Saturday, 7 May 2022

অনির ডাইরি ৩০শে এপ্রিল, ২০২২

 


রাত আটটা। বাইরে মুষলধারে  বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সাথে তীব্র ঝড়ো হাওয়া। প্রায় আধেক ঘন্টা ধরে একই অবস্থা। বিরক্ত হয়ে মেসেজ করলাম,‘ আমি যদি না যাই, তোরা কি খুব দুঃখ পাবি?’ বৈশাখীর গলাটা এমনিতেই ভয়ানক মিষ্টি, আরো মিষ্টি লাগে যখন কাঁদো কাঁদো গলায় অনুনয় বিনয় করে। ‘এমন করিস না অনি। আমার এত দিনের শখ। তুই আমার জন্য তমলুক থেকে হাওড়া এলি, আর এইটুকু আসতে পারবি না? প্লিজ আয়।’ যাব এবং অনেকক্ষন থাকব বলেই না সংসার গুছিয়ে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিয়ে তমলুক থেকে বেরিয়েছি। সাতটা নাগাদ হাওড়ার বাড়িতে ঢুকে, ব্যাগটা রেখে, মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই দৌড়াব, এমন বাদ সাধল প্রকৃতি। বৈশাখীর জন্মদিনে কালবৈশাখী, কি আজব সমাপতন মাইরি। 


 যাঁরা আমার অনির ডাইরির নিয়মিত পাঠক, তাঁরা সকলেই জানেন, আর যাঁরা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে, হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যলয়। তারা সুন্দরীর প্রাক্তনী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি প্রায় সিকি সেঞ্চুরী হতে চলল, আজও চৈতালীর ভাষায়,আমরা ‘বেঁধে বেঁধে থাকি,বেঁধে বেঁধে রাখি।’ ফেসবুক হোয়াটস্অ্যাপে একে অপরের হাঁড়ির খবর তো রাখিই, তাছাড়াও ছলছুঁতো খুঁজতে থাকি,সামনাসামনি মিলিত হবার। 


আধিকারিক-সাংসারিক- বৃহত্তর পারিবারিক, সামাজিক যাবতীয় চরিত্রে প্রথাসিদ্ধ রূপদান করার সফল/বিফল প্রচেষ্টার মধ্যেও আমরা ঠিক সময় খুঁজে নিই একে অপরের জন্য। সময়ের স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটে, ভৌগলিক দূরত্বকে তুড়ি মেরে আজও সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ পোশাকে আমরা সমবেত হই বুড়ো স্কুলটায়। সবাই হয়তো পারি না, সবসময় হয়তো পারি না, তবুও দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় চৈতালীদের ছাতে আবির মেখে ভাঙের আসর না বসালে কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় আমাদের বসন্তোৎসব। নববর্ষের প্রাক্কালে আমাদের বাড়ির দোতলায় সাদা লাল পোশাকে জমে ওঠে আমাদের বর্ষবরণ। সব তারাদের জন্য গুণে গুণে বেল আর জুঁই ফুলের মালা কিনে আনে অনিন। আমার বিয়ের খোঁপার কাঁটা আর হেয়ারপিন,যা পরম যতনে গুছিয়ে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা, ব্যাগ খুলে উল্টে দেয় তুত্তুরী। আহাঃ মাসিরা মাথায় ফুল লাগাবে যে- 


প্রথম কাশফুল ফোটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে আমাদের উন্মাদনার পারদ। কোথায়, কবে দেখা হবে তারাদের? কোথায় হবে প্রি-পুজো খাওয়াদাওয়া, কোথায় বসবে পুজোর তারার হাট? এমনি কোন আড্ডায় একবার বলেছিল বটে বৈশাখী,‘জানিস, আমার খুব ইচ্ছে, তোদের সাথে জন্মদিন পালন করার। তোরা আসবি?’ তখন তো সবাই বলেছিলাম, অবশ্যই যাব। পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। তারপর যা হয়, সব স্মৃতি, সব প্রতিশ্রুতির ওপর জমে সময়ের ধুলো। ‘কিছু ভুলেছ তুমি, আমিও গেছি ভুলে’। 


ঘোরতর আপিস টাইমে বৈ যেদিন ফোন করে মনে করায়, প্রাথমিক অভিব্যক্তিটা ছিল, ভাগ ব্যাটা। সপ্তাহের মাঝখানে জন্মেছিস কেন? দীর্ঘ বাদানুবাদের পর দেখা গেল,  এ বছরটায় অন্তত তিনি সপ্তাহান্তেই জন্মেছেন। তাও আসল জন্মতিথিতে আর পৌঁছে উঠতে পারলাম না আমরা। এক সাথে এক ডজন তারার সহাবস্থান কি মুখের কথা? বিশেষতঃ এই দুর্দম গরমে। আজ এর বাচ্ছার জ্বর, তো কাল সে শৌচালয়ে শয্যা পাতে। 


হয়তো আরো পিছিয়ে যেত, যদি না কোন এক ভোরের বাতাস সুদূর পুরুলিয়া থেকে বয়ে আনত বিশেষ বার্তা,‘ আমি আসছি। তোরাও আয় ভাই।’ দেবু আর বৈ উভয়েরই জন্মতিথি এক। বার বার কাতর অনরোধ করছিল বটে বৈ,‘ আয় দেবু এক সাথে কেক কাটি।’ আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি, প্রিয় বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সত্যিই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চেপে বসবে দেবু। অত দূর থেকে দেবু আসতে পারলে, একটা নদী এপার ওপার করতে পারব না আমরা?


শনিবার বিকেল পাঁচটায় যখন তুত্তুরী সহ রওণা দিলাম তমলুক থেকে, তখনও রোদের দমকে ভাপ ছাড়ছে উত্তপ্ত মাটি। ঝকঝকে আকাশ। মোবাইলে টুং টাং মেসেজ, ‘কটায় ঢুকছিস?’ ‘কি পরছিস?’ ' এই গরমে শাড়ি পরার নামও করিস না' ইত্যাদি প্রভৃতি। হাওড়ায় ঢোকার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে গেল মরশুম। প্রথমে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক, তারপরই প্রবল ঝড় এবং মুষলধারে বৃষ্টি। একে তো আবহাওয়ার চোখ রাঙানি, তার ওপর আমার মায়ের রক্ত চক্ষু। এত রাতে, এই আবহাওয়ায় তুত্তুরীকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা মায়ের কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। 


একাধারে আমার গর্ভধারিণী অপরদিকে প্রকৃতির যুগ্ম চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে আধ ভেজা অবস্থায় বৈ এর বাড়ি যখন পৌঁছালাম, রাত সোয়া আটটা। তুত্তুরীর কান বাঁচিয়ে বর্ষিত হল একরাশ খিস্তিখেউড়, আসব না বলার গর্হিত অপরাধে। অপরাধই তো। শুধু আমাদের জন্য, কি খাটুনিই না খেটেছে সদ্য জন্মানো দুই তারা। বিগত দুদিন ধরে ক্ষেপে ক্ষেপে বাজার করেছে বৈ, আজ সকাল থেকে ছানাপোনা সহ আমাদের জন্য সবটুকু নিজ হাতে রেঁধেছে। পুরুলিয়া থেকে হাওড়া স্টেশনে নেমেই ছুটে এসেছে দেবু। হাত লাগিয়েছে প্রাণের সহচরীর সাথে। 


জানলার বাইরে প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নাচ,গান, আনন্দ,হুল্লোড়ের কয়েকটা ঘন্টা যে কিভাবে কেটে গেল। কব্জি ডুবিয়ে নৈশাহার সেরে,  রাত পৌনে বারোটার সময় যখন গলির মুখে নামিয়ে দিল রাখি, ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো পাড়া। এমনকি পাড়ার সারমেয়গুলোও  কুণ্ডলী পাকিয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তখনও অভুক্ত অবস্থায় আমাদেরই জন্য প্রতীক্ষমাণ। যথারীতি মায়ের 'এত সাহস ভালো নয়' এর সাথে বাবার, ' হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো। আমরাও তো এমনিই ছিলাম,নাকি। ১৯৫৮র স্কুল ফাইনালের ব্যাচ আমাদের, ২০১৬ অবধি এমনিই উদ্দাম আড্ডা, ফিস্ট, ফ্যামিলি ফিস্ট করে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। তারপর কি যে হল, একে একে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিল অনেকে, বাকিরা এমন অসুস্থ, স্থবির হয়ে পড়ল, কেউ কেউ হাওড়া শহরের পাট গুটিয়ে ছেলেমেয়ের কাছে অন্য শহরে চলে গেল,  নাহলে দেখতিস আজও হত আমাদের আড্ডা। আর তুই তো আমারই মেয়ে। বেশ করেছিস।' এই না হলে আমার বাবা। মুখ হাত ধুয়ে, পথ শ্রম আর হইচই পর্বের ক্লান্তিতে যখন ঢুলে আসছে চোখ, ভেসে এল সেই চিরাচরিত স্নেহ আর ভালোবাসায় জবজবে কথা গুলো, ' হ্যাঁ রে, পেট ভরে খেয়েছিস তো? নাকি আমাদের সঙ্গে একটা রুটি খাবি-। দুটো রুটি বেশি করেই করেছি কিন্তু ’ অন্য সময় হলে হয়তো হেসেই গড়িয়ে পড়তাম, আজ কেন জানি না, মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। ভালোবাসার এই মুহূর্তগুলো কেন যে এত স্বল্পস্থায়ী। খেতে তো পারব না, তবুও একটু না হয় এমনিই বসি ডাইনিং টেবলে। জানি গল্প শুনতে উন্মুখ হয়ে আছে দম্পতি। গল্প বলতে বলতে বন্ধুদের সাথে চলুক ছবি দেওয়া নেওয়া, আরো বহু বহু বছর যেন এভাবেই একে অপরের অ্যালবাম ভরিয়ে রাখতে পারি আমরা। ট্যাগ হোক, ত্যাগ নয়।

No comments:

Post a Comment