Saturday 1 July 2023

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

ভোর বেলা বুঝতেই পারিনি যে দিনটা এমন তুফান আনতে চলেছে। আর পাঁচটা দিনের মতই ভোর থেকে বাজা অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠা। "একটু জলদি নড় বাবা" বলে তুত্তুরীকে তাড়া দেওয়া। গোছানো স্কুলের ব্যাগ হাঁটকে বই খাতা  বার করে বিশেষ বিশেষ চ্যাপ্টার গুলোর ছবি তুলে রাখা। মেয়েকে স্কুলের দরজার সামনে ছেড়ে বাড়ি ফিরেই সারাদিনের পড়াশোনার হিসেব করা। তমলুকে একজন দিদিমণি ছিলেন,এখানে আর কাউকে রাখার ভরসা পাইনি আমরা। কে জানে, ক ঘন্টা আছি মোরা এথায়। ফলে মেয়ের পড়াশোনার পুরো দায়িত্বটাই ভাগ করে পালন করি আমরা। সব বিষয় পড়ানো, বোঝানো, রিভিশন করানোর দায়িত্ব আমার। ইংরেজি আর ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর গুলো লিখে এবং দেখে দেয় শোভিক। দু একটা বাদে প্রায় সব বিষয়েরই সিলেবাস শেষ করে ফেলেছি আমি আর তুত্তুরী। এবার রিভিশন দেবার পালা। তাই জন্যই ছবি তুলে নিই, ওকে স্কুলে ছেড়ে এসে ওই ছবি দেখে দেখে হোম ওয়ার্ক দিই আমি। 


গুচ্ছের হোম ওয়ার্ক দিয়ে,বরের সাথে খানিক ভিজে বাগানে হেঁটে, বাড়িতে ফোন করে বাবার প্রভাতী নিঃসঙ্গতা খানিক কাটিয়ে,স্নান, পুজো সেরে, ধড়াচূড়া পরে যখন খেতে বসি, আক্ষরিক অর্থেই গাইতে ইচ্ছে করে, " আমি সকল কাজের পাই যে সময়" ভালো করে খেতে পাইনে। রোজই মনে হয়, ইশ আমরাও যদি জাবর কাটতে পারতাম,তাহলে কি ভালোই না হত। তাড়াহুড়ো করে খাবার গুলো গলায় ঢেলে বেরিয়ে পড়তাম, বাসে বসে বসে আয়েস করে চিবিয়ে খেতাম। এমনিতেও তো গিলতেই হয়, চিবানোর অবকাশ পাই কোথায়। টাইম ম্যানেজমেন্ট ব্যাপারটা মোটেই আমার জন্য নয়। 


চিরুনি, ফেস পাউডার আর লিপস্টিক ব্যাগেই থাকে, মহকুমা শাসকের নিবাস থেকে রূপশ্রী বাইপাস যাবার পথে ঝটপট করে চুল আঁচড়ে, লিপস্টিক লাগিয়ে নিই। ফেস পাউডার অধিকাংশ দিনই আর লাগানো হয় না। দূর কে দেখবে।


আজ মাসের শেষ দিন, মায়ের পেনশনটা তুলে দিয়ে আসতে হবে। যদিও বাবা বলেই যাচ্ছে, তাড়া নেই। আমি জানি, মাসের শেষ দিন, খুব জোর হলে পয়লাতেই সবার বেতন দিয়ে দেয় বাবা। টাকাটা না  তুলে দিয়ে এলে চলবে কেমনে। বড় সাহেবকে বলে দ্বিতীয়ার্ধ ছুটি নিয়ে যখন বেরোলাম রোদে ফাটছে তাম্রলিপ্ত নগরী। রাস্তার ধারের টলটলে নয়ানজুলি ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে গতকালও মেঘের বালাপোশ মুড়ি দিয়ে ছিল শহরটা। পথে মেছেদায় থামলাম টাকা তুলব বলে। মায়ের নতুন পেনশনের এটিএম কার্ড এক্টিভেট করলাম। পেনশন তুললাম। এবার আমার টাকা তোলার পালা। বেশ কিছু টাকা দেবার আছে বাবাকে। তুলতে গিয়েই হোঁচট খেলাম, বলে কি, "non-operative account।"


বারো মাস এই একাউন্ট থেকেই টাকা তুলি, অনলাইন কেনাকাটা করি, গত কাল রাতেই তো টাকা ট্রান্সফার করেছি,কি যেন কিনেওছি, তাহলে non-operative হয় কি করে। এই সংক্রান্ত কোন মেল/ মেসেজও তো পাঠায়নি। বার তিনেক চেষ্টা করলাম, টাকার পরিমাণ কমিয়ে বাড়িয়ে। OTP ও এল, দিলাম ও,ফলাফল সেই এক। কেবল বলে হোম ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। হোম ব্রাঞ্চ তো সেই মহানগরে, মহাকরণের পিছনে। অবর বর্গীয় সহায়ক (এলডিসি) ছিলাম যখন, তখনই খোলা। সেখানে যাওয়া কি মুখের কথা। ছুটি নিয়ে যেতে হবে। ততোদিন আমার চলবে কি করে?


ওখানে দাঁড়িয়ে চুল ছিঁড়ে লাভ নেই, হাওড়া তো যেতেই হবে। হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সবার আগে অনলাইন ব্যাঙ্কিং একাউন্টটা খুলে দেখলাম, টাকাপয়সা গুলো আছে, নাকি -। হিসেব মিলে যেতে সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শান্তনুকে ফোন করলাম, আমাদের অফিসের যাবতীয় লেনদেন হয় যে ব্রাঞ্চ থেকে,তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখুক,যদি ওরা কোন হেল্প করতে পারে। তিন মিনিট বাদে শান্তনু ফোন করে বলল, "ম্যাডাম ওরা কেউ নেই। সবার ইলেকশন ডিউটি পড়েছে। সবাই ট্রেনিং নিতে গেছে। ব্রাঞ্চে তালা।" কি সর্বনাশ। 

গুগল দেখে হোম ব্রাঞ্চে ফোন করলাম, ল্যান্ড ফোন বেজেই গেল। অগুনতি বার ফোন করে করে ক্লান্ত হয়ে শেষে হেল্পলাইনে ফোন করলাম। অল্পবয়সী একটি ছেলে বলল, " বলুন ম্যাডাম আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি," সব জানিয়ে বললাম, একটু ঠিক করে দে বাবা। স্যালারি একাউন্ট নন অপারেটিভ হলে খেয়ে পড়ে বাঁচব কি করে। ছেলেটা কি সব খুটখাট করে বলল, " ম্যাডাম আমার লগ ইনে দেখাচ্ছে আপনার KYC পেন্ডিং।" কি মস্করা হচ্ছে, পদবী বদল, ঠিকানা বদল, আধার,প্যান লিঙ্ক হাবিজাবি কারণে কতবার তো করা হয়েছে KYC। ছেলেটি প্রশিক্ষিত দায়সারা  উত্তর দিয়ে ছেড়ে দিল, মোদ্দা কথা ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। 


চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কাঁদ কাঁদ সুরে যখন শৌভিক কে ফোন করলাম, ও তখন ট্রেনিং ভেনু ঘুরে দেখছে। ওই ব্যস্ততার মধ্যেই সব শুনল,বলল, "হাওড়া তো যাচ্ছিসই, একবার ব্যাংক ঘুরে আয়। দেখ কি সমস্যা।" ব্যাংকে গেলেই বা কি, আধার/ভোটার কার্ড, পাশ/চেক বই কিছুই  তো নেই। মোবাইলে আধার স্ক্যান করানো আছে কেবল কাকে যেন পাঠিয়ে ছিলাম। শৌভিক বলল, "ওটাই দেখিয়ে দিবি। গিয়েই দেখ না।" 


ভাবলাম গিয়েই দেখি, গুগল ম্যাপ বলল, ব্যাংক বন্ধ হয় বেলা তিনটায় আর তুমি যত জলদিই ছোট, সাড়ে তিনটার আগে পৌঁছাবে না। কি করি, ধরিত্রী কেন যে এই সব মুহূর্তে দ্বিধা হয় না। তখনই এক খুড়তুতো ননদের কথা মনে পড়ল, আমার পরিচিত এই একজনই আছে যে এখনো ব্যাংকে আছে। ভট্টাচার্য বাড়ির বিদুষী নক্ষত্র,শৌভিক গর্ব করে বলে ওর এই বোন একটা দিনের জন্য বেকার থাকেনি। মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোনোর সাথে সাথেই ব্যাংকের চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। একাধিক বড় ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের পদ সামলেছে দায়িত্ব নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, একটু ভয়ই পাই এই ননদিনীকে। আমার বিয়ে/ বৌভাতের দিন যে পুঁচকে মেয়েটা আমার পিছন পিছন ঘুরত সে এখন মস্ত অফিসার। তাও ভয়ে ভয়ে ফোনটা করেই ফেললাম, ভেবেছিলাম তুমি বলে সম্বোধন করব, ওর গলার উষ্ণতায় গলে গেল সঙ্কোচের বরফ। খুলে বললাম সমস্যার কথা। শ্রীমতী অসীমা ভট্টাচার্য সব শুনে বললেন, " অব্যশই যাও ব্যাংকে। চারটে অবধি তোমাকে ঢুকতেই দেবে। একটু এদিক ওদিক হলেও চিন্তা নেই,বললে ওরা হেল্প করে দেবে। বললে প্রিন্ট ও করে দেবে। বলেই দেখো না। " 


কি করে জানব আজই অফিস পাড়ার সবথেকে ধনী ব্রাঞ্চে যেতে হবে, গয়ংগচ্ছ ভাবে বেরিয়েছি, পরেছি একটা সস্তা সুতির সালোয়ার কামিজ। তেলে ভাজা পাঁপড়ের মত মুখ, ব্যাগ হাঁটকে একটা লিপস্টিক ও খুঁজে পেলাম না আজ। ঢুকতে দিলে হয়।ব্যাংকে যখন পৌঁছলাম, আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। ব্যাংকের মধ্যে ছোটখাট জনজোয়ার। আজ মাস কাবার কিনা। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। অনুসন্ধান লেখা কাউন্টারে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,সমস্যার কথা। টেবিলের উল্টো দিকে বসা রূপসী মেয়েটি, কি সব খুটখাট করে বলল, " আপনার একাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।শুধু টাকা ঢুকতে পারে,বেরোবে না।" মানে? সেই একই কথা KYC নেই। এর বেশি কথা উনি বলতে না শুনতে অক্ষম। বললেন সার্ভিস ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে। 


তাঁর কিউবিকলের সামনে বিরাট লাইন। লাইন দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। উনি কম্পিউটার ঘেঁটে বললেন, "২০১৪ য় করেছিলেন। আপনি বেঁচে আছেন কি না ব্যাংক বুঝবে কি করে? আবার করুন। যান ফর্ম তুলে আনুন।" বললাম আমার কাছে কোন ডকুমেন্ট হার্ড কপি নেই। শোনার সময় নেই বুঝতে পারলাম।


ফর্ম তুলে আবার গেলাম, ভদ্রলোক হাত থেকে ফর্ম কেড়ে নিয়ে চার জায়গায় টিক মেরে বললেন, "ভরে আনুন।" ভরে আবার লাইন দিলাম। উনি হাত নেড়ে ডেকে নিলেন আগে, বললেন," আধার দেখান।" মোবাইল খুলে স্ক্যান করা ছবিটা দেখলাম, একটা যন্ত্র এগিয়ে বললেন," আঙ্গুল ঠেকান"। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ঠেকালাম, কিছুই হল না। বুঝতে পেরে,ভালো করে গায়ে মুছে চাপ দিলাম। কিছুই এলো না। কি সর্বনাশ। ক্রিম মেখে মেখে ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে গেল নাকি?  তুত্তুরীর ছোটবেলায় বানানো আধারে যেমন নটা আঙ্গুলের ছাপ ছিল।দশমটা জাস্ট ওঠেনি,হাজার চেষ্টা করেও। আমার কি এই ধেড়ে বয়সে তাই হল?  লোকটা খানিক ক্ষণ তাকিয়ে দাড়ি চুলকে বলল, "অন্য আঙ্গুল দিন তো দেখি।" তর্জনী অবশ্য আমায় ব্যর্থ করল না। 


ফর্ম নিয়ে এই ওই সেই কাউন্টার ঘুরে, অনেক দফা অনুমোদন নিয়ে যখন লক খুলল তখন বৃষ্টি ভেজা মহানগরে নামছে বিকেল। ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকের দরজা। বলা হল,আরো একদফা কি যেন অনুমোদন লাগবে, ফলে এখুনি না পারলেও, কাল টাকা তুলতে পারব। এত দেরি হবে ভাবিনি। আপিস টাইমের ভাত ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি, এতটা পথ যাতায়াত করব বলে জল ও খাইনি তেমন। কে জানত দিনটা এমন গোবর মার্কা হতে চলেছে।


 হাওড়ায় আর বসার সময় নেই। আজই ফিরব কাঁথি। মায়ের পেনশন মায়ের হাতে দিয়ে, মায়ের হাতের পুঁই শাকের চচ্চড়ি আর ডবল ডিমের ঝাল দিয়ে কয়েক চামচ ভাত গিলতে গিলতে আবার মনে হল, জাবর কাটা ব্যাপারটা মন্দ নয়। কেমন সুন্দর এখন গিলে নিতাম আর কাঁথি যেতে যেতে চিবাতাম। দুটো কথা তো বলতে পারতাম আমার বুড়োবুড়ির সাথে।

অনির ডাইরি ২৯ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি


ব্যাগ গোছাচ্ছি, জহর বাবু দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম চলি যাচ্ছেন?" ঘাড় নেড়ে জানালাম হ্যাঁ। আজ উল্টোরথ, 'জগু এন্ড কোং'কে ফেরত আনতে হবে মাসির বাড়ি থেকে। নাহলে আমার যা গুণধরী মেয়ে, এই বৃষ্টিতে আজ আর আনতে যাব না, বলে বসে থাকবে। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছি। জহর বাবু আবার প্রশ্ন করলেন, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো?" হেসে বললাম, "হ্যাঁ, কাল ঈদুজ্জোহা তো। আপনি আবার ভুলে গিয়ে, অফিস খুলে বসে থাকবেননি যেন।" একাধিক বার ওমন করার রেকর্ড আছে ভদ্রলোকের। শুনে একগাল হাসলেন জহর বাবু, তারপর  জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম, তাহলে হক বাবু খাওয়াবেন তো?" প্রশ্নের গুঁতোয় হাসি চাপা দায়। জহর বাবু একটু খেতে ভালোবাসেন, একদম আমারই মতো।  হক বাবু এই কিছুদিন আগের ঈদেই সবাইকে পেট পুরে খাইয়েছেন। আবার খাওয়াতে বললে নির্ঘাত মারবেন।সেটাই জানালাম বৃদ্ধকে।


ঘন মেঘে ঢাকা হাই রোড ধরে বাড়ি ফিরছি, উপর্যুপরি বৃষ্টিতে ঝাপসা জানলার কাঁচ। একই প্রশ্ন করল উত্তমকুমার, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো? নাকি কোথাও বেরোবেন?" ঈদের দিন আবার কোথায় বেরোবো রে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না জেনে রাখতেছি। আসলে কালকের দিনটা একটা ছুটি নিব আর কি, কুরবানি করব তো।"

বিষম খেয়ে বললাম, তুমি কুরবানী করবে? মানে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না না আমি না। আমার এক বন্ধু করবে।ওদের কি নিয়ম আছে, কুরবানীর পর মাংস বিলি করে গরীব-দুঃখীকে, পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়, কিছুটা ফ্রিজে রেখেও ৩-৪ কিলো মতো থেকে যায়। ওটাই বন্ধুরা সবাই মিলে রেঁধে খাই। ওদের ভাড়া বাড়ির ছাদে প্লাস্টিক টাঙানো হয়ে গেছে। কড়া-খুন্তি-হাতা ভাড়া করে নিই আমরা, বাজারে বলাও হয়ে গেছে। ও কুরবানী করে মাংস বিলি করতে যায়, আমরা বাকি বন্ধুরা মিলে রান্না করি।  শুধু মাংস আর ভাত, আর কিচ্ছু নয়। মাথা পিছু সাত আট পিস করে হয়, দুপুর বেলা সবাই মিলে ওদের ছাদে বসে একসাথে খাই।"


মাংস বিলি করার ব্যাপারটা আগের দিনই হক বাবু বোঝাচ্ছিলেন বিশদে। দুদিন ছুটি চাইতে এসেছিলেন ঈদ উপলক্ষে, আমিই প্রশ্ন করেছিলাম কি কুরবানী দেন আপনারা? চার্চ লেনের বুড়ো হুসেন মিঞা বলত, সবাই গরু দেয় না। যার যেমন সামর্থ্য তেমনি দেয়। ধনীরা উট বা দুম্বা দেয়, ভেড়াও দেয় বোধ হয়। ছাগল দেয়। গরু ও দেয়। হুসেন মিঞার বক্তব্য অনুসারে, গাঁয়ের গরিবগুর্বো মানুষজন বেশ কয়েকজন মিলে একটা গরু দেয়। একে তো সস্তা হয়,তারওপর মাংসটাও একটু বেশি পাওয়া যায়। এই আর কি-। 


সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হক বাবুকে জিজ্ঞাসা করছিলাম। হক বাবু বললেন,' আমি দিই না ম্যাডাম। আমার দাদার ঘরে দেওয়া হয়।ওখানেই যাব। ছাগলই দেওয়া হয়।" জিজ্ঞাসা করলাম, ছাগল ছাড়া এখানে আর কি কুরবানি দেয় লোকজন। উট দেয় কি? হক বাবু বললেন," উট তেমন প্রচলিত নয় এদিকে। কেন বলুন তো, এখানে যে উটগুলো বেচতে আসে সেগুলো এমনিতেই বাতিল। অকর্মণ্য। বুড়ো উট। কেবল লোক দেখাতেই কেনা আর বেচা। আমি একবারই খেয়েছিলাম, ভালো লাগেনি। আমার দুম্বাও এমন আহামরি লাগে না। দিশি ছাগল দেয়, আর বড় বড় ছাগল যেগুলোকে রামছাগল বলে ওগুলো দেওয়া হয়।"


একটু থেমে বললেন, " ম্যাডাম, আমাদের নিয়ম কি জানেন! কুরবানী হয়ে গেলে মাংসটা তিনভাগ করা হয়। একভাগ বিলি করা হয় গরিব-দুঃখীদের, একভাগ যায় পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজনদের,  বাকিটা আমরা খাই। সেই জন্যেই ম্যাডাম, এই ঈদে আমি কাউকে বাড়িতে ডাকি না। এত মাংস আসে, গরুও আসে, যদি মিলেমিশে যায়।"


শুনতে শুনতে চার্চ লেনের নাজিম সাহেবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঈদ এলেই খাওয়াতেন নাজিম সাহেব, কিন্তু মুর্গি। আর প্রতিবারই জনৈক বৃদ্ধবড়দা, "বড়খাসি" খাওয়ানোর জন্য ঝোলাঝুলি করতেন। প্রতিবারই এক কথা বলতেন নাজিম সাহেব, "কেন গো, আপনাদের ধর্মে এই একটা জিনিসই তো খেতে নিষেধ আছে, সেটাই মানুন না। তাছাড়া আমার ধর্মেও নিষেধ আছে। কাউকে জোর করে বা না জানিয়ে খাওয়াতে নেই।" 


তাই জন্যই বোধহয় মইনুদ্দিন মামা মাংসের ঝোলাটা মায়ের হাতে ধরিয়েই বলতেন, " এটা কিন্তু খাসির মাংস।" মায়ের সহকর্মী ছিলেন ভদ্রলোক,  গোঁড়া বিহারী মুসলমান। পূর্বপুরুষ খাস সৌদি আরব থেকে এসেছিলেন বলে দাবি করতেন। নিয়মিত ইসলামী তত্ত্ব আর ইসলামী শাস্ত্র চর্চা করতেন আমার মায়ের সাথে। সুদূর মুর্শিদাবাদের রামনগর হাই স্কুলের ছাত্রী আমার মায়ের মাথার উপর দিয়ে যেত সেই সব জটিল তত্ত্ব। আকারে, ইঙ্গিতে, চিল্লিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে, চেয়ার নিয়ে সটান ঘুরে বসে, এমনকি ওনার স্ত্রীর কাছে নালিশ করে তা প্রকাশও করত মা। তাও দমানো যেত না বুড়োকে। ধর্মচর্চা না করলেই অংক করাতেন,  রীতিমতো বেত্রাঘাত করে। ওনার অংকের গুঁতোয় কি যেন একটা ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা এক লপ্তেই পাশ করে গিয়েছিল মা। 


এহেন মইনুদ্দিন মামা প্রতি ঈদে, চার পাঁচ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে আসতেন, তার পাতানো বোনকে মাংস দিতে। স্টিলের ঝোলায় ঝরঝরে কাঁচা মাংস, দুপুরবেলায় মায়ের হাতের গুণে কি যে খুশবু ছড়াতো বাড়ি ময়। সেই দশক গুলোই বোধহয় ছিল অন্যরকম। যুগটাও ছিল আলাদা। উনি গোঁড়া মুসলমান আমরা বর্ণ হিন্দু। যে যার, সে তার ধর্ম নিয়ে নিষ্ঠাবান এবং সোচ্চার। উভয়ের চোখেই তার তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র মধ্যে। মানবিক সম্পর্ক গুলোর  মাঝে কখনো নাক গলাবার সুযোগ পেত না সে। আর আজ কাউকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গেলেও তিনবার ভাবতে হয়। আমাদের বা ওদের কোন ধর্মীয় অনুশাসন ভাঙছি না তো? নেটিজেনরা আবার সেকু/ সেকুলাঙ্গার বলে গাল পাড়বে নাতো। 


ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, উত্তমের গলার আওয়াজে যখন হুঁশ ফিরল, কালিনগরের খাল পেরোচ্ছি। মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ' কি বলছ?' উত্তমকুমার গাড়ি চালাতে চালাতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, " আপনি কখনও কুরবানীর মাংস খেয়েছেন ম্যাডাম?" ব্যাটা বলে কি? গুছিয়ে জবাব দিতে যাব, তার আগেই উত্তম বলল, "এমনি দোকান থেকে ওই নলি কাটা (হালাল) মাংস কিনে খেয়ে দেখবেন,আর কুরবানীর মাংস খেয়ে দেখবেন। একদম আলাদা। কি যে কানে ফিসফিস করে মন্ত্র পড়ে দেয়, স্বাদটাই আলাদা হয়ে যায়। ঠিক যেমন আমাদের বলির মাংসের স্বাদ একদম আলাদা হয়। এমনি ছাগল কাটুন ওই স্বাদই পাবেন না। কি ভাবে যে হয়। সবই বোধহয় ভগবানের মহিমা বুঝলেন তো ম্যাডাম।" 


দূর কি এতক্ষণ উল্টোপাল্টা ভাবছিলাম, কিচ্ছু বদলায়নি আমার দেশ।  গুটি কয়েক নেটিজেনের বাইরে যে বৃহত্তর খেটে খাওয়া ভারতবর্ষ, ছিটে ফোঁটা ও বদল হয়নি তার চরিত্রে। একই আছে আমার দেশ। বড় করে একটা শ্বাস ফেলে আঙ্গুলের ইশারায় বললাম, তুই সামনে ফিরে গাড়ি চালা বাপ, এখনই মরতে চাই না। রথ সমেত তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে বাড়ি আনতে হবে, জিলিপি খেতে হবে, কাল সকাল হলেই জনগণকে ঈদ মুবারক করতে হবে, একটু বেলা হলেই সব গোঁসা করে বসে থাকবেন নয়তো নিজেরাই লাফাতে লাফাতে ফোন করে বসবেন। শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব মিটলে বাসি জিলিপি গুলোও সাবাড় করতে হবে, কাজ কি কম। মরার কি ফুরসৎ আছে বাপু।

Saturday 24 June 2023

অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সেদিন মোদের বড়ই খুশির দিন, আজ আর অফিস ফেরতা একা বাড়ি ফিরব না। বাবা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে ফিরব কাঁথি। কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে নড়তে চায় না বাবা। কোথাও যাবার কথা বললেই, সেন্টু দেয়। বলে, "এটা আমার বার্ধক্যের বারাণসী। আমাকে এখানেই থাকতে দাও।" দুটো পুকুর সহ সাড়ে সাত বিঘে বাস্তুভিটের, আজ কেবল মেরে কেটে সাতকাটাই দৃশ্যমান। যার আধ কাটার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে পাড়ার দোতলা ক্লাব। বাবার ভাগে পড়েছে কাটা দেড়েক। খন্ডিত ভগ্নপ্রায় ভাগের বাস্তুভিটে সহ এই দেড় কাটা জমির উপর বাবার মায়া সাংঘাতিক।


এই ভিটেতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন আমার স্বর্গীয় পিতামহ-পিতামহী। জেঠু মারা যান হাসপাতালে, ছোট কাকু বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাবার পথে। বাবার ইচ্ছে এই ভিটেতেই যেন চোখ বুঝতে পারে বাবা। প্রায়ই বলে," এই বাস্তুটুকু কে বাঁচিয়ে রাখতে কি অসীম লড়াই করতে হয়েছিল বাবা আর আমাদের তিন ভাইকে, তোরা জানিস না।" 

ব্যাপারটা বা কথাগুলো বাবার কাছে যতটা রোমান্টিক আমার কাছে ততোটাই বেদনাদায়ক।  সেকথা বলতে গেলেও হুলো বেড়ালের মত ফাঁসিয়ে ওঠে বৃদ্ধ। "কেউ কি সাধ করে মরতে চায়? তুমি বারবার এই কথাগুলো বলো আর আমার মনে হয় চলে যাবার দিন আগত বুঝি।" ঠিকই তো, আমিই বলি, বাবা তো মাছ ভাজার সোজা-উল্টোই চেনে না। 


এহেন জেদি, একবগ্গা বৃদ্ধকে, কিভাবে যে পটিয়ে হাওড়া থেকে কাঁথি যেতে রাজি করিয়েছি, সে কেবল আমিই জানি। মিথ্যে বলব না, আমার জন্য মোটেও বাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি বাবা। রাজি হয়নি প্রাণাধিকা তুত্তুরীর জন্যও। রাজি হয়েছিল কেবল মায়ের মুখ চেয়ে। কিছু দিন ধরেই বেশ মনমরা হয়ে পড়ছিল মা, ভুগছিল অপরিসীম নিঃসঙ্গতায়। তুত্তুরীর পড়াশোনা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যস্ততার জন্য আজকাল আর অত ঘনঘন হাওড়া যেতে বা গিয়ে থাকতে পারি না আমরা। একলা নিঃসঙ্গ জীবনে হাঁপিয়ে উঠছিল মা। মনের প্রভাব পড়ছিল শরীরে। এমতবস্থায় হাওয়া বদল আর অষ্টপ্রহর তুত্তুরীকে আলিঙ্গন_আঘ্রাণ করলেই যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে মা, এই বলেই পটিয়েছিলাম বৃদ্ধকে।


তাও নোটিশ দিতে হয়েছিল এক মাস আগে,  ঈশ্বরকে হাজির নাজির জেনে কথা দিতে হয়েছিল ঠিক কোন তারিখে কোন ঘটিকায় বাড়ি থেকে বের করব এবং কোন তারিখে কোন মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে আসব। তুত্তুরীর গরমের ছুটি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে, তখন ছুটি নিইনি। এখন চাইল্ড কেয়ার লিভ নিলাম শুধুমাত্র ওদের জন্যই। আহাঃ ওরা যে আমার তুত্তুরী থেকেও পুঁচকে ছানা। আর তেমনি অবাধ্য ছানা। 


কোন এক দুর্বল মুহূর্তে, আমার সুড়সুড়িতে রাজি হয়ে গেলেও আবার পিছু হঠছিল বাবা, দেখাচ্ছিল নানা ওজর আপত্তি। যেমন ধরুন কিভাবে প্যাকিং করবে, কিসে প্যাকিং করবে, কি কি নেবে কিছুই নাকি বাবার মাথায় ঢুকছিল না। ভিডিও কলে বলতে পারেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, কোথায় রাখা আছে চাকা লাগানো ঝকঝকে ট্রলি ব্যাগ। এমন দিনের কথা ভেবেই উপহার দিয়ে ছিলাম প্রায় অর্ধ দশক পূর্বে। এখনও কাটা হয়নি তার ট্যাগ। রীতিমতো লিস্ট বানিয়ে দিলাম এত জোড়া জামাকাপড়, যার মধ্যে এতগুলি বাইরে পরার আর অতগুলি ঘরে পরার। এছাড়া চার্জার ( এবাড়িতে বেশ অনেকগুলি চার্জার আছে,কিন্তু কোনটাই ওদের ফোনে গলবে না), টুথব্রাশ আর ওষুধ। ব্যাস এইটুকুই আর কিছু না আনলেও চলবে। উৎসাহের আতিশয্যে শ্রীমতী তুত্তুরী বললেন, টুথব্রাশও না আনলে চলবে, এ বাড়িতে বিস্তর আছে।


ছুটিতে থাকা সত্ত্বেও কিছু দপ্তরী কাজের ধারবাকি ছিল, তাই নিয়েই গিয়েছিলাম মহানগর। ঠিক ছিল ফেরার পথে তুলে আনব, মিঃ অ্যান্ড মিসেস চ্যাটার্জিকে। সেই মোতাবেক কাঁথি থেকে রওনা হবার শুভ মুহূর্তে যখন ফোন করলাম, বাবা বলল, " কি সর্বনাশ! এখনও তো কিছুই গোছানো হয়নি-"। এত কি যে গোছাচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই কাঁথি থেকে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। কাজকর্ম মিটে ও গেল সব।ভেবে ছিলাম কাজ মিটতে মিটতে বুঝি গড়িয়ে যাবে বেলা, দেড়টার মধ্যেই মিটে গেল সব কাজ। এখান থেকে হাওড়া বড়জোর ঘন্টা আধেক। এতক্ষণে নির্ঘাত মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, একটু জিরিয়ে নিক বরং। অনেকটা রাস্তা। তিনটে নাগাদ যদি বেরোতে পারি, দিনের আলো থাকতে থাকতেই  ঢুকে যেতে পারব কাঁথি। 


এত কিছু ভাবার পর বাড়িতে ফোন করে জানতে পারলাম, এখনও স্নান পর্যন্ত করেনি বাবা। মা ঝেঁঝে বলল," তোর বাবা সকাল থেকে সারা বাড়ি গোল গোল করে ঘুরছে, আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। দশ পনেরো প্যাকেট সিগারেট ছাড়া, আর কিছুই গোছায়নি এখনও পর্যন্ত। আমার গোছানো শেষ। ওকে ফেলে রেখেই চলে যাব আজ।" 

 মায়ের কথার ফাঁকেফোকরে শুনতে পাচ্ছিলাম, ফোনের ওপারে তীব্র চিৎকার জুড়েছে বাবা, মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে বলে। হাওড়া পৌঁছালাম যখন, ঘড়ির কাটা ২ আর আড়াই এর মাঝামাঝি। স্নান সেরে নিয়েছে বটে বাবা, বসেনি মধ্যাহ্নভোজে। জেদ ধরেছে, আমি না এলে খাবে না নাকি। দুপুরে ভাত খাব বলে জানিয়ে রাখিনি, এখন হঠাৎ করে এদের ভাতে ভাগ বসালে হয় নাকি। তাছাড়া ব্যাগে করে টিফিন এনেছি আমি।  

ওসব ওজর আপত্তি টিকলো না, ভাত নাকি অঢেল আছে। ডাল তরকারি বন্যা বয়ে যাচ্ছে নাকি এই বাড়িতে। বাবা বলল তোর টিফিনটা সেরকম হলে আমি খেয়ে নেব। তুই ভাত খা। হাত ধুয়ে খেতে বসে চোখ ফেটে জল এল, ঠিক কয়েক চামচ ভাত নিয়েছে বাবা। মায়ের পাতে তার থেকে গোটা দুই/চার চামচ বেশি ভাত। একটা ছোট্ট মুরগির ডিম,, আধাআধি করে পাতে নিয়েছে দুজনে। আমার পাতে উপচে পড়ছে ভাত, আমার থালায় জ্বলজ্বল করছে, একটা গোটা ডিম।


বেশ বুঝতে পারলাম কদিন থাকবে না বলে ফ্রিজ ফাঁকা করে ফেলেছিল মা। যা ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাই খেতে বসেছিল দোঁহে। রান্না করে যে মেয়েটি সে আমাকে অনুযোগের সুরে বলল," দেখুন না দিদিভাই, বললাম প্রেসারকুকারে দুটো ভাত বসিয়ে দিই, দোকান থেকে একটা ডিম কিনে আনি। তো মেসোমশাই বললেন, এই রোদে আর কত খাটবি? কত ছুটবি?  যা আছে, তাই ভাগ করে খাব সবাই। বলে নিজেদের ভাতগুলো সব আপনাকে তুলে দিল। বললাম আমার থেকেও একটু দিই তো কি চিৎকার। বলল, বেশি পাকামি করিস না।"


জেদি বৃদ্ধের ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা আমার সাধ্যাতীত। মোটামুটি চোখের আন্দাজে সমান ভাগ করার চেষ্টা করলাম ভাতের। পুরোপুরি সফল হলাম না যদিও। ঘড়িতে তিনটে বাজে। তাড়া লাগালাম। আর এক ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই বেরোতে হবে।

বাবা বেজার মুখে এক গ্লাস জল আর ওষুধের বাক্স নিয়ে বসল। মা তৈরি হতে গেল, আর আমি হাঁক পাড়লাম পিসিকে। যারা আমার পিসিকে চেনেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি পিসি হল বাবার দিদি। যদিও আমরা সব খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও ওনাকে দিদি বলে সম্বোধন করে।


এ হেন দিদির বয়স অষ্টাশি। কিন্তু আপাততঃ, তিনিই এ বাড়িতে সব থেকে সুস্থ। আমার ঠাকুমার আত্মজা কি না, জরা, ব্যধিকে তিলমাত্রও পাত্তা দেয় না আমার পিসি। হ্যাঁ উপর্যুপরি কয়েকবার পড়ে যাওয়ার জন্য হাঁটু গুলো ইদানিং কিঞ্চিৎ মচমচ করে,কানেও সামান্য কম শোনে পিসি। ব্যাস ওইটুকুই। তেমনি মানসিক জোর। বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি কেউ আসে নি তমলুকে, শুধু পিসি এসেছিল। এক ডাকে বেরিয়ে পড়েছিল আমার সাথে।  


 দুই খুড়তুতো ভাই প্রায়ই খোঁচা দেয়, আমি নাকি পিসির নয়ন মনি। যদিও তা সর্বৈব মিথ্যা। পিসির কাছে তার চার ভাইপো ভাইঝিই সমান আদরের।  আজও যেই দিদি বলে চিৎকার জুড়েছি, অয়ন লাফিয়ে এসে বলল, " ওরে খেতে বসেছে। খাওয়া হোক বলছি। না হলে তুই এসেছিস শুনে, খাওয়া ফেলে এঁটো হাতেই ছুটবে।" তা অবশ্য পিসি করে।


অয়ন কখন খবর দিয়েছিল জানিনা, পাঁচ মিনিট বাদেই দেখি টলমল করতে করতে পিসি এসে হাজির। টেনে আমার পাশে বসালাম। সাদাসিধে করে পড়া বিবর্ণ সুতির শাড়ি, হাত কাটা রঙ চটা ব্লাউজ, দুহাতে দুটো সরু সোনার চুড়ি, এক পিঠ কাঁচা পাকা খোলা চুল, এক মুখ হাসি এই আমার পিসি।

অয়ন অনিন্দ্য মাঝেমধ্যে চিৎকার করে, " ও দিদি,  ওই শাড়িগুলো এবার ফেলে দাও।" পিসির শাড়ির অভাব নেই তা সত্ত্বেও কিছু ফেলে না। দেরাজ খুললে থরে থরে সাজানো না জানি কবেকার সব শাড়ি। ছোটবেলায় বাবা বলত," এটা লর্ড ক্লাইভ দিয়েছিল দিদিকে, ওটা বাদশা আকবরের দেওয়া। শুধু সম্রাট অশোক যে জামাটা দিয়েছিলেন ওইটা ছিড়ে গেছে।" মনে করে অজান্তেই হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওষ্ঠাধরে। এককালে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই চূড়ান্ত অভাবে দিন কেটেছে পিসিরও। সেই সব দিনের কথা ভেবেই হয়তো কিছু ফেলে না পিসি। কিছু অপচয় করে না। 


টুকটাক কুশল বিনিময়ের ফাঁকফোকরে পিসি বলে, " খুব ভালো করেছিস তোর বাবা-মাকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমাকেও আরেকবার নিয়ে যাস তো। কি ভালোই না লেগেছিল সেবার তোর ওখানে গিয়ে। তবে আমি গেলে কিন্তু সাত দিন থাকব  -।" বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় পিসি। বাবার দিকে ঘুরে বলে," হিটলার ওটা দে?" বাবাকে নাম ধরে ডাকার মত মানুষ আর খুব কেউ নেই। তখনও জামাকাপড় পরেনি বাবা। তখনও বেজার মুখে জলের গ্লাস  আর ওষুধের বাক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল বাবা, যেন কতই না ওষুধ খাচ্ছে। পিসির ধমক খেয়ে আচমকা ধড়মড় করে উঠে, একটা খাম এনে পিসির হাতে দিল। খামটা মুড়ে আমার হাতে দিয়ে পিসি বলল, " এটা শৌভিককে দিস। জামাইষষ্ঠীতে তো আসতে পারেনি।"


বাড়ি ফিরে শৌভিকের হাতে খামটা দিয়ে বললাম, এর মধ্যে যা আছে, সেটাকে টাকার অঙ্কে যদি ফেলিস তবে খুবই নগন্য কিছু হবে। কিন্তু এক সম্বলহীন বৃদ্ধার অন্ধ ভালোবাসা আর আশিস মিশিয়ে যদি দেখিস তবে এত মূল্যবান কিছু আদানি- আম্বানিদের ঘরেও পাবি না। যত সামান্যই হোক প্লিজ এটা দিয়ে কিছু কিনিস, বুড়ি খুব খুশি হবে। 

  টাকাটা বার করে নেবার পর খামটাকেও ফেলতে পারিনি আমি, রেখে দিয়েছি শৌভিকের ঝুলন্ত এক কোটের পকেটে। চূড়ান্ত আবেগপ্রবণতা Aquarian দের বৈশিষ্ট্য।  তারপর যা হয় ভুলেই গেছি, আজ অফিস বেরোচ্ছি, একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল শৌভিক, "এই দেখ,তোর পিসির দেওয়া টাকায় এটা কিনেছি। পিসিকে জানাস।" ভিতরে খলখল করছে একটা বডি স্প্রে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের শত ব্যস্ততার মাঝেও ভোলেনি, ঠিক মনে রেখেছে। মুখ ফুটে কোনদিন ভালোবাসি শব্দটা বলে না আমার বর, চেপে ধরলে বলে, "ভালো টাটকা হতে পারে, বাসি কেন হবে।" তবে এই ভাবে আমার প্রতিটা ঘ্যানঘ্যানে কথা কান করে শোনা, আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা সম্মান করা, এগুলো যদি ভালো টাটকা হয়, তো আমার টাটকাই ভালো, বাসি কে চায়।

তুতুরি উবাচ, ২৩ শে জুন ২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻- আজকে মিস্ ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, স্কুলের সাইন্স এক্সিবিশনের জন্য কে কি করছে। 

👩🏻- তুই বললি? 

👧🏻- হুঁ। সবাই বলল।এমনকি ঋতুরাজও(নাম পরিবর্তিত) হাত তুলেছিল। 

👩🏻- সে কে যেন? 

👧🏻- ওই যে আমাদের ক্লাসে একটা দুষ্টু ছেলে আছে না, যে মিসকে খুব জ্বালাতন করে, জোর করে ফার্স্ট বেঞ্চে বসালেও, লাস্ট বেঞ্চে পালিয়ে যায়, টেবিল বাজিয়ে গান গায়, মিসকে ভ্যাঙায় ---

👩🏻- আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। সে হাত তুলেছে তো কি সমস্যা? তুই যদি বানাতে পারিস, (কন্যার কুঞ্চিত ভ্রু যুগলের দিকে তাকিয়ে, হাসি চেপে) তারও নির্ঘাত তোরই মত রঞ্জিত কাকু আর মাসি আছে, যারা আসল কাজটা করে দেবে- 

👧🏻- (কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হয়ে) আমি শুধু ওদের ভিডিওটা দেখিয়েছি, করে দিতে বলিনি😡। (খানিক বিড়বিড় করে মায়ের মুণ্ডপাত করে, একটু দম নিয়ে) মিস তো অবাক, বললেন, " তুমি সত্যি সত্যি সাইন্স প্রজেক্ট করবে তো? মস্করা মারছো না তো?" ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "হেঁঃহেঁঃ"। 

মিস জিজ্ঞাসা করলেন, "মডেল বানাবে, না পাওয়ার পয়েন্ট?" ছেলেটা জবাব দিল," মডেল"। 


 মিস জানতে চাইলেন, " কিসের মডেল বানাবে?" আবার বলল, "হেঁঃহেঁঃ"। মিস খুব ভালো, খুব ঠাণ্ডা মাথা, অন্য স্যার হলে তো, খেত এক থাবড়া। মিস কিন্তু ধৈর্য ধরে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, " বল বাবু কিসের মডেল বানাবি?" তখন বলল, " সাইন্স ফর গ্লোবাল ওয়েলবিইং"।  


👩🏻- বাঃ। খুব ভালো টপিক তো। 

👧🏻-( হেসে উঠে) দূর ওটা থিম হতে পারে। টপিক তো কংক্রিট হতে হয়। মিস ও তাই বললেন। তখন বলে কি না," ওয়াশিং মেশিন"।

 👩🏻- (ভ্রু কুঁচকে) এতেই বা হাসির কি হল?

👧🏻-(থতমত খেয়ে) শোন না। মিস বললেন, "বেশ ঠিক আছে। তাই বানাও। তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা বলো।" তখন বলে কি, "মিস নম্বরটা আপনি এসে নিয়ে যান। চেঁচিয়ে বলব না, তাহলেই মেয়েরা নিয়ে নেবে।" এমন ভাবে বলল, হাসি চাপা দায়। মিস খানিকক্ষণ তাজ্জব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, "কেউ টুকবে না বাবু।তুই গিয়ে গিয়ে মেয়েদের দিয়ে এলেও ওরা নেবে না। তবে আমি আসছি।"

তুত্তুরী উবাচ ২২ শে জুন, ২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻- (Plant and Animal Kingdom পড়তে পড়তে, দৃঢ় স্বরে) একদিন আমি মিস্‌কে জিজ্ঞাসা করবই, করব। 

👩🏻- কি? 

👧🏻- ওরা তো কই আমাদের সম্পর্কে পড়াশোনা করে না। তাহলে আমরা কেন পড়ব? 

👩🏻- (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে)কারা রে?

👧🏻- এই যে Protista, Monera এরা।( আচমকা উত্তেজিত হয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে) কোন অ্যামিবা, কোন অ্যামিবাটা এখন আমার সম্পর্কে পড়ছে আগে তুমি বলো, যে আমাকে এসব পড়তে হবে? 😡😡😡😡😡

অনির ডাইরি ২০শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

বিগত দুই বছর ধরে রথটা কেমন যেন ঘেঁটে গেছে তুত্তুরী আর আমার জীবনে। Dবিশ্রী একটা পারিবারিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় ২০২১ সালের রথের দিন। সে বছরও লফট্ থেকে ঝেড়েঝুড়ে বার করা হয়েছিল তুত্তুরী থুড়ি জগন্নাথ দেবের তিনতলা মজবুত কাঠের রথ। রথের মধ্যে উঠেও পড়েছিলেন ভাই বোন সমেত জগন্নাথ দেব। তারপরই যে কি হয়ে গেল। মেয়ে আর মেয়ের রথ ফেলে বেরিয়ে পড়তে হল দুজনকে। বাকি দিনটা কেটে গেল হাসপাতালের চক্কর কেটেই। দ্বিপ্রাহরিক আহার জুটল পড়ন্ত বিকেলে, আহার বলতে হাওড়ার সুরকি কলের কাছে, নর্দমার ধারে বসে ভাজা শুটকো কয়েকটা জিলিপি মাত্র। 


লাটেই উঠতে বসেছিল সে বছরের রথ যাত্রা। যদি না উমারানি থাকত। আজও বলছিল তুত্তুরী, " তোমরা বেরিয়ে যাবার পর, কি কান্নাই না কেঁদে ছিলাম। একে তো বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি হয়েছে হাওড়ায়, তার ওপর পরের দিনই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে Rতমলুক চলে যাবে বাবা। শোক উথলে উথলে উঠছিল। মাসি অনেক চেষ্টা করছিল ভোলাতে। পারেনি। দুপুর বেলা বেল বাজিয়ে যখন কাকিমা এসে ঢুকল, ফুল, মালা, গাছের পাতা নিয়ে কি যে আনন্দ হল। কাকিমা বসল, তবে ভাত খেয়েছিলাম সেদিন।" উমার সাথেই সেবার রথ টেনেছিল তুত্তুরী। বাড়ি ফিরে, শুকনো মুখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সঙ্গী হয়েছিলাম বটে আমিও। তবে অনুভব করতে পারিনি কিছুই। 


২০২২ সালে, আমরা তখন তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। সবই ঠিক ছিল সে বছর, কোথাও কোন সমস্যা ছিল না, আমরাও Kমা-মেয়েতে অধীর ছিলাম জগন্নাথ দেবার রথ যাত্রার জন্য। বাংলোয় রান্না করতেন যে দিদি, ঝাড়পোঁচ করতেন যে দিদি, বাংলো পাহারা দিত যে ছেলে দুটি সবাইকে বলাও ছিল, রথের দিন এসো কেমন। সপরিবারে এসো। রথ টানব সবাই মিলে। সবই ঠিক ছিল শুধু বেঁকে বসলেন জগন্নাথ দেব স্বয়ং। গোটা তাম্রলিপ্ত নগরী ঢুঁড়েও মিলল না টানার মতন একখানিও রথ। আমরা সবে এসেছি, দোকান বাজার কিছুই চিনি না। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় শৌভিকের তৎকালীন ড্রাইভারের ওপর। তাকেই বলেছিলাম, একটা রথ কিনে আনতে। রোজই আশ্বস্ত করত ছেলেটি, "আজ পেয়ে যাব ম্যাডাম। আজ নিয়েই আসব ম্যাডাম।" দেখতে দেখতে রথ এল, চলেও গেল। জগুদা এণ্ড কোং আর এসে উপনীত হলেন না, তমলুকের মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসে।


হয়তো এই Dজেলার এমনিই নিয়ম। আমাদের হাওড়া-কলকেতার মত পথেঘাটে ঢেলে বিক্রি হয় না রথ, এই ভেবে এবারে তাই আর কোন আশাই রাখিনি Rতুত্তুরী আর আমি। ছিল না,রথ টানার বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহের সৌজন্যে, ইদানিং মাত্রাতিরিক্ত ভোরে স্কুল বসছে তুত্তুরীর। ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে Kস্কুলে ছেড়ে এসে আর এক দফা ঘুমিয়ে, কপালে করাঘাত করে, চটজলদি নাকে মুখে গুঁজে অফিস বেরিয়েছি, দেখি মহকুমা শাসকের করণ ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দু'ধারে সারি সারি সাজানো রয়েছে রথ। অধিকাংশই শোলা থুড়ি থার্মোকলের। কি অপূর্ব দেখতে সবকটা। মেয়েটার জন্য কেঁদে উঠল মন।  বাইরে থেকে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, আমার মাথায় ছুঁইছুঁই প্রায়, তবে ভিতরে তো এখনও তেমনি ভোম্বলই রয়ে গেছে।


Dমহকুমা শাসকের বাহনচালক নূপুর বাবুই নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসে তুলে দিতে, থাকতে না পেরে হ্যাংলার মতই তাকে বলে বসলাম," নূপুর বাবু, আমার মেয়েটাকে একটা রথ কিনে দেবেন গো?"

নূপুরবাবু জিভ কেটে বললেন, "এ বাবা ম্যাডাম, কেন কিনে দেবোনি! এ আর এমন কি ব্যাপার, আমরা তো অমুক সাহেবের মেয়েকেও কিনে দিতুম। রথ টানা হত,জিলিপি খাওয়া হত।"

এ আর এমন কি ব্যাপার, রথের দিন জিলিপি তো হবেই। পৃথিবী উল্টে গেলেও হবে। তবে তার আগে একবার মহকুমা শাসকের অনুমতি নেওয়া, বাধ্যতমূলক। তারও আগে এ ব্যাপারে শ্রীমতী তুত্তুরীর কি অভিমত তা জানা জরুরী।


Rতুত্তুরীর ছুটির সময় হিসেব করে, মাসির ফোনে, ফোন করলাম। প্রসঙ্গত কাঁথির মহকুমা শাসকের নিবাসে একখানি ল্যান্ড ফোনের দেহাবশেষ পড়ে আছে বটে, তবে তা সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ। বিগত ৮ মাসে তিনি একটি বারই ধড়মড় করে জীবিত হয়ে উঠে ছিলেন। অতঃপর কিছুক্ষন প্রবল ক্যাঁওম‌্যাঁও করে পুনরায় দেহ রাখেন। ল্যান্ডফোন আজকাল কেউই ব্যবহার করেন না, আর তুত্তুরীর নাগালের মধ্যে একখানি জ্যান্ত ফোন রাখা সমীচীন নয়, বলে আমরা আর তাকে খোঁচাইনি। অগত্যা মাসির ফোনই ভরসা।


এমনিতেও আমাদের Kঅনুপস্থিতিতে মাসির ফোনটা আর মাসির থাকে না। অন্য কারো কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যথারীতি তিনিই ধরলেন ফোনটা এবং রথ কিনে আনার কথা শুনে বেশ উদাস স্বরে বললেন "আমার কি আর রথ টানার বয়স আছে মা?" বেশ তবে টানিস না, বলে ফোন রেখে দিলাম।  যার জন্য চুরি করব মনস্থ করেছি, সেই যদি চোর ভাবে তাহলে আমি নাচার।


ফোনটা রাখার পর দুই মিনিটও কাটল না। পুনরায় ঝনঝনিয়ে উঠল মুঠোফোন। নম্বরটা তুত্তুরীর মাসির হলেও, ফোনের ওপারে তিনি স্বয়ং। "এই মা, ভাবছি রথটা টেনেইনি।" বেশ, এর পরের ধাপ মাননীয় মহকুমা শাসক মহোদয়কে পটানো। তিনি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে ইদানিং যা ব্যস্ত থাকছেন, তাঁকে ফোন করার উপরেও চেপেছে হাজার খানেক বিধিনিষেধ। যেমন ধরুন জীবনমরণ সমস্যা হলে তবেই যেন তার অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করা হয়। তাহলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুন না কেন, তিনি ফোনটা ধরবেন। অন্য যাবতীয় সমস্যার জন্য ফোন করতে হবে তার ব্যক্তিগত নম্বর। সেটি তিনি ধরতেও পারেন, নাও ধরতে পারেন। আর দরকার ছাড়া নিছক খোশ গল্প করার জন্য কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ফোন না করা হয়।


অনেক ভেবেচিন্তে, ফোন করা না করার উপপাদ্য সম্পাদ্য তত্ত্বটা মাথার মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝালিয়ে, শেষে ব্যক্তিগত নম্বরেই ফোন করলাম। তিনি ধরলেন, গলায় সামান্য ব্যস্ততার ছোঁয়া থাকলেও বিরক্তি বা ধমক নাই। বললাম," ওগো তুমি কি এখন কোথাও বেরোবে? যদি না বেরোও তাহলে নূপুর বাবুকে একটি বার বাংলোয় পাঠাও না, তুত্তুরী একটা রথ কিনতে যাবে। বেশি দূর নয়, এই তো তোমার অফিসের সামনের বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে।"তিনি কইলেন," অ। আমি নূপুরকেই বলছি বরং, একটা রথ কিনে দিয়ে আসতে।"


বাতাস অনুকূল দেখে নিজের কাজে মন দিলাম। কাজ করার কি যো আছে, কাকে যেন সাঁকো নাড়ানো দেখাতে নেই, কি কুক্ষণে যে রথ কেনার কথাটা বলেছিলাম। শ্রীমতী তুত্তুরী আক্ষরিক অর্থেই ফোন আর মেসেজের বন্যা বইয়ে দিলেন। "মা, নূপুর কাকু শোলার রথ কিনে এনেছে। এটা টানব কি করে?"  বললাম, তোর বাপকে বল। নূপুরকে পাঠিয়ে বদলে আনবে। সেটুকু সাহসটুকুও তার নেই। যত জোর কেবল মায়ের উপর।


যাইহোক সন্ধ্যা নামার আগে শোলার রথ বদলে যা আনা হল, তিনি পাতলা কাঠ বা পিচবোর্ডের হলেও তার চাকাগুলি মাটির। সামনে ঘোড়াটিও নেই, দড়ি বাঁধা হবে কোথায়? আর বাঁধলেও টানবে কি করে, বুঝতে পারলাম না। কারণ টানতে গেলেই তিনি সটান উল্টে যান। সন্ধ্যাবেলায় পাকশাল সামলায় যে ছেলেটি, সে আশ্বস্ত করল, "ও আমি কাল এসে সব ঠিক করে দেব সোনা মা(তুত্তুরী)। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।"


আজ সত্যিই বিকাল তিনটে থেকে একগাদা পেরেক, সুতো, রাংতা, মার্বেল পেপার, সোনালী জরি কিনে এনে রথটা সাজাল ছেলেটা, সঙ্গতে ছিল তুত্তুরীর মাসি। শ্রীমতী তুত্তুরী কয়েকবার মাতব্বরি করতে গিয়েছিলেন বটে, তেমন পাত্তা পাননি। বাগান থেকে তুলে আনা টাটকা ফুলে সেজে উঠলেন তিন ভাইবোন। এবার রথ টানার পালা। তুত্তুরীর হাতে তুলে দেওয়া হল রথের দড়ি থুড়ি জরি। 

দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল তুত্তুরী, রথের চাকা গুলো দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে, রথ ফেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল তিন ভাইবোন। কোন মতে,তাদের শান্ত করে, পুনরায় রথে প্রবিষ্ট করা হল। ছেলেটা পর্যায়ক্রমে রথের সামনে-পিছনে, চাকার উপরে-নীচে সর্বত্র পেরেক আর দড়ি বেঁধে দিল। তাও টলমল করেন তিন ভাই বোন। শেষে আমি বললাম, "চল বাবু তুই রথ টান। আর আমি রথের মাথাটাকে ধরে থাকি। দেখি যদি নড়ানো যায় তেনাদের।" তাও তাঁরা দোদুল্যমান। তখন মাসি বলল, " দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে দক্ষিণা দিই। দক্ষিণা না নিয়ে নড়বেন না মনে হচ্ছে।" দক্ষিণা দেওয়া হল, নকুলদানার প্রসাদ বিতরণ করা হল, অতঃপর জয় জগন্নাথ ধ্বনি সহ যাত্রা শুরু করলেন তাঁরা।


 জগন্নাথ দেবের টলমলে রথের জন্য খোলা হল বাংলোয় গাড়ি ঢোকার মস্ত সবুজ ফটক খানি। রাস্তায় নামলাম আমরা। এবার যাব কোথা। "বাবার অফিসে যাবে মা?" প্রশ্ন করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে রথ টানতে লাগল তুত্তুরী। জগুদাদা এন্ড কোং এরও মনে হয় বাবার অফিস দেখারই ইচ্ছে ছিল, তাই দিব্য টলটল করতে করতে এগিয়ে গেলেন তেনারা। কে বলবে, একটু আগে এনাদের নড়ানোই ছিল দুষ্কর। বাংলোর গেট থেকে শৌভিকের অফিস সাকুল্যে আড়াইশো মিটার হবে।  অফিসের ঢুকতে হয় ঢালু রাম্প ডিঙিয়ে। সেখানে আর রথ টানার সাহস হল না কারো। কোলেই নিলাম তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে সবাহন। 


শৌভিকের চেম্বারে ঢুকতে যাব, নূপুর বাবু দৌড়ে এলেন, "ম্যাডাম স্যার তো মিটিং করছেন। ইলেকশনের মিটিং, এডিএম স্যারও রয়েছেন।"

অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মহোদয় প্রেস দেখতে আসবেন বলেছিল বটে শৌভিক। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব, ফিরে আসব কিনা, ততক্ষণে চেম্বারের দরজা খুলে ধরেছে মহকুমা শাসকের আর্দালি কানাই বাবু। আমার সম্মতি ছাড়াই দিব্য গটগট করে ঢুকে গেল তুত্তুরী সহ তিন ভাই বোন। এডিএম স্যার এবং মহকুমা শাসক দুজনেই দেখলাম অত্যন্ত সহরষে স্বাগত জানালেন চারজনকে। নকুল দানার প্রসাদও হাত পেতে গ্রহণ করলেন দোঁহে। এমন কি দক্ষিণাও পাওয়া গেল বেশ। যা নাকি যে রথ টানে কেবল তারই প্রাপ্য। যে রথ ঠেলে বা সামলায় বা কোলে নেয় তার ভাগ্যে কচু ঘেঁচু এবং টিকটিকি।


এবার ফিরে আসার পালা। আমরা বাংলো প্রত্যাবর্তন করলাম বটে, তিন ভাইবোন রয়ে গেলেন মহকুমা শাসকের চেম্বারের এক পরিচ্ছন্ নকোণায়। ওটাই নাকি ওদের মাসির বাড়ি। অন্তত শ্রীমতি তুত্তুরী তাই ঘোষণা করলেন। কন্যার আব্দার দেখলাম হাসিমুখে মেনেও নিল শৌভিক। বাইরের আবরণটা যতই জাদরেল অফিসারের হোক না কেন, ভিতরে তো নিখাদ স্নেহপ্রবণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ।


Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প 


আমার বাবা-মায়ের কোনদিনই ঠিক সেই ভাবে বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আশি/নব্বইয়ের দশকে আমাদের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে কারই বা সেভাবে পালন করা হত।

বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই আসত বিশেষ দিনটা আর নীরবে বিদায় নিত। বাবা-মায়ের রুদ্ধশ্বাস রোমান্সের গল্প যদিও চলত সারা বছর। কিভাবে জেলে প্রথম দেখা, বাবা তখন বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দি। কিভাবে বাবার অজান্তে, গ্রামে ফিরে গিয়ে ফসল বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে বাবার জামিন করিয়েছিল সদ্য পরিচিত মা, সেই গল্পটাই ছিল আমার শৈশবের রূপকথা।


ঐতিহাসিক মে দিবসের দিন বাবা মায়ের ছোট্ট করে আইনানুগ বিবাহ, বাবার কিনে দেওয়া নীল বেনারসি শাড়ি আর বড় মাসির কাছ থেকে ধার করা গয়নায় লাজবন্তি মা আর বাবার যুগল সাদাকালো ছবিটা, সপ্তপদীর থেকে কম রোমান্টিক লাগত না আমার। ভালোবাসায় মোড়া ছিল দিনগুলো, ছিল না কেবল ভালবাসার দিনটার উদযাপন।


আশি- নব্বইয়ের দশককে পিছনে ফেলে, Y2K এর যাবতীয় জটিলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শনপূর্বক হুড়মুড় করে এসে পড়ল সহস্রাব্দ। আশেপাশে ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ল কত যে রক্ষণশীলতার প্রাচীর। কত কিছু যা এককালে দৃষ্টিকটু বা অবাস্তব গণ্য হত, স্বাভাবিক হয়ে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, তার ইয়ত্তা নেই। বদলে গেল অনেক কিছুই, বদলানো না কেবল আমার ফুটো কপাল। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, চাকরি পেয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেল, এমনকি বাবা মাও হয়ে পড়ল না জানি কতজন তুতো ভাই বোন, সহপাঠী, সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধব। আমিই রয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ কাঠ বেকার। 


কানাঘুষো শুনি,"আমাদের মধ্যে কেবল অনিন্দিতাটারই কিছু আর হল না।" আর মাটিতে মিশে যাই। হল নাই তো, মায় একটা টিউশনিও জোটে না মাইরি। বাস ভাড়ার জন্যও হাত পাততে হয় অবসর নেওয়া প্রৌঢ় বাপের কাছে। অন্তর্বাস, ন্যাপকিনটাও কিনে দিতে হয় মাকে। আমার মত ব্যর্থ অপদার্থ মেয়ের জন্য কেন যে ধরিত্রী দ্বিধা হত না। 

 এমন সময় আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য জনে জনে কুম্ভীরাশ্রুপাত করা এক প্রাক্তন সহপাঠী প্রস্তাব দিল তার কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য। সপ্তাহে একটা ক্লাস, অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতে হবে, বেতন মিলবে দেড়শ টাকা।


টাকার অঙ্কটা শুনে তাচ্ছিল্য করতেই পারেন, বিশেষতঃ আজকের বাজার দরে। তবে মূল্য তখনই বুঝবেন যদি আপনি কখনও বেকারত্বের জ্বালা অনুভব করে থাকেন। সাদা ছোট্ট খামে মোড়া একটা ১০০ আর একটা ৫০ টাকার নোট। রবিবার সকালের ফাঁকা ৫২ নম্বর বাসের লেডিস সিটে বসে, জনগণের চোখ বাঁচিয়ে কতবার যে শুঁকে ছিলাম টাকার গন্ধটা। "শালা ম্যায় তো সাহাব বান গ্যয়া" মার্কা কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসের জানলা দিয়ে চোখ গেল রাস্তার ধারের একটা ছোট্ট দোকানে ঝোলানো হলুদ সাদা একটা পাঞ্জাবির দিকে। আজ আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী না, ঝট করে বাস থেকে নেমে পড়ে কিনেই ফেললাম পাঞ্জাবীটা বাবার জন্য। দাম পড়ল ৯০ টাকা। আর মায়ের জন্য পাড়ার দোকান থেকে কিনলাম এক লিটারের একটা মেট্রোর বাটারস্কচ আইসক্রিম। চকলেট ফ্লেভার মায়ের ঘোরতর নাপসন্দ ছিল যে। কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি এই পৌনে তিন কিলোমিটার পথ আসতেই উড়িয়ে দিলাম সারা মাসের মাইনে।


এমন কপাল, সেই বছরই নভেম্বর মাসে নিউমোনিয়া বাঁধাল বাবা। এক সপ্তাহ ধরে যমে মানুষে টানাটানি। সুযোগ পেয়ে গেল মাও, "দেখলি তো,ওই সব বিবাহবার্ষিকী- টার্ষিকী করলে কি হয়।" তারপরের কয়েকটা বছর সত্যিই কিছু করিনি। করার সুযোগ ও পাইনি। ওই বছর গুলো ছিল আমার লড়ার এবং জেতার বছর। কিচ্ছু না হওয়া থেকে একসাথে অনেক অনেক  কিছু হবার বছর। থিতু হতেই আবার শুরু হল বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার কেনা। সবাই মিলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, গল্পগুজব, সামান্য স্মৃতিচারণ এই আর কি। ব্যাপারটা যে বাবা বা মা খুব ভালো ভাবে নেয়, এমন ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। বেশ বিরক্ত হয় বুড়োবুড়ি। প্রতিবারই বলে, ও সব আদিখ্যেতা এবার বন্ধ কর। নেহাৎ আমি শুনি না।


এটা বৃদ্ধ বৃদ্ধার ৪৯ তম বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু এবার কিছু করাটা ছিল বেশ দুষ্কর। বাড়ি থেকে প্রায় শ দেড়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছি। এত স্বল্প অবসরে বাড়ি যাই যে বাজার দোকান, রান্নাবাড়া কোন কিছুই আমার একার পক্ষে করে তোলা সম্ভব নয়। তারওপর আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাজগোজ। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতে বললে, কিছুই নাকি খুঁজে পায় না বাবা। আর মা অনেক খুঁজে বার করে একটা ন্যাতা শাড়ি। কারণ, " ওরে বাবা কি গরম! তুমি কি চাও, এই গরমে আমি বেনারসী পরব নাকি?" 


ভাগ্যে অয়ন ছিল। শ্রীমান অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় আমার বাবার ভ্রাতুষ্পুত্র। মেন্যু নির্ধারণ আমি করে দিলেও, আগের দিন রাত থেকে বসে লিস্ট করে, নিজে বেছে সব থেকে ভালো মালপত্র কিনে এনে, এই গা চিড়বিড় গরমে যা রাঁধল ছেলেটা, আহা অসাধারণ। দুটো মালাও কিনতে বলেছিলাম, সেটা অবশ্য কেনেনি, " এই বয়সে মার খাওয়াবি নাকি? মালা দেখে মেজ জেঠু রেগে ফায়ার হয়ে যাবে জানিস না। আসল বিয়ের দিনই মালা পরল না, সে নাকি বিবাহবার্ষকীতে পরবে।"

দই মিষ্টিটা অবশ্য আমার ফরমায়েশ মত কাঁথি থেকে নিয়ে গিয়েছিল শৌভিক। ভাগ্যে গিয়েছিল,তাই না ওমন সোনা মুখ করে সাজুগুজু করল বুড়ো বুড়ি। ভগিনী, কন্যা, জামাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনী পরিবৃত হয়ে এক কথায় কেকটাও কেটে ফেলল। দেদার নকল বরফ ওড়ালো বুল্লু বাবু আর তুত্তুরী। বৃদ্ধ দম্পতির মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করল সাতাশি বছরের তরুণী তন্বী পিসি। " তোরা দুজনেই তো আমার শিব রাত্রির সলতে। আর তো সবই হারিয়ে গেছে আমার। খুব ভালো থাক। আরো আরো ঝগড়া কর। ঝগড়া করলে ফুসফুসের জোর বাড়ে, আমি পড়েছি।"  সময় ও আজব খেলা খেলে মাইরি, বছর বিশেক আগে এ দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। এমনিই থাকুক না, এমনিই চলুক না। বাকি সব অঙ্ক সময় আর কর্মফল ঠিক মিলিয়েই দেবে। অন্তত জীবন তো আমায় তাই শিখিয়েছে।