Saturday 7 May 2022

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২২

 


‘দিদি কাল আমার সাথে যাবে?’ যাঁর উদ্দেশ্যে বলা, তিনি ঘোলাটে দৃষ্টিতে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। সম্পর্কে আমার বাবার দিদি, কিন্তু আমরা চার খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও দিদি বলেই ডাকে। ৮৬টা বসন্ত কাটিয়ে ৮৭র দিকে পা বাড়িয়েছে দিদি। একমাত্র হাই প্রেশার ছাড়া ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়।  খুড়তুতো ভাই অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’ অমনিই আমার পিসি। 


আজ শ্রীমান অনিন্দ্যর জন্মদিনের পার্টি। আমরা অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী হাওড়ায় গেলেই একটা না একটা পার্টি হয়ই। ‘পার্টি’ শব্দটা নিছক গৌরবার্থে ব্যবহার করি আমরা, আসলে তিন প্রজন্ম মিলে সামান্য খাওয়া দাওয়া। একটু গানবাজনা। চৈতি অর্থাৎ আমাদের আদরের ভাতৃবধূর নাচ আর রাত সাড়ে বারোটা- একটা অবধি চুটিয়ে আড্ডা, এই আর কি। অনিন্দ্যর আসল জন্মদিনটা হয়ে গেছে সেই মার্চ মাসের শেষের দিকে। তখন সিমলিপালের জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর যতবারই অনিন্দ্য(এঃ ডাকনামটা বাদ দিয়ে পোশাকি নামে ডাকতে কি অস্বস্তিই না হচ্ছে।) খাওয়াতে চায়, কিছু না কিছু কারণে পিছিয়ে যায় ব্যাপারটা। এবারে তাই হাওড়ায় আসার আগে, যেচেই পার্টি আদায় করেছি আমি আর তুত্তুরী। 


কেক কাটার তালে তালে দারুণ জমে উঠেছে আমাদের পার্টি। আমাদের আনন্দে সামিল হতে আবহাওয়াটাও হঠাৎ যেন ভোল বদলে ফেলেছে। একতলার বসার ঘরটায় হৈ হৈ করে এসে ঢুকছে  তুমল ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভিজতে ভিজতেই পিসিকে বললাম,‘কাল সকালে আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ বুড়ো পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’ 


সবাই মিলে বললাম, পারবে না মানে? মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। সোমবার ভোরে বেরোব আর বুধবার বিকেলে ফিরে আসব। ঈদ যদি সোমবার হত, তাহলে আর এভাবে তমলুক ফিরতে হত না।  আমাদের হক বাবু বলেও ছিলেন,‘ঈদ সম্ভবতঃ সোমবারই হয়ে যাবে ম্যাডাম।’ আমিও আশায় আশায় ছিলাম। একটু আগেই হক বাবু জানালেন, ঈদ মঙ্গলবার। অর্থাৎ কাল আপিস যেতেই হবে। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য থেকেই যাবেন। ঈদের ছুটি কাটিয়ে ফিরবেন। তখন না হয় আমার সাথে ফিরে আসবে পিসিও। 


শ্রীমান অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’ কটা বুড়ি পিসিকে এত ভালোবাসে তার ভাইপোরা কে জানে! 


বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি থুড়ি বুড্ডি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। এরপর কখন যে পিসি ব্যাগ গুছাবে আর কখন যে ঘুমাবে ভগবান জানে। আপাতত আমি ঘুমাতে গেলাম, কাল ভোর ভোর বেরোব আমরা, উত্তমকুমারের গাড়ি চেপে। 


No comments:

Post a Comment