Saturday 1 January 2022

অনির ডাইরি ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১

 

পৌনে তিনটে নাগাদ ফোন করলাম। ফোনের ওপার থেকে চরম ব্যস্ত কেজো স্বর বলল,‘হুঁ?’ আমার ভয় পাওয়া চেহারা আমি আদতে আনাড়ি, স্বভাব সিদ্ধ ভীতু স্বরে জানতে চাই, ‘বেরোলে?’ রোজ একই প্রশ্ন করি। তবে অন্যান্য দিন সময়টা পেছিয়ে যায় আরোও ঘন্টা তিন, সাড়ে তিন। আজ তো বছরের শেষ দিন। 


বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি আমি। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বাড়ি ফেরা, বাসি রুটি আর সকালের বা আগের দিনের লাউয়ের তরকারী বা দু পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি আর সকালের বেঁচে যাওয়া ডাল নাহলে নিছক দুধ কর্নফ্লেক্স খাই আমরা মা আর মেয়ে। নাক সিঁটকাবেন না। এগুলো মোটেই তেমন খারাপ নয়, ভয়ঙ্কর তো হল ওলকপি আর বড়ির তরকারি। এই মোটা মোটা করে কাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ওলকপির সাথে সামান্য আলু আর বড়ি মিশিয়ে ঝোল। উফঃ একবার রাঁধলে তিনদিনেও শেষ হয় না তা। 


যাই হোক, যাই থাকুক তাই দিয়ে টিফিন সেরে শ্রীমতী তুত্তুরীর মাথায় একখানা চাঁটি মেরে আপিস যাই আমি। আমার সাথে বসে ঐসব অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়া আর আমার হাতের চাঁটির জন্য বসে থাকে তুত্তুরী। যেদিন কোন মিটিং এ আটকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়, সেদিন একটু বেশীই শুকিয়ে থাকে মেয়ের মুখ। বুঝি খিদে পেয়েছে, কিন্তু না খেয়ে বসে আছে মায়ের জন্য। তমলুক পোস্টিং এর এই একটাই ভালো দিক খুঁজে পায় তুত্তুরী। 


তবে আজ ফিরব না। কাজ গুছিয়ে বেরোতে একটু দেরী হবে। সকালে বলাতে মুখ ঝুলে গিয়েছিল শ্রীমান তুত্তুরীর। তখন উপযাজক হয়ে শৌভিকই বলেছিল, পৌরসভায় কিসব কাজ আছে, সামলে ফাইলপত্তর নিয়ে তিনটের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। এখন যখন ফোন করলাম, জাস্ট উড়িয়েই দিল, ‘না-না-না। দেরী হবে।’ অগত্যা কি আর করি, মাসির ফোনে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, ‘খেয়ে নে বাবু। বাবার দেরী হবে।’ 


সাড়ে তিনটে নাগাদ, শৌভিক উচ্চস্বরে ঘোষণা করল,‘আমি বেরিয়েছি।’ যেটা অনুচ্চ থেকে গেল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে আমাকেও। অন্ততঃ মহকুমা শাসকের সেটাই মনোবাঞ্ছা। মুস্কিল হচ্ছে গোটাও বললেই তো আর গোটানো যায় না। ফাইল-চিঠি-অর্ডার জলদি হাতে গোটাচ্ছি, জহর বাবু এসে বললেন,‘ম্যাডাম চলে যাবেননি যেন।  একটু মিষ্টি-’। মিষ্টি বোধহয় বানিয়ে আনছে ব্যাটারা, উসখুস করছি আমি। আরএলও ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করছি,‘সৌরভ আমি বাড়ি যাই?’ সব আপিসে আপিসমাস্টাররা আটকায় কর্মচারীবৃন্দকে, এখানে উল্টোপুরাণ। সৌরভ গম্ভীর সুরে বলে, ‘দাঁড়ান ম্যাডাম, আজ শেষ দিন তো। সব লাইফ সার্টিফিকেট গুলো গেল কি না একবার দেখে নি।’ মিনিট পনেরো পর জানা গেল তাঁরা হেঁটে হেঁটে মহানগরের পথ ধরেছে। এবার আমিও গুটি-গুটি- মানে হেঁ-হেঁ আর কি। 

আবার মাথা নাড়ে সৌরভ। আসে আরো কিছু কাজের ফিরিস্তি, আসতেই থাকে। যতক্ষণ না আমি নাকে কাঁদতে শুরু করি। ‘আমি বাড়ি যাব। যাবোই-’।


আজ বর্ষশেষ। ফেসবুকের পাতা ভরে ওঠে সুসজ্জিত উৎসব মুখর নরনারী আর রঙবেরঙের তরল পানীয়র ছবিতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্সে ডুবে যাই আমি। আপাততঃ কিছুদিন আর বই পড়ছি না। মাইকেল প্রঙ্কোর দা লাস্ট ট্রেন শেষ করে পুরো ঘেঁটে গেছে মাথা। কেন যে বইটার এত নাম, কারা যে এইসব বইগুলোকে এত পুরষ্কার দেয় ভগবান জানে। ব্যোমকেশ-ফেলুদা-শবর-কাকাবাবু ছাড়ুন আমাদের কিরিটি রায়ও এর থেকে অনেক ভালো। অন্তত পড়ে বোঝা যায় কে, কি এবং কেন। জাপানীদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা।  

 

তুত্তুরীকে বগলদাবা করে ইন্ডিয়ানা জোনস্ দেখতে বসে শৌভিক। হেড ফোন ভেদ করে ভেসে আসে বাপবেটির উত্তেজিত কথাবার্তা। কোনটা যে বেশি বিমোহিত বুঝতে পারি না। একবাটি গরম চিলি-পটেটো বলস্ ভেজে নিয়ে দুজনের মধ্যে ঢুকে বসি আমি।  একসাথে তিনজনে ঘুরে বেড়াই পেট্রা নগরীর পথে পথে। মা-মেয়েতে একসাথে প্রেমে পড়ি তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডের। শৌভিকের সাথে ঝগড়া করি কে বেশী মহোময় শন কনোরি নাকি হ্যারিসন ফোর্ড। এই ভাবেই কাটুক না আগামী বছর, আগামী প্রতিটা বছর। বছর আসুক, বছর যাক, সম্পর্ক গুলো অমলিন থাকুক সবার। বাকিটা ঠিক ম্যানেজ হয়েই যাবে।

অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১

#তাম্রলিপ্তকড়চা


বাড়িটা মম করছে টাটকা ফুলের সৌরভে। বিগত দুদিন ধরে যেখানেই গেছি, সে ময়না হোক বা নন্দকুমার,চণ্ডীপুর হোক বা শহীদ মাতঙ্গিনী- তাজা ফুলের স্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে এজেন্ট আর এসএলওরা। যত বলি, এতো প্রথম আলাপ নয়, এর আগেও মিলিত হয়েছি আমরা, আমার চেম্বারে। তারপর একপ্রস্থ ট্রেনিং হয়েছে পোর্টালের নতুন মডিউল নিয়ে, তাহলে আবার কেন? আর আমি তো অতিথি না, আমি তো তোমাদেরই লোক। ঠিক যেমন, তোমরা আমার লোক। 


শুরু করেছিল ময়না। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত ব্লক। একে তো তমলুক শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া, তারওপর দীর্ঘদিন যাবৎ নেই কোন পাকাপাকি ইন্সপেক্টর, নেই কোন কন্ট্রাকচুয়াল ক্লার্কও। এতদিন অতিরিক্ত দায়িত্বভার সামলাতেন যে ইন্সপেক্টর, সাম্প্রতিক অর্ডারে বদলি হয়ে যাবেন তিনিও। আবার নতুন কারোর ঘাড়ে চাপবে ময়না। 


সদ্য বদলি হয়ে এসেছি নতুন জেলায়, এর মধ্যেই বদলি হয়ে যাচ্ছেন চার জন ইন্সপেক্টর সাহেব। ওদিকে ৪৮ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যাবে দুয়ারে সরকার। চাপা উৎকন্ঠায় ভুগছিলাম, তাই ভাবলাম যাই একবার সামনা-সামনি দেখেই আসি, কতটা প্রস্তুত সবাই। ভেবেছিলাম ময়নার লোকজন হয়তো ক্ষেপে থাকবে, গেলেই উজাড় করে দেবে নালিশের ঝাঁপি। বদলে পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। টুকরো নালিশ যে ছিটকে আসেনি তা নয়, ওটুকু ও না হলে সন্দেহ হত, ব্যাটারা কাজের কিস্যু জানে কি না। গিয়েছিলাম এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে, ফিরলাম আশ্বস্ত হয়ে। 


এবার নন্দকুমারের পালা। এদের একটু বকলাম অবশ্য, এতদূর এসেছি, ময়না থেকে আবার তমলুক ফিরে উল্টোদিকে যেতে হয় নন্দকুমার। একটু না বকাবকি করলে কেমন যেন গা ম্যাজম্যাজ করে। বদলে নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রণজিৎ একবাটি ছানার পায়েস খাওয়াল। ‘খান না ম্যাডাম, এখেনে এটা খুব ভালো বানায়। আমরা প্রায়ই খাই, ইয়ে খেলে মাথা ঠাণ্ডা হবে।’ বলি রসমালাইকে ছানার পায়েস বলে খাওয়ালে পৃথিবীর কারো মাথা ঠান্ডা হয়? যত বলি, এটা ছানার পায়েস না, এটা রস মালাই। এই তো পুঁচকে পুঁচকে একপাল রসগোল্লার বাচ্ছা সাঁতার কাটছে ঘন দুধে। বললে শুনছেই বা কে আর মানছেই বা কে? রঞ্জিত সমানে লড়ে গেল, ' না ম্যাডাম, এটা ছানার পায়েসই। রসমালাই তো ওই গুলো, লম্বা লম্বা রসগোল্লা, ঘন দুধে ভেসে থাকে-।' আপদ ওই বস্তুটাকে যে ক্ষীর চমচম বা মালাই চমচম বলে, সেটা তখন আর মাথায় আসেনি। নাহলে ছাড়তামই না ব্যাটাকে।


নন্দকুমারের পর চণ্ডীপুরের পালা। দীঘা যাবার রাস্তা ধরে, হলদি নদী টপকে খানিক গেলেই চণ্ডীপুর ব্লক। হলদি নদীর পাড়ে, বিশাল গঙ্গা মন্দির। মকর সংক্রান্তিতে নাকি মস্ত মেলা বসে এখানে। আসন্ন মেলার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে, রাস্তার ওপর বাঁধা চলছে সুদৃশ্য তোরণ। পথে পড়ে ছোট্ট রেলস্টেশন, নাম ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। এই জেলায় যদি এমন স্টেশন না থাকবে তাহলে থাকে কোথায়। 


বদলী হয়ে যখন এই জেলায় আসি,কে না সতর্ক করেনি। ‘খুব সাবধান। পূর্ব মেদিনীপুর কিন্তু হুগলী নয়। চুঁচুড়ার বদান্যতা, আনুগত্য এই জেলায় আশাও করো না।’ নাঃ আমি আশা করিনি। কেন করব? এই জেলাটা তো হুগলী নয়। এখানকার মানুষজনই বা কেন হুগলীর মানুষের মত হবে। 


গাঙ্গেয় বঙ্গের অধিবাসীরা যতই তাচ্ছিল্য করুক, কিচ্ছু যায় আসে না এই জেলার। এই জেলার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বলেই হয়তো অনেক বেশি লড়াকু এখানকার মানুষজন। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলা যার সীমান্ত বরাবর খোলাখুলি আড়ামোড়া ভাঙে স্বয়ং বঙ্গোপসাগর। জেলা জুড়ে জড়িয়ে আছে কত যে রাজবাড়ি আর তাদের অজানা ইতিহাস। বিশ্বাস হচ্ছে না তো?  তমলুক,মহিষাদল, কাজলাগড়, পাঁচেতগড়, ময়না।  পাঁচটা রাজবাড়ির হাল হকিকৎ তো এখুনি কড় গুনে বলে দিতে পারি। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা যদি বলেন, তো এই জেলার ধারে কাছে বর্তমান এপার বঙ্গের কোন জেলা আসবে মশাই? ' ভারত ছাড়' আন্দোলনের সময় আক্ষরিক অর্থে মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই জেলা। এই তো গত ১৭ই ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের ৭৯তম জয়ন্তী পালিত হল।


চণ্ডীপুরের পর শহীদ মাতঙ্গিনীর পালা। এখানকারই মেয়েছিলেন কিনা তিনি। ব্লক চত্বরে রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। বছর শেষের পড়ন্ত রোদে, তাঁর মূর্তির সামনে ক্ষণিক দাঁড়ালাম আমরা, কাকতলীয় ভাবে এই ব্লকের এজেন্ট এসএলও দের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ, মেয়েদের মধ্যেও আবার অল্প বয়সীদের থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা বেশ বেশি। বলে দিতে হয় না, এটা গান্ধীবুড়ির মহল্লা। দিদিদের মধ্যে অনেকেই কাজে ঢুকেছেন এই সহস্রাব্দের শুরুতে। তারপর কত কি ঘটে গেছে, বদলে গেছে স্কিম, উঠে গেছে মোটকা সাবেকি লেজার খাতা, এসেছে- গেছে একাধিক সাইট, বদলাননি শুধু এখানকার দিদিরা। জনৈক দিদি গল্প শোনাচ্ছিলেন এ বছরের মত বন্যা দীর্ঘদিন দেখেনি গান্ধীবুড়ির ব্লক। খোদ ব্লক অফিসটাই দীর্ঘদিন ছিল আধ ডোবা হয়ে। তারই মধ্যে কাজে আসতেন তাঁরা। এক হাঁটু জল ঠেলে। খুব সাদামাটা ভাবে বললেন, 'হাঁটুর ওপর জল ম্যাডাম। ল্যাট্রিন অবধি জলের তলায়। ওই জল ঠেলে এলি কি পা চুলকাইত।' পাশ থেকে ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, 'পচা জল তো ম্যাডাম। বিডিও অফিস থেকে কিছু গামবুট দেওয়া হয়েছিল , তবে সে তো আর -'। বুঝলাম, উনি পাননি। পাবার কথাও নয়। তাজ্জব আমি প্রশ্ন করলাম, ' শাড়ি পরেই আসতেন? মানে ভিজে শাড়ি লটপট করতে করতে?' ওনারা হেসে মুখে চাপা দিলেন, ' হায় ম্যাডাম কি যে বলেন, শাড়ি পরবুনি?'

Sunday 26 December 2021

ছোট্ট কবিতার বড়দিন

 


মৃদু হলেও, মুখোমুখি ধাক্কা। দোষ আমারই, টিকিটটা পড়তে পড়তে হাঁটছিলাম যে। শশব্যস্ত হয়ে মার্জনা চাইতে গিয়ে থমকে গেলাম। বড় চেনা, বড় প্রিয় এক জোড়া চোখ। বরাবরের মতই চোখ ভর্তি হাল্কা বিরক্তি। কবেই বা আমার দিকে প্রসন্ন হয়ে তাকিয়েছে ঐ চোখের মালিক। থতমত খেয়ে, ক্যাবলার মত হেসে জানতে চাইলাম, সব ভালো কি না। জানতাম উত্তরে ‘হ্যাঁ’ই আসবে। তারপর আর একটু হেসে ভিড়ে মিশে যাব আমি। যদিও মধ্যাহ্ন, তবুও বড়দিন তো বটে। আশেপাশে ক্রমেই জমে উঠেছে উৎসবমুখর রঙবেরঙের সুখী মানুষের ভিড়। ওই ভিড়েই হারিয়ে যাব আমি, মুখকে এবার কিছুতেই আর মনের আয়না হতে দেব না। 


প্রশ্নের উত্তরে ভেসে এল প্রশ্ন।  নাঃ আমি কেমন আছি, জানতে চাইল না সে। স্বভাবসিদ্ধ উদাসীন হয়তো বা সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবেই জানতে চাইল,‘একা?’  অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে জানালাম, দোকা আর পাই কোথায়? মেয়েটাকে বলেছিলাম বটে আসতে, এল না। তার চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে দারুণ ভয়। অথচ ছোটবেলায় কি ভালোই না বাসত চড়তে, বলত ‘মজার সিঁড়ি।’ বলতে বলতে ব্রেক কষলাম,বড় বেশি ব্যক্তগত কথা বলছি। সে তো জানতেও চায়নি। প্রশ্ন ছিল, আমি একা এসেছি কি না। জবাবে শুধু হ্যাঁ বলে দিলেই তো মিটে যেত। এতক্ষণে বাড়তে থাকা জনারণ্যে মিশে যেতাম আমি। তা নয়, কেন যে নিজেকে এত ছ্যাবলা প্রমাণ করি, বার-বার।  


‘কোন সিনেমা?’ জানতে চাইল সে। জবাব দিলাম। ‘এর টিকিট কাটতে হলে আসতে হয় নাকি? বাড়ি বসেই তো-’। বললাম, তা যায় বটে, তবে খামোখা কনভিনিয়েন্স ফি’র নামে অনেকটা টাকা কেটে নেয় ব্যাটারা। বলেই জিভ কাটলাম। কি আনস্মার্টের মত যে কথা বলি আমি। অন্য কিছুও তো বলা যেত। এত স্বচ্ছ হবার দরকারটাই বা কি? মেয়েরা যত  রহস্যময়ী হয়, ততোই বাড়ে তাদের আবেদন। আর  আমায় দেখো-। এতগুলি বছর কিছুই শেখাতে পারল না আমায়। শিখে উঠতে পারেলাম না কি করে বুনতে হয় আলোআঁধারি মায়াজাল। 


ওদিক থেকে অবশ্য ভেসে এল সমর্থনের সুর। ‘হ্যাঁ প্রায় একশ টাকা কাটল বটে।’ তারপর বেশ অনেকখানি নিস্তব্ধতা। শুধু বুকের মধ্যে বিষম যুদ্ধ। নির্বোধ হৃদয় চাইছে, খানিক থমকে দাঁড়াক না এ সময়। আরো কিছু বলুক সে, ফুসফুসে আর একটু ভরেনি তার সৌরভ। অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া মস্তিষ্ক বলছে, আবার কেন? 


একই সিনেমা দেখতে এসেছি দুজনে, নাঃ পাশাপাশি সিট পড়েনি। এটা তো আর সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। সবথেকে সস্তার টিকিট কেটেছি আমি, একদম সামনের রো এর পরের-পরেরটা। ‘ঠিক আছে’ বলে পিছন দিকে এগিয়ে গেল সে। হলের বাতি তখনও নেভেনি, অথচ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু। দম নিতেও চাপা কষ্ট। অঝোর গালি দিচ্ছে পোড় খাওয়া মাথা। বলেছিলাম না, এবার এই ব্যথা সারতে কে জানে লাগবে আরো কত-কত বছর। কি সব বিজ্ঞাপন চলছে পর্দা জুড়ে, বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। আলো নিভলে, উঠে যাব কি? 


আলো নেভার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল, ইশারায় বলল, পাশের সিটে যেতে। বোকার মত বললাম, এটা যাঁর সিট, তিনি যদি আসেন?  জবাব এল,‘এলে অন্য কোথাও বসবে। ম্যাটিনি শো, সবই তো ফাঁকা-’। 


আলো নিভল, বুকের ভেতর অকারণ বড় ছটফট করছে হৃদয়, মন বসাতে পারছি না একদম। কি যে হচ্ছে পর্দা জুড়ে। মন থেকে মনে কোন সিগন্যাল যায় কি না জানি না, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সে, ‘এটা পি আর মান সিং, ওদের ম্যানেজার, প্রায় ফাদার ফিগার ছিল গোটা টিমের কাছে।’ গল্প এগোচ্ছে, সাথে ফিসফিসানিও। গুলিয়ে ফেলছি, কোনটা কে। বলে দিচ্ছে সে, ‘এটা মদনলাল। ওটা কীর্তি আজাদ। মহিন্দর অমরনাথের বাবার রোলে খোদ মহিন্দর অমরনাথ।’ ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে মন আর মাথার দ্বৈরথ, ডুবে যাচ্ছি আমিও শৈশবের একরাশ স্মৃতিতে। সমবয়সী আমরা। ঘটনাপ্রবাহ যে সময়কার, তখন নিছক অবোধ শিশু আমরা। ক্রিকেট কি কিছুই বুঝতাম না কেউই। কিন্তু এই দিনগুলোর গল্প তো কম শুনিনি আমাদের বাবা-কাকা-জেঠাদের কাছে। 


উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে বলেই যাচ্ছে সে, ‘ একদম ক্লাইভ লয়েডের মত ভাবভঙ্গী।  হাঁটছেও অমনি সামান্য কুঁজো হয়ে। বকের মত। পুরো ভিভ রিচার্ডস্ এর মত করে ব্যাট চালাচ্ছে।’ গলায় ঝরে পড়ছে উত্তেজনা। আমী জানি লোকটার প্রাণের প্রতিটা তন্ত্রিতে মিশে আছে ক্রিকেট। বড় ভালো খেলত এককালে। তখনও ঘণ কৃষ্ণ কেশদামের ফাঁকে উকি মারেনি একটা দুটো কাশফুলের গোছা। জানি এখনও সুযোগ পেলে ইউটিউব খুলে পুরাণ ম্যাচের রেকর্ডিং দেখে লোকটা। লোকটার কাছে ভিভ রিচার্ডস নিছক ক্রিকেটার নন, ঈশ্বর স্বয়ং।  


ব্যাগের মধ্যে কেঁপে উঠল বেরসিক মুঠোফোন। বার করতে গেলাম, বিরক্ত হল সে।  ‘থাক না। ওটা থাক।’ পরক্ষণেই তরল হয়ে এল কণ্ঠস্বর, ‘এই ম্যাচটা কিন্তু ইণ্ডিয়া হারবে। পরেরটাও। ম্যালকম মার্শালের বল বেঙ্গসরকারের থোবড়া ভেঙে দেবে।’ থুতনিতে সত্যিই আঘাত পেল পর্দার বেঙ্গসরকার, বিবেকহীনের মত, বল থেকে টুসকি মেরে রক্ত ঝেড়ে ফেলল পর্দার মার্শাল। নিজের সিটে সটান হয়ে বসল সে, বলল, ‘ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের এমন ভিলেনের মত দেখাচ্ছে কেন? আসলে তো ওরা ভিলেন নয়। নিছক বিপক্ষ কেবল। যেটা দেখালো না, সেটা হল,পরের বলটা করতে গিয়ে মার্শাল দেখেছিল বলটায় খানিক মাংস আর রক্ত লেগে। দেখে ও মাঠেই বমি করে দিয়েছিল।’ বেশ বুঝতে পারি, মন আর মাথাকে ক্রমশঃ  ঘিরে ধরছে অপরিসীম মুগ্ধতার কুয়াশা।D


বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। এর পরের ম্যাচটা জিতবে তো? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাই আমি। ‘হ্যাঁ একদম। এরপরের ম্যাচেই তো জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।’ ৯রানে পড়ে যায় ৪ উইকেট। যদিও জানা ইতিহাস, তবুও ড্রাম বাজতে থাকে বুকের মধ্যে। অন্ধকারে কি করে বোঝে সে কে জানে, বলে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তারপর মদনলাল আর কিরমানিকে সঙ্গে নিয়ে বেদম পেটায় কপিল।’


দমবন্ধ  করা সুখ বড় স্বল্পস্থায়ী। জ্বলে ওঠে সিনেমা শেষের আলো। স্ক্রিনে তখন মুখ খুলেছেন আসল কপিল দেব। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠছে একের পর এক সাদাকালো ছবি। কেউ বসে দেখছে, কেউ বা উঠে ভিড় জমাচ্ছে এক্জিট লেখা দরজার সামনে। একদম ইচ্ছে করছে না উঠতে, নীরবে পর্দার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের জনও। তবুও উঠতেই হয়, একটু আগের দমবন্ধ করা সুখের মুহূর্ত গুলোকে স্মৃতিতে তালা বন্ধ করে ধরতেই হয় নিজের নিজের রাস্তা। R


হ্যাংলা মন শুধু চিৎকার করে ওঠে, 'আরও কিছুক্ষণ না হয় রইলে কাছে--'। শুনতে যে পেল না সেও বুঝলাম। মুখ বন্ধ ছিল যে। বড় সাহস বেড়ে গেছে মনের, আজ আর কিছুতেই থামতে দিতে চায় না কথার স্রোতকে। নিছক খেজুরে কথা বলার জন্যই বললাম,“ তোমার সেই ডাস্ট এলার্জি?সেরে গেছে বুঝি?” জবাবে ভ্রু কুঁচকে বলল,“কমোনি তো দেখছি এক ছটাকও। ” মোটা বলল বুঝি, রাগ হল না তো?হৃদয়ের বেদনা যেন কিছুটা উপশম হল, বললাম,“নাঃ কমিনি। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বরং বেড়েই গেছি। ” হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠল কি  ওষ্ঠ আর অধরের জটিল বিভঙ্গে? সুযোগ বুঝে বললাম,“একটা সেল্ফি?” বলল,“সেল্ফাইটিস্ টাও বেড়েছে দেখছি।” বলতে পারলাম না,“কয়েদ করে রাখতে চাই এই মুহূর্তটাকে। যেমন রেখেছি তোমার সঙ্গে কাটানো আরো অজস্র মুহূর্ত।" বলতে পারলাম না, একদলা কষ্ট কোথা থেকে এসে চেপে ধরল বুক আর গলা। ছলছলে চোখকে অন্যদিকে ঘোরালাম, ধরা পড়তে চাই না। কিছুতেই না। সূর্য কি পশ্চিমে ঢলে পড়ল খানিকটা? এবার যেতে হয় এবং যেতে দিতেও হবে। মন বলল,“ভালো থেকো। ” আর সে? সে বলল,“চলো তোমার ছবিটা তুলে নি”। হাসলাম দুজনেই। ক্যামেরার সামনে হাসতে হয় তো। শাটার বন্ধের সাথে সাথেই কি নেমে আসবে নিশ্ছিদ্র  অমানিশা?না কি সব নিয়ম ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে উল্টোদিকে দৌড়বে পৃথিবী?K

Wednesday 22 December 2021

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 


চেম্বারের দরজায় পর্দা লাগাতে চেয়েছিল সাপ্লায়ার ছেলেটি। ‘পর্দা লাগিয়ে নিন ম্যাম। নাহলে যে সে ঢুকে পড়বে। এখানকার সব অফিসারদের ঘরেই দরজায় পর্দা লাগানো।’ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছি। ইল্লি আর কি! একে তো ভাঁড়ে মা ভবাণী। টাকাপয়সার জন্য রীতিমত অ্যালুমিনিয়াম বাটি হাতে হেড আপিসে চক্কর কাটি আজকাল। ‘টাকা, নেই, টাকা চাই, টাকা কই’ করে মহানগরে এমনি রেপুটেশন বানিয়েছি যে, আমায় দেখলেই সেকশন ফাঁকা। হেড আপিসে ফাণ্ড অ্যালটমেন্ট ছাড়ে যে ছেলেটি, আগেরদিন বলেই ফেলল, ‘আপনাকে দেখলে আজকাল আমার হেবি ভয় লাগে ম্যাডাম।’ সুকন্যা সাক্ষী। একটুও বাড়িয়ে বলছি নেকো।


তবে টাকা না থাকার থেকেও বড় কথা হল, আমি চাই না মানুষ আমার চেম্বারে ঢুকতে ভয় পাক। এটা ল্যাবার দপ্তর। সমাজের একদম তলার দিকের মানুষদের নিয়ে আমাদের কাজ, তারাই যদি তাদের দাবীদাওয়া সুখবিসুখ না জানাতে পারে, কি লাভ অমন চেয়ারে বসে। এত বচ্ছরের লেবারগিরি একটা জিনিস শিখিয়েছে, যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। কেউ এটা ভেবে আসে না যে আমার হাতে সোনার কাঠি আছে, ছোঁয়াব আর সব মনোমত হয়ে যাবে। কি পারব, কতটুকু পারব, আদৌ পারব কি না, কেন পারব না বা কেন পারছি না খুলে বলে দিলে অনেকাংশে ঝামেলা মিটে যায়। অন্তত স্তিমিত তো হয় রে বাপু।


এই জ্ঞানের কথা শুনিয়ে, কাগজের কাপে আদা, গোলমরিচ আর বিটনুন দেওয়া একখানা পাঁচন মার্কা চা খাইয়ে আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর পার্থকে বললাম, তাহলে বুঝলে কি না? যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। চলো যোগাযোগ করি। এত গুলো বেনিফিট ছাড়ছ, যোগাযোগ না করে ছাড়বেই না কেন? যোগাযোগ করো বিধায়ক মশাইয়ের সাথে, বিডিও সাহেব যদিও প্রচণ্ড ব্যস্ত তবুও বলোই না তাঁকে একবার। বলো পঞ্চাযেত সমিতির সভাপতি, সহ সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতি তথা জেলা পরিষদের সদস্য, পঞ্চাযেত প্রধানদের। কোলাঘাট আমার সবথেকে বড় এলডব্লুএফসি। এই ব্লকের প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক।শুধু এই ব্লক থেকেই ১৫৭ জন নির্মাণ আর পরিবহন কর্মীকে পেনশন দিই আমরা। সবথেকে বেশি ডেথ কেস এবং ফাইনাল পেমেন্ট অর্থাৎ মেয়াদপূর্তিতে টাকা ফেরতের আবেদনও আসে এই ব্লক থেকে। এত কাজ করো, সেটা কেউ জানতেই পারে না। আর যেটা পারো না, সেটা নিয়েই উড়ে বেড়ায় অভিযোগের গরম বাতাস। 


আমার জ্ঞান না কালেক্টরেটের চায়ের গুণ জানি না, দারুণ ভালো একটা প্রোগ্রাম নামাল বটে আজ পার্থ, শুভদীপ্ত আর তাদের দলবল। ৩৩জন মৃত বেনিশিয়ারীর উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় ২২লাখ টাকার মৃত্যুকালীন অনুদান। জনা ৩০ কে দেওয়া হল মেয়াদপূর্তির টাকা। তবে আজকে আমাদের অনুষ্ঠানের স্টার যিনি ছিলেন, তাঁর নাম হল শেখ ইসমাইল। এই সেদিন অবধি বাস চালাতেন উনি। তখনই নাম লিখিয়েছিলেন আমাদের পরিবহন কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। ষাট বছর হবার পর আবেদন করেন পেনশনের জন্য। একটু সময় লেগেছে বটে, তবে যেদিন থেকে ওণার ষাট বছর হয়েছে সেইদিন থেকে ধরে আজ পর্যন্ত নিঁখুত ভাবে গণনা করে মোট সাড়ে তেত্রিশ হাজার টাকার পেনশন ঢুকেছে ওণার ঝুলিতে। প্রোগাম শেষে আমি স্বয়ং ওণার কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা চলুন তো, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি। আপনারাই হলেন আসল যোগাযোগ। আপনারা আছেন বলেই এই দপ্তরটাকে এত ভালোবাসি। ’ 


পার্থকে যে জ্ঞান দিয়েছিলাম,  তা বাকিদেরও খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলুম। সেগুলো শুনল বটে, মাথাও চুলকালো বেজায়, তারপর কোথায় সটকে পড়ল একে একে। ভাবছে আমি খেয়াল করিনি-।সবকটাকে চেপে ধরব, শুধু একবার ফাণ্ডটা ঢুকতে দিন।

Sunday 19 December 2021

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর, ২০২১

 

গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির  জন্মদিন। ভূতের  জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ। 

শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি। 

তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল। 

কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

 

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই তো সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল। 

যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো। 


সেই থেকে বিগত এগারো বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া। 

কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কাকে কষ্ট করে ঝিলের ধারের বাড়ি পড়ে শোনায় তুত্তুরী? তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয় কে? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও আব্দার করলেই খাইয়ে দেয় মাঝে মাঝে? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত মুখচাট টিফিন? মাসিই তো। 


মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? বাড়িতে কোন খাবার এলেই কে তার ভাগের খাবারটা নিয়ে দৌড়য় মাসিকে চাখাবে বলে? কে সুযোগ পেলেই মাসির স্মার্ট ফোনটা হাতিয়ে নেয় আর লাইক,কমেন্ট সাবস্ক্রাইব করে বেড়ায় যত পরিচিত জনের ইউটিউব ভিডিও আর চ্যানেল? তুত্তুরীই তো। কাজেই দাদা-দিদি,মাসএবং কাকারা, আপনারা যদি তুত্তুরীর পরিচিত হন এবং কাল আবিষ্কার করেন যে আপনার ভিডিওতে কমেন্ট করেছেন জনৈকা কনকলতা দত্ত তাহলে মোটেই হতবাক না কিন্তু। 


যাই হোক,মাসি আর মাসির সোনামা এর এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হল হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।

অনির ডাইরি ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


যবে থেকে তাম্রলিপ্তে বসতি পত্তন করেছি, জনে জনে শুধু ডেকেই গেছি। এসো না গো, দুদণ্ড জিরোতে। আমাদের সাথে হাসিমজার কটা মুহূর্ত কাটাতে। কে নেই সেই তালিকায়, উভয়ের আত্মীয়স্বজন, যৌথ বন্ধুবান্ধব, উভয়ের সার্ভিস তুতো দাদা-দিদি, ভাই-বনু। মোট কথা যাদের সাথেই সুর বা তালে মিলেছে, মিলেছে লয় এবং ছন্দে তাদেরই আহ্বান করেছি আমরা। আমরা না হয় নাই যেতে পারি মহানগর, মহানাগরিকরাই নাহয় একটু কষ্ট করে আসুক আমাদের কাছে। 


কি ভালো মাছ পাওয়া যায় এই জেলায়। রোজকার রুই-কাতলা-ভেটকিও স্বাদে অতুলনীয় হেথায়। অতিকায় পমফ্রেটই বলুন বা ছোট্ট ছোট্ট গুলি পাবদা স্বাদে যেন অমৃত। আর চিকেন? এখানে এক বিশেষ ধরণের চিকেন পাওয়া যায়, কাঁচা অবস্থায় দেখে রেড মিট বলে ভ্রম হয়। সোয়াদেও খাসির মাংসের মতই খেতে। স্থানীয়রা বলে লড়াই চিকেন। নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াব। এত প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও জনগণ আসে কই? আসে কেবল এষারা। এষা-অর্জুন আর কুট্টুস। একবার ডাকলেই চলে আসে। বেশ কিছুদিন না ডাকলে ছটফট করে। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মেসেজ করে আমাকে। সম্পর্কে শৌভিকেরই সার্ভিস তুতো বোন, কিন্তু দাদাকে হেব্বি ভয় পায়। যত আব্দার দিদির কাছে। সপ্তাহান্তে ওদের ফেলে যেখানেই যাই, এষার মেসেজ ঢোকে, ‘ কি ভালো ঘুরেছ। তোমরা আমাদের ভুলে গেছ দিদি-’। 


যখন এষা জ্বালায় না, তখন তাকে জ্বালাতন করে  তুত্তুরী। ভুলভাল ইংরেজিতে মেসেজ পাঠাতেই থাকে, অনুরোধ উপরোধ করে, ‘এসো না এষা পিসি।’ শুধু এসোই না, জলদি জলদি এসো। আপিসের কাজ ফেলে, দরকারে আপিসে তালা মেরে পালিয়ে এসো। শুধু যে উৎকট দাবী করে তাই নয়, এষাদের আসার ঢের আগে থেকে বাগানে পায়চারি করে । দূর থেকে কোন গাড়ির আওয়াজ এলেই ছুটে যায় গ্রীলের বড় গেটটার কাছে। উঁকিঝুঁকি মারে। অতঃপর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে বসার ঘরে বা ঢুঁ মারে বাবার বাংলো চেম্বারে। কর্মব্যস্ত শৌভিকের নজর এড়িয়ে তুলে নেয় বাবার বা আমার ফোন, তারপর ফিসফিস করে জানতে চায়,‘হ্যালো এষা পিসি বা অর্জুন পিসে, তুমি যে বলেছিলে চারটের মধ্যে অফিস থেকে বেরোবে? সাড়ে ছটা বেজে গেল তো!’ 


শেষ পর্যন্ত এষাদের গাড়িটা যখন হর্ন বাজিয়ে এসে থামে তাম্রলিপ্তের মহকুমার শাসকের সরকারী আবাসের সামনে, এদিকে হুড়মুড় করে ছুটে যায় শ্রীমতী তুত্তুরী আর ওদিক থেকে নামানো কাঁচের ফাঁক গলে বেরিয়ে ছুটে আসতে চায় শ্রীমান কুট্টুস। আতঙ্কে যত চেপে ধরে এষা, যত ধমকায় অর্জুন ততো লম্ফঝম্ফ বাড়ে দুই এবং চারপেয়ে দুই ভাইবোনের। শৌভিক বিরস বদনে মন্তব্য করে, ‘এষা বুঝতে পারছ তো,  আসলে কার প্রতীক্ষায় বসেছিল এতক্ষণ। ’ 


আট বছরের  তুত্তুরীর সাথে যখন প্রথম মোলাকাৎ হয়েছিল কুট্টুস বাবুর তখন আমাদের হিসেবে ওর বয়স ছিল কয়েক মাস মাত্র।  আর ওদের হিসেবে চার বা পাঁচ বছর। আমাদের এক বছর সমান ওদের ছয় বছর, এই তত্ত্ব সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম। সেদিন থেকেই  তুত্তুরী দিদি আর কুট্টুস ভাই। তারপর বিগত দুবছরে বেড়ে উঠে কুট্টুস এখন বছর আঠারোর তরতাজা যুবক। দিদি সেটা মানলে তো। এখনও দিদির মতোই খবরদারি করে। ধমকায়। কথা না শুনলে বা দুষ্টুমি করলে নালিশ করে, কখনও কখনও গর্হিত অপরাধ যেমন লুকিয়ে প্লাস্টিকের ফুল চিবোলে বা একপেট মাংস আর সেরেলাক খেয়েও হ্যাংলার মত রান্নাঘরের ময়লার বালতি হাঁটকে মাংসের হাড় চিবোলে চোরাগোপ্তা কষিয়েও দেয় দুটো থাপ্পড়। কুট্টুসও কামড়ে দেয় কুটকুট করে। আবার ঝগড়া ঝাঁটি করে,ওকে ফেলে তুত্তুরী চলে গেলেও তীব্র হল্লা জুড়ে দেয় কুট্টুস।


অবিকল মানুষের ছানার মত খেলা করে দোঁহে। ছুটোছুটি-হুটোপাটি-লাফালাফি-নাচানাচি তো বটেই এমনকি স্লিপওভার-স্লিপওভারও খেলে দুজনে। সেটা কি খেলা প্লিজ আমায় জিজ্ঞাসা করবেন না। অনেকক্ষণ মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কি করছে সে, দেখি ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে তুত্তুরী। পাশের বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে কুট্টুস। তাকে কিসব সাপব্যাঙ গল্প শোনাচ্ছে তুত্তুরী, জবাবে চোখ পিটপিট করছে,হাই তুলছে আর মাঝেমাঝে খরখরে জিভটা দিয়ে দিদির মুখটা চেটে সাফ করে দিচ্ছে কুট্টু বাবু। আমি ঢুকতেই ধড়মড় করে খাটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল কুট্টুস। আর ‘মাআআআআআ  তুমি ওকে তুলে দিলে’ বলে প্রবল শোরগোল জুড়ে দিল তুত্তুরী। 


এষারা রাতে থেকে গেলে, ঘুমায়ও দুজনে একসাথে। আগের বার আলাদাই শুয়েছিল দুজনে। দিব্যি মানুষ বাবা-মার মাঝে চার হাতপা তুলে ঘুমিয়েও পড়েছিল কুট্টুস। তারপরই কি যে হল, লাফিয়ে খাট থেকে নেমে দরজা আঁচড়াতে লাগল কুট্টুস। মাঝরাতের ন্যাকামো বলে বেশ খানিকক্ষণ পাত্তা দিল না এষা আর অর্জুন, তখন করুণ সুরে কাঁদতে লাগল কুট্টুস। পেট ব্যথা বা অন্য সমস্যা হচ্ছে ভেবে যেই খোলা হল ঘরের দরজা, ওমনি এক ছুটে তুত্তুরী দিদির ঘরে। সোজা খাটে উঠে, পিছন দিয়ে তুত্তুরী দিদিকে ঠেলে- তার বালিশটা দখল করে গুটিসুটি মেরে শুল। তুত্তুরী তো হেসেই খুন, এষা আর অর্জুন  কোমরে হাত দিয়ে বকেই চলেছে, কি নাটুকে ছানা রে তুই। মাঝরাতে আর কত ঢঙ করবি। 


ঢঙই তো। দিব্যি নদীর ধারে পোজ দিয়ে বসেছিল অর্জুনের সাথে। গোটা দুয়েক ওদের ছবি তোলার পর, তুত্তুরীকে বলা হল, তুই ওর পাশে গিয়ে বস। একসাথে তিনটের ছবি তুলবে বাবা। ওমা তুত্তুরী যেই উবু হয়ে বসল, প্রথমে  তার দিকে একবার তাকাল, তারপর সটান হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরল কুট্টুস। যেন ডাকছে, একটু আমার দিকেও তাকা দিদি। তাকাবে কি, দিদি তো হেসেই খুন।

অনির ডাইরি ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২১

 


রূপনারায়ণ নদে তখন পূর্ণ জোয়ার। আমরা চলেছি স্রোতের বিপরীতে, মাঝ নদী বরাবর। ঘড়ি বলছে সময় ঠিক মধ্যাহ্ন, শেষ ডিসেম্বরের রেশমী রোদ মোটেই গা জ্বালানো নয়। বরং বেশ মনোরম।উত্তুরে বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফোলানো স্পিড বোটে নৌকা বিহারে বেরিয়েছি আমরা।  নদীর বিপরীত দিকে হাওড়া জেলার তটভূমি আপাততঃ হাল্কা কুয়াশার চাদরে মোড়া। মুছে যাওয়া তটভূমির জন্যই কেন জানি না, বেশ সমুদ্দুর মার্কা একটা অনুভূতি হচ্ছিল আমাদের। 


বলাতে শৌভিক বলল, কিছুদিন আগে কারা যেন এমনিই বোটে চড়ে সমুদ্রে গিয়েছিল, সমুদ্রের তিন চার কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে আচমকা খারাপ হয়ে যায় বোট। পাক্কা দেড় ঘন্টা তারা, চড়া রোদে মাঝ সমুদ্রে বসেছিল ওমনি খারাপ হয়ে যাওয়া বোটে। এক্কেবারে হিচকক সাহেবের 'লাইফবোট' এর মত কেস আর কি। 


বলতে না বলতেই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বোট খানা। খুব এক চোট দাঁত কিড়মিড় করলাম আমি, কোন সময় কোন কথাটা বলতে নেই, সেটাও জানে না মাইরি। তারপর আর কি, বিস্তর খোঁচাখুঁচি, টানা হ্যাজরা এবং হে ঠাকুর এবারের মত তরিয়ে দাও প্রভু।  আমাদের দেরী দেখে অনেকটা এগিয়েও পিছিয়ে এল আরেকটা বোট। তবে খুব কাছে এলো না। মোচার খোলার মত ফোলানো বোট কি না, চলমান বোটের ঢেউ এর ধাক্কায় না হলে উল্টে যাবে যে। 


আমরা সাকুল্যে নয় জন। পাঁচটা লেবার, একটা এক্সিকিউটিভ আর তিনটে ছানা। এত লোক তো আর একটা ফোলানো বোটে ধরে না, তাই ভাগ করে উঠেছি আমরা। আমাদের বোটটা ছাড়ার সময় ও বেগড়বাই করছিল। বন্যার পর থেকে গুদামজাত হয়ে পড়ে থেকে নাকি কি একটা সুইচ বসে গেছে। একটা পিন বা পেরেক না পেলে তাকে তোলা যাচ্ছিল না। বিরক্ত হয়ে শৌভিক বলল, 'এই মনোরঞ্জন তোমার রিভলভারটা এনেছ?' মনোরঞ্জন ওরফে মনা হল মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তাঁর পকেটে সবসময়ই একখানা  বন্দুক আর গাড়িতে দুখানা জবরদস্ত লাঠি থাকে বটে। 


মনা তো হেসেই অস্থির। আমরা সমস্বরে হাঁ হাঁ করে উঠলাম, কাকে গুলি করবে? বোটটাকে? দুই বোটম্যান তড়িঘড়ি বলে উঠল, 'গুলি করলে আর চলবেই নি স্যার।' যাই হোক তখন মোনার বন্দুকের ভয়ে দৌড়েছিল বটে, এখন এই মাঝ দরিয়ায় তো আর  মনা নেই। তাহলে কি হবে? বাড়ি ফিরব কি করে? বোট চালকদের অবশ্যি কোন হেলদোল নেই। ওরা জলের বোতল আর কেকের প্যাকেট নিয়েই উঠেছে। আবার শুরু করল টানাটানি। 


কান টানলে মাথা আসার মত, বিস্তর টানাটানির পর অবশেষে ছুটতে শুরু করলেন তিনি। এবার আবার স্রোতের বিপরীতে এমন জোরে ছুটতে লাগলেন যে রীতিমত ঢেউয়ের তালে উঠতে এবং নামতে লাগলাম আমরা। জলের ছিটেয় অর্ধেক ভিজেই গেলাম বিদিশা দি আর আমি। আর তুত্তুরী বলল, 'উফঃ কি গদাগুম রাইড হচ্ছে মাইরি। বাড়ি ফিরেই দাদুকে বলব-'।