#অনিরডাইরি
আসছে, আসবে করতে করতে শেষ পর্যন্ত এসেই পড়ল ভোটটা। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা, দুপুর দুপুর মেসেজ পাঠাল শৌভিক, আজই শেষ বেলায় ঘোষণা হতে চলেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট। ফরওয়ার্ড করে দিলাম টিম তাম্রলিপ্তর অফিসিয়াল গ্রুপে। একরাশ হতাশা নিয়ে জানতে চাইল সৌম্য, "ম্যাডাম চাইল্ড লেবারের অনুষ্ঠানটা কি আর করা ঠিক হবে?"
দুদিন বাদেই ১২ই জুন, বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস। সেই উপলক্ষে মেছেদা বাসস্ট্যান্ডে বড় অনুষ্ঠান করতে চলেছিলাম আমরা। মহকুমা শাসক তথা পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, অসুস্থ অবস্থাতেও আমাদের এক অনুরোধে বাউল গানের টিম ঠিক করে দিয়েছিলেন জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক। শিশুশ্রম বিরোধী গানও লিখে ফেলেছিলেন কবি সৌম্য মুখোপাধ্যায় ওরফে আমাদের সৌম্য। ছাপতে চলে গিয়েছিল ফ্লেক্সও, সৌম্যরই লেখা নাটকের রিহার্সালও দিয়ে ফেলেছিল দুই শান্তনু, মণীশ আর যশুয়া। সেখান থেকে পিছু হঠা যে কি মনখারাপি ব্যাপার। কিন্তু আমরা নিরুপায়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষা করার জন্যই তো সরকারি কর্মচারীদের জন্ম।
নির্বাচনী ঘোষণার সাথে সাথেই ব্লকের ইন্সপেক্টরদের তুলে নেওয়া হল। সবাই কোন না কোন সেলের ইনচার্জ অথবা সহকারী পঞ্চায়েত রিটার্নিং অফিসার অথবা সেক্টর অফিসার হয়ে বসল। আমার সবথেকে গোবলু ইন্সপেক্টরটা তো একসাথে একাধিক দায়িত্ব পেয়ে গেল। একই অঙ্গে এত রূপ, সামলাবি কি করে বাপ, বলা ছাড়া কিছুই করার ক্ষমতা নেই আমার। অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেল আমার অফিস। দুই পুরসভার ইন্সপেক্টর, আরএলও ইন্সপেক্টর আর সিকেসিওদের নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল অফিস।
সেই বা কতদিন,ওদেরও পোলিং ডিউটি পড়ল বলে। কিন্তু CKCO রা তো কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ। ওদের কি আদৌ এই ডিউটি পড়তে পারে? ফাঁকা অফিসে বিতর্ক জমে ওঠে। সঞ্জয় জোর গলায় দাবি করতে থাকে, "পড়বে না ম্যাডাম। কিছুতেই পড়তে পারে না।" আর শান্তনু বলে, "অবশ্যই পড়বে ম্যাডাম। আগের বারও পড়েছিল।"
দেখতে দেখতে প্রথম ট্রেনিংয়ের নোটিশ চলে আসে। ঝেঁটিয়ে ডিউটি পড়ে সবার। নেহাৎ জহর বাবু অবসরপ্রাপ্ত, না হলে হয়তো আমাকেই তালা খুলতে হত অফিসের। প্রথম ট্রেনিংটা শনিবার পড়েছিল এই রক্ষা, অবস্থা দেখে দ্বিতীয় ট্রেনিং এর কয়েকদিন আগেই অফিসের বাইরে নোটিশ টাঙাই আমরা, "অমুক তারিখে এই দপ্তরের সব কর্মচারীর ইলেকশন ট্রেনিং থাকার দরুণ, স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে।" এমনিতেও লোক কমই আসছে আজকাল, চড়চড়িয়ে সর্বত্র চড়ছে উত্তেজনার পারদ। এই পরিস্থিতিতে যারা আসছেন তারাও কাজ মিটিয়েই জুড়ছেন খোশ গল্প। কি হতে চলেছে আসন্ন নির্বাচনে, তাই নিয়েই চলছে গবেষণা, পাল্টা গবেষণা।
দ্বিতীয় ট্রেনিং এর আগেই ডিএম অফিসের কাকে যেন পটিয়ে, কার কোথায় ডিউটি পড়তে চলেছে সেই লিস্ট জোগাড় করে ফেলে শান্তনু। দেখা যায় রবিবাবু আর শান্তনুর একই স্কুলে ট্রেনিং পড়েছে। সে কি আনন্দ দুজনের। রবিবাবুর হাসি আর ধরে না, শান্তনু তো আনন্দের চোটে নেচেই নেয় কয়েক পাক। একসাথেই থাকবে, একসাথেই ডিউটি করবে দুজনে, যেন একই বুথে দেবে দুটোকে। ভোট মিটলে দীঘা ঘুরতে যাবে মানিকজোড় ইত্যাদি প্রভৃতি। চিরকাল দেখে আসছি, ভোটের ডিউটি পড়লেই সবার পিলের ব্যথা ওঠে, এতো উল্টোপুরাণ। দিন-দুপুরে গাজা খেয়েছ দুজনে, বলে খেপাই আমি।
রবি আর শান্তনুর আনন্দ দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। ভেঙে যায় জুটি যখন দ্বিতীয় ট্রেনিংয়ের আগের সন্ধ্যায় মেসেজ ঢোকে, কন্ট্রাকচুয়াল কর্মচারীদের অব্যাহতি দেওয়া হল পোলিং ডিউটি থেকে। উচ্চ আদালতে হুকুম নামা অনুসারে অফিস মাস্টারদের নির্দেশ দেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ সবাইকে জানাতে, যাতে ভুল করেও কোন কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ ট্রেনিংয়ে চলে না যায়। চটজলদি সবাইকে সচেতন করি আমি। আওয়াজ দেয় সঞ্জয়, "দেখলেন ম্যাডাম, বলেছিলাম না। গরীবের কথা -"। এত রাতে করা Whatsapp এর ওপর ভরসা না করে, সবাইকে ফোন করে সচেতন করার দায়িত্বটা শান্তনুকেই দিই। যথারীতি দেখা যায় সুরজিৎ আর সৌমেন হোয়াটসঅ্যাপ খুলেও দেখেনি। শান্তনুর ফোন পেয়ে আকাশ থেকে পড়ে, দুটোয়, "সত্যি বলছু? কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবেনি তাহলে?"
দিন এগোয়,পারদ চড়ে। নতুন করে নোটিশ ধরানো হয় শান্তনুর হাতে। ৫ম পোলিং অফিসারের দায়িত্বভার অর্পিত হয় ওর ওপর। ৫ম পোলিং কি বস্তু,খায় না মাখে বুঝে উঠতেই পারি না আমরা। বিন্দুমাত্র হেল্প করতে পারে না গুগল না ইউটিউব। জনৈক জেলাতুতো আধিকারিককে ভয়ে ভয়ে ফোন করে শুধাই আমি, এটা কি বস্তু। জবাব পাই, ৫ম আসলে রিজার্ভ পোলিং অফিসার। তবে ভোট করার লোকের সংখ্যা এতই কম যে একজনও আর রিজার্ভ পড়ে থাকবে না।প্রত্যেককেই সম্ভবত ডিউটি করতে হবে।
দুদিন আগেও টাট্টু ঘোড়ার মতন লাফিয়ে বেড়ানো ছেলেটা মুখ শুকনো করে ঘোরে আর বলতে থাকে, "বহুৎ না ইনসাফী হ্যায়। আমার একারই কেন অর্ডার এল বলুন তো ম্যাডাম। শুভাশিসদার ও এলে ভালো হত। দাঁড়ান ওকে একটু ফোন করে ভয় দেখাই-"। ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই ভয় পেয়ে যায় শান্তনু। ছেলের অসুস্থতার জন্য সেদিন একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল শুভাশিস। রাস্তাতেই ওকে প্রথমে ফোন, তারপর হোয়াটসঅ্যাপ করে অর্ডার ধরানো হয়েছে। সেই কি যেন গায়ে মাখলেও, কে যেন ছাড়ে না কেস। একবার ছেড়ে দিয়েও আবার কেন ধরা হল, প্রশ্ন করলে শুনতে হয় লোক কোথায়? ভোটটা তো করতে হবে। সত্যিই তো ভোট করার জন্যই তো সরকারি কর্মচারীদের জন্ম, তিনি স্থায়ী না অস্থায়ী কি যায় আসে তাতে।
ভোটের আগের দিন DC। ভোর ৭:০০ টায় রিপোর্ট করতে হবে সবাইকে। তার আগের দিন একটু তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিই সবাইকে, শর্ত একটাই, আমার সঙ্গে খেতে হবে এক কাপ চা। জহর বাবুর হাতের হাকুচ তেতো চায়ের কাপে ওঠে তুফান। অভিজ্ঞরা জ্ঞান দেয় নবীনদের। ভাগ করে নেওয়া হয় পূর্বের বিভিন্ন নির্বাচনী অভিজ্ঞতা। সবাই কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন, কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ। পেশাদারী কর্তব্য সেরে, অক্ষত দেহে, প্রিয়জনের কাছে ফিরতে উন্মুখ। ভরসা দিই আমি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, এত শিক্ষিত জেলা। মামলাবাজ হতে পারে, বর্বরদের মত ক্যালাক্যালি নির্ঘাত করবে না।
ভুল ভাঙায় নন্দন। বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা শোনায়। চোখের সামনে দেখা মারামারি, খিস্তি খেউড়, মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া। এক থালা মাংস ভাত, এক প্যাকেট বিরিয়ানি, এক বোতল মদের জন্য নির্বিচারে মারধর, অসভ্যতা, অভব্যতা। দেখেও না দেখা আধিকারিক, প্রতিবাদ করে অপসৃত হওয়া পুলিশ, বাসি গল্প গুলো ধুলো ঝেড়ে নতুন করে উঠে আসে স্মৃতির পিছন পাতা থেকে।
সময় থমকে দাঁড়ায় না, DC শুরু হয়ে যায়। বেলা গড়ায়, ব্যস্ততা চরমে ওঠে। ভোটের জিনিস পত্র বগলে নিজ নিজ বুথের দিকে রওনা হয় আমার টিম। সন্ধ্যা নামে, রাত গাঢ় হয়। খবর আসে,কেন্দ্রীয় বাহিনী আসেনি এখনও। তাদের ছাড়া পোলিং পার্টিকে বুথে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কোন কোন জায়গায়। সকাল থেকে জমানো সংযম ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মত। ফোন করি আমার ছেলেগুলোকে, ওরা ঠিক আছে তো। শৌভিক ধমকায়, "ওদের এখন অনেক কাজ, অনেক চাপ,ফোন করে জ্বালাতন করিস না।"
সৌরভ, সঞ্জয়, শুভাশিস বা শান্তনুর সাথে কথা বলে মনে হয় না ওরা বিরক্ত হল। সবাই বেশ খুশি খুশি হয়েই কথা বলল। শান্তনু বলল, " ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ম্যাডাম জানেন তো। এমন সময় দরজায় কে যেন ঠকঠক করল। ব্যালট গুলো তো আমাদের সঙ্গেই আছে, আমরা তো ভয়েই অস্থির। সবার আগে ব্যালট গুলোকে ঝাপটে ধরিছি, তারপর দেখি সেক্টর অফিসার আসতেছে সিসিটিভি লাগাতে। তখন ধড়ে প্রাণ এল।"
আজ সকাল থেকে দূরদর্শনের পর্দা জোড়া ঘটনা গুলি দেখতে দেখতে প্রতিটা মুহূর্তে একটা কথাই মনে হচ্ছিল দূতের মত এই ভোট কর্মীরাও তো অবধ্য। নিখাদ পেটের দায়ে আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে ডিউটি করতে গেছে ওরা।
এখন রাত সোয়া একটা, একের পর এক মেসেজ করছে আমার টিমের সদস্যরা, কেউ সেক্টর অফিসার হিসেবে পোলিং পার্টি তুলছে, কেউ বা পোলিং অফিসার হিসেবে বসে আছে কখন সেক্টর অফিসার বাস পাঠাবে। কেউ RC তে মাল পত্র জমা করবে বলে লাইন দিয়েছে তো কেউ RC র কাউন্টার ইন চার্জ হিসেবে জমা নেওয়া মাল পত্রের হিসেব রাখছে। কারো ছাড়া পেতে কাল সকাল নয়টা বাজবে, কেউ বা রিলিজ পেয়ে এত রাতেও ঘরমুখী। যত রাতই হোক, যত বেলাই হোক, যত হয়রানিই হোক ঘরে ফিরুক সবাই। অক্ষত দেহে ফিরে যাক প্রিয়জনদের কাছে এটাই আপাতত প্রার্থনা।
No comments:
Post a Comment