Wednesday 12 January 2022

তুত্তুরী উবাচ ১২ই জানুয়ারি, ২০২২

 

👩🏻- শৌখিন বানান কি?

👧🏻- স এ ঔ কার-

👩🏻-কি? ওটাই তো অশুদ্ধ বানানটা ছিল। তুই কি শুদ্ধ বানানগুলো না পড়ে উল্টোটাই পড়েছিস?

👨🏻-(পাশ থেকে ফাইল সই করতে করতে, মুচকি হেসে) ঠিকই আছে। ও সুখ থেকে না হয় সৌখিন করেছে। 

👩🏻- (বিরক্ত হয়ে) ভুলভাল শেখাস না। বাবার কথায় কান দিস না তো।  পুষ্প বানান কি?

👧🏻- প এ উ-স্প। 

👩🏻- উফঃ ভগবান। বিশেষণ বানাণ কি?

👧🏻- ব এ ই(দম নিয়ে)- শ য়ে একার-(পুনরায় দম নিয়ে) ষ (আবার দম নিতে গিয়ে মায়ের রক্ত চক্ষু পর্যবেক্ষণ পূর্বক তড়িঘড়ি) ন। 

👩🏻- উফঃ। আবার? আরেঃ ওটা তো অশুদ্ধ বানানটা। 

👧🏻-(প্রবল চিন্তান্বিত হয়ে) তাহলে কি ণ?

👩🏻- হুঁ। তোকে ণত্ব-ষত্ব বিধান বলেছিলাম না। ষ য়ের পর  সবসময় ণ বসে। আগে র এর পরও বসত। এখন বসে না। 

👧🏻-(প্রবল বিরক্তি নিয়ে বিশেষণ বানান লিখতে লিখতে স্বগতোক্তির ঢঙে) কিছুদিন পর ষ এর পরেও বসবে না। 

👩🏻-কল্যাণীয়েষু বানান কি?

👧🏻-( বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলে, এক ডজন চোখ পিটপিট করে, বাবার দিকে সাহায্যের অভিলাষায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে) ক-ল এ য ফলা- দন্ত্য ( মায়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি) ণ এ ঈ। কল্যাণী। (বিকট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) এষু বানানটা যেন কি? ও হ্যাঁ এ শ এ উ। 

👨🏻-(দড়াম করে ফাইল বন্ধ করে) ঐ শুটা ইংরেজি।  মানে জুতো। তোর মা যেটা আনতে যাচ্ছে। শু-শিক্ষা দিতে।

Friday 7 January 2022

অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২২

 


শৌভিক দিব্যি আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, নিজেকে রাজা উজির ভেবে দিব্য চটি ফটফটিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, গোছা গোছা ফাইল আর সার্টিফিকেট সই করছে, শ্যেন দৃষ্টিতে আমার সমস্ত কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে, পদে পদে আমার দোষ ধরছে, চুরি করে মুখে একটা নারকেল নাড়ু পোরার সাথে সাথেই চলমান অশরীরীর মত এসে উদয় হচ্ছে এবং আমার গুষ্টির তুষ্টি করছে।  সর্বোপরি কথায় কথায় আস্তিন গুটিয়ে ঘটি-বাঙালের ঝগড়া করছে। কে বলবে আজ সন্ধ্যার ডাকে খবর এসেছে ব্যাটা কোভিড পজিটিভ। 


 এমনিই তো ছেড়ে গিয়েছিলাম মঙ্গলবার। দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম আমার শহরে। দুর্গা পুজোর পর আর থাকাই হয়নি বাবার বাড়ি। একদিকে পিছিয়ে যাওয়া দুয়ারে সরকার, অন্যদিকে তুত্তুরীর বন্ধ ইস্কুল, তাই ভেবেছিলাম দুটো দিন কাটিয়ে আসি হাওড়ায় গিয়ে। বাপের বাড়ি ভারি মজা। নৈশ ভোজে মায়ের হাতের লাল আটার লুচি, আলু ফুলকপির জিভে জল আনা বাটি চচ্চড়ি  আর কড়কড়ে চিনি। বেলা সাড়ে নটার সময় চোখ খুলেই মুখের কাছে ধরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, প্রাতঃরাশে কাঁচা আম আর লঙ্কার আচার দিয়ে ম্যাগি, দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে কাঁচা লঙ্কা আর অপরিমিত কাঁচা তেল দিয়ে পোস্ত বাটা, হিং গন্ধী বিউলির ডাল, আচারের তেল দিয়ে মাখা এক তাল আলু ভাতে, কাঁচা সর্ষের তেল ছড়ানো আলু-বড়ি পোস্ত, নিটোল করে ছাড়ানো হাফ বয়েল সিদ্ধ ডিম আর সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্স দেখা- এত সুখ সহ্য হলে তো।  


সত্যি বলছি মাইরি আওয়াজ দেবার জন্যই ফোনটা করেছিলাম। ওরম আমি প্রায়ই করি, হাওড়ায় গেলেই। ‘ কি রে, কি করছিস? আপিস যাচ্ছিস? আজ ছুটি না? ওঃ আজ বুধবার বুঝি, ইশ্ কত খাটিস তুই। পারিস কি করে, কে জানে? ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমি তো এই ঘুম থেকে উঠে, জলখাবার সাঁটিয়ে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুতে যাচ্ছি। আজ ভাবছি চানটাও আর করব না-। ’ 


কিন্তু এবারে জবাবটা প্রত্যাশিত পেলাম না। অঝোর গালি বর্ষণের বদলে ভেসে এল ম্রিয়মাণ কণ্ঠ, ‘নাঃ আজ আমিও যাচ্ছি না। পলাশকে(ড্রাইভার) নিষেধ করে দিলাম।বললাম অফিসে থাকতে। প্রয়োজনে ডেকে নেব।  শরীরটা ঠিক যুৎ লাগছে না। কাল রাত থেকে গলায় ভীষণ ব্যথা।’ গলায় ব্যথাটা শৌভিকের নৈমিত্তিক সমস্যা। টনসিলের ধাত, মাঝেমধ্যেই ঠাণ্ডা লেগে ইনফেকশন হয়। পইপই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও যে ভাবে গরম জলে স্নান করে সকাল-সকাল পাতলা টিঙটিঙে একখান টিশার্ট পরে ছাতে পায়চারি করে বা সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ঐ টিশার্টটা পরেই হনহন করে বাগানে হাঁটে, ঠাণ্ডা লাগাটা তো সময়ের অপেক্ষা। কতবার বলি, ওরে একটা টুপি পর অন্তত, ছেলেদের টাকে ঠাণ্ডা বেশি লাগে- শোনে কেমন? যাই করতে বলি, শৌভিকের একটাই জবাব, ‘শ্বশুরটাকে করতে/পরতে বল। ’ সারাদিন আমার বাপকে নিয়েই পড়ে থাকে লোকটা। ঈর্ষা, পাতি ঈর্ষা। এত বছর বিয়ের পরও, আমার প্রিয়তম পুরুষ আমার বাবা কি না। 


যতই লঘু ভাবে নিই ব্যাপারটা, শৌভিক অফিস কিন্তু চট করে কামাই করে না। বিশেষতঃ অসুস্থতার অজুহাতে তো নয়ই। বেলা এগারোটা নাগাদ ফোন করলাম, খোঁজ নিতে। কম্বলের তলা থেকে চিঁচিঁ কণ্ঠে জবাব এল, ‘পলাশকে একটা থার্মোমিটার আনতে বলেছি। জ্বর আসছে।’ এরপর আর রিস্ক নিইনি। তুত্তুরীকে তার দাদু-দিদার নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একাই ফিরে আসি তাম্রলিপ্ত। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন দরজা খুলে দিল শৌভিক, মুখ লাল, চোখ ছলছলে। টেবিলে আধখাওয়া ম্যাগির প্লেট। জীবনেও এ বাড়িতে অর্ধভুক্ত প্লেট পড়ে থাকে না টেবিলে। যতই শরীর খারাপ হোক উচ্ছিষ্টটুকু ময়লার বালতিতে ফেলে, সিঙ্কে প্লেটটা নামাবেই শৌভিক। জন্মসূত্রে Virgo কি না, তাই পরিচ্ছন্নতার বাতিক মারাত্মক। সেই লোকটা আজ কোন মতে দরজাটা খুলে দিয়েই গিয়ে শুয়ে পড়ল, তখনই বুঝতে বাকি রইল না, কি বাঁধিয়ে বসেছে। 


বুধবার রাতটা সত্যিই একটু চাপে কাটল। প্যারাসিটামল চিবিয়েও জ্বর দাঁড়িয়েই রইল ১০২ এর ঘরে, সাথে ব্যাপক কাঁপুনি আর অসহ্য বেদনা। এ আমার চেনা লক্ষণ। ২০২০র জুন-জুলাই মাসে ঠিক একই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম। খুঁড়ে খুঁড়ে বেদনা বার করে আনে কোভিড। ভাগ্যে ছুঁতে শেখেনি হৃদয়কে। 


  ঝঞ্ঝাবহুল রাতের পর বৃহস্পতিবার সকালটা অবশ্য শুরু হল বেশ পজিটিভ ভাবে।  জ্বর পুরোপুরি না সারলেও থমকে দাঁড়াল ৯৯ এর ঘরে। গলা ব্যথা, কান কটকট আর পিঠে  সামান্য বেদনা বাদে রোদ খেতে গেল বাকি ব্যথাবেদনার দল। সদলবলে সদর হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেল শৌভিক। বাড়ি বসে করল না কেন? এ প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দিবেননি।  রাপিড টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এল।  RTPCR টেস্ট করিয়ে  দুটো পাখনা সমেত উড়তে উড়তে বাড়ি এল শৌভিক। শুক্রবারও উড়ছিল, এমন সময় খবর এল বাবু ওমিক্রন বাঁধিয়ে বসেছেন। 


তারপর থেকে শুধু তুল্যমূল্য বিচারই করে চলেছি আমরা। আমার কোভিড আর শৌভিকের কোভিডের। আমার সময় টেস্ট করাতেই লেগেছিল পাঁচ ছদিন। তাও পোড়াতে হয়েছিল বিস্তর কাঠ আর খড়। আর ওর বেলায়-। আমার সময় একঘরে হবার ভয়ে হাতে গোণা জনা কয়েক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে খবর দিতে সাহস পাইনি আমরা। যেদিন টেস্ট হয়েছিল, সেদিনই  দুসপ্তাহের মত চাল, আলু, মাছ আর ডিম কিনে গুদামজাত করে রেখেছিল শৌভিক। এমনকি তুত্তুরীর জন্মদিনেও বেরোয়নি বাড়ি থেকে। ঐ গুদামজাত সামগ্রী দিয়েই মাথা খাটিয়ে হাতে গোণা উপকরণ দিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছিলাম মেয়ের সামনে। সুস্থ হয়ে আপিস যেতেও বুক কাঁপছিল, যদি আমাকে অচ্ছুৎ গণ্য করে এক ঘরে করে ব্যাটারা। যদিও ফুল,মিষ্টি আর কিসব উপহার দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল আমার তৎকালীন টিম, তবুও মনে আছে সেই গা ছমছমে দিনগুলোর কথা। 


আর শৌভিকের বেলায়, দুবেলা আসছে যাচ্ছে ফাইলের পাহাড়। এবেলা ওবেলা খবর নিয়ে যাচ্ছে শৌভিকের লোকজন। খুচখাচ বাজার নিয়ে চার বার তো পলাশ একাই এসে ঘুরে গেল। টেস্ট করতে যাবার সময় শৌভিকের ড্রাইভার আর সিকিউরিটিকে বললাম, ভালো করে মাস্ক পরে যেতে। দুজনে হেসে উড়িয়ে দিল। ব্যধিটা একই আছে অথচ কত বদলে গেছে সমাজ আর তার দৃষ্টিভঙ্গি। 


পুনশ্চঃ আর একটা জিনিসও বদলায়নি, তা হল আমার ভূতের ভয়, সেদিনও একা শুতে পারতাম না, আজও নয়। ভূতের থেকে কোভিডের সঙ্গে কুস্তি করা অনেক ভালো রে বাবা।

অনির ডাইরি ১লা জানুয়ারি, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


পূর্ব মেদিনীপুর জেলা যে এতখানি ঐতিহ্যপূর্ণ তা এখানে আস্তানা না বানালে হয়তো জানতেও পারতাম না। এ জেলার আছে, নিজস্ব ইতিহাসের ধারা। গোটা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা রাজবাড়ি। আরো বেশিও থাকতে পারে আমি এখনও পর্যন্ত কেবল তমলুক, মহিষাদল, পাঁচেৎগড়, কাজলাগড় আর ময়না রাজবাড়ির হাল হদিসই জানতে পেরেছি। আজও সেই সব রাজবংশ তথা তাঁদের অধীনস্থ ভূস্বামীদের তৈরি অসংখ্য পোড়া মাটির মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই জেলার এদিক-ওদিক। বেশ কিছুর অবলুপ্ত প্রায়। বাকিদেরও অবস্থা খুব খারাপ। যেগুলো সারানো হয়েছে, সেগুলি দেখলে কান্না পায়। পাতি সিমেন্ট বালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাবতীয় পোড়ামাটির সুক্ষ্ম কারুকার্য।  


মংলাইয়ের মন্দিরটা অবশ্য এখনও টিকে আছে। পয়লা জানুয়ারির দুপুরে আমরা গিয়েছিলাম ফুল দেখতে। ক্ষীরাই নয়, ওখানে আজ বড় ভিড় আর হট্টগোল। তাই ভিতরে, গ্রামে যেখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই এমন অঞ্চলে। এবছর যদিও ফুলের হাল খুবই খারাপ। অসময়ের বৃষ্টিতে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ পাঁশকুড়ার ফুলের চাষ।  অন্যান্য বছরে এতদিনে মাঠগুলো ভরে যায় রঙবেরঙের মরশুমি ফুলে। দূর থেকে মনে হয় শতরঙী গালচে পাতা হয়েছে বুঝি। এবছর এখনও আসেনি ফুলের পুরো বাহার। তাও যা দেখা গেল, আমরা তো তিনজন তো তাতেই মোহিত। বড় উর্বর এখানকার মাটি, ফুল-সব্জি যাই লাগানো হয়, ঝেঁপে আসে ফসল। 


ফুলের শোভা দেখে ফিরে আসব, বিডিও সাহেব অনুরোধ করলেন কয়েকটা স্থানীয় মন্দির দেখে যেতে। সবই বেশ প্রাচীন, আড়াই-তিনশ কি আরো পুরানো পোড়ামাটির মন্দির। রাজপথ থেকে বেশ অনেকটা ভিতরে, চাষের জমির মাঝে মংলাই রাধাদামোদর মন্দিরে গিয়ে যখন আমরা পৌঁছালাম, সন্ধ্যা নামছে। দিনের শেষে রাসমঞ্চের পিছনে মুখ লুকাচ্ছেন অস্তমান দিনমণি। 


১৭খানা চূড়াওয়ালা তিনতলা দোলমঞ্চ। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম তুত্তুরী আর আমি। তিনতলায় ওঠার আর সাহস হল না। বেশ খারাপ অবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন এবছর বন্যায় দীর্ঘদিন ডুবে ছিল দোলমঞ্চটি।  সাপখোপের বাসা। শীতকাল বলে হয়তো সামনে আসছেন না তাঁরা, তাই বলে বেশী সাহস না দেখানোই বাঞ্ছনীয়। দোলমঞ্চটি শোভিত অপরূপ পোড়ামাটির ভাস্কর্যে।  


বঁদিকে ভগ্নপ্রায় মন্দির।  আদতে বানিয়েছিলেন যে ভূস্বামী, তাঁর বংশধরেরা আজও চেষ্টা করে চলেছেন মন্দিরটিকে টিকিয়ে রাখার। আজও উপাসিত হন,এই মন্দিরের দেবতা। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে পৌঁছেছি আমরা, দেবতার সামনে জ্বলে উঠেছে সন্ধ্যাদীপ, অন্ধকার মন্দিরের ভিতর কম্পমান দীপশিখা যেন আচমকা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর কোন ঐতিহাসিক গল্পের পটভূমিকায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কে জানে কালের মন্দিরার মত কোন গল্প রচিত হয়েছিল কি না, এই মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে।  


মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসংখ্য পোড়া মাটির মূর্তি। যার অন্যতম হল ১৮ হাতের মা দুর্গা। বিষ্ণু মন্দিরে দেবী শক্তির মূর্তি কেন? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? সবকিছুই যেন কেমন রহস্যে মোড়া-






Saturday 1 January 2022

অনির ডাইরি ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১

 

পৌনে তিনটে নাগাদ ফোন করলাম। ফোনের ওপার থেকে চরম ব্যস্ত কেজো স্বর বলল,‘হুঁ?’ আমার ভয় পাওয়া চেহারা আমি আদতে আনাড়ি, স্বভাব সিদ্ধ ভীতু স্বরে জানতে চাই, ‘বেরোলে?’ রোজ একই প্রশ্ন করি। তবে অন্যান্য দিন সময়টা পেছিয়ে যায় আরোও ঘন্টা তিন, সাড়ে তিন। আজ তো বছরের শেষ দিন। 


বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি আমি। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বাড়ি ফেরা, বাসি রুটি আর সকালের বা আগের দিনের লাউয়ের তরকারী বা দু পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি আর সকালের বেঁচে যাওয়া ডাল নাহলে নিছক দুধ কর্নফ্লেক্স খাই আমরা মা আর মেয়ে। নাক সিঁটকাবেন না। এগুলো মোটেই তেমন খারাপ নয়, ভয়ঙ্কর তো হল ওলকপি আর বড়ির তরকারি। এই মোটা মোটা করে কাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ওলকপির সাথে সামান্য আলু আর বড়ি মিশিয়ে ঝোল। উফঃ একবার রাঁধলে তিনদিনেও শেষ হয় না তা। 


যাই হোক, যাই থাকুক তাই দিয়ে টিফিন সেরে শ্রীমতী তুত্তুরীর মাথায় একখানা চাঁটি মেরে আপিস যাই আমি। আমার সাথে বসে ঐসব অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়া আর আমার হাতের চাঁটির জন্য বসে থাকে তুত্তুরী। যেদিন কোন মিটিং এ আটকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়, সেদিন একটু বেশীই শুকিয়ে থাকে মেয়ের মুখ। বুঝি খিদে পেয়েছে, কিন্তু না খেয়ে বসে আছে মায়ের জন্য। তমলুক পোস্টিং এর এই একটাই ভালো দিক খুঁজে পায় তুত্তুরী। 


তবে আজ ফিরব না। কাজ গুছিয়ে বেরোতে একটু দেরী হবে। সকালে বলাতে মুখ ঝুলে গিয়েছিল শ্রীমান তুত্তুরীর। তখন উপযাজক হয়ে শৌভিকই বলেছিল, পৌরসভায় কিসব কাজ আছে, সামলে ফাইলপত্তর নিয়ে তিনটের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। এখন যখন ফোন করলাম, জাস্ট উড়িয়েই দিল, ‘না-না-না। দেরী হবে।’ অগত্যা কি আর করি, মাসির ফোনে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, ‘খেয়ে নে বাবু। বাবার দেরী হবে।’ 


সাড়ে তিনটে নাগাদ, শৌভিক উচ্চস্বরে ঘোষণা করল,‘আমি বেরিয়েছি।’ যেটা অনুচ্চ থেকে গেল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে আমাকেও। অন্ততঃ মহকুমা শাসকের সেটাই মনোবাঞ্ছা। মুস্কিল হচ্ছে গোটাও বললেই তো আর গোটানো যায় না। ফাইল-চিঠি-অর্ডার জলদি হাতে গোটাচ্ছি, জহর বাবু এসে বললেন,‘ম্যাডাম চলে যাবেননি যেন।  একটু মিষ্টি-’। মিষ্টি বোধহয় বানিয়ে আনছে ব্যাটারা, উসখুস করছি আমি। আরএলও ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করছি,‘সৌরভ আমি বাড়ি যাই?’ সব আপিসে আপিসমাস্টাররা আটকায় কর্মচারীবৃন্দকে, এখানে উল্টোপুরাণ। সৌরভ গম্ভীর সুরে বলে, ‘দাঁড়ান ম্যাডাম, আজ শেষ দিন তো। সব লাইফ সার্টিফিকেট গুলো গেল কি না একবার দেখে নি।’ মিনিট পনেরো পর জানা গেল তাঁরা হেঁটে হেঁটে মহানগরের পথ ধরেছে। এবার আমিও গুটি-গুটি- মানে হেঁ-হেঁ আর কি। 

আবার মাথা নাড়ে সৌরভ। আসে আরো কিছু কাজের ফিরিস্তি, আসতেই থাকে। যতক্ষণ না আমি নাকে কাঁদতে শুরু করি। ‘আমি বাড়ি যাব। যাবোই-’।


আজ বর্ষশেষ। ফেসবুকের পাতা ভরে ওঠে সুসজ্জিত উৎসব মুখর নরনারী আর রঙবেরঙের তরল পানীয়র ছবিতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্সে ডুবে যাই আমি। আপাততঃ কিছুদিন আর বই পড়ছি না। মাইকেল প্রঙ্কোর দা লাস্ট ট্রেন শেষ করে পুরো ঘেঁটে গেছে মাথা। কেন যে বইটার এত নাম, কারা যে এইসব বইগুলোকে এত পুরষ্কার দেয় ভগবান জানে। ব্যোমকেশ-ফেলুদা-শবর-কাকাবাবু ছাড়ুন আমাদের কিরিটি রায়ও এর থেকে অনেক ভালো। অন্তত পড়ে বোঝা যায় কে, কি এবং কেন। জাপানীদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা।  

 

তুত্তুরীকে বগলদাবা করে ইন্ডিয়ানা জোনস্ দেখতে বসে শৌভিক। হেড ফোন ভেদ করে ভেসে আসে বাপবেটির উত্তেজিত কথাবার্তা। কোনটা যে বেশি বিমোহিত বুঝতে পারি না। একবাটি গরম চিলি-পটেটো বলস্ ভেজে নিয়ে দুজনের মধ্যে ঢুকে বসি আমি।  একসাথে তিনজনে ঘুরে বেড়াই পেট্রা নগরীর পথে পথে। মা-মেয়েতে একসাথে প্রেমে পড়ি তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডের। শৌভিকের সাথে ঝগড়া করি কে বেশী মহোময় শন কনোরি নাকি হ্যারিসন ফোর্ড। এই ভাবেই কাটুক না আগামী বছর, আগামী প্রতিটা বছর। বছর আসুক, বছর যাক, সম্পর্ক গুলো অমলিন থাকুক সবার। বাকিটা ঠিক ম্যানেজ হয়েই যাবে।

অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১

#তাম্রলিপ্তকড়চা


বাড়িটা মম করছে টাটকা ফুলের সৌরভে। বিগত দুদিন ধরে যেখানেই গেছি, সে ময়না হোক বা নন্দকুমার,চণ্ডীপুর হোক বা শহীদ মাতঙ্গিনী- তাজা ফুলের স্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে এজেন্ট আর এসএলওরা। যত বলি, এতো প্রথম আলাপ নয়, এর আগেও মিলিত হয়েছি আমরা, আমার চেম্বারে। তারপর একপ্রস্থ ট্রেনিং হয়েছে পোর্টালের নতুন মডিউল নিয়ে, তাহলে আবার কেন? আর আমি তো অতিথি না, আমি তো তোমাদেরই লোক। ঠিক যেমন, তোমরা আমার লোক। 


শুরু করেছিল ময়না। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত ব্লক। একে তো তমলুক শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া, তারওপর দীর্ঘদিন যাবৎ নেই কোন পাকাপাকি ইন্সপেক্টর, নেই কোন কন্ট্রাকচুয়াল ক্লার্কও। এতদিন অতিরিক্ত দায়িত্বভার সামলাতেন যে ইন্সপেক্টর, সাম্প্রতিক অর্ডারে বদলি হয়ে যাবেন তিনিও। আবার নতুন কারোর ঘাড়ে চাপবে ময়না। 


সদ্য বদলি হয়ে এসেছি নতুন জেলায়, এর মধ্যেই বদলি হয়ে যাচ্ছেন চার জন ইন্সপেক্টর সাহেব। ওদিকে ৪৮ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যাবে দুয়ারে সরকার। চাপা উৎকন্ঠায় ভুগছিলাম, তাই ভাবলাম যাই একবার সামনা-সামনি দেখেই আসি, কতটা প্রস্তুত সবাই। ভেবেছিলাম ময়নার লোকজন হয়তো ক্ষেপে থাকবে, গেলেই উজাড় করে দেবে নালিশের ঝাঁপি। বদলে পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। টুকরো নালিশ যে ছিটকে আসেনি তা নয়, ওটুকু ও না হলে সন্দেহ হত, ব্যাটারা কাজের কিস্যু জানে কি না। গিয়েছিলাম এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে, ফিরলাম আশ্বস্ত হয়ে। 


এবার নন্দকুমারের পালা। এদের একটু বকলাম অবশ্য, এতদূর এসেছি, ময়না থেকে আবার তমলুক ফিরে উল্টোদিকে যেতে হয় নন্দকুমার। একটু না বকাবকি করলে কেমন যেন গা ম্যাজম্যাজ করে। বদলে নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রণজিৎ একবাটি ছানার পায়েস খাওয়াল। ‘খান না ম্যাডাম, এখেনে এটা খুব ভালো বানায়। আমরা প্রায়ই খাই, ইয়ে খেলে মাথা ঠাণ্ডা হবে।’ বলি রসমালাইকে ছানার পায়েস বলে খাওয়ালে পৃথিবীর কারো মাথা ঠান্ডা হয়? যত বলি, এটা ছানার পায়েস না, এটা রস মালাই। এই তো পুঁচকে পুঁচকে একপাল রসগোল্লার বাচ্ছা সাঁতার কাটছে ঘন দুধে। বললে শুনছেই বা কে আর মানছেই বা কে? রঞ্জিত সমানে লড়ে গেল, ' না ম্যাডাম, এটা ছানার পায়েসই। রসমালাই তো ওই গুলো, লম্বা লম্বা রসগোল্লা, ঘন দুধে ভেসে থাকে-।' আপদ ওই বস্তুটাকে যে ক্ষীর চমচম বা মালাই চমচম বলে, সেটা তখন আর মাথায় আসেনি। নাহলে ছাড়তামই না ব্যাটাকে।


নন্দকুমারের পর চণ্ডীপুরের পালা। দীঘা যাবার রাস্তা ধরে, হলদি নদী টপকে খানিক গেলেই চণ্ডীপুর ব্লক। হলদি নদীর পাড়ে, বিশাল গঙ্গা মন্দির। মকর সংক্রান্তিতে নাকি মস্ত মেলা বসে এখানে। আসন্ন মেলার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে, রাস্তার ওপর বাঁধা চলছে সুদৃশ্য তোরণ। পথে পড়ে ছোট্ট রেলস্টেশন, নাম ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। এই জেলায় যদি এমন স্টেশন না থাকবে তাহলে থাকে কোথায়। 


বদলী হয়ে যখন এই জেলায় আসি,কে না সতর্ক করেনি। ‘খুব সাবধান। পূর্ব মেদিনীপুর কিন্তু হুগলী নয়। চুঁচুড়ার বদান্যতা, আনুগত্য এই জেলায় আশাও করো না।’ নাঃ আমি আশা করিনি। কেন করব? এই জেলাটা তো হুগলী নয়। এখানকার মানুষজনই বা কেন হুগলীর মানুষের মত হবে। 


গাঙ্গেয় বঙ্গের অধিবাসীরা যতই তাচ্ছিল্য করুক, কিচ্ছু যায় আসে না এই জেলার। এই জেলার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বলেই হয়তো অনেক বেশি লড়াকু এখানকার মানুষজন। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলা যার সীমান্ত বরাবর খোলাখুলি আড়ামোড়া ভাঙে স্বয়ং বঙ্গোপসাগর। জেলা জুড়ে জড়িয়ে আছে কত যে রাজবাড়ি আর তাদের অজানা ইতিহাস। বিশ্বাস হচ্ছে না তো?  তমলুক,মহিষাদল, কাজলাগড়, পাঁচেতগড়, ময়না।  পাঁচটা রাজবাড়ির হাল হকিকৎ তো এখুনি কড় গুনে বলে দিতে পারি। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা যদি বলেন, তো এই জেলার ধারে কাছে বর্তমান এপার বঙ্গের কোন জেলা আসবে মশাই? ' ভারত ছাড়' আন্দোলনের সময় আক্ষরিক অর্থে মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই জেলা। এই তো গত ১৭ই ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের ৭৯তম জয়ন্তী পালিত হল।


চণ্ডীপুরের পর শহীদ মাতঙ্গিনীর পালা। এখানকারই মেয়েছিলেন কিনা তিনি। ব্লক চত্বরে রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। বছর শেষের পড়ন্ত রোদে, তাঁর মূর্তির সামনে ক্ষণিক দাঁড়ালাম আমরা, কাকতলীয় ভাবে এই ব্লকের এজেন্ট এসএলও দের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ, মেয়েদের মধ্যেও আবার অল্প বয়সীদের থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা বেশ বেশি। বলে দিতে হয় না, এটা গান্ধীবুড়ির মহল্লা। দিদিদের মধ্যে অনেকেই কাজে ঢুকেছেন এই সহস্রাব্দের শুরুতে। তারপর কত কি ঘটে গেছে, বদলে গেছে স্কিম, উঠে গেছে মোটকা সাবেকি লেজার খাতা, এসেছে- গেছে একাধিক সাইট, বদলাননি শুধু এখানকার দিদিরা। জনৈক দিদি গল্প শোনাচ্ছিলেন এ বছরের মত বন্যা দীর্ঘদিন দেখেনি গান্ধীবুড়ির ব্লক। খোদ ব্লক অফিসটাই দীর্ঘদিন ছিল আধ ডোবা হয়ে। তারই মধ্যে কাজে আসতেন তাঁরা। এক হাঁটু জল ঠেলে। খুব সাদামাটা ভাবে বললেন, 'হাঁটুর ওপর জল ম্যাডাম। ল্যাট্রিন অবধি জলের তলায়। ওই জল ঠেলে এলি কি পা চুলকাইত।' পাশ থেকে ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, 'পচা জল তো ম্যাডাম। বিডিও অফিস থেকে কিছু গামবুট দেওয়া হয়েছিল , তবে সে তো আর -'। বুঝলাম, উনি পাননি। পাবার কথাও নয়। তাজ্জব আমি প্রশ্ন করলাম, ' শাড়ি পরেই আসতেন? মানে ভিজে শাড়ি লটপট করতে করতে?' ওনারা হেসে মুখে চাপা দিলেন, ' হায় ম্যাডাম কি যে বলেন, শাড়ি পরবুনি?'

Sunday 26 December 2021

ছোট্ট কবিতার বড়দিন

 


মৃদু হলেও, মুখোমুখি ধাক্কা। দোষ আমারই, টিকিটটা পড়তে পড়তে হাঁটছিলাম যে। শশব্যস্ত হয়ে মার্জনা চাইতে গিয়ে থমকে গেলাম। বড় চেনা, বড় প্রিয় এক জোড়া চোখ। বরাবরের মতই চোখ ভর্তি হাল্কা বিরক্তি। কবেই বা আমার দিকে প্রসন্ন হয়ে তাকিয়েছে ঐ চোখের মালিক। থতমত খেয়ে, ক্যাবলার মত হেসে জানতে চাইলাম, সব ভালো কি না। জানতাম উত্তরে ‘হ্যাঁ’ই আসবে। তারপর আর একটু হেসে ভিড়ে মিশে যাব আমি। যদিও মধ্যাহ্ন, তবুও বড়দিন তো বটে। আশেপাশে ক্রমেই জমে উঠেছে উৎসবমুখর রঙবেরঙের সুখী মানুষের ভিড়। ওই ভিড়েই হারিয়ে যাব আমি, মুখকে এবার কিছুতেই আর মনের আয়না হতে দেব না। 


প্রশ্নের উত্তরে ভেসে এল প্রশ্ন।  নাঃ আমি কেমন আছি, জানতে চাইল না সে। স্বভাবসিদ্ধ উদাসীন হয়তো বা সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবেই জানতে চাইল,‘একা?’  অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে জানালাম, দোকা আর পাই কোথায়? মেয়েটাকে বলেছিলাম বটে আসতে, এল না। তার চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে দারুণ ভয়। অথচ ছোটবেলায় কি ভালোই না বাসত চড়তে, বলত ‘মজার সিঁড়ি।’ বলতে বলতে ব্রেক কষলাম,বড় বেশি ব্যক্তগত কথা বলছি। সে তো জানতেও চায়নি। প্রশ্ন ছিল, আমি একা এসেছি কি না। জবাবে শুধু হ্যাঁ বলে দিলেই তো মিটে যেত। এতক্ষণে বাড়তে থাকা জনারণ্যে মিশে যেতাম আমি। তা নয়, কেন যে নিজেকে এত ছ্যাবলা প্রমাণ করি, বার-বার।  


‘কোন সিনেমা?’ জানতে চাইল সে। জবাব দিলাম। ‘এর টিকিট কাটতে হলে আসতে হয় নাকি? বাড়ি বসেই তো-’। বললাম, তা যায় বটে, তবে খামোখা কনভিনিয়েন্স ফি’র নামে অনেকটা টাকা কেটে নেয় ব্যাটারা। বলেই জিভ কাটলাম। কি আনস্মার্টের মত যে কথা বলি আমি। অন্য কিছুও তো বলা যেত। এত স্বচ্ছ হবার দরকারটাই বা কি? মেয়েরা যত  রহস্যময়ী হয়, ততোই বাড়ে তাদের আবেদন। আর  আমায় দেখো-। এতগুলি বছর কিছুই শেখাতে পারল না আমায়। শিখে উঠতে পারেলাম না কি করে বুনতে হয় আলোআঁধারি মায়াজাল। 


ওদিক থেকে অবশ্য ভেসে এল সমর্থনের সুর। ‘হ্যাঁ প্রায় একশ টাকা কাটল বটে।’ তারপর বেশ অনেকখানি নিস্তব্ধতা। শুধু বুকের মধ্যে বিষম যুদ্ধ। নির্বোধ হৃদয় চাইছে, খানিক থমকে দাঁড়াক না এ সময়। আরো কিছু বলুক সে, ফুসফুসে আর একটু ভরেনি তার সৌরভ। অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া মস্তিষ্ক বলছে, আবার কেন? 


একই সিনেমা দেখতে এসেছি দুজনে, নাঃ পাশাপাশি সিট পড়েনি। এটা তো আর সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। সবথেকে সস্তার টিকিট কেটেছি আমি, একদম সামনের রো এর পরের-পরেরটা। ‘ঠিক আছে’ বলে পিছন দিকে এগিয়ে গেল সে। হলের বাতি তখনও নেভেনি, অথচ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু। দম নিতেও চাপা কষ্ট। অঝোর গালি দিচ্ছে পোড় খাওয়া মাথা। বলেছিলাম না, এবার এই ব্যথা সারতে কে জানে লাগবে আরো কত-কত বছর। কি সব বিজ্ঞাপন চলছে পর্দা জুড়ে, বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। আলো নিভলে, উঠে যাব কি? 


আলো নেভার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল, ইশারায় বলল, পাশের সিটে যেতে। বোকার মত বললাম, এটা যাঁর সিট, তিনি যদি আসেন?  জবাব এল,‘এলে অন্য কোথাও বসবে। ম্যাটিনি শো, সবই তো ফাঁকা-’। 


আলো নিভল, বুকের ভেতর অকারণ বড় ছটফট করছে হৃদয়, মন বসাতে পারছি না একদম। কি যে হচ্ছে পর্দা জুড়ে। মন থেকে মনে কোন সিগন্যাল যায় কি না জানি না, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সে, ‘এটা পি আর মান সিং, ওদের ম্যানেজার, প্রায় ফাদার ফিগার ছিল গোটা টিমের কাছে।’ গল্প এগোচ্ছে, সাথে ফিসফিসানিও। গুলিয়ে ফেলছি, কোনটা কে। বলে দিচ্ছে সে, ‘এটা মদনলাল। ওটা কীর্তি আজাদ। মহিন্দর অমরনাথের বাবার রোলে খোদ মহিন্দর অমরনাথ।’ ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে মন আর মাথার দ্বৈরথ, ডুবে যাচ্ছি আমিও শৈশবের একরাশ স্মৃতিতে। সমবয়সী আমরা। ঘটনাপ্রবাহ যে সময়কার, তখন নিছক অবোধ শিশু আমরা। ক্রিকেট কি কিছুই বুঝতাম না কেউই। কিন্তু এই দিনগুলোর গল্প তো কম শুনিনি আমাদের বাবা-কাকা-জেঠাদের কাছে। 


উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে বলেই যাচ্ছে সে, ‘ একদম ক্লাইভ লয়েডের মত ভাবভঙ্গী।  হাঁটছেও অমনি সামান্য কুঁজো হয়ে। বকের মত। পুরো ভিভ রিচার্ডস্ এর মত করে ব্যাট চালাচ্ছে।’ গলায় ঝরে পড়ছে উত্তেজনা। আমী জানি লোকটার প্রাণের প্রতিটা তন্ত্রিতে মিশে আছে ক্রিকেট। বড় ভালো খেলত এককালে। তখনও ঘণ কৃষ্ণ কেশদামের ফাঁকে উকি মারেনি একটা দুটো কাশফুলের গোছা। জানি এখনও সুযোগ পেলে ইউটিউব খুলে পুরাণ ম্যাচের রেকর্ডিং দেখে লোকটা। লোকটার কাছে ভিভ রিচার্ডস নিছক ক্রিকেটার নন, ঈশ্বর স্বয়ং।  


ব্যাগের মধ্যে কেঁপে উঠল বেরসিক মুঠোফোন। বার করতে গেলাম, বিরক্ত হল সে।  ‘থাক না। ওটা থাক।’ পরক্ষণেই তরল হয়ে এল কণ্ঠস্বর, ‘এই ম্যাচটা কিন্তু ইণ্ডিয়া হারবে। পরেরটাও। ম্যালকম মার্শালের বল বেঙ্গসরকারের থোবড়া ভেঙে দেবে।’ থুতনিতে সত্যিই আঘাত পেল পর্দার বেঙ্গসরকার, বিবেকহীনের মত, বল থেকে টুসকি মেরে রক্ত ঝেড়ে ফেলল পর্দার মার্শাল। নিজের সিটে সটান হয়ে বসল সে, বলল, ‘ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের এমন ভিলেনের মত দেখাচ্ছে কেন? আসলে তো ওরা ভিলেন নয়। নিছক বিপক্ষ কেবল। যেটা দেখালো না, সেটা হল,পরের বলটা করতে গিয়ে মার্শাল দেখেছিল বলটায় খানিক মাংস আর রক্ত লেগে। দেখে ও মাঠেই বমি করে দিয়েছিল।’ বেশ বুঝতে পারি, মন আর মাথাকে ক্রমশঃ  ঘিরে ধরছে অপরিসীম মুগ্ধতার কুয়াশা।D


বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। এর পরের ম্যাচটা জিতবে তো? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাই আমি। ‘হ্যাঁ একদম। এরপরের ম্যাচেই তো জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।’ ৯রানে পড়ে যায় ৪ উইকেট। যদিও জানা ইতিহাস, তবুও ড্রাম বাজতে থাকে বুকের মধ্যে। অন্ধকারে কি করে বোঝে সে কে জানে, বলে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তারপর মদনলাল আর কিরমানিকে সঙ্গে নিয়ে বেদম পেটায় কপিল।’


দমবন্ধ  করা সুখ বড় স্বল্পস্থায়ী। জ্বলে ওঠে সিনেমা শেষের আলো। স্ক্রিনে তখন মুখ খুলেছেন আসল কপিল দেব। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠছে একের পর এক সাদাকালো ছবি। কেউ বসে দেখছে, কেউ বা উঠে ভিড় জমাচ্ছে এক্জিট লেখা দরজার সামনে। একদম ইচ্ছে করছে না উঠতে, নীরবে পর্দার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের জনও। তবুও উঠতেই হয়, একটু আগের দমবন্ধ করা সুখের মুহূর্ত গুলোকে স্মৃতিতে তালা বন্ধ করে ধরতেই হয় নিজের নিজের রাস্তা। R


হ্যাংলা মন শুধু চিৎকার করে ওঠে, 'আরও কিছুক্ষণ না হয় রইলে কাছে--'। শুনতে যে পেল না সেও বুঝলাম। মুখ বন্ধ ছিল যে। বড় সাহস বেড়ে গেছে মনের, আজ আর কিছুতেই থামতে দিতে চায় না কথার স্রোতকে। নিছক খেজুরে কথা বলার জন্যই বললাম,“ তোমার সেই ডাস্ট এলার্জি?সেরে গেছে বুঝি?” জবাবে ভ্রু কুঁচকে বলল,“কমোনি তো দেখছি এক ছটাকও। ” মোটা বলল বুঝি, রাগ হল না তো?হৃদয়ের বেদনা যেন কিছুটা উপশম হল, বললাম,“নাঃ কমিনি। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বরং বেড়েই গেছি। ” হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠল কি  ওষ্ঠ আর অধরের জটিল বিভঙ্গে? সুযোগ বুঝে বললাম,“একটা সেল্ফি?” বলল,“সেল্ফাইটিস্ টাও বেড়েছে দেখছি।” বলতে পারলাম না,“কয়েদ করে রাখতে চাই এই মুহূর্তটাকে। যেমন রেখেছি তোমার সঙ্গে কাটানো আরো অজস্র মুহূর্ত।" বলতে পারলাম না, একদলা কষ্ট কোথা থেকে এসে চেপে ধরল বুক আর গলা। ছলছলে চোখকে অন্যদিকে ঘোরালাম, ধরা পড়তে চাই না। কিছুতেই না। সূর্য কি পশ্চিমে ঢলে পড়ল খানিকটা? এবার যেতে হয় এবং যেতে দিতেও হবে। মন বলল,“ভালো থেকো। ” আর সে? সে বলল,“চলো তোমার ছবিটা তুলে নি”। হাসলাম দুজনেই। ক্যামেরার সামনে হাসতে হয় তো। শাটার বন্ধের সাথে সাথেই কি নেমে আসবে নিশ্ছিদ্র  অমানিশা?না কি সব নিয়ম ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে উল্টোদিকে দৌড়বে পৃথিবী?K

Wednesday 22 December 2021

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 


চেম্বারের দরজায় পর্দা লাগাতে চেয়েছিল সাপ্লায়ার ছেলেটি। ‘পর্দা লাগিয়ে নিন ম্যাম। নাহলে যে সে ঢুকে পড়বে। এখানকার সব অফিসারদের ঘরেই দরজায় পর্দা লাগানো।’ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছি। ইল্লি আর কি! একে তো ভাঁড়ে মা ভবাণী। টাকাপয়সার জন্য রীতিমত অ্যালুমিনিয়াম বাটি হাতে হেড আপিসে চক্কর কাটি আজকাল। ‘টাকা, নেই, টাকা চাই, টাকা কই’ করে মহানগরে এমনি রেপুটেশন বানিয়েছি যে, আমায় দেখলেই সেকশন ফাঁকা। হেড আপিসে ফাণ্ড অ্যালটমেন্ট ছাড়ে যে ছেলেটি, আগেরদিন বলেই ফেলল, ‘আপনাকে দেখলে আজকাল আমার হেবি ভয় লাগে ম্যাডাম।’ সুকন্যা সাক্ষী। একটুও বাড়িয়ে বলছি নেকো।


তবে টাকা না থাকার থেকেও বড় কথা হল, আমি চাই না মানুষ আমার চেম্বারে ঢুকতে ভয় পাক। এটা ল্যাবার দপ্তর। সমাজের একদম তলার দিকের মানুষদের নিয়ে আমাদের কাজ, তারাই যদি তাদের দাবীদাওয়া সুখবিসুখ না জানাতে পারে, কি লাভ অমন চেয়ারে বসে। এত বচ্ছরের লেবারগিরি একটা জিনিস শিখিয়েছে, যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। কেউ এটা ভেবে আসে না যে আমার হাতে সোনার কাঠি আছে, ছোঁয়াব আর সব মনোমত হয়ে যাবে। কি পারব, কতটুকু পারব, আদৌ পারব কি না, কেন পারব না বা কেন পারছি না খুলে বলে দিলে অনেকাংশে ঝামেলা মিটে যায়। অন্তত স্তিমিত তো হয় রে বাপু।


এই জ্ঞানের কথা শুনিয়ে, কাগজের কাপে আদা, গোলমরিচ আর বিটনুন দেওয়া একখানা পাঁচন মার্কা চা খাইয়ে আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর পার্থকে বললাম, তাহলে বুঝলে কি না? যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। চলো যোগাযোগ করি। এত গুলো বেনিফিট ছাড়ছ, যোগাযোগ না করে ছাড়বেই না কেন? যোগাযোগ করো বিধায়ক মশাইয়ের সাথে, বিডিও সাহেব যদিও প্রচণ্ড ব্যস্ত তবুও বলোই না তাঁকে একবার। বলো পঞ্চাযেত সমিতির সভাপতি, সহ সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতি তথা জেলা পরিষদের সদস্য, পঞ্চাযেত প্রধানদের। কোলাঘাট আমার সবথেকে বড় এলডব্লুএফসি। এই ব্লকের প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক।শুধু এই ব্লক থেকেই ১৫৭ জন নির্মাণ আর পরিবহন কর্মীকে পেনশন দিই আমরা। সবথেকে বেশি ডেথ কেস এবং ফাইনাল পেমেন্ট অর্থাৎ মেয়াদপূর্তিতে টাকা ফেরতের আবেদনও আসে এই ব্লক থেকে। এত কাজ করো, সেটা কেউ জানতেই পারে না। আর যেটা পারো না, সেটা নিয়েই উড়ে বেড়ায় অভিযোগের গরম বাতাস। 


আমার জ্ঞান না কালেক্টরেটের চায়ের গুণ জানি না, দারুণ ভালো একটা প্রোগ্রাম নামাল বটে আজ পার্থ, শুভদীপ্ত আর তাদের দলবল। ৩৩জন মৃত বেনিশিয়ারীর উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় ২২লাখ টাকার মৃত্যুকালীন অনুদান। জনা ৩০ কে দেওয়া হল মেয়াদপূর্তির টাকা। তবে আজকে আমাদের অনুষ্ঠানের স্টার যিনি ছিলেন, তাঁর নাম হল শেখ ইসমাইল। এই সেদিন অবধি বাস চালাতেন উনি। তখনই নাম লিখিয়েছিলেন আমাদের পরিবহন কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। ষাট বছর হবার পর আবেদন করেন পেনশনের জন্য। একটু সময় লেগেছে বটে, তবে যেদিন থেকে ওণার ষাট বছর হয়েছে সেইদিন থেকে ধরে আজ পর্যন্ত নিঁখুত ভাবে গণনা করে মোট সাড়ে তেত্রিশ হাজার টাকার পেনশন ঢুকেছে ওণার ঝুলিতে। প্রোগাম শেষে আমি স্বয়ং ওণার কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা চলুন তো, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি। আপনারাই হলেন আসল যোগাযোগ। আপনারা আছেন বলেই এই দপ্তরটাকে এত ভালোবাসি। ’ 


পার্থকে যে জ্ঞান দিয়েছিলাম,  তা বাকিদেরও খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলুম। সেগুলো শুনল বটে, মাথাও চুলকালো বেজায়, তারপর কোথায় সটকে পড়ল একে একে। ভাবছে আমি খেয়াল করিনি-।সবকটাকে চেপে ধরব, শুধু একবার ফাণ্ডটা ঢুকতে দিন।