মইনুদ্দিন মামা প্রতি ঈদে, চার পাঁচ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে আসতেন, তার পাতানো বোনকে মাংস দিতে। স্টিলের ঝোলায় ঝরঝরে কাঁচা মাংস, দুপুরবেলায় মায়ের হাতের গুণে কি যে খুশবু ছড়াতো বাড়ি ময়। সেই দশক গুলোই বোধহয় ছিল অন্যরকম। যুগটাও ছিল আলাদা। উনি গোঁড়া মুসলমান আমরা বর্ণ হিন্দু। যে যার, সে তার ধর্ম নিয়ে নিষ্ঠাবান এবং সোচ্চার। উভয়ের চোখেই তার তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র মধ্যে। মানবিক সম্পর্ক গুলোর  মাঝে কখনো নাক গলাবার সুযোগ পেত না সে। আর আজ কাউকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গেলেও তিনবার ভাবতে হয়। আমাদের বা ওদের কোন ধর্মীয় অনুশাসন ভাঙছি না তো? নেটিজেনরা আবার সেকু/ সেকুলাঙ্গার বলে গাল পাড়বে নাতো। 


ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, উত্তমের গলার আওয়াজে যখন হুঁশ ফিরল, কালিনগরের খাল পেরোচ্ছি। মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ' কি বলছ?' উত্তমকুমার গাড়ি চালাতে চালাতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, " আপনি কখনও কুরবানীর মাংস খেয়েছেন ম্যাডাম?" ব্যাটা বলে কি? গুছিয়ে জবাব দিতে যাব, তার আগেই উত্তম বলল, "এমনি দোকান থেকে ওই নলি কাটা (হালাল) মাংস কিনে খেয়ে দেখবেন,আর কুরবানীর মাংস খেয়ে দেখবেন। একদম আলাদা। কি যে কানে ফিসফিস করে মন্ত্র পড়ে দেয়, স্বাদটাই আলাদা হয়ে যায়। ঠিক যেমন আমাদের বলির মাংসের স্বাদ একদম আলাদা হয়। এমনি ছাগল কাটুন ওই স্বাদই পাবেন না। কি ভাবে যে হয়। সবই বোধহয় ভগবানের মহিমা বুঝলেন তো ম্যাডাম।" 


দূর কি এতক্ষণ উল্টোপাল্টা ভাবছিলাম, কিচ্ছু বদলায়নি আমার দেশ।  গুটি কয়েক নেটিজেনের বাইরে যে বৃহত্তর খেটে খাওয়া ভারতবর্ষ, ছিটে ফোঁটা ও বদল হয়নি তার চরিত্রে। একই আছে আমার দেশ। বড় করে একটা শ্বাস ফেলে আঙ্গুলের ইশারায় বললাম, তুই সামনে ফিরে গাড়ি চালা বাপ, এখনই মরতে চাই না। রথ সমেত তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে বাড়ি আনতে হবে, জিলিপি খেতে হবে, কাল সকাল হলেই জনগণকে ঈদ মুবারক করতে হবে, একটু বেলা হলেই সব গোঁসা করে বসে থাকবেন নয়তো নিজেরাই লাফাতে লাফাতে ফোন করে বসবেন। শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব মিটলে বাসি জিলিপি গুলোও সাবাড় করতে হবে, কাজ কি কম। মরার কি ফুরসৎ আছে বাপু।