Sunday 26 March 2023

অনির ডায়েরী ২৪ শে মার্চ ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"আমার নতুন PT ড্রেস লাগবে, বাবা," কোন একদিন বলেছিল তুত্তুরী। তখন সদ্য শেষ হয়েছে বার্ষিক পরীক্ষা, স্কুল বন্ধ। শৌভিক উড়িয়েই দিল দাবিটা, "আগে পাশ কর, নতুন ক্লাসে ওঠ, তবে না পিটি ড্রেস।"


মেনে নিল, বেশ কিছুদিন নির্বাক রইল তুত্তুরী। কাউকে আর কিছু বলল না, তারপর এল সেই দিন, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো এবং আমাদের যাবতীয় আশঙ্কা সমূলে বিনষ্ট করে দেখা গেল, সসম্মানেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী।  অতঃপর তিনি পুনরায় দাবি তুললেন, " মা, এবার আমায় পিটি ড্রেস কিনে দাও।"


এবার আমার জবাব দেবার পালা। বললাম, " আগে স্কুল খুলুক গিয়ে দেখ কি বলে, তবে না-। গিয়ে হয়তো দেখলি, যে পিটি ড্রেস আবার বদলে গেছে। অথবা একদমই বদলায়নি, গত ক্লাসেরটাই আবার পরতে বলছে। তাই না, হতে পারে তো-"।


স্কুল খুলল কোন এক বৃহস্পতিবার এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। নতুন রুটিন অনুযায়ী দেখা গেল, শুক্রবারই PT ক্লাশ পড়েছে। অফিস থেকে ফিরে দেখি মেয়ের মুখে জমেছে বাদল। ড্রেস ওই একই আছে এবং সবাই তা পরেছিল। "সবাই আমাকে দেখে হাসছিল। বলল তোর ড্রেস কই?  সবাই সালোয়ার পরে কি সুন্দর দৌড়াদৌড়ি করল, আর আমায় স্কার্ট পরে ওদের পিছন পিছন ছুটতে হলো"- স্ফুরিত অধরে, জানালেন শ্রীমতী তুত্তুরী।


তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, তা তুই খামোকা স্কার্ট পরলি কেন? আগের বছরের পিটি ড্রেস দুটো তো নতুনই আছে। যাঁরা জানেন না তাঁদের অবগতির জন্য বলি, বিগত বৎসরে দুবার স্কুল বদল হয়েছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। একবার এপ্রিল মাসে মহানগর থেকে তাম্রলিপ্ত‌। আর একবার মধ্য নভেম্বরে তাম্রলিপ্ত থেকে কাঁথি। তাম্রলিপ্ত স্কুলেরটা পরতে বলছি না, কিন্তু এই স্কুলেরটা তো পরতেই পারতিস।


বাবাও সম্মতি দিল পাশ থেকে,'এক্কেবারে ভোম্বল।' শ্রীমতী তুত্তুরী চোখ বড় বড় করে বললেন, "এই না না। একদম নয়, হয় নতুন পিটি ড্রেস নয়তো নরমাল স্কুল ইউনিফর্ম, না হলে ঢুকতেই দেবে না-'।  অতঃপর বাবার কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে, গদগদ কণ্ঠে কইলেন, " বা-আ-বা-আ, PT ড্রেস কিনে দাও না, বাবা।" সুড়সুড়ির আমেজে চোখ বন্ধ করে, ইশারায় মাথাটা দেখিয়ে, ওখানে বিলি কাটতে বলে, বাবা বললেন, " হ্যাঁ, দেবো তো। মা কিনে দেবে।"


ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি, সোমবার কাক ভোরে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে গিয়ে, স্কুলের উল্টোদিকের সদা হাস্যময়ী সেলাই মাসিকে বলে এলাম, " ও দিদি, মেয়ের পিটি ড্রেস লাগবে যে। আসছে শুক্রবারের মধ্যে দিতে পারবেন? না হলে আবার স্কুল কামাই করতে হবে মেয়েকে।"  মাসি এক গাল হেসে বাড়ি পাঠালেন।


প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বুধবারের মধ্যেই নূপুর বাবু (মহকুমা শাসকের ড্রাইভার) গিয়ে নিয়ে এলেন নতুন জামা। বিলটা দেখেই বুঝলাম, যে কেন বাবা বলেছিল, ওটা মা দেবে। যাই হোক, ভাবলাম পকেটে আগুন লাগলো বটে, ঝামেলাটা অন্তত মিটলো। হরি হরি! বাড়ি ঢুকতেই লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা তোমার হলুদ ওড়না আছে?"


ঋণাত্মক জবাব পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে জানতে চাইলেন, "তাহলে  কি হবে মা? ওড়না ছাড়া তো ঢুকতে দেবে না। তুমি আমায় একটা হলুদ ওড়না কিনে দাও-"। ভাবলাম বলি, ওটা বাবা দেবে। বললাম না কারণ জানি, বিস্তর ফাইল চালাচালির পরেও ওটা আমারই ঘাড়ে চাপাবে শৌভিক। অতি কষ্টে ও ব্যাটাকে ওড়না এবং হলুদ রং যদিও বা বোঝাতে পারি, দোকানের  হাল হকিকৎ বোঝাতে আমার জান বেরিয়ে যাবে। 


সত্যি কথা বলতে কি, কোন দোকানে পাওয়া যায়, এই শহরে, তা তো আমি নিজেই জানিনা। ভাগ্যে বন্ধুদের থেকে দোকানের নামটা জেনে এসেছিল তুত্তুরী।  কাঁথি শহরের জমজমাট বাজারের মধ্যে,বেশ নামী এবং বড় দোকান। আসন্ন চৈত্র সেলের বিস্তর ভিড় আর টোটোওয়ালাদের সাথে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ করে, বিগত বছরের PT ইউনিফর্ম (হাউস) রং মিলিয়ে যখন কিনে নিয়ে এলাম হলুদ ওড়না, আক্ষরিক অর্থেই শ্রীমতী তুত্তুরীর তখন খুশির সীমা নাই। কেবল বাবাকে বা মাসিকে দেখিয়ে স্বাদ মিটলো না, উল্লাসের চোটে হাওড়ায় ফোন করে দাদু দিদাকেও সবিস্তারে শোনালো সব গল্প।


আজ সকালেও প্রত্যক্ষ করলাম তার অপরিসীম আনন্দ। সময়ের বেশ খানিক আগে উঠে পড়ে,  তৈরি হয়ে নিয়েছেন একা একাই। সুপ্ত বাপকে ঠেলে তুলে আহ্লাদী হয়ে দেখালেন, "  বাবা, বাবা। দেখো বাবা আমায় নতুন PT ড্রেস।" বাপ মেয়েতে যখন এই নিয়ে খুনসুটি আর আহ্লাদ করছে, আমার মনে পড়ছিল প্রায় এক যুগ আগে, এক বৃদ্ধের উপদেশ-। 


তখন তুত্তুরী আড়াই বা তিন মাসের ছোট্ট বেবি। কন্যা সমেত আমি তখনও পিত্রালয়ে বসবাস করি। সপ্তাহান্তে শ্বশুরমশাই স্বয়ং এসেছেন পুত্রবধূ আর নাতনিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। শৌভিক তখন খড়গপুর ২ নম্বর ব্লকের বিডি ও। বাড়ি ফিরছে সেও। দীর্ঘদিন বাদে একত্রিত হতে চলেছে গোটা ভট্টাচার্য পরিবার। গিরিশ পার্ক ফ্লাইওভার তখনও কিছু গর্ত আর লোহার ছড়ের সমষ্টি। তাও প্রবল ট্রাফিক জ্যামে অচল গণেশ টকিজের মোড়। জানলা দিয়ে বাইরের বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখছিলাম আমি, দাদুর কোলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে সেদিনের ছোট্ট তুত্তুরী ।বেবি পাউডারে প্রায় সাদা, কপালে কাজলের ধ্যাবড়া টিপ।


নিদ্রিত নাতনির পায়ের আঙুল টেনেটেনে খেলা করছিলেন শ্বশুরমশাই।আচমকা বললেন, " তোমায় একটা কথা বলব, দুঃখ পেয়ো না। এ যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দেবে না।" অতঃপর একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, "সামান্য হলেও অভাব বোধ থাকাটা বড্ড দরকার। না হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।"


বৃদ্ধের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানি আমরা।  মুখ খুলতেই কক্ষনো কিছু পেয়ে যায় না শ্রীমতী তুত্তুরী। মাসকাবার কাকে বলে তাও জানে এবং বোঝে তুত্তুরী। কোন জিনিস চেয়ে ফেলেও, দাম দেখে পিছিয়ে যায় তুত্তুরী। আশার বাইরে সামান্য কিছু পেয়ে গেলে এত্ত, এত্ত খুশি হয় তুত্তুরী। সময় বড় নির্দয়। বাবার শেখানো নেতির নেতিকরণ তত্ত্ব অনুসারে, আজ যা স্বাভাবিক, কাল তাই অস্বাভাবিক। আজ যা সাদা, কাল তাই ঘোর মসীবর্ণ। সময়ের অমোঘ নিয়মে বদলে যাবেন হয়তো ইনিও, না বদলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। আজকের সবটুকুই থেকে যাবে স্মৃতিতে। তবুও এই সান্তনা টুকু তো থেকে যাবে, যে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।

অনির ডাইরি ২৩ শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জীবনে দুঃখের কি আর শেষ আছে বাপু। শুনতে আপনার দুঃখ বিলাস মনে হবে হয়তো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার সবথেকে বড় এবং চিরকালীন দুঃখ হল ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা। রাতের বেলা যত তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি না কেন, হতভাগা ঘুম কিছুতে আসতে চায় না। মাথার মধ্যে গজগজ করে, না জানি কত কিছুই। মস্তিষ্ককে বেশ দু চার ঘা বেত্রাঘাত পূর্বক, মাত্রাতিরিক্ত সাধ্য সাধনা করে ডেকে আনতে হয় নিদ্রাদেবীকে। রাত্রিবাস করার পর, তাঁরই এমন সোহাগ উথলে ওঠে অধমের প্রতি, যে তিনি আর আমার ঘাড় থেকে নামতেই চান না।


দুঃখ হয়, খুব দুঃখ হয়, জাস্ট কান্না পায় অফিস টাইমে অফিস বেরোতে। বিশেষতঃ যখন ভোরের রোদ ঝলমলে আকাশটা আচমকাই ভার করে ফেলে মুখ। কে জানে কার ওপর অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে তার আঁখি। চৈতালি বৃষ্টিতে যখন কাকস্নান করে, জানলার বাইরের ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি গাছ গুলো, ভিজে চুপচুপে হয়ে যায় ঝগড়ুটে ছাতারে আর মেহনতী কাঠঠোকরার পাল, তখন কেবলই মনে হয়, "এমন দিনে তারে বলা যায়"।  চন্দ্রবিন্দুর জুজু গানের সুরে বলতেই তো পারি,  "মার্জনা করবেন স্যার, আজ আর আসছি না।" 


বেইমান আকাশ, অভিমান ভুলে খিলখিলিয়ে ওঠে একটু পরেই, ঝলমলিয়ে ওঠেন সূর্যি দেব। পরমেশ্বরের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ আর হ্যাংলার মত প্রার্থনা করতে করতে আপিস বেরোই আমি। হে ভগবান, আজ একটা ভালো বাস পাইয়ে দিও কিন্তু। বাসে উঠেই যেন একখান সিট পাই। দীর্ঘ দুই, পৌনে দুই ঘন্টার বাস যাত্রা দাঁড়িয়ে করতে আমি অসমর্থ। ‘সিট হয়ে যাবে, উঠে আসুন না’ মার্কা গুলগল্পে বিশ্বাস করতে আমি নারাজ। দূরপাল্লার বাসে, পরের স্টপে সিট হয়ে যাবে মানে খুব কম করেও পনেরো-বিশ মিনিটের গল্প। 


শুধু কি তাই, হে ভগবান ভাড়া যেন ঠিকঠাক নেয় প্রভু। দীঘা অভিমুখী বা ফিরতি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে প্রাত্যহিক ভাড়া। কলকাতার লোক নাই, তো ভাড়া পঞ্চাশ/ষাট। তিনটে সিট বুক করে, জড়াজড়ি করে অর্ধ শায়িত হয়ে মহানগর ফিরতি কপোতকপোতী দর্শনের মতলব হল আমাদের সিটও নেই আর আমাদের ভাড়াও বেড়ে একশ। দাঁড়ান আরো আছে, হে ভগবান তোমার পায়ে পড়ি আমাকে বাদশা, টনি কক্কর এণ্ড পার্টির হাত থেকে বাঁচিও। 


দূর পাল্লার এসি বাস হলে যেমন সিনেমা চলে, নন এসি বাস হলে তেমনি বাজে গান। যেমন তাদের সুর, তেমনি কথা। গতকালের গান গুলো এখনও আমার কানে ভাসছে- ‘শি ডোন্ট নো, শি ডোন্ট নো-’, ‘ইউ ডার্টি, ডার্টি গাল, তু প্যার করে ইয়া ধোঁকা’, ‘থ্রি সিক্সটি পে কমর ঘুমা-’ ইত্যাদি। শুধু গানে রক্ষে নেই, একদম সামনের ছোট টিভিতে কারা আবার নাচেও। চোখ জুড়ানো লোকেশনে, মূল্যবান ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাতে বিদেশী ইয়ের বোতল নিয়ে একদল নারীপুরুষের সে কি উদ্দাম নাচ। ভয়ে চশমা খুলে বসে থাকি আমি। হতে পারে ঐ নাচগানের সৌজন্যেই, ঘুম আসে না রাতে। 


কি ভাবলেন, দুঃখ বা প্রার্থনা শেষ? দাঁড়ান মশাই, আরো আছে। হে ভগবান, বাসটা যেন ঠিকঠাক যায় প্রভু। আপদ বাস একই সময় ছেড়ে কোনদিন পুচ্ছ তুলে দৌড়ে চলে আসে তো কোনদিন তার গেঁটে বাত হয়। হয় এসে দেখি, সবে জহর বাবুর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে সুইপার মাসি। এক প্রস্থ ঝগড়ার পর, ডাস্টবিন খালি করবে মাসি, তারপর ঝাঁট পড়বে, তারপর মোছা। 'তুমি আজ এত সকালে কেন' বলে হুংকার ছাড়ে মাসি। নয় তো দেখি, সব কাজ সেরে, জহর বাবুর এন্ড পার্টির সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ খোশ গল্প করে, বস্তা বগলে বাড়ি ফিরছে মাসি। ফেরার পথে আমাকে আওয়াজ দিয়ে যায় " এই যে, তোমার আজ এত দেরি কেন?"


এর পরেও থাকে নানা খুচখাচ দুঃখ এবং আব্দার, যেমন হে ভগবান যাওয়া এবং আসাটা যেন নির্বিঘ্নে হয়। এ পথে, পথ দুর্ঘটনা আকছার ঘটে। পথ অবরোধও নৈমিত্তিক ঘটনা। অবরোধ হল তো হল, অন্যান্য সহযাত্রীদের তেমন  তাপোত্তাপ থাকে না দেখি। অনেকেই নেমে পড়েন বাস থেকে, ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক। তত্ত্বতালাশ করেন, অবরোধ কেন হল, অবরোধ করা কতটা ন্যায়সঙ্গত ইত্যাদি প্রভৃতি। এসি বাস হলে, বন্ধ করে দেয় বাতানুকূল যন্ত্র। ফাঁকা হয়ে যায় সমগ্র বাস। এক আমিই বসে থাকি বোকার মতন, আর ভাবতে থাকি, হে ভগবান আজ সকালে কার মুখ দেখেছিলাম প্রথমে। নির্ঘাত আমার নিজেরই হবে। 


খোঁজ নিতে থাকি, অবরোধ কেউ তুলছে কি? পুলিশ এল কি? মহকুমা শাসককে ফোনটা করেই ফেলব নাকি? পুলিশ অবশ্য আসে, অবরোধ উঠেও যায়, বাস ছেড়েও দেয়, তখনও ওঠে না কয়েকজন যাত্রী। ‘হ্যাঁগো, কই গো’ বলে ফোন করে তাদের পরিবার পরিজন। কণ্ডাক্টর আর ড্রাইভার মিলে চর্চা জোড়ে, নির্ঘাত চরতে গেছে, ব্যাটাকে ফেলেই চলে চল। হাউমাউ জোড়েন মহিলারা, ‘ বাস ছেড়ে দিবে? ছেড়ে দিবে মানে কি?বলতেছি তো, লোকটা পাইখানা গেছে। তা লোকের পাইখানা পাবেনি-’। যিনি অপকর্ম করতে গিয়েছিলেন, এমন ভাবে বেল্ট আটকাতে আটকাতে বাসে ওঠেন, যেন বাসটা ওণার শ্বশুরমশাই যৌতুক দিয়েছিলেন। বউ প্রশ্ন করে, ‘ঠিকঠাক ধুইছ?’ মাথা চুলকানোর অছিলায় কানে আঙুল দিই আমি, মনে মনে বলি,হে ভগবান, সকাল সকাল এত দুঃখ কেন দিচ্ছ প্রভু, তুলে নাও প্রভু। 


কেউ কাউকে তোলে না, বরং আরো জোরে, আরো রসালো সুরে জমে ওঠে দাম্পত্যালাপ, ‘তোমায় কখন থেকে বলতেছি, বাস দাঁড়াইছে,এই তালে হেগে আসো। তা নয়, বসে বসে পা💨ছ।' বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দেবার সাথে সাথেই, এসি বাসগুলো কেন যে এমন পূতিগন্ধময় এবং জনশূণ্য হয়ে ওঠে বেশ অনুধাবন করতে পারি। অন্যান্য সহযাত্রীদের মত কেন যে বাস থেকে নেমে গেলাম না ভেবে মুচড়ে ওঠে হৃদয়। রাগ হয়, সাথে সাথে আসে দুঃখ, এখন আপনি এটাকে দুঃখু বিলাস ভাববেন না কি ভাববেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুঝলেন কি না,  বিগ বি ঠিকই বলে গেছেন," ইয়ে জিনা ভি কোই জিনা হ্যায় লাল্লু "।

অনির ডাইরি ১৮ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"পাঁউসির কাছে একটা অনাথ আশ্রমে বসন্ত উৎসবের নিমন্ত্রণ আছে, যাবি?"কোন এক রবিবারে সকালে সাগ্রহে জানতে চাইল শৌভিক। দোল কেটেছে বেশ কয়েকদিন হল, জানলার বাইরে উদ্দাম উল্লাসে গান ধরেছে কোকিলের গুষ্টি। গরম কফির কাপটাকে দুই হাতে সোহাগী আলিঙ্গন পূর্বক, সেই কলতানই শুনছিলাম মন দিয়ে‌।

জবাব দিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হওয়ায় আবার বলল শৌভিক,"যাবি? পাশেই একটা রিজর্ট আছে 'মনচাষা' বলে, ওটাও ঘুরে নেব আর ফেরার পথে তোদের মন্দারমনি থেকেও ঘুরিয়ে আনব। লাল কাঁকড়া বিচ, যাবি?" 


কয়েক বছর আগে হলেও, সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে কোথাও যেতে বললে বিকট মুখব্যাদান করতাম আমি। ছুটির দুপুরে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো ছিল আমার কাছে স্বর্গসুখ। সাধের দিবানিদ্রা ফেলে কোথাও নড়তে রাজি হতাম না তেমন। ইদানিং বয়স বেড়েছে, প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করি, হাতে কমে আসছে সময়। ব্যস্ততাটাকেও ততো খারাপ  লাগেনা আজকাল আর। 


জলখাবার খেয়ে, আমরা যখন রওনা দিলাম মধ্য গগনে উঠবার তোরজোড় সম্পন্ন করে ফেলেছেন সূর্যদেব। কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু স্টিয়ারিং ধরলে তো, মিনিট কুড়ি -পঁচিশেই পৌঁছে যাব আমরা। গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেলেন নূপুর বাবু, আগেকার স্যার ম্যাডামরা নাকি প্রায়ই যেতেন, এই আশ্রমে। দূর দূর থেকে বহু লোক আজও আসেন এই আশ্রমটি দেখতে। বেশ অনেকবার বললেন, "খুব ভালো লাগবে ম্যাডাম।"


বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকলাম, একনজরে বুঝতে পারলাম না, এটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে আছে কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো আছে, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। নূপুর বাবু বললেন, "ওই দেখুন কত মানুষ এসেছে। এনারা প্রচুর অনুদান পান স্যার।"


হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। করজোড়ে শৌভিককে অভ্যর্থনা জানিয়ে, সাদরে নিয়ে গেলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হাঁটলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান।


খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে বানানো হয়েছে ছাউনি। ছাউনির নিচে সারি সারি চেয়ারপাতা। সামনে সিমেন্টের তৈরি পাকা মঞ্চ। সেখানে নাচছে অধিবাসী মেয়েরা। এগোতে এগোতে দাঁড়িয়ে পড়ে শৌভিক দেখালো, আকাশে ড্রোন উড়িয়ে ছবি এবং ভিডিও তোলা হচ্ছে। মঞ্চের পিছনে লাগানো আছে মস্ত এলইডি স্ক্রিন। পর্দায় ফুটে উঠছে ছবি এবং ভিডিও। সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই। 

একদম সামনের তিনটি চেয়ার বরাদ্দ হল আমাদের জন্য। অধিবাসী এক শিশু কোথা থেকে এক চুবড়ি পাঁপড় ভাজা নিয়ে এসে হাজির হল। উপস্থিত অভ্যাগতদের চা আর পাঁপড় ভাজা দিয়েই খাতির করা হচ্ছে এখানে। কুলোয় করে তিন রঙা আবির নিয়ে এসে হাজির হলো তিন সুসজ্জিতা আশ্রম বালিকা। মোদের তিনজনের গালে লাগল নতুন করে আবিরের ছোঁয়া। বাঁদিকের লম্বা মাটির দাওয়ায় পেতে রাখা কাঠের টেবিল এবং বেঞ্চে বসে বসে পা দোলাচ্ছে কয়েকটি বালিকা। প্রত্যেকেই বেশ সুন্দর সাজুগুজু করেছে, বুঝতে পারলাম এদের অনুষ্ঠান এখনও বাকি।


যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এসেছেন, দেখলাম তিনি মঞ্চে উঠে গিয়ে সঞ্চালিকার কানে কানে কিছু বলে এলেন। অতঃপর সঞ্চালিকার সুললিত আহ্বানে মঞ্চে উঠতে হলো তিনজনাকে। সদ্য বাবার পুরাণ ক্যামেরাটার দখল পেয়েছে তুত্তুরী, গলা থেকে ক্যামেরা নামাচ্ছে না মোটে। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছে এখানেও, তুলছিলও কিছু ছবি, আচমকা মঞ্চে ডাক পেয়ে, অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে, ভোম্বলের মতোই স্টেজে উঠল। গৌরবার্থে বহুবচনের মতই মহকুমা শাসকের সাথে সাথে বরণ করে নেওয়া হলো আমাদেরও। মনোজ্ঞ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হলো শৌভিককে। তারপর আমরা আবার নেমে গিয়ে দর্শকের আসন গ্রহণ করলাম।


খালি গলায় অসম্ভব সুন্দর গান শোনালো এক আশ্রম বালিকা। তারপর আবার নাচের পালা, নাচ সাঙ্গ হলে আবার গান। দাড়ি বুড়ো যে কতগুলো বসন্তের গান লিখে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজও যেকোনো বসন্ত উৎসবের প্রাণপুরুষ কেবল তিনিই। সঞ্চালিকা ঘোষণা করলেন এবার দশ মিনিটের নৃত্যনাট্যের পালা।  ফিসফিস করে বলল শৌভিক, "বোর লাগলে উঠে পড়তে পারি। দীঘাও যাওয়া যায়।"  যায় তো বটে, কিন্তু একটুও বোর হচ্ছি না যে। কি ভালো গান গাইছে, কি সুন্দর নাচছে ছেলেমেয়েগুলো। কি উৎসাহ সবকটার। কি মিষ্টি লাগছে বাচ্ছাগুলোকে। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, " এত সুন্দর বাচ্ছাগুলোকে, কে অনাথ আশ্রমে রেখে গেল গো।"


নৃত্যনাট্য শেষে, অনুষ্ঠানে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে, সঞ্চালিকা যিনি আবার কর্মসূত্রে পাঁশকুড়া পুরসভার কর্মীও, মঞ্চে ডেকে নিলেন এই অনাথ আশ্রমের প্রধান কর্ণধার তথা প্রাণপুরুষ শ্রী বলরাম করণকে। হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা পরিহিত যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এনেছিলেন, বুঝলাম উনিই হলেন বলরাম বাবু।


করজোড়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে তিনি শুরু করলেন অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।" 


এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। বর্তমানে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকে। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। যেখানেই থাকেন আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।


বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, সাংবাদিক সুব্রত বাবু স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন বলরাম বাবু। ডেকে নিলেন উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য ব্যক্তিদের। দীর্ঘদিন এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত এঁরা সকলেই। শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষ আছেন যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা  বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। যেমন বর্তমানে নার্সিং পড়ছে বেশ কয়েকজন মেয়ে।


গল্প শোনাচ্ছিলেন জনৈক দম্পতি, এই আশ্রমের সঙ্গে ওনাদের ১৯ বছরের সম্পর্ক। ভদ্রমহিলা বলছিলেন," প্রথম যখন আসি সেটা ২০০৪ সাল। খবরের কাগজ পড়ে বলরামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। সেটা মোবাইলের যুগ নয়। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা পাঁশকুড়া স্টেশনে দাঁড়াবো, আর আমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে থাকবো।" আজও তাই পরে আছেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী একটু আগে বলছিলেন, তাঁর বয়স ৮০। বর্তমানে বিদেশে বসবাস করেন। কখনও সিঙ্গাপুর, তো কখনো আমেরিকা। দুই পুত্রই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। জ্যেষ্ঠ পুত্র গুগলে মস্ত অফিসার। অনুষ্ঠান শেষে শৌভিককে গল্প শোনাচ্ছিলেন, Google Pay তে যত ট্রানজাকশন হয়, তার জন্য উনি রয়ালটি পান। কারণ ওটা ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই ডিজাইন। 


বলছিলেন ১৯ বছর ধরে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত, মায়া পড়ে গেছে এই আশ্রম আর এর প্রতিটি আবাসিকের ওপর। যেখানেই থাকুন প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন। দুঃখ করছিলেন, "আর কতদিন আসতে পারব জানিনা। বয়স ৮০ হল, তবে এটুকু আশ্বাস নিয়ে যেতে পারব পরপারে, যে আমার পরেও আমার ছেলেরা পাশে থাকবে, এই বাচ্ছা গুলোর।"


বেশ অনেকক্ষণ বসলাম আমরা, আরো কিছুক্ষণ বসতে পারলে ভালো হতো কিন্তু বলরাম বাবু ধরে নিয়ে গেলেন আশ্রম দেখতে, বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। গণবিবাহ দেন, বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন ইত্যাদি প্রভৃতি। সবশেষে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের আশ্রমে, এটি একটি বিশেষ আশ্রম এখানে থাকে বিশেষ ধরনের শিশু যারা যৌন নির্যাতনের শিকার বা যারা ১৮ বছরের কম বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বিনা অনুমতিতে এই আশ্রমে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ চতুর্দিকে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, সিসিটিভি ক্যামেরার ছড়াছড়ি।  শৌভিক সাবধান করে দিল তুত্তুরীকে, "গলা থেকে ক্যামেরা খুলে,গাড়িতে রেখে যা। এখানে কোনরকম ছবি তোলা যাবে না।"


তালা লাগানো মস্ত লোহার গেটের ভিতরে চকচকে নিকানো উঠোন, উঠোনে তুলসী মঞ্চ। উঠোনকে ঘিরে দুদিকে দুটো দোতলা বাড়ি। যার একতলায় রয়েছে অফিস। অফিসে টাঙানো রয়েছে আশ্রমিকদের খাদ্য তালিকা, কখন কি ক্লাস আছে, কে পড়াতে আসবেন ইত্যাদি। দেখলাম লেখাপড়া ছাড়াও নাচ,গান,সেলাই, পাটের কাজ এবং অন্যান্য হাতের কাজ শেখানো হয়। কে, কখন এইসব স্পেশাল ক্লাস নিতে আসবেন, ঝোলানো আছে তারও তালিকা। 


বেরিয়ে আসছি, দোনা মোনা করে একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম, বাচ্ছাগুলো এই ট্রমা কাটায় কি করে? বিশেষ আশ্রমের দেখাশোনা করেন যে ম্যাডাম, উনি বললেন কাউন্সিলর আসেন। কাউন্সেলিং হয় নিয়মিত। জানতে চাইলাম, ভোলা যায়? কেউ ভোলে? উনি হাসলেন কেবল। প্রশ্নটাই বড় বোকাবোকা যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই বোধহয় ভালো। মিশুক না বাস্তবে কিছুটা কল্পনার রং। যেখানে ভালো থাকবে প্রতিটা শিশু, যেখানে মুছে যাবে সমস্ত কুৎসিত দাগ।


ছবি সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডায়েরি ১৫ ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মোবাইলের ঘড়ি বলছে সোয়া আটটা বাজতে এখনো বাকি কয়েকটা মিনিট, গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি না বেরোলে কেউ যে আসর ছেড়ে নড়বেনা, বেশ বুঝতে পারছি। আজ আমাদের চণ্ডীপুরের ইন্সপেক্টর সাহেবের বৌভাত। শান্তনু, সন্দীপ আর মনীষ আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টর। ব্যাটাদের চাকরি জীবনের বছর ঘুরে গেছে,অথচ এখনও ঘোঁছেনি "বেবি ইন্সপেক্টরের" তকমা। 

এহেন আমার তিন "বেবি"র মধ্যে শান্তনুরই প্রথম আইবুড়ো নাম ঘুঁচলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া ইস্তক, যেভাবে সকলে শান্তনুর পিছনে লেগেছিল, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এমন উৎতপেতে লোকজনকে জীবনের শুভতম দিবসে মোটেই নিমন্ত্রণ জানাবে না শান্তনু। সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল শান্তনু এবং তাও চূড়ান্ত সরলতা, এক রাশ উষ্ণতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে।


নিমন্ত্রিত হলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে এটাই আমার বাবার শিক্ষা। অতিমারি এসে সব চেনা ছক উল্টেপাল্টে দিল তাই, নতুবা কেউ আমার বাবাকে নিমন্ত্রণ করবে আর বাবা যাবে না, এমন ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই কোটিকে গুটিক। উপরোধে ঢেঁকি গিলে, এমন কত যে নিমন্ত্রণ বাবা রক্ষা করেছে, যেখানে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। যেখানে কেউ বলেনি,'আসুন', কেউ বলেনি,'খেতে চলুন' বা 'ভালো করে খাবেন।' নীরব অবজ্ঞা উপলব্ধি করে, নীরবেই উপহার প্রদান পূর্বক অভুক্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে বাবা, কিন্তু গেছে।


শুধু যে নিজে গেছে তাই নয় যেতে বাধ্য করেছে মাকে এবং আমাকে। তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, অভদ্রতায় জ্বলে গেছে গা, ভরে উঠেছে চোখ, তাও হাসির মুখোশ পরে দাঁড়াতে হয়েছে সর্বজন সমক্ষে। বৃদ্ধের আমি এতটাই অনুরাগিনী, যে কখনই বৃদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা বা সাহস হয়নি। আজও হয় না। অবশ্য আমার স্ট্রাইক রেট বাবার মত অত নিখুঁত ও নয়। স্বভাবতঃ কুঁড়ে হওয়ায়, না যেতে পারা নিমন্ত্রণ বাড়ির সংখ্যাও আমার খুব কম কিছু নয়।


আজও কোন বিয়ে বাড়ির ছবি লাগালে, ঠোঁট ফোলায় রমেশ, দুঃখ পায় প্রিয়াঙ্কা। চুঁচুড়া ছেড়ে আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিলাম যে, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওদের বিয়েতে আমি আসবোই। কথা দিয়েছিলাম তমলুক ব্লকের এসএলও জয়ন্ত বাবুকেও, অবশ্যই হাজির হব ওনার কন্যার শুভবিবাহে। দুখানা কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, একটা শুধু আমাকে সপরিবারে আর একটা দিয়ে পুরো অফিসকে। 


দিনটা সম্ভবত ছিল রবিবার। প্রস্তুত ছিলাম আমি আর তুত্তুরী। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেবল আমরা ছাড়া, অন্য সকলেরই সেদিন অন্য কোন না কোন নিমন্ত্রণ বা ব্যস্ততা আছে। সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী, এমতবস্থায় একাকী, অচেনা পরিবেশে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবার মতন সৎ সাহস সেদিন জোটাতে পারিনি। বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলাম পরিকল্পনা। সবথেকে খারাপ লেগেছিল, যখন কন্যার বিবাহের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, "ম্যাডাম আসছেন তো? ম্যাডাম কত দূরে আছেন?"  ঠিক যেমন ফোন করেছিল চুঁচুড়া থেকে রমেশ।


পরের দিন আপিসে এসে খুব বকেছিলাম সবকটাকে। কিসের এত গেঁতোমি তোমাদের বাপু? মানছি দূরের লোকেরা ছুটির দিন পরিবার ফেলে আসতে বিপন্ন বোধ করে, কাছাকাছি যারা থাকো তারা গেলে না কেন? সবাই চুপ, শেষে চঞ্চল বলল,' আসলে ম্যাডাম‌ কুন্তল স্যার সবাইকে গাড়ি করে নিয়ে যেত তো-'। কুন্তল আমার পূর্বসূরী এবং ব্যাচমেট এবং সুহৃদ। আজও এদের নয়নমণি। কুন্তলের সাথে নিমন্ত্রণ বাড়ি না যাবার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। চঞ্চল বলল,' তার আগে তো, সাহেব ম্যাডামরা সবাই গাড়ি করে চলে যেতেন। স্টাফেরা যে যার মত বাসে করে যেত। একবারই গাড়ি দিয়েছিলেন অমুক আধিকারিক, সবাই খুব আনন্দ করে গিয়েছিল সেবার খেতে, ওমা হঠাৎ তাঁর মনে হল, যে তিনি হলদিয়া যাবেন। ভয়ের চোটে উত্তম তো না খেয়েই উঠে পড়ল।'


কবেকার কথা, তাও উত্তমকে বললাম, 'খেয়ে উঠবে তো? না খেয়ে হলদিয়া নিয়ে যেতে বলেনি তো কেউ।' উত্তম কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ' আপনি জানেননি, উনি পাঁচবার খাবার জায়গায় চলে গেছেন আমায় ডাকতে, শেষে পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লুম। যা ভয় পেতুম ম্যাডাম ওনাকে, ওনার ভয়ে বাথরুম পর্যন্ত যেতুমনি, চেপে বসে থাকতুম গাড়িতে। একবার বাথরুম গেছি চাবিটা গাড়িতে লাগানো ছিল, মোবাইলটাও গাড়িতেই রাখা ছিল। দু মিনিট পর ফিরে এসে দেখি, গাড়ি নাই। আমার তো মাথায় হাত, আশেপাশের অন্য সরকারি গাড়ির ড্রাইভাররা বলল, 'তোর বস্, তোর গাড়ি লিয়ে চলে গেছে।' ফোনটাও গাড়িতে রয়ে গেছে, ফোন করতেও পারতেছি নে। পকেটে যা পয়সা ছিল তাই দিয়ে বাসে করে অফিসে এসে দেখি, তিনি তুলকালাম বাঁধিয়েছেন। অমিয় দাকে (গাড়ির মালিক) বলতেছেন, 'হয় উত্তম থাকবে, নয় তোমার গাড়ি থাকবে।' উত্তমকুমারকে অবশ্য, দূর করে দেবার হুমকি, আমিও দিই। প্রতি তিন দিনে একবার তো বটেই। ভাগ্যে গাড়ি চালাতে পারি না- 


 যাইহোক প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি বুঝতে পেরে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা গেলে না কেন? ইতস্তত করে চঞ্চল বলল,' সেবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন এত অটো টোটো ছিল না, ওই রোদে দুপুর বেলা সবাইকে হেঁটে অফিস ফিরতে হয়েছিল।' বুঝতে পারলাম আগেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যই, ওরা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে। আশ্বস্ত করে বললাম, কুন্তল স্যার জিন্দাবাদ। আর আমার ফেলে আসা অফিসের লোকজনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো,  চুঁচুড়ায় কেমন মুড়ি টিনের মত ঠেসে ঠেসে সবাইকে গাড়িতে তোলা হত। এখানেও তাই হবে। আধিকারিক বা অফিস বদলে গেলেও বদলাবে না নিয়ম।


নিমন্ত্রণ এলে তারপর থেকে মোটামুটি হাজিরা দেয় অধিকাংশই। আজই যেমন সব মিলিয়ে আমরা ১৬ জন এসেছি। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্যর উপর ভার ছিল, কারা কারা যাবে তাদের নামের লিস্ট বানানো। তালিকা শেষ পর্যন্ত যা লম্বা হলো, বেদজ্যোতি-শুভাশিস-নন্দনের মত গুটিকয়েক যদি নানা কারণে যেতে অপারগ না হতো, তাহলে বোধহয় একটা মিনিবাস ভাড়া করতে হত, চাঁদা তুলে।


ঠিক ছিল, ঠিক চারটের সময় কাঁথি থেকে রওনা দেব আমি। পাঁচটা নাগাদ হক বাবুকে তোলা হবে নন্দকুমার থেকে। নিমতৌড়ি থেকে উঠবে সৌরভ আর CKCO শান্তনু। উপহার সমেত উঠবে শুভদীপ্ত। মেছেদা থেকে উঠবে সুরজিৎ, কোলাঘাট থেকে রঞ্জিৎ, দেউলটি থেকে সৌম্য, বাগনান থেকে রবিবাবু এবং সন্দীপ। সঞ্জয় আর মনীশ আসবে ট্রেনে। উলুবেরিয়া স্টেশন থেকে ওদের তুলে নেব আমরা। কাটায় কাটায় ছটায় পৌছবো আমরা নব দম্পতিকে আশিস এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম ব্যাচে খেয়ে ঠিক রাত আটটায় বেরিয়ে পড়ব আমরা।

সেই মতো শনিবার দুপুরে এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে পৌনে চারটের মধ্যে সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেলাম আমি। সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল, শৌভিক আর তুত্তুরী রাজি হলো না এই অবেলায় উলুবেরিয়া যেতে, তাঁরা নাকি যুগলে পাখির ছবি তুলতে যাবেন। সব হলো স্টার্ট নিল না কেবল গাড়িটা। টেনশনে আধ কিলো ঘেমে গেল উত্তম কুমার। বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেটি এবং উত্তমে মিলে বিস্তর ঠেলাঠেলিও করল তাও নড়লো না গাড়ি। বিরস বদনে মেসেজ করলাম অফিস গ্রুপে, ভাই সব তোমরা যে যেমন পারো, যেভাবে পারো চলে যাও। মনে হয় না আমি যেতে পারবো।


ভেবেছিলাম এই নিমন্ত্রণ বাড়িটাও বুঝি সংযুক্ত হতে চলেছে অপারগতার তালিকায়। পাঁচটা বেজে গেলে হয়তো সত্যি সত্যি আর যেতামও না। বাঁচিয়ে দিল কাঁথি বাজারের বুড়ো মেকানিক, আসতে একটু দেরি করেছিলেন বটে তবে মাত্র তিন মিনিটে কি যে মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করালেন গাড়িটাকে। গাড়ি একদম রকেট হয়ে দৌড়লো। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা।


মেনু কি হতে চলেছে আগেই জেনে নিয়েছিলাম আমরা, যদিও কিছুই আর মনে ছিল না সেদিন। তবে জানতাম এবং মনেও ছিল যে টকটকে লাল লেহেঙ্গা পড়বে নববধূ। লেহেঙ্গার ছবিও দেখিয়েছিল শান্তনু। ছেলেটা এতই ভালোমানুষ গোবলু, যে কে সাজাতে আসবে, কখন সাজাতে আসবে এবং সাজানোর খরচ কত সেসব গল্পও শুনিয়ে ছিল আমাদের। ফলে সুসজ্জিতা নববধূর মঞ্চে অবতীর্ণ হতে, যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত ছিলাম। 


নববধূর আসতে বিলম্ব হলেও ফুচকাওয়ালার যে আসতে বিলম্ব হবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। অবিলম্বে লাইন পড়ে গেল ফুচকাওয়ালার সামনে। একদল কটকটে ঝাল ফুচকা চায়, তো একদল ঝাল বিহীন শুকনো ফুচকা। ফুচকার পাশেই ঢেলে রাখা গরম গরম পনির কাঠি কাবাব। তার পাশে জ্বলন্ত চিকেন মোমো। তার পাশেই কফি। ফুচকার টক জলে পেট টইটুম্বুর, এমতবস্থায় কিছুতেই কফি খাব না আমরা, শান্তনুর মামা বাবুও ছাড়বেন না।  বড় ভালো বানিয়েও ছিল বটে কফিটা। পেট পুরে স্টার্টার সাঁটিয়ে, নববধূর ফাঁকা সিংহাসনে বসে ছবি তুলে, সেলফি কর্নারে গ্রুপি তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার চোখ ঠিক ঘড়ির ওপর। এতগুলোকে তাড়িয়ে এনেছি যেমন, সালামত ভাবে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও তেমনি আমারই। লজ্জার মাথা খেয়ে শান্তনুর মামাকে শেষ পর্যন্ত আমিই গিয়ে বললাম, রান্না কি সম্পন্ন? তাহলে আমাদের যদি একটু বসিয়ে দেন।


প্রথম ব্যাচে খেতে বসার সবথেকে বড় সুবিধা হল কোন কিছুই ঠান্ডা পাবেন না আপনি। জিভ জ্বালানো ফিস পাঞ্জাবি, আঙুল পোড়ানো মুগমোহন, কিমা মোটর, পোলাও, ভেটকি মাছের পাতুরি, খাসির মাংস, কষা চিকেন, মাছ, পনির ইত্যাদি যখন আসতে শুরু করল পরপর তখন বড় দুঃখ হচ্ছিল জানেন, কেন যে অতগুলো ফুচকা খেলাম। তেঁতুল জল আর এক্সপ্রেসো কফির আভ্যন্তরীণ বিবাদে, বাদ দিতে হলো অনেক কিছুই। তবে সন্দেশটা আর শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে ছাড়তে পারলাম না। আমাদের হাওড়া জেলার বাগনান-উলুবেরিয়া অঞ্চল এমনিতেই মিষ্টির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এই অসময়েও সন্দেশটা থেকে ভুরভুর করে নলেন গুড়ের সুবাস ছাড়ছিল। প্রতি কামড়ে জিহবা আর তালুতে মিশছিল খাটি ছানার সোহাগ।


শান্তনুদের বাড়ির আতিথেয়তা অসম্ভব উষ্ণ। কতবার, কতজন, কতরকম ভাবে যে বলে গেল, ভালো করে খাবেন, যা ইচ্ছে খাবেন, যতবার ইচ্ছে চেয়ে খাবেন। আমার ছোট কাকুর ভাষায় নির্লজ্জের মত খাবেন অর্থাৎ লজ্জা করে খাবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি । বর বেশে এক ঘর অভ্যাগত দের সামনে অন্তত গোটা পাঁচেক বার তো আমায় প্রণাম করার চেষ্টাই করে ফেলল শান্তনু। পদাধিকার বলে উপরওয়ালা বটে, তাই বলে গুরু ঠাকুর তো নই, আরেকবার প্রণাম করতে এলেই ঠ্যাঙাবো, এই ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করলাম শেষ পর্যন্ত। পাশ থেকে সন্দীপ ফুট কাটল, "ম্যাডাম সাথে সাথে শোকজ টাও করে দিন।" যেন অনাবশ্যক শোকজ করাটাই আমার কাজ। ওটাকেও দু চার ঘা দিলে মন্দ হত না, যা বুঝলাম।


আটটায় বের হব ভেবেছিলাম মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে পেরেছি ব্যাপারটা। তার জন্য তারিফও করলো হক বাবু আর উত্তম। 'এই আপনি তাড়া দিলেন, তাই সব কটা নড়ল।' সেটা দূর থেকেও বুঝতে পারছিলাম বেশ, নতুবা যে হারে নতুন বরকে গোল করে ঘিরে ধরে মন্ত্রণা দিচ্ছিল সব কটা, এত বুদ্ধি আমাদের শান্তনু মাথায় রাখতে পারলে বাঁচি। কিছু রাখবে, কিছু হয়তো মিশে যাবে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতির ভিড়ে। সব মিলিয়ে খুব খুব ভালো থাকবে আমাদের শান্তনু আর তার মৌলি, এটাই আপাতত টিম তাম্রলিপ্তর প্রতিটি উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সদস্যর একমাত্র কামনা। ভালো থেকো নব দম্পতি। অনেক অনেক ভালোবাসা আর আশীর্বাদ রইল তোমাদের জন্য।

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

মাসি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অফিস ঝাড়পোচ করে আসছে। অফিস স্থানান্তরিত হয়েছে, বদলে গেছে ইন্সপেক্টর থেকে আধিকারিক সকলে। জগদীশ গুপ্ত সাহেব তো মারাও গেছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কত সিকেসিও। নতুন জয়েন করেছে আবার। মাসি শুধু রয়ে গেছে  ধ্রুবক হয়ে। মাসির আসল নাম পুতুল দাস। এককালে চা বিক্রি করতেন, তখন আপিস সাফাই করত অন্য মাসী। সে মাসি গত হলে, ঐ কাজটাও চাপে এই মাসির ঘাড়ে। 


আমি আসার পর মাসির সামান্য চাপ বেড়েছে। মেঝে কতটা সাফ হল, কোথায় ঝুল জমল,ডাস্টবিন কতদিন পর খালি করা হল - পুরুষ আধিকারিকরা এসব দেখে থোড়াই। দুচারদিন ডুব মারলেও কেউ কিছু বলত না। মাসির ভাষায় সবকটা “সাক্ষাৎ ভগবান ছেল”। আমি একাই অসুর। আমি আসার পর হাজিরা খাতা বানানো হয়েছে মাসিরও। অফিসে ঢুকে ঝ্যাঁটা ন্যাতায় হাত দেবার আগেই,সামনে খাতা খুলে ধরেন হক বাবু। নিত্য আমার আর হক বাবুর মুণ্ডপাত করতে করতে সই করতে হয় মাসিকে। লম্বা ছুটি নিলে দিতে হয় একজন প্রতিস্থাপক। ঝাড়পোঁচ করতে হয় একটু ধৈর্য্য ধরে।টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে যাতে নাম না লেখা যায়। ঘর মোছার আগে পাল্টাতে হয় জল। কাদাগোলা মেঝে আমার দুচক্ষের বিষ। খালি করতে হয় ডাস্টবিনও। অফিসে ঢুকতেই পচা গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন আমার দুচক্ষের বিষ। ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এতদসত্ত্বেও মাসি নীবর থাকে, কারণ আপাততঃ মাসির মজুরীটা মাসেমাসেই দিতে পারি আমরা। আগে ঐটি পেতে কালঘাম ছুটত মাসীর। এখন অ্যালটমেন্ট এলেই সর্বাগ্রে আলাদা করে রাখা হয় মাসীর সম্বৎসরের মজুরীর টাকা। পুজোর বোনাসের ব্যবস্থা করা গেছে সময়মত। মাঝেমাঝেই, "মজুরী বাড়াও নাহলে আর আসবুনি" বলে হুমকি দেয় বটে মাসি, ওগুলো নির্বিষ আস্ফালন আমরাও বুঝি। কিন্তু বসন্তোৎসবের পরের দিন মাসির যে রূপ দেখলাম, তা মোটেই ইয়ে মানে শান্ত নয়। হোলির পরের দিন আপিসে ঢুকে দেখি, হক বাবু, জহর বাবু এবং অরূপ সিঁটিয়ে আছে। আলমারি হাঁটকে ছেঁড়া ন্যাকড়া আর পুরাণ ডাস্টার বার করছেন জহর বাবু। মাসি একাই সব্যসাচী। নেহাৎ মজুরীর বিলে আমিই সই করি, তাই আমার ভাগ্যে অমৃত বচন তেমন না জুটলেও, চোখ গোলগোল করে, মনে মনে ব্যাপক ভর্ৎসনা করল মাসি। বেদম হেসে মাসির ধ্যান না ভাঙালে, ভম্মই হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


যত চটছিল মাসি,ততো বাড়ছিল আমার হাসির দমক। যত হাসছিলাম আমি, ততো চটছিল মাসি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হার মেনে নিলাম আমিই। সরি মাসি বলে বেশ খাণিক আদরও করে দিলাম, তাও গলল না বৃদ্ধা। তাও নমনীয় হল না দৃষ্টি। শুধু বলল,‘ মা, মা গো। মা জননী। তোমায় প্রণাম।” 🤕


ছবি - অরূপ এবং বেদজ্যোতি। দুদিন ধরে একই রকম ক্ষেপে আছে মাসি।😔

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা #happywomensday 


প্রতিবছর মার্চ মাসে একটা মোটা টাকার অ্যালটমেন্ট ঢুকত। সাথে সাথে আসতো নির্দেশ নামা, আসন্ন নারী দিবস উপলক্ষে, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের নিয়ে করতে হবে দুদিনের কর্মশালা। তড়িঘড়ি চুঁচুড়া পুরসভার বাতানুকূল হলটা বুক করে ফেলতাম আমরা। কথা বলতাম নারী-স্বশক্তিকরণ (women empowerment) নিয়ে কাজ করছে এমন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, এনজিও এবং সরকারি আধিকারিকদের সাথে।


সেশন নিতে ডাকতাম, আমার পরিচিত এমন নারীদের, যাঁরা আমার চোখে প্রকৃতই সবলা। সবাই যে আসতে পারতো তা নয়, আবার অনেকেই চলে আসতো। যেমন এষা বা দেবশ্রী দি। একবার তো DLSA এর তৎকালীন সেক্রেটারি সাহেবের সৌজন্যে, ডিস্ট্রিক্ট জাজ স্বয়ং এসে হাজির আমাদের ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে। কথা বললেন, কথা শুনলেন, প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দিলেন মেয়েদের। ভাঙা ঘরে সেদিন আমাদের চাঁদের আলো।


এই জেলায় আসা ইস্তক আর আসে না ওই টাকাটা। কি জানি কেন বিমুখ হয়েছে দপ্তর, অধমের প্রতি। উচ্চতম আধিকারিক থেকে করণিক কার কাছে না অনুরোধ জানায়নি। তাও ভেজেনি চিঁড়ে।


 Women empowerment আমার প্যাশন বলতে পারেন। নিজেকে আমি সেই গুটিকয় empowered women দের মধ্যে ধরি, যাদের ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বে তাদের পিতা-মাতার যদি পুত্রাকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, নবজাতিকার মুখদর্শনের সাথে সাথেই তা দূরীভূত হয়েছিল চিরতরে। শৈশবে বা কৈশোরে আমরা কোনদিন সুস্পষ্ট ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়নি। গোটা ডিমই বলুন বা মাছের পেটি বা খাসির মেটে বা নতুন জামা সবকিছুই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সমান সমান পেয়ে এসেছি। যতদিন পড়তে চেয়েছি, যা নিয়ে পড়তে চেয়েছি অনুমতি এবং উৎসাহ পেয়েছি। বিয়ের জন্য অযথা জোরাজুরি করেনি কেউ। পড়তে গিয়ে যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, কোনদিন ঘটেনি কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা। চাকরির ফর্ম তোলা থেকে ইন্টারভিউ অব্দি, মহিলা বলে পড়তে হয়নি কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির সামনাসামনি। আমাকে কেউ কোনোদিন ঠারেঠোরেও বলেনি যে মহিলা বলে এই পদের আমি অযোগ্য বা অনুপযুক্ত। গ্লাস সিলিং এর সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরুষ সহকর্মীদের সাথে নিজেকে প্রমাণ করার সমান সুযোগ পেয়েছি আমি। সমতালে বেড়েছে বেতন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসিড নিয়ে ধাওয়া করেনি কেউ। চাকুরীরতা বলে বিয়ে করতে অসম্মত হয়নি কেউ। বিয়ের পরেও কেউ বলেনি চাকরি ছাড়তে। গার্হস্থ হিংসার শিকার হতে হয়নি। কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার পর শুনতে হয়নি কোন কটু মন্তব্য। মেটারনিটি লিভ পেয়েছি। চাইল্ড কেয়ার লিভ পাই। আমি তো সমাজের ভাগ্যবান অংশ। আক্ষরিক অর্থেই the creamy layer। 


কিন্তু সবাই যে এত ভাগ্যবান হয় না। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ'- এ, কন্যা ভ্রূণহত্যা, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা, স্কুল ছুট, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থহিংসা (domestic violence), যৌন নির্যাতন ইত্যাদি প্রভৃতি যে আজও আছে। এখনও সমাজের একটা গরিষ্ঠাংশ প্রতি মুহূর্তে যুঝে চলেছে এই দৈত্যগুলির সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা হল, এণারা অনেকেই এগুলিকে ভবিতব্য  বলে মেনে নিচ্ছেন। জন্ম থেকেই ধরে নিচ্ছেন নারী মাত্রই অবলা। অবরবর্গীয় মানুষ,বা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। তারা জানতেও পারছেন না, মানতেও পারছেন না যে নিছক জন্ম দিলে বা লালন পালন করলে বা ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলেই গায়ে হাত তোলার অধিকার জন্মায় না কারো। শুধু গায়ে হাত তোলাটাই গার্হস্থ্য হিংসা নয়। মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন যেমন সবার সামনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, উপহাসের পাত্র বানানো ইত্যাদি ও গার্হস্থ্য হিংসারই অঙ্গ। যেখানে প্রতিমুহূর্তে মেয়েটিকে মনে করানো হয় যে তার অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ, একান্তই নিষ্প্রয়োজন। 


এই সমস্ত পিছিয়ে পড়া মেয়েদের একটু স্পেশাল ফিল করানো, একটু সচেতনতা বৃদ্ধি, এইটাই তো হল নারী দিবসের উদ্দেশ্য। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। এইতো সেদিন সম্পত্তির অধিকার ছিল না মেয়েদের, ছিল না মতদানের অধিকার। এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। সেখান থেকে অনেক লড়াই করে আমরা এসেছি তো এতটাদূর। দিল্লি এখনো অনেক দূর হয়তো, তবে রাস্তাটা তো বোঝা যাচ্ছে। আর রাস্তা না থাকলেই বা কি, রাস্তা বানাতে হবে তো!


 জানি দুদিন বা একদিনের ওয়ার্কশপে কোন পরিবর্তনই হয়তো আনতে পারব না। ব্যাপারটা সিন্ধুতে বিন্দু সম। তাই বলে কি চেষ্টা করব না। ফান্ডে রাহু লেগেছে বটে, তবুও ঠিক করলাম যে, সীমিত সামর্থের মধ্যেই ওয়ার্কশপ আমরা করব।  ডিএম সাহেবের মিটিং হল বুক করতে লাগে না কোন টাকা পয়সা। মিটিং হলেই রয়েছে প্রজেক্টর। ল্যাপটপ তো আমাদের অরূপেরই আছে। চা বিস্কুট বা সামান্য দুটি মাছ ভাতের ব্যবস্থা ধারেনগদে হয়ে যাবে ডিএম অফিসের ক্যান্টিনে। রইল এবার কারা অংশগ্রহণ করবে আর কারা ক্লাস নেবে? আমাদের মহিলা এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদেরই ডাকা হল শেষ পর্যন্ত। প্রতিদিন অগুনতি মানুষের সাথে কাজ করেন এনারা। যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই আমার মেয়েরা অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এদের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে সামান্য সচেতনতা। 


ট্রেনার হিসেবে ডাকলাম আমার এক প্রিয় দিদি আর এক বন্ধুকে। বন্ধুবর শেষ পর্যন্ত এসে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু তানিয়া দি এসেছিল। জানতাম, এই মহিলার মাথায় আমার মতোই নারী স্বশক্তিকরনের পোকা গিজগিজ করছে। তাই না হাওড়া শিবপুর থেকে ঠেঙিয়ে তমলুক এলো আমার মেয়েদের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এবং সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেসেস পড়াতে। মালদায় পোস্টিং ভদ্রমহিলার। সেখান থেকে কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, ছেলের পরীক্ষা বলে। তার মধ্যে থেকেও একটা বেলা, একটা দিন শুধু আমাদের জন্য খরচ করাটা আমার কাছে মোটেই ছোট কথা নয়। সেটা বললাম ও দিদিকে। 


আর বললাম যে, টাকা পয়সা সেভাবে কিছু দিতে পারবো না। হাল বহুত খারাপ। উল্টে দিদি আমায় মুখ ঝামটা দিল, "তোর সঙ্গে কি আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক, অ্যাঁ? রাখ তোর টাকা তোর পকেটে।" সাধে কি বলেছি, ভদ্রমহিলার মাথায় পোকা গিজগিজ করছে। সাধে কি ভদ্রমহিলার সাথে আমার এত প্রেম। দুজনেই হাওড়ার মেয়ে যে। রতনে রতন চেনে মশাই।

অনির ডাইরি ৭ই মার্চ ২০২৩

 


 আজ মায়ের জন্মদিন।  কাগজে কলমে কিন্তু আজ না, জানুয়ারী মাসের তিরিশ তারিখে মায়ের জন্মদিন। এরকম কেন? প্রশ্ন করলেই মা বলে,“ভূতের আবার জম্মবার। ” ভূত অর্থাৎ অদৃশ্য কোন জীব, হ্যাঁ তাই তো থেকেছে মা বরাবর, অদৃশ্য,আত্মগোপনকারী, পিছনের সারিতে মুখ লুকিয়ে বসা আনস্মার্ট চাকচিক্যহীন প্রাণী। যাদের কেউ হিসেবে ধরে না। যারা স্বপ্নেও আশা করেন না, ঝকমকে লাইমলাইট কখনও এসে পড়বে তাঁদেরও ওপর। অথচ তাঁদের জীবন নিয়েই রচিত হয় আধুনিক রূপকথা। 


আপাতদৃষ্টিতে মায়ের গল্পের শুরুতে নতুনত্ব তেমন কিছুই নেই, সদ্য বিভক্ত- দাঙ্গা বিধ্বস্ত স্বাধীন ভারতবর্ষে জন্মানো, ৫০-৬০এর দশকে বড় হওয়া আর পাঁচটা মেয়ের মতই একই গতানুগতিক ছন্দে বাঁধা শৈশব। সুদূর মুর্শিদাবাদে দুকূল ছাপানো ভাগীরথীর তীরে, ঘন সবুজ ধান-পাট-মুসুরি খেত আর ঐতিহাসিক আমবাগানে ঘেরা গণ্ডগ্রাম রামনগর। 


সেখানে ঘোষেদের বিশাল যৌথ পরিবার, পরিবারের মাথা, মায়ের ঠাকুমা হরিমতী দেবী ছিলেন বড়ই জাঁদরেল। দাদু এবং দিদা, হরিমতী দেবীর আতঙ্কে থরহরি কম্প। দাদু থাকতেন কলকাতার মেসে। সপ্তাহান্তে ট্রাঙ্ক হাতে পাড়ি দিতেন দেশে। বাড়ি যখন ঢুকতেন তখন আমবাগানের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করত রামনগরের চাঁদ। ঝিঁঝি পোকাদের কলতানে দূর থেকে সানন্দে যোগদান করত শৃগালের দল। সেই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠত স্থানীয় সারমেয় কুল। অকুল আঁধারে টেমটেমির আলো জ্বেলে বসে ঢুলত অভুক্ত দিদা। মেয়েরা কখন ঘুমিয়ে কাদা।দাদুর বড় দুঃখ হত। কেন জেগে থাকে না মেয়েরা? কি করে জাগিয়ে রাখা যায় চার কন্যাকে?


 দাদু অঙ্কে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত দক্ষ, দশ ক্লাশের পরীক্ষায় পাওয়া শংসা পত্র, যত্ন করে রেখেছিল দিদা অনেকদিন। জীবনের অঙ্কে অবশ্য দাদু ছিল বরাবর কাঁচা। না হলে,৬০এর দশকে নিছক মায়ের(হরিমতী দেবী) শখ মেটাতে কেউ কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে বানায় দোতলা মাটির কেল্লা? 

তো যাই হোক বড় দুঃখ দাদুর, মানসিক অঙ্ক করেই চলেন, কি করে জাগিয়ে রাখা যায়, মেয়েদের?শেষে দিদার কাছে আব্দার  করলেন, যেদিন উনি আসবেন, সেদিন কিছু যেন স্পেশাল রান্না করে দিদা, গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে এমন বেঢপ আব্দার শুনে মুখ ঝামটাতেন আমার সাধাসিধে নিরীহ দিদা। মধ্যবিত্তের আবার ইসপেশাল কি হয়? রোজই তো থোড়-বড়ি-খাড়া। হোক না তবুও কিছু-। দাদু বলতেন,“আমি যেদিন আসব, তুমি বরং শুধু সেদিনই ডাল রেঁধো। তাহলে মেয়েরা ভাববে, আজ বাবা আসবে, আজ ডাল হবে!” বলেছিলাম না,বড় সরল,  জীবনের অঙ্কে বড় কাঁচা ছিলেন দাদু। 


মায়ের ভয়ে কোনদিন বউ মেয়েদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাননি। বড় বেড়ানোর শখ ছিল দিদার। মাথায় ছোট্ট খাট্টো দিদা আর তালগাছের মত ঢ্যাঙা দাদুর ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। হঠাৎ একদিন সাহস করে পুরীর টিকিট কেটেই ফেললেন দাদু। ভয়ে ভয়ে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে হরিমতী দেবীকে বললেন,“শীলু খুব বায়না করছিল। ঐ টাকা জমিয়েছিল। ” শীলু অর্থৎ শিউলি অর্থাৎ আমার মা। বয়স— বছর বারো। সেই বোধহয় প্রথম এবং শেষ বার দাদুর মিথ্যা বলা। অতঃপর? হাওড়া ইস্টিশন থেকে কু ঝিকঝিক-দৌড়াল স্বপ্নের রেল। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন সবৎসা সদানন্দ এবং সুনীতি রাণী ঘোষ। প্রথম সমুদ্র দেখা। প্রথম বাঁধন ছেঁড়া খুশি ভাসিয়ে নিয়ে গেল মা-মাসিদের শৈশব। 


স্থায়ী হল কোথায়? টুক্ করে একদিন চলে গেলেন দাদু। একটা ছোট্ট স্ট্রোক বদলে দিল জীবন। মা তখন নবম শ্রেণী, মায়ের সদ্য শাড়ি।  

 বড় মাসির বাড়িতে একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি ছিল,ফুলে ঢাকা দাদুর শরীর ঘিরে দাঁড়িয়ে-বসে দিদা আর তার চার মেয়ে আর একমাত্র জামাই,আমার বড় মেসোমশাই। সকলের চোখে অসীম শূণ্যতা আর অসহায়তা।থমথম করছে শোক। ব্যতিক্রম শুধু ছোট মাসি। আহাঃ বড়ই ছোট ছিল গো। দিদার কোল থেকে নামতে চাইত না। তখন ঐ ধরণের ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। 


সাদা থান পরা দিদাকে দেখে, জনৈক আত্মীয় নাকি বলছিলেন,“তোমায় খারাপ লাগছে না, বুঝলে। ” হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন কিশোরী মা আর মাসিরা। সদ্য সাদা শাড়িপরা মা, যে কোন সন্তানের কাছে বিভীষিকা। এই চূড়ান্ত অসময়ে কি বলছে এরা? সমাজ এত নিষ্ঠুর? 

চোখ মুছে আমার স্বল্প শিক্ষিত, সাড়ে চারফুটের দিদা তার পিতৃহারা মেয়েদের বলেছিল,“একদম কাঁদবি না। আজ থেকে আমিই তোদের মা- আমিই বাবা। আমি যতদিন না মরছি, কেউ কাঁদবি না। ” 


বিমুখ-লোলুপ-পলায়নপর আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিড়ে একা প্রহ্লাদ ছিলেন আমার বড় মেশোমশাই স্বর্গীয় অজিত সিংহ। জন্মসূত্রে বিদ্যাসাগরের দেশ ঘাটালের অধিবাসী। স্বভাবেও অনেকটা একই। বাহ্যিক আবেগ ছিটেফোঁটাও ছিল না,ছিল শুধু অটল কর্তব্যপরায়ণতা। অন্তরে, স্নেহের কাঙাল ছিলেন “মেশোই”।  এই নামেই ডাকতাম। আরএমএস এর ছাপোষা বেতনে হাওড়া শহরে বাসা ভাড়া করে পরিবার পালন করতে দম বেরিয়ে যেত- তবু পিছপা হননি দায়িত্ব নিতে। মেশোই এর নির্দেশে একাকী পলাশী স্টেশন থেকে লালগোলা এক্সপ্রেসে হাওড়া পাড়ি দিল সেদিন কিশোরী মা। শিয়ালদায় প্রতীক্ষারত মেশোই, মায়ের ভাষায় দু নম্বর বাবা। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের সাদাকালো ছবির মত, কয়লার ইঞ্জিনে টানা ট্রেন একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে পৌঁছাল মহানগরে। মেশোই বলল,“এসেছিস! চা খাবি?” “হ্যাঁ জামাইবাবু। ” মাটির খুড়িতে চা খেতে খেতে মেশোই বলল,“চাটা পুড়ে গেছে বল? কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। ” আবার মাথা নাড়ল মা,“হ্যাঁ জামাইবাবু। আপনাকে ঠকিয়েছে। পোড়া চা। ” ঠকাস্ করে পড়ল গাঁট্টা,“ভজহরি! এটাকে বলে কফি। বুঝেছিস। ”মেশোইয়ের প্রিয় শব্দ ভজহরি। সকলেই ভজহরি। যেমন আমি বলি অপদার্থ। 


এরপর শুরু হল আসল জীবন সংগ্রাম। অন্নচিন্তা চমৎকারা। মা এবং তার বোনেদের জীবন চরিত নিয়ে তিনখানা উপন্যাস লেখা যায়। একজোড়া শাড়ি আর এক জোড়া চপ্পল নিয়ে যুদ্ধ জয় করেছে আমার দিদার মেয়েরা। উপার্জনের জন্য মধ্য হাওড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজার গেছে টিউশ্যনি করতে, শিখেছে হিন্দি টাইপ। পাঁচ দশ পয়সার বিনিময়ে পোস্ট অফিসের বাইরে বসে খাম পোস্টকার্ড- মানি অর্ডার লিখেছে তবু হাল ছাড়েনি সদানন্দ ঘোষের মেয়েরা। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল হয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকে নিরন্তর পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিয়ে নিজস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার সেরা পদে উঠে সসম্মানে অবসর নিয়েছে মা। তাও আজ বারো বছর হয়ে গেল। পেয়েছে অগণিত মানুষের ভালোবাসা। যৌথ চাটুজ্জে পরিবারের মেজ বউ হয়ে, কোমর বেঁধে সামলেছে যাবতীয় দায়দায়িত্ব কর্তব্য। 

কি অমানুষিক পরিশ্রম করত মা, ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি ছুটেই যেত মা। 

শরীর ভাঙছিল অনেকদিন ধরেই। অম্বল- গরহজম-থাইরয়েড-প্রেশার- হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার ব্যামোর পাশাপাশি, ২০১৩ সালে যুক্ত হল লো সোডিয়াম আর অ্যাকিউট ডিপ্রেশন। বেশ কটাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরল মা, ততোদিনে  ভুলে গেছে সবকিছু, চিনতে পারছিল না সেই পাঁচদিন বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করা প্রাণাধিকা তুত্তুরীকে, তখনও মা ভোলেনি, মায়ের গায়ের রঙ কালো। মা ভোলেনি, কালো মেয়ে মানেই অসুন্দর, ভোলেনি গাঁয়ের মেয়ে মানেই আনস্মার্ট আর গাঁইয়া, ভোলেনি চাকরী করা মেয়ে মানেই গৃহকর্মে ঢ্যাঁড়শ। 


  কিছু কিছু ক্ষত বোধহয় এমন গভীর হয়, যা কখনও সারে না। সেদিনের দামী হাসপাতালের নামী মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন,“ব্রেনের কিছু সেল শুকিয়ে আসছে। ওষুধে আপাতঃ  সারলেও ধীরে ধীরে বাড়বে এই  ভুলে যাবার প্রবণতা। ধীরে ধীরে আক্রমণ করবে অ্যালঝাইমার্স। ভুলে যাবেন সবকিছুই। ” 

ডাক্তারের ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে আজ দশ বছর বাদেও দিব্যি আছে মা। হ্যাঁ ভুলে যায় খুবই, আমরা কাছাকাছি থাকি না বলে ভোগে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায়। 


এই নিরাপত্তাহীনতার জন্যই ২০২১ সালে মস্ত বড় বিপদ বাঁধিয়েছিল মা, ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ যে সেই বিপদ থেকে মাকে আমি বার করে আনতে পেরেছি। বাকি জীবনটুকুও যাতে মাকে ভালো রাখতে পারি, এটাই আপাতত ঈশ্বরের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা। প্রতিটা সফল পুরুষের পিছনে যেমন থাকেন একজন অবগুণ্ঠনবতী, তেমনি প্রতিটি নারীর সফল হয়ে ওঠার পিছনেও থাকে একাধিক পুরুষের অবদান। মায়ের জীবনের প্রথম পুরুষ, আমার স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। দ্বিতীয় পুরুষ আমার বাবা, তৃতীয় পুরুষ, যেন আমি হয়ে উঠতে পারি।