Saturday 24 June 2023

তুত্তুরী উবাচ ২২ শে জুন, ২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻- (Plant and Animal Kingdom পড়তে পড়তে, দৃঢ় স্বরে) একদিন আমি মিস্‌কে জিজ্ঞাসা করবই, করব। 

👩🏻- কি? 

👧🏻- ওরা তো কই আমাদের সম্পর্কে পড়াশোনা করে না। তাহলে আমরা কেন পড়ব? 

👩🏻- (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে)কারা রে?

👧🏻- এই যে Protista, Monera এরা।( আচমকা উত্তেজিত হয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে) কোন অ্যামিবা, কোন অ্যামিবাটা এখন আমার সম্পর্কে পড়ছে আগে তুমি বলো, যে আমাকে এসব পড়তে হবে? 😡😡😡😡😡

অনির ডাইরি ২০শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

বিগত দুই বছর ধরে রথটা কেমন যেন ঘেঁটে গেছে তুত্তুরী আর আমার জীবনে। Dবিশ্রী একটা পারিবারিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় ২০২১ সালের রথের দিন। সে বছরও লফট্ থেকে ঝেড়েঝুড়ে বার করা হয়েছিল তুত্তুরী থুড়ি জগন্নাথ দেবের তিনতলা মজবুত কাঠের রথ। রথের মধ্যে উঠেও পড়েছিলেন ভাই বোন সমেত জগন্নাথ দেব। তারপরই যে কি হয়ে গেল। মেয়ে আর মেয়ের রথ ফেলে বেরিয়ে পড়তে হল দুজনকে। বাকি দিনটা কেটে গেল হাসপাতালের চক্কর কেটেই। দ্বিপ্রাহরিক আহার জুটল পড়ন্ত বিকেলে, আহার বলতে হাওড়ার সুরকি কলের কাছে, নর্দমার ধারে বসে ভাজা শুটকো কয়েকটা জিলিপি মাত্র। 


লাটেই উঠতে বসেছিল সে বছরের রথ যাত্রা। যদি না উমারানি থাকত। আজও বলছিল তুত্তুরী, " তোমরা বেরিয়ে যাবার পর, কি কান্নাই না কেঁদে ছিলাম। একে তো বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি হয়েছে হাওড়ায়, তার ওপর পরের দিনই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে Rতমলুক চলে যাবে বাবা। শোক উথলে উথলে উঠছিল। মাসি অনেক চেষ্টা করছিল ভোলাতে। পারেনি। দুপুর বেলা বেল বাজিয়ে যখন কাকিমা এসে ঢুকল, ফুল, মালা, গাছের পাতা নিয়ে কি যে আনন্দ হল। কাকিমা বসল, তবে ভাত খেয়েছিলাম সেদিন।" উমার সাথেই সেবার রথ টেনেছিল তুত্তুরী। বাড়ি ফিরে, শুকনো মুখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সঙ্গী হয়েছিলাম বটে আমিও। তবে অনুভব করতে পারিনি কিছুই। 


২০২২ সালে, আমরা তখন তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। সবই ঠিক ছিল সে বছর, কোথাও কোন সমস্যা ছিল না, আমরাও Kমা-মেয়েতে অধীর ছিলাম জগন্নাথ দেবার রথ যাত্রার জন্য। বাংলোয় রান্না করতেন যে দিদি, ঝাড়পোঁচ করতেন যে দিদি, বাংলো পাহারা দিত যে ছেলে দুটি সবাইকে বলাও ছিল, রথের দিন এসো কেমন। সপরিবারে এসো। রথ টানব সবাই মিলে। সবই ঠিক ছিল শুধু বেঁকে বসলেন জগন্নাথ দেব স্বয়ং। গোটা তাম্রলিপ্ত নগরী ঢুঁড়েও মিলল না টানার মতন একখানিও রথ। আমরা সবে এসেছি, দোকান বাজার কিছুই চিনি না। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় শৌভিকের তৎকালীন ড্রাইভারের ওপর। তাকেই বলেছিলাম, একটা রথ কিনে আনতে। রোজই আশ্বস্ত করত ছেলেটি, "আজ পেয়ে যাব ম্যাডাম। আজ নিয়েই আসব ম্যাডাম।" দেখতে দেখতে রথ এল, চলেও গেল। জগুদা এণ্ড কোং আর এসে উপনীত হলেন না, তমলুকের মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসে।


হয়তো এই Dজেলার এমনিই নিয়ম। আমাদের হাওড়া-কলকেতার মত পথেঘাটে ঢেলে বিক্রি হয় না রথ, এই ভেবে এবারে তাই আর কোন আশাই রাখিনি Rতুত্তুরী আর আমি। ছিল না,রথ টানার বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহের সৌজন্যে, ইদানিং মাত্রাতিরিক্ত ভোরে স্কুল বসছে তুত্তুরীর। ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে Kস্কুলে ছেড়ে এসে আর এক দফা ঘুমিয়ে, কপালে করাঘাত করে, চটজলদি নাকে মুখে গুঁজে অফিস বেরিয়েছি, দেখি মহকুমা শাসকের করণ ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দু'ধারে সারি সারি সাজানো রয়েছে রথ। অধিকাংশই শোলা থুড়ি থার্মোকলের। কি অপূর্ব দেখতে সবকটা। মেয়েটার জন্য কেঁদে উঠল মন।  বাইরে থেকে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, আমার মাথায় ছুঁইছুঁই প্রায়, তবে ভিতরে তো এখনও তেমনি ভোম্বলই রয়ে গেছে।


Dমহকুমা শাসকের বাহনচালক নূপুর বাবুই নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসে তুলে দিতে, থাকতে না পেরে হ্যাংলার মতই তাকে বলে বসলাম," নূপুর বাবু, আমার মেয়েটাকে একটা রথ কিনে দেবেন গো?"

নূপুরবাবু জিভ কেটে বললেন, "এ বাবা ম্যাডাম, কেন কিনে দেবোনি! এ আর এমন কি ব্যাপার, আমরা তো অমুক সাহেবের মেয়েকেও কিনে দিতুম। রথ টানা হত,জিলিপি খাওয়া হত।"

এ আর এমন কি ব্যাপার, রথের দিন জিলিপি তো হবেই। পৃথিবী উল্টে গেলেও হবে। তবে তার আগে একবার মহকুমা শাসকের অনুমতি নেওয়া, বাধ্যতমূলক। তারও আগে এ ব্যাপারে শ্রীমতী তুত্তুরীর কি অভিমত তা জানা জরুরী।


Rতুত্তুরীর ছুটির সময় হিসেব করে, মাসির ফোনে, ফোন করলাম। প্রসঙ্গত কাঁথির মহকুমা শাসকের নিবাসে একখানি ল্যান্ড ফোনের দেহাবশেষ পড়ে আছে বটে, তবে তা সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ। বিগত ৮ মাসে তিনি একটি বারই ধড়মড় করে জীবিত হয়ে উঠে ছিলেন। অতঃপর কিছুক্ষন প্রবল ক্যাঁওম‌্যাঁও করে পুনরায় দেহ রাখেন। ল্যান্ডফোন আজকাল কেউই ব্যবহার করেন না, আর তুত্তুরীর নাগালের মধ্যে একখানি জ্যান্ত ফোন রাখা সমীচীন নয়, বলে আমরা আর তাকে খোঁচাইনি। অগত্যা মাসির ফোনই ভরসা।


এমনিতেও আমাদের Kঅনুপস্থিতিতে মাসির ফোনটা আর মাসির থাকে না। অন্য কারো কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যথারীতি তিনিই ধরলেন ফোনটা এবং রথ কিনে আনার কথা শুনে বেশ উদাস স্বরে বললেন "আমার কি আর রথ টানার বয়স আছে মা?" বেশ তবে টানিস না, বলে ফোন রেখে দিলাম।  যার জন্য চুরি করব মনস্থ করেছি, সেই যদি চোর ভাবে তাহলে আমি নাচার।


ফোনটা রাখার পর দুই মিনিটও কাটল না। পুনরায় ঝনঝনিয়ে উঠল মুঠোফোন। নম্বরটা তুত্তুরীর মাসির হলেও, ফোনের ওপারে তিনি স্বয়ং। "এই মা, ভাবছি রথটা টেনেইনি।" বেশ, এর পরের ধাপ মাননীয় মহকুমা শাসক মহোদয়কে পটানো। তিনি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে ইদানিং যা ব্যস্ত থাকছেন, তাঁকে ফোন করার উপরেও চেপেছে হাজার খানেক বিধিনিষেধ। যেমন ধরুন জীবনমরণ সমস্যা হলে তবেই যেন তার অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করা হয়। তাহলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুন না কেন, তিনি ফোনটা ধরবেন। অন্য যাবতীয় সমস্যার জন্য ফোন করতে হবে তার ব্যক্তিগত নম্বর। সেটি তিনি ধরতেও পারেন, নাও ধরতে পারেন। আর দরকার ছাড়া নিছক খোশ গল্প করার জন্য কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ফোন না করা হয়।


অনেক ভেবেচিন্তে, ফোন করা না করার উপপাদ্য সম্পাদ্য তত্ত্বটা মাথার মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝালিয়ে, শেষে ব্যক্তিগত নম্বরেই ফোন করলাম। তিনি ধরলেন, গলায় সামান্য ব্যস্ততার ছোঁয়া থাকলেও বিরক্তি বা ধমক নাই। বললাম," ওগো তুমি কি এখন কোথাও বেরোবে? যদি না বেরোও তাহলে নূপুর বাবুকে একটি বার বাংলোয় পাঠাও না, তুত্তুরী একটা রথ কিনতে যাবে। বেশি দূর নয়, এই তো তোমার অফিসের সামনের বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে।"তিনি কইলেন," অ। আমি নূপুরকেই বলছি বরং, একটা রথ কিনে দিয়ে আসতে।"


বাতাস অনুকূল দেখে নিজের কাজে মন দিলাম। কাজ করার কি যো আছে, কাকে যেন সাঁকো নাড়ানো দেখাতে নেই, কি কুক্ষণে যে রথ কেনার কথাটা বলেছিলাম। শ্রীমতী তুত্তুরী আক্ষরিক অর্থেই ফোন আর মেসেজের বন্যা বইয়ে দিলেন। "মা, নূপুর কাকু শোলার রথ কিনে এনেছে। এটা টানব কি করে?"  বললাম, তোর বাপকে বল। নূপুরকে পাঠিয়ে বদলে আনবে। সেটুকু সাহসটুকুও তার নেই। যত জোর কেবল মায়ের উপর।


যাইহোক সন্ধ্যা নামার আগে শোলার রথ বদলে যা আনা হল, তিনি পাতলা কাঠ বা পিচবোর্ডের হলেও তার চাকাগুলি মাটির। সামনে ঘোড়াটিও নেই, দড়ি বাঁধা হবে কোথায়? আর বাঁধলেও টানবে কি করে, বুঝতে পারলাম না। কারণ টানতে গেলেই তিনি সটান উল্টে যান। সন্ধ্যাবেলায় পাকশাল সামলায় যে ছেলেটি, সে আশ্বস্ত করল, "ও আমি কাল এসে সব ঠিক করে দেব সোনা মা(তুত্তুরী)। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।"


আজ সত্যিই বিকাল তিনটে থেকে একগাদা পেরেক, সুতো, রাংতা, মার্বেল পেপার, সোনালী জরি কিনে এনে রথটা সাজাল ছেলেটা, সঙ্গতে ছিল তুত্তুরীর মাসি। শ্রীমতী তুত্তুরী কয়েকবার মাতব্বরি করতে গিয়েছিলেন বটে, তেমন পাত্তা পাননি। বাগান থেকে তুলে আনা টাটকা ফুলে সেজে উঠলেন তিন ভাইবোন। এবার রথ টানার পালা। তুত্তুরীর হাতে তুলে দেওয়া হল রথের দড়ি থুড়ি জরি। 

দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল তুত্তুরী, রথের চাকা গুলো দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে, রথ ফেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল তিন ভাইবোন। কোন মতে,তাদের শান্ত করে, পুনরায় রথে প্রবিষ্ট করা হল। ছেলেটা পর্যায়ক্রমে রথের সামনে-পিছনে, চাকার উপরে-নীচে সর্বত্র পেরেক আর দড়ি বেঁধে দিল। তাও টলমল করেন তিন ভাই বোন। শেষে আমি বললাম, "চল বাবু তুই রথ টান। আর আমি রথের মাথাটাকে ধরে থাকি। দেখি যদি নড়ানো যায় তেনাদের।" তাও তাঁরা দোদুল্যমান। তখন মাসি বলল, " দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে দক্ষিণা দিই। দক্ষিণা না নিয়ে নড়বেন না মনে হচ্ছে।" দক্ষিণা দেওয়া হল, নকুলদানার প্রসাদ বিতরণ করা হল, অতঃপর জয় জগন্নাথ ধ্বনি সহ যাত্রা শুরু করলেন তাঁরা।


 জগন্নাথ দেবের টলমলে রথের জন্য খোলা হল বাংলোয় গাড়ি ঢোকার মস্ত সবুজ ফটক খানি। রাস্তায় নামলাম আমরা। এবার যাব কোথা। "বাবার অফিসে যাবে মা?" প্রশ্ন করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে রথ টানতে লাগল তুত্তুরী। জগুদাদা এন্ড কোং এরও মনে হয় বাবার অফিস দেখারই ইচ্ছে ছিল, তাই দিব্য টলটল করতে করতে এগিয়ে গেলেন তেনারা। কে বলবে, একটু আগে এনাদের নড়ানোই ছিল দুষ্কর। বাংলোর গেট থেকে শৌভিকের অফিস সাকুল্যে আড়াইশো মিটার হবে।  অফিসের ঢুকতে হয় ঢালু রাম্প ডিঙিয়ে। সেখানে আর রথ টানার সাহস হল না কারো। কোলেই নিলাম তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে সবাহন। 


শৌভিকের চেম্বারে ঢুকতে যাব, নূপুর বাবু দৌড়ে এলেন, "ম্যাডাম স্যার তো মিটিং করছেন। ইলেকশনের মিটিং, এডিএম স্যারও রয়েছেন।"

অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মহোদয় প্রেস দেখতে আসবেন বলেছিল বটে শৌভিক। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব, ফিরে আসব কিনা, ততক্ষণে চেম্বারের দরজা খুলে ধরেছে মহকুমা শাসকের আর্দালি কানাই বাবু। আমার সম্মতি ছাড়াই দিব্য গটগট করে ঢুকে গেল তুত্তুরী সহ তিন ভাই বোন। এডিএম স্যার এবং মহকুমা শাসক দুজনেই দেখলাম অত্যন্ত সহরষে স্বাগত জানালেন চারজনকে। নকুল দানার প্রসাদও হাত পেতে গ্রহণ করলেন দোঁহে। এমন কি দক্ষিণাও পাওয়া গেল বেশ। যা নাকি যে রথ টানে কেবল তারই প্রাপ্য। যে রথ ঠেলে বা সামলায় বা কোলে নেয় তার ভাগ্যে কচু ঘেঁচু এবং টিকটিকি।


এবার ফিরে আসার পালা। আমরা বাংলো প্রত্যাবর্তন করলাম বটে, তিন ভাইবোন রয়ে গেলেন মহকুমা শাসকের চেম্বারের এক পরিচ্ছন্ নকোণায়। ওটাই নাকি ওদের মাসির বাড়ি। অন্তত শ্রীমতি তুত্তুরী তাই ঘোষণা করলেন। কন্যার আব্দার দেখলাম হাসিমুখে মেনেও নিল শৌভিক। বাইরের আবরণটা যতই জাদরেল অফিসারের হোক না কেন, ভিতরে তো নিখাদ স্নেহপ্রবণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ।


Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প 


আমার বাবা-মায়ের কোনদিনই ঠিক সেই ভাবে বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আশি/নব্বইয়ের দশকে আমাদের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে কারই বা সেভাবে পালন করা হত।

বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই আসত বিশেষ দিনটা আর নীরবে বিদায় নিত। বাবা-মায়ের রুদ্ধশ্বাস রোমান্সের গল্প যদিও চলত সারা বছর। কিভাবে জেলে প্রথম দেখা, বাবা তখন বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দি। কিভাবে বাবার অজান্তে, গ্রামে ফিরে গিয়ে ফসল বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে বাবার জামিন করিয়েছিল সদ্য পরিচিত মা, সেই গল্পটাই ছিল আমার শৈশবের রূপকথা।


ঐতিহাসিক মে দিবসের দিন বাবা মায়ের ছোট্ট করে আইনানুগ বিবাহ, বাবার কিনে দেওয়া নীল বেনারসি শাড়ি আর বড় মাসির কাছ থেকে ধার করা গয়নায় লাজবন্তি মা আর বাবার যুগল সাদাকালো ছবিটা, সপ্তপদীর থেকে কম রোমান্টিক লাগত না আমার। ভালোবাসায় মোড়া ছিল দিনগুলো, ছিল না কেবল ভালবাসার দিনটার উদযাপন।


আশি- নব্বইয়ের দশককে পিছনে ফেলে, Y2K এর যাবতীয় জটিলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শনপূর্বক হুড়মুড় করে এসে পড়ল সহস্রাব্দ। আশেপাশে ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ল কত যে রক্ষণশীলতার প্রাচীর। কত কিছু যা এককালে দৃষ্টিকটু বা অবাস্তব গণ্য হত, স্বাভাবিক হয়ে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, তার ইয়ত্তা নেই। বদলে গেল অনেক কিছুই, বদলানো না কেবল আমার ফুটো কপাল। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, চাকরি পেয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেল, এমনকি বাবা মাও হয়ে পড়ল না জানি কতজন তুতো ভাই বোন, সহপাঠী, সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধব। আমিই রয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ কাঠ বেকার। 


কানাঘুষো শুনি,"আমাদের মধ্যে কেবল অনিন্দিতাটারই কিছু আর হল না।" আর মাটিতে মিশে যাই। হল নাই তো, মায় একটা টিউশনিও জোটে না মাইরি। বাস ভাড়ার জন্যও হাত পাততে হয় অবসর নেওয়া প্রৌঢ় বাপের কাছে। অন্তর্বাস, ন্যাপকিনটাও কিনে দিতে হয় মাকে। আমার মত ব্যর্থ অপদার্থ মেয়ের জন্য কেন যে ধরিত্রী দ্বিধা হত না। 

 এমন সময় আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য জনে জনে কুম্ভীরাশ্রুপাত করা এক প্রাক্তন সহপাঠী প্রস্তাব দিল তার কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য। সপ্তাহে একটা ক্লাস, অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতে হবে, বেতন মিলবে দেড়শ টাকা।


টাকার অঙ্কটা শুনে তাচ্ছিল্য করতেই পারেন, বিশেষতঃ আজকের বাজার দরে। তবে মূল্য তখনই বুঝবেন যদি আপনি কখনও বেকারত্বের জ্বালা অনুভব করে থাকেন। সাদা ছোট্ট খামে মোড়া একটা ১০০ আর একটা ৫০ টাকার নোট। রবিবার সকালের ফাঁকা ৫২ নম্বর বাসের লেডিস সিটে বসে, জনগণের চোখ বাঁচিয়ে কতবার যে শুঁকে ছিলাম টাকার গন্ধটা। "শালা ম্যায় তো সাহাব বান গ্যয়া" মার্কা কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসের জানলা দিয়ে চোখ গেল রাস্তার ধারের একটা ছোট্ট দোকানে ঝোলানো হলুদ সাদা একটা পাঞ্জাবির দিকে। আজ আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী না, ঝট করে বাস থেকে নেমে পড়ে কিনেই ফেললাম পাঞ্জাবীটা বাবার জন্য। দাম পড়ল ৯০ টাকা। আর মায়ের জন্য পাড়ার দোকান থেকে কিনলাম এক লিটারের একটা মেট্রোর বাটারস্কচ আইসক্রিম। চকলেট ফ্লেভার মায়ের ঘোরতর নাপসন্দ ছিল যে। কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি এই পৌনে তিন কিলোমিটার পথ আসতেই উড়িয়ে দিলাম সারা মাসের মাইনে।


এমন কপাল, সেই বছরই নভেম্বর মাসে নিউমোনিয়া বাঁধাল বাবা। এক সপ্তাহ ধরে যমে মানুষে টানাটানি। সুযোগ পেয়ে গেল মাও, "দেখলি তো,ওই সব বিবাহবার্ষিকী- টার্ষিকী করলে কি হয়।" তারপরের কয়েকটা বছর সত্যিই কিছু করিনি। করার সুযোগ ও পাইনি। ওই বছর গুলো ছিল আমার লড়ার এবং জেতার বছর। কিচ্ছু না হওয়া থেকে একসাথে অনেক অনেক  কিছু হবার বছর। থিতু হতেই আবার শুরু হল বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার কেনা। সবাই মিলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, গল্পগুজব, সামান্য স্মৃতিচারণ এই আর কি। ব্যাপারটা যে বাবা বা মা খুব ভালো ভাবে নেয়, এমন ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। বেশ বিরক্ত হয় বুড়োবুড়ি। প্রতিবারই বলে, ও সব আদিখ্যেতা এবার বন্ধ কর। নেহাৎ আমি শুনি না।


এটা বৃদ্ধ বৃদ্ধার ৪৯ তম বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু এবার কিছু করাটা ছিল বেশ দুষ্কর। বাড়ি থেকে প্রায় শ দেড়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছি। এত স্বল্প অবসরে বাড়ি যাই যে বাজার দোকান, রান্নাবাড়া কোন কিছুই আমার একার পক্ষে করে তোলা সম্ভব নয়। তারওপর আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাজগোজ। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতে বললে, কিছুই নাকি খুঁজে পায় না বাবা। আর মা অনেক খুঁজে বার করে একটা ন্যাতা শাড়ি। কারণ, " ওরে বাবা কি গরম! তুমি কি চাও, এই গরমে আমি বেনারসী পরব নাকি?" 


ভাগ্যে অয়ন ছিল। শ্রীমান অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় আমার বাবার ভ্রাতুষ্পুত্র। মেন্যু নির্ধারণ আমি করে দিলেও, আগের দিন রাত থেকে বসে লিস্ট করে, নিজে বেছে সব থেকে ভালো মালপত্র কিনে এনে, এই গা চিড়বিড় গরমে যা রাঁধল ছেলেটা, আহা অসাধারণ। দুটো মালাও কিনতে বলেছিলাম, সেটা অবশ্য কেনেনি, " এই বয়সে মার খাওয়াবি নাকি? মালা দেখে মেজ জেঠু রেগে ফায়ার হয়ে যাবে জানিস না। আসল বিয়ের দিনই মালা পরল না, সে নাকি বিবাহবার্ষকীতে পরবে।"

দই মিষ্টিটা অবশ্য আমার ফরমায়েশ মত কাঁথি থেকে নিয়ে গিয়েছিল শৌভিক। ভাগ্যে গিয়েছিল,তাই না ওমন সোনা মুখ করে সাজুগুজু করল বুড়ো বুড়ি। ভগিনী, কন্যা, জামাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনী পরিবৃত হয়ে এক কথায় কেকটাও কেটে ফেলল। দেদার নকল বরফ ওড়ালো বুল্লু বাবু আর তুত্তুরী। বৃদ্ধ দম্পতির মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করল সাতাশি বছরের তরুণী তন্বী পিসি। " তোরা দুজনেই তো আমার শিব রাত্রির সলতে। আর তো সবই হারিয়ে গেছে আমার। খুব ভালো থাক। আরো আরো ঝগড়া কর। ঝগড়া করলে ফুসফুসের জোর বাড়ে, আমি পড়েছি।"  সময় ও আজব খেলা খেলে মাইরি, বছর বিশেক আগে এ দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। এমনিই থাকুক না, এমনিই চলুক না। বাকি সব অঙ্ক সময় আর কর্মফল ঠিক মিলিয়েই দেবে। অন্তত জীবন তো আমায় তাই শিখিয়েছে।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আজ ২৫শে বৈশাখ সরকারি ক্যালেন্ডার এ লাল থাকার সৌজন্যে আমার আজ ছুটি। শৌভিক অবশ্য বেরোবে। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়ে বেড়াবে। প্রথমেই যাবে কাঁথি উপসংশোধনাগারে। পাতি বাংলায় জেল। পদাধিকার বলে এই জেলের সুপার কাঁথির মহকুমা শাসক। কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দিরাই থাকেন এই জেলে। বিচার শেষে হয় মুক্তি, নয়তো যতদূর জানি, মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় আবাসিক বন্দীদের।এই আবাসিক বন্দীদের নিয়েই রবীন্দ্রজয়ন্তীর সামান্য আয়োজন। 


আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে খুব একটা যে উৎসুক ছিল শৌভিক তা নয়, বলতে পারেন গায়ে পড়েই সঙ্গী হয়েছি। জেল পরিদর্শনের লোভ আমার বরাবরই। আমার পূর্বতন দুই প্রজন্মের একাধিক পুরুষ তাঁদের তারুণ্যের বেশ কিছুটা করে অংশ জেলে কাটিয়েছেন, রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে। বাবা আর ছোট কাকুর সময় ছিল নকশাল আন্দোলন। ছোট দাদুর ক্ষেত্রে ছিল," ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়"। আর পিতামহ ছিলেন অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য, বাঘা যতীনের অনুরাগী। স্থান হয়েছিল খাস মান্দালয় জেলে। ছেলেকে দেশে ফেরাতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হতে হয়েছিল প্রপিতামহকে। তাই আমাকে নিরস্ত করা অত সহজ নয়।


 মহকুমা শাসকের নিবাসের ঢিল ছোড়া দূরত্বেই জেলটা। বর্তমান জেলার সাহেবের তীব্র অনুরাগী আমার বর। কথায় কথায় ওনার প্রশংসা করে, উনি নাকি অত্যন্ত উদ্যোগী পুরুষ। জেলারের কাজটাকে নিছক গতানুগতিক ভাবে নয় বরং প্রগাঢ় ভালোবেসে করেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই এমনকি কখনও কখনও নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়েও আবাসিকদের দিয়ে নানা রকম হাতের কাজ করান। বর্তমানে মুক্ত এমনই এক আবাসিকের স্বহস্তে তৈরি মূর্তি শোভা পায় শৌভিকের অফিস চেম্বারে, উপহার দিয়েছিলেন জেলার সাহেব। 


নামকাওয়াস্তে গাড়িতে ওঠা আর নামা। রাস্তা পেরিয়েই দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী যেহেতু অস্ত্র বহন করেন, তাই জেলে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যুগলে ঢুকলাম জেলের মস্ত গেটটা দিয়ে। ভিতরে এক সহাস্য ভদ্রলোক প্রতীক্ষা করছিলেন আমাদেরই জন্য। শৌভিক আলাপ করিয়ে দিল, ইনিই জেলার সাহেব। ভদ্রলোক বয়সে আমাদেরই সমান হবেন। মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি চেহারা। চোখে চশমা, পরনে চেক শার্ট আর প্যান্ট। জেলারের উর্দি না থাকাতেই আমি চিনতে পারিনি ওনাকে।


নমস্কার -প্রতিনমস্কারের পালা মিটতে উনি হাসিমুখে জানালেন," ম্যাডামকে এনেছেন, এতে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছি।" অতঃপর ওনার ইশারায় খুলে গেল মস্ত তালা লাগানো, "কারার ঐ লৌহ কপাট।" ভিতরটা ঝকঝক করছে, কেয়ারি করা ফুলের বাগান। সর্বত্র যত্ন আর আন্তরিকতার ছাপ। শৌভিক ফিসফিস করে বলল, " এই সমস্ত গাছের বীজ এবং চারা জেলার সাহেব ওনার পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনিয়েছেন। বাগান করলে আবাসিকের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটবে শুধু সেই জন্য। বলেছিলাম না এই লোকটা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং ভালো।"


বাঁদিকে বেঁকে একতলা মস্ত হল ঘর। সেখানেই অনুষ্ঠানটি চলছে। লম্বাটে হল ঘর, মাটিতে কালো কম্বল পাতা। বাইরে অনেকগুলি জুতা ছাড়া ছিল, আমরা জুতো খুলতে গিয়েও জেলার সাহেবের আপত্তিতে খুলতে পারলাম না। দেওয়ালের চুনকাম সময়ের অভিঘাতে বিবর্ণ। ইতি ইতি দেওয়ালে এবং ছাদে ফাটল ধরেছে। দৈর্ঘ্য বরাবর দুই দিকেই নির্দিষ্ট দূরত্ব ছাড়া ছাড়া মানুষ সমান বেশ অনেকগুলি লম্বা জানালা। ফলে ঘরটা তেমন গরম নয়। রংবেরঙের বেলুন টাঙ্গানো হয়েছে জানলা জুড়ে যার কয়েকটা মাঝেমধ্যেই সশব্দে ফাটছে। 


প্রস্থ বরাবর একদিকের দেয়াল হলুদ সাদা সস্তার কাপড়ে মোড়া। তার সামনে, একদম বাঁদিকে একটি কাঠের চেয়ারের ওপরে বসে আছেন রবি স্বয়ং। তার ডানদিকে দুটি পালিশ চটা কাঠের টেবিল জুড়ে একটি উত্তরীয় পেতে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। টেবিলের উপর রাখা রেকাবিতে গুটি কয়েক পুষ্পহার সাজানো আছে। টেবিলের পিছনে গোটা চার পাঁচ চেয়ার রাখা, তারই দুটি দখল করে বসলাম দোঁহে। আরো মান্য-গণ্য অতিথিরা আসতে পারেন ভেবে, ভয়ে এক কোনায় বসে ছিলাম শৌভিক ইশারায় পাশের চেয়ারটি দখল করতে বলল। সামনাসামনি বসে আছেন আবাসিক বৃন্দ। সংখ্যায় খুব কম নয়। মাথা গুনে দেখলাম ১১ জন মহিলা আর শতাধিক পুরুষ। দশটা থেকে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান, এখন সোয়া এগারোটা। উপস্থিত শ্রোতা এবং দর্শকদের মুখে চোখে ক্লান্তি বা বিরক্তির কোন চিহ্ন নেই।


প্রথমে মাল্যদান পর্ব। মহকুমা শাসকের জায়া হিসেবে গৌরবার্থে বহুবচন, আমাকেও মালা পরানোর অনুরোধ করা হল। দাড়ি বুড়োর গলায় মালা পরিয়ে, প্রণাম সেরে বসতেই শুরু হল অনুষ্ঠান। আমাদের জন্যই থমকে ছিল কিছু ক্ষণ।  মঞ্চের ডান দিকে একটি বিবর্ণ টেবিল এর উপর হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন এক প্রৌঢ়। তার পাশে ঢোলক বাজাচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ বন্দী, তার পাশে দাঁড়িয়ে করতাল বাজাচ্ছে একটি অল্প বয়সী ছেলে। ঘোষক ঘোষণা করতেই করতাল বাজানো ছেলেটি গান ধরল, " মন মোর মেঘেরও সঙ্গী"। সঙ্গে "নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাইরে" র যুগলবন্দী। কতই বা বয়স হবে ছেলেটির, খুব জোর ২৫-২৬।  শ্যামলা দোহারা চেহারা, ওষ্ঠের ওপর সরু গোঁফের রেখা, তেল দিয়ে, সাইডে সিঁথি কেটে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। পরণে সস্তার ফুল প্যান্ট এবং হলুদ মেরুন টি শার্ট। দেখে দেখেই পড়ল এবং গাইল ছেলেটা, উচ্চারণে সামান্য জেলার টান থাকলেও এত ভালো গাইল যে আমরা দুজনে অভিভূত হয়ে পড়লাম। গান শেষে শৌভিক শুধাল, " তুমি আগে থেকে গানটা জানতে? কবিতাটা আগে পড়েছ?" ছেলেটি ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, "কবিতাটা ছোট বেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম আজ্ঞে। গানটাও শুনেছিলাম মনে হয়। তবে গাইনি কখনও। এই অনুষ্ঠানের জন্য স্যারই শেখালেন।" 


দুজোড়া সার্চ লাইটের মত, শৌভিক আর আমার চোখ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল জেলার সাহেবের দিকে। শৌভিক মুগ্ধ হয়ে জানতে চাইল, " আপনি শিখিয়েছেন? আপনি গান বাজনা করেন?"  উনি লাজুক হেসে বললেন,"ঐ আর কি? কয়েকদিন রিহার্সাল দিইয়েছিলাম ওদের নিয়ে।"  শৌভিক আবার প্রশ্ন করল, " এখানে যারা আজ পারফর্ম করছেন, তারা কি সবাই আপনার জেলের আবাসিক বন্দী?" উনি ঘাড় নেড়ে বললেন, "আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। বাইরের বলতে কেবল আমাদের এক সহকর্মীর ভাইঝি। বাচ্ছা মেয়ে। সেজেগুজে এসেছে, নাচবে বলে।  বাকি সবাই এই জেলের বাসিন্দা।"


এবার গান ধরলেন বুড়ো ঢোলক বাজিয়ে। কাঁপা কাঁপা হালকা বিষাদ মাখানো সুরে, "এ মণিহার আমায়, নাহি সাজে-"। নুব্জ চেহারা, মাথা ভর্তি পাকা চুল, গালে বেশ কয়েকদিনের না কাটা খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি,পরণে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের  পুরু কাঁচের চশমা। চশমার পিছনে একজোড়া ঘোলাটে চোখ। ঈষৎ ধরা গলায়, সামান্য ঝুঁকে গেয়ে চলেছেন বৃদ্ধ, 

" ফুলমালার ডোরে বরিয়া লও মোরে--

তোমার কাছে দেখাই নে মুখ মণিমালার লাজে",   বৃদ্ধের গান শুনতে শুনতে কেন যে করকর করে ওঠে দুই চোখ। কে জানে কি অপরাধে এই বয়সে বিচারাধীন বন্দীর তকমা জুটেছে লোকটার।  


 ছোট মেয়েটি এসে নেচে গেল বার দুয়েক। অনুষ্ঠান শেষে সেলফি তোলার আব্দার জানিয়ে গেল। তারপর গান ধরল আরেকটি আবাসিক ছেলে। বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। পরণে সস্তার জিন্স আর গোলাপি রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট। হাতে গলায় নীলচে ট্যাটু। মাথায় পাঁশুটে রঙের খাড়া খাড়া চুল। হাঁটেও অল্প বয়সী মিঠুন চক্রবর্তীর মত করে। স্টিলের বালা পরা হাতে মাইক্রোফোন ধরে ছেলেটা গান ধরলো, " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,তবে একলা চল রে।" সুস্পষ্ট উচ্চারণ, অটুট সুর, তাল এবং লয়। আবার বিমোহিত হলাম দুজনে।


অনুষ্ঠান চলতে লাগল, জেলার সাহেব ফাঁকে ফাঁকে জানালেন, " এখানে যোগব্যায়ামও হয় জানেন তো ম্যাডাম। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটা থেকে। ওদের দিয়ে বাগান করাই, এই দেখুন ওদের জন্য লাইব্রেরী করেছি।" আমার পিছনে রাখা কয়েকটি আলমারিকে দেখিয়ে বললেন, "ওদের নিয়মিত বই পড়তে দিই। তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা লিখতে পড়তে পারেন না, তাদের আমরাই পড়ে শোনাই। আপনাদের একবার ডাকব, আমাদের গল্প বলার আসরে।"  করজোড়ে বললাম, প্লিজ ডাকবেন। অবশ্যই মনে করে ডাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার এই কর্মযজ্ঞের সামান্যতম অংশ হতে পারলেও আমি অন্তত নিজেকে ধন্য মনে করব। তুত্তুরীকেও সঙ্গে করে আনব। 


বেলা গড়ায়। শৌভিকের নিজের অফিসেও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন হবে। মহকুমা তথ্য এবং সংস্কৃতি আধিকারিক বারবার ফোন করছেন।  ওখানে আজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হবে স্থানীয় একটি সরকারি হোমের দশ থেকে বারো বছর বয়সী মেয়েদের নিয়ে। জীবনে প্রথমবার জনসমক্ষে রবি ঠাকুরকে আবৃত্তি করে শোনাবে মেয়ে গুলো। দর্শক হিসেবে আমাকেও নিয়ে যাবার বায়না করে রেখেছি আগে থেকেই। তবে সে তো অন্য গল্প। মোদ্দা কথা, অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ হলেও আমাদের এবার উঠতে হবে।


জেলার সাহেব বাইরে অব্দি আমাদের ছাড়তে এলেন। ভিতরে তখন গান ধরেছে জনৈক আবাসিক, " গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা-"। মানুষ সমান লম্বা জানালাগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে বেরোতে বেরোতে এক ঝলক ভিতর দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন, চোখ মুচছে কোন কোন বন্দী। লুঙ্গি পরা একটা লোক তো দুই আঙ্গুলে চোখ টিপে মাথা নীচু করে বসেই রইল। কি জানি, কার জন্য ছল ছলিয়ে উঠছে এই বিচারাধীন বন্দীদের চোখ। সে যেখানেই থাকুক, যেন খুব ভালো থাকে।


পুনশ্চঃ ছবির পুতুল গুলি কাঁথি উপ সংশোধনাগারের এক প্রাক্তণ আবাসিকের হাতে তৈরি। বর্তমানে শোভা পায় মহকুমা শাসকের টেবিলে


অনির ডাইরি ১২ই মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথি_থেকে_তমলুক


একটা লাল বাস আসে, বাতানুকূল বাস। বাসের গায়েও বড় বড় করে লেখা, "রেড বাস"। ভিতরে লোকনাথ বাবার ছবি টাঙানো। এমন তিতো, বিরক্ত মুখের লোকনাথ বাবা ইতিপূর্বে দেখিনি। তাঁর মুখের  সামনের রডে, একটা কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝোলানো থাকে, ব্যাগ ভর্তি একই রকম কালো প্লাস্টিক। পাশেই দরজার উপরে বড় বড় করে লেখা, "বমি করলে প্লাস্টিক ব্যবহার করুন"। হরদমই কেউ না কেউ যায় আর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মুখের সামনে থেকে প্লাস্টিক নিয়ে আসে, বৃদ্ধের বিরক্ত হবার যথেষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।


তবে, বাসটাতে বসে বড় আরাম। দুজনের সিটে আমার মত চেহারার দুজন আরাম করে ধরে যায়। কাউকে 'ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান' হয়ে সফর করতে হয় না। কন্ডাক্টার ড্রাইভার হেল্পারের ব্যবহারও খুব ভালো। মাত্র পঞ্চাশ টাকায়, এসির হাওয়া খেতে-খেতে, ঢুলতে-ঢুলতে, অফিস পৌঁছে যাই। যদি ঘুমিয়েও পড়ি, হেল্পার বা কন্ডাক্টর ঠিক ডেকে তুলে দেয়। তবে বাসটাকে পাওয়াই দুষ্কর। ব্যাটার কোন সময় জ্ঞান নেই, কোনদিন নটা ১৩য় ন্যাজ তুলে পালায়, তো কোনদিন নটা ২৪ এও তার দেখা মেলে না। কোন কোন দিন আবার থাকেও না অযথাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয়রান হই আমি।


গতকালই যেমন বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। নূপুর বাবু, মহকুমা শাসকের ড্রাইভার যিনি প্রত্যহ 'দাবাং' স্টাইলে আমাকে বাসে তুলে, একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেন, আশ্বাস দিলেন, "কুন ব্যাপার নয় ম্যাডাম, ঐ বাসটাই ধরিয়ে দেব আপনাকে।" অন্য দিন আমরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দীঘা বাইপাস থেকে বাসে উঠি, যাতে সিট পাওয়া যায়। বাসটা ওখান থেকে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড হয়ে রূপশ্রী বাইপাসে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নুপুর বাবু আজ না পিছিয়ে সোজা গাড়ি ঘোরালেন রূপশ্রী বাইপাসের দিকে।


রূপশ্রীতে দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে, তারা আমার লাল্টু বাসটা নয়। "হুঁ" বলে গাড়ি ঘুরে গেল সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। পথে যদি দেখা মেলে তার। দেখতে দেখতে, পৌঁছেও গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম লাল্টু বাসটার জন্য। বাস আসে, বাস যায়, আমার বাসটাই কেবল গরহাজির। একটা স্টেট বাস তাকাতে তাকাতে পাশ দিয়ে চলে গেল। নূপুর বাবু উঠতে দিলেন না, " দেখতেছেন ম্যাডাম কি ভিড়! এই গরমে নন এসি বাসে যাবেন কেমন করে? বসেন না আপনার লাল বাসটাই ধরাব আপনাকে।" 


 শেষমেষ অবশ্য জানা গেল যে আমার বাসটা আজ আদৌ যাবে না। তাড়াহুড়ো করে যে বাসটায় উঠলাম, সেটিও নন এসি। উঠে, বসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, মনে হল, নন এসি বাসই ভালো। বাসের নিজস্ব লড়ঝড়ে আওয়াজে আর অন্য কিছু শোনা যায় না। এসি বাসের ভিতরে বাইরের শব্দ ঢোকে না বটে, সে অভাব পূরণ করে দেয় সজোরে বাজা গুটিকয়েক মোবাইল। ঝাড়া দু ঘন্টা রিলস্ দেখতে দেখতে যায় লোকে। এতটুকুও ভাবে না, সহযাত্রীদের মাথায় কেমন দমাদম হাতুড়ি পিঠছেন ওনারা।


একেবারে অসহ্য না হওয়া অব্দি দাঁতে দাঁত চিপে সয়ে যাই। মনে মনে খিস্তি মেরে গুষ্টি উদ্ধার করে দিই। তারপর মুখ খুলতেই হয়। "একটু আসতে শুনুন না, প্লিজ-"। বললে কেউ কেউ, "হাঁহাঁ" বলে আওয়াজ কমিয়ে দেয়। কেউ আবার পাত্তাও দেয় না। দীঘা থেকে ছুটি কাটিয়ে কলকাতা ফেরা জনৈকা যাত্রী তো আমাকে গুচ্ছের জ্ঞানই দিয়ে দিলেন গতকাল, "বাবাঃ। এটা বাস দিদি, একটু এ্যাডজাস্ট করতে শিখুন।না পারলে গাড়িতে যান।" এমন ভয় পেয়ে গেলাম যে বাকি পথ মুখে কুলুপ এঁটে ওনার মোবাইলের আওয়াজ শুনতে শুনতে মাথা ধরিয়ে অফিস গেলাম। রাতে খেতে বসে শৌভিক শুনে বলল, " আরে এটা তো তোর ডায়লগ। ও বলল কেন? বলবি তো, আপনি গাড়িতে যান মোবাইল শুনতে শুনতে-"। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে আর কি।


আজ অবশ্য সে যন্ত্রণা নেই, ঐ হুব্বা পাবলিক গুলো নন এসি বাসে চড়ে না। বাইরে থেকে হু হু করে ছুটে আসছে বোশেখের তপ্ত বাতাস। ড্রাইভারের কেবিনের পিছনে, ছোট্ট স্ক্রিনে পরিমিত ভল্যুমে চলছে, বাংলা কোন সিনেমা। বছর চল্লিশের প্রসেনজিৎ ছলছল চোখে কার দিকে যেন তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় উদয় হয়ে বললেন,"-আমার বাবা। পাগল হয়ে গেছেন। তাই ওইসব কথা বলে বেড়ান।" নায়ক জানতে চান কিভাবে পাগল হলেন উনি, শুভাশিস বাবু গোল গোল জবাব দেন বটে, মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করেও আমার বুঝতে অসুবিধে হয় না, " তুঝে সব হ্যায় পতা" প্রসেনজিৎ।  

অজ্ঞ শুভাশিস বাবু, কলির মহানায়ক কে চিনতে পারেন না। তাই জানতে চান, তিনি কে এবং গ্রামে কেন এসেছেন। নায়ক নাম বলতে গিয়ে, ঢোঁক গিলে, চোখ ঘুরিয়ে বলেন, " সু -,  সুরেশ। আমার নাম সুরেশ।" শুভাশিস বাবু বিশ্বাস করলেও, আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। ওনার নাম আর যাই হোক না কেন, সুরেশ নয় বাপু। 


সুরেশ গ্রাম দেখতে এসেছেন এবং হোটেল খুঁজছেন শুনেই ধরণী দ্বিধা হয়। এক গলা জিভ কেটে, শুভাশিস বাবু এক অজ্ঞাত কুলশীল বছর চল্লিশের শহুরে ছোকরাকে( তখনও জানি না যে এই শহুরে ছোকরা সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন) বগলদাবা করে নিয়ে যান তাঁর গৃহে।  "আমার বাড়ি থাকতে হোটেলে থাকবেন কেন- হেঁঃ হেঁঃ।" 


বাড়িতে ওনার উন্মাদ পিতাকে দেখতে পাই না বরং দর্শন পাই এক অতীব রূপসী তন্বী ভগিনীর। নাম বোধহয় রীনা। অভিনেত্রী অপরিচিতা।  রীনা এখনও পুতুল খেলে, পুতুলের বিয়ে দেয়। ঠিক যেমন শৈশবের সাথীর সাথে খেলত। সেই সাথী নিরুদ্দেশ বহু বছর, কিন্তু "করণ-অর্জুন" সিনেমার রাখির মত রীনাও বিশ্বাস করে যে, সে ‘আয়েগা। জরুর আয়েগা। ’ ঢ্যাং করে ঘন্টা পড়ে। মঞ্চে ছলছল চোখে সুরেশের প্রবেশ দেখে আমি মাঝ পথেই বুঝে যাই, যে ইনিই তিনি। রীনা অব্যশই বোঝে না। বুঝে গেলেই তো গপ্প শেষ। 


দুজনের ন্যাকা প্রেম, খুনসুটি, চা বাগানে নাচানাচি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে ভাবছিলাম একটু ঘুমিয়ে নিই, ঠিক এই সময়, "কোন সাপের বাচ্ছা মহিম হালদারের ছেলের গায়ে হাত তুলেছে রে? যা গিয়ে সাপের বাচ্ছাটার ল্যাজ ধরে টেনে আন।"  বলে গর্জে ওঠে কে যেন। চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখি যে মঞ্চে মহিম হালদার রূপী দীপঙ্কর দে প্রবিষ্ট হয়ে খেলা জমিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গতে লাল পাড় সাদা শাড়ি, এলো চুল, ধ্যাবড়া সিঁদুরের টিপ পরা কটা চোখের অনামিকা সাহা। কতদিন বাদে দেখলাম ভদ্রমহিলাকে। সাধারণতঃ খলনায়িকার চরিত্রচিত্রন করতেন, এখানে যদিও মহিম হালদারের সাধ্বী স্ত্রী তথা বিবেকের ভূমিকায়। “ওগো এমন করো না গো। গরীব মানুষের চোখের জল সইবে না-“ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার মতই দীপঙ্কর দেও শেষে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করো না তো। যাও ছেলের জন্য এক গ্লাস মাল নিয়ে এসো। বেশ কড়া করে।” বাসের পিছনের সিট থেকে পটাপট কয়েকটা তালি পড়ে গেল। 


বাস গড়ায়, নাটক জমে। আরো একজন নায়িকার উদ্রেক হয়। মহিম হালদারের কন্যা তথা সুরেশের কলেজের প্রেমিকা। দুই নায়িকা মিলে সুরেশকে নিয়ে ব্যাপক দড়ি টানাটানি করে। মাঝখান থেকে জানা যায় সুরেশের আসল নাম সূর্য। মহিম হালদার সূর্যর বাপের হত্যাকারী। তাই প্রতিশোধ নিতে গাঁয়ে ফিরেছে সূর্য। একা ফেরেনি সঙ্গে রঞ্জিত মল্লিক সহ আরো চার বৃদ্ধকেও নিয়ে ফিরেছে। যাদের একজন দেবেশ রায়চৌধুরী, আরেকজন রাজেশ শর্মা। মাথায় গোঁফে ট্যালকম পাউডার ঢেলে পাকা চুলদাড়ি বানালেও, যাদের বৃদ্ধ বলে হজম হয় না। তো এই তরুণ বুড়োর দল আর্মির পোশাক আর টুপি পরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় আর ডিস্যুম ডিস্যুম করে। জানা যায় এরা আসলে সূর্যর স্বর্গীয় পিতৃদেবের দাস (পড়ুন গৃহপরিচারক) ছিলেন। শৈশবে সবাই মিলে স্টিলের দুধের গ্লাস নিয়ে শিশু প্রসেনজিৎকে তাড়া করতেন। দুষ্টু মহিম হালদার নিজে খুন করে সবকটাকে জেলে পাঠান। 


এরপর আরো অনেক কিছু হয়, প্রেম, কান্না, ত্যাগ, আত্মবলিদান, চোখের জল এমনকি মার্ডারও। মহিম হালদার আর তার কুপুত্রকে কোতল করে, এক ডজন চেলাচামুণ্ডাকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে, মহিম হালদারের স্যাঙাত থানার ওসিকে বেল্ট পেটা করে মাথা ফাটিয়ে মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়ের ভূয়সী প্রশংসা পায় প্রসেনজিৎ। ঠিকই তো, দুষ্টের দমন তো করারই কথা। যার ল্যাজে আগুন লাগবে সেই তো লঙ্কা পোড়াবে। ওসব আইন- আদালত- পুলিশ থাকার দরকারটাই বা কি। এই তো জীবন কালি দা। 


দিব্যি খোশ মেজাজে নিমতৌড়ি স্টপে নামলাম। আহা এমন সিনেমা কতদিন দেখিনি গো। আফসোস কেবল একটাই, রঞ্জিত মল্লিক একবারও বেল্টটা খুললেন না, এই যা। ঠিক করলাম আজ আমার সাথে যারই দেখা হবে তাকেই এই গপ্পটা শোনাব। কারা যেন ডেপুটেশন দিতে আসবে বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছে, আসুক ব্যাটারা। আগে আমার গল্প শুনতে হবে, তবে অন্য কথা। 


আর রাত টা নামতে দিন, কি যেন বলছিল শৌভিক, বিলি ওয়াইল্ডারের ডবল ইনডেমনিটি দেখাবে? যা কিনা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সিনেমা গুলির মধ্যে অন্যতম? সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়তম সিনেমা? যেটা দেখে বিমোহিত হয়ে উনি বিলি ওয়াইল্ডারকে ১১ পাতার এক খানা চিঠি লেখেন, ওনার জীবিত অবস্থায় যার কোন প্রত্যুত্তর আসেনি। অস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রচারিত ওনার ভাষণে উনি সেই কথা জানাতে, বিলি ওয়াইল্ডার সাহেব চিঠি লিখতে বসেন বটে,তবে সে চিঠি পাবার আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন সত্যজিৎ। অবশ্যই দেখব, তবে তার আগে আমার গপ্পটা শুনতে হবে।

অনির ডাইরি ২১শে মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথি_থেকে_তমলুক 


আজ বেরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বেশি না, মিনিট কতক। তবে প্রিয় লাল বাসটা যে এতক্ষণে ভাগলবা হয়ে গেছে তা বুঝতে নূপুর বাবু বা আমার কোন সমস্যা নেই। আরেকবার পরিচয় করিয়ে দিই, নূপুর বাবু হলেন মহকুমা শাসকের সরকারি বাহন চালক। এই নিয়ে নয় জন মহকুমা শাসককে সওয়ারি করাচ্ছেন ভদ্রলোক। আমার এই বাসে করে অফিস যাওয়াটা কিছুতেই গলদ্ধকরণ করতে পারেন না ভদ্রলোক। প্রায়ই বলেন, " চলেন তো ম্যাডাম, আপনাকে অফিসে ছেড়ে দিয়ে আসি। স্যার তৈরি হতে হতে চলে আসবনি-"।  সেটা হতেই পারে, কারণ আমি যখন নাকে মুখে গুঁজে বাস ধরতে দৌড়াই, তখনও স্নান করতেই ঢোকে না শৌভিক। বাস্তবে যদিও ব্যাপারটা ওই জল্পনা কল্পনার স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সত্যি সত্যি রূপশ্রী বাইপাসের লক্ষণ রেখা অতিক্রম করার দুঃসাহস নূপুর বাবু বা আমার হয় না। 


 প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি, একটাও বাসের দেখা নেই। প্রতি দেড় মিনিট অন্তর নূপুর বাবু এসে জিজ্ঞাসা করছেন, "ম্যাডাম এসি চালিয়ে দেব?"  অথবা, " চলুন ম্যাডাম বেরিয়ে পড়ি। উত্তমকে একটু এগিয়ে আসতে বলে দিন। মাঝপথে নেমে পড়বেন।" প্রস্তাব খানা লোভনীয় হলেও উত্তমের দৈনন্দিন রুটিন আমার অজ্ঞাত নয়। ঘড়ি বলছে, উত্তম এখন সাইকেলে চাপিয়ে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর ফিরে পুকুরে ডুব গেলে, চাট্টি ভাত খেয়ে ডিউটি করতে বেরোবে। আমার ফোন পেলে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে পড়বে হয়তো, তবে ভাত আর জুটবে না ছেলেটার। এক প্যাকেট বিস্কুট চিবোতে চিবোতে চলে আসবে। আগে বলে রাখলে হত হয়তো, এই মুহূর্তে ও পথে না এগোনই ভালো।


তীর্থের কাকের মত রাজপথের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম। আচমকা নূপুর বাবু ইশারায় ডাকলেন। বাসের টিকিও দেখা যাচ্ছে না, তাহলে খামোখা নামব কেন? ভাবতে ভাবতে ঝোলাঝুলি সমেত নেমেই পড়লাম। উল্টো দিক থেকে একটা মেরুন রং এর অলটো গাড়ি এসে থেমেছে, তারই ড্রাইভারের পাশের দরজাটা খুলে ধরে আমায় ডাকছিলেন নূপুর বাবু। শাটল ট্যাক্সিতে আগেও চড়েছি, মনটা খুশি হয়ে গেল। এই পথে শাটল পাওয়া মানে নিরুপদ্রবে অল্প সময়ে অফিস পৌঁছে যাওয়া।


তবে এটা সত্যিই শাটল, নাকি নূপুর বাবু ম্যাডামের সুবিধার্থে কারো গাড়িতে জোর করে তুলে দিলে, জানতে গাড়ির চাকা গড়াতেই প্রশ্ন করলাম, "আরো যাত্রী নেবেন তো?" ড্রাইভারের বয়স পঞ্চাশের খারাপ দিকে। দোহারা চেহারা, পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া গাত্র বর্ণ, মাথা জোড়া চকচকে টাক। ঝোড়া গোঁপ, সম্ভবত কলপ করা, কারণ গালে সদ্য জন্ম নেওয়া দাড়ি গুলি সবই সাদা। পরণে বেগনি রঙের ঢোলা প্যান্ট আর কনুই অবধি গোটানো পার্পল রঙের ফুলহাতা শার্ট। ভদ্রলোক মিনমিন করে বললেন," বেশি লোক নেব না। যদি কেউ ওঠে তো ভালো না হলে এমনিই বেরিয়ে যাব।"

খড়গপুর বাইপাস, রুপশ্রী মোড়ে বার কয়েক হর্ন বাজালেন ভদ্রলোক, সামান্য ধীমে হল গতি কিন্তু কেউ হাত দেখাল না। গাড়ি আবার ছুটল। নাচিন্দা ছাড়াতে না ছাড়াতেই নামলো বৃষ্টি। মিহি জলকণায় ঢেকে গেল গাড়ির কাঁচ। দু-চারটে  দুষ্টু জলকণা ভিতরে এসে ভিজিয়ে দিল আমাকেও। ওয়াইপার চালাতে চালাতে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, "জানলা তুলে, এসি চালিয়ে দিব ম্যাডাম?" সজোরে মাথা নেড়ে না বললাম। ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন, "অফিস যাচ্ছেন তো? নিমতৌড়ি নামবেন মানে নিশ্চয়ই সরকারি দপ্তর। আমিও সরকারি অফিসেই গাড়ি চালাই। এই গাড়িটায় কে চড়ে জানেন?" নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম। শুনলাম জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের কোন বড় পদাধিকারী চড়েন। মূলতঃ পশ্চিম মেদিনীপুরেই চলে গাড়িটা। আধিকারিক ছুটিতে থাকলে টুকটাক ভাড়া খাটে গাড়িটা। তেমনি ভাড়ায়  কাউকে দীঘা ছাড়তে এসেছিলেন ভদ্রলোক।


ভালো শ্রোতা হিসেবে বোধহয় নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলাম, ভদ্রলোক জানালেন অনেকদিন ধরে গাড়ির লাইনে আছেন। বর্তমানে ওনার ছটা না নটা যেন গাড়ি, দুই ছেলে তারাও গাড়ি চালায়। সবকটা গাড়িরই কম বেশি বাঁধা খদ্দের আছে। 

বৃষ্টি থেমে গেল অচীরেই। কালিনগরের খাল পেরোলেই দুদিকে চোখ জুড়ানো সবুজ ধান ক্ষেত। মাঠ থেকে উঠে আসা ভিজে হাওয়ায় ঘুমে ঝুলে আসছে চোখ, তাও সজাগ হয়ে বসে আছি, যেহেতু গাড়িতে অন্য কোন সহযাত্রী নেই। ভদ্রলোকের এর মধ্যে বেশ কয়েকটা ফোন এল। কেউ বোধহয় ক্ষীরপাইয়ের ওদিকে ডাক্তার দেখাতে যাবেন, তাঁর এই গাড়িটাই চাই। ড্রাইভার ভদ্রলোক জানালেন ওনার মেছেদা বা কোলাঘাট ঢুকতে অন্তত আরো ঘন্টা দুয়েক লাগবে। ততক্ষণ সওয়ারি কেন অপেক্ষা করবেন খামোখা, বরং অন্য বিশ্বস্ত কোন গাড়ি খুঁজে দিচ্ছেন উনি তার গাড়িতেই যান। তবে ভাড়া বেশি লাগবে। যেহেতু যাওয়া আসা দুটোই। ওদিকের ভদ্রলোক বোধহয় নিমরাজি হলেন।


এবার শুরু হল মেচেদা বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন ড্রাইভারকে ফোন করা। "এই ইয়াসিন, এই রবিউল, এই শাকিব ভাড়া যাবি?" যা বুঝলাম, কেউই যেতে রাজি হল না। ভদ্রলোক নশো টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে বারোশো টাকা অবধি ভাড়া বাড়ালেন, তাও কোন লাভ হল না। ইতিমধ্যে অপেক্ষমান সওয়ারি বেশ কয়েকবার ফোন করে তাগাদা দিয়ে ফেললেন।


যদিও পাকা ড্রাইভার, রাস্তাও ফাঁকা, তবুও এইভাবে এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে, এত হিসেব-নিকেশ ঠিক সহ্য হচ্ছিল না আমার। শেষে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, "আপনি বরং গাড়িটা দাঁড় করিয়ে কথা বলে নিন।" ভদ্রলোক জিভ কেটে বললেন, " না,না ম্যাডাম। আপনার অফিসে পৌঁছাইতে দেরি হয়ে যাবে। চিন্তা করবেননি, আমি সেই ১৯৮৩ সাল থেকে গাড়ি চালাচ্ছি। তখন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। উনি একবার কোলাঘাটে এসেওছিলেন সেই সময়। আমি তখন কত আর, খুব জোর বছর ১৫। পুলিশের পাইলট ভ্যান চালাই। তখন সব গাড়ি পেট্রোলে চলত। পেট্রোলের দর কত ছিল বলুন তো?"


নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম আবার। ১৯৮৩ সালে পেট্রোল কাকে বলে, তাই জানতাম না আমি। উনি হেসে বললেন, " তিন টাকা/লিটার। ভাবতে পারেন?"  তিন টাকা লিটার পেট্রোল যদিও বা ভাবতে পারি, মাত্র ১৫ বছর বয়সে পুলিশের পাইলট ভ্যান চালানো সত্যি কল্পনা করতে ব্যর্থ হলাম। সে কথা বলাতে উনি হাসলেন।" ল্যাখাপড়া তো তেমন শিখিনি ম্যাডাম। ১২ বছর হতেই আব্বা নিয়ে গিয়ে মেছেদা বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে এল। বলল, ' গাড়ি ধুবি।আর সুযোগ পেলেই চালাবি।' তাই করতাম। মাঝে মাঝে এক আধবার স্টিয়ারিং ধরতে পেতাম। সবই উপরওয়ালার মর্জি বুঝলেন তো। এই করতে করতেই প্রথমে ট্যাক্সি, তারপর ওই পাইলট ভ্যান চালানো।'


"তবে ম্যাডাম এখনকার ছেলেদের মত, কুঁড়ে ছিলুম নি। দেখতেছেন তো, ফোন করে করে কত সাধছি, একটা বুড়ো লোককে একটু ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে যাওয়ার জন্য। একটাকেও রাজি করাতে পারলুম কেমন? কত টাকার তেল পুড়বে? খুব জোর ৪০০ টাকা। ৯০০ টাকা ভাড়া নিলেও ৫০০ টাকা লাভ। তাও যাতেচ্ছে না হতভাগারা। বাসস্ট্যান্ডে বসে আছে, তাও যাতেচ্ছে না। এই ভাবে ব্যবসা হয়? 


জীবনে একটা পয়সা বাজে খরচ করিনি ম্যাডাম।যা পেতাম, সামান্য খরচ করে,বাকিটা জমাতাম। এই পয়সা জমিয়ে জমিয়ে,১৯৮৯ সালে একটা এম্বাস্যাডার গাড়ি কিনে ফেললাম। ঝকঝকে নতুন সাদা এম্বাস্যাডার। দাম পড়েছিল ৫০০০ টাকা। কি গাড়ি ম্যাডাম। জম্পেশ গাড়ি। এই সেদিন পর্যন্ত ভাড়া খেটেছে গাড়িটা। তো যাই হোক গাড়িটা কিনে পুলিশ লাইনেই দিয়ে দিলাম। অমুক সাহেব চড়তেন। এর মধ্যে হল কি, পেট্রোলের দাম খুব বেড়ে গেল। প্রায় ন টাকা/লিটার। ডিজেল তখন সাড়ে তিন টাকা/লিটার। বুদ্ধি খাটিয়ে করলাম কি, নতুন গাড়ির ইঞ্জিনটা দিলাম বদলে, পেট্রোল থেকে ডিজেল।"


তাজ্জব হয়ে বললাম, তা আবার হয় নাকি? উনি জোর গলায় বললেন," আলবাৎ হয়। আমিই করিছি। সরকারি গাড়ি তখন সব পেট্রোলে চলত, ফলে পুলিশ থেকে আমায় যে পেট্রোল দিত ওটা আমি জ্যারিকেনে করে নিয়ে গিয়ে বেচে দিতাম। আর গাড়িতে ডিজেল ভরে নিতাম। এছাড়া কিছু কেরোসিন পেতাম সেটাও বাজারে বেচে দিতাম। পুলিশের অমুক সাহেব আমাকে এত ভালবাসতেন, যে উনি রিটায়ার হবার আগে কনস্টেবল হিসেবে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ফোর্সে। হিসেব করে দেখলাম, কনস্টেবল হলে তো আর তেল চুরি করতে পারবুনি। মাইনা যা পাব, তাতে চলবে নি। তাই হাত জোড় করে বললাম,' স্যার আমায় মাফ করে দেন।' না হলে আজ ওই চাকরিটাই করতে হতো। তাহলে কি আর নিজের ব্যবসাটাকে দাঁড় করাতে পারতাম?"


এক হতভাগ্য সরকারি নৌকর হিসেবে নীরব থাকাই সমীচীন বলে বোধ হল। ভদ্রলোক আবার ফোন করতে লাগলেন। শেষমেষ বৃদ্ধকে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে রাজি হয়ে গেল জনৈক গাড়িওয়ালা, কিন্তু বেঁকে বসলেন বৃদ্ধ সওয়ারি খোদ। উনি এই ড্রাইভারের সাথেই যাবেন। চণ্ডীপুর ছাড়িয়েছি আমরা, কোলাঘাট ঢুকতে আরো এক ঘন্টা অন্তত লাগবে। সে কথা বললেন ও ড্রাইভার দাদা, কিন্তু ওপারের বৃদ্ধ নাছোড়বান্দা। উনি প্রয়োজনের দেড় ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। 


 ফোন রেখে এক গাল হেসে ড্রাইভার দাদা কইলেন," দেখছেন তো ম্যাডাম। একবার আমার গাড়িতে চাপলে, লোকে আর অন্য কোন গাড়িতে চাপতে চায় না। সবই উপরওয়ালার দয়া। মানুষ আমাকে এত ভালোবাসে কি বলব! ব্যবসাটা আমি খুব ঈমানদার হয়ে করি ম্যাডাম। উল্টোপাল্টা ভাড়া চাই না। মানুষ বিপদে পড়লে অনেক সময় বিনা ভাড়াতেও গাড়ি করে নিয়ে যাই। এই তো সেদিন, তখন রাত ন'টা। ডিউটি করে বাড়ি ফেরার পথে মেছেদা স্টেশনে বসেছিলাম, এক ভাঁড় চা খাব বলে। দেখি একটা ছেলে, কি সুন্দর দেখতে। আপনাদেরই কাস্টের হবে। বছর ২৪ বয়স। উদভ্রান্তের মতন ঘুরছে, একবার এদিক, একবার ওদিক। রাতের মেছেদা বাস স্ট্যান্ড খুব ভালো জায়গা তো নয়। বেশ কিছুক্ষন লক্ষ্য করার পর ছেলেটাকে ডাকলাম, একভাঁড় চা হাতে ধরিয়ে বললাম, " বাবা। সত্যি কথা বলত, বাড়ি থেকে পালিয়েছিস তাই না?" ছেলেটা ভেঙে পড়ে বলল হ্যাঁ। বলল, বাগনানে বাড়ি। বেশ সম্পন্ন পরিবার, কাকার পেট্রোল পাম্প আছে, হাই রোডের ওপরে। বাড়ির একটাই ছেলে। মাস তিনেক হল বিয়ে হয়েছে। বউটা আন্দুলের মেয়ে। কলেজে পড়ে। প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়ি থেকেই কলেজ করত, তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে দেখে, এখন থেকে বাপের বাড়ি থাকবে বলে মনস্থ করেছে, পরীক্ষা না হওয়া অবধি। এই নিয়েই দুজনের ঝগড়া। বাবু বউয়ের ওপর রাগ করে, কাউকে কিছু না জানিয়ে, মানিব্যাগ,মোবাইল না নিয়েই পালিয়ে এয়েছেন।"


"অনেকক্ষণ ধরে বোঝালাম। আরো কয়েক কাপ চা-কেক- মিষ্টি খাইয়ে মাথাটা ঠান্ডা করে বললাম, 'তোর বাড়ির ফোন নম্বরটা দিবি বাপ? আর কিছু নয়, আমি কেবল একটা ফোন করে জানাব যে তুই নিরাপদে আছিস। একবার ভাব, মা কতখানি চিন্তা করছেন। বউটাও নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করছে।' কি ভাবল কে জানে, বাড়ির নম্বর দিল না বটে, কাকার ফোন নম্বরটা দিল। আমি ফোন করতে দেখি, ওদিকে হুলস্থূল কাণ্ড। সবাই মিলে ছেলেটিকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আমায় জিজ্ঞাসা করল, ' আপনি কোথায় আছেন বলুন, আমরা এক্ষুনি আসছি।' ছেলেটার যা মানসিক অবস্থা, এসব শুনে যদি আবার পালিয়ে যায়? তখন তো আমি বিপদে পড়ব। তাই বললাম, 'না। আপনারা থাকুন। আমি আসছি।একটু সময় দেন। আগে ওর মাথাটা একটু ঠিক হোক। উঠতি বয়সের ছেলে, আপনাদের দেখলে যদি আবার পালিয়ে টালিয়ে যায়। ভরসা রাখুন, আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করে নিয়ে যাব।' 


ছেলেটাকে নিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে বারোটা। ওর বাবা-মা তো আমাকে জড়িয়ে সে কি কান্না। জানেন, ওরা ২৫০০০ টাকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল, আমায় পুরস্কার দেবে বলে। আমি বললাম, আমি পুরস্কারের লোভে আপনাদের ছেলেকে ফেরত আনিনি। আমি এনেছি, কারণ মানুষ হিসেবে মনে হয়েছে সেটাই আমার কর্তব্য। আমাকে কেবলমাত্র তেলের দামটা দিন। কারণ ফিরে যেতে হবে তো।' বিশ্বাস করবেন নি, ম্যাডাম ওরা আজও যোগাযোগ রাখে। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলেই ছেলেটা আমায় ফোন করে।" 


দেখতে দেখতে আমার অফিস এসে গেল। ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ভদ্রলোক যদিও জোরাজুরি করছিলেন, অফিস অবধি ছেড়ে আসার জন্য। জানালাম তার দরকার নেই। রাস্তার ওপারে অপেক্ষা করছে উত্তম কুমার। গাড়ি থেকে নেমে নিজেই দরজা খুলে দিলেন ভদ্রলোক, হাত দেখিয়ে রাস্তা পার করে দিলেন আমাকে। কি বলব বুঝতে পারলাম না, একই মানুষের মধ্যে যে কত বৈচিত্র থাকে। ভাগ্যে এই চাকরিটা পেয়েছিলাম না হলে কত অভিজ্ঞতা থেকে যে বঞ্চিত হতাম।

অনির ডাইরি ১ লা জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


রাত দেড়টা বাজছে। পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে শৌভিক। কেবল আমিই তন্দ্রাহারা। মন আর মাথা জুড়ে গিজগিজ করছে কত যে স্মৃতি। বন্ধ চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে কাকু-কাকিমা- দাদা-বৌদি আর ওদের বাচ্ছাটার মুখ। 


কাকু বাবার সহপাঠী ছিলেন এককালে। বিদ্যালয় জীবনে যদিও তেমন বন্ধুত্ব ছিল না দুজনের। স্কুল ছাড়ার পর দূরত্ব আরো বাড়ে। আগুনে সত্তরে বাবা যখন নকশাল নেতা, আর পাঁচজন সুবোধ বালকের মত কাকুও নাকি এড়িয়ে চলতেন বাবাকে। ভাগ্য বৈগুণ্যে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়ে গেলেও, না দেখার ভান করে পাশের গলিতে নাকি ঢুকে যেতেন কাকু। 


একগাদা রক্ত ঝরিয়ে বিদায় নিল সত্তর। ব্যর্থ বিপ্লব আর দিন বদলের অলীক স্বপ্ন ছেড়ে রুক্ষ বাস্তরের মাটিতে আছড়ে পড়ল বাবা। বাধ্য হল ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠতে। কাকু তো জন্ম সংসারী। এরই মধ্যে টাকা জমিয়ে একফালি জমিও কিনে ফেলেছেন। ব্যারাকের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে আসা কেবল কয়েকটা দিনের গল্প। মুস্কিল হল সব গল্প গুলি যদি এমনিই সরলরেখা বরাবর চলত। ভিত তৈরি করতে গিয়েই হোঁচট খেলেন কাকু। সৌজন্য পাড়ার দাদারা এবং তাদের কেলাব। ক্রীত জমির গরিষ্ঠাংশ দাবী করে বসলেন তারা। বড় কেলাব বিল্ডিং বানাবেন।  নিজের রক্ত জল করা পয়সায় কেনা জমি, কোন মধ্যবিত্ত বাঙালি ছাড়তে পারে। এই নিয়েই দ্বৈরথ। খিস্তিখেউড়। 


সেটা ছিল রবিবার। হঠাৎ আমাদের বুড়ো সদর দরজায় এসে উদয় হলেন কাকু। পিছু হঠতে হঠতে হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, পাশের গলিতেই তো থাকে তাঁর ছোট বেলার বন্ধু। বিরাট নকশাল নেতা অলোক। থলে নিয়ে সাপ্তাহিক  রেশন তুলতে যাওয়া আমার বাবার গায়ে ততোদিনে নকশালত্বের কোন গন্ধই আর অবশিষ্ট নেই। তবুও বলে না, মরা হাতি লাখ টাকা। বাবার বেশ কিছু ভক্ত অনুরক্ত তখনও হাওড়া এবং শহরতলী কাঁপায়। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কাকুকে বগলদাবা করে বাবা গিয়ে হাজির হল কেলাবে। 


এতক্ষণের খিস্তিখেউড় পলকে মোলায়েম অনুরোধে বদলে যায়। “মাইরি বলছি হিটলারদা। জানতুম না, উনি আপনার ন্যাংটো বেলার বন্ধু। সরি দাদা। মাপ করে দেন দাদা। এতদিন ঐ জমিতেই আমরা বসতুম,  আড্ডা মারতুম। ওখেনেই আমদের কালী পুজো হয়। যদি মায়ের নামে কিছুটা জায়গা দেন। কেলাব বানাব না, শুধু মায়ের আরাধনা করব, একটা পাকা মঞ্চ বানিয়ে। এইটুক কথা শুনুন লক্ষ্মী দাদা আমার। ”


বিপদ কালে বুদ্ধিমানরা অর্ধেক পরিত্যাগ করে। কাকু সেখানে কয়েক ছটাক জমি পরিত্যাগ করলেন বটে, তবে বাবার সাথে সম্পর্কটা বাঁধিয়ে নিলেন সোনা দিয়ে। এরপর থেকে গোটা আশি- নব্বইয়ের দশকে এমন একটা দিন, একটা সন্ধ্যে যায়নি যেদিন কাকু এসে বাবার খবর নিয়ে যায়নি। দেখা গেল কাকিমার সাথে মায়ের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। মা যখন শিবপুর পোস্ট অফিসে ডিউটি করতে যেত, ঠিক তখনি, ঐ একই বাসে করে কাকিমাও যেতেন প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে। 


কাকু-কাকিমার সাথে পারিবারিক  সম্পর্ক গড়ে উঠলেও দাদার সাথে কোনদিনই বন্ধুত্ব হয়নি আমার। একে তো বয়সে অনেক বড়, তারপর কেমন যেন ছিল। গম্ভীর, ভোম্বল প্রকৃতির। ঢলঢলে হাফ প্যান্ট পরে, বগলে ট্যালকম পাউডার ঢেলে ইয়া বড় ভুঁড়ি বার করে ঘুরত। বিকম পাশ করার পর কাকুর পরিচিত একটি কারখানায় আ্যাকাউন্টসের কাজ করত দাদা। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ছেলের বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন কাকু। কারণ ওণার মা যাতে নাতবৌয়ের মুখ দেখে যেতে পারেন। ১৯৯৯ এর মার্চ বা এপ্রিলে সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক হল দাদার। পাত্রী আমাদের পিছনের পাড়াতেই থাকে। পাত্রীর বাবা আবার ছোটকাকুর বন্ধু। 


বিয়েতে আমি যেতে পারিনি। বউভাতেও নয়। পরীক্ষা চলছিল। বাবা মা যদিও ঘরের লোকর মতই সবেতে হাজিরা দিয়েছিল। বউভাতের পরের দিন সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসেছি, হঠাৎ দেখি নবোঢ়া পুত্রবধূকে বগলদাবা করে কাকু হাজির। “এই যে ঝুনু,তুমি বিয়েতে যেতে পারোনি বলে বউদি নিজেই এসেছে তোমার সাথে আলাপ করতে।” বেশ লম্বা, ফর্সা, একটু ভারীর দিকে চেহারা বৌদির। ঘোর কৃষ্ণ দুই ভ্রুর নীচে এক জোড়া ফুরফুরে অতিকায় চোখ, একটা মস্ত থ্যাবড়া নাক আর একটু পুরু হাসিহাসি দুই ঠোঁট। প্রথম আলাপেই আপন হয়ে গিয়েছিল বউদি। জানলাম বৌদিও তারা সুন্দরীর ছাত্রী। যদিও আমাদের থেকে বছর চারেক সিনিয়র। সম্পর্ক বিহীন এক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম আমরা চারজন। বাবা-মা- আমি আর বৌদি। 


প্রথম প্রথম কাকুর অনুগামী হয়ে আসলেও ধীরে ধীরে বউদি একাই চলে আসতে শুরু করল। বাপের বাড়ি যাচ্ছি, বলে সোজা আমাদের বাড়ি। মা প্রায়ই বলত,‘মিথ্যে কথা বলে কেন আসিস বাপু। মাঝেমধ্যে বাপের বাড়িও যা।’ বললেই হেসে গড়িয়ে পড়ত বৌদি। ‘ওবাড়িতে আমায় কেউ ভালোবাসে না কাকিমা। কিছু বললেই মা বলে,‘ বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এবার তোমারটা তুমি বুঝে নাও।’ 


দাদা অবশ্য জানত। অফিস ফেরৎ বউকে নিতে আসত। এমনি একদিন হঠাৎ চলে এসে হাপুস নয়নে কাঁদছিল বউদি। বাবা, মা, আমি তো হতভম্ব। দীর্ঘক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মা। অনেক আদর করল মা। আদা দিয়ে ঘন দুধের চা করে আনল মা। তারপর মুখ খুলল বউদি,‘জানেন সরমা কাকিমা, বিয়ের আগে আমি বাবাকে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, আমাকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিও, যে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা বেতন পায়।  আমাকে বলা হয়েছিল ও নাকি তাই পায়। আজ রামরাজাতলা গিয়েছিলাম আমরা, ফেরার পথে স্টেশনে বসে জিজ্ঞাসা করলাম তো বলল, ওর বেতন মাত্র দুই হাজার টাকা। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ”


একজন পুরুষকে শুধু মাত্র তার উপার্জন দিয়ে বিচার করা হয় না আমাদের বাড়িতে। তাহলে তো একজন কেন্দ্র সরকারী কর্মচারী হিসেবে জেলখাটা লোককে বিয়ে করারই কথা নয় আমার মায়ের। সেটাই বোঝাল বাবা আর মা। আজকের বাজারদরে সংসার চালানোর দায় পুরুষের একা নয়। তুমিও কিছু কর। দুজনে মিলে রোজগার করে নাও দশ হাজার। দাদা ও ছুটে এসেছিল বউয়ের পিছু পিছু, মাথা নত করে তিনিও শুনলেন। 


সেরাতে দুজন চুপচাপ বাড়ি ফিরে গেলেও, অল্প দিনের মধ্যেই আবার এসে হাজির হল বৌদি। বাইরে সেদিন অঝোর ধারাপাত। একই ধারাপাত বৌদির দু নয়নে। হাতে একটা গাঁটরিতে কয়েকটা শাড়ি। দুর্মুখ শাশুড়ি পাঠিয়েছে। “জানো অনিন্দিতা বিয়ের আগে আমি একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতাম। বেশি না পাঁচশ টাকা বেতন দিত। তাও তো আমার নিজের উপার্জন। তোমার ঐ কাকিমা আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল। চাকরি করলে নাকি ভালো করে সংসার করা যায় না। আমি সংসার সামলাব আর উনি পড়াতে যাবন। সেই মহিলা আজকাল কথায় কথায় খোঁটা দেয়। বলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুটো শাড়ি বিক্রি করলেও তো পারো।’ 


সেদিন দাদাকে খুব বকেছিল বাবা।" ও শাড়ি বিক্রি করতেই পারে,যদি ও চায়।" নাঃ শাড়ির ব্যবসাটা চলেনি বৌদির। একটাও বোধহয় বিক্রি করতে পারেনি। চায়ওনি। এর কিছুদিন পর বাটিকের কাজ শেখার ক্লাশে ভর্তি করে দেয় কাকু। বেশ ভালোই শেখে কাজটা। মাকে একটা বাটিকের ব্যাগ, বাবাকে বাটিকের শার্ট পিস, আমার জন্য রুমাল বানায় বৌদি। ‘হ্যাঁরে তোর মাকে দিয়েছিস? শাশুড়িকে দিয়েছিস?’ প্রশ্ন করে মা। মুখ বেঁকায় বৌদি। ‘কেন দেব কাকিমা? যাদের ভালোবাসি তাদের দেব। ’ 


“ জানেন কাকিমা কি দেখলাম আজ রাস্তায়? আমার বোন একটা ছেলের সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। পিছন পিছন আসছে আমার মা। ভাবতে পারেন? আমি কোন ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকালেও গায়ে হাত তুলত মা। যাতা বলে অপমান করত বাবা। আর বোনের বেলায় সব বজ্র আঁটুনি খুলে গেল?” বোনকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসলেও, খুব কড়া অনুশাসনে বড় হওয়া বউদি কিছুতেই মানতে পারত না, তার ঘোরতর রক্ষণশীল পিতামাতার এই দ্বিচারিতা। 


বাটিকের নেশাও একদিন ফিকে হয়ে গেল। বউদি পাগল হয়ে উঠল সন্তানের মুখ দেখার ইচ্ছেয়। কিছু শারিরীক জটিলতা ছিল, সেসব কাটিয়ে কোন এক বছর জুলাই মাসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করল বৌদি। ছেলেই চেয়েছিলও। বলত, ‘আমার শাশুড়িকে তো জানোই।  মেয়ে হলে কত যে কথা শুনতে হবে। এমনিই উঠতে বসতে বলে, ‘দেখো যেন মেয়ে না হয়।’ কাকিমার আশঙ্কা দূর করে দক্ষিণ কলকাতার এক বড় নার্সিং হোমে জন্মাল বাবু। নাতির জন্মের যাবতীয় খরচ বহন করল বৌদির বাবা। ততোদিনে কাকুর মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছে অ্যালঝাইমার্স আর পার্কিনসন ব্যধি। মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলছেন কাকু। ঐ অবস্থায়ও ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হল ছেলেটার। ব্যয়ভার বহন করলেন কাকু। 


অনেক সাধনার ফসল বাবু, দেখতে যেন মাখনের তাল। প্রায় দিনই ছেলে কোলে আমাদের বাড়ি পালিয়ে আসে বৌদি। মুণ্ডপাত করে কাকিমার। হাহুতাশ করে উঠতি বাজারদরের। চাকরির পরীক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছি আমি।  স্কুলসার্ভিসের ক্লাশও তার মধ্যে ধরা। যদিও শিক্ষিকা হওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। তবুও বৌদির জন্য ক্লাশ করতে রাজি আমি। নোটস্ এনে দেব, তুমি পরীক্ষাটা তো দাও। তখন হুড়মুড়িয়ে লোক নিচ্ছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। 


‘না অনিন্দিতা। আমার ছেলেটাকে কে দেখবে?’ আর বললাম না। মা শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল,‘ছেড়ে দে। ওর চাকরি করার কোন ইচ্ছেই নেই।’ আমার কথাটা সেদিন শুনলে হয়তো ভালো করত বৌদি। অচীরেই চোখ বুঝলেন কাকু। অবসর নিলেন কাকিমাও। সংসার চালানোর দায়ভার কিছুটা এসে বর্তাল দাদার ওপর। এতেই ঘোরতর আপত্তি বৌদির। ‘সারা জীবন কেবল সংসারই করে যাব? একটু আনন্দ ফূর্তি করব না? আর কটাদিনই বা বাঁচব, কাকু।’ 


কাকুর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে জরা এসে গ্রাস করল কাকিমাকে। খিটখিটেও হয়ে গেলেন খুব। সংসারে নিত্য অভাব। নিত্য অশান্তি। বৌদির শান্তিনিকেতন কেবল আমাদের বাড়ি। যাবতীয় অনুযোগ কেবল আমাদের কাছে। কতবার যে বাবা ধমকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আবার চলে এসেছে ছেলে বগলে। পুরী গিয়ে নিজে নিজেই পুজো দিয়ে এসেছে আমার নামে। ‘তোমার চাকরি হচ্ছে না বলে কাকিমা কষ্ট পাচ্ছেন কিনা। দেখবে জয় জগন্নাথ সব ঠিক করে দেবে। ’


দিয়েও ছেন। চাকরী পেলাম। রাইটার্সে কমার্স ইন্ডাস্টিজ্ দপ্তরে। সেদিন ১৯শে জুলাই, বউদির ছেলে বাবুর জন্মদিন। বছর ঘুরল না লেবার সার্ভিস পেয়ে গেলাম।  চাকরীর দুশ্চিন্তা ফেলে মায়ের মাথায় চাপল আমার বিয়ের ভূত। আবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জয় জগন্নাথদেবের শরণাপন্ন  হল বৌদি। বিয়ে হল।  বিয়ের পর জানতে পারলাম, শৌভিকের দাদুর দেওয়া নাম,‘জগন্নাথ। ’ যদিও তিনি চলে যাবার পর ঐ নামে আর কেউ ডাকে না। 


আমার বিয়ের তত্ব সাজানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে ছেলে ট্যাঁকে হাজির বৌদি। সঞ্চিতা আর পম্পার সাথে হাত মিলিয়ে সব কাজ করল। পরের দিন ভোরবেলা আয়লা মাথায় ছুটে এল, শুধু বিদায়ের আগে আমাদের আশির্বাদ করবে বলে। দুটো মস্ত ক্যাডবেরি দুজনের হাতে দিয়ে মস্তক চুম্বন করল বৌদি। বাবা মাকে ছেড়ে যেতে যেতে একটা সান্ত্বনা নিয়ে গেলাম, আর কে কি করবে জানি না, এই ভদ্রমহিলা অন্তত নিয়মিত মায়ের খোঁজ নেবে। বকে বকে মায়ের মাথা ধরিয়ে দেবে। যতক্ষণ না বাবা ধমকে বলবে,‘ এবার বাড়ি যা।’


জীবনের গল্প যদি সত্যিই নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনে চলত। পরের এক দশকে কি যে হয়ে গেল। কাকিমা চলে গেলেন। বাবার পই পই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও, কাকুর অত সাধের বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে দিল দাদা আর বৌদি। বারো লাখ টাকা আর একটা ফ্ল্যাটের বিনিময়ে। সেই বারোর আটই ওরা পেয়েছিল। বাকি চার, দালাল যিনি আবার সম্পর্কে ওদের আত্মীয় সিম্পলি ঝেঁপে দেয়। বাবার কাছে ছুটে এসেছিল দোঁহে, কিন্তু বাবার সেই ম্যাজিক এখন আর কই। পরিচিত সব লোকই প্রায় মৃত। দুঃখ ভুলে মনের মত করে ফ্ল্যাট সাজায় বৌদি। বিশাল ঝাঁকজমক করে গৃহপ্রবেশ হয়। আর তারপরই দাদার চাকরিটা চলে যায়। 


আমি সদ্য চুঁচুড়ায় বদলি হয়েছি। একদিন দুপুরে অফিসে মায়ের ফোন। অসময়ে বাড়ির ফোন এলে বুক কেঁপে ওঠে এমনিই, তার ওপর আবার মায়ের ক্রন্দনোন্মুখ কণ্ঠস্বর,‘এই মানা শোন না, অমুকের বরের চাকরিটা চলে গেছে। তুই ওকে একটা চাকরি দেখে দে। ’ করজোড়ে নিজের জননীকে বললাম, আর কেউ না জানুক,তুমি অন্তত জানো আমি অত বড় কেলেমবক্স নই। কাউকে চাকরি পাইয়ে দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। মা তাও দমে না। ফোন করতে থাকে একে ওকে তাকে। বারবার। শেষ পর্যন্ত আমার মাসতুতো দাদা একটা চাকরি খুঁজেও দেয়, অ্যাকাউন্টিং এর কাজ। অফিস নিউটাউন। বেতন আট/নয় হাজার।


দাদা জাস্ট গেলই না। কারণ হাওড়া থেকে নিউটাউন নাকি অনেক দূর। মায়ের মুখ পুড়ল। ভেবেছিল আর ওদের সমস্যা নিয়ে ভাববে না, কিন্তু কমলি যে ছাড়ে না। নিত্য কেঁদে কেঁদে ফোন করে বউদি, “কাকিমা সংসার চলবে কি করে?” শাড়ির ভাঁজে, আলমারির কোণে লুকিয়ে রাখা মায়ের সীমিত পুঁজি ভেঙে বৌদির হাতে তুলে দেয় মা। মায়ের রেস্ত শেষ হলে, এগিয়ে আসে বাবা। আমিও। ফোন করে সাহস দিই, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে নাকি। সবটা দাদার ওপর ছেড় না। তুমিও কিছু কর। বাটিকের কাজ শুরু কর। এত ভালো রাঁধো, হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করতে পারো। ছেলেকে একাই এতদিন পড়িয়ে এসেছ, সেই বিদ্যেটা কাজে লাগাও। টিউশ্যনি করো। মূলধনের চিন্তা আমার।


সবই কাকস্য পরিবেদনা। দিনের শেষে সেই,“ কিছু টাকা ধার দাও।ছেলেটাকে পাঁচদিন শুধু আলু সিদ্ধ ভাত ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারিনি।  দাদা চাকরি পেলে শুধে দেব।“ধার দেওয়া টাকার অঙ্ক পাঁচ সংখ্যা ছাড়িয়েছে বহুদিন। ওগুলো ধার হিসেবে দেখিও নি আমরা। ফেরৎ পাবার আশা/ আকাঙ্খাও রাখিনি। কিন্তু এভাবে কত দেওয়া যায়। আর কতদিন বুকফাটা হাহাকার শোনা যায়। সদুপদেশ দিলেও শোনে না। ব্যবসা শুরু করবে বললে তাও একটা কথা ছিল। ধারের পয়সায় কতদিন সংসার চলে- ইদানিং বউদি নিজেও আসত না। দাদা বা বাবুকে পাঠিয়ে টাকাটা নিয়ে যেত। 


আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ছিল। টাকা দিতে পারব না বললে এমন কাঁদত যে ভয়ে বার তিনেক ওর ফোন ধরিনি আমি। তারপর একদিন হঠাৎ ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেল। মা বলল,‘ছেলেটা মনে হয় চাকরি পেয়ে গেছে। ঠাকুর। ’ কোন যোগাযোগই আর করল না দাদা বৌদি। বাবা বলল,‘পাছে টাকা ফেরৎ চাই তাই এড়িয়ে যাচ্ছে। যাক। ওরা ভালো থাকলেই হল।’ ভালো যে নেই অচীরেই জানতে পারলাম। আমার এক সহকর্মী একদিন ফোন করে বলল,‘ দিদি তোমার ঐ বউদি না আমায় এক্ষুণি ফোন করেছিলেন। বললেন খুব বিপদে পড়েছেন। ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। চল্লিশ হাজার টাকা ধার চাইছেন। বললেন তোমায় না জানাতে। তাও আমি ভাবলাম-’। 


বউদির সাথে দু একবারই দেখা হয়েছিল মেয়েটার। আমিই পাঠিয়েছিলাম বৌদির কিছু কাজের জন্য। তার কাছেও টাকা চাইছে? ছি ছি। লজ্জায় মাথা কাটা গেল যেন। রূঢ় ভাবেই বললাম,‘পাড়াতুতো বৌদি। ওর বরের চাকরি চলে যাবার পর আমাদের কাছেও ধার করেছে। এবার তুমি যা বুঝবে।’ কি বুঝেছিল মেয়েটা, কি হয়েছিল তারপর জানি না। এরপর একদিন বৌদির বাবা মা এসে হাজির আমাদের বাড়ি। ওদের থেকেও নিয়মিত টাকা চাইত বৌদি। যতদিন পেরেছেন ভদ্রলোক দিয়েছেন। আর দিতে পারবেন না জানাতেই অশান্তি। দাদা নাকি বুড়ো শ্বশুরকে মারতে গেছে। বুড়ি শাশুড়ি মাকে বাজারের মেয়েছেলে বলে খিস্তি করেছে। সবটুকুই হয়েছে বৌদির সামনে। তিনি নাকি নূন্যতম প্রতিবাদ ও করেননি। অসহায় বুড়োবুড়ি অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছে আরেক বুড়োবুড়ির কাছে। ওনারা আসার পর যেটা হল, নির্মম ভাবে মন থেকে কেটে ফেলে দিলাম সব অনুভূতি দাদা বৌদির প্রতি। 


গত বছর আবার ফোন করেছিল মেয়েটি,‘ দিদি শুনেছ? তোমার ঐ বৌদির হাজব্যান্ড মারা গেছেন। সাহায্য চাইছিলেন।’ শুনে কেঁপে উঠলাম। আকাশ থেকে পড়লাম। চটজলদি বৌদির পরিচিত আরেক বন্ধুকে ফোন করলাম। কথাটা কি সত্যি? এটা কি আদৌ সত্যি হতে পারে? দাদা কতই বা বড় আমার থেকে? বছর দশেক মেরেকেটে। শুনলাম সত্যিই উনি চলে গেছেন। বেশ কিছুদিন আগে।  হার্ট ফেল। কিছু করা যায়নি। 


বন্ধুটির কাছে, তার শাশুড়ি মায়ের কাছেও টাকা ধার করেছিল বৌদি। বন্ধুটি শোনাল সে কথা। খবরটা শুনেই মনে হয়েছিল ছুটে যাই বৌদির কাছে। জড়িয়ে ধরি। সাহস হয়নি। কি বলব গিয়ে? আর সেই বা কি বলবে? খবরটা শুনে মা খুব কেঁদেছিল। দীর্ঘক্ষণ হাতে মাথা রেখে বসেছিল বাবা। আমাদের কাছে যতগুলো নম্বর ছিল সবই ঘোরানো হল। কোনটাই লাগল না। তারপর যা হয়, কলকাতা থেকে তমলুক। তমলুক থেকে কাঁথি। মায়ের হসপিটালাইজেশন, বাবার অসুস্থতা, শাশড়ি মায়ের আছাড় খেযে ফিমার ভাঙা, ২/৩ এ নেমে যাওয়া হিমোগ্লোবিন, ডাক্তার কতৃক শ্বশুরমশাই এর দেহে পুনরায় কর্কট রোগের আশঙ্কা সব মিলিয়ে এমন ঘেঁটে গেলাম, ভুলেই গেলাম বিপদের দিনের বন্ধুকে। 


আজ সন্ধ্যেয় জনৈকা সহপাঠিনীর ফোনটা যখন হঠাৎ এল, মনে পড়ে গেল এর ছেলে তো বৌদির ছেলের সাথে পড়ত। বৌদির খুব ঘনিষ্ঠ ছিল মেয়েটি। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, বৌদি কেমন আছে রে? ওদিক থেকে জবাব এল,‘ও তো মারা গেছে।’ ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়। কি বলছিস? ওর বর মারা গেছে। বন্ধুটি বলল,“ হ্যাঁ। গত বছর ওর বর মারা গেছে যে দিন, এ বছর ঠিক সেদিন নিউমোনিয়া নিয়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চারদিন বাদে ও মারা যায়। একমাস হল-। জানিস অনি, আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। শেষের দিকে টাকা পয়সা নিয়ে এমন করল। সবার কাছে এত ধার করে ফেলল যে আমরা ওকে এড়িয়ে যেতাম। এভাবে যে চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি । এত অপরাধ বোধ হয় কি বলব। কেন ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করলাম -’। 

রাত সোয়া চারটে। খবরটা শোনা ইস্তক এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না। চোখের সামনে কেবল বৌদির মুখটা ভেসে উঠছে। কানে ভাসছে,‘ গরীব বলে একটু আনন্দ ফূর্তিও করব না? আর কটাদিনই বা বাঁচব অনিন্দিতা। “  যেখানেই থাকো বৌদি, খুব ভালো থেকো। অনেক অনেক আনন্দ, ফুর্তি করো। আর যদি পারো তো  এই অপদার্থ ননদটাকে ক্ষমা করে দিও।