Saturday, 1 July 2023

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

ভোর বেলা বুঝতেই পারিনি যে দিনটা এমন তুফান আনতে চলেছে। আর পাঁচটা দিনের মতই ভোর থেকে বাজা অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠা। "একটু জলদি নড় বাবা" বলে তুত্তুরীকে তাড়া দেওয়া। গোছানো স্কুলের ব্যাগ হাঁটকে বই খাতা  বার করে বিশেষ বিশেষ চ্যাপ্টার গুলোর ছবি তুলে রাখা। মেয়েকে স্কুলের দরজার সামনে ছেড়ে বাড়ি ফিরেই সারাদিনের পড়াশোনার হিসেব করা। তমলুকে একজন দিদিমণি ছিলেন,এখানে আর কাউকে রাখার ভরসা পাইনি আমরা। কে জানে, ক ঘন্টা আছি মোরা এথায়। ফলে মেয়ের পড়াশোনার পুরো দায়িত্বটাই ভাগ করে পালন করি আমরা। সব বিষয় পড়ানো, বোঝানো, রিভিশন করানোর দায়িত্ব আমার। ইংরেজি আর ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর গুলো লিখে এবং দেখে দেয় শোভিক। দু একটা বাদে প্রায় সব বিষয়েরই সিলেবাস শেষ করে ফেলেছি আমি আর তুত্তুরী। এবার রিভিশন দেবার পালা। তাই জন্যই ছবি তুলে নিই, ওকে স্কুলে ছেড়ে এসে ওই ছবি দেখে দেখে হোম ওয়ার্ক দিই আমি। 


গুচ্ছের হোম ওয়ার্ক দিয়ে,বরের সাথে খানিক ভিজে বাগানে হেঁটে, বাড়িতে ফোন করে বাবার প্রভাতী নিঃসঙ্গতা খানিক কাটিয়ে,স্নান, পুজো সেরে, ধড়াচূড়া পরে যখন খেতে বসি, আক্ষরিক অর্থেই গাইতে ইচ্ছে করে, " আমি সকল কাজের পাই যে সময়" ভালো করে খেতে পাইনে। রোজই মনে হয়, ইশ আমরাও যদি জাবর কাটতে পারতাম,তাহলে কি ভালোই না হত। তাড়াহুড়ো করে খাবার গুলো গলায় ঢেলে বেরিয়ে পড়তাম, বাসে বসে বসে আয়েস করে চিবিয়ে খেতাম। এমনিতেও তো গিলতেই হয়, চিবানোর অবকাশ পাই কোথায়। টাইম ম্যানেজমেন্ট ব্যাপারটা মোটেই আমার জন্য নয়। 


চিরুনি, ফেস পাউডার আর লিপস্টিক ব্যাগেই থাকে, মহকুমা শাসকের নিবাস থেকে রূপশ্রী বাইপাস যাবার পথে ঝটপট করে চুল আঁচড়ে, লিপস্টিক লাগিয়ে নিই। ফেস পাউডার অধিকাংশ দিনই আর লাগানো হয় না। দূর কে দেখবে।


আজ মাসের শেষ দিন, মায়ের পেনশনটা তুলে দিয়ে আসতে হবে। যদিও বাবা বলেই যাচ্ছে, তাড়া নেই। আমি জানি, মাসের শেষ দিন, খুব জোর হলে পয়লাতেই সবার বেতন দিয়ে দেয় বাবা। টাকাটা না  তুলে দিয়ে এলে চলবে কেমনে। বড় সাহেবকে বলে দ্বিতীয়ার্ধ ছুটি নিয়ে যখন বেরোলাম রোদে ফাটছে তাম্রলিপ্ত নগরী। রাস্তার ধারের টলটলে নয়ানজুলি ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে গতকালও মেঘের বালাপোশ মুড়ি দিয়ে ছিল শহরটা। পথে মেছেদায় থামলাম টাকা তুলব বলে। মায়ের নতুন পেনশনের এটিএম কার্ড এক্টিভেট করলাম। পেনশন তুললাম। এবার আমার টাকা তোলার পালা। বেশ কিছু টাকা দেবার আছে বাবাকে। তুলতে গিয়েই হোঁচট খেলাম, বলে কি, "non-operative account।"


বারো মাস এই একাউন্ট থেকেই টাকা তুলি, অনলাইন কেনাকাটা করি, গত কাল রাতেই তো টাকা ট্রান্সফার করেছি,কি যেন কিনেওছি, তাহলে non-operative হয় কি করে। এই সংক্রান্ত কোন মেল/ মেসেজও তো পাঠায়নি। বার তিনেক চেষ্টা করলাম, টাকার পরিমাণ কমিয়ে বাড়িয়ে। OTP ও এল, দিলাম ও,ফলাফল সেই এক। কেবল বলে হোম ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। হোম ব্রাঞ্চ তো সেই মহানগরে, মহাকরণের পিছনে। অবর বর্গীয় সহায়ক (এলডিসি) ছিলাম যখন, তখনই খোলা। সেখানে যাওয়া কি মুখের কথা। ছুটি নিয়ে যেতে হবে। ততোদিন আমার চলবে কি করে?


ওখানে দাঁড়িয়ে চুল ছিঁড়ে লাভ নেই, হাওড়া তো যেতেই হবে। হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সবার আগে অনলাইন ব্যাঙ্কিং একাউন্টটা খুলে দেখলাম, টাকাপয়সা গুলো আছে, নাকি -। হিসেব মিলে যেতে সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শান্তনুকে ফোন করলাম, আমাদের অফিসের যাবতীয় লেনদেন হয় যে ব্রাঞ্চ থেকে,তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখুক,যদি ওরা কোন হেল্প করতে পারে। তিন মিনিট বাদে শান্তনু ফোন করে বলল, "ম্যাডাম ওরা কেউ নেই। সবার ইলেকশন ডিউটি পড়েছে। সবাই ট্রেনিং নিতে গেছে। ব্রাঞ্চে তালা।" কি সর্বনাশ। 

গুগল দেখে হোম ব্রাঞ্চে ফোন করলাম, ল্যান্ড ফোন বেজেই গেল। অগুনতি বার ফোন করে করে ক্লান্ত হয়ে শেষে হেল্পলাইনে ফোন করলাম। অল্পবয়সী একটি ছেলে বলল, " বলুন ম্যাডাম আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি," সব জানিয়ে বললাম, একটু ঠিক করে দে বাবা। স্যালারি একাউন্ট নন অপারেটিভ হলে খেয়ে পড়ে বাঁচব কি করে। ছেলেটা কি সব খুটখাট করে বলল, " ম্যাডাম আমার লগ ইনে দেখাচ্ছে আপনার KYC পেন্ডিং।" কি মস্করা হচ্ছে, পদবী বদল, ঠিকানা বদল, আধার,প্যান লিঙ্ক হাবিজাবি কারণে কতবার তো করা হয়েছে KYC। ছেলেটি প্রশিক্ষিত দায়সারা  উত্তর দিয়ে ছেড়ে দিল, মোদ্দা কথা ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। 


চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কাঁদ কাঁদ সুরে যখন শৌভিক কে ফোন করলাম, ও তখন ট্রেনিং ভেনু ঘুরে দেখছে। ওই ব্যস্ততার মধ্যেই সব শুনল,বলল, "হাওড়া তো যাচ্ছিসই, একবার ব্যাংক ঘুরে আয়। দেখ কি সমস্যা।" ব্যাংকে গেলেই বা কি, আধার/ভোটার কার্ড, পাশ/চেক বই কিছুই  তো নেই। মোবাইলে আধার স্ক্যান করানো আছে কেবল কাকে যেন পাঠিয়ে ছিলাম। শৌভিক বলল, "ওটাই দেখিয়ে দিবি। গিয়েই দেখ না।" 


ভাবলাম গিয়েই দেখি, গুগল ম্যাপ বলল, ব্যাংক বন্ধ হয় বেলা তিনটায় আর তুমি যত জলদিই ছোট, সাড়ে তিনটার আগে পৌঁছাবে না। কি করি, ধরিত্রী কেন যে এই সব মুহূর্তে দ্বিধা হয় না। তখনই এক খুড়তুতো ননদের কথা মনে পড়ল, আমার পরিচিত এই একজনই আছে যে এখনো ব্যাংকে আছে। ভট্টাচার্য বাড়ির বিদুষী নক্ষত্র,শৌভিক গর্ব করে বলে ওর এই বোন একটা দিনের জন্য বেকার থাকেনি। মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোনোর সাথে সাথেই ব্যাংকের চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। একাধিক বড় ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের পদ সামলেছে দায়িত্ব নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, একটু ভয়ই পাই এই ননদিনীকে। আমার বিয়ে/ বৌভাতের দিন যে পুঁচকে মেয়েটা আমার পিছন পিছন ঘুরত সে এখন মস্ত অফিসার। তাও ভয়ে ভয়ে ফোনটা করেই ফেললাম, ভেবেছিলাম তুমি বলে সম্বোধন করব, ওর গলার উষ্ণতায় গলে গেল সঙ্কোচের বরফ। খুলে বললাম সমস্যার কথা। শ্রীমতী অসীমা ভট্টাচার্য সব শুনে বললেন, " অব্যশই যাও ব্যাংকে। চারটে অবধি তোমাকে ঢুকতেই দেবে। একটু এদিক ওদিক হলেও চিন্তা নেই,বললে ওরা হেল্প করে দেবে। বললে প্রিন্ট ও করে দেবে। বলেই দেখো না। " 


কি করে জানব আজই অফিস পাড়ার সবথেকে ধনী ব্রাঞ্চে যেতে হবে, গয়ংগচ্ছ ভাবে বেরিয়েছি, পরেছি একটা সস্তা সুতির সালোয়ার কামিজ। তেলে ভাজা পাঁপড়ের মত মুখ, ব্যাগ হাঁটকে একটা লিপস্টিক ও খুঁজে পেলাম না আজ। ঢুকতে দিলে হয়।ব্যাংকে যখন পৌঁছলাম, আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। ব্যাংকের মধ্যে ছোটখাট জনজোয়ার। আজ মাস কাবার কিনা। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। অনুসন্ধান লেখা কাউন্টারে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,সমস্যার কথা। টেবিলের উল্টো দিকে বসা রূপসী মেয়েটি, কি সব খুটখাট করে বলল, " আপনার একাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।শুধু টাকা ঢুকতে পারে,বেরোবে না।" মানে? সেই একই কথা KYC নেই। এর বেশি কথা উনি বলতে না শুনতে অক্ষম। বললেন সার্ভিস ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে। 


তাঁর কিউবিকলের সামনে বিরাট লাইন। লাইন দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। উনি কম্পিউটার ঘেঁটে বললেন, "২০১৪ য় করেছিলেন। আপনি বেঁচে আছেন কি না ব্যাংক বুঝবে কি করে? আবার করুন। যান ফর্ম তুলে আনুন।" বললাম আমার কাছে কোন ডকুমেন্ট হার্ড কপি নেই। শোনার সময় নেই বুঝতে পারলাম।


ফর্ম তুলে আবার গেলাম, ভদ্রলোক হাত থেকে ফর্ম কেড়ে নিয়ে চার জায়গায় টিক মেরে বললেন, "ভরে আনুন।" ভরে আবার লাইন দিলাম। উনি হাত নেড়ে ডেকে নিলেন আগে, বললেন," আধার দেখান।" মোবাইল খুলে স্ক্যান করা ছবিটা দেখলাম, একটা যন্ত্র এগিয়ে বললেন," আঙ্গুল ঠেকান"। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ঠেকালাম, কিছুই হল না। বুঝতে পেরে,ভালো করে গায়ে মুছে চাপ দিলাম। কিছুই এলো না। কি সর্বনাশ। ক্রিম মেখে মেখে ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে গেল নাকি?  তুত্তুরীর ছোটবেলায় বানানো আধারে যেমন নটা আঙ্গুলের ছাপ ছিল।দশমটা জাস্ট ওঠেনি,হাজার চেষ্টা করেও। আমার কি এই ধেড়ে বয়সে তাই হল?  লোকটা খানিক ক্ষণ তাকিয়ে দাড়ি চুলকে বলল, "অন্য আঙ্গুল দিন তো দেখি।" তর্জনী অবশ্য আমায় ব্যর্থ করল না। 


ফর্ম নিয়ে এই ওই সেই কাউন্টার ঘুরে, অনেক দফা অনুমোদন নিয়ে যখন লক খুলল তখন বৃষ্টি ভেজা মহানগরে নামছে বিকেল। ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকের দরজা। বলা হল,আরো একদফা কি যেন অনুমোদন লাগবে, ফলে এখুনি না পারলেও, কাল টাকা তুলতে পারব। এত দেরি হবে ভাবিনি। আপিস টাইমের ভাত ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি, এতটা পথ যাতায়াত করব বলে জল ও খাইনি তেমন। কে জানত দিনটা এমন গোবর মার্কা হতে চলেছে।


 হাওড়ায় আর বসার সময় নেই। আজই ফিরব কাঁথি। মায়ের পেনশন মায়ের হাতে দিয়ে, মায়ের হাতের পুঁই শাকের চচ্চড়ি আর ডবল ডিমের ঝাল দিয়ে কয়েক চামচ ভাত গিলতে গিলতে আবার মনে হল, জাবর কাটা ব্যাপারটা মন্দ নয়। কেমন সুন্দর এখন গিলে নিতাম আর কাঁথি যেতে যেতে চিবাতাম। দুটো কথা তো বলতে পারতাম আমার বুড়োবুড়ির সাথে।

No comments:

Post a Comment