অনির নববর্ষের ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২২
নগর কলিকাতার থেকে একদমই অন্যরকম জীবন হেথায়। অনেক সিধাসাদা, অনেক ঢিলেঢালা। ঘড়ির কাঁটা যেন সামান্য হলেও ধীরে নড়ে হেথায়। মহানগর ছেড়ে সুদূর তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী হবার সিদ্ধান্তটা ছিল নিছক আমার একার। শৌভিকের বরং ঘোর আপত্তিই ছিল। বাড়ির পাশের বিধাননগর পোস্টিং ছেড়ে কোন পাগলে যেচে পূব মিদনাপুর যায়?
নবোঢ়া হলেও কিঞ্চিৎ বোধগম্য হত ব্যাপারটা, বিবাহিত জীবন কেটে গেছে একযুগেরও বেশি, তারপরেও একসাথে থাকার এত আদিখ্যেতা কিসের বাপু? দিব্যি তো ছিলাম, বর কাছে না থাকলেও, ফোন তুললেই সুইগি আর জ্যোমাটো তো থাকত। রাস্তা পেরোলেই ছিল হাবিব, রিক্সায় চাপলেই পৌঁছানো যেত তুত্তুরীর স্কুলে, মস্ত স্কুল। স্কুলের মধ্যে বুড়ো চার্চ। একটা অটো ধরলেই পৌঁছে যেতাম সিটিসেন্টার। সুইমিং ক্লাব থেকে চব্বিশ ঘন্টা খোলা জিম সবই ছিল হাতের নাগালে। অবশ্য ওসব থেকেও যে আমার কোন পরিবর্তন ঘটেছিল, তা নিন্দুকেও বলবে না। তবুও তো ছিল। তুত্তুরীর দাঁতগুলোও তো অবশিষ্ট ছিল। যদি না আসতাম এই জেলায়, অক্ষতই থাকত হয়তো-
এই জেলায় এসে কি শিখেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী,শিখেছেন পাঁচফোড়নকে সোমরা বলে, শিখেছে কুমড়োকে বৈতাল বলতে, পেঁপে গাছকে পিপা বলতে। চিনেছেন ওলকপি, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা,বেগুন, হলুদ,আদার মত হরেকরকম গাছ। চিনেছেন তথা আস্বাদ করেছেন নানা ধরণের শাক। ঘরোয়া পুঁই-পালং-কলমি ছাড়াও চেখেছে সুষনি শাক, গিমে শাক, হিংচে শাক। জেনেছে কচি পটল সুস্বাদু হলেও, পলতা বেশ তিতো হয়। আর পটল গাছের শিকড় তো মারাত্মক বিষ।
শুধু যে গাছ চিনেছে তাই নয়,নিজের হাতে সব্জি তুলতেও শিখেছে তুত্তুরী। মাটি থেকে দুহাতে উপড়ে তুলে এনেছে ওলকপি। গাছের ডাল থেকে ছিড়তে শিখেছে কচি শসা বা টমেটো, রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে গিয়ে কাটতে শিখেছে লাউ,কুমড়ো আর পুঁই শাক। শাক তুলতে গিয়ে গুচ্ছের ব্যাঙ, ফড়িং এমনকি সাপও চিনেছে বটে গুটি কয়েক। তবে তেনারাই তো আমাদের ভয়ে অস্থির।
তুত্তুরীর হাতে তোলা বাগানের একরাশ সব্জি নিয়ে এক মাস পরে ফিরছি নিজের শহরে। গঙ্গা পাড়ের, ধূলিমলিন, পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা আজও আমার প্রিয়তমা। ক্যালেণ্ডারে লাল দাগ দেখলেই ঘরে ফেরার জন্য হাঁকপাঁক করে চিরকেলে ঘরকুনো মনটা আমার। সাঁতরাগাছি স্টেশনের জ্যাম কাটিয়ে এগোনোর সাথে সাথেই চড়তে থাকে ঘরে ফেরার উত্তেজনার পারদ। এ যেন অকাল শারদীয়া। ঝলমলে রেস্তরাঁয় ঘেরা বেলেপোল থেকে বাঁদিকে বেঁকে, ৫২র চৌরাস্তায় খানিক থমকে, ইছাপুর জলট্যাঙ্কে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে গিয়ে সোজা কদমতলা বাজার। এই পড়ন্ত সন্ধ্যাতেও এক রাশ টাটকা সব্জি আর ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বাজার। দেদার বিক্রি হচ্ছে মাছ আর মুর্গি। নগর কলিকাতার বাসিন্দাদের জন্য এ অতি সাধারণ দৃশ্য হলেও, সুদূর মেদিনিপুরের উত্তমকুমার প্রতিবার মুগ্ধ হয়ে যায়। যেমন মুগ্ধ হয়ে যাই আমি। এখানে এলেই কেন জানি না, ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইডের মত, আমার ঝড়ু বাজারু সত্ত্বা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
লাল-সবুজ-কমলা আনাজ আর ফলের পাশেই স্তূপাকারে বিক্রি হচ্ছেন বিভিন্ন সাইজের দুই সহোদর-সহোদরা, শ্রীমতী লক্ষ্মী আর সবার শ্রীমান গণেশ। নববর্ষ মানেই হাওড়া শহরে হালখাতার মরশুম যে।
“কাল দয়া করে একটু সকাল সকাল উঠো”। যার উদ্দেশ্যে বলা, তিনি হাওড়া এলেই কেমন যেন প্যাঁচা হয়ে যান। এত গল্প যে কোথায় জমিয়ে রাখে মেয়েটা কে জানে। গভীর রাত পর্যন্ত একবার দাদুর সঙ্গে গল্প চলে, আরেকবার মাম্মাম(দিদার) সাথে। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না, অযথা দুটো কটু কথা শুনতে হয় মায়ের কাছে। মায়ের কটু কথা তাও হজম হয়, বাবার সেন্টুটা জাস্ট অসহ্য। কিন্তু এযাত্রা আমি নিরূপায়। এক গাদা কাজ নিয়ে এসেছি, কাল সকালে একবার বড় মাসির বাড়ি ঢুঁ মারব। কি জানি কেন দুই মাসির জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই খুব মন খারাপ। বড় দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সকলে। বিকালে মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাব, পরশু তারাদের নববর্ষের গেট্টু আছে, তরশু আবার ফিরে যাব তাম্রলিপ্ত নগরী, তার আগে একবার ঢুঁ মেরে যাব শ্বশুরালয়ে। এক ঢিলে মারা যায় যতগুলো পাখি, এই আর কি-
আমার ঝটিকা সফরের ব্যাখ্যান শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বাবা, “তাহলে আর আমাদের জন্য সময় কোথায় তোর? এত কাজ নিয়ে আসিস কেন?”
কোনমতে মুখ হাতটা ধুয়েই মায়ের ফ্রিজ থেকে ডাইনিং টেবল হয়ে সাবেকি মিটশেফের যাবতীয় কৌটোবাটা হাতড়াতে থাকি আমি। বাপের বাড়িতে ফিরলেই এত খিদে পায় কেন কে জানে? মস্ত স্টিলের টিফিন কৌটো ভর্তি লাল টুকটুকে তরমুজ জারিত হচ্ছে ফ্রিজে। এমনিতে তরমুজ আমার ঘোর অপছন্দের ফল, তাও এক টুকরো মুখে দিতেই জুড়িয়ে গেল প্রাণ। আমার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতে করতে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে আমার বৃদ্ধের মুখে। তাও জানতে চায়, “ভালো লেগেছে? মাকে বললাম, কেটে অল্প চিনি মাখিয়ে ফ্রিজে রেখে দাও।“ তরমুজে চিনি বোধহয় একমাত্র আমাদের বাড়িতেই মাখানো হয়। ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা বাবার পছন্দের দোকানের গুটি কয়েক মিষ্টির প্যাকেট। আমার জন্য কালো জাম আর তুত্তুরীর জন্য ওর মনপসন্দ ছানার মুড়কি। এসব কে কিনে আনল বাবা?
প্রশ্ন করে বিরাগ ভাজন হই। বৃদ্ধ নিজেই গিয়েছিল মেয়ে আর নাতনির জন্য তাদের প্রিয় মিষ্টান্ন ক্রয় করতে। সাথে দু হাঁড়ি পুরু সর ওয়ালা লাল দইও এনেছে, যাতে দইয়ের মাথা খাওয়া নিয়ে আমাতে আর তুত্তুরীতে হাতাহাতি না করতে পারি। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানাল বৃদ্ধ।
বিগত শারদীয়ায় এক কষাই মার্কা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এক পক্ষকালেরও বেশি হাসপাতাল বাস করে তথা শুধু স্যালাইনের ওপর বেঁচে, কেবল চেহারা খানাই অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল তাই না, শরীরের যাবতীয় পেশি বিশেষতঃ পায়ের জোরও হারিয়ে ফেলেছিল বৃদ্ধ। বাড়িতেই হাঁটতেই পারত না কতদিন, রাস্তায় বেরানো তো ছেড়েই দিন। সেখান থেকে নিজের পায়ে হেঁটে, গলির মোড় থেকে রিক্সা পাকড়াও করে সুদূর কদমতলা বাজার থেকে এত কিছু কিনে আনা তো স্বপ্নাতীত। কি করে পারলে বাবা? জবাব একটাই, অদম্য মনের জোর। আর তুত্তুরী আর আমার জন্য অপরিসীম ভালোবাসা।
সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে নাতনির হাতে তোলা আনাজপাতি দেখতে বসে মা আর তুত্তুরী। তমলুকে এসে কত রকম গাছ চিনেছে সেই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ওঠে সাপ আর ব্যাঙের প্রসঙ্গও। একদিনে পর পর একজোড়া লাউডগা দেখেছে তুত্তুরী,সেই গল্প শুনতে শুনতে আঁতকে ওঠে মা। আমি যে কোন এক স্বর্ণালী সন্ধ্যেয় খালি চোখে কোলা ব্যাঙকে মাটির ঢেলা ভেবে শট মেরেছিলাম, এবং তাতে ব্যাঙটা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে কটমট করে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে লাফিয়ে পালিয়েছিল সেই গল্প শুনতে শুনতে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে তিনজন।
বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীর দিন ফুল তুলতে গিয়ে ঠিক কিভাবে ভূপতিত হয়েছি আমি, সে দৃশ্যও অভিনীত হয় আমাদের চাটুজ্জে বাড়ির দালানে। কপালে আলু থেকে থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট হয়ে গোড়ালি মচকানো অবধি কিছুই বাদ যায়নি যার জন্য, সেই পতনের গপ্প শুনে একমাত্র পিসি ছাড়া কারো মুখে আমার জন্য একফোঁটাও সমবেদনা দেখতে পাই না আমি। আমার পতনে কি চরম আমোদিত হয় সবাই। এরা কি সত্যিই আমার আপনজন? এদের জন্যই কি আমি হাওড়া এলাম? ধুত্তেরি। শাশুড়ি মা ঠিকই বলেন মাইরি, বেঁচে থেকে কোন লাভই নেই, যা দেখছি।
(চলবে)
অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-২) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২
কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এখনও বেদম চটে আছে তুত্তুরী, ‘কেন মা কেন? তুমি একা যাও না।’ একা যেতে পারলে কি আর যেতাম না, দোলের সময় তো একাই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বড় মাসির বাড়ি। ও বাবা, কেউ খুশি হয়নি, আমাকে দেখে, সবার মুখে একটাই প্রশ্ন,থুড়ি অনুযোগ,‘মেয়েটাকে আনলি না কেন?’
মায়ে-ঝিয়ে ধরাচূড়া পরে বেরোনোর আগে, কি মনে হল, একবার ফোন করেই নি। ‘হ্যালো বড়দা। তুমি কোথায়?’ প্রশ্ন করাটা ছিল নিছক বাতুলতা মাত্র,বড়দার কতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে ভেসে আসা চলন্ত ট্রেনের ঘটাং ঘটাং শব্দ সোচ্চারে জানাল, বড়দা আপাততঃ চূড়ান্ত ব্যস্ত কর্মক্ষেত্র সামলাতে।
আমরা পাঁচ ভাইবোন, মাসতুতো শব্দটা কখনওই প্রবেশাধিকার পায়নি আমাদের মধ্যে। চার দাদার একমাত্র ‘ঢিপচালতি’ গোবরগণেশ, ল্যাদাড়ু বোন আমি।
চারজনের সঙ্গে চার রকমের সম্পর্ক, ছোটদার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান যাই হোক না কেন, বরাবরই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। মা আর বড়মাসির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সামনাসামনি সংঘর্ষ(পড়ুন হাতাহাতি)হত আমাদের। অত্যন্ত বাজে ছেলে ছিল মাইরি, আমার হাড় জ্বালাতে কি সব উদ্ভট, উদ্ভট দাবীই না করত ছোটদা। যাকেই পছন্দ করতাম, যাকেই সমর্থন করতাম, ঠিক তার উল্টো বা পরম প্রতিদ্বন্দীকেই বেছে নিত ছোটদা। বাইশ গজের মহারণে আমি ইন্ডিয়ার সমর্থক, তো ছোটদা পাকিস্তানের।
সেই সব আশি নব্বইয়ের আগুনে দিন। কল্পনা করুন, বাইশ গজের বিশ্বযুদ্ধে গোটা বাড়ি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া করে চিল্লাচ্ছে, আর ছোটদা একা পাকিস্তান- পাকিস্তান করছে। কেন? না আমার হাড় জ্বালাতে। সেসব দিনে ইন্ডিয়া হারতও বাপু। দুপক্ষের ম্যাচ মানেই গোহারান হেরে, মুখ কালো করা আমি আর ৩২ পাটি দেখিয়ে পেশি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছোটদা।
আরো ছোটবেলায়,যখন ভারত-পাক বোধ আসেনি বা ক্রিকেটের প্রতি কোন টান জন্মায়নি, আমার হাড় জ্বালাতে ছোটদা দাবী করত, সবাই মানে মা-বাবা-মাসি-মেসো-দিদা-দাদারা সবাই নাকি ছোটদাকেই বেশি ভালোবাসে, আমায় নয়। অতঃপর ষড়যন্ত্রের সুরে,‘ বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করে দেখ-’। আর আমিও অমনি হ্যাংলার মত জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম আমি, ‘হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো।’ সবথেকে বেশি ঝগড়া করেছি বলে হয়তো সবথেকে বেশি মন খারাপও ছোটদার জন্যই করে। কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই ফোন করে অকারণে খানিক হ্যাজাই। আজ আর কেউ কারো হাড় জ্বালাই না আমরা, বরং পরম মমতায় রোমন্থন করি সেসব গৃহযুদ্ধের অমূল্য স্মৃতি। কি ভালোই না ছিল সেইসব দিন, আরেকবার যদি ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া যেত-
সেজদার অন্ধ ভক্ত, অনুরাগী ছিলাম আমি। সেজদার সবকিছুই ছিল ভয়ানক অন্যরকম।রীতিমত নায়কোচিত। নিজের হাতে বাজির মসলা তৈরি করে, ঘরেই রঙমশাল, হাউই আর তুবড়ি বানাত সেজদা। যে কোন ঘরোয়া গ্যাজেট ফটাফট খুলে সারিয়ে ফেলত সেজদা। বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের যাবতীয় সমস্যা একা হাতে সামলে দিত সেজদা। নিছক চ্যালেঞ্জের বশে, পাতি ডট পেন দিয়ে ইতিহাস বই থেকে খাতায় নামিয়ে আনত কখনও নেতাজী তো কখনও টিপু সুলতানকে। যা করত, তাতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত সেজদা। নিজস্ব কি সব যেন ভাষা আবিষ্কার করেছিল সেজদা, অনর্গল বকে যেত সেই ভাষাতে। হাঁ করে শুনতাম আমি।
মেজদা ছিল এবং আছে আমার সবথেকে নরম,সবথেকে আদরের জায়গা। আমার বইয়ের আলমারির অর্ধেক জুড়ে শুধু মেজদার দেওয়া উপহার। ফি বছর বইমেলা হলেই বস্তা ভরে বই কিনে আনত মেজদা, আমার জন্য। কলেজে ভর্তি হবার লাইনে সঙ্গী হত মেজদা। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য তাড়া তাড়া সার্টিফিকেট অ্যাটেস্টেড করে এনে দিত মেজদা। আমার দাদাদের মধ্যে প্রথম মেজদার সাথেই শৌভিকের আলাপ। সে কি কেলো। ধর্মতলায় কি যেন কাজে গিয়েছিল মেজদা, পড়বি তো পড় হাত ধরাধারি করে মুখোমুখি দেখা। একটু আগে হলেও ঠেলে সরিয়ে দিতাম,ভিড়ে মিশে যেতে বলতাম তাকে, আর তো উপায় নেই। ভেবেছিলাম কান মুলে দেবে নির্ঘাত, বদলে কি মিষ্টি করে হেসে গল্প করেছিল মেজদা। হাতে একটা সদ্য কেনা জলের বোতল ছিল, ভালোবেসে সেটাই শৌভিককে গছিয়ে দিচ্ছিল মেজদা। শৌভিকও নেবে না,মেজদাও ছাড়বে না। “একটু জল খাও ভাই।” সেদিন বাসে তুলে দিতে দিতে, আমুদে স্বরে বলেছিল শৌভিক,‘শালাটা বেশ ভালো তো।’ ভালো তো হবেই, বোনকে যে বড্ড ভালোবাসত, আজও বাসে। আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে তো মেজদা ভালোবাসবেই। আজ মেজদার ভালোবাসার গল্প? সে অন্য দিন হবে খন। দাদা-বৌদির অনুমতিক্রমে, নাহলেই কপালে দুগুণ কানমলা।
বাকি রইল বড়দা। আপাততঃ যিনি ঘোর ব্যস্ত আপন কর্মক্ষেত্রে। বড়দা আমার শিক্ষাগুরু। সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে রীতিমত বেত হাতে পড়িয়েছে বড়দা। আজও যেকোন ভালো বা খারাপ খবর, বাবা,শ্বশুরমশাই আর শৌভিকের পরেই যাকে ফোন করে জানাই,সে আমার বড়দা। তাই নিয়ে মেজ,সেজ বা ছোটদার কোন নালিশ কোনদিন ছিল না,নেই ও। সবাই জানে বড়দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য তারে বাঁধা। পেশায় ইস্টার্ন রেলের গার্ড,ভয়ানক ব্যস্ত জীবন, ভয়ানক অনিয়মিত ডিউটি আওয়ার, তার ওপর বিশাল পরিবারের বড়কর্তা, দুই পুত্রকন্যার জনক, তাও যখনিই বিপদে পড়েছি, যখনই নিঃসঙ্গ বোধ করেছি দেখেছি ঘেমো হেলমেটটা হাতে নিয়ে বড়দা এসে হাজির।
আজ সকালে বড়মাসির বাড়ি যাবার আগে, তাই অভ্যাস বশতঃই ফোন করলাম,‘ দাদা তুমি কোথায়?’বড়দা তখন ট্রেন চালাতে ব্যস্ত। কখন বাড়ি ফিরবে দাদা, জবাব এল রাত দশটায়। ‘কাল আসবি? তাহলে গল্প করা যেত। কতদিন কথা হয় না।’ দেখা হয়না সত্যিই,দেখা করতেই তো তৈরি আমি আর তুত্তুরী, কিন্তু কাল তো বন্ধুদের গেট্টু, বললামও সে কথা। অনুরোধের স্বরে দাদা বলল,‘সন্ধ্যা বেলা আয় অন্তত?দেখ না?’ চিরদিন তো নির্দেশ দিত দাদা, এটা পড়ে রাখবি, ওটা লিখে রাখবি, চিত্রহার দেখবি না,সুপারহিট মুকাবিলা দেখবি না। আজ তিনি অনুরোধ করলে হবে? কাল বিকাল মানে, কাল বিকালেই যাব আমি। তুমি থাকবে তো দাদা? আবার ভেসে আসে মনখারাপ করা সুর,‘ দেখছি বলে, যদি কালকের দিনটা অফ দেয়।’
বেলা আড়াইটে নাগাদ বেরোলাম,মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে। গিরিশ পার্কে বসেন উনি, আমাদের বাড়ি থেকে গিরিশ পার্কের দূরত্ব গুগল ম্যাপ বলে সাত কিলোমিটারও নয়। তাতে কি? যেতে পড়ে পোস্তা আর ফিরতে পড়ে মহাত্মা গান্ধী রোড আর বড়বাজার। তাই হাতে পাক্কা একঘন্টা হাতে নিয়েই বেরোই আমরা। আজ নববর্ষের আগের বিকেল, আজ যে কি আছে কপালে কে জানে। এই অজুহাতেই যেতে চাইছিল না মা। সেই জানুয়ারিতে দেখানোর কথা ছিল,পিছোতে পিছোতে এপ্রিল হয়েছে। এবার পিছোলে, পুজোর আগে হবে কি না সন্দেহ। হে মা পুঁটে কালি, জ্যামের হাত থেকে বাঁচাও মা। রোজ তো জ্যাম হয়ই, একদিন যদি না হয়, তো কি এমন মহাভারত অক্ষুন্ন হবে মা?
অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-৩) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২
‘আইসক্রিম খাবে মা?’বড়দিনের ছুটিতে চিড়িয়াখানা দেখতে আসা শিশুর মত, বিস্ফোরিত তথা উল্লসিত চোখে গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটন্ত মহানগরকে পর্যবেক্ষণ করছিল মা। খসখসে হাত দুটো কোলের ওপর আলগোছে ফেলা। বাঁ হাতের মলিন হয়ে আসা নোয়াটা ছাড়া, দুহাতে দুটো কবেকার লাল সরু পলা আর গুটি কয়েক ঝুটো সোনার চুড়ি। ছোটমাসি এলেই কিনে আনে। আর দুবোনে ভাগ করে পরে। হাতে সোনার কিছু পরো না কেন মা, প্রশ্ন করলেই নির্বিকার মুখে জবাব দেয় মা, ‘চোরে নিয়ে নেবে।’
নিজের ছিটেফোঁটাও যত্ন করে না মা। যৌবনে সময় পায়নি, সামর্থ্যও ছিল খুবই সীমিত। সে যুগের চিন্তাধারাও অবশ্য ছিল ভিন্নতর। আজ চাইলেই অনেক কিছু কিনতে পারে মা, সময়ও অঢেল, তবুও বদলায়নি মা। তেল, ক্রিম, ময়শ্চারাইজার ইত্যাদি অনেক কিছু কিনে দিয়েও দেখেছি, কিছুই ব্যবহার করে না মা। সব কিছুতেই অনীহা, সবেতেই ঘোর ক্লান্তি এবং অলসতা। বাবা তুলনায় অনেক সতেজ,টগবগে। জীবনের রূপ,রস,গন্ধে মাতোয়ারা।
এটা নিয়েই কথা হচ্ছিল মায়ের ডাক্তারের সাথে। শুধু আমার মা’ই যে এমন তা নয়, আমার সমসাময়িক, আমার পরিচিত শতকরা আশি ভাগ পরিবারের একই গল্প। মায়েরা কেন যে ভোগে এত বিষাদ আর অবসাদে কে জানে? একই রকম স্থবিরতা,নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও বাবারা তো দিব্যি থাকে, ফুরফুরে-।
প্রায় নয় বছরের সম্পর্ক আমাদের। ন বছর আগে যখন মাকে প্রথম দেখাতে এনেছিলাম, তখন ইনি বসতেন বাই পাসের ধারে এক পাঁচতারা হাসপাতালে। সোডিয়াম কমে যাওয়া জনিত সমস্যার জন্য সাময়িক ভাবে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল মা। কেমন যেন কথা বলা পুতুলের মত নিষ্পাপ, সরল হয়ে গিয়েছিল মা। মায়ের রিপোর্ট দেখে সেদিন উনি বলেছিলেন, ওষুধ খেলে কিছুটা নিশ্চয়ই উন্নতি হবে, তবে সোডিয়ামের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান কোষ, ফলে স্বাভাবিকত্বের স্থায়িত্ব বেশি দিন নয়।
পুতুলের মত হাসিমুখের মাকে নিয়ে সেদিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরেছিলাম।তুখোড় মনের জোরওয়ালা আমার বাবাও যেন কেমন অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সাহস দিয়েছিল কেবল আমার বর।শৌভিক তখন মগরাহাটের বিডিও, আজও মনে আছে দূরাভাষে ভেসে আসা সেদিনের শৌভিক বাণী,‘আরেঃ উনি ডাক্তার হলেও ভগবান তো নয়। সম্ভবনার কথা বলেছেন কেবল। তুই এত ঘাবড়ে গেলে ওদের কে সামলাবে? আর তুই না আস্তিক?’
সত্যিই তো, আমি আস্তিক। আমি অবশ্য, অবশ্যই আস্তিক। মাথার ওপর কেউ আছেন, যিনি দুহাতে আগলে রেখেছেন আমায় আর আমার প্রিয়জনদের একথা আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি। হয়তো তাঁরই ইচ্ছায় উত্তরোত্তর উন্নতি করেছে মা। ভুলে যাওয়া তো দূরাস্ত, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে দিন দিন আরোও আরোও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে মা। কবে আমি বা বাবা কি গর্হিত অপরাধ করেছিলাম, মুখে মুখে কবে কি চোপা করেছি আমি বা তুত্তুরী সবকিছু ইদানিং ঠোঁটের আগায় থাকে আমার মায়ের।
আজ তো ডাক্তার ম্যাডামও বললেন, ‘দিব্যি আছেন তো। এমনিই থাকুন। খুব ভালো থাকুন।’ মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, ওণার দেওয়া ওষুধগুলো নয়, আসলে উনিই হলেন আমার মায়ের ওষুধ। কি ভাবে যে মায়ের যাবতীয় সমস্যা উনি মুখ না খুলতেই অনুধাবন করেন, চূড়ান্ত সফিস্টিকেশন থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিতান্ত ছাপোষা জীবনের তুচ্ছাতিতু্চ্ছ ঘটনাবলীর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে, ঐ ক্ষুদ্র পরিসরে নিজের অনুরূপ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন আমি অবাক হয়ে দেখি। আগে শুধু শাড়িই পরতেন, এখন শুধুই পশ্চিমী পোশাক পরেন। তখনও নিরাভরণ থাকতেন, আজও তাই। তবে যখন শাড়ি পরতেন, তখন শাড়ির সঙ্গে মানানসই একটা ভারি সোনার ব্রোচ লাগাতেন। একবার বলেছিলেন,‘ব্রোচটা আশা করি কেউ ছিনতাই করে নিতে পারবে না।’
ডাক্তারখানা থেকে হাসি মুখে গাড়িতে উঠেই আইসক্রিম খাবার প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। জানলার বাইরে বছরের শেষ চৈতালী বিকেল ক্রমশঃ গড়াচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। আগ্রহী বালিকার মত মাথা নাড়ল মা। ভাড়াটে গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম,‘একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে একটু দাঁড়াবে ভাই? মাকে কথা দিয়েছি, আইসক্রিম খাওয়াব।’
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর এক পুঁচকে দোকান থেকে তিনটি আইসক্রিম কিনে গাড়িতে উঠলাম। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল গাড়িটা, পুলিশের ভয়ে এদিক, ওদিক তাকাচ্ছিল বাচ্ছা ড্রাইভার ছেলেটি। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে খেয়ে নাও আগে। তারপর ছেড়ো। আশা করি পুলিশ কিছু বলবে না। আজ বছরের শেষ দিন।’ মোড়ক খুলে ড্রাইভার আর আমি বেশ কয়েক কামড় মেরেও ফেললাম, মা তখনও নিজেরটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ‘কি হল খাবে না?’ চকলেট ফ্লেভারটা আগে তেমন পছন্দ করত না মা। এদিকে আমি তো চকলেট ছাড়া খাইও না, আর খাওয়াই ও না। তবে কি বদলে এনে দেব? জবাবে মা বলল,‘তোর বাবারটা কই? আর তুত্তুরীর?’ এই না হলে মা। আমি যে কবে এমন মা হতে পারব। তবে আর যাই করি মানে যতই হ্যাংলার মত, তুত্তুরীকে ছাড়া ভালোমন্দ খেয়ে নিই না কেন, একটা কাজ আমি কখনও করি না। তা হল কন্যার সাথে মিথ্যাচার। যাই খাই, বাড়িতে পা রেখেই সটান জানিয়ে দিই এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যে অচীরেই শ্রীমতী তুত্তুরীকে তা আমি খাওয়াব।
এবারেও জানালাম। মায়ের হ্যাংলামিতে অভ্যস্ত তুত্তুরী, নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ঠিক আছে। মামমাম(দিদা)কে খাইয়েছ, খুব ভালো করেছ।’ এমন মেয়েকে তো ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতেই হয়, তার সাথে আমার বাপটাকেও। আর আমার পিসি, আর শ্রীমান বুল্লু কুমার। পিসি আমার অনেক কিছুই খায় না। মাংস তো জীবনেও স্পর্শ করেনি। মাছও খুব কম খায়। এমনকি মুর্গির ডিমেও পিসির অ্যালার্জি। তবে একটা জিনিস উপরোক্ত সবাই প্রচণ্ড ভালোবাসে, তা হল মোগলাই পরোটা।
হাঁসের ডিমের মোগলাই পরোটা একটা দোকানই করে, ছোট্ট পুঁচকে দোকান। রাত নটায় বেরোলাম মোগলাই কিনতে। ‘কিন্তু কেন?’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল শৌভিকের ধমক। টোটোয় উঠে সোহাগ করে ফোন করেছি যে। কোন মতে আমতা আমতা করে, করুণ সুরে বললাম, কাল নববর্ষ তো তাই।‘তাই বলে জাঙ্ক ফুড খেতে হবে কেন?’ এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে আমার স্বাস্থ্য সচেতন গৃহস্বামীকে। রাত নটাতেই কেমন যেন নিঝুম পুরী হয়ে উঠেছে আমাদের পাড়াটা। ক্লাবের মাঠে আড্ডারত গুটি কয় চ্যাংড়া ছাড়া, সব কিছু শুনশান। এমনকি কুণ্ডলী পাকিয়ে পথের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়ার সারমেয় কুল ও। মোড়ের মাথায় অবশ্যি কিঞ্চিৎ জন সমাগম পেলাম। তবে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিল কদমতলা বাজার। এত লোক কি সত্যিই হাওড়া শহরে থাকে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল, এত লোক কি কাল সত্যিই খাসির মাংস খাবে? মাংসের দোকানের সামনে যা ভিড়, দুজন সিভিক পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড়, শাড়ির দোকানেও দম বন্ধ করা ভিড়।রাত বারোটা অবধি চলবে আজ বিকিকিনি।
মধ্য রাত্রি অবধি জমজমাট পারিবারিক আড্ডা মেরে সবে শুয়েছি, ভেসে এল মায়ের প্রশ্নবাণ, ‘হ্যাঁ রে, কাল তোর বন্ধুরা সব আসবে তো?’ হ্যাঁ তো। কাল আমাদের গেট্টু তো। ‘তো কারা আসবে?’ জানি না তো। এখনও কিছু ঠিক হয়নি। 'কখন আসবে?' সেটাও তো ঠিক বলতে পারছি না। দুপুর বেলা এটুকু জানি শুধু। ক্রমশঃ বিরক্তি চড়ছে মায়ের গলায়, ‘তা খাবি কি?’ ঢোক গিললাম, জবাব একই, এখনো কিছু ঠিক নেই। কি যে হবে কাল।চৈতালিকে একবার ফোন করব কি? ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে বারো। গালাগাল দেবে নির্ঘাত, তবে মায়ের কাছে গাল খাবার থেকে, চৈ এর গালাগাল ঢের ভালো রে বাবা।
অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব- ৪)
যত দূর সম্ভব, উৎকণ্ঠা, হীনমন্যতা,সম্ভ্রম আর ভয় মিশিয়ে ডাকলাম,‘মা, ইয়ে মানে তোমাদের ঝ্যাঁটা আর ন্যাতা কোথায় থাকে গো? আর ফিনাইলটাও লাগত একটু।’এমনিতেই সকাল থেকে ক্ষেপে আছেন গর্ভধারিণী। আজ নববর্ষের পূণ্য প্রভাতে যেখানে সারা বাংলা কাক ভোরে ঘুম ভেঙে, পূণ্যস্নান সেরে, ঈশ্বর তথা গুরুজনদের নববর্ষের প্রণাম, লঘুজনদের স্নেহাশিস জানানোর পর্ব সেরে ফেলেছে, সেখানে অধম আমি ঘুম থেকেই উঠেছি বেলা নটায়।
সত্যি বলছি মাইরি, এত বেলা হয়ে যাবে আমিও বুঝতে পারিনি।ভোর ৬টা ৩২এ ডেকেছিল বটে মা, দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেও কেন এত ভোরে উঠব, এই নিয়ে এক প্রস্থ অশান্তি করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মেয়েকে জড়িয়ে। অতঃপর আর কি? অতি কষ্টে যখন একটা চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম, ঘড়ি বলছে নটা বেজে গেছে। জানলার বাইরে প্রবল বিক্রমে দেদীপ্যমান দিনমণি। পাশের বিছানা খালি, অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী আগেই উঠে গেছেন বহুক্ষণ আগেই।
চোরের মত গুটি গুটি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে দেখি, রিল তুলছেন আমার কন্যা। বেশ কিছুদিন ধরেই রিল বানানোর জন্য অনুরোধ উপরোধ করছে বটে তুত্তুরী, ওর সমস্ত বন্ধুরা নাকি বানাচ্ছে, আমি ঢেঁকি গিলিনি অবশ্য। তবে আমার বৃদ্ধ বাপ যে গিলেছে, বেশ বুঝতে পারলাম। অদূরে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আমার মা আর আমার মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মুখে ধূমপান করছে বাবা। মায়ের মোবাইলটা কায়দা করে ধরে তুত্তুরী বলছে,‘হ্যালো বেব্বি!কাঁইসে হ্যায়?’ মায়ের বোধহয় বলার কথা,‘একদম মস্ত।’ গতকাল থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে বহুবার ট্রেনিং দিয়েছে তুত্তুরী। রিল বানানোর ট্রেনিং। আজ আমি ঘুমোচ্ছি দেখে সুযোগ বুঝে তার চূড়ান্ত মঞ্চায়ন হচ্ছে। মা যদিও ফেল্লু ছাত্রীর মত কিছুই বলল না, আমার দিকে একপলক ক্রুর বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তুত্তুরী থুড়ি তার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল। দাঁতে দাঁত চিপে তুত্তুরী বলল,‘বলো মামমাম, ‘উ কৌন হ্যায় বেবি?’ মা তাও কিছু বলল না। বিরক্তি চেপে নিজেই পার্টটা বলে তুত্তুরী,‘উ?’ বলে ইশারায় বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,‘উ তো হামরি দাদু হ্যায়। আ রে মোটকাঃ, ইধার আ।’ বিগত শারদীয়ায় পক্ষকাল হাসপাতাল বাস করে ফিরে বাবার চেহারা হয়েছে হাড় জিরজিরে। বেল্ট দিয়েও আর কোমরে থাকতে চাইছে না প্যন্ট গুলো। সেই নিয়ে বাবার মনোযাতনার শেষ নেই। তবুও তিনি মোটকা সেজে, সিগারেট হাতে থপথপ করতে করতে এলেন। বাকি টুকু বলার জন্য তৈরিও হল তুত্তুরী, কিন্তু সবকিছুতে জল ঢেলে উঠে পড়ল আমার মা জননী। ‘তোমরাই করো ওসব রিল মিল। আমার কি অত সময় আছে? সব লাটসাহেবেরা একে একে ঘুম থেকে উঠছেন, তাদের চা দিতে হবে তো।’
চা, প্রাতঃরাশ খেয়ে, লক্ষ্মীমেয়ের মত স্নানার্চনা সেরে গুরুজনদের হাতে কলমে এবং ফোনে প্রণামও সেরে ফেললাম। তাও একফোঁটা প্রসন্নতা ফুটল না মাইরি মায়ের চোখে মুখে। এমনিতেই মা খচে আছে, তার ওপর আবার আজ আমাদের গেট্টু। তাও এই বাড়িতেই।
নিয়মিত অথবা অনিয়মিতই সই যাঁরা এই অধমের ডাইরি পড়েন, তারা সকলেই জানেন আশা করি যে আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা নিঃসন্দেহে মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। তারাসুন্দরীর প্রাক্তণী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের, ‘তারা’ বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি দুদশকেরও বেশি হতে চলল, তবুও ঢিলে হয়নি বাঁধন। আজও চৈতালীর ভাষায় আমরা ’বেঁধে বেঁধে থাকি, বেঁধে বেঁধে রাখি’ একে অপরকে। ঘর-বাইরের হাজারো সমস্যা, জটিলতা সামলে, পেশাদারী আর গার্হস্থ্য জীবনের সাম্য বজায় রেখে, কন্যা-সহধর্মিনী-মাতার নাম ভূমিকায় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেও আমরা সময় চুরি করে রাখি একে অপরের জন্য।সবাই হয়তো পারি না,সবসময় হয়তো পারি না, তবুও চেষ্টা করি সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ শাড়ি পরে বুড়ো স্কুলটায় গিয়ে হাজির হতে, চেষ্টা করি দোল পূর্ণিমার রাতে পূর্ণ চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে সম্মিলিত ভাবে ভাঙের গ্লাসে চুমুক দিতে, চেষ্টা করি লালসাদা শাড়ি আর মাথায় সুগন্ধী জুঁই-বেলির মালা নিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে, সারা রাত জেগে পুজোর কলকাতায় টহল দিতে, কালি পুজোর সন্ধ্যেয় একসাথে ছানাপোনা নিয়ে বাজি পোড়াতে ইত্যাদি প্রভৃতি।
এবারের বর্ষবরণটা পুরো ঘেঁটে গেছে শুধু আমার জন্য। প্রিয়জনদের অসুস্থতার জন্য বার বার পিছিয়ে গেছে মিলিত হবার দিনটা। শেষ পর্যন্ত যদিও আমি এসে পৌঁছেছি আমার প্রিয় শহরে, কিন্তু বাকিরা পারবে কি? সেটা জানতেই গতকাল মধ্য রাতে ফোন করেছিলাম চৈতালীকে। রাত সাড়ে বারোটায় কাউকে ফোন করে সোহাগ করতে গেলে যে রকম প্রিয় সম্ভাষণ প্রত্যাশিত, তাই পেয়েছি। সেসব সুশীল সমাজে লেখার অযোগ্য।
যদিও এতদসত্ত্বেও চৈ শুধু আমারই জন্য অত রাতে কনফারেন্স কলে ধরে ছিল প্রায় সব্বাইকে। ফলাফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। কয়েকজন রূপসী যথারীতি নিদ্রামগ্ন হয়ে ফোনই তোলেননি। বাকিদের নানা পূর্ব পরিকল্পনা, পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে। কারো বা তরল দাস্ত হচ্ছে, কেউ বা গিয়ে বসে আছেন গ্রামের বাড়ি। এমনকি আমি দিন দুয়েকের জন্য হাওড়া গেলেও যে শতেক ব্যস্ততার জাল কাটিয়ে প্রতিবার ছুটে আসে, সেই অন্তু ওরফে অন্তরাও বলল, ‘শোন না, বছরের প্রথম দিন তো, বরের সাথে না খেয়ে গেলে কি হয় বল! তবে আমি যাব। যাব বলেছি যখন, যাবই। একটু বেলা হবে এই যা।’ অন্তরার খুব তাড়াতাড়ি মানে বেলা আড়াইটে/তিনটে। বেলা হবে মানে, নির্ঘাত সন্ধ্যে বেলায় এসে হাজির হবেন তিনি।
মোদ্দা কথা হল, আজ আমাদের গেট্টু আছে বটে, তবে কারা আসবে জানি না। কখন আসবে তাও জানি না। এমনকি, কি খাওয়া হবে সে ব্যাপারেও সম্পূর্ন অন্ধকারে আমি। বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে মা, রহস্য করে এড়িয়ে গেছি। সত্যি কথাটা বললে যে কি হবে-। এখন মধ্যাহ্ন, চৈ মেসেজ করেছে দেখলাম, বেলা আড়াইটে নাগাদ আসবে। মানে তার আগে পারবে না। সঞ্চিতাকে পান আনতে বললাম,তিনি লিখেছেন, পান আনতে অপারগ। পানের পরিবর্তে মাংস চলবে কি? কারণ তিনি শুধু আমাদের জন্যই রেঁধে আনছেন ,সুতরাং আর কিছু না থাকলেও সঞ্চিতার মাংস থুড়ি করা মাংসটুকু অন্তত জুটবে। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে দিয়ে এক বোতল সাদা আর এক বোতল কালো কোল্ড ড্রিংকস ও আনিয়ে রেখেছি। শীতল পানীয়ের ক্ষেত্রে বড্ড বর্ণ বিদ্বেষী ব্যাটারা। কেউ সাদা ছাড়া খান না, তো কেউ কৃষ্ণের(বর্ণ) অনুরক্ত।
বেলা সাড়ে বারোটা, সবে খাটের তলায় ঢুকেছি ঝাঁট দিতে, নীচে থেকে আমার বাপ আর আমার কন্যার যুগপৎ চিৎকার,‘ ফোন এসেছেএএএএ।’ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সরলতার সুযোগ যে যেমন ভাবে পারে নেয়। মায়ের কাজের দিদি নাকি প্রত্যহ দোতলা ঝাঁট দেয় আর সপ্তাহে দুদিন মোছে। এতদসত্ত্বেও আমার এই অপটু হাতেই বেরিয়েছে কয়েক কিলো ধুলো। শোবার ঘরের মেঝে জুড়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে শ্রীমতী তুত্তুরীর পায়ের ছাপ। তিনি বিগত দুদিন স্নান সেরে ভিজে গা এবং পায়ে কোথায় কি বিভঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। তড়িঘড়ি বেরোতে গিয়ে মাথা ঠুকলাম খাটে, ফোনটাও গেল কেটে। মাঝখান থেকে ফোন দিতে আসা শ্রীমতী তুত্তুরী আমার মাকে গিয়ে লাগলেন,‘মামমাম, মা তোমার একটা পেলমেট ভেঙে ফেলেছে।’ সত্যি বলছি ধর্মাবতার, মোট্টেই আমি ভাঙিনি। আমি তো সবকটা জানলার পর্দা কেবল সরাতে গিয়েছিলাম। তিনি স্বেচ্ছায় সটান ভেঙে আমার মাথায় পড়েছেন।
মায়ের রোষ কষায়িত নয়নের সামনে দিয়ে মাথা নীচু করে গিয়ে ফোনটা নিলাম। বাবা যদিও বলছে, ‘ভেঙেছিস বেশ করেছিস। বাপের পর্দাই তো ভাঙলি। ও ঠিক আছে।’সাধে তুত্তুরীকে বলি, আমার বাপটার কোন তুলনা নেই। রুণা ফোন করেছিল। ‘শোন না তোদের বাড়ির দরজাটা ঠিক চিনতে পারছি না।’ মানে! রুণা আসছে নাকি? কত বছর বাদে? সেই বোধহয় শেষ ১৯৯৭সালে আমাদের বাড়ি এসেছিল রুণা। তড়িঘড়ি পায়ে জুতো গলিয়ে, ‘তুই দাঁড়া, আমি তোকে নিয়ে আসছি’, বলে রোয়াকে বেরিয়ে দেখি ঠিক আমাদের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে রুণা। ‘দ্যাখ ভুলিনি তো?’ সত্যিই ভোলেনি মেয়েটা। পঁচিশ বছর পরে, যার মধ্যে বিশ বছর এই জেলার বাইরে থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছে আমাদের বাড়িটা। স্কুলের বন্ধুত্ব গুলো বোধহয় এমনিই হয়, মূল্যবান মদের মত। যত পুরাণ ততো দামী।
দেখে আশ্বস্ত হলাম যে রুণাও শাড়ি পরেনি। যা চিড়বিড়ে গা জ্বালানো গরম আজ হাওড়ায়। সঞ্চিতা যদিও ভয়ানক সুন্দর একখান শাড়ি পরে হাজির হল। রোয়াকে বসে রকবাজি মার্কা গসিপ, প্রচুর ছবি তোলার ফাঁকে মা একবার জিজ্ঞাসা করল বটে, ‘তা তোরা খাবি কি?’ শুধু মাংস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস? তাও দোতলায় গিয়ে?মায়ের দুচোখে চূড়ান্ত অবিশ্বাস। তড়িঘড়ি বলি, না না আরোও কিছু তো নির্ঘাত খাব। শ্রীমতী তুত্তুরী, বুল্লু বাবু, রুনার মেয়েও তো খাবে। আমরা অধঃপতিত বটে, তবে এতটাও নয়। রাইস বা নুডলস কিছু নির্ঘাত অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তা অর্ডারটা দিল কে? কেন চৈতলী। নির্ঘাত অর্ডার দিয়েছে চৈ। হ্যাঁ রে চৈ খাবার কখন আসবে রে? আকাশ থেকে পড়ে চৈতালী, ‘ধ্যার ব্যাটা। আমি আবার খাবার অর্ডার দিলাম কখন? তোকে বললাম না, আমি পুজোয় বসেছি।’
শেষ পর্যন্ত খাবার এসে পৌঁছেছিল বেলা তিনটায়, আর অন্তু সন্ধ্যা ছটায়। একরাশ ভুলে ভরা বছরের প্রথম দিনের সূর্য ডুবতে ডুবতে কি জানি কি বার্তা দিয়ে গেল, হয়তো বলে গেল, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, তবে যে কটা দিন এমন ভাবে যায়, যাক না- মন্দ কি? (শেষ)
No comments:
Post a Comment