#তাম্রলিপ্তকড়চা
আমায় কেউ কোনদিন ইফতারে ডাকেনি। স্কুল, কলেজে না হয় কোন মুসলিম বন্ধু ছিল না, কর্মক্ষেত্রে তো ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নিয়ম করে রোজা রাখতেনও। রোজ গপ্প শোনাতেন, সের্গিতে কে, কি খেলেন। ‘বুঝলে অনিন্দিতা, বেশি কিছু না,সামান্য দুধভাত আর এক টুকরো ইলিশ মাছ।’ গল্প শোনাতেন,কার বাড়িতে কি রান্না হত, ভাগ করে নিতেন ঈদের বাজেট। ‘বুঝলেন ম্যাডাম, ফলের যা দাম, আপনার বৌদি বলছে, চল্লিশ হাজার শুধু ফলেই ধরে রাখো। বড় পরিবার তো আমাদের-’। ওদের কাছেই শিখেছিলাম কেউ রোজা রাখলে তার সামনে খেতে নেই। খেলে পাপ লাগে। তবে তিনি অনুমতি দিলে খাওয়া যায় বটে।
বলতে নেই, ঈদের পর অবশ্য সকলেই খাওয়াতেন, ঘি, দুধ আর চিনি দিয়ে মাখা ময়দার মিষ্টি মিষ্টি পরোটা আর চিকেন চাঁপ আর সেই বিখ্যাত সেমাই। নিউমার্কেটের স্পেশাল সেমাই, যার বেধ লজ্জা দেবে নাইলন সুতোকেও। ভালো ঘিয়ে ভাজা, সাথে প্রচুর কাজু এবং কিশমিস। সবই হতো, শুধু ইফতারটাই যা কোনদিন হত না।
আমাদের তমলুক আপিসের উডিসি হক বাবু যখন রোজা রাখা শুরু করলেন, আমরাও মুখিয়ে রইলাম, আসুক ঈদ, তারপরই আসবে সেমাই আর পরোটা। আমি যা বলি শুভাশিস আর শান্তনু বলে তার শতগুণ। রোজ দিন গুণি আমরা, কবে আসবে ঈদ। এমনি ভাবতে ভাবতেই একদিন মনে হল, হক বাবু আমাদের যবে খাওয়াবেন, খাওয়ান, তার আগে বোধহয় আমাদের একবার ওণাকে খাওয়ানো উচিৎ। হক বাবুকে বললাম,আমরা আপনাকে ইফতার পার্টি দিতে চাই, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে একেবারে অনভিজ্ঞ তথা অর্বাচীন। কি দিতে হয়, কি করতে হয় সেটা আপনাকেই বলে দিতে হবে।
হক বাবু প্রথমে লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে গেলেন বটে, পরে ধীরে ধীরে বললেন,‘ম্যাডাম, আমি তো ছটা না বাজলে খেতে পারব নি। আপনারা কেন অত দেরী অবধি থাকবেন।’ এ আবার কেমন কথা। আপনার জন্য একটা দিন আমরা দেরী করে বাড়ি ফিরতে পারব না? আপনি শুধু বলুন কি কি আনতে হবে? কি ভাবে সাজাতে হবে? হক বাবু লাজুক ভাবে জানান, ‘একটু আদা, একটু ভিজে ছোলা আর খেজুর এই আর কি।’ ব্যাস? হয়ে গেল? আর ফল? ফল দিতে হয় না? আর তেলে ভাজা? আর ঠাণ্ডা কিছু? ধুর হক বাবু, আপনি দেখছি কিছুই জানেন নি গো। আপনি ছাড়ুন।
অতঃপর আমাদের হক বাবুর জন্য, আমরা নিজেরা মাথা খাটিয়ে বানালাম ইফতার পার্টি। রাধামণি বাজার থেকে বেছে বেছে ফল কিনে আনল অরূপ, একটা পুঁচকে কৌটো করে আনা হল কুচানো আদা আর ভিজে ছোলা। নিচের ক্যান্টিন থেকে আনানো হল, টক দইয়ের সাথে কুচানো বাদাম আর মরিচ গুঁড়ো মেশানো ওদের সেই বিখ্যাত লস্যি, বিদ্যুৎ বেকারি থেকে আনা হল, সবুজ সবুজ পুদিনা দেওয়া আলুভাজা আর কাঠি কাবাব।আয়োজন হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু উৎসাহ, আন্তরিকতা আর ভালোলাগাটুকু ছিল একেবারে নিখাদ।
সাড়ে পাঁচটার পর, যখন একে একে ঝাঁপ বন্ধ করছে নিমতৌড়ির অন্যান্য দপ্তর, আমাদের দরিদ্র শ্রম দপ্তরে তখন শুরু হয়েছে ইফতারের প্রস্তুতি। আপিসের পোশাক বদলে ধপধপে ফেজ টুপি, লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিতে সেজে নিয়েছেন হক বাবু। মেঝেতে বিছানো হয়েছে কার্পেট, নামাজ পড়তে বসার আগে হক বাবু বলে গেলেন, " ম্যাডাম আমার ভীষণ ভালো লাগছে। কোনদিন ভাবিও নি, যে আপিস আমাকে ইফতার দেবে।" আমি ভেবেছিলাম বটে, আপিসে একটা ছোট পুজো করিয়ে নেব, একেবারে নতুন বিল্ডিং, আর যা ঝঞ্ঝাটের দপ্তর আমাদের। নিত্য লেগে থাকে অশান্তি। অর্থাভাবে আর পূজারীর অভাবে করতে পারিনি। হক বাবুকে বললাম, আপনি যখন প্রার্থনা করবেন, একটু বলে দেবেন তো। ওপরওয়ালা তো একজনই। মাধ্যম যাই হোক না কেন। একটু দেখবেন আজ্ঞে। আর ইয়ে DA র জন্যও দুয়া চাইতে ভুলবেননি যেন।
No comments:
Post a Comment