Thursday 12 May 2022

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০১৮

 

“বললাম, গাড়ি করে যাই-” গজগজিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছেন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দম্পতি, বৃদ্ধর বয়স সম্ভবতঃ আশির দোরগোড়ায়, বৃদ্ধাও সত্তরোত্তীর্ণা। একজনের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম,অপরের টকটকে ফর্সা। বৃদ্ধা উঠেই হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন, হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধও মুখে যদিও দুষ্টু হাসি। রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে লাগলেন মুখ। 

হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন,“বললাম, গাড়ি ভাড়া করো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাই, তা নয় ট্রেনে চল।” বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন,“গাড়ি ভাড়া করলে হাজার টাকার ধাক্কা, তারওপর ছ ঘন্টা কেটে গেলেই শালারা বারো পনেরো যা খুশি চায়। চলো না, ট্রেন চললেই হাওয়া আসবে। নেমে অটোয় চাপাব না, রিক্সা ধরে নেব। ” বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিলেন। বৃদ্ধ গদগদ সুরে বলতে লাগলেন,“আরে আগে তো ট্রেনেই যাতায়াত করেছি। তোমার বাবা কাকা দাদা যা ছিল সব একএকটা। নামি গুণ্ডা। তাদের ভয়ে ভিড় ট্রেনে চেপে কোন ফাঁকা স্টেশনে নেমে দেখা করতে হত। বাপসঃ। ” এবার সত্যিই কুরুক্ষেত্র লেগে গেল। আমার যদিও প্রচণ্ড মজা লাগছিল, ওণাদের ডেটিং এর গল্প শুনতে। 

বেশ খানিক ঝগড়ার পর নেতিয়ে পড়লেন বৃদ্ধা। এই গরমে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচল প্রান্ত গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই লাইনে অনেক মধ্যবয়সীই হিজাবের পরিবর্তে শাড়ির আঁচল জড়ান। বৃদ্ধ চটজলদি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দিলেন।গায়ের চাপা খুলে দিতে অনুরোধ করলেন।  জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে আবার ঝগড়া। 

বৃদ্ধ রীতিমত গলার শির ফুলিয়ে বৃদ্ধাকে অভিযুক্ত  করতে লাগলেন, বৃদ্ধা নাকি  ঠিকঠাক ওষুধ খান না। বৃদ্ধাও সমান তেজী। বেশ খানিক তর্কের পর ওষুধের হিসেব নিতে বসলেন বৃদ্ধ। কোন ওষুধ কটা পড়ে আছে। গো হারান হেরে গেলেন বৃদ্ধা। 

সাময়িক শান্তি। তারপর বৃদ্ধ শুরু করলেন,“ওদের বাড়িতে যতই বলুক, বুঝলে পেট ভরে খাবো না। ফেরার পথে স্টেশন রোডের ফুচকা।” মহিলা বোধহয় ঝাল নিয়ে কিছু বললেন, বৃদ্ধ বললেন,“তুমি ঝাল ছাড়াই খেয়ো। তেমন হলে শুকনোই খেয়ো। একটা খেয়ো অন্তত। না হলে-”।  বলে এমন অভিমানী ভঙ্গীতে মাথা নত করে বাইরের দিকে তাকালেন, যে বোঝাই গেল গিন্নী ব্যতীত উনি ফুচকায় স্বাদ পাবেন না। বৃদ্ধা ফিসফিস করে কিছু আব্দার করলেন, বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন,“বেশ। হবে। ফুচকাও হবে, আইসক্রীম ও হবে। তুমি গায়ের চাপাটা এবার খোলো। সিদ্ধ হয়ে মরবে।  কেউ কিচ্ছু বলবে না। আরেঃ আমি বলছি,”।  ট্রেন বেশ ফাঁকা, বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ভীরে মাথা এবং গা থেকে আঁচল সরিয়ে জড়সড় হয়ে লাজুক নবোঢ়া বধূর মত স্বামীর গায়ে গা লাগিয়ে বসলেন। চমকে গেলাম, বৃদ্ধার মাথা ভর্তি চকচকে টাক। দুহাতে অজস্র সূঁচ ফোটানোর  কালো দাগ। কেমো চলছে অথবা কেমো হয়েছে। বৃদ্ধ মজা করে বলে চলেছেন,“আমার বউ টেকো হতে পারে তাই বলে কি কম সুন্দর নাকি-”। বৃদ্ধা মুখ বেঁকিয়ে বোধহয় বললেন মরণ। চোখের কোণটা এত কড়কড় করছে কি বলব, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। দিন কয়েক আগে বোধহয় আমিও ভাবছিলাম এ শহর বিস্মৃত হয়েছে প্রেম। আজ এদের দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই, ফুল ফুটুক না ফুটুক আমার শহরে বিরাজমান  চিরবসন্ত।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২২

 



আর পারছি না গুরু, সেই সকাল সাতটা থেকে শুরু। এত বছর তো নিজে পড়াশোনা করলাম। তারপর আবার চাকরীর জন্য পড়তে হল। চাকরী পেয়েও পড়তে বসলাম, আপদ ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য। নাহলে নাকি চাকরী পাকা হবে না। তারপর কয়েকটা বছর একটু শান্তিতে কাটল বটে, অতঃপর আবার শুরু করতে হল, ‘অ লেখ রে ভাই, দাগে, দাগে।’ আবার ভর্তি হতে হল স্কুলে। আবার পড়ে গেলাম সেই ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার চক্করে।  কেন, কেন এবং কেন আমাকে দুবার করে পড়তে হবে? আমি আর পড়তে বসতে রাজি নই। যাঁর উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি অনন্তকাল ধরে এক কাপ আদা মধুর জল নিয়ে বসে আছেন। একটু আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। ওণার দাবী, ‘যতই গ্রীষ্ম- বর্ষা-শীত-বসন্ত আসুক ক্লাস হোক কেবল অফ লাইন, আর পরীক্ষা হোক অনলাইন।’ 


মামার বাড়ির আব্দার মাইরি। শ্রীমতী তুত্তুরীর বক্তব্য হল, অফলাইন ক্লাশ হলে কেমন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ভাবের আদানপ্রদান চলে। অনলাইন ক্লাশ হলে তো কেবল স্যার একাই বকে যান। এতই যদি অফলাইন ক্লাশ পছন্দ, তাহলে পরীক্ষা অনলাইনে চাইছিস কেন? ‘ অনেক দিন দিইনি। জানি না আর পারব কিনা’। উদাস দার্শনিক ভাবে জবাব দেয় তুত্তুরী। অতঃপর একখান রাম কানমলা এবং যাবতীয় বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনা জানলা গলে পগার পার। 


 সকাল সাড়ে সাতটা। সক্কাল সক্কাল আজকাল বাবাকে ফোনটা করেনি। সারাদিন আমি সকল কাজের পাই যে সময়, সময় হয় না শুধু বুড়ো নিঃসঙ্গ বাপটাকে ফোন করার। বাবা সেদিন দুঃখ করে বলেই ফেলল, ‘বুড়ো হয়েছি তো। একটু বেশি বকি। আর আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই,যে আমার বকবক সহ্য করবে। তুত্তুরীটাও আজকাল কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর মতের বিরুদ্ধে কিছু বললেই, বলে, “আচ্ছা দাদু, এখন রাখছি। হোমওয়ার্ক করতে হবে।“’ 


তা বলে বটে, শ্রীমতী তুত্তুরীর মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি আজকাল ভয়ানক বিরক্ত হন। বাবা তো শুধু ফোনে শুনে আহত হয়, আমি তো নিত্য দেখতে পাই, তাঁর অভিব্যক্তি গুলো। আমার সব কথাই তাঁর আজকাল করলার রস গেলার মত লাগে। তুত্তুরীর প্রিয়তম ব্যক্তি হলেন তাঁর বাবা। কারণ শ্রীমতী তুত্তুরী উচ্ছন্নে গেলেও তিনি কিছুই বলেন না। উল্টে বলেন,“সবাইকে যে মানুষই হতে হবে কোথায় লেখা আছে? দু চারটে তো গেছো বাঁদর হবেই।” 


সবে আটটা বাজছে, এরই মধ্যে রোদে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর। মুঠো ফোন বলছে বাইরের তাপমাত্রা ৩২ মাত্র, যদিও ‘রিয়েল ফিল’ ৩৮মত। এত রোদেও গাছে জল দিয়েই যাচ্ছে বাগানে কাজ করতে আসা মাসির দল। দিন কয়েক আগে অমনি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামাতে গিয়ে দেখি, বিকাল সোয়া চারটের তুখোড় রোদে চলছে গাছে জল দেওয়া। মাথার ওপর দেদীপ্যমান দিনমণি,মাটি থেকে উঠছে তাপ, প্রায় ফুটছে ট্যাঙ্কের জল, সেই জলে স্নান করানো হচ্ছে আমার সাধের জিনিয়া, কশমস আর নয়নতারাদের। এরপরই ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,শসা,কুমড়ো, টমেটো আর বেগুন গাছের পালা। 


সিকিউরিটি ছেলেটা বিরস বদনে পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে ডেকে বললাম,‘শিগ্গির নিষেধ করো রে বাবা।’  তিতকুটে স্বরে জবাব এল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম। বললেও শুনতেছে না। খালি বলতেছে, তুমি চুপ করছু। ম্যাডামকে বলা আছে। ম্যাডাম সব জানতেছেন।’ এতো মহাজ্বালা। কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললেই, সে আমার নামে সব চালিয়ে দেয় হেথায়। আরেঃ আমি শহুরে ভূত হতে পারি, গাছপালা তেমন নাও চিনতে পারি, তাই বলে এটুকু তো জানি যে এই তুখোড় রোদে গাছে জল দিলে গাছ ধড়ফড় করে মরে যায়। সেযাত্রা আমার অনুরোধ আর সিকিউরিটি ছেলেটির হম্বিতম্বিতে দুপুর বেলা জল দেওয়া বন্ধ হলেও চালু হয়েছে সকাল বেলা। অগত্যা বলতেই হয়,‘ও দিদিরা আর জল দিবেননি গো। আপনাদেরই হাতে লাগানো গাছ, সব মরে যাবে এবার।’ 


সকাল সাড়ে আটটা, স্নান করতে যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। তার আগে মাথায় তেল মাখবেন জবজবে করে। তবে সেই তেল মাখানোর গুরুদায়িত্বটি মোটেই মায়ের উপর ছাড়তে তিনি নারাজ। মা যে ঘোরতর নারকেল তেলের পন্থী। নারকেল তেলের শিশি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ মিস করি ১৭ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী এক বৃদ্ধাকে। নারকেল তেলের মর্ম যদি ঠাকুমা বেঁচে থাকতে থাকতে বুঝতে পারতাম-। 


বেলা সাড়ে দশটা, ‘তুমি কিন্তু আজ বাড়িতে খেতে আসবে।’ যাকে উদ্দশ্য করে বলা তিনি নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছেন। ‘হ্যাঁ তা আসাই যায়।’ এটাই নৈমিত্তিক দায়সারা জবাব। তুত্তুরীর স্কুল থাকলে টিফিন নিয়েই যাই আমি, আর ছুটি থাকলে বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি। শৌভিক কোনদিন আসে না। টিফিনে কি খায়? কোনদিন মুড়ি চিবোয়, কোনদিন বা গোলাপীর মাখন পাঁউরুটি আর ডিমের অমলেট। কে যেন কিছুদিন আগেই গল্প করছিল,গোলাপীর ঘুঘনিতে পোকা আর ডিমে আরশোলার বাচ্ছা পেয়েছে। সে গল্প বড় মুখ করে শৌভিকই শুনিয়েছে আমায়। তাও গোলাপী প্রীতি ছাড়তে পারে না। প্রসঙ্গতঃ গোলাপী নামটা মহিলাসুলভ হলেও, তিনি আদতে পুরুষ। 


আরে ভাই,মুড়িই যদি খাবি,তো বাড়িতে এসে খা। মাখন পাঁউরুটিও কি বাড়িতে জোটে না তোর? সপরিবারে থাকিস, তাও খামোকা গোলাপের পাউরুটি চিবোস কেন? যাঁর উদ্দেশ্য বলা, ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে তাঁর গাড়ির চাকা। চিৎকার করে বলি,‘ আমি ফোন করব, পৌনে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বি অফিস থেকে।’  


পৌনে এগারোটা, কে বলবে তুফান আসছে, কি বিকট গরম। গাড়ি থেকে নেমে লিফট অবধি পৌঁছাতেই ঘেমে গেলাম। লিফটের দরজা আটকে দুই মহিলা আর এক পুরুষ। কি করছে রে ভাই? উঠছেও না, উঠতে দিচ্ছেও না। গলায় একরাশ কেজো বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘সরুন। সরুন। অযথা গেট আটকে রাখবেন না।’


 ‘এই তো, এই দিদি  যাচ্ছেন, এণার সাথে চলে যাও', বলে ওঠে ছেলেটা। দুই গ্রাম্য ভদ্রমহিলা, দম দেওয়া পুতুলের মত নড়তে নড়তে লিফটে উঠলেন। নিজের তলার বোতাম টিপে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, বললেন আমার ওপরের তলায় যাবেন। বোতাম টিপে দিলাম। দরজা বন্ধ হল, লিফট উঠতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ভদ্রমহিলা আমায় জড়িয়ে ধরলেন। হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম,‘ কি হয়েছে?’ সরল, গ্রাম্য ভঙ্গিমায় বললেন,‘খুব ভয় করছে। আগে চড়ছি না তো।’ পাশের মহিলা দেখলাম ওণাকে চেপে ধরেছেন। তিনিও বেশ ভীত। আশ্বস্ত করলাম, ভয়ের কিছু নেই। তবু যুগলে বললেন,‘তোমায় একটা কথা বলব, আমাদের একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?’ এত সরল, অকপট অনুরোধ কি ফেলা যায়? চলুন আপনাদের জন্য একতলা বেশিই উঠি না হয় আজ। 


বেলা দুটো, অফিসের রাবার গাছটা আজ মরে গেল। এই আপিসে কি আছে কে জানে, এত বড় বড় জানলা, এত রোদ আলো ঢোকে, তবু গাছ বাঁচে না। এই নিয়ে তিন চারটে গাছ মরে গেল। ফাঁকা টব গুলো পড়ে থাকে ভূতের মত। এখানেও যদি মাম্পির মত কেউ থাকত-। এত বকুনি খেত, তাও সুযোগ পেলেই একাধিক ব্যাগ ভর্তি করে নদীর পলি মাটি, বালি, শতেক রকমের গাছের চারা, মাটি কোপানোর খুরপি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হত চুঁচুড়ার আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে। তমলুকেও একবার এসো না মাম্পি, প্লিজ। দূরত্ব অনেকটা মানছি, গরমটাও মাত্রা ছাড়া, বর্ষা নামলেই না হয় এসো, তোমার বাড়ির গাছ গুলো যত বাচ্ছা দেবে, সবকটা আমার চাই। পাগলি মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে ফোনের ওপারে। ‘আমি সত্যিই যাব ম্যাডাম। সদ্য পক্স থেকে উঠিছি তো, একটু শরীরটা সারতে দিন, প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চলে যাব। আপনার আপিস পুরো গাছে ভরে দেব আমরা।’ আকাশকুসুম পরিকল্পনা করি দুজনে। জানি বাস্তবায়ন অসম্ভব। 


বেলা তিনটে, কি রে খেতে আসবি? ওপাশ থেকে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। নাঃ তোরা খেয়ে নে। এভাবে কাজ ফেলে যেতে পারব না। ধুত্তোরি বলে ফোন রাখতে রাখতে থমকে দাঁড়াই, হয়তো আমাকে খুশি করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘আজ রাতে একটু চিকেন করবি?’  রাতেই তো করি, সকালে সময় পাই কোথা? 


বিকাল সাড়ে পাঁচটা, অপিসের গাড়িটা সবে এসে থেমেছে গাড়ি বারন্দার নীচে, কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী, ‘এই মা,একটা কেলো হয়েছে।’ কি হল আবার? তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে যার দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি ভয়ে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। মাসি পাশ থেকে জানান, পায়ে পেরেক ফুটেছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। কি ভাবে নিজের হাতে ফুটে যাওয়া নাছোড়বান্দা  পেরেকটাকে টেনে বার করেছে তুত্তুরী সেই বীরগাথা শুনতে শুনতে তাকে টিটেনাস দিইয়ে আনি। আগামী এক ঘন্টা যে তিনি জনে জনে ফোন করে তাঁর বীরবত্তার গল্প শোনাবেন, তা বেশ বুঝতে পারি। উত্তম কুমার বলে, ' ম্যাডাম দুটো ব্যথার ট্যাবলেট কিনে নিলে পারতেন,ব্যথা হয় যদি।' হোক না, ব্যথা সইতেও তো শিখতে হবে। 


সন্ধ্যা সাড়ে ছটা, সাধারণ চিকেন রাঁধতে একদম ইচ্ছে করছে না। ভীষণ ভীষণ রেজালা রাঁধতে মুঞ্চায়। রাতে আর কি করেছ গো মাসি, ভাত না রুটি? জবাব আসে ভাত। ভাতের সাথে রেজালা, শুনে ঢোঁক গেলে শৌভিক। 'তার থেকে ঝোলই কর। বেশি করে আলু দিয়ে লম্বা ঝোল।কেমন?' রাঁধব তো আমি, তাও নিজের ইচ্ছে মত পারব না?  কোন দিন এবাড়িতে যদি আমার মর্জিমাফিক কিছু হয়। 


রাত সাড়ে সাতটা- আমার বাংলা পড়ানো শেষ। এবার ইংরেজি বইটা নিয়ে বাপের কাছে যা। করলা গেলা মুখ নিয়ে গেল বটে তুত্তুরী, ফিরে এল গাল ভরা হাসি নিয়ে। বাবা বলেছে, অত পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। কিসের ছুটি রে? বাবা স্প্যানিশ থ্রিলার দেখবে, তাই নাকি মেয়ের ছুটি। ‘আমি সওওব পড়িয়ে দেব।’ জানি না আমার ভয়েই কিনা, মেয়ের পিছু পিছু দোতলা থেকে নেমে এসে আমাকে আশ্বস্ত করে যায় শৌভিক। কবে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেক হিসেব টিসেব কষে, কান এঁটো করা হাসি সমেত জবাব আসে, ‘ কাল। না না কাল তো হবে না। তাহলে পরশু। বুঝলি তো বুজু, তুই আর আমি, পরশু সব পড়ে ফেলব-’।


রাত নটা, রান্না প্রায় শেষ, না তেরা না মেরা, মার্কা ঝোল করেছি চিকেনের। টক দই, মরিচ গুঁড়ো, আদা রসুন বাটা আর সাদা তেল দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংসকে কষেছি পোস্ত আর কাজু বাদাম বাটা দিয়ে। গুটি কয়েক গোটা শুকনো লঙ্কা ও দিয়েছি ফোড়ন হিসেবে। দিয়েছি অল্প ঘি, গরম মশলা আর সামান্য একটু বেশি মিষ্টি। গোলাপ আর কেওড়ার জল আর মাখানা মেশালেই পুরো রেজালা হয়ে যেত মাইরি। এমনিতেই যা ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। সামান্য বেশি কষার জন্য, একটা হালকা হলদেটে রং এসেছে যদিও। সত্যিই রেজালা তো নয়, অত নিখুঁত করার দরকারটাই বা কি? 


পদ্ধতি এক হলেও হিসেব বহির্ভূত কেবল আলুটা। আলু না দিলে গোঁসা হয় যে এদের বাপ মেয়ের। এমনিতেই শ্রীমতী তুত্তুরী উপুড় করে রেখেছেন অনুযোগের ডালি। আমি কেন তার বাবাকে খোঁচালাম, তাই না বাবা বলল, তুত্তুরীকে নিয়ে সব পড়ে ফেলবে বাবা। মুস্কিল হচ্ছে, মোটেই সব পড়তে রাজি নয় তুত্তুরী। বোকা মা যে কেন বোঝে না, পড়াশোনা করতেই আগ্রহী নন তিনি। বিরক্ত হয়ে বলি, ‘লেখাপড়া না শিখলে বড় হয়ে ফুচকা বেচতে হবে যে-’। জবাব আসে, ‘ফুচকাওয়ালা হওয়া তো ভালো। বড় বড় লোকেরা আমার সামনে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।’  হে ঈশ্বর, আমায় তুলে নাও প্রভু। অথবা হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও, এই বাপ মেয়ের সংসারে, আমার যে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই, আমি বেশ বুঝতে পারছি।

Tuesday 10 May 2022

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

দরিদ্র, অপাংক্তেয় শ্রম দপ্তরের অগোছলো সেকশনের এক কোণে, হঠাৎই একদিন এসে বসলেন তিনি। কি যেন একটা তুফানে কেঁপে ওঠার কথা পূর্ব মেদিনীপুর। আকাশের মুখ ঘোর কৃষ্ণ, মাঝেমাঝেই ছুটে আসছে মাতাল হাওয়া, এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সাধের তুরস্ক নীলরঙা পর্দা গুলোকে। উড়ে বেড়াচ্ছে যত কুচো আর বাতিল কাগজ। দূরের লোকজনকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ছুটির ঘন্টা বাজতে তখনও বেশ খানিক বাকি, ঘন্টা বাজলেই গুটি গুটি রওণা দেব আমরাও। এমন আবহাওয়ায় রুদ্ধ চেম্বারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে পারি না আমি, ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে, প্রতিটা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে, কতটা অন্যরকম লাগে মেঘলা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলক আর দামাল হাওয়াকে। 


তেমনি পায়চারির ফাঁকে আচমকাই তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময়। উড়ন্ত অবাধ্য কেশগুচ্ছকে দ্রুত শাসন করে উল্লাস না চাপতে পারা চপল স্বরে জানতে চাইলাম, এণাকে কোথায় পেলে? চঞ্চল,শান্তনু আর শুভাশিস ততোধিক উল্লসিত স্বরে জানাল, ‘ছিলেন তো ম্যাডাম। আমাদের পুরাণ অফিসেও শোভা পেতেন।এখানেও এসেছিলেন, আমাদের সাথে, তারপর কোথায় যে বস্তাবন্দি হয়ে লুকিয়ে বসেছিলেন। অতি কষ্টে, অনেক ধুলো ঘেঁটে খুঁজে বার করা হয়েছে, বৃদ্ধকে।’ 


সেই থেকে আমাদের অকিঞ্চিৎকর সেকশনের মাঝেই আসন পাতা তাঁর। নীরবে প্রত্যক্ষ করেন আমাদের কার্যকলাপ। দুরন্ত হাওয়ায় মাঝেমধ্যে হেলে দুলে যান বটে,  দুয়েক দিন ছাড়া,ছাড়াই সাফ ডাস্টার দিয়ে সাফ সুতরো করে দেওয়া হয় তাঁকে। দিন দিন আরো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন আমাদের ঘরের রবি। 


সপ্তাহ পেরোলেই 'আমাদের ঘরের রবি'র জন্মদিন। তো এ হেন রবি বাবুকে কি আমরা একটা মালাও পরাব না? 


শুক্রবার এমনিতেই ভিড় বেশি হয় এই অফিসে, পাশবই রিনিউ করতে, পেনশনের আবেদন নিবেদন করতে জমায়েত হন, একরাশ পরিবহন শ্রমিক, আসেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও। সকলের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া বেবি ইন্সপেক্টর দ্বয়কে আজ বসানো হয়েছে জনতার দরবারে। ক্ষণিকের জন্য সবাইকে ডেকে প্রস্তাব রাখলাম, ঘরের রবির জন্মদিন পালনের। আর কিছু না পারি, সামান্য একটা পুষ্প হার, দুয়েক কলি তাঁর গান বা কবিতা, শুভদীপ্তর কন্যার একটা নাচ, আর সবার শেষে জনগণমন, এই আর কি। বাহুল্য নয়, শুধুখানিক আন্তরিকতা আর অনেকটা ভালোবাসা। 


মুস্কিল হল, এই তাপপ্রবাহ দীর্ণ খর দুপুরে এই আপিস পাড়ায় মালা কোথায় পাব? পৌনে চারটে নাগাদ স্কুল ছুটি হয় তুত্তুরীর, ভাবলাম ওকে নিয়ে ফেরার পথে কিনে আনব খন। শুভাশিস বলল, ‘ আপনারা যে রাস্তা দিয়ে ফেরেন, ঐ রাস্তায় পাবেননি ম্যাডাম। আপনাকে বর্গভীমা মন্দিরের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হবে।’ বর্গভীমা মন্দিরের সমনের রাস্তাটা বড়ই সঙ্কীর্ণ আর তেমনি যানবাহনপূর্ণ। ওদিকে যেতে হবে বললেই গজগজ করে আমাদের উত্তমকুমার। ‘সকাল থেকে বলতে পারলনি শুভাশিস দা। এখন মালা কোথায় পাবেন?’ এতবড় শহর, একছড়া মালা পাব না? ‘আহাঃ পাবেননি কেন,কিন্তু এই গরমে কোন ফুলওয়ালা আপনার জন্য বসে থাকবে বলুন দিকি।’ তাও বটে, তবুও কপাল ঠুকে রওণা দিলাম আমরা। দুই বেবি ইন্সপেক্টরকে বলে গেলাম, সবার নাম টুকতে। হয় গান গাইতে হবে, নয়তো আবৃত্তি করতে হবে। কিছুতো করতেই হবে,মুখ খুলতেই হবে ঘরের রবির খাতিরে। 


ভারি ব্যাগ সমেত তুত্তুরীকে গাড়িতে তুলে প্রায় অর্ধেক শহর পরিক্রমা করে ফেললাম আমরা, মনের মত মালা কোথায় পাই? মন্দিরের সামনে ঝোলানো আধশুকনো জবার মালাগুলো দেখে গাড়ি থামালই না উত্তম। শেষে এক কাঠের পোলের পাশে অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ দোকান থেকে দেড় গুণ মূল্যে পাওয়া গেল তাঁর মালা। প্রবল কাশির দমকে অস্থির, ক্লান্ত তুত্তুরীকে বাড়িতে নামিয়ে যখন আপিসে পৌঁছালাম, ততোক্ষণে নতুন করে পাতা হয়েছে 'আমাদের ঘরের রবি'র আসন। হাতল ছাড়া চেয়ারের ওপর তকতকে সাদা তোয়ালে পেতে বসেছেন তিনি। আপিসের সব থেকে সেরা গাছ গুলো দিয়ে ঘিরে রচিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব শান্তিনিকেতন। কাগজের কাপে মাটি দিয়ে পোঁতা হয়েছে গোছা গোছা ধুপ। 


আপিস জুড়ে বইছে তপ্ত আবেগের  বাতাস। গান আবৃত্তি নয়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখবে শান্তনু আর শুভাশিস, কবিতা পড়বে চঞ্চল, পেনশন আর রিনিউয়ালে ফাইল গুছোতে গুছোতে গুণ গুণ করে আবৃত্তি অভ্যেস করছে নন্দন বাবু।  মোবাইল থেকে গুগল খুলে, কি সব গান টুকছেন জহর বাবু। নিজের চেম্বারে সেঁদিয়ে যেতে যেতে বললাম, ' আজ কিন্তু এ আমার গুরু দক্ষিণা গাইবেন না কেমন?' জিভ কেটে জহর বাবু দেখিয়ে গেলেন, উনি 'একলা চলো রে' টুকছিলেন। 


 জানলার বাইরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যে, একে একে জ্বলে উঠছে নিমতৌড়ির হলদেটে নিয়ন আলো গুলো। সপ্তাহান্তিক  ছুটির মেজাজে খালি হয়ে যাচ্ছে অন্যান্য আপিস গুলো, আর আমরা তৈরি হচ্ছি ঘরের রবির জন্মদিন পালনে। ফাইল পত্র গুটিয়ে, কম্পিউটার গুলো বন্ধ করে জড় হচ্ছি তাঁকে ঘিরে। ভিজে রজনীগন্ধার মালা থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি ফুলেল সৌরভ। শান্তনু বলল,‘ম্যাডাম আপনি পরিয়ে দিন।’ ভেবেছিলাম তুত্তুরী বা তিথির হাত দিয়ে মালা পরাব তাঁকে, একজন জ্বরগ্রস্ত, আরেকজন তখনও এসে পৌঁছায়নি। বড্ড ছোট যে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে,মুখ হাত ধুয়ে তবে না নাচতে আসবে। এই প্রবল দাবদাহে তিনি যে আদৌ আসতে রাজি হয়ছেন, তাতেই ধন্য আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্ত। 


অগত্যা শান্তনুকে বললাম, তুমিই পরাও। থোড়াই পদ মর্যাদা দেখবেন রবি বাবু, রবির আলোকে তো সবাই সমান, ‘হে মহান, নেমে এসে তুমি যারে করেছ গ্রহণ,সৌন্দর্যের অর্ঘ্য তার তোমা-পানে করুক বহন।’ 


নতুন ইন্সপেক্টর দ্বয়ের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল,সবাইকে দিয়ে গান আর আবৃত্তি করানো। দেখলাম লম্বা তালিকা প্রস্তুত। প্রাথমিক জড়তা, কাটিয়ে, দপ্তরী পদমর্যাদা তথা সংকোচ ভুলে সবাই খোলা মনে উজাড় করে দিল, শ্রদ্ধার ডালি নিয়ে। নিজেদের মধ্যে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে কেউ কি জানত, সবই যে তাঁর মহিমা। বাঙালির প্রাণের ঠাকুর কি সাধে কয়।


Saturday 7 May 2022

অনির ডাইরি ৩০শে এপ্রিল, ২০২২

 


রাত আটটা। বাইরে মুষলধারে  বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সাথে তীব্র ঝড়ো হাওয়া। প্রায় আধেক ঘন্টা ধরে একই অবস্থা। বিরক্ত হয়ে মেসেজ করলাম,‘ আমি যদি না যাই, তোরা কি খুব দুঃখ পাবি?’ বৈশাখীর গলাটা এমনিতেই ভয়ানক মিষ্টি, আরো মিষ্টি লাগে যখন কাঁদো কাঁদো গলায় অনুনয় বিনয় করে। ‘এমন করিস না অনি। আমার এত দিনের শখ। তুই আমার জন্য তমলুক থেকে হাওড়া এলি, আর এইটুকু আসতে পারবি না? প্লিজ আয়।’ যাব এবং অনেকক্ষন থাকব বলেই না সংসার গুছিয়ে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিয়ে তমলুক থেকে বেরিয়েছি। সাতটা নাগাদ হাওড়ার বাড়িতে ঢুকে, ব্যাগটা রেখে, মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই দৌড়াব, এমন বাদ সাধল প্রকৃতি। বৈশাখীর জন্মদিনে কালবৈশাখী, কি আজব সমাপতন মাইরি। 


 যাঁরা আমার অনির ডাইরির নিয়মিত পাঠক, তাঁরা সকলেই জানেন, আর যাঁরা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে, হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যলয়। তারা সুন্দরীর প্রাক্তনী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি প্রায় সিকি সেঞ্চুরী হতে চলল, আজও চৈতালীর ভাষায়,আমরা ‘বেঁধে বেঁধে থাকি,বেঁধে বেঁধে রাখি।’ ফেসবুক হোয়াটস্অ্যাপে একে অপরের হাঁড়ির খবর তো রাখিই, তাছাড়াও ছলছুঁতো খুঁজতে থাকি,সামনাসামনি মিলিত হবার। 


আধিকারিক-সাংসারিক- বৃহত্তর পারিবারিক, সামাজিক যাবতীয় চরিত্রে প্রথাসিদ্ধ রূপদান করার সফল/বিফল প্রচেষ্টার মধ্যেও আমরা ঠিক সময় খুঁজে নিই একে অপরের জন্য। সময়ের স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটে, ভৌগলিক দূরত্বকে তুড়ি মেরে আজও সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ পোশাকে আমরা সমবেত হই বুড়ো স্কুলটায়। সবাই হয়তো পারি না, সবসময় হয়তো পারি না, তবুও দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় চৈতালীদের ছাতে আবির মেখে ভাঙের আসর না বসালে কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় আমাদের বসন্তোৎসব। নববর্ষের প্রাক্কালে আমাদের বাড়ির দোতলায় সাদা লাল পোশাকে জমে ওঠে আমাদের বর্ষবরণ। সব তারাদের জন্য গুণে গুণে বেল আর জুঁই ফুলের মালা কিনে আনে অনিন। আমার বিয়ের খোঁপার কাঁটা আর হেয়ারপিন,যা পরম যতনে গুছিয়ে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা, ব্যাগ খুলে উল্টে দেয় তুত্তুরী। আহাঃ মাসিরা মাথায় ফুল লাগাবে যে- 


প্রথম কাশফুল ফোটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে আমাদের উন্মাদনার পারদ। কোথায়, কবে দেখা হবে তারাদের? কোথায় হবে প্রি-পুজো খাওয়াদাওয়া, কোথায় বসবে পুজোর তারার হাট? এমনি কোন আড্ডায় একবার বলেছিল বটে বৈশাখী,‘জানিস, আমার খুব ইচ্ছে, তোদের সাথে জন্মদিন পালন করার। তোরা আসবি?’ তখন তো সবাই বলেছিলাম, অবশ্যই যাব। পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। তারপর যা হয়, সব স্মৃতি, সব প্রতিশ্রুতির ওপর জমে সময়ের ধুলো। ‘কিছু ভুলেছ তুমি, আমিও গেছি ভুলে’। 


ঘোরতর আপিস টাইমে বৈ যেদিন ফোন করে মনে করায়, প্রাথমিক অভিব্যক্তিটা ছিল, ভাগ ব্যাটা। সপ্তাহের মাঝখানে জন্মেছিস কেন? দীর্ঘ বাদানুবাদের পর দেখা গেল,  এ বছরটায় অন্তত তিনি সপ্তাহান্তেই জন্মেছেন। তাও আসল জন্মতিথিতে আর পৌঁছে উঠতে পারলাম না আমরা। এক সাথে এক ডজন তারার সহাবস্থান কি মুখের কথা? বিশেষতঃ এই দুর্দম গরমে। আজ এর বাচ্ছার জ্বর, তো কাল সে শৌচালয়ে শয্যা পাতে। 


হয়তো আরো পিছিয়ে যেত, যদি না কোন এক ভোরের বাতাস সুদূর পুরুলিয়া থেকে বয়ে আনত বিশেষ বার্তা,‘ আমি আসছি। তোরাও আয় ভাই।’ দেবু আর বৈ উভয়েরই জন্মতিথি এক। বার বার কাতর অনরোধ করছিল বটে বৈ,‘ আয় দেবু এক সাথে কেক কাটি।’ আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি, প্রিয় বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সত্যিই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চেপে বসবে দেবু। অত দূর থেকে দেবু আসতে পারলে, একটা নদী এপার ওপার করতে পারব না আমরা?


শনিবার বিকেল পাঁচটায় যখন তুত্তুরী সহ রওণা দিলাম তমলুক থেকে, তখনও রোদের দমকে ভাপ ছাড়ছে উত্তপ্ত মাটি। ঝকঝকে আকাশ। মোবাইলে টুং টাং মেসেজ, ‘কটায় ঢুকছিস?’ ‘কি পরছিস?’ ' এই গরমে শাড়ি পরার নামও করিস না' ইত্যাদি প্রভৃতি। হাওড়ায় ঢোকার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে গেল মরশুম। প্রথমে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক, তারপরই প্রবল ঝড় এবং মুষলধারে বৃষ্টি। একে তো আবহাওয়ার চোখ রাঙানি, তার ওপর আমার মায়ের রক্ত চক্ষু। এত রাতে, এই আবহাওয়ায় তুত্তুরীকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা মায়ের কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। 


একাধারে আমার গর্ভধারিণী অপরদিকে প্রকৃতির যুগ্ম চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে আধ ভেজা অবস্থায় বৈ এর বাড়ি যখন পৌঁছালাম, রাত সোয়া আটটা। তুত্তুরীর কান বাঁচিয়ে বর্ষিত হল একরাশ খিস্তিখেউড়, আসব না বলার গর্হিত অপরাধে। অপরাধই তো। শুধু আমাদের জন্য, কি খাটুনিই না খেটেছে সদ্য জন্মানো দুই তারা। বিগত দুদিন ধরে ক্ষেপে ক্ষেপে বাজার করেছে বৈ, আজ সকাল থেকে ছানাপোনা সহ আমাদের জন্য সবটুকু নিজ হাতে রেঁধেছে। পুরুলিয়া থেকে হাওড়া স্টেশনে নেমেই ছুটে এসেছে দেবু। হাত লাগিয়েছে প্রাণের সহচরীর সাথে। 


জানলার বাইরে প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নাচ,গান, আনন্দ,হুল্লোড়ের কয়েকটা ঘন্টা যে কিভাবে কেটে গেল। কব্জি ডুবিয়ে নৈশাহার সেরে,  রাত পৌনে বারোটার সময় যখন গলির মুখে নামিয়ে দিল রাখি, ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো পাড়া। এমনকি পাড়ার সারমেয়গুলোও  কুণ্ডলী পাকিয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তখনও অভুক্ত অবস্থায় আমাদেরই জন্য প্রতীক্ষমাণ। যথারীতি মায়ের 'এত সাহস ভালো নয়' এর সাথে বাবার, ' হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো। আমরাও তো এমনিই ছিলাম,নাকি। ১৯৫৮র স্কুল ফাইনালের ব্যাচ আমাদের, ২০১৬ অবধি এমনিই উদ্দাম আড্ডা, ফিস্ট, ফ্যামিলি ফিস্ট করে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। তারপর কি যে হল, একে একে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিল অনেকে, বাকিরা এমন অসুস্থ, স্থবির হয়ে পড়ল, কেউ কেউ হাওড়া শহরের পাট গুটিয়ে ছেলেমেয়ের কাছে অন্য শহরে চলে গেল,  নাহলে দেখতিস আজও হত আমাদের আড্ডা। আর তুই তো আমারই মেয়ে। বেশ করেছিস।' এই না হলে আমার বাবা। মুখ হাত ধুয়ে, পথ শ্রম আর হইচই পর্বের ক্লান্তিতে যখন ঢুলে আসছে চোখ, ভেসে এল সেই চিরাচরিত স্নেহ আর ভালোবাসায় জবজবে কথা গুলো, ' হ্যাঁ রে, পেট ভরে খেয়েছিস তো? নাকি আমাদের সঙ্গে একটা রুটি খাবি-। দুটো রুটি বেশি করেই করেছি কিন্তু ’ অন্য সময় হলে হয়তো হেসেই গড়িয়ে পড়তাম, আজ কেন জানি না, মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। ভালোবাসার এই মুহূর্তগুলো কেন যে এত স্বল্পস্থায়ী। খেতে তো পারব না, তবুও একটু না হয় এমনিই বসি ডাইনিং টেবলে। জানি গল্প শুনতে উন্মুখ হয়ে আছে দম্পতি। গল্প বলতে বলতে বন্ধুদের সাথে চলুক ছবি দেওয়া নেওয়া, আরো বহু বহু বছর যেন এভাবেই একে অপরের অ্যালবাম ভরিয়ে রাখতে পারি আমরা। ট্যাগ হোক, ত্যাগ নয়।

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২২

 


‘দিদি কাল আমার সাথে যাবে?’ যাঁর উদ্দেশ্যে বলা, তিনি ঘোলাটে দৃষ্টিতে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। সম্পর্কে আমার বাবার দিদি, কিন্তু আমরা চার খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও দিদি বলেই ডাকে। ৮৬টা বসন্ত কাটিয়ে ৮৭র দিকে পা বাড়িয়েছে দিদি। একমাত্র হাই প্রেশার ছাড়া ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়।  খুড়তুতো ভাই অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’ অমনিই আমার পিসি। 


আজ শ্রীমান অনিন্দ্যর জন্মদিনের পার্টি। আমরা অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী হাওড়ায় গেলেই একটা না একটা পার্টি হয়ই। ‘পার্টি’ শব্দটা নিছক গৌরবার্থে ব্যবহার করি আমরা, আসলে তিন প্রজন্ম মিলে সামান্য খাওয়া দাওয়া। একটু গানবাজনা। চৈতি অর্থাৎ আমাদের আদরের ভাতৃবধূর নাচ আর রাত সাড়ে বারোটা- একটা অবধি চুটিয়ে আড্ডা, এই আর কি। অনিন্দ্যর আসল জন্মদিনটা হয়ে গেছে সেই মার্চ মাসের শেষের দিকে। তখন সিমলিপালের জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর যতবারই অনিন্দ্য(এঃ ডাকনামটা বাদ দিয়ে পোশাকি নামে ডাকতে কি অস্বস্তিই না হচ্ছে।) খাওয়াতে চায়, কিছু না কিছু কারণে পিছিয়ে যায় ব্যাপারটা। এবারে তাই হাওড়ায় আসার আগে, যেচেই পার্টি আদায় করেছি আমি আর তুত্তুরী। 


কেক কাটার তালে তালে দারুণ জমে উঠেছে আমাদের পার্টি। আমাদের আনন্দে সামিল হতে আবহাওয়াটাও হঠাৎ যেন ভোল বদলে ফেলেছে। একতলার বসার ঘরটায় হৈ হৈ করে এসে ঢুকছে  তুমল ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভিজতে ভিজতেই পিসিকে বললাম,‘কাল সকালে আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ বুড়ো পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’ 


সবাই মিলে বললাম, পারবে না মানে? মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। সোমবার ভোরে বেরোব আর বুধবার বিকেলে ফিরে আসব। ঈদ যদি সোমবার হত, তাহলে আর এভাবে তমলুক ফিরতে হত না।  আমাদের হক বাবু বলেও ছিলেন,‘ঈদ সম্ভবতঃ সোমবারই হয়ে যাবে ম্যাডাম।’ আমিও আশায় আশায় ছিলাম। একটু আগেই হক বাবু জানালেন, ঈদ মঙ্গলবার। অর্থাৎ কাল আপিস যেতেই হবে। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য থেকেই যাবেন। ঈদের ছুটি কাটিয়ে ফিরবেন। তখন না হয় আমার সাথে ফিরে আসবে পিসিও। 


শ্রীমান অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’ কটা বুড়ি পিসিকে এত ভালোবাসে তার ভাইপোরা কে জানে! 


বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি থুড়ি বুড্ডি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। এরপর কখন যে পিসি ব্যাগ গুছাবে আর কখন যে ঘুমাবে ভগবান জানে। আপাতত আমি ঘুমাতে গেলাম, কাল ভোর ভোর বেরোব আমরা, উত্তমকুমারের গাড়ি চেপে। 


Friday 22 April 2022

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 

আমায় কেউ কোনদিন ইফতারে ডাকেনি। স্কুল, কলেজে না হয় কোন মুসলিম বন্ধু ছিল না, কর্মক্ষেত্রে তো ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নিয়ম করে রোজা রাখতেনও। রোজ গপ্প শোনাতেন, সের্গিতে কে, কি খেলেন। ‘বুঝলে অনিন্দিতা, বেশি কিছু না,সামান্য দুধভাত আর এক টুকরো ইলিশ মাছ।’ গল্প শোনাতেন,কার বাড়িতে কি রান্না হত, ভাগ করে নিতেন ঈদের বাজেট। ‘বুঝলেন ম্যাডাম, ফলের যা দাম, আপনার বৌদি বলছে, চল্লিশ হাজার শুধু ফলেই ধরে রাখো। বড় পরিবার তো আমাদের-’। ওদের কাছেই শিখেছিলাম কেউ রোজা রাখলে তার সামনে খেতে নেই। খেলে পাপ লাগে। তবে তিনি অনুমতি দিলে খাওয়া যায় বটে।


বলতে নেই, ঈদের পর অবশ্য সকলেই খাওয়াতেন, ঘি, দুধ আর চিনি দিয়ে মাখা ময়দার মিষ্টি মিষ্টি পরোটা আর চিকেন চাঁপ আর সেই বিখ্যাত সেমাই। নিউমার্কেটের স্পেশাল সেমাই, যার বেধ লজ্জা দেবে নাইলন সুতোকেও। ভালো ঘিয়ে ভাজা, সাথে প্রচুর কাজু এবং কিশমিস। সবই হতো, শুধু ইফতারটাই যা কোনদিন হত না। 


 আমাদের তমলুক আপিসের উডিসি হক বাবু যখন রোজা রাখা শুরু করলেন, আমরাও মুখিয়ে রইলাম, আসুক ঈদ, তারপরই আসবে সেমাই আর পরোটা। আমি যা বলি শুভাশিস আর শান্তনু বলে তার শতগুণ। রোজ দিন গুণি আমরা, কবে আসবে ঈদ। এমনি ভাবতে ভাবতেই একদিন মনে হল, হক বাবু আমাদের যবে খাওয়াবেন, খাওয়ান, তার আগে বোধহয় আমাদের একবার ওণাকে খাওয়ানো উচিৎ। হক বাবুকে বললাম,আমরা আপনাকে ইফতার পার্টি দিতে চাই, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে একেবারে অনভিজ্ঞ তথা অর্বাচীন। কি দিতে হয়, কি করতে হয় সেটা আপনাকেই বলে দিতে হবে। 


হক বাবু প্রথমে লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে গেলেন বটে, পরে ধীরে ধীরে বললেন,‘ম্যাডাম, আমি তো ছটা না বাজলে খেতে পারব নি। আপনারা কেন অত দেরী অবধি থাকবেন।’ এ আবার কেমন কথা। আপনার জন্য একটা দিন আমরা দেরী করে বাড়ি ফিরতে পারব না? আপনি শুধু বলুন কি কি আনতে হবে? কি ভাবে সাজাতে হবে? হক বাবু লাজুক ভাবে জানান, ‘একটু আদা, একটু ভিজে ছোলা আর খেজুর এই আর কি।’ ব্যাস? হয়ে গেল? আর ফল? ফল দিতে হয় না? আর তেলে ভাজা? আর ঠাণ্ডা কিছু? ধুর হক বাবু, আপনি দেখছি কিছুই জানেন নি গো। আপনি ছাড়ুন। 


অতঃপর আমাদের হক বাবুর জন্য, আমরা  নিজেরা মাথা খাটিয়ে বানালাম ইফতার পার্টি। রাধামণি বাজার থেকে বেছে বেছে ফল কিনে আনল অরূপ, একটা পুঁচকে কৌটো করে আনা হল কুচানো আদা আর ভিজে ছোলা। নিচের ক্যান্টিন থেকে আনানো হল, টক দইয়ের সাথে কুচানো বাদাম আর মরিচ গুঁড়ো মেশানো ওদের সেই বিখ্যাত লস্যি, বিদ্যুৎ বেকারি থেকে আনা হল, সবুজ সবুজ পুদিনা দেওয়া আলুভাজা আর কাঠি কাবাব।আয়োজন হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু উৎসাহ, আন্তরিকতা আর ভালোলাগাটুকু ছিল একেবারে নিখাদ। 


সাড়ে পাঁচটার পর, যখন একে একে ঝাঁপ বন্ধ করছে নিমতৌড়ির অন্যান্য দপ্তর, আমাদের দরিদ্র শ্রম দপ্তরে তখন শুরু হয়েছে ইফতারের প্রস্তুতি। আপিসের পোশাক বদলে ধপধপে ফেজ টুপি, লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিতে সেজে  নিয়েছেন হক বাবু। মেঝেতে বিছানো হয়েছে কার্পেট, নামাজ পড়তে বসার আগে হক বাবু বলে গেলেন, " ম্যাডাম আমার ভীষণ ভালো লাগছে। কোনদিন ভাবিও নি, যে আপিস আমাকে ইফতার দেবে।" আমি ভেবেছিলাম বটে, আপিসে একটা ছোট পুজো করিয়ে নেব, একেবারে নতুন বিল্ডিং, আর যা ঝঞ্ঝাটের দপ্তর আমাদের। নিত্য লেগে থাকে অশান্তি। অর্থাভাবে আর পূজারীর অভাবে করতে পারিনি। হক বাবুকে বললাম, আপনি যখন প্রার্থনা করবেন, একটু বলে দেবেন তো। ওপরওয়ালা তো একজনই। মাধ্যম যাই হোক না কেন। একটু দেখবেন আজ্ঞে। আর ইয়ে DA র জন্যও দুয়া চাইতে ভুলবেননি যেন।

Tuesday 19 April 2022

অনির নববর্ষের ডাইরি ২০২২

 অনির নববর্ষের ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২২


নগর কলিকাতার থেকে একদমই অন্যরকম জীবন হেথায়। অনেক সিধাসাদা, অনেক ঢিলেঢালা। ঘড়ির কাঁটা যেন সামান্য হলেও ধীরে নড়ে হেথায়। মহানগর ছেড়ে সুদূর তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী হবার সিদ্ধান্তটা ছিল নিছক আমার একার। শৌভিকের বরং ঘোর আপত্তিই ছিল। বাড়ির পাশের বিধাননগর পোস্টিং ছেড়ে কোন পাগলে যেচে পূব মিদনাপুর যায়?


নবোঢ়া হলেও কিঞ্চিৎ  বোধগম্য হত ব্যাপারটা, বিবাহিত জীবন কেটে গেছে একযুগেরও বেশি, তারপরেও একসাথে থাকার এত আদিখ্যেতা কিসের বাপু? দিব্যি তো ছিলাম, বর কাছে না থাকলেও, ফোন তুললেই সুইগি আর জ্যোমাটো তো থাকত। রাস্তা পেরোলেই ছিল হাবিব, রিক্সায় চাপলেই পৌঁছানো যেত তুত্তুরীর স্কুলে, মস্ত স্কুল। স্কুলের মধ্যে বুড়ো চার্চ। একটা অটো ধরলেই পৌঁছে যেতাম  সিটিসেন্টার। সুইমিং ক্লাব থেকে চব্বিশ ঘন্টা খোলা জিম সবই ছিল হাতের নাগালে। অবশ্য ওসব থেকেও যে আমার কোন পরিবর্তন ঘটেছিল, তা নিন্দুকেও বলবে না। তবুও তো ছিল। তুত্তুরীর দাঁতগুলোও তো অবশিষ্ট ছিল। যদি না আসতাম এই জেলায়, অক্ষতই থাকত হয়তো- 


এই জেলায় এসে কি শিখেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী,শিখেছেন পাঁচফোড়নকে সোমরা বলে, শিখেছে কুমড়োকে বৈতাল বলতে, পেঁপে গাছকে পিপা বলতে। চিনেছেন ওলকপি, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা,বেগুন, হলুদ,আদার মত হরেকরকম গাছ। চিনেছেন তথা আস্বাদ করেছেন নানা ধরণের শাক। ঘরোয়া পুঁই-পালং-কলমি ছাড়াও চেখেছে সুষনি শাক, গিমে শাক, হিংচে শাক। জেনেছে কচি পটল সুস্বাদু হলেও, পলতা বেশ তিতো হয়। আর পটল গাছের শিকড় তো মারাত্মক বিষ।  


শুধু যে গাছ চিনেছে তাই নয়,নিজের হাতে সব্জি তুলতেও শিখেছে তুত্তুরী। মাটি থেকে দুহাতে উপড়ে তুলে এনেছে ওলকপি। গাছের ডাল থেকে ছিড়তে শিখেছে কচি শসা বা টমেটো, রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে গিয়ে কাটতে শিখেছে লাউ,কুমড়ো আর পুঁই শাক। শাক তুলতে গিয়ে গুচ্ছের ব্যাঙ, ফড়িং এমনকি সাপও চিনেছে বটে গুটি কয়েক। তবে তেনারাই তো আমাদের ভয়ে অস্থির। 


 তুত্তুরীর হাতে তোলা বাগানের একরাশ সব্জি নিয়ে এক মাস পরে ফিরছি নিজের শহরে। গঙ্গা পাড়ের, ধূলিমলিন, পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা আজও আমার প্রিয়তমা। ক্যালেণ্ডারে লাল দাগ দেখলেই ঘরে ফেরার জন্য হাঁকপাঁক করে চিরকেলে ঘরকুনো মনটা আমার। সাঁতরাগাছি স্টেশনের জ্যাম কাটিয়ে এগোনোর সাথে সাথেই চড়তে থাকে ঘরে ফেরার উত্তেজনার পারদ। এ যেন অকাল শারদীয়া। ঝলমলে রেস্তরাঁয় ঘেরা বেলেপোল থেকে বাঁদিকে বেঁকে, ৫২র চৌরাস্তায় খানিক থমকে, ইছাপুর জলট্যাঙ্কে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে গিয়ে সোজা কদমতলা বাজার। এই পড়ন্ত সন্ধ্যাতেও এক রাশ টাটকা সব্জি আর ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বাজার। দেদার বিক্রি হচ্ছে মাছ আর মুর্গি। নগর কলিকাতার বাসিন্দাদের জন্য এ অতি সাধারণ দৃশ্য হলেও, সুদূর মেদিনিপুরের উত্তমকুমার প্রতিবার মুগ্ধ হয়ে যায়। যেমন মুগ্ধ হয়ে যাই আমি। এখানে এলেই কেন জানি না, ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইডের মত, আমার ঝড়ু বাজারু সত্ত্বা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।


 লাল-সবুজ-কমলা আনাজ আর ফলের পাশেই স্তূপাকারে বিক্রি হচ্ছেন বিভিন্ন সাইজের দুই সহোদর-সহোদরা, শ্রীমতী লক্ষ্মী আর সবার শ্রীমান গণেশ। নববর্ষ মানেই হাওড়া শহরে হালখাতার মরশুম যে।  


“কাল দয়া করে একটু সকাল সকাল উঠো”। যার উদ্দেশ্যে বলা, তিনি হাওড়া এলেই কেমন যেন প্যাঁচা হয়ে যান। এত গল্প যে কোথায় জমিয়ে রাখে মেয়েটা কে জানে। গভীর রাত পর্যন্ত একবার দাদুর সঙ্গে গল্প চলে, আরেকবার মাম্মাম(দিদার) সাথে। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না, অযথা দুটো কটু কথা শুনতে হয় মায়ের কাছে। মায়ের কটু কথা তাও হজম হয়, বাবার সেন্টুটা জাস্ট অসহ্য। কিন্তু এযাত্রা আমি নিরূপায়। এক গাদা কাজ নিয়ে এসেছি, কাল সকালে একবার বড় মাসির বাড়ি ঢুঁ মারব। কি জানি কেন দুই মাসির জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই খুব মন খারাপ। বড় দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সকলে। বিকালে মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাব, পরশু তারাদের নববর্ষের গেট্টু আছে, তরশু আবার ফিরে যাব তাম্রলিপ্ত নগরী, তার আগে একবার ঢুঁ মেরে যাব শ্বশুরালয়ে। এক ঢিলে মারা যায় যতগুলো পাখি, এই আর কি-


আমার ঝটিকা সফরের ব্যাখ্যান শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বাবা, “তাহলে আর আমাদের জন্য সময় কোথায় তোর?  এত কাজ নিয়ে আসিস কেন?” 


 

কোনমতে মুখ হাতটা ধুয়েই মায়ের ফ্রিজ থেকে ডাইনিং টেবল হয়ে সাবেকি মিটশেফের যাবতীয় কৌটোবাটা হাতড়াতে থাকি আমি। বাপের বাড়িতে ফিরলেই এত খিদে পায় কেন কে জানে? মস্ত স্টিলের টিফিন কৌটো ভর্তি লাল টুকটুকে তরমুজ জারিত হচ্ছে ফ্রিজে। এমনিতে তরমুজ আমার ঘোর অপছন্দের ফল, তাও এক টুকরো মুখে দিতেই জুড়িয়ে গেল প্রাণ। আমার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতে করতে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে আমার বৃদ্ধের মুখে। তাও জানতে চায়, “ভালো লেগেছে? মাকে বললাম, কেটে অল্প চিনি মাখিয়ে ফ্রিজে রেখে দাও।“ তরমুজে চিনি বোধহয় একমাত্র আমাদের বাড়িতেই মাখানো হয়। ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা বাবার পছন্দের দোকানের গুটি কয়েক মিষ্টির প্যাকেট। আমার জন্য কালো জাম আর তুত্তুরীর জন্য ওর মনপসন্দ ছানার মুড়কি। এসব কে কিনে আনল বাবা? 


প্রশ্ন করে বিরাগ ভাজন হই। বৃদ্ধ নিজেই গিয়েছিল মেয়ে আর নাতনির জন্য তাদের প্রিয় মিষ্টান্ন ক্রয় করতে। সাথে দু হাঁড়ি পুরু সর ওয়ালা লাল দইও এনেছে, যাতে দইয়ের মাথা খাওয়া নিয়ে আমাতে আর তুত্তুরীতে হাতাহাতি না করতে পারি। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানাল বৃদ্ধ। 


বিগত শারদীয়ায় এক কষাই মার্কা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এক পক্ষকালেরও বেশি হাসপাতাল বাস করে তথা শুধু স্যালাইনের ওপর বেঁচে, কেবল চেহারা খানাই অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল তাই না, শরীরের যাবতীয় পেশি বিশেষতঃ পায়ের জোরও হারিয়ে ফেলেছিল বৃদ্ধ। বাড়িতেই হাঁটতেই পারত না কতদিন, রাস্তায় বেরানো তো ছেড়েই দিন। সেখান থেকে নিজের পায়ে হেঁটে, গলির মোড় থেকে রিক্সা পাকড়াও করে সুদূর কদমতলা বাজার থেকে এত কিছু কিনে আনা তো স্বপ্নাতীত। কি করে পারলে বাবা? জবাব একটাই, অদম্য মনের জোর। আর তুত্তুরী আর আমার জন্য অপরিসীম ভালোবাসা। 


সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে নাতনির হাতে তোলা আনাজপাতি দেখতে বসে মা আর তুত্তুরী। তমলুকে এসে কত রকম গাছ চিনেছে সেই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ওঠে সাপ আর ব্যাঙের প্রসঙ্গও। একদিনে পর পর একজোড়া লাউডগা দেখেছে তুত্তুরী,সেই গল্প শুনতে শুনতে আঁতকে ওঠে মা। আমি যে কোন এক স্বর্ণালী সন্ধ্যেয় খালি চোখে কোলা ব্যাঙকে মাটির ঢেলা ভেবে শট মেরেছিলাম, এবং তাতে ব্যাঙটা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে কটমট করে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে লাফিয়ে পালিয়েছিল সেই গল্প শুনতে শুনতে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে তিনজন। 


বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীর দিন ফুল তুলতে গিয়ে ঠিক কিভাবে ভূপতিত হয়েছি আমি, সে দৃশ্যও অভিনীত হয় আমাদের চাটুজ্জে বাড়ির দালানে। কপালে আলু থেকে থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট হয়ে গোড়ালি মচকানো অবধি কিছুই বাদ যায়নি যার জন্য, সেই পতনের গপ্প শুনে একমাত্র পিসি ছাড়া কারো মুখে আমার জন্য একফোঁটাও সমবেদনা দেখতে পাই না আমি। আমার পতনে কি চরম আমোদিত হয় সবাই। এরা কি সত্যিই আমার আপনজন? এদের জন্যই কি আমি হাওড়া এলাম? ধুত্তেরি। শাশুড়ি মা ঠিকই বলেন মাইরি, বেঁচে থেকে কোন লাভই নেই, যা দেখছি। 

(চলবে)


অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-২) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২


কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এখনও বেদম চটে আছে তুত্তুরী, ‘কেন মা কেন? তুমি একা যাও না।’ একা যেতে পারলে কি আর যেতাম না, দোলের সময় তো একাই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বড় মাসির বাড়ি। ও বাবা, কেউ খুশি হয়নি, আমাকে দেখে, সবার মুখে একটাই প্রশ্ন,থুড়ি অনুযোগ,‘মেয়েটাকে আনলি না কেন?’ 


মায়ে-ঝিয়ে ধরাচূড়া পরে বেরোনোর আগে, কি মনে হল, একবার ফোন করেই নি। ‘হ্যালো বড়দা। তুমি কোথায়?’ প্রশ্ন করাটা ছিল নিছক বাতুলতা মাত্র,বড়দার কতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে ভেসে আসা চলন্ত ট্রেনের ঘটাং ঘটাং শব্দ সোচ্চারে জানাল, বড়দা আপাততঃ চূড়ান্ত ব্যস্ত কর্মক্ষেত্র সামলাতে। 


 আমরা পাঁচ ভাইবোন, মাসতুতো শব্দটা কখনওই প্রবেশাধিকার পায়নি আমাদের মধ্যে। চার দাদার একমাত্র  ‘ঢিপচালতি’ গোবরগণেশ, ল্যাদাড়ু বোন  আমি। 


চারজনের সঙ্গে চার রকমের সম্পর্ক, ছোটদার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান যাই হোক না কেন, বরাবরই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। মা আর বড়মাসির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সামনাসামনি সংঘর্ষ(পড়ুন হাতাহাতি)হত আমাদের। অত্যন্ত বাজে ছেলে ছিল মাইরি, আমার হাড় জ্বালাতে কি সব উদ্ভট, উদ্ভট দাবীই না করত ছোটদা। যাকেই পছন্দ করতাম, যাকেই সমর্থন করতাম, ঠিক তার উল্টো বা পরম প্রতিদ্বন্দীকেই বেছে নিত ছোটদা। বাইশ গজের মহারণে আমি ইন্ডিয়ার সমর্থক, তো ছোটদা পাকিস্তানের। 


সেই সব আশি নব্বইয়ের আগুনে দিন। কল্পনা করুন, বাইশ গজের বিশ্বযুদ্ধে গোটা বাড়ি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া করে চিল্লাচ্ছে, আর ছোটদা একা পাকিস্তান- পাকিস্তান করছে। কেন? না আমার হাড় জ্বালাতে।  সেসব দিনে ইন্ডিয়া হারতও বাপু। দুপক্ষের ম্যাচ মানেই গোহারান হেরে, মুখ কালো করা আমি আর ৩২ পাটি দেখিয়ে পেশি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছোটদা। 


 আরো ছোটবেলায়,যখন ভারত-পাক বোধ আসেনি বা ক্রিকেটের প্রতি কোন টান জন্মায়নি, আমার হাড় জ্বালাতে ছোটদা দাবী করত, সবাই মানে মা-বাবা-মাসি-মেসো-দিদা-দাদারা সবাই নাকি ছোটদাকেই বেশি ভালোবাসে, আমায় নয়। অতঃপর ষড়যন্ত্রের সুরে,‘ বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করে দেখ-’।  আর আমিও অমনি হ্যাংলার মত জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম আমি, ‘হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো।’ সবথেকে বেশি ঝগড়া করেছি বলে হয়তো সবথেকে বেশি মন খারাপও ছোটদার জন্যই করে। কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই ফোন করে অকারণে খানিক হ্যাজাই। আজ আর কেউ কারো হাড় জ্বালাই না আমরা, বরং পরম মমতায় রোমন্থন করি সেসব গৃহযুদ্ধের অমূল্য স্মৃতি। কি ভালোই না ছিল সেইসব দিন, আরেকবার যদি ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া যেত- 


সেজদার অন্ধ ভক্ত, অনুরাগী ছিলাম আমি। সেজদার সবকিছুই ছিল ভয়ানক অন্যরকম।রীতিমত নায়কোচিত। নিজের হাতে বাজির মসলা তৈরি করে, ঘরেই রঙমশাল, হাউই আর তুবড়ি বানাত সেজদা। যে কোন ঘরোয়া গ্যাজেট ফটাফট খুলে সারিয়ে ফেলত সেজদা। বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের যাবতীয় সমস্যা একা হাতে সামলে দিত সেজদা। নিছক চ্যালেঞ্জের বশে, পাতি ডট পেন দিয়ে ইতিহাস বই থেকে খাতায় নামিয়ে আনত কখনও নেতাজী তো কখনও টিপু সুলতানকে। যা করত, তাতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত সেজদা। নিজস্ব কি সব যেন ভাষা আবিষ্কার করেছিল সেজদা, অনর্গল বকে যেত সেই ভাষাতে। হাঁ করে শুনতাম আমি। 


মেজদা ছিল এবং আছে আমার সবথেকে নরম,সবথেকে  আদরের জায়গা। আমার বইয়ের আলমারির অর্ধেক জুড়ে শুধু মেজদার দেওয়া উপহার। ফি বছর বইমেলা হলেই বস্তা ভরে বই কিনে আনত মেজদা, আমার জন্য। কলেজে ভর্তি হবার লাইনে সঙ্গী হত মেজদা। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য তাড়া তাড়া সার্টিফিকেট অ্যাটেস্টেড করে এনে দিত মেজদা। আমার দাদাদের মধ্যে প্রথম মেজদার সাথেই শৌভিকের আলাপ। সে কি কেলো।  ধর্মতলায় কি যেন কাজে গিয়েছিল মেজদা, পড়বি তো পড় হাত ধরাধারি করে মুখোমুখি দেখা। একটু আগে হলেও ঠেলে সরিয়ে দিতাম,ভিড়ে মিশে যেতে বলতাম তাকে, আর তো উপায় নেই। ভেবেছিলাম কান মুলে দেবে নির্ঘাত, বদলে কি মিষ্টি করে হেসে গল্প করেছিল মেজদা। হাতে একটা সদ্য কেনা জলের বোতল ছিল, ভালোবেসে সেটাই শৌভিককে গছিয়ে দিচ্ছিল মেজদা। শৌভিকও নেবে না,মেজদাও ছাড়বে না। “একটু জল খাও ভাই।” সেদিন বাসে তুলে দিতে দিতে, আমুদে স্বরে বলেছিল শৌভিক,‘শালাটা বেশ ভালো তো।’ ভালো তো হবেই, বোনকে যে  বড্ড ভালোবাসত, আজও বাসে। আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে তো মেজদা ভালোবাসবেই। আজ মেজদার ভালোবাসার গল্প? সে অন্য দিন হবে খন। দাদা-বৌদির অনুমতিক্রমে, নাহলেই কপালে দুগুণ কানমলা। 


বাকি রইল বড়দা। আপাততঃ যিনি ঘোর ব্যস্ত আপন কর্মক্ষেত্রে।  বড়দা আমার শিক্ষাগুরু। সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে রীতিমত বেত হাতে পড়িয়েছে বড়দা। আজও যেকোন ভালো বা খারাপ খবর, বাবা,শ্বশুরমশাই আর শৌভিকের পরেই যাকে ফোন করে জানাই,সে আমার বড়দা। তাই নিয়ে মেজ,সেজ বা ছোটদার কোন নালিশ কোনদিন ছিল না,নেই ও। সবাই জানে বড়দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য তারে বাঁধা।  পেশায় ইস্টার্ন রেলের গার্ড,ভয়ানক ব্যস্ত জীবন, ভয়ানক অনিয়মিত ডিউটি আওয়ার, তার ওপর বিশাল পরিবারের বড়কর্তা, দুই পুত্রকন্যার জনক, তাও যখনিই বিপদে পড়েছি, যখনই নিঃসঙ্গ বোধ করেছি দেখেছি ঘেমো হেলমেটটা হাতে নিয়ে বড়দা এসে হাজির। 


আজ সকালে বড়মাসির বাড়ি যাবার আগে, তাই অভ্যাস বশতঃই ফোন করলাম,‘ দাদা তুমি কোথায়?’বড়দা তখন ট্রেন চালাতে ব্যস্ত। কখন বাড়ি ফিরবে দাদা, জবাব এল রাত দশটায়। ‘কাল আসবি? তাহলে গল্প করা যেত। কতদিন কথা হয় না।’ দেখা হয়না সত্যিই,দেখা করতেই তো তৈরি আমি আর তুত্তুরী, কিন্তু কাল তো বন্ধুদের গেট্টু, বললামও সে কথা। অনুরোধের স্বরে দাদা বলল,‘সন্ধ্যা বেলা আয় অন্তত?দেখ না?’ চিরদিন তো নির্দেশ দিত দাদা, এটা পড়ে রাখবি, ওটা লিখে রাখবি, চিত্রহার দেখবি না,সুপারহিট মুকাবিলা দেখবি না। আজ তিনি অনুরোধ করলে হবে? কাল বিকাল মানে, কাল বিকালেই যাব আমি। তুমি থাকবে তো দাদা? আবার ভেসে আসে মনখারাপ করা সুর,‘ দেখছি বলে, যদি কালকের দিনটা অফ দেয়।’


বেলা আড়াইটে নাগাদ বেরোলাম,মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে। গিরিশ পার্কে বসেন উনি, আমাদের বাড়ি থেকে গিরিশ পার্কের দূরত্ব গুগল ম্যাপ বলে সাত কিলোমিটারও নয়। তাতে কি? যেতে পড়ে পোস্তা আর ফিরতে পড়ে মহাত্মা গান্ধী রোড আর বড়বাজার। তাই হাতে পাক্কা একঘন্টা হাতে নিয়েই বেরোই আমরা। আজ নববর্ষের আগের বিকেল, আজ যে কি আছে কপালে কে জানে। এই অজুহাতেই যেতে চাইছিল না মা। সেই জানুয়ারিতে দেখানোর কথা ছিল,পিছোতে পিছোতে এপ্রিল হয়েছে। এবার পিছোলে, পুজোর আগে হবে কি না সন্দেহ। হে মা পুঁটে কালি, জ্যামের হাত থেকে বাঁচাও মা। রোজ তো জ্যাম হয়ই, একদিন যদি না হয়, তো কি এমন মহাভারত অক্ষুন্ন হবে মা? 

অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-৩) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২


‘আইসক্রিম খাবে মা?’বড়দিনের ছুটিতে চিড়িয়াখানা দেখতে আসা শিশুর মত, বিস্ফোরিত তথা উল্লসিত চোখে গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটন্ত মহানগরকে পর্যবেক্ষণ করছিল মা। খসখসে হাত দুটো কোলের ওপর আলগোছে ফেলা। বাঁ হাতের মলিন হয়ে আসা নোয়াটা ছাড়া, দুহাতে দুটো কবেকার লাল সরু পলা আর গুটি কয়েক ঝুটো সোনার চুড়ি। ছোটমাসি এলেই কিনে আনে। আর দুবোনে ভাগ করে পরে। হাতে সোনার কিছু পরো না কেন মা, প্রশ্ন করলেই নির্বিকার মুখে জবাব দেয় মা, ‘চোরে নিয়ে নেবে।’ 


নিজের ছিটেফোঁটাও যত্ন করে না মা। যৌবনে সময় পায়নি, সামর্থ্যও ছিল খুবই সীমিত। সে যুগের চিন্তাধারাও অবশ্য ছিল ভিন্নতর। আজ চাইলেই অনেক কিছু কিনতে পারে মা, সময়ও অঢেল, তবুও বদলায়নি মা। তেল, ক্রিম, ময়শ্চারাইজার ইত্যাদি অনেক কিছু কিনে দিয়েও দেখেছি, কিছুই ব্যবহার করে না মা। সব কিছুতেই অনীহা, সবেতেই ঘোর ক্লান্তি এবং অলসতা। বাবা তুলনায় অনেক সতেজ,টগবগে। জীবনের রূপ,রস,গন্ধে মাতোয়ারা। 


এটা নিয়েই কথা হচ্ছিল মায়ের ডাক্তারের সাথে। শুধু আমার মা’ই যে এমন তা নয়, আমার সমসাময়িক, আমার পরিচিত শতকরা আশি ভাগ পরিবারের একই গল্প। মায়েরা কেন যে ভোগে এত বিষাদ আর অবসাদে কে জানে? একই রকম স্থবিরতা,নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও বাবারা তো দিব্যি থাকে, ফুরফুরে-।  


প্রায় নয় বছরের সম্পর্ক আমাদের। ন বছর আগে যখন মাকে প্রথম দেখাতে এনেছিলাম, তখন ইনি বসতেন বাই পাসের ধারে এক পাঁচতারা হাসপাতালে। সোডিয়াম কমে যাওয়া জনিত সমস্যার জন্য সাময়িক ভাবে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল মা। কেমন যেন কথা বলা পুতুলের মত নিষ্পাপ, সরল হয়ে গিয়েছিল মা। মায়ের রিপোর্ট দেখে সেদিন উনি বলেছিলেন, ওষুধ খেলে কিছুটা নিশ্চয়ই উন্নতি হবে, তবে সোডিয়ামের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান কোষ, ফলে স্বাভাবিকত্বের স্থায়িত্ব বেশি দিন নয়। 


পুতুলের মত হাসিমুখের মাকে নিয়ে সেদিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরেছিলাম।তুখোড় মনের জোরওয়ালা আমার বাবাও যেন কেমন অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সাহস দিয়েছিল কেবল আমার বর।শৌভিক তখন মগরাহাটের বিডিও, আজও মনে আছে দূরাভাষে ভেসে আসা সেদিনের শৌভিক বাণী,‘আরেঃ উনি ডাক্তার হলেও ভগবান তো নয়। সম্ভবনার কথা বলেছেন কেবল। তুই এত ঘাবড়ে গেলে ওদের কে সামলাবে? আর তুই না আস্তিক?’


সত্যিই তো, আমি আস্তিক। আমি অবশ্য, অবশ্যই আস্তিক। মাথার ওপর কেউ আছেন, যিনি দুহাতে আগলে রেখেছেন আমায় আর আমার প্রিয়জনদের একথা আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি। হয়তো তাঁরই ইচ্ছায় উত্তরোত্তর উন্নতি করেছে মা। ভুলে যাওয়া তো দূরাস্ত, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে দিন দিন আরোও আরোও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে মা। কবে আমি বা বাবা কি গর্হিত অপরাধ করেছিলাম, মুখে মুখে কবে কি চোপা করেছি আমি বা তুত্তুরী সবকিছু ইদানিং ঠোঁটের আগায় থাকে আমার মায়ের। 


আজ তো ডাক্তার ম্যাডামও বললেন, ‘দিব্যি আছেন তো।  এমনিই থাকুন। খুব ভালো থাকুন।’ মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, ওণার দেওয়া ওষুধগুলো নয়, আসলে উনিই হলেন আমার মায়ের ওষুধ। কি ভাবে যে মায়ের যাবতীয় সমস্যা উনি মুখ না খুলতেই অনুধাবন করেন, চূড়ান্ত সফিস্টিকেশন থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিতান্ত ছাপোষা জীবনের তুচ্ছাতিতু্চ্ছ ঘটনাবলীর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে, ঐ ক্ষুদ্র পরিসরে নিজের অনুরূপ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন আমি অবাক হয়ে দেখি। আগে শুধু শাড়িই পরতেন, এখন শুধুই পশ্চিমী পোশাক পরেন। তখনও নিরাভরণ থাকতেন, আজও তাই। তবে যখন শাড়ি পরতেন, তখন শাড়ির সঙ্গে মানানসই একটা ভারি সোনার ব্রোচ লাগাতেন। একবার বলেছিলেন,‘ব্রোচটা আশা করি কেউ ছিনতাই করে নিতে পারবে না।’ 


ডাক্তারখানা থেকে হাসি মুখে গাড়িতে উঠেই আইসক্রিম খাবার প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। জানলার বাইরে বছরের শেষ চৈতালী বিকেল ক্রমশঃ গড়াচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। আগ্রহী বালিকার মত মাথা নাড়ল মা। ভাড়াটে গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম,‘একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে একটু দাঁড়াবে ভাই? মাকে কথা দিয়েছি, আইসক্রিম খাওয়াব।’ 


সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর এক পুঁচকে দোকান থেকে তিনটি আইসক্রিম কিনে গাড়িতে উঠলাম। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল গাড়িটা, পুলিশের ভয়ে এদিক, ওদিক তাকাচ্ছিল বাচ্ছা ড্রাইভার ছেলেটি। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে খেয়ে নাও আগে। তারপর ছেড়ো। আশা করি পুলিশ কিছু বলবে না। আজ বছরের শেষ দিন।’ মোড়ক খুলে ড্রাইভার আর আমি বেশ কয়েক কামড় মেরেও ফেললাম, মা তখনও নিজেরটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ‘কি হল খাবে না?’ চকলেট ফ্লেভারটা আগে তেমন পছন্দ করত না মা। এদিকে আমি তো চকলেট ছাড়া খাইও না, আর খাওয়াই ও না। তবে কি বদলে এনে দেব? জবাবে মা বলল,‘তোর বাবারটা কই? আর তুত্তুরীর?’ এই না হলে মা। আমি যে কবে এমন মা হতে পারব। তবে আর যাই করি মানে যতই হ্যাংলার মত, তুত্তুরীকে ছাড়া ভালোমন্দ খেয়ে নিই না কেন, একটা কাজ আমি কখনও করি না। তা হল কন্যার সাথে মিথ্যাচার। যাই খাই, বাড়িতে পা রেখেই সটান জানিয়ে দিই এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যে অচীরেই শ্রীমতী তুত্তুরীকে তা আমি খাওয়াব। 


এবারেও জানালাম। মায়ের হ্যাংলামিতে অভ্যস্ত তুত্তুরী, নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ঠিক আছে। মামমাম(দিদা)কে খাইয়েছ, খুব ভালো করেছ।’ এমন মেয়েকে তো ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতেই হয়, তার সাথে আমার বাপটাকেও। আর আমার পিসি, আর শ্রীমান বুল্লু কুমার। পিসি আমার অনেক কিছুই খায় না। মাংস তো জীবনেও স্পর্শ করেনি। মাছও খুব কম খায়। এমনকি মুর্গির ডিমেও পিসির অ্যালার্জি। তবে একটা জিনিস উপরোক্ত সবাই প্রচণ্ড ভালোবাসে, তা হল মোগলাই পরোটা।


 হাঁসের ডিমের মোগলাই পরোটা একটা দোকানই করে, ছোট্ট পুঁচকে দোকান। রাত নটায় বেরোলাম মোগলাই কিনতে। ‘কিন্তু কেন?’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল শৌভিকের ধমক। টোটোয় উঠে সোহাগ করে ফোন করেছি যে। কোন মতে আমতা আমতা করে, করুণ সুরে বললাম, কাল নববর্ষ তো তাই।‘তাই বলে জাঙ্ক ফুড খেতে হবে কেন?’ এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে আমার স্বাস্থ্য সচেতন গৃহস্বামীকে। রাত নটাতেই কেমন যেন নিঝুম পুরী হয়ে উঠেছে আমাদের পাড়াটা। ক্লাবের মাঠে আড্ডারত গুটি কয় চ্যাংড়া ছাড়া, সব কিছু শুনশান। এমনকি কুণ্ডলী পাকিয়ে পথের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়ার সারমেয় কুল ও। মোড়ের মাথায় অবশ্যি কিঞ্চিৎ জন সমাগম পেলাম। তবে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিল কদমতলা বাজার। এত লোক কি সত্যিই হাওড়া শহরে থাকে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল, এত লোক কি কাল সত্যিই খাসির মাংস খাবে? মাংসের দোকানের সামনে যা ভিড়, দুজন সিভিক পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড়, শাড়ির দোকানেও দম বন্ধ করা ভিড়।রাত বারোটা অবধি চলবে আজ বিকিকিনি। 


 মধ্য রাত্রি অবধি জমজমাট পারিবারিক আড্ডা মেরে সবে শুয়েছি, ভেসে এল মায়ের প্রশ্নবাণ, ‘হ্যাঁ রে, কাল তোর বন্ধুরা সব আসবে তো?’ হ্যাঁ তো।  কাল আমাদের গেট্টু তো। ‘তো কারা আসবে?’ জানি না তো। এখনও কিছু ঠিক হয়নি। 'কখন আসবে?'  সেটাও তো ঠিক বলতে পারছি না। দুপুর বেলা এটুকু জানি শুধু। ক্রমশঃ বিরক্তি চড়ছে মায়ের গলায়, ‘তা খাবি কি?’ ঢোক গিললাম, জবাব একই, এখনো কিছু ঠিক নেই। কি যে হবে কাল।চৈতালিকে একবার ফোন করব কি? ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে বারো। গালাগাল দেবে নির্ঘাত, তবে মায়ের কাছে গাল খাবার থেকে, চৈ এর গালাগাল ঢের ভালো রে বাবা।

 

অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব- ৪) 


যত দূর সম্ভব, উৎকণ্ঠা, হীনমন্যতা,সম্ভ্রম আর ভয় মিশিয়ে ডাকলাম,‘মা, ইয়ে মানে তোমাদের ঝ্যাঁটা আর ন্যাতা কোথায় থাকে গো? আর ফিনাইলটাও লাগত একটু।’এমনিতেই সকাল থেকে ক্ষেপে আছেন গর্ভধারিণী। আজ নববর্ষের পূণ্য প্রভাতে যেখানে সারা বাংলা কাক ভোরে ঘুম ভেঙে, পূণ্যস্নান সেরে, ঈশ্বর তথা গুরুজনদের নববর্ষের প্রণাম, লঘুজনদের স্নেহাশিস জানানোর পর্ব সেরে ফেলেছে, সেখানে অধম আমি ঘুম থেকেই উঠেছি বেলা নটায়। 


সত্যি বলছি মাইরি, এত বেলা হয়ে যাবে আমিও বুঝতে পারিনি।ভোর ৬টা ৩২এ ডেকেছিল বটে মা, দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেও কেন এত ভোরে উঠব, এই নিয়ে এক প্রস্থ অশান্তি করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মেয়েকে জড়িয়ে। অতঃপর আর কি? অতি কষ্টে যখন একটা চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম, ঘড়ি বলছে নটা বেজে গেছে। জানলার বাইরে প্রবল বিক্রমে দেদীপ্যমান দিনমণি। পাশের বিছানা খালি, অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী আগেই উঠে গেছেন বহুক্ষণ আগেই। 


চোরের মত গুটি গুটি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে দেখি, রিল তুলছেন আমার কন্যা। বেশ কিছুদিন ধরেই রিল বানানোর জন্য অনুরোধ উপরোধ করছে বটে তুত্তুরী, ওর সমস্ত বন্ধুরা নাকি বানাচ্ছে, আমি ঢেঁকি গিলিনি অবশ্য। তবে আমার বৃদ্ধ বাপ যে গিলেছে, বেশ বুঝতে পারলাম। অদূরে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আমার মা আর আমার মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মুখে ধূমপান করছে বাবা। মায়ের মোবাইলটা কায়দা করে ধরে তুত্তুরী বলছে,‘হ্যালো বেব্বি!কাঁইসে হ্যায়?’ মায়ের বোধহয় বলার কথা,‘একদম মস্ত।’ গতকাল থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে বহুবার ট্রেনিং দিয়েছে তুত্তুরী। রিল বানানোর ট্রেনিং। আজ আমি ঘুমোচ্ছি দেখে সুযোগ বুঝে তার চূড়ান্ত মঞ্চায়ন হচ্ছে। মা যদিও ফেল্লু ছাত্রীর মত কিছুই বলল না, আমার দিকে একপলক ক্রুর বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তুত্তুরী থুড়ি তার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল। দাঁতে দাঁত চিপে তুত্তুরী বলল,‘বলো মামমাম, ‘উ কৌন হ্যায়  বেবি?’ মা তাও কিছু বলল না। বিরক্তি চেপে নিজেই পার্টটা বলে তুত্তুরী,‘উ?’ বলে ইশারায় বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,‘উ তো হামরি দাদু হ্যায়। আ রে মোটকাঃ, ইধার আ।’ বিগত শারদীয়ায় পক্ষকাল হাসপাতাল বাস করে ফিরে বাবার চেহারা হয়েছে হাড় জিরজিরে। বেল্ট দিয়েও আর কোমরে থাকতে চাইছে না প্যন্ট গুলো। সেই নিয়ে বাবার মনোযাতনার শেষ নেই। তবুও তিনি মোটকা সেজে, সিগারেট হাতে থপথপ করতে করতে এলেন। বাকি টুকু বলার জন্য তৈরিও হল তুত্তুরী, কিন্তু সবকিছুতে জল ঢেলে উঠে পড়ল আমার মা জননী। ‘তোমরাই করো ওসব রিল মিল। আমার কি অত সময় আছে? সব লাটসাহেবেরা একে একে ঘুম থেকে উঠছেন, তাদের চা দিতে হবে তো।’  


চা, প্রাতঃরাশ খেয়ে, লক্ষ্মীমেয়ের মত স্নানার্চনা সেরে গুরুজনদের হাতে কলমে এবং ফোনে প্রণামও সেরে ফেললাম। তাও একফোঁটা প্রসন্নতা ফুটল না মাইরি মায়ের চোখে মুখে। এমনিতেই মা খচে আছে, তার ওপর আবার আজ আমাদের গেট্টু। তাও এই বাড়িতেই। 


 নিয়মিত অথবা অনিয়মিতই সই যাঁরা এই অধমের ডাইরি পড়েন, তারা সকলেই জানেন আশা করি যে আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা নিঃসন্দেহে মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। তারাসুন্দরীর প্রাক্তণী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের, ‘তারা’ বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি দুদশকেরও বেশি হতে চলল, তবুও ঢিলে হয়নি বাঁধন। আজও চৈতালীর ভাষায় আমরা ’বেঁধে বেঁধে থাকি, বেঁধে বেঁধে রাখি’ একে অপরকে। ঘর-বাইরের হাজারো সমস্যা, জটিলতা সামলে, পেশাদারী আর গার্হস্থ্য জীবনের সাম্য বজায় রেখে, কন্যা-সহধর্মিনী-মাতার  নাম ভূমিকায় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেও আমরা সময় চুরি করে রাখি একে অপরের জন্য।সবাই হয়তো পারি না,সবসময় হয়তো পারি না, তবুও চেষ্টা করি সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ শাড়ি পরে বুড়ো স্কুলটায় গিয়ে হাজির হতে, চেষ্টা করি দোল পূর্ণিমার রাতে পূর্ণ চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে সম্মিলিত ভাবে ভাঙের গ্লাসে চুমুক দিতে, চেষ্টা করি লালসাদা শাড়ি আর মাথায় সুগন্ধী জুঁই-বেলির মালা নিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে, সারা রাত জেগে পুজোর কলকাতায় টহল দিতে, কালি পুজোর সন্ধ্যেয় একসাথে ছানাপোনা নিয়ে বাজি পোড়াতে ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এবারের বর্ষবরণটা পুরো ঘেঁটে গেছে শুধু আমার জন্য। প্রিয়জনদের অসুস্থতার জন্য বার বার পিছিয়ে গেছে মিলিত হবার দিনটা। শেষ পর্যন্ত যদিও আমি এসে পৌঁছেছি আমার প্রিয় শহরে, কিন্তু বাকিরা পারবে কি? সেটা জানতেই গতকাল মধ্য রাতে ফোন করেছিলাম চৈতালীকে। রাত সাড়ে বারোটায় কাউকে ফোন করে সোহাগ করতে গেলে যে রকম প্রিয় সম্ভাষণ প্রত্যাশিত, তাই পেয়েছি। সেসব সুশীল সমাজে লেখার অযোগ্য।


যদিও এতদসত্ত্বেও চৈ শুধু আমারই জন্য অত রাতে কনফারেন্স কলে ধরে ছিল প্রায় সব্বাইকে। ফলাফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। কয়েকজন রূপসী যথারীতি নিদ্রামগ্ন হয়ে ফোনই তোলেননি।  বাকিদের নানা পূর্ব পরিকল্পনা, পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে। কারো বা তরল দাস্ত হচ্ছে, কেউ বা গিয়ে বসে আছেন গ্রামের বাড়ি। এমনকি আমি দিন দুয়েকের জন্য হাওড়া গেলেও যে শতেক ব্যস্ততার জাল কাটিয়ে প্রতিবার ছুটে আসে, সেই অন্তু ওরফে অন্তরাও বলল, ‘শোন না, বছরের প্রথম দিন তো, বরের সাথে না খেয়ে গেলে কি হয় বল! তবে আমি যাব। যাব বলেছি যখন, যাবই। একটু বেলা হবে এই যা।’ অন্তরার খুব তাড়াতাড়ি মানে বেলা আড়াইটে/তিনটে। বেলা হবে মানে, নির্ঘাত সন্ধ্যে বেলায় এসে হাজির হবেন তিনি। 


মোদ্দা কথা হল, আজ আমাদের গেট্টু আছে বটে, তবে কারা আসবে জানি না। কখন আসবে তাও জানি না। এমনকি, কি খাওয়া হবে সে ব্যাপারেও সম্পূর্ন অন্ধকারে আমি। বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে মা, রহস্য করে এড়িয়ে গেছি। সত্যি কথাটা বললে যে কি হবে-। এখন মধ্যাহ্ন, চৈ মেসেজ করেছে দেখলাম, বেলা আড়াইটে নাগাদ আসবে। মানে তার আগে পারবে না। সঞ্চিতাকে পান আনতে বললাম,তিনি  লিখেছেন, পান আনতে অপারগ। পানের পরিবর্তে মাংস চলবে কি? কারণ তিনি শুধু আমাদের জন্যই রেঁধে আনছেন ,সুতরাং আর কিছু না থাকলেও সঞ্চিতার মাংস থুড়ি  করা মাংসটুকু অন্তত জুটবে। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে দিয়ে এক বোতল সাদা আর এক বোতল কালো কোল্ড ড্রিংকস ও আনিয়ে রেখেছি। শীতল পানীয়ের ক্ষেত্রে বড্ড বর্ণ বিদ্বেষী ব্যাটারা। কেউ সাদা ছাড়া খান না, তো কেউ কৃষ্ণের(বর্ণ) অনুরক্ত। 


বেলা সাড়ে বারোটা, সবে খাটের তলায় ঢুকেছি ঝাঁট দিতে, নীচে থেকে আমার বাপ আর আমার কন্যার যুগপৎ চিৎকার,‘ ফোন এসেছেএএএএ।’ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সরলতার সুযোগ যে যেমন ভাবে পারে নেয়। মায়ের কাজের দিদি নাকি প্রত্যহ দোতলা ঝাঁট দেয় আর সপ্তাহে দুদিন মোছে। এতদসত্ত্বেও আমার এই অপটু হাতেই বেরিয়েছে কয়েক কিলো ধুলো। শোবার ঘরের মেঝে জুড়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে শ্রীমতী তুত্তুরীর পায়ের ছাপ। তিনি বিগত দুদিন স্নান সেরে ভিজে গা এবং পায়ে কোথায় কি বিভঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। তড়িঘড়ি বেরোতে গিয়ে মাথা ঠুকলাম খাটে, ফোনটাও গেল কেটে। মাঝখান থেকে ফোন দিতে আসা  শ্রীমতী তুত্তুরী আমার মাকে গিয়ে লাগলেন,‘মামমাম, মা তোমার একটা পেলমেট ভেঙে ফেলেছে।’ সত্যি বলছি ধর্মাবতার, মোট্টেই আমি ভাঙিনি। আমি তো সবকটা জানলার পর্দা কেবল সরাতে গিয়েছিলাম। তিনি স্বেচ্ছায় সটান ভেঙে আমার মাথায় পড়েছেন।


মায়ের রোষ কষায়িত নয়নের সামনে দিয়ে মাথা নীচু করে গিয়ে ফোনটা নিলাম। বাবা যদিও বলছে, ‘ভেঙেছিস বেশ করেছিস। বাপের পর্দাই তো ভাঙলি। ও ঠিক আছে।’সাধে তুত্তুরীকে বলি, আমার বাপটার কোন তুলনা নেই। রুণা ফোন করেছিল। ‘শোন না তোদের বাড়ির দরজাটা ঠিক চিনতে পারছি না।’ মানে! রুণা আসছে নাকি? কত বছর বাদে? সেই বোধহয় শেষ ১৯৯৭সালে আমাদের বাড়ি এসেছিল রুণা। তড়িঘড়ি পায়ে জুতো গলিয়ে, ‘তুই দাঁড়া, আমি তোকে নিয়ে আসছি’, বলে রোয়াকে বেরিয়ে দেখি ঠিক আমাদের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে রুণা। ‘দ্যাখ ভুলিনি তো?’ সত্যিই ভোলেনি মেয়েটা। পঁচিশ বছর পরে, যার মধ্যে বিশ বছর এই জেলার বাইরে থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছে আমাদের বাড়িটা। স্কুলের বন্ধুত্ব গুলো বোধহয় এমনিই হয়, মূল্যবান মদের মত। যত পুরাণ ততো দামী। 


দেখে আশ্বস্ত হলাম যে রুণাও শাড়ি পরেনি। যা চিড়বিড়ে গা জ্বালানো গরম আজ হাওড়ায়। সঞ্চিতা যদিও ভয়ানক সুন্দর একখান শাড়ি পরে হাজির হল। রোয়াকে বসে রকবাজি মার্কা গসিপ, প্রচুর ছবি তোলার ফাঁকে মা একবার জিজ্ঞাসা করল বটে, ‘তা তোরা খাবি কি?’ শুধু মাংস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস? তাও দোতলায় গিয়ে?মায়ের দুচোখে চূড়ান্ত অবিশ্বাস। তড়িঘড়ি বলি, না না আরোও কিছু তো নির্ঘাত খাব। শ্রীমতী তুত্তুরী, বুল্লু বাবু, রুনার মেয়েও তো খাবে। আমরা অধঃপতিত বটে, তবে এতটাও নয়। রাইস বা নুডলস কিছু নির্ঘাত অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তা অর্ডারটা দিল কে? কেন চৈতলী। নির্ঘাত অর্ডার দিয়েছে চৈ। হ্যাঁ রে চৈ খাবার কখন আসবে রে?  আকাশ থেকে পড়ে চৈতালী, ‘ধ্যার ব্যাটা। আমি আবার খাবার অর্ডার দিলাম কখন? তোকে বললাম না, আমি পুজোয় বসেছি।’ 


 শেষ পর্যন্ত খাবার এসে পৌঁছেছিল বেলা তিনটায়, আর অন্তু সন্ধ্যা ছটায়। একরাশ ভুলে ভরা বছরের প্রথম দিনের সূর্য ডুবতে ডুবতে কি জানি কি বার্তা দিয়ে গেল, হয়তো বলে গেল, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, তবে যে কটা দিন এমন ভাবে যায়, যাক না- মন্দ কি? (শেষ)