Sunday 26 March 2023

অনির দোলের ডায়েরি ৬ই মার্চ, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


প্রতিবছর ন্যাড়াপোড়াটা আমাদের দোলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর ন্যাড়াপোড়া মানেই হাওড়া। আমার বেড়ে ওঠার শহর। যে শহর দিয়েছে আমায় শৌভিক। যে শহরে প্রথম ঘুম ভেঙেছে আমার তুত্তুরীর।দূষিত হলেও, ঘিঞ্জি হলেও, আমার প্রাণের শহর। 


দোলের ছুটি পড়ার আগের শেষ কর্ম দিবসে, এক আঁচল রঙ খেলে, ঠিক সন্ধ্যের নামার মুখে সকন্যা হাওড়ায় গিয়ে হাজির হতাম আমি। বৈঠকখানার বড় কাঠের দরজাটা খুলে, উন্মুখ হয়ে আমাদের প্রতীক্ষায় থাকত বাবা আর মা।


ঢুকেই আগে হাঁকতাম, ' মা চা করো।' তারপর কোন মতে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে, আবিরে ফাগে জবরজং শাড়িটা বদলে, আমরা লেগে পড়তাম ন্যাড়াপোড়ার জোগাড় করতে। ওই স্বল্প আলোতেই, দুটো ঝাঁটা নিয়ে, পূব আর পশ্চিমের বাগান ঝাঁটিয়ে যত শুকনো পাতা জোগাড় করত তুত্তুরি আর বুল্লু বাবু। অনেক সময় প্রতিবেশীদের বাগান থেকেও চুরি করে আনতো, ঝরে পড়া শুকনো নারকেল পাতা। চোখের সামনে দিয়ে, ঝরা পাতা নিয়ে যেত চোরেরা, দাঁত বার করে হাসত গেরস্ত। আজব পাড়া মাইরি আমাদের। আজব শহর মাইরি, আমাদের হাওড়া।


 অতঃপর, পশ্চিমে দিকে,  বাবার এক ফালি ছোট্ট বাগানে, মরে যাওয়া বেলগাছের একপাশে, স্তূপাকারে জমা করা হতো সেই সব শুকনো পাতা। তার ওপরে ফেলা হতো যত অপ্রয়োজনীয় কাগজ, পুরানো খাতা, দস্তাবেজ, ফেললু জিনিসপত্র। আর তারপর? তারপরের সময়টা ছিল শুধুই প্রতীক্ষার।


থেকে থেকে আমার দুই খুড়তুতো ভাই, অয়ন আর অনিন্দ্যর মোবাইল নম্বরে ফোন করতো তুত্তুরী। "ও বড় মামা। ও ছোট মামা। বলি কখন আসবে তোমরা? জলদি এসো প্লিজ। নাহলে যে আমরা চাঁচড় পোড়াতেই পারছি না।"  সেই যে সেবার অয়ন গিয়েছিল বাঁকুড়া। কথা ছিল বিকাল বিকাল পৌঁছে যাবে বাড়ি। ট্রেন লেট করে, ঢুকতে ঢুকতে গড়িয়ে গেল রাত দশটা, রাত দশটা অবধি আমরা সপরিবারে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করে গেছি, কখন আসবে অয়ন, তবে পুড়বে শ্রীমান বা শ্রীমতী ন্যাড়া।


ন্যাড়াপোড়ার সময় হলে, একত্রিত হত বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাবা,মা,পিসি,অয়ন,চৈতি,অনিন্দ্য বুল্লু বাবু, তুত্তুরী এবং আমি। বেচারা ন্যাড়া, দোল পূর্ণিমার আগের রাতে, হালকা বাতাসে অল্প একটু শরশর্ শব্দ করা ছাড়া,  মোটামুটি নীরবেই দাঁড়িয়ে থাকত। খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে তার গায়ে আগুন লাগাতো শ্রীমান অয়ন। দেশলাই বা লাইটার সরবরাও করত আমার বাপ। ধীরে ধীরে একটু একটু করে জ্বলতো ন্যাড়া, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে সটান পাঁচিলের ওপরে তুলে দিত অনিন্দ্য, আর সপরিবারে আমরা জুড়তাম প্রবল হল্লা। 


আমরা হাওড়াবাসীরা বলতাম

" আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল। 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।" 


আর আমার মুর্শিদাবাদী মা বলতো, 

" আজ আমাদের নেড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, পাড়ায় গন্ডগোল।"


হাওড়া আর মুর্শিদাবাদের উদ্দাম ঝগড়ায় রেফারির হত আমার বাবা। আমাদের সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে শোনা যেত বাবার উল্লাসী আওয়াজ, " লে পচা----"। এক চোট থমকে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত সকলে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতো পিসি, " তোর যত উল্টোপাল্টা কথাবার্তা কেবল হিটলার।"


ইদানিং কানে আর তেমন কিছুই শুনতে পায় না পিসি। একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে তবে হয়তো বুঝতে পারে। বাবারও ফুসফুসের সে যোশ আর নেই। স্বাস্থ্যটা ভালো যাচ্ছে না মায়ের ও। এবারে দোলে হাওড়া যায়নি আমরাও। 


আসলে মনটাই ভেঙ্গে গেছে। এইতো সেদিন দেখা হল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। সম্পর্কে আমার ভাই বউ, চৈতীর বাবা। বুল্লু বাবুর পৈতেতে এসেছিলেন সপত্নিক। ছিলেন বেশ কয়েকটা দিন। বুল্লু বাবুর পৈতের যাবতীয় আচার তো আমরা মাসিমাকে অনুসরণ করেই পালন করলাম। উনি যে ভাবে বললেন,উনি যা বললেন, উনি যখন বললেন। বাড়ি ফিরে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই যে এইভাবে একবেলার জ্বরে যে চলে যাবেন ভদ্রলোক আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। বিনা মেঘে বজ্রপাত একেই বলে বুঝি। 


এমতবস্থায় শ্রীমতি তুত্তুরীর,মন ভালো রাখার জন্যই ন্যাড়া পোড়ার কথাটা তুলেছিলাম। বাগানে প্রচুর শুকনো পাতা তো পড়েই থাকে, তাদের কয়েকটাকে একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে গেল। ন্যাড়াও পুড়ল, নটে গাছটিও মুড়াল। সমস্যা বাধালেন মহকুমা শাসক স্বয়ং। ওনার অনুমতি ছাড়া, ওনার লোকজন কি আর আমার কথা শুনবে? সকাল থেকে লিটার-লিটার, গ্যালন-গ্যালন তৈল মর্দনের পর অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় গররাজি হলেন তিনি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে, সাধ্যাতীত করলেন আমাদের রঞ্জিত বাবু আর তুত্তুরীর মাসি।এত ভালো ভাবে, এত উপাচার সহযোগে কোনদিন পোড়েনি আমাদের ন্যাড়া। পুড়ল বটে, আনন্দও হল খুব।কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেল খানিকটা বিষন্নতা আর অনেকটা অসম্পূর্ণতা। পরিবার ছাড়া কি আর উৎসব জমে? 

যাই হোক, সকলকে দোল পূর্ণিমার অগ্রিম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই। ভালো কাটুক আপনাদের দোল। রঙিন হোক আগামী প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।

Friday 17 March 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

বালি ব্রিজ টপকালাম কত দিন বাদে, ব্রিজের নিচে কুচকুচে কালো মা গঙ্গা আর বাঁহাতে ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল মা দক্ষিণেশ্বরী। মা কালী আবার মা গঙ্গার সতীন,একসাথে দুজনকে প্রণাম করা উচিত নয় বোধহয়। এতদিন বাদে দেখা, আশা করি আজ ওরা কেউ কিছু মনে করবে না।


 বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তার দু'ধারে যত চায়ের দোকান ছিল সব ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কিছুকাল আগে। প্লাস্টিক টাঙিয়ে তারাই আবার ফিরে এসেছে। উজ্জ্বল বাল্বের আলো হাত বাড়িয়ে ডাকে, "ও দিদি, আসুন না। কতদিন বাদে এলেন কলকাতায়।এক কাপ চা তো খেয়ে যান অন্তত। ঘন দুধে, এলাচ থেঁতো করে, একটু বেশি চিনি আর চা দিয়ে ফুটিয়ে, মাটির ভাঁড়ে মুখ পোড়ানো অনবদ্য দিশি চা। পছন্দ নয় বুঝি? তাহলে না হয় আপনার জন্য বিলিতি চাই বানিয়ে দেব। কষকষে করে ফোটানো গরম জলে দার্জিলিং চায়ের পাতা ভিজিয়ে আপনার জন্য তৈরি করে দেবো, সুগন্ধ কালো চা। তাতে থাকবে ব্যাস এক চিমটে চিনি। আমাদের বিস্কুট গুলো দেখেছেন?  এই যে কাঁচের বয়াম ভর্তি বিস্কুট,  এগুলো কি আপনাকে ডাকছে না ? দেখুন কি না নেই, মুচমুচে লেড়ো বিস্কুট আছে, প্রজাপতি বিস্কুট আছে, ক্রিম রোল আছে, সুজির হরেক রকম বিস্কুট, যাদের আপনারা কুকিজ বলে কেনেন অনেক দামি মল থেকে, সব আছে। আছে চেরি আর চাল কুমড়ার মিঠাই ছড়ানো সস্তা বেকারির কেক।  বলুন তো কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবেন? ও দিদিইইইইইইইইই আসুন নাআআআআআ।"


এয়ারপোর্ট। আড়াই নম্বরের গেট দিয়ে ঢুকতেই একযোগে মেসেজ পাঠালো ওলা এবং উবের। " ও দিদি আসব নাকি? প্রাইম, ম্যাক্স, মিনি, মাইক্রো কি লাগবে বলুন না যা বলবেন তাই নিয়ে এসে হাজির হব। হ্যাঁ, আমাদের ড্রাইভার গুলো একটু ছ্যাঁচড়া বটে, আমাদের নির্ধারিত ভাড়ায় কিছুতেই যেতে চাইবে না ব্যাটারা, বলবে অ্যাপ বন্ধ করে দিন, বলবে ক্যাশ টাকায় ভাড়া না দিলে কিছুতেই নিয়ে যাব না, হাজার বললেও এসি চালাবে না। উল্টে আপনাকে ওয়ান স্টার দেবে। আপনি নালিশ করবেন, আপনি ফেসবুকে লিখবেন, আপনি টুইটারে নালিশ করবেন। কিচ্ছু করবো না আমরা। জাস্ট কিচ্ছু করব না। বড়জোর একটা, " সরি ম্যাডাম, এই তো আমরা ড্রাইভারের মুণ্ডুচ্ছেদ‌ করলাম বলে- " মার্কা একটা গুরুত্বহীন মেসেজ পাবেন।  তাও কেবল টুইটারে। ওখানকার লোকজন একটু বেশিই গালাগাল দেয় কিনা। 


ওসব ছাড়ুন বরং। কতদিন বাদে ফিরলেন এই বুড়ি শহরে, কোথাও যাবেন না নাকি…? হাওড়ায় বুড়ো বাপ মায়ের কাছে অন্তত চলুন। নাকি অন্য কোথাও ঘুরে দেখতে চান? রাতের মহানগর কেমন লাগে? নামমাত্র পয়সায় রাতের মহানগর দেখাবো আপনাকে, তাও এঁকেবেঁকে, অলিগলি দিয়ে। নামমাত্র ভাড়ায়, শুধু ঘেমো হেলমেটটা একটু পরতে হবে। পিছন থেকে বলল রেপিডো।


ভিআইপি রোড। নিয়নের আলোয় পিচ্ছিল রাজপথ, পিছন পিছন তাড়া করেছে সুইগী আর zomato। ও ম্যাডাম কি খাবেন বলুন না। বিরিয়ানি খাবেন, বিরিয়ানি? কোথা থেকে খাবেন একবার বলুন শুধু, আমিনিয়া চলবে? আর্সলান? সিরাজ? রহমানিয়া? বিরিয়ানি বাই কিলো? কাবুলিওয়ালা? নাকি ইন্ডিয়া?

আরেকজন বলল, মোগলাই ছাড়ুন। বড় বেশি তেল আর মসলা, ওভার রেটেড বুঝলেন তো। আপনি তো ইয়ে আবার একটু মানে, স্বাস্থ্যবতী কিনা, চাইনিজ খান বরং।  উচ্চ মানের নুডুলস খাওয়াব দিদি। গ্রেভি চান যদি, গ্রেভি। না হলে হাক্কা।  কতদিন ভালো চাউমিন খাননি ভাবুন। মিক্সড চাউমিন খাবেন? গোটা গোটা প্রণ, মাশরুম, মাখনে ভাজা ওমলেটের কুচি, মাখন-গোলমরিচ দিয়ে সটেড চিকেন আর কুচি কুচি পর্ক।  ওঃ  আপনি তো আবার শুয়োরের মাংসটাংস খান না। ফিস উইথ রেড ওয়াইন নিন সাথে একদম জমে যাবে।


অপরজন পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিদেশী জিনিসপত্র ছাড়ুন তো? এতদিন বাদে নিজের শহরে ফিরেছেন নিজের দেশি খাবার খান। বিরিয়ানি ছাড়াও অনেক কিছু আছে মোগলাইএ। বিভিন্ন রকম নান আছে। আর কাবাবের কথা ভুলে গেলে? তোমার প্রিয় কাবাব। এককালে তো ফ্যান্টাসাইজ করতে কাবাবের নামে। শোন, ওসব চিনে খাবার খাওয়ার থেকে সাহেবী খাবার খাও বরং। চিজে লটপট পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি খাও না, আমরা এনে দেবো তো। 


ফ্ল্যাটের তালা খুলছি আরবান  ক্লাপ বলল,  আজ তুমি বড় ক্লান্ত না? কাল আসি তাহলে? বড় নোংরা হয়েছে তোমার ফ্ল্যাট খান বাপু। বাথরুমে গিয়ে দেখো, কোণায় কোণায় ঝুল, জমা জলের লালচে দাগ। রান্না ঘরে ঢুকে দেখ না, দেখবে কেমন তেলচিটে পড়েছে। সব পরিষ্কার করে দেব। তোমার কোন চিন্তা নেই। এই শোনো না নিজের দিকে কতদিন তাকাও না বলতো, ফাটা গোড়ালি টা দেখেছো আর হাতের নখগুলো? কি কুচ্ছিত রকমের কিউটিকল জমেছে। এত কালোই বা হয়ে গেলে কি করে? বলছি কি একটা ফুল বডি স্পা করে নাও বরং। সাথে একটা দুরন্ত ফেসিয়াল। কোথাও যেতে হবে না তোমায়, আমরাই আসবো বরং। ফোল্ডিং বেড আনব,  ডিস্পোজেবল পোষাক আনব। তোমার শোবার ঘরে, তোমার বাতানুকূল যন্ত্রের শীতল হওয়ায়, দুর্দান্ত মালিশ করে দেবে আমাদের মেয়েরা। রিলাক্স করার জন্য, জ্বালানো হবে তোমার মনের মত সুগন্ধী, পপৌড়ি বা সেজ। নিদেনপক্ষে চন্দন। সামান্য একটু বেশি খরচা হবে, যদি চকলেট রাপ লাগিয়ে নাও, তাহলে দেখবে কি রকম ঝিলিক মারবে তোমার চামড়া।”


পাত্তা না দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলাম। কতদিন বাদে এলাম। প্রায় দুই মাসেরও পর। শেষ এসেছিলাম বড়দিনের ছুটিতে। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল মহানগর ত্যাগ করার। আজকাল সেই টানটা আর অনুভূত হয় না।  উল্টে খুঁত গুলোই বেশি চোখে পড়ে। কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করি শহরটাকে। তিনশ তেত্রিশ বছরের বুড়ির আর দেবারই বা কি আছে নতুন করে?নেহাৎ দুই প্রাণের বন্ধু এই মুহূর্তে মহানগরে পোস্টেড,নাহলে আরো বাড়ত খিস্তির তীব্রতা। কিন্তু একটা ব্যাপার প্রতিবারই অনুভব করি,কিছু তো আছে বুড়ির মধ্যে। সাধে তিলোত্তমা বলে না লোকে।বুড়ি বেশ কুহকিনী। সীমানা স্পর্শ করলেই, কেমন যেন আপন করে নেয় বুড়ি। ফিসফিস করে বলতে থাকে মান ভাঙ্গানো আদরের কথা। যাবতীয় ক্ষতে যেন মলম লাগিয়ে দেয় বুড়ি। যত্ত খিস্তিখেউর,রাগ, বিরক্তি, অভিমান সব যেন কেমন গলে গলে যায়। বিরাগটা যে কখন অনুরাগ হয়ে, মাখো মাখো প্রেমে পরিণত হয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারি না। দূষিত বিষ বাতাসকেও একটু বেশি ভরে নিই ফুসফুসে। ঘুমিয়ে পড়ি বুড়ির বুকে মাথা রেখে, ময়লা আঁচল খানা জড়িয়ে। কাল সকালে উঠে সেই তো আবার ফিরে যেতে হবে। যতই চেপে ধরি না কেন,কাল সকালে ঠিক হাত ছাড়িয়ে নেবে বুড়ি। আবার ফিরে যেতে হবে পাতানো শহরে। নাককান মূলে ভাব জমাতে হবে আবার। এই তো জীবন কালি দা।

অনির ডাইরি ২রা মার্চ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

 মোবাইলে যে টাওয়ার নেই খেয়ালই করিনি। দিব্য শান্তিতে কাজ করছিলাম। মাঝে হাত-পা ছাড়াতে, সেকশনে গিয়ে খানিক খোশগল্প ও করে এলাম সবার সাথে। আমাদের চঞ্চল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তিনবেলা আহ্নিক করে। টিকি রাখে। কপালে তিলক কাটে। আজকের তিলকটা বড়ই নিখুঁত কেটেছে। কিভাবে এমন সুন্দর তিলক কাটা যায়,সেই সংক্রান্ত খাণিক জ্ঞান আহরণও করে এলাম। তিলক নাকি শুধু মাথায় কাটলেই হয় না। শরীরের বারো জায়গায় কাটতে হয়। প্রতিটা তিলক শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন রূপের নামে কাটা হয়। সাথে সাথে পড়তে হয় সংস্কৃত মন্ত্র।  যাতে বলা থাকে শরীরের কোন অংশের তিলক কোন রূপের উদ্দেশ্যে অঙ্কিত। 


শরীরের কোথায় কোথায় তিলক কাটা হয়, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। আমিও শুনব না। চঞ্চলও ছাড়বে না। “শুনুন না ম্যাডাম। শুনলে পূণ্যি হয়। কপালের তিলক কেশবের নামে। কণ্ঠে শ্রী গোবিন্দ। হৃদমাঝে থাকেন শ্রীমাধব। উদরের এক পার্শ্বে শ্রীবিষ্ণু, অন্যদিকে বামনাবতার। মধ্যে নারায়ণ। এক বাহুতে ত্রিবিক্রম আর মধুসূদন আর অপর বাহুতে হৃষিকেশ আর শ্রীধর। পিঠে থাকেন পদ্মনাভ। কোমরে দামোদর। আর মস্তকে বাসুদেব।” বললাম তেরো হল তো। উৎসাহ পেয়ে গুছিয়ে বলে চঞ্চল,‘ না বারোটাই কাটি। কাটার পর যে টুকু মাটি হাতে লেগে থাকে,সেটা মাথায় মুছেনি বাসুদেবের নামে।’ জানতে চাই কাটো কি দিয়ে? জবাব পাই, ছাঁচ আছে। আবার প্রশ্ন করি, কাটো কি দিয়ে, চন্দন কি? চঞ্চল মাথা নাড়ে গম্ভীর ভাবে। ‘না ম্যাডাম। এটা হল দ্বারকার মাটি। যাতে মিশে আছেন আমাদের প্রভু। কেউ কেউ বৃন্দাবনের মাটি দিয়েও কাটে। সেটা কালো হয়। এটা মঠ ভেদে, আচার ও ভিন্ন হয়।’ 


বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। জিজ্ঞাসা করি, মাটিটা পায় কোথা থেকে? উত্তর পাই মায়াপুর থেকে কিনে আনে। ‘বেশি দাম না। একশ টাকা কেজি। একবার কিনলে অনেক দিন চলে যায়। ’ মায়াপুরের কোন মঠে দীক্ষা নিয়েছে চঞ্চল। ইসকন্ নয়। 


বৈষ্ণব ধর্ম নেবার ফলে কি কি পরিবর্তন এসেছে, সে গল্পও শোনাল চঞ্চল। আমিষ ছেড়ে দেবার সাথে সাথে কমেছে তমঃ এবং রজ গুণ। সিগারেট ছেড়েছে। চায়ের নেশা ছিল তাও ছেড়েছে। গল্প আরো গড়াত, যদি না  বড় সাহেব মেসেজ পাঠাতেন, “তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?’ কি সর্বনাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখি কখন যে মোবাইলের সবকটা টাওয়ার পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলটা রিস্টার্ট দিলাম আর জহর বাবুকে বললাম এক কাপ চা খাওয়াতে। 


জহর বাবু কোন এককালে আমাদের নাইটগার্ড ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর ঘুরে গেল। কিন্তু তাও নিত্য অফিস আসেন। অবসর নিয়ে বাড়িতে থাকা বোধহয় এই সব লোকের পোষায় না। সোয়া নটায় অফিসে ঢোকেন। ঝাড়পোঁচ নিয়ে সুইপার মাসির সাথে এক চোট ঝামেলা করেন। তারপর শুরু করেন চা করতে। চায়ের লোভে কত যে বন্ধু আসে জহর বাবুর। আমি গরহাজির বা অন্যমনস্ক থাকলেই  আমাদের ভিজিটর চেয়ার দখল করে তাঁরা বসে পড়েন চা খাবেন বলে। চা খেয়ে চলে গেলেও হয়, তা নয় এরপর শুরু হয় মজলিশি গল্প। ফলে কাকতাড়ুয়ার মত আমাকে চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাতেই হয়। এক ঝাঁকি দর্শনেই সব সাফ। ট্রেড ইউনিয়নের লোকেদের সাথেও ওণার হেব্বি ভাব। ডেপুটেশন দিতে এলেও তাদের বসিয়ে চা খাওয়ান, রসিয়ে সুখদুখ, ভূতভগবানের গল্প করেন জহর বাবু। ফলে আমার ঘরে যখন তাঁরা ঢোকেন, বিক্ষোভের বারুদ ততোক্ষণে ভিজে ন্যাতা। 


এ হেন জহর বাবুর চায়ের কোয়ালিটি নিয়ে কোন কথা হবে না। আমার অধিকাংশ ইন্সপেক্টর সাহেব ও চা ছোঁয়ও না। ঐ চা বর্জন করার বদবুদ্ধি আমাকেও দেয়। নেহাৎ আমি খানদানী চা-তাল। জলে চা মোটামুটি একবার দেন জহরবাবু। বাকিটা ঐ চা পাতাতেই চলে। জলটা বারবার পড়ে নতুন নতুন করে। চিনি থাকলে ভালো, নাহলে কোথা থেকে হরির লুঠের বাতাসা যোগাড় করে চায়ে ফেলে দেন জহরবাবু। চড়াম্ চড়াম্ গুড় বাতাসাও থাকে অনেক সময় চায়ে। থাকে কদমা বা বীরখণ্ডিও। সে যে কি ভয়ানক মিষ্টি, বাপরে। 


মিষ্টি ছাড়াই দিতে বলি আমি। বেশী বেলা হলে অনেক সময় বলি, জহরবাবু এটা চা? না আপনার হাত মোছাটা ফুটিয়ে দিয়েছেন। রাগ করে না বুড়ো। শুধু মাঝেসাঝে বেপোট চিৎকার করে, ‘জয় গৌরনিতাই’ বলে। ‘ইয়া আল্লাহ’ বলেও চিৎকার করেন অনেক সময়। বেলা তিনটে বাজলেই, আমার অগোচরে মোবাইলে সজোরে হয় কালিকীর্তন নয়তো হরিনাম চালান। সাথে নিজেও গলা মেলান। আমি বেরোলেই, সব চুপ।  আসেপাশের দপ্তরের লোকজন নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওণার গান শোনে। 


তো যাই হোক, কাগজের কাপে চা দিয়ে গেলেন জহর বাবু। এক চুমুক দিতেই মনে হল চায়ে জোয়ান দিয়েছেন আজ। এ আবার কি নবতম সংযোজন রে বাপু। এমনিতেই চাটার কোন স্বাদ গন্ধ নাই,  নিছক লালচে গরম জলের মত সোয়াদ। তারওপর জোয়ানগন্ধী। ডেকে জানতে চাইলাম, চায়ে জোয়ান দেবার দুর্বুদ্ধিটা কে দিল মশাই আপনাক? জহরবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। ‘জোয়ান, আজ্ঞে?’ বললাম জী আজ্ঞে। উনি সাফাই দিলেন, ব্যাগে চাও ছিল,পুজোর বেলপাতাও ছিল। চায়ে নির্ঘাত পুজোর বেলপাতা মিশে গেছে। বেলপাতায় এমন জোয়ানের গন্ধ বেরোয়, বাপের জন্মে শুনিনি বাপু। বললাম, আরেকবার ভালো করে চা বানিয়ে আনুন দেখি। বেলপাতা -চাপাতাটা তার আগে সটান ময়লার বালতিতে ফেলুন। 


আবার চা এল। আবার জোয়ানের গন্ধ। এবার বোধহয় একটা জোয়ানও পড়ল মুখে। জহর বাবুর এক কথা। চায়ে পুজোর বেলপাতা মিশেছে। হতে পারে। আর একটা জিনিস ও হতে পারে,যেটা আমার পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি বলেছিল কিছুদিন আগে, ‘জহরবাবু পান চিবোন তো। হয়তো সেই চিবানো পানই খানিক চায়ে পড়ে গেছে ম্যাডাম।’ আবার ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, জহরবাবু আপনার পান কোথায়? একগাল হেসে বললেন, ‘পান আজ্ঞে?পান তো পকেটে?’ জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, পানে জোয়ান দিয়ে খান না। করলাম না। কিছু প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত থাকাই শ্রেয়। আপদ বেদজ্যোতি, যত কুচিন্তা ঢোকায় আমার মাথায়। থেকে থেকে চা-পানের পিক আর জোয়ান এই ঘুরতে লাগল সারাটা দিন মাথায়। জহরবাবু যতদিন না মাস্ক পরে চা বানাচ্ছেন, আমি আর চা খাচ্ছি না এই অফিসে।

অনির ডাইরি ১লা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


শ্রীমতী তুত্তুরী আমাদের দ্বাদশী কন্যা এবং পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা। আমরা দুজনেই সরকারী নৌকর। দুজনেরই বদলীর চাকরি, বদলীর চক্করে মহানগর ছেড়েছি আমরা।  বার তিনেক স্কুল বদল হয়েছে তুত্তুরীর। শেষ বদল হয়েছে বিগত নভেম্বরে। তাম্রলিপ্ত পাবলিক স্কুল থেকে কাঁথি। তো এহেন তুত্তুরীর বর্তমান স্কুল থেকে যখন মেসেজটা ঢুকল, যে আসছে রবিবার ওনারা বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করবেন, আমাদের মস্তকে আক্ষরিক অর্থেই বজ্রাঘাত হল। যার কৃতকর্মের ফলাফল ঘোষণা হতে চলেছে, তিনি তো হাওড়া।  মহানন্দে মাতুলালয়ে অধিবাস করছেন।  রবিবার দিনই তাকে কাঁথি ফেরত আনতে যাব দোঁহে। 


আমার বর ক্ষণিক ভেবে বলল, “নূপুরকে পাঠিয়ে দেবো বরং।’ নূপুরবাবু দীর্ঘদিনের সরকারী বাহন চালক।  ওনাকে এই শহরের এবং আসেপাশের পঞ্চায়েত এলাকার সবাই একডাকে চেনে। উনিও সবাইকে চেনেন। ভদ্রলোক স্বভাবেও বেশ ডাকাবুকো। অনেকটা ‘দাবাং’য়ের পাণ্ডেজীর মত। ফলে উনি গেলে রেজাল্ট ঠিক নিয়েই ফিরতে পারবেন। 


নিরস্ত করলাম আমিই। লোকটা এত ভক্তি শ্রদ্ধা করে আমার বরকে, তুত্তুরী রেজাল্ট দেখিয়ে সেই ভয়-ভক্তি বিনাশ করাটা কি ভালো হবে? শ্রীমতী তুত্তুরীর রেজাল্ট তো আমি আজ থেকে আনছি না। রীতিমতো হাঁড়ি-বালতি-ছালা নিয়ে যেতে হয়। এমন ঝুড়িঝুড়ি নম্বর পায় আমার দুলালী।


ও আমিই যাবো খন রেজাল্ট আনতে, এবারও।  বরকে বললাম,একটু স্কুলে কথা বলে দেখ সোমবার দেবে কিনা। দেখা গেল স্কুল তো রাজি, বেবারে রেজাল্ট দিতে, গররাজি শ্রীমতী তুত্তুরী।  বাড়ি ফিরে যখন শুনলেন, আমি তাঁর রেজাল্ট আনতে যাব তৎক্ষণাৎ পড়ে গেলেন বাপের পায়ে। 


 “ বাবা, প্লিজ মাকে যেতে দিও না বাবা। ওই মহিলা কি রকম মারকুটে জানো তো। আমাকে আর আস্ত রাখবে না"  শুধু কাকুতিমিনতি নয়, রীতিমত উৎকোচের প্রলোভন ও দেখানো হল, " আমি তোমাকে আমেজ করে দেবো বাবা।” আমেজ বলতে, ভোলানাথ হয়ে চোখ বন্ধ করে বসবেন একজন, আর অপরজন মনের সুখে তার মাথার চুল টানবে, পিঠে সুড়সুড়ি দেবে, কান মূলে দেবে। তাতে নাকি আমার বরের ব্যাপক আমেজ হয়। কান মূললে কারো কোনদিন আমেজ হতে পারে, মা না হলে জানতেই পারতাম না। 


বাপমেয়ের যোগসাজশে শেষ পর্যন্ত আমাকে আর এ যাত্রা রেজাল্ট আনতে যেতে হল না। আমাকে বলা হল, " তুমি অফিস যাও বরং।" মাঝখান থেকে টানাপোড়েনে বেশ খানিক দেরী হয়ে গেল অফিস যেতে। আমার আপিস তমলুকে। যাতায়াতের জন্য দীঘা- কলকাতা বাসই আমার ভরসা। এমনিতে কলকাতা থেকে দীঘা যাবার হাজারে হাজারে বাস, দীঘা থেকে কলকাতা আসার বাসের সংখ্যা ও খুব কম নয়, কিন্তু অফিস টাইম পেরিয়ে গেলেই এই বাসগুলোর আর টিকি দেখা যায় না। যেহেতু আজকে বেরোতে দেরি হয়েছে, কপালে দুঃখ আছে বেশ বুঝলাম। 


অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর নূপুর বাবু। প্রত্যহ আমাকে বাসে তুলে দেবার দায়িত্বটা উনি আগ বাড়িয়ে ঘাড়ে নিয়েছেন। উনি তো পারলে আমাকে আমার অফিসেই ছেড়ে আসেন, নেহাৎ সাহেবের রক্তচক্ষুর ভয়ে আপাততঃ দীঘা বাইপাস অবধিই আমাকে সঙ্গ দেন। 


দাবাংয়ের চুলবুল পাণ্ডের মত,রীতিমত মাঝ রাস্তায় বাস থামিয়ে আমায় তুলে দেন এবং যাতে সিট পাই সেটাও বলে দেন ড্রাইভার/কণ্ডাক্টরকে। কিন্তু আজ চুলবুলও ফেল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর যে বাসটি এল, কণ্ডাক্টর হাত তুলে দিল, সিট নেই বলে। এতটা রাস্তা প্রায় সত্তর/পঁচাত্তর কিলোমিটার, দুটো ব্যাগ নিয়ে বাসে  দাঁড়িয়ে যেতে আমি অপারগ। অগত্যা বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেটাও নাপসন্দ নূপুর বাবুর। সতেরো বার বললেন, ‘গাড়িতে বসুন ম্যাডাম। সাহেবের বউ দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো লাগে নাকি।’ 


বড্ড রোদ। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে তো উঠলাম, মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল। নির্ঘাত সিট ছিল। এখানে না থাকলেও সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে বা খড়্গপুর বাইপাসে নির্ঘাত খালি হত। এই নূপুর বাবুর জন্যই আমায় তোলেনি। সবাইকে আমার বৈবাহিক পরিচয় বলার যে কি দরকার।পরিচয় জানতে পারলে আর উল্টোপাল্টা ভাড়া চাইতে পারবে না। নির্ঘাত তাই তোলেনি। 


এই রুটের এই এক দস্তুর। কোন বাঁধা ভাড়া নেই। স্থানীয়দের থেকে ৫০ নেবে তো আমার থেকে ৬০। তা নিক। কোন-কোনদিন, কোন-কোন বাস তো ১০০টাকাও চায় এবং নেয়। আমাকে দেখেই বোঝে, এ স্থানীয় অধিবাসী নয়, অমনি যাতাঃ ভাড়া চায়।  যতক্ষণ না স্থানীয়দের মত কোমর বেঁধে ঝগড়া করছি, ‘কাল ৬০ নিলে আজ ১০০ কেন দেব’, ভাড়া বাড়তেই থাকে।


দাঁড়িয়ে থুড়ি বসে আছি মিনিট পাঁচ সাতেক, আচমকা নূপুর বাবু ডেকে বললেন,‘ম্যাডাম আসুন।’ একটা সাদা স্করপিও দাঁড়িয়ে আছে, তার দরজা খুলে ধরে বললেন,‘উঠে পড়ুন। ম্যাডাম। আমার চেনা গাড়ি। এই ঠিক করে পৌঁছে দিবি কিন্তু।’ ভেবলে গিয়ে উঠেও পড়লাম, কিছু বোঝার আগেই, ড্রাইভার কিঞ্চিৎ গ্যাঁগো করে, গাড়ি ছেড়ে দিল। সামনের সিটে মস্ত ব্যাগ নিয়ে একটা লোক বসে আছে। ভাবলাম ওণারই গাড়ি হয়তো। ভ্যাবলার মত বললাম,‘ দেখুন আমি কিন্তু কিছুই জানি না। আপনি কি আদৌ নিমতৌড়ি যাচ্ছেন?’ আমার আপিস নিমতৌড়িতে। সামনের লোকটা আর ড্রাইভার উভয়ে একসাথে জানালেন, ওণারা বাগনান যাবেন। পথে আমার যেখানে প্রয়োজন, নামতে পারি। তবে রাজপথেই নামতে হবে, গলিঘুঁজিতে গাড়ি ঢুকবে না। 


সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটা থামতেই, এক দঙ্গল লোক হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। এতক্ষণে বুঝলাম এটা শাটল্ খাটছে। চারজন বড় এবং একটি বাচ্ছা গাদাগাদি করে বসলাম মাঝের সিটে। পিছনেও চারজন। একটি অল্পবয়সী ছেলে কিঞ্চিৎ  আপত্তি করছিল, ড্রাইভার বলল, ‘একটু এডজাস্ করে নে ভাই। নাচিন্দায় ওণারা নেমে যাবেন, তোকে ভালো সিট দুব।’ পিছনের লোকেদের সুবিধার্থে নামিয়ে দেওয়া হল সব কাঁচ। খোলা হাইরোড ধরে হুহু করে ছুটছে গাড়ি, হাওয়ার দাপটে দম বন্ধ হয়ে আসে।পথে কিছু মানুষ উঠল। কিছু নামল। 


আজকাল আর শাড়ি পরে অফিস যেতে পারি না। যে সালোয়ার গুলো পরি, সেগুলো আমার মায়ের ভাষায়," ফেলে দিলেও, কেউ কুড়িয়ে নেবে না।" বেতনপত্রের আপাততঃ যা হাল, ভাবলাম এই বেলা মিন্ত্রা খুলে দেখি সস্তা গণ্ডায় যদি কিছু মেলে। জামা দেখছি, পার্শ্ববর্তিনী আচমকা বললেন, ‘এটা বেশ ভালো তো। ’ চমকে তাকিয়ে দেখি উনিও আমার মুঠো ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা কৃশকায়, পরণে সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি। অবিন্যস্ত কেশদাম,তেল প্যাটপ্যাটে মুখচোখ। কি বলব,বুঝতে পারলাম না। বোকার মত হাসলাম। হাসলেন উনিও লাজুক ভাবে, তারপর বললেন, ‘কিছু মনে করবেন নি। আমার আসলে কুর্তির দোকান আছে তো। তাই আপনার ফোনের দিকে চোখটা চলে গেল।’ 


সামান্য হেসে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। ভদ্রমহিলা গল্প বলার মুডে আছেন,আমার সাথে খোশ গপ্প জুড়লেন। জানতে পারলাম ওণারা মেলায় মেলায় ঘুরে কুর্তি-নাইটি বিক্রি করেন। তবে মিন্ত্রায় যেমন দেখছিলাম ওমন ফ্যান্সি কিছু না। পাইকারি দরে কিনে, মেলায় বিক্রি করেন। এই মুহূর্তে নন্দীগ্রামের শিবরাত্রির মেলায় দোকান দিয়েছেন। ওণার গৃহকর্তা ওখানেই আছেন এখন। সামনেই এদিকে হোলির মেলা বসবে, ভদ্রমহিলা সেখানেই গিয়েছিলেন স্টলের ব্যবস্থা করতে। কথা হয়ে গেছে, পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছে মেলা কমিটি। ভদ্রমহিলা আবার নন্দীগ্রাম ফিরে যাচ্ছেন। 


বললেন বাড়ি নন্দকুমার। জানতে চাইলাম রাতে কখন ফিরবেন মেলা  সেরে? বললেন, রাতে আর ফিরবেন না।  রাত বারোটা অবধি দোকান খোলা থাকে। তারপর সব বন্ধ করে রান্না চাপাবেন। খেয়ে দেয়ে কর্তা গিন্নী ঐ স্টলেই শুয়ে পড়বেন। চমকে উঠলাম শুনে। তাই নাকি? বললেন "হ্যাঁ। এমন কত করি আমরা। পুরো সংসারটাই উঠিয়ে নিয়ে ঘুরি। খুব কষ্ট হয় জানেন। দুটো পয়সার জন্য করি। বিক্রিটা যদি ভালো হয়, তাহলেও ভালো। না হলে খুব কষ্ট হয়। যে কোন মেলায় স্টল দিতে নিদেনপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা তো দিতেই হয়। কুর্তি পিছু কত আর লাভ থাকে। দশ- কুড়ি-তিরিশ টাকা। খুব জোর পঞ্চাশ।"  জানতে চাই,এবারে বিক্রি কেমন হয়েছে? জানতে চাই স্নানাদি কোথায় সারেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে জবাব দেন, ঈশ্বরের কৃপায় বিক্রি মন্দ হয়নি। জানান মেলাতে শৌচালয়ের বন্দোবস্ত করেছে মেলা কমিটি। ওখানেই -। 


চণ্ডীপুর এসে যায়। ' আসছি ' বলে নেমে যান ভদ্রমহিলা। ওঠেন সাদা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি পরা এক প্রৌঢ়। জানতে চান,‘নন্দকুমার যাবি ভাই?’ ড্রাইভার জবাব দেয়, ঐ পথেই তো যাচ্ছি। গাড়ির চাকা গড়ায়। জুৎ করে বসেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসা করেন,‘তুই ঠিক কোথায় যাচ্ছিস বল তো ভাই?’ ড্রাইভার বলে,‘তার্-কেশ্বর যাব চাচা। ঠিক তার্-কেশ্বর নয়, হরিপাল অবধি যাব।’ প্রৌঢ় বলে,‘ আমায় নে যাবি? কত নিবি?’ আমি আর ড্রাইভার একসাথে প্রৌঢ়ের দিকে তাকাই, আপনার দরকার নন্দকুমার,আপনি খামোখা হরিপাল যাবেন কেন?প্রৌঢ় বলে, ‘ওটাই আমার স্বভাব। আমি খালি গাড়ি পেলেই উঠে পড়ি। আমার কোন গন্তব্য থাকে না। গাড়ি যেখানে নিয়ে যায়, চলে যাই। যেখানে ছেড়ে দেয়, বাড়ির পথ ধরি। পথে যা পাই , তাই খাই। রাস্তার কলের পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করি।’ 


মনে হল যেন বুড়ো হিমু বা নীললোহিতের সাথে দেখা হল বুঝি। এমন মানুষ এই হিসেবী, মামলাবাজ জেলায় থাকতে পারে কল্পনাতীত। ভদ্রলোক আরোও কিছু অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে ইচ্ছুক ছিলেন, আমার গন্তব্য এসে যাওয়ায় নেমে পড়লাম। ড্রাইভার কিছুতেই পয়সা নেবে না। নূপুর বাবু নাকি নিষেধ করেছেন। এই লোকটাকে নিয়ে আর পারি না। সামনের লোকটা প্রায় আমার সঙ্গেই উঠেছিল, সে ৭০টাকা দিল দেখে, আমিও তাই সিটে রেখে নেমে এলাম। নিলে নে, না হলে হাওয়ায় উড়িয়ে দে। ড্রাইভার তখনও বলে চলেছে,‘আমায় খুব বকবে ম্যাডাম।’ 


 এখান থেকে আমার আপিস হেঁটে দুমিনিট। আপিসে ঢুকেছি, শ্রীমতী তুত্তুরীর ফোন,‘মা আমি পাশ করে গেছি।’ বিশ্বাসই হল না প্রথম চোটে। কি বলছিস রে বাবু? বিগত নভেম্বরের মাঝামাঝি ভর্তি হয়েছে নতুন স্কুলে। সবার সাথে ভাব জমাতে না জমাতেই এসে পড়েছে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা চলাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্বশুরমশাই। সেই টানাপোড়েনের মধ্যে কিছুই দেখতে পারিনি আমি। বরের কথা তো ছেড়েই দিলাম।


 নিজেই পড়েছে, নিজেই পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটা আমার। দিনান্তে বাড়ি ফিরে আমি কেবল জানতে চেয়েছি, ‘কেমন হয়েছে পরীক্ষা। ভদ্রলোকের এক কথার মত, রোজই "হুঁ, ভালো" বলেছে তুত্তুরী। সত্যিই ভালো বলে বিশ্বাস করিনি যদিও। তুত্তুরী নিজেও করেনি। সন্দেহ প্রকাশ করলেই বলত," রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্টো হ্যায় না মমি। তুম চিন্তা মাৎ করো। পাশ করা দেগা।"  রেজাল্ট বেরানের দুদিন আগে বর যখন বলল, ‘ওটা সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রে মর্কট। এখানে ফেল মানে ফেলই।’ আমাদের মা মেয়ের হৃৎকম্প হয়েছিল। কি হবে, আমার মেয়েটা নতুন ক্লাশে আদৌ উঠবে তো?


 আজ যখন সোচ্ছারে বলছিল তুত্তুরী,‘আমি পাশ করে গেছি মমি। তোমার সাবজেক্ট গুলোতে সব এ আর এ প্লাস পেয়েছি। কেবল বাবার ইংরেজি সাহিত্যটা ভালো হয়নি। বি পেয়েছি। আর ড্রয়িংয়ে বি পেয়েছি।’ সেটাই স্বাভাবিক। চাকরগিরি করার চক্করে, নিজের সাবজেক্ট হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি সাহিত্য ছিটেফোঁটাও দেখেনি তুত্তুরীর বাপ। আর আমার আর শৌভিকের কন্যা আঁকায় ডি পেলেই ধন্য হয়ে যাই আমরা। সেখানে বি তো লটারি পাওয়ার সামিল। বিরাট কোন প্রত্যাশা তো নেই জীবনের কাছে, এমনি করেই যাক না দিনগুলো। এমনিই থাকুক আমার তুত্তুরী মাটির কাছাকাছি। বাকি হিসেব সময় হলে ঠিক মিলেই যাবে।

Wednesday 1 March 2023

অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

পর্ব - ১



আমরা বলতাম, ‘ছিরি।’ আসল নাম যদিও শ্রী। অন্নপ্রাশন থেকে উপনয়ন, এমনকি বাড়ির বড় সড় পুজো- যাবতীয় শুভকাজের অন্যতম উপকরণ এই শ্রী। শ্রী বানাত বটে আমার জ্যাঠইমা, স্বর্গীয়া শ্রীমতী কল্পনা চট্টোপাধ্যায়। শুধু চাটুজ্জে বাড়ি নয়, যাবতীয় আত্মীয়- অনাত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী সকলের কাছ থেকে রীতিমত শ্রী বানানোর বরাত পেত জ্যাঠাইমা। যার বাড়িতে যা শুভকাজ পড়ত, এসে একবার হাঁক পাড়ত শুধু, ‘ডলি দি’। কল্পনা নামটা বোধহয় খোদ জ্যাঠাইমারও আর মনে ছিল না। 


  মূলতঃ চালের গুঁড়ি বা গুঁড়ো দিয়েই তৈরি হয় শ্রী। এখন বারোমাস সহজলভ্য হলেও, তখন পৌষ মাস ছাড়া বাজারে মিলত না চালের গুঁড়ি। ফলে ভোর ভোর চাল ভেজাত জ্যাঠাইমা। জেঠু ছিল সুগার পেশেন্ট। সেই ১৯৮২ সাল থেকে রক্তে মাত্রা ছাড়া শর্করা নিয়ে চলত জেঠু, চড়া ডোজের ওষুধের পাশাপাশি, খাওয়া-দাওয়ার ছিল হাজার খানেক ধরাকাট। বাতে প্রায় পঙ্গু হলেও জেঠুর তত্ত্বাবধানে এতটুকু খুঁত রাখত না জ্যাঠাইমা। নিজে বাজার করে আনা থেকে, পঞ্চব্যঞ্জন রান্না, সুন্দর করে কাঁসার থালা বাটি গ্লাসে সাজিয়ে পরিবেশন,  সবটুকু করত একাহাতে। তারওপর ছিল জেঠুর মিনিটে মিনিটে চায়ের ফরমাইশ। ব্যাঁটরার চাটুজ্জেরা জন্ম -চা-তাল। চায়ের সাথে মেজাজ অনুযায়ী ছোলা- বাদাম ভাজা বা নোনতা বিস্কুট সব কিছু সাজিয়ে মুখের কাছে ধরে, সব সামলে উঠতে উঠতে, সূর্যি মামা আসর গুটিয়ে রওণা দিত পশ্চিমে। আকাশে লাগত রঙের ছোঁয়া। বাতাস মুখরিত হত কুলায় ফিরতে উন্মুখ পাখিদের কলতানে। তখন নিরালায় ঠাকুর ঘরে বসে শ্রী গড়াতে হাত লাগাত জ্যাঠাইমা। 


কাঁসা বা স্টিলের কাঁসির(প্লেট) ওপর নিপুন হাতের কাজে ফুটে উঠত অনবদ্য সব নকশা। মূল কাঠামোটা একই হত, একটা দেউলের মত উঁচু চাউলের মণ্ড, তার গায়ে লাল-লীল-সবজে নক্সা। লাল হত সিঁদুর দিয়ে,নীল বা লীল রঙ আসত রবিন ব্লু দিয়ে। গুঁড়ো হলুদ ধরাত হলদে রঙ। সবুজ কি দিয়ে করত মনে নেই। সম্ভবতঃ কোন গাছের পাতা বেটে। সব হলে ওপর থেকে অকাতরে সর্ষের তেল ঢালত জ্যাঠাইমা। শ্রী নাকি সর্ষের তেলে চুবিয়ে এবং ডুবিয়ে রাখতে হয়। 


যবে থেকে বুল্লু বাবুর পৈতে থুড়ি উপনয়নের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে,কত শত সহস্র বার যে জ্যাঠাইমার নাম উঠেছে। শুধু শ্রী গড়া নয়, চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় নিয়মকানুন যার মগজে তালাবন্ধ ছিল সে ছিল আমার জ্যাঠাইমা। মা আছে, পিসি আছে কিন্তু  নিয়মকানুনের কিছুই ওদের অধিগত নয়। থাকবে কেন? জ্যাঠাইমা জীবিত থাকতে কোনদিন জানার প্রয়োজন পড়েছে নাকি? প্রথম শুভকাজ, জ্যাঠাইমা ছাড়া। যে যা প্রশ্ন করছে, আমরা শুধু ভাবছি। ভাবছি জ্যাঠাইমা থাকলে কি বলত। 


ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল শুভ দিনটা। কাক না ডাকা ভোরের দধি মঙ্গল থেকে সাড়ে নটার গায়ে হলুদ। পর পর হয়েও গেল সবকিছু। এবার বরণের পালা, মাসিমা অর্থাৎ চৈতির মা অর্থাৎ বুল্লু বাবুর দিদিমা আমায় বললেন, ‘শ্রী টা তুমি নাও’। শ্রী? শ্রী গড়েছে নাকি কেউ? তাকিয়ে দেখি অবিকল জ্যাঠাইমার মতই গড়া হয়েছে শ্রীটা। কে গড়ল রে? পাশ থেকে চৈতি বলল,‘ আমার মা খানিক গড়েছিল, বাকিটা ওর বাবা মানে তোমার ভাই (শ্রী অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় ) গড়েছে।’ ভরে উঠল হৃদয়, জ্যাঠাইমা না থেকেও রয়ে গেছে। এইভাবেই তো থেকে যায় আমাদের পূর্বসুরীরা,আমাদের মধ্যে দিয়ে। থেকে যায় তাদের শিক্ষা- সংস্কৃতি, আশির্বাদ। নাঃ কিছুই হারায় না মশাই। কোথাও না কোথাও থেকে যায় সবটুকুই।


পর্ব - ২ 



#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আইবুড়ো ভাত বেশ কয়েকজনকে খাওয়ালেও, অপৈতে ভাত ইতিপূর্বে কখনও কাউকে খাওয়াইনি। সত্যি কথা বলতে কি, এমন যে কিছু আছে তাই তো জানতাম না। আমার মাতৃকুল কায়স্থ, ফলে ওদিকে কারো উপনয়নের গল্প ছিল না। আর পিতৃকুলে যে সব ভাইদের উপনয়ন হয়েছে তা এমন মান্ধাতার আমলে হয়েছে যে কেবল ন্যাড়ামুণ্ডি হওয়া ছাড়া কোন স্মৃতিই তেমন নেই আর। 


কিছুদিন আগে জনৈকা বন্ধুপুত্রের উপনয়নের ছবি দেখতে গিয়ে প্রথম জানতে পারি অপৈতেভাতের কথা। তখনও বুল্লু বাবুর উপনয়ন জল্পনা-কল্পনার স্তরে। কথা প্রসঙ্গে অপৈতেভাতের কথাটা তুলেছিলাম, ব্যাপারটা কি এবং কেন ইত্যাদি। বুল্লুবাবুর জননী ওরফে আমার ভ্রাতৃবধু চৈতি বুঝিয়ে বলল,‘ ও দিদিভাই, পৈতে হলে তো এক বছর আঁশ খাওয়া নিষেধ। মাছ-মাংস- ডিম- পেঁয়াজ কিছুই খেতে নেই। তাই আর কি, সবাই অগ্রিম ডেকে পেট পুরে খাইয়ে দেয়।’ 


 বুল্লুকুমার কি আদৌ এক বৎসর নিরামিষাশী হয়ে থাকতে পারবে? একথা ভাই ভূতেও বিশ্বাস করবে না। তা নাই করুক, আচার বিধি নাই মানতে পারুক, আমি ওকে খাওয়াবই, অপৈতেভাত। সেই মত যবে থেকে দিন স্থির হয়েছে, আমি পর্যায়ক্রমে সবার পিছনে পড়ে থেকেছি। ওরে আয় রে, হবু ব্রহ্মচারীকে একটু পেট পুরে খাওয়াই। 


দেখতে দেখতে,যাচ্ছি- যাব করতে করতে দিন গড়ায়। ২২ তারিখে উপবীত ধারণ করবেন শ্রীমান বুল্লু। ১০ই ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা ফোন করে অয়ন, বুল্লু বাবুর পিতৃদেব। ‘শোন না তোকে নেমন্তন্ন করতে যাব ভাবছি। এই রবিবার।’ শুনে লাফিয়ে উঠি আমি। আয় ভাই,আয়। নেমন্তন্ন না করলেও চলবে, ব্যাটাকে অপৈতেভাতটা খাওয়াই। কিভাবে আসবি, কি ভাবে যাবি এই সব কথায় কথায় জানতে পারলাম, অয়ন ভাবে এখনও বুঝি আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী। ‘কেন? দাশনগর থেকে ট্রেন ধরব। মেচেদায় নামব। না হলে বেলেপোল থেকে ফাঁকা বাস ধরে নেব, নিমতৌড়িতে নেমে পড়ব।’ বলি তারপর? অকুতোভয় অয়ন বলেই চলে, “তারপর আর কি? ওখান থেকে তো তোদের বাংলো হাঁটা পথ।”


হাসি চেপে বলি, একদম হাঁটা পথ। গুগলে বলছে বেশি না তেরো ঘন্টা হাঁটলেই কেল্লা ফতে। “অ্যাঁ?” আঁতকে ওঠে অয়ন। “তোরা এখন কোথায় থাকিস রে?” হোক কাঁথি, তাও বদলায় না পরিকল্পনা। ভোরের তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ধরে এসে হাজির হয় সবাই। রাতের কাণ্ডারী ধরে ফিরে যায়। “নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেছি রে“ মেসেজটা যখন এসে পৌঁছায় তখন মধ্য রাতি পেরিয়ে গেছে। 


ওদের ওপর ব্যাপারটা অকথ্য নির্যাতন হলেও আমাদের যে কি আনন্দে কেটে যায় দিনটা। মনের মত করে বাগানের ফুল তুলে এনে সাজিয়ে দিই বুল্লু বাবুর থালাবাটি। চৈতি আবার দৌড়ে গিয়ে তুলে আনে আরোও কিছু ফুল। একই রকম ভাবে খেতে দেওয়া হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকেও। সকাল থেকে যিনি মুখ ভার করে ঘুরছিলেন আর থেকে থেকে নালিশ করছিলেন, ‘কেন? কেন? শুধু দাদা কেন? কেবল ছেলেদেরই কেন? মেয়েদের কেন পৈতে হয় না?” নালিশ শুনতে শুনতে বিরক্ত হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েক দশক পূর্বে এমনিই এক হিংসুটে মেয়ের কথা। যার পিঠোপিঠি খুড়তুতো ভাইদের যখন পৈতে থুড়ি উপনয়ন হচ্ছিল এমনিই তীব্র ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছিল মেয়েটা। এমনি ভাবেই নালিশ করে বেড়াচ্ছিল তার বাবার পিছন পিছন। আর তার বাবা বলছিল,‘ মেয়েদের যদিও উপনয়ন হয় না, তা না হোক। তোর আমি পৈতে দেবো। ন্যাড়া হবি তো? ভেবে দেখ-”। বুঝতেই পারছেন আশা করি মেয়েটা কে? আর তার রাম-ফাজিল বাপটাই বা কে। চিত্রনাট্য একই থাকে মশাই, সময়ের সাথে সাথে শুধু বদলে যায় কুশীলব। এই যা।




পর্ব - ৩


রাত সাড়ে চারটে। দধিমঙ্গল হবে বুল্লু বাবুর। একদম বিয়ের মতই, সূর্যোদয়ের আগে পেট পুরে দই,চিঁড়ে,সন্দেশ মেখে খেয়ে নিতে হবে। এরপর খেতে পাবে সেই বিকালে, যজ্ঞাদি মিটলে, দণ্ডীঘরে ঢুকে। তাও ডাল-ভাত-মাছ নয়। চরু। চরু জিনিসটা কি, ঠাকুমা বলত বটে, এখন আর বিশদে মনে নেই। পায়েসের মত কিছু একটা। 


এত ভোরে বুল্লু আদৌ উঠতে পারবে কি না, তাই নিয়ে রীতিমত দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমরা। আমি স্বয়ং উঠতে পারব কি না, ভয় ছিল তা নিয়েও। গতকাল কাঁথি ছেড়ে যখন বেরিয়েছি তখনও নটা বাজেনি।হাওড়া ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে গেছে পৌনে ছয়ের ঘর। খুব ইচ্ছে ছিল সকাল সকাল আসার। কিন্তু সাম্প্রতিক সরকারী নির্দেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি তো দূর, অর্ধদিবস ছুটিও অসম্ভব ছিল। তাও বড় সাহেবকে অনুরোধ করে একটু আগে বেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যে থেকে আনন্দনাড়ু ভাজার কথা-


আমাদের যাবতীয় শুভ অনুষ্ঠানের আগের দিন চালের গুঁড়ো, সাদা তিল, নারকেল কোরা, আর আখের গুড় দিয়ে একটা নাড়ু ভাজা হয়। আমরা বলি আনন্দনাড়ু।আমার বিয়ের আনন্দনাড়ু ভেজেছিল আমার জ্যাঠাইমা আর বড় মাসি মিলে। নিমন্ত্রণ করতে এসে বুল্লুর বাপ অর্থাৎ অয়ন অনুরোধ করেছিল এসে নাড়ু ভাজায় হাত লাগাতে। এই নাড়ু সবাই ভাজতে পারে না। যাদের পরিবারে এই নিয়ম আছে, কেবল তারাই নাকি হাত লাগাতে পারবে। নিকটাত্মীয় কারোরই তেমন নেই, যাদের আছে তাদের সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে। অয়ন সাগ্রহে আমার কাছে জানতে চাইল, ‘তোদের আছে তো?’ 


আমাদের অর্থাৎ ভটচায বাড়ির? কখনও তো দেখিনি বা শুনিনি। কাকে শুধাই? আমার বরের মতই আমার শ্বশুরমশাই জন্ম নাস্তিক। শাশুড়ীমাতাও তেমন নিয়ম জানেন না। ফলে আমি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আজও চাটুজ্জে বাড়ির নিয়মই অনুসরণ করি। বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত ফোন করলাম ছোট খুড় শ্বশুরকে। শৌভিকের ছোটকাকার থেকেই আমি জেনেছিলাম আমাদের গোত্র কি। এটাও নির্ঘাত উনিই বলতে পারবে। ভদ্রলোককে ওণার ভ্রাতুষ্পুত্ররা মোমো বলে সম্বোধন করে, আমিও তাই বলেই ডাকি। প্রশ্ন করলাম, ‘হ্যাঁ গো মোমো, আমাদের আনন্দনাড়ু আছে?’ প্রথমে তো বললেন না। তারপর খানিক ভেবে বললেন, এটা কি সেই চালের গুঁড়ি আর তিল দিয়ে বানায়? আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, হ্যাঁ,হ্যাঁ। ওটাই। ওটাই। আছে কি আমাদের কুলে? মোমো খানিক মাথা চুল্কে বলল,‘হত তো আগে। তবে ওকে আনন্দনাড়ু বলে কি না জানি না। দাঁড়া তোর কাকিমার সাথে কথা বল।’ ছোট খুড়ি শাশুড়ি মাতা অভয় দিলেন, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাদের আছে। আমাদেরও আনন্দনাড়ুই বলে। তুই নির্ভয়ে ভাজগে যা।’ 


নিয়ম যতই থাকুক, সরকারী চাকরবৃত্তি করলে কি আর ওসব হয়। ভাগ্যে চৈতির(বুল্লুর মা) মেজ পিসি এসেছিলেন,ওণাতে আর আমার মায়ে মিলে যখন কড়ায় নাড়ু ছাঁকতে শুরু করেছেন তখন গিয়ে পৌঁছালাম আমি। নাঃ কেউ কথা রাখে না, এমনকি আমি নিজেও না। 


পুনশ্চ - ধুতিটা কিন্তু বুল্লু বাবু নিজেই পরেছে। ঘুম চোখে এত অল্প বয়সে, এত ভালো করে ধুতি পরতে আমি আজ অবধি কাউকে দেখিনি। ❤️❤️


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৪


ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুত্তুরীকে বলে শুয়েছিলাম, মাত্র পনেরো মিনিট শোব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি, সোয়া ছটা বাজলে ডেকে দিস তো। তুত্তুরী ডেকেছে, তার ওপর ভরসা না করে সেট করে রাখা মোবাইলের অ্যালার্ম তো বেজে গেছে,আমি শুনতে পাইনি। নিথর হয়ে ঘুমিয়েছি কে জানে কতক্ষণ। শীত বিদায় নেবার সাথে সাথেই যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে পথশ্রমের ক্লান্তি। পথশ্রমে কেন যে ক্যালোরি পোড়ে না ভগবান জানে। এত লম্বা লম্বা দূরত্ব গ্যাঁট হয়ে বসে পাড়ি দিই, তাও একটুও কমি না মাইরি। উত্তর-মধ্য-অন্ধ্র যাবতীয় প্রদেশের আয়তন ক্রমবর্ধমান। 


সাতটা নাগাদ কোন মতে নিজেকে চাগিয়ে তুললাম সুপ্তির অতল খাদ থেকে। ঘর ফাঁকা। পাশ থেকে মোবাইলটি হাতিয়ে কখন সটকে পড়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাইরে থেকে ভেসে আসছে শানাইয়ের মধুর আওয়াজ। সদর দরজার মাথার ওপর ঝলসাচ্ছে ঝর্ণা আলোর রোশনাই। স্বর্গীয় ছোটকাকুর বসার ঘর, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের কলকাকলি। গোটা বাড়িটার গায়ে আজ লেগেছে উৎসবের ফাগ। সদ্য ভাজা আনন্দ নাড়ুর সৌরভে মম করছে চারিধার। চৈতির মেজোপিসির সঙ্গে সই পাতিয়েছে আমার মা। কি খোশগপ্পই যে করছে দুই জনে, সবাইকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দুই বৃদ্ধার কলতান। অবশ্য বৃদ্ধা বললে পিসিমা হয়তো লাঠির বাড়ি আমাকে দিতেও পারেন দুয়েক ঘা। 


এও যেন এক রূপকথা। বুল্লু বাবুর উপনয়নের আনন্দনাড়ু ভাজছে তার মেজ জেঠঠাকুমা আর মেজো পিসিদিদা। আজকালকার দিনে কটা ছেলে/মেয়ের এমন সৌভাগ্য হয়। এত কিছু ভেবে আরোও ঘুম পেয়ে গেল যেন, কোন মতে টলতে টলতে বাবাকে গিয়ে বললাম,‘ যা যা করার কাল করব কেমন? আরেকটু ঘুমাই, কেমন বাবা?’ 


যা যা করা বলতে, বেশ অনেককিছুই করার আছে, যেমন ধরুন মায়ের ব্লাউজ কেনা। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মায়ের ব্লাউজ কেনার কাজটা বোধহয় আমি নবম বা দশম শ্রেণী থেকে করে আসছি। হাওড়া ময়দানের যাকে বলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন হাওড়া দি বসাক ব্রাদার্স ছাড়া অন্য কোন দোকানের ব্লাউজ মায়ের কোনদিন পছন্দ হয়নি। উৎসবে অনুষ্ঠানে বসাকে খুনোখুনি করার মত ভিড় হয়, তাও আমায় যেতে হত এবং হয় মায়ের শাড়ি বগলে। শুধু যে মারামারি করে কিনে আনব আর মিটে যাবে তা কিন্তু নয়। রঙমিলান্তি একটা বড় চাপের ব্যাপার। নীল মানে এমন নয়, অমন নীল। সবুজ পানে হলুদ নয় ইত্যাদি প্রভৃতি। ধরুন ঐ পরীক্ষাতেও আমি পাশ করে গেলাম, তারপর মা নাক সিঁটকাবে, ‘কাপড়টা কি? রুবিয়া? ভয়েল? অরবিন্দ মিল?’ ধরুন এটার জবাবও আমি দিতে পারলাম। এরপরের প্রশ্ন, ‘এঃ হাতাটা কত বড়/ছোটরে। এ চলবে না পাল্টে নিয়ে আয়।’ শুধু কি হাতা? ‘পিটটা এত কাটা কেন? এটা কি প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস?’ মায়ের পৃথিবীতে এই একজনই আছেন যিনি খোলামেলা পোশাক পরেন। অন্য কারো নামধাম আমার মায়ের কোন কালে মনে পড়ে না। সবকিছুতেই এটা তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস বলে নাক সিঁটকায় মা। আবার যদি পিঠ ঢাকা ব্লাউজ আনি তো, শুনতে হয়,‘এটা কি এনেছিস?এটা পরে তো আমার গরমে ঘামাচি বেরিয়ে গেল।’ আরোও আছে, হুক গুলো এত বাজে ভাবে বসানো কেন? সেলাই করেছে দেখ যেন মানুষ সেলাই করেছে ইত্যাদি প্রভৃতি। 


দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজ করছি তাও আজ পর্যন্ত একটাও মায়ের মনোমত ব্লাউজ আনতে পারিনি। যবে থেকে পৈতের দিনস্থির হয়েছে রোজ ফোনে একটাই কথা বলে যাচ্ছে মা, ‘আমায় একটা ব্লাউজ কিনে দিস তো। পৈতের দিন পরব।’ বসাক ব্রাদার্স খোলে বেলা বারোটার পর। ফলে কাল সকালে বেরিয়ে কিনে আনতে আনতে আর মায়ের পরা হবে না। দুচোখে পাঁচ কেজির বাটখারা চাপানো, কিন্তু হৃদয়ে যে কাঁটা ফুটছে। মেয়েটাও কাল শাড়ি পরবে। ওর আপাততঃ একটাই ব্লাউজ। ও মহানন্দে তাই পরতে রাজি হয়ে গেছে যদিও। কিন্তু আমি মা হয়ে সেটা কেমনে হতে দিই। 


সাড়ে সাতটার সময় শেষে থাকতে না পেরে, গুগল করে ফোন নম্বর বার করে, ফোন করেই ফেললাম বসাক ব্রাদার্সে। চেনা কণ্ঠ বলল, আটটায় বন্ধ হয়ে যাবে। ঊর্দ্ধশ্বাসে পোশাক বদলে দৌড়ালাম। দৌড়ানোর আগে বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম ভিক্ষা দেবার সরঞ্জামের তালিকা। হবু ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষা দেবে মা। এই ভিক্ষার থালা এবং উপকরণ নিয়েও কয়েকদিন ধরে দাম্পত্য যুদ্ধ চলছে আমাদের গৃহে। বাবা চায় কাঁসার থালা। মায়ের মত স্টিল। কাজে আসবে। কাঁসা আজকাল কেউ ব্যবহার করে নাকি? 


প্রথম রাউন্ডে অবশ্য বাবা জিতেছে। কাঁথি থেকে বড় কাঁসার থালা কিনে বাবু অভিজ্ঞান চট্টোপাধ্যায়ের নাম এবং উপনয়নের দিনটির বাংলা তারিখ লিখিয়ে দিয়ে গেছি আমি আগেই। সে কি কেলেংকারি। কার্ডটা না নিয়েই দোকানে চলে গেছিলাম আমি। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছি লিখে দিন মাঘ, ১৪২৯। বাংলা সাল নির্ণয় আমার বরাবরই নিখুঁত কিন্তু তারিখ সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। দোকানদারই বললেন, ‘ম্যাডাম তারিখটা ফোন করে জেনে নিন না। তারিখ সমেত লিখি, ভালো লাগবে।’ ফোন করে জানতেও চাইলাম বুল্লুর বাপের কাছে। সে তখনও অফিসের কাজে ব্যস্ত। বলল,‘বাড়ি গিয়ে তোকে রাতে জানাচ্ছি।’ অত রাত অবধি কাঁথির দোকান খোলা থাকবে নাকি? দোকানদারই শেষে কোথা থেকে ছেঁড়া বাংলা ক্যালেণ্ডার যোগাড় করে লিখে দিল ৯ই ফাল্গুন,১৪২৯। 


যাই হোক,থালার যুদ্ধে বাবা জিতলেও,ভিক্ষা সামগ্রীর যুদ্ধে মাই জিতেছে শেষ পর্যন্ত। বাবা যদিও সহজে হার মানেনি। রীতিমত পুরোহিত মহাশয়কে ফোন করে জেনে, একগাল মাছি হওয়া সত্ত্বেও টুকে রেখেছে কি কি আনতে হবে। ব্লাউজ পর্ব সফল ভাবে মিটিয়ে গেলাম কদমতলা বাজারে। সেখানে তখন বিশাল ভীড়। পত্নীসহ বিসর্জনে চলেছেন ভোলেবাবা। উদ্দাম ঢাক ঢোল বাজাচ্ছে ভূতপ্রেতের দল। বাতাসে ফুরফুরে গাঁজার সৌরভ। পাশকাটিয়ে যাওয়া দুষ্কর।


 কোনমতে চাল, ফল,মিষ্টি, হরিতকী, পৈতে ইত্যাদি বগলে যখন টোটোয় উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁইছুঁই। আমার উল্টোদিকে আমারই মত কেউ বসে আছে, তারও মুখেচোখে সারাদিনের পরিশ্রম আর শ্রান্তির কালিমা। সহমরমি দুই জোড়া ঢুলুঢুল চোখ একে অপরের ওপর পড়তেই ঝলমলিয়ে উঠল যেন শহরটা। আরে এতো আমাদের অদিতি। দুইজনেই ‘তারাসুন্দরী’, দীর্ঘদিনের সহপাঠী। 


আমাদের বিদ্যালয়ে পদবীর প্রথম অক্ষর ধরে বিভাগ নির্ধারিত হত। যেমন আদক থেকে দাসেরা ক বিভাগ। আবার মণ্ডল,মুখার্জী, নন্দীরা গ বিভাগ।আমি চাটুজ্জে তাই আমার সেকশন ছিল এ আর অদিতি লাহা ছিল বলে সম্ভবতঃ বি। জীবন বড় নির্মম, স্কুলের নিরাপদ পরিমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর সময়ের অভিঘাতে ক-খ-গ-ঘ সব মিলেমিশে একাকার। গোটা রাস্তা স্কুলের মেয়েদের মতই কলকল করতে করতে এলাম আমরা। একে অপরকে শোনালাম, “-- কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা।” নিজেরাই তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমরা কি সত্যিই এতটাও সবলা ছিলাম! শৈশবে বুঝিনি তো। বুঝলেই বা কি হত? অন্যরকম হত কি জীবনটা? লেখা হত অন্য কোন গপ্প? নাঃ মশাই, এই বেশ ভালো আছি। 


ঝাউতলায় নেমে গেল অদিতি, ‘তোর ভাড়াটা দিয়ে গেলাম,তুই আবার দিতে যাস না। আর একদিন মিট করি চল -’ বলে। আবার খানিক ঝিমিয়ে পড়ল যেন বুড়ো শহরটা। গোটা পাঁচেক ব্যাগ বগলে লটরপটর করতে করতে বাড়ি পৌঁছে দেখি বুল্লুর বাপ বসে আছে আমারই প্রতীক্ষায়। সুসংবাদ দিলেন। কাল সকাল চারটের সময় উঠতে হবে। সূর্যোদয়ের পূর্বে বুল্লুবাবুকে দধিমঙ্গলে বসতে হবে। প্রয়োজন তিনজন এয়োস্ত্রীর। বুল্লুর মা-দিদিমা ছাড়া অপর ভাগ্যবতী আমি। যৎপরনাস্তি পুলকিত হয়েও খেয়াল হল, এই রে পট্টবস্ত্র পরতে হবে তো।সাকুল্যে এনেছি তিন সেট জামাকাপড়। একটা পরে এসেছি এবং বাজার গেছি। অন্যটা পরে রাতে ঘুমাব আর তৃতীয়টা কাল অনষ্ঠান বাড়িতে পরব। অপারগতা জানিয়ে বললাম,‘মাকে নিয়ে যা না।’ সিঁড়ি ভাঙার নামে ককিয়ে উঠল মা। আর অয়নও নস্যাৎ করে বলল,‘মানার (আমার মা এবং অয়নের জেঠিমা) একটা শাড়ি পরে নিবি। আমি তোকে চারটের সময় ফোন করব।’ 


অয়নের ফোনের ভরসায় না থেকে ভাগ্যে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। আমি উঠলাম, মায়ের কাচা শাড়ি পরলাম, মুখ ধুলাম,মাথায় গঙ্গা জল ছিটালাম, বাইরে রোয়াকের আলো জ্বালালাম,তালা খুললাম,মোবাইলে ফেসবুকও দেখে ফেললাম প্রায় মিনিট বিশেক কেউ ডাকে না। শেষে বিরক্ত হয়ে আমিই ফোন করতে গেলাম, ওরা আদৌ উঠেছে কি না জানতে। এদিকে চারটে সাঁইত্রিশ বাজে। ফোন করতে গিয়ে দেখি আমার ফোনটাই চমকে বসে আছে। ফোন যাচ্ছে না অর্থাৎ আসছেও না। সাহস করে দরজা খুলে উঠোনে যখন নেমেই পড়লাম উল্টোদিকের বারন্দা থেকে অয়ন বলল,‘তুই উঠেছিস? আমি তো ভাবছি মেজ জেঠু উঠে আলো জ্বেলে সিগারেট খাচ্ছে বুঝি।’ বোঝ কাণ্ড। আমায় যে কেন কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। শাশুড়ি মাতা যথার্থই বলেন, "বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।"


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫



পেশাদার চিত্রগ্রাহিকা বলেছিলেন, "গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা বাইরে করুন না।প্লিজ।" চৈতি বলল, " কেন?সব যোগাড় তো এই ঘরেই করা হয়েছে।" মেয়েটি বলল, " আসলে বাইরে তুললে প্রেক্ষাপটটা বেশ ভালো আসত। এখানে 🫤।" চৈতি কখনও গলা তুলে কথা বলে না। হুকুম করে না। তবে সেই মুহূর্তে চৈতির কণ্ঠ স্বরে ফুটে উঠল, এক অদ্ভুত ঋজুতা। " না এখানেই তুলুন। পিছনে এই ছবি দুটো যেন থাকে।" যাঁরা চেনেন না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ছবি দুটি হল আমার স্বর্গীয় ছোট কাকু এবং কাকিমা অর্থাৎ অসিত কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং কণিকা চট্টোপাধ্যায়ের। চৈতির শ্বশুর শাশুড়ি এবং বুল্লু বাবুর পিতামহ এবং পিতামহী। দুজনেই নেই আজ বেশ অনেক গুলো বছর।


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫


আমার জননী এবং আমার কন্যা। দুজনকেই সাজানোর কৃতিত্ব এই অধমের। দ্বিতীয় জন সানন্দে সাজুগুজু করে নিলেও,প্রথম জনকে সাজাতে হয়ে গেছে একখানা ছোট্টখাট্টো কুরুক্ষেত্র। আমার মায়ের বক্তব্য হল,‘সাজবি তো তোরা। আমি বুড়ো মানুষ, খামোখা আমায় নিয়ে টানাটানি কেন?’ বললেই হল? কমলি কি অত সহজে ছাড়ে? আর এক্ষেত্রে কমলি তো আর সংখ্যায় একটা নয়। 


বিগত সপ্তাহান্তে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে হাওড়া ছাড়তে গেছি, সদর দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি মায়ের রাগত কণ্ঠস্বর। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও আমার তিরাশি পেরোনো বাপ গিয়ে পাড়ার দোকান থেকে কিনে এনেছে চুলের রঙ। বুড়ি মেজ জেঠিকে রোয়াকে বসিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাই লাগিয়ে দিচ্ছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন। মা দিব্যি রোদে বসে মাথায় কলপ থুড়ি রঙ করছে এবং চাটুজ্জে গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করছে। দেখে মন ভরে গেল। প্রতিনিয়ত ভাগ্যের কাছে কতই না অভিযোগ করে মা হাঁটুর ব্যথা, অবসাদ, আমার বাড়ি থেকে বহুদূরে পোস্টিং, বাবার মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট খাওয়া, খকখকে কাশি ইত্যাদি প্রভৃতি। যা নেই তার শোকে মা যে কেন দেখতে পায় না, আদতে মা কত ধনী। মায়ের সম্পদ নিক্তিতে মাপা যায় না, এই যা। 


চুল তো হল, এবার পোশাকের পালা। কিছুতেই ভালো শাড়ি পরবে না মা। এমন একখান শাড়ি পরল যেটা ২০১৩ সালে আমিই এনে দিয়েছিলাম আগ্রা থেকে। বাঁশ না কলার খোসা কি দিয়ে যেন তৈরি শাড়িটা। ১৪০ না ১৫০ টাকা দাম নিয়েছিল যেন। একেবারে ন্যাতা এবং জ্যালজেলে শাড়ি। উৎসব বাড়িতে অন্য সবার ঝকমকে পোশাকের পাশে আমার মা প্রায় অদৃশ্য। অতঃপর রীতিমত খণ্ডযুদ্ধ, শ্রীমতী তুত্তুরীর গ্যালন খানেক অশ্রুপাতের পর নমনীয় হল মা। ভালো শাড়ি পরবে বটে, তবে তা যেন ভারি না হয়। হলহলে সিল্কের না হয়। চকরাবকরা না হয়। ইত্যাদি,প্রভৃতি। ভদ্রমহিলার নক্সা কি কম। 


অনেক ভেবে চিন্তে জ্যাঠাইমার দেওয়া এই শাড়িটা বার করলাম। আইবুড়ো ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা এই শাড়িটা দিয়ে। শাড়িটা আমার ভয়ানক,ভয়ানক পছন্দ ছিল। মহানগরে পোস্টেড থাকাকালীন যতবার মাননীয়ার প্রোগ্রাম হয়েছে আর আমার স্টেজ ডিউটি পড়েছে, এই শাড়িটাই পরে গেছাি আমি। বারবার। লাগাতার। কে বলবে শাড়িটার বয়স ১৪ বছরেরও বেশী। 


আর শ্রীমতী তুত্তুরীর শাড়িটার বয়স কত বলুন তো? পাক্কা ২৪বছর। দাদার বিয়েতে পাওয়া। জীবনে প্রথম বার ননদ হিসেবে কিছু পেয়েছিলাম। দাদা বৌদির ফুলশয্যার তত্ত্বে নিজের নাম দেখতে পাওয়া, সে যে কি আনন্দ, ভাষায় অপ্রকাশ্য। বউদির বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো উপহার,তাই কেবল বৌদির অনুমতি নিয়েই ট্রেটা তুলে নিয়েছিলাম। তখনও আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক। আরো অনেকের অনুমতি নেওয়া উচিৎ মাথাতেও আসেনি। ছোট থেকে জানি,চার দাদার একমাত্র বোন আমি। গুরুজনরা যে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তা বোঝার মত পরিপক্কতা আমার ছিল না। ওনারা যদি একবারও বলতেন, আমি নিতাম ও না। সবটাই ছিল এক নাবালিকা তরুণীর নিছক আনন্দ।      


যাঁরা সমালোচনা, পরচর্চা করেন,তাঁরা তো বেশ রসিয়ে আলোচনা করেন, যাদের নিয়ে করেন,ব্যাপারটা তাদের কাছে যে কতটা বেদনার তা বোঝেন না। আর কখনও কারো বিয়ের পর কিছুতে হাত দিইনি। আমার নাম লেখা ট্রে হলেও না। বৌদিরা ডেকে, ভালোবেসে হাতে তুলে দিয়েছে, মেজ বৌদি তো ট্রে বগলে চলেই এসেছে আমাদের বাড়ি। তাও হাত বাড়িয়ে নিতে কেঁপেছে হাত। আবার না কেউ কিছু বলে বসে। আবার না মাকে শুনতে হয়, 'মেয়েকে কোন শিক্ষা দিসনি।' এমনও হয়েছে,ট্রে খুলে আসে পাশে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছি বডি স্প্রে,পাউডার, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি। তাও মোছেনি দাগ। তাও ভরেনি ক্ষত। এমনও ভাবতাম যে, যেদিন বেকারত্ব ঘুচবে, বেতন পেয়ে সব কিছু দুটো করে কিনে প্যাক করে ফেরত দিয়ে আসব। যেদিন সত্যিই রাইটার্স বিল্ডিং এর কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ অবর বর্গীয় সহায়কের চাকরিটা পেলাম, প্রথম বেতন হাতে এল, ৬০৩৬ টাকা। ততোদিনে কেটে গেছে সাত বছর। বেড়েছে পরিপক্কতা। সেদিন মনে হল, যদি সত্যিই ফেরত দি, তাহলে সেদিন যারা সমালোচনা করেছিলেন তাদের আদৌ কিছু যায় আসবে না। অপমানিত হবে আমার বৌদি আর তার পিতামাতা। তাঁরা তো একদিনের জন্যও কিছু বলেননি। তাঁরা তো বরং বারবার ভালোবেসে জানতে চেয়েছেন, আমার কেমন লেগেছে শাড়িটা। কতটা পছন্দ হয়েছে তত্ত্ব ইত্যাদি। 


 ভীষণ পছন্দ হলেও, অভিমান করেই বহুদিন পরিনি শাড়িটা। তোলা ছিল আলমারির কোণে, নরম কাপড় মুড়ে। ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়িটার কথা।দাদার উপনয়নে শাড়ি পরার অনুমতি পেয়ে আহ্লাদিত শ্রীমতী তুত্তুরীই খুঁজে বার করেছিলেন শাড়ি খানা। ভেবেছিলাম পাটে পাটে ফেঁসে গেছে বুঝি। মেয়েকে পরাতে গিয়ে দেখলাম আজও নতুন আছে শাড়িটা। নাহ্ এ তো সুন্দর শাড়িটার ওপর অভিমান করাটা আমার মস্ত ভুল হয়েছে। শাড়ি গুলো তো নিছক শাড়ি নয়, প্রতিটা শাড়ি আসলে একেকটা ইমোশন। প্রতিটা শাড়িই আসলে একটা উপন্যাস।


অনির ডাইরি, ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


এখন অনেক রাত। আজ আমার বাড়ি ফাঁকা। পরীক্ষা শেষে দাদু-দিদার কাছে গেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। ঘুম আসছে না, ইন্সটাগ্রামে নিয়মিত ফলো করি এমন একজন যশস্বী আর্মেনিয়ান সুন্দরীর ডায়েট আর ব্যায়ামের ব্যাপারে বিশদে পড়াশোনা করলাম। মাত্র তিন সপ্তাহে সাত কেজি ওজন ঝরিয়ে দুনিয়াকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছে সুন্দরী। দেখলাম কার্বোহাইড্রেট প্রায় খানই না। কেবল বেকন, এগস্ আর গ্রীন জুস্, গ্রীন কফি ইত্যাদি খান এবং পান করেন। ব্যায়ামের চার্টটা তো আরো সাংঘাতিক, কতকিছু করেন, বাপরে! সবই আবার ২০/৩০ খানা রিপিটিশন। সাধে কি ত্বকে পিছলে যায় প্রভাতী সূর্যের সোনালী রশ্মি। উন্মুক্ত কটিদেশের ভাঁজে স্বছন্দে রাখা যায় টলটলে সোমরসের গ্লাস। 


পড়তে পড়তে মনে পড়ল, খাবার ঘরের তাকে এক প্যাকেট ঝুরি ভাজা দেখলাম না? রাতের রান্না করে যে ছেলেটি, দিনের বেলা একটা দোকান চালায়। তার দোকানের ঝুরি ভাজা। বড়ই সুস্বাদু। মটর ডালের বেসন দিয়ে, খাঁটি সর্ষের তেলে ভাজা। ভাবতেই টপ্ করে এক ফোঁটা জল পড়ল মুঠি ফোনের স্ক্রিনে। বিদায় সুন্দরী। কাল সকালে আবার দেখা হবে। আপাততঃ অভিসার "ঝুরি ভাজা।"


পা টিপে টিপে পেরিয়ে গেলাম গেস্ট রুমের বন্ধ দরজাটা। ঘরটা অন্ধকার বটে, ভিতর থেকে ভেসে আসছে মৃদু আফ্রিকান সঙ্গীতের সুর। সপ্তাহান্থে গৃহকর্তা  আপাততঃ মগ্ন সঙ্গীত সুধা পানে। এমন সময় ডাকাত পড়লেও তাঁর টনক নড়ার কথা নয়। নিশ্চিন্ত হয়ে আরো কয়েক কদম এগিয়ে গেলাম। সামনেই খাবার ঘরের চৌকাঠ। ডিঙোতেই যাব, এমন সময় বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে এল জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর,‘ কিচ্ছু খাবি না কিন্তু।’ 


ধ্যাৎ তেরি। বিদায় ঝুরি ভাজা। আপাততঃ অন্ধকার ঘরে বসে প্যাচেলবেল ক্যানন ডি শুনছি। মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছে শৌভিক, ‘চোখ বন্ধ করে শোন। ভদ্রলোক বাখের পূর্বসুরী। এঁর এই একটাই কম্পোজিশন পাওয়া গেছে। আরো কিছু আছে, কিন্তু সেগুলো ওণারই কি না বলা মুস্কিল। কিন্তু এটা মাস্টার পিস্। শুনতে শুনতে নেশা ধরে যায়। এরপর তোকে চ্যারিয়টস্ অফ ফায়ারের থিম সং শোনাব। কম্পোজারের নাম ভ্যাঞ্জেলিস্। কতবার, কত সিনেমায় যে ব্যবহার হয়েছে মিউজিক'টা।’ শুনতে শুনতে চোখের সামনে সত্যিই ভেসে উঠছে খোলামেলা পোশাকে সিক্ত সোনু ওয়ালিয়া আর কবির বেদী। সিনেমার নাম খুন ভরি মাঙ্গ। " ম্যায় তেরি হুঁ জানম, তু মেরি জিয়া"। দূরদর্শন বরাবর কেটে দিত গানটা। 


ঘড়ির কাটা রাত একটা ছাড়ালো। জেবিএলের স্পিকারের দখল নিয়েছেন রাহত ইন্দোরী, এ আর রহমান আর সোনু নিগম্। “জিন্দেগি হাত মিলা, সাথ চল্, সাথ মে আ। উম্র ভর সাথ রহি, দো কদম অউর সহি। দো কদম অউর সহি---- ।"  রাত গড়াচ্ছে। জানলার বাইরে, কাঠগোলাপ গাছের ফাঁকে ছুটোছুটি করছে জোনাকীর দল। প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান ধরেছেন, “গিয়েছিলাম ফুলের হাটে,তোমারই জন্য।” আচ্ছা আজ কি, ভালোবাসার দিন?  আজ কি, ভ্যালন্টাইন্স ডে? কে জানে, গুলিয়ে যাচ্ছে সব হিসেব। প্রতুল মুখোপাধ্যায় গেয়েই চলেছেন, ‘---রাত তো থমথম্। আমরা ধান কাটার, গান গাই। আমরা তাঁত চালাই, গান গাই। আমরা প্রাণ বাঁচাই, চেষ্টা করবই। আজকে জোর কদম চলচল। আজকে হাত মিলাই ভাইভাই। ভাঙব এই শেকল গাঁয় গাঁয়।” বলি ওহে আর্মেনিয়ান সুন্দরী, তোমারও কি আছে নাকি এমন রাত? থাকলে ভালো। না থাকলে চলো ভাই, ঝুরি ভাজা খাই, অবশ্য যদি অনুমতি পাই।

অনির ডাইরি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


কত আশা নিয়ে বাবাকে শোনাতে গিয়েছিল তুত্তুরী,‘ জানো তো বাবা, ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিন না কাউ হাগ ডে ঘোষিত হয়েছে।’ গম্ভীর মুখে শৌভিক বলেছিল,‘হুঁ, সেই জন্যই তো মা তোকে ভ্যালেন্টাইন বানাবে ঠিক করেছে।’ শুধু কি তাই, যেদিন বাতিল হল গো-আলিঙ্গন দিবস, রাতে খেতে বসে খবরটা জানালাম আমি, জবাব এল, ‘ যাঃ! ঐদিন তোর ছানাটাকে হাগ করব ভেবেছিলাম যে-’। 


এমন লোককে কি আদৌ ভালোবাসা যায়? এর থেকে বাপু আমার তুত্তুরীই ভালো। মুখ ফসকে সেটা বলে ফেলাই কাল হল। বিগত সপ্তাহ দুই ধরে আমার পিছনেই পড়ে ছিলেন তিনি। পাকেচক্রে আবার তাঁর পরীক্ষাও শেষ হয়েছে গতকাল।


 মধ্যরাত্রে অতর্কিতে চমকে দেবার ইচ্ছা থাকলেও উপায় খুব একটা ছিল না। গোলাপ, বাগানে প্রচুর ফুটে থাকলেও, মনের মত কেক, ভালো চকলেট, সুরভিত মোমবাতি বা উপহার দেবার মত পছন্দসই কিছু খুঁজেই পাচ্ছিলাম না আসে পাশে। মহানগর থেকে দূরত্বটা এতটাই বেশী যে টুক করে একবার ঘুরে আসব তারও কি যো আছে। আর জীবন ইদানিং এতটাই গতিময় যে এরপর আরোও সাত-আট ঘন্টা অতিরিক্ত সময় বার করার কথা ভাবলেও ক্লান্ত লাগে।  


অগত্যা অনলাইনই ভরসা। একটি একটি করে পার্সেল আসে, একটু একটু করে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন শ্রীমতী তুত্তুরী। প্রথমবার মুখ ফসকে বলে ফেললেও, তারপর মুখে চাবি লাগাই আমি। যাই আসুক, তা আমার জন্য আসছে বলে দাবী করতে থাকি। তাও সন্দেহ ঘোঁচে না তাঁর। বাবার সঙ্গে চলে ফিসফিসিয়ে মন্ত্রণা, ‘মায়ের পেট থেকে খবরটা বার করো তো।’ 


নাঃ খবরটা শেষ পর্যন্ত কেউ বার করতে পারেনি। গতরাতেও তুত্তুরী ঘ্যানঘ্যান করছিল,‘তুমি বলেছিলে আমায় ভ্যালেন্টাইন বানাবে। বাবা বলেছিল আমায় হাগ করবে।’ নির্বিকার চিত্তে নেটফ্লিক্স দেখছিলাম আমি। ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিইনি যে শৌভিকের বাংলো চেম্বারের ফাইল রাখার আলমারিতে লুকানো আছে অরূপকে দিয়ে আনানো, তুত্তুরীর নাম লেখা রেড ভেলভেট কেক। বা বুকশেল্ফের পিছনে লুকানো আছে বাপ-বেটির উপহার। বা আমার হাত ব্যাগে লুকানো আছে আমাদের কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্যর লিখে দেওয়া ভালোবাসা মাখা শুভেচ্ছা বার্তা। 


সাড়ে এগারোটা নাগাদ একবার উঁকি মারতেও এসেছিল শৌভিক, এতরাতে বাংলো চেম্বারে বসে কি করছি আমি। নেটফ্লিক্সের গাঁকগাঁক আওয়াজ শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেছে। পুনরায়  মনঃনিবেশ করেছে কি যেন ভুটানি সিনেমায়। অস্কারের জন্য মনোনীত প্রথম ভুটানি সিনেমা নাকি, বার কয়েক শুনিয়েও গেছে। মন খারাপ করে শুয়ে পড়েছিল তুত্তুরীও। যদিও উসখুসানির আওয়াজ দিব্যি পাচ্ছিলাম কোণের ঘর থেকে। 


রাত বারোটায় যখন বাপ-বেটিকে ডেকে আনলাম, খুশি উপচে পড়ছিল অভ্যন্তরে, মুখে যদিও এমনি ভাব যে এটাই তো হবার কথা। সবই তো জানত দোঁহে। এটাই ভটচায বাড়ির বৈশিষ্ট্য। শ্বশুরমশাই এবং তাঁর পুত্র, পৌত্রী বর্গ সবকটা এমনিই। শান্ত, পরিশীলিত,সংযত। সাধে রেগে আগুন, তেলে বেগুন হয়ে যান শাশুড়ি মাতা। এই যদি আমরা চাটুজ্জেরা হতাম, দেখতেন উল্লাস কাকে বলে। পাশের হাউজিং এর লোকজনের ঘুম চটকে যদি না দিতাম, আমরা ব্যাঁটরার চাটুজ্জেই নই। 


যাই হোক, অনি,শৌভিক আর তুত্তুরীর পক্ষ থেকে  সকলকে ভালোবাসার দিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।  আজ গো আলিঙ্গন দিবস হোক না হোক, পুলওয়ামার শহীদ দিবস তো অবশ্যই। কে জানে আরো কত কি দিবস আজ। সবকিছুই হোক,সবকিছুই চলতে থাকুক। আর সবার মাঝে মাথা উঁচু করে বাঁচুক ভালোবাসা। কারণ ঐ যে তিনি গেয়ে গেছেন না, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?’