Monday 8 November 2021

অনির ডাইরি ৮ই নভেম্বর ২০১৮


কি কুক্ষণে বলেছিলাম,“ ঘুমিয়ে পড় বাবু, তাহলে বিকালে তোকে ভূত সাজিয়ে দেব। ”“দেবে মা?সত্যি দেবে?” বাপের বাড়ি,মায়ের আদর আর অখণ্ড বিশ্রামের আমেজে তখন ভারি হয়ে এসেছে চোখের পাতা,বললাম,হ্যাঁ দেবোই তো। অবশ্যই দেব। এরপর শুরু হল প্রশ্নবান,কাকে ভয় দেখাবো? কি ভাবে ভয় দেখাবো?কি পরব? ভূতেরা কি জামাকাপড় পরে? কেনে কোথা থেকে?বানায় কে? ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, বাপের জন্মেও কোন হিন্দি ইংরেজি বা বাংলা সিনেমায় উলঙ্গ ভূত দেখিনি। বরং হিন্দি “লাশ কা মাউন্টেন,খুন কা ফাউন্টেন” মার্কা সিনেমায় বরাবার দেখেছি,যে উদ্ভিন্ন যৌবনা যুবতী সর্বপ্রথম বস্ত্র উন্মোচন করতে উদ্যোগী হয়, ভয়াল আওয়াজ সহ ভূত বাবাজী প্রথমেই তার ঘাড় মটকায়। হুঁ হুঁ বাবা। ভূত অত্যন্ত সংস্কারী। 

এরপর প্রশ্ন তাহলে আমি কি পরব?মামমামের শাড়ি না দাদুর লুঙ্গি?“লুঙ্গি পরা ভূত” কেমন হয় ঘুম চোখে ভাবতে গিয়ে গেল ঘুম চটকে। যদি ভয় দেখাতে গিয়ে ইয়ে লুঙ্গি খুলে টুলে যায়-। তাহলে শাড়িই ভালো। সূর্য  পশ্চিমাকাশে মুখ লুকানোর সাথে সাথে প্রবল বায়না,“দাও। দাও। এখুনি ভূত সাজিয়ে দাও। দাদু আর দিদি(অর্থাৎ আমার পিসিকে) ভয় দেখাব। ” খুঁজে পেতে মায়ের পুরানো সাদা শাড়ি যোগাড় হল। তুত্তুরীর ধারণা ভূতেরা মাত্রই বিধবা। সিনেমায় তো সাদা শাড়ি পরে। এই শাড়িতে যদিও লালের আধিক্য প্রকট। অগত্যা পেত্নী আর শাঁখচু্ন্নির থিয়োরী বোঝালাম। জিন্সের প্যান্ট আর গোলাপী লাভ লেখা টিশার্টের ওপর গিঁট দিয়ে পরানো হল শাড়ি। এবার মেকআপ করে দাও মা। লাল লিপস্টিক ভূতভূতে করে ঠোঁটে মেখে রক্ত সিঞ্চিত ওষ্ঠাধর হল। সাধের কাজল পেন্সিলটিকে দিয়ে চোখে কালি ফেলাতে গিয়ে সেটি মট করে ভাঙল। ইত্যাদি প্রভৃতির পর দুহাত দিয়ে মাথার চুল ঘেঁটে একগলা ঘোমটা দিয়ে তু্ত্তুরী গেল সবাইকে ভয় দেখাতে। শুধু হাঁউমাউখাঁউ করে তেমন জমল না। তখন গল্প ফাঁদল,“আঁমি ১৬৯৯সাঁলে জঁন্মেছি। আঁমায় ইঁংরেজরা পুঁড়িয়ে মেঁরেছিল।” কমবেশী সবাই ভয় পেল শুধু বাবাকে যখন ভিডিও কল করা হল, বাবা বলল,“এত সাজগোজের কি দরকার ছিল?এমনিতেই তো ভূতের ছানা-”। ভিডিও কলে ঠিক ভয় দেখানো জমে না,কি বলেন?

Saturday 6 November 2021

আমাদের কথা

আমাদের কথা ১০ই জুন,২০২২


👨🏻-(  কাঁধে টোকা মেরে, নিপাট ভালোমানুষের ঢঙে) একটা মশা কিন্তু আছে। 

👩🏻- (মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে)আচ্ছা। 

👨🏻-(কিয়ৎক্ষণ পর,পুনরায় টোকা মেরে) ওটা কিন্তু কামড়াবে। 

👩🏻- (অন্যমনস্ক ভাবে) আচ্ছা। 

👨🏻-(আবার টোকা দিয়ে) আমাকে কামড়াতে এলে, আমি কিন্তু তোকে দেখিয়ে দেব। 

👩🏻-(বিরক্ত হয়ে মোবাইল বন্ধ করে,তার দিকে ফিরে) তাই দিস। তাইই দিস। মশার কামড় আমার দিব্যি সহ্য হয়,কিন্তু মাঝ রাতে আলো জ্বেলে মশা মারার নামে,‘হাইয়া’করে চিৎকার আর চড় থাপ্পড় খাওয়াটা জাস্ট অসহ্য।


আমাদের কথা ২০শে এপ্রিল, ২০২২


👩🏻-"হ্যাঁ গো, সালোয়ার পরব না শাড়ি?"

👨🏻-( চশমার ওপারে একজোড়া নির্বিকার চোখ, এক পলকের দৃষ্টি বিনিময় করে ডুবে গেল ফোনে।) ঝাঁকানো কাঁধ বার্তা বয়ে আনল, যা খুশি। 


👩🏻-"পরপর দুদিন সালোয়ার পরেছি, আজ বরং শাড়িই পরি নাকি? তবে যা গরম-।"


👨🏻-আপিসের জন্য দ্রুত  প্রস্তুত হওয়া দোলচালহীন কণ্ঠ জানাল,‘ তা বটে।’ 


👩🏻- (গোটা তিনেক শাড়ি বেরোল আলমারি থেকে, আনুসাঙ্গিক শায়া-ব্লাউজ সমেত। অতঃপর- )

‘এই শাড়িটা আর পছন্দ হচ্ছে না। এটা পরব না থাক। ওটা পরি। আচ্ছা ঐ শাড়িটার সঙ্গে এই ব্লাউজটা চলবে-’। 

👨🏻-(এতক্ষণের নির্বিকার চোখে এবার নামল তীব্র আতঙ্কের ছায়া, কোনমতে ঘাড় নেড়ে বলল,)‘হ্যাঁ।  হ্যাঁ। খুব চলবে। চালালেই চলবে-’।

👩🏻- (আরো কয়েকমিনিট উদ্দিষ্ট শাড়ি এবং ব্লাউজকে পর্যবেক্ষণ পূর্বক,) ‘নাঃ চলবে না। তোমায় প্রশ্ন করাই ভুল হয়েছে। তুমি কিছুই দেখো না। ভালো করে দেখো, ঐ শাড়িটার সঙ্গে ঐ ব্লাউজটা চলবে কিনা। আর এই হারটা কেমন মানাবে-’। 


👨🏻-(কয়েক গ্যালন কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন পূর্বক, মিনতি করে) ‘ আমাকে ছেড়ে দে না। আমি এসব বুঝি না। তুই বরং আমার শ্বশুরটাকে ফোন কর, কেমন? সে ঠিক বলে দেবে-’। 

👩🏻- নাঃ নিজের বাপকে খামোখা আর বিরক্ত না করে, নিজের মর্জি মোতাবেক তৈরি হয়ে বললাম,‘একটা ছবি তুলে দে অন্তত-’। উপরোধে ঢেঁকি গেলার মত গোটা কয়েক তুলে দিল বটে, সবকটা অখাদ্য। অতঃপর ফোনটা হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া গত্যম্তর ছিল না। 


👨🏻-গোটা দুই তুলেছি কি তুলিনি,নীচে থেকে প্রথমে হুঙ্কার,তরপর অনুনয় বিনয় ‘ফোন দে। ফোনটা দে রে বাবা-। অফিস টফিস যেতে হবে তো নাকি? তুইও যা কেমন। আপিসটা করে আয়, বিকেলে ল্যাবেঞ্চুষ পাবি। এখন ফোনটা- ’। 


প্রসঙ্গত: শাড়িটার বয়স দুদশকেরও বেশি। কার যেন বিয়েতে পাওয়া উপহার, ভাগ্যে মা যত্ন করে তুলে রেখেছিল। এটা আর বললাম না, ওমন লক্ষ্মীস্বরূপা গুছানো মায়ের এমন অলবড্ডে,অগোছাল মেয়ে সংক্রান্ত ভাষণ এই আপিস টাইমে শোনার থেকে ফোনটা ফেরত দিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল।

 আমাদের কথা,  ২রা নভেম্বর, ২০২১

👨🏻- আলোটা নেভা। 

👩🏻-দাঁড়া আজ ধনতেরাস, একটু সোনা কিনব। সবাই কিনছে আর ছবি দিচ্ছে। 

👨🏻-না। একদম নয়। রাত বারোটা বেজে গেছে। ধনতেরাস শেষ। এবার ভূতচরাস।

👩🏻- (লোভী সুরে) এই হারটা কিনে দিবি? পিসি চন্দ্র। বেশী নয়, মাত্র আটষট্টি হাজার টাকা বলছে অ্যামাজন। 

👨🏻-একদমই দেব না। আজ ধনতেরাস বলে সোনা চাইছিস, কাল ভূত চতুর্দশী, বলবি দুটো ভূত কিনে দে।

অনির ডাইরি ৬ই নভেম্বর, ২০২১

 

কি যে হইচই হত ভাইফোঁটার সকালগুলোয়। পুরো গমগম করত ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। হবে নাই বা কেন, বাবারা তিন ভাই, পাঁচ বোন। উপরি পাওনা হিসেবে মাঝেমাঝেই এসে উপস্থিত হতেন বাবলু পিসি, সম্পর্কে বাবাদের পিসতুতো দিদি। সাবেকী ঠাকুর ঘরে,তিনটি আসন পেতে, পিতলের লম্বা পিলসুজের ওপর রাখা মস্ত প্রদীপের কাঁপা আলোকে পরপর বসত জেঠু, বাবা আর ছোটকাকু। একে একে ফোঁটা দিত বড়পিসি, বাবলুপিসি, মেজো পিসি(যাঁকে আমরা তিন প্রজন্ম ধরে দিদি বলে ডেকে আসছি) আর অন্যান্য পিসিরা। এত মিষ্টি পেত বাবারা যে ছোটখাট একটা মিষ্টির দোকান দেওয়াই যেত বোধহয়। সাতদিন ধরে ঘুরতে ফিরতে মুখ চালিয়েও শেষ হত না সব।  


তারপর যা হয় আর কি, বয়ে যায় সময়ের নদী। টুপটাপ করে ঝরে যায় প্রিয় সম্পর্কগুলি। ১৯৮৯ সালে চলে গেল বাবলু পিসি। ২০০৬এ বড়পিসি। ২০১২ এ ছোটকাকু। ২০১৫য় বড় জেঠু। বাকি সম্পর্কগুলিতেও লাগল জরার ছোঁয়া। সবাই কেমন যেন ছিটকে গেল আরোও আরোও দূরে। পড়ে রইল কেবল মেজো পিসি আর বাবা।


কিছু সম্পর্কে বোধহয় হাত দেবার সাহস পায় না সময়, তাই তো কয়েক মাস কম ৮২ বছরের ছোট ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেবার জন্য আজও একই রকম ব্যগ্র আমার ৮৭ বছরের বৃদ্ধ পিসি। টুকটুক করে জমানো পয়সা নিয়ে খোদ গিয়েছিল মিষ্টি কিনতে। ভুল লিখলাম,পিসি অনুরোধ করেছিল আমায়। তখনও আসেনি কোজাগরী পূর্ণিমা, ব্যাগ গুছিয়ে তাম্রলিপ্ত যাবার তোড়জোর করছি আমি, পিসি ফিসফিস করে বলল,  ‘শোন না, ভাইফোঁটায় আসবি তো? আমার জন্য তিনটে প্যাকেট কিনে আনিস তো। একটা একটু বড়, আর দুটো একটু ছোট। টাকাটা নিতে হবে কিন্তু। ’ বুঝলাম বড় প্যাকেটটা আমার বাবার আর ছোট দুটো ছিমান বুল্লু কুমার আর ছিমতী তুত্তুরীর। কথা দিয়েছিলাম অবশ্যই কিনে আনব। 


কাল তাম্রলিপ্ত থেকে এক পক্ষকাল পর নিজের শহরে ফেরার পর খেয়াল হল,পিসির অনুরোধ আমি বেমালুম ভুলে এবং গুলে খেয়ে নিয়েছি। কি হবে এবার? অগতির গতি আমার খুড়তুতো ভাই শ্রীমান অয়ন কুমার চাটুজ্জে।  তিনি বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র কিনা, তিনি আশ্বাস দিলেন, ‘কুচ পরোয়া নেই। আমি কিনে আনছি। ’ কিন্তু গোঁ ধরল পিসি, তিনিও যাবেন।  অগত্যা, দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপন অন্তে পিসি ভাইপো রওণা দিল মিষ্টি কিনতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে মোড়ের মাথা, সেখান থেকে টোটোয় চেপে কদমতলা বাজার। বাইকে চড়তে যে মোটেই চায় না পিসি। 


আর আমি, ভরদুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে, বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগলাম,‘ হে ধরণী, দয়া করে দ্বিধা হও মা। ’ নিজের অপদার্থতা সম্পর্কে বরাবরই আমি সন্দেহহীন, তবে এবারের অপরাধটা একেবারে অমার্জনীয় যাকে বলে। 


ভাগ্যে পিসি ভুলে মেরেছে, এমন কোন অনুরোধ করেছিল,তাই রক্ষে। মা হলে নির্ঘাত আর মুখ দেখত না আমার। এক ডজন কথা ইতিমধ্যেই শুনিয়ে দিয়েছে তাও।  বিকাল চারটের সময় মস্ত লাইন দিয়ে বিরাট বাক্স করে মনপসন্দ মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরল পিসি। 


রাত পোহাতেই, স্নান সেরে, বুড়ো হাড়ে কাঁপতে কাঁপতে কাচা শাড়ি পরে, প্লেট সাজিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নেমে, শ্যাওলা ধরা উঠোনের একফালি পেরিয়ে, মস্ত লাল রোয়াক ধরে হেঁটে এসে বাবার শরিকি বসার ঘরে। ফোঁটা মিটলে বললাম, চল দুই ভাইবোনের একটা ছবি তুলে দিই। এমন সম্পর্ক যে বড় বিরল আজকের দিনে। বড় ভাগ্যবান এরা, হয়তো টাকাপয়সা, সোনা দানা, ব্যাংক ব্যালেন্স কিছুই নেই দুজনের তবুও এমন ভাগ্য, এত ভালোবাসা কজন পায় আর কজনই বা দিতে পারে। খুব ভালো থেকো দিদি আর বাবা, তোমারই আমাদের আদর্শ। তোমরাই তো শিখিয়েছ, অন্তে সব হিসেব মিলেই যায়, আর যা মেলে না, ভুল আছে সেই অংকটাতেই। #ভাইফোঁটারগপ্প

Sunday 31 October 2021

অনির ডাইরি ২৫শে অক্টোবর, ২০২১

 

আমরা যারা সরকারী চাকরি করি, পরিযায়ী পাখির মত বাঁচি, তাদের বদলীর সময় এলেই দুটি চিন্তা ভ্রমরের মত গুঞ্জরিত হয় মাথায়, প্রথমতঃ অবশ্যই আমার কোথায় হবে আর দ্বিতীয়তঃ আমার  জায়গায় কে আসবে? কার হাতে তুলে দিয়ে যাব আমার দলবলকে, কেমন মানুষ সে? যখন দুটি প্রশ্নের উত্তরই হয় মনোমত তখন আর চিন্তা কি? 


একে তো যেখানে যাচ্ছি, চেয়ে চিন্তেই যাচ্ছি, তারওপর উত্তরসুরি আবার পরম সুহৃদ। ফলতঃ 'আমার মত সুখী কে আছে'?অন্তত আজকের দিনটায়। বাকি থাকে কেবল বড়দি, অর্থাৎ উপরওয়ালীর মৌখিক সম্মতি। এমনিতে বড়দি নির্ঝঞ্ঝাট, প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ম্যাডাম আর আপনি বলে সম্বোধন করলেই ঠ্যাঙাবেন। যেমন দিদিগিরি চলত, তেমনিই যেন চলে। তা এহেন বড়দি যদি অনুমতি দেন তো 'রইল ঝোলা, চলল ভোলা' করে গুটি গুটি রওণা দিই আর কি। বড়দি যে খুব একটা খুশি খুশি, ‘ আচ্ছা তাহলে পাততাড়ি গুটাও’ বললেন তাও না, বরং মৃদু অনুযোগের সুরেই বললেন,‘ এত তাড়া কিসের তোমার?’ বলবেন নাই বা কেন, একই অর্ডারে নাম ছেপে বের হওয়া কেউই যে এখনও অব্যাহতি পায়নি দায়ভার থেকে


শেষ পর্যন্ত অবশ্য বড়দিকে পটিয়ে, কাগজপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলাম, বেশ একটা,‘ পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই, সবারে আমি প্রণাম করে যাই’ মার্কা ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম সোমবারটা। মাঝখান থেকে ত্রিপাক্ষিক এগ্রিমেন্টটাও সই হয়ে গেল মালিক আর শ্রমিকপক্ষের মধ্যে। সব পক্ষের আনা মিষ্টির বন্যা বয়ে গেল আপিসে। মাথা পিছু তিন চারখানা মিষ্টি সাঁটিয়েও শেষ হল না। ধীমান বিরক্ত হয়ে বলল,‘ এই বাক্সটা বাড়ি নিয়ে যান। আর কেউ খেতে চাইছে না। ’  


মেশিন বন্ধ করে উঠতে যাচ্ছি, কৌশিক বলল,‘ ম্যাডাম একটু সার্কিট হাউসটা যদি-’। বুক করাব? কেন? কেউ থাকবে নাকি রাতে? ঘাড় মাথা চুলকে যা বলল, বুঝলাম সার্কিট হাউসের মিটিং হলে ফেয়ারওয়েল দিতে চায় ওরা আমায়। ধীমান এমনিতেই খবর নিয়ে এসেছে, ফাঁকাই আছে মিটিং হলখানা।  নাজিরের সাথে কথা বলে হাতে লিখেও দিয়ে এসেছে, শুধু একটা চিঠি যদি করে দি, আরো পোক্ত হয় ব্যাপারটা।  নিজের ফেয়ারওয়েলের জন্য নিজেই চিঠি করলাম, একটু নজ্জা নজ্জা করছিল যদিও। 


বাড়ি ফিরছি, সঞ্চিতার ফোন, ‘টিফিন আনবেন না। লাঞ্চের সামান্য ব্যবস্থা করেছি আমরা।তুত্তুরীকে অবশ্যই আনবেন। ওকেও ধরা হয়েছে-। ’ লজ্জায় আর বলতে পারলাম না, ওকে তো আনতেই হবে। প্রথমতঃ আমার বদলীর খবর আসা ইস্তক চুঁচুড়া আর তার মানুষগুলোর জন্য বিলাপ করে চলেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বিগত পাঁচ বছরে বেশ অনেক বারই এসেছে কিনা, পিকনিক থেকে মেলা সবেতেই উপস্থিত ছিলেন তিনি। প্রথম দিকে রমেশ আর প্রীতিই ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু, এখন আরো অনেকের সাথে দোস্তি হয়েছে তাঁর। আমার সাথে সাথে এই মানুষগুলোকে বিদায় জানাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁরও।  


তবে শুধু এই জন্যই নয়, তুত্তুরীকে আনব, কারণ তেমনিই মানত করেছিলাম দেবী হংসেশ্বরীর কাছে। মানত করেছিলাম সেই বিগত জানুয়ারীতে। তারপর আর সেই মানত পুরো করা হয়ে ওঠেনি। এমনিই হয় আমার। প্রতিবছর মেলার আগে মানত করি, ঘাড় ধরে যখন বাঁশবেড়িয়াতেই টেনে আনো বারবার, তখন নির্বিঘ্নে মেলা মেটানোর দায় আমার পাশাপাশি তোমারও। তুমি এইবারটি করে দাও, তারপরই আমি এসে পুজো দিয়ে যাব। বলি বটে, তবে পুজো দিতে দিতে এসে পড়ে পরের বছরের মেলা। বাঁধে তুমুল গণ্ডগোল,দেখাদেয় উটকো সমস্যা, কিছুই হয় না ঠিকঠাক। তখন মনে পড়ে,হায় মা, তোর পুজোটা তো বাকি রয়ে গেছে। আসছি মা, আসছি, আর সমস্যা সৃষ্টি করিস না। অতঃপর চূড়ান্ত ব্যস্ত নির্মলকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাই মন্দির, চল বাবা চল। মিষ্টি ফুল যা যা লাগবে যোগাড় করে পুজো দিই। নাহলে তোর আর আমার মাথাটাই খারাপ করে দেবেন এই নীলবর্ণা ভদ্রমহিলা থুড়ি দেবী। 


২০২১এর মেলায় জনৈক রাজনৈতিক দল এমন সমস্যা করছিল বলার নয়।ডেপুটেশন, মেলার বাইরে কালো পোস্টার, টুকটাক হুমকি। তারওপর অরাজনৈতিক একচোট মারামারি, জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভিআইপি টিফিনে তুলতুলে খাসির মাংসের আব্দার- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগলই হয়ে যাব। দুচারটে লোককে কামড়ে দিলে যদি মেটে কিছু সমস্যা। একমুঠো বাজেটে খাওয়াব কি আর সাজাব কি? নিজেদের খাবার বলতেই তো ডিম ভাত, তৎকালীন বড়সাহেব বলেছিলেন দুটো ডিম যদি দেওয়া যায়, ওসি ফুড চঞ্চল হাত জোড় করে মার্জনা চেয়েছিল। ভিআইপি প্যাকেট নিয়ে স্যার-চঞ্চল-কেটারার আর আমি রীতিমত গবেষণা করেছিলাম সবথেকে সস্তায় সবথেকে বড় প্যাকেট কি হতে পারে, যা নাড়াচাড়া হলে ঠং ঠং করবে না। সেখানে খাসি আনব কোথা থেকে? তা যাও বা ম্যানেজ হল, এল নতুন ফর্মান, গান শোনাতে হবে। আমায় নয়, কোন ভাড়া করা সুগায়িকাকে দিয়ে। 


আধপাগল  থেকে পৌনেপাগল হয়ে মনে পড়ল, যাঃ বিগত বছরের পুজোটা তো রয়ে গেছে বাকি। বিশ্বাস করবেন না, পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই কি ভাবে যেন মিটে গেল সমস্যা গুলো। ঝামেলা বাঁধানো রাজনৈতিক দলের জনৈক নেতা, স্বয়ং ফোন করে আশ্বস্ত করলেন,‘ আমাদের নিয়ে একদম টেনশন করবেন না। এটা রাজ্যব্যাপী কর্মসূচী, আমাদের তাই করতেই হবে। তবে এই আপিসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এত ভালো, গেলে আপনারা বসান, চা খাওয়ান। দাবীদাওয়া শোনেন, দরকারে কলকাতায় পাঠান লোকজনকে তত্বাবধান করতে। আপনাদের কোন ভাবে বিপদে বা অস্বস্তিতে ফেলব না আমরা। ’ অতঃপর তিনি বিশদে জানালেন, কোথায় জমায়েত হবেন তাঁরা, কোথা থেকে রওণা হবে ডেপুটেশনের মিছিল। এজেন্ডা কি ইত্যাদি। এবং পরিশেষে কোথায় তাঁদের আটকালে বাঁচবে তাঁদের মুখ আর আমাদের মেলা। অমুক বাবু, আমি জানি আপনি স্বনামে ফেসবুকে নেই, কিন্তু এটাও জানি আমাদের যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার শ্যেন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন আপনারা। কথাপ্রসঙ্গে দু চারটে লোপ্পা বল আপনি বা আপনার দলবল স্বয়ং তুলে দিয়েছিল আমার হাতে। মুস্কিল হল, আমাকে দেখে যতটা গাম্বাট হোঁদলু মনে হয়, আসলে ততোটা নই। যাই হোক, এটাও নির্ঘাত অচীরেই আপনার দৃষ্টিগোচর হবে, তাই আগেভাগেই  বলে রাখি, বিশ্বাস করুন, আপনার সেদিনের উপকার আমি জীবনে ভুলব না। আর একটা কথা আপনার নাম আমি আমার বর( যিনি আমার কোন বক্তব্যই হয় কান দিয়ে শোনেন না অথবা শুনলেও অন্য কান দিয়ে বার করে দেন) ছাড়া আর কারো কাছে আজ অবধি প্রকাশ করিনি। এমনকি বড়সাহেবের কাছেও নয়। সবাই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল আমার তথ্য শুনে। রাত এগারোটা অবধি থানায় বসে,রিহার্সাল হয়েছিল পুরো নাটকটা।তারপর আর কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। 


মোদ্দা কথা পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই সবকিছু সাল্টে দিয়েছিলেন, নীলবর্ণা দেবী। বদলে মানত ছিল, 'মেলা উৎরে দাও মা, মেয়েটাকে সমেত ধরে এনে পুজো দেব।' তাই আনতেই হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে। ফোনটা রেখে, জানলার বাইরে ছুটে চলা আলোর শহর আর ছায়া মানুষ গুলোকে দেখতে দেখতে এই প্রথম উপলবব্ধি হল, চার বছর দশ মাস কাটানো শহর, থেকে তাহলে সত্যি সত্যিই এবার গোটাতে হবে পাততাড়ি।

Saturday 30 October 2021

অনির ডাইরি, ২২শে জুলাই ২০১৯ (এটিআই এর গপ্প)

 

(এটিআই এর গপ্প, দিবস-১)

পকেটের মধ্যে মোবাইলটা আছে, কিন্তু আর বার করতে ইচ্ছে করছে না। কত রাত হবে? খুব বেশী হলে রাত দশটা। অথচ মনে হচ্ছে মধ্যরাত। চতুর্দিক নিশুতি। সল্টলেক এটিআই এর সুবিশাল প্রান্তরে গুটি কয় টিমটিমে লালচে নিয়ন আলো তৈরি করছে কেমন যেন ধোঁয়াশা। মাইরি বলছি, পেটে মুশুর ডাল,রুটি, আলু ঢ্যাঁড়শের ঘ্যাঁট আর কাতলার পেটি ছাড়া কিচ্ছু পড়েনি কো। ঢ্যাঁড়শটায় কি মিশিয়েছিল কে জানে, আচারের মত টকটক। তিন বার নিলাম। কল্লোলদা আর রথীনদার খেতে আসতে দেরী হয়ে গিয়েছিল, পরিমাণে বোধহয় কম পড়ল। কল্লোলদা যদিও বলল,“ভাগ্ তো।”অঙ্কন আবার নিরামিষ। সকালে বেচারা শুধু ডাল ভাত আলুপটলকুমড়োর ছক্কা আর কাঁকড়োল ভাজা দিয়ে ভাত খেয়েছে। দেখিয়ে দেখিয়ে মুর্গীর ঠ্যাং চিবোতে হেব্বি দুঃখ হচ্ছিল মাইরি। ঝোলটাও এত ভাল করেছিল। চামচে করে খাচ্ছি দেখে, রথীনদা বলেই ফেলল,“অ তুই ও চামচ পার্টি। যা অয় টেবিলে বস গিয়া। ” যাই হোক, পরে শুনলাম অঙ্কন ওসব দেখেনি।অঙ্কন ওসব দেখে না। লাঞ্চের  পর পার্থদা হেব্বি পিছনে লাগল, “ডালটা যে খেলি, ওতে পেঁয়াজ রসুন নেই বলছিস?” রথীনদা ঢুলতে ঢুলতে বলল,“হঃ। ভাতেও রসুন দিয়াছিল। ” বেচারা অঙ্কন। বিকালে দু্টো আলুর চপ আর চা। সাড়ে আটটায় ডিনার দেবে। হজম হলে বাঁচি, করতে করতে তুহিন টপ করে একটা প্যান ফর্টি গিলে নিল। ক্লাশ শেষ হতে হতে ঘড়ির কাঁটা সাতটা পার। সুকন্যার কি শখ মাইরি, সাড়ে সাতটার পর গেল মাথা ধুতে। বাথরুমে নয় রে বাবা, পার্লারে।

 

মাকে ভিডিও কল করতে ব্যালকনিতে এসে দেখি,কি দম বন্ধ করা সাংঘাতিক পোড়া পোড়া গন্ধ। এতো তার পুড়ছে মনে হয়।আমার ঘরের এসিটা পুড়ছে না তো।  ফোন রেখে ঘরের দরজা খুলে দেখি করিডরেও তিতকুটে গন্ধ ম ম করছে। বারন্দার রেলিংএ ডিসপেনসারের ওপর ওল্টানো আছে ভারি জলের ড্রাম। ত্রিদিবেশদা নবেন্দুকে সাবধান করছে,“দেখিস উল্টে নীচে ফেলে দিস না যেন। ” কেয়ারটেকারকে ধরে আনা হল, কি যে দেখল কে জানে? গন্ধ তো কমেই না।  তুহিন,নবেন্দু আর আমি বিল্ডিং থেকে নেমে গিয়ে গোল গোল চক্কর কাটলাম বার কয়েক। এটিআইয়ের কোন গেটটা দিয়ে বেরিয়ে কোনটা দিয়ে ঢুকলাম, রীতিমত আলোআঁধারির গোলকধাঁধা। নটা নাগাদ সুকন্যা খবর আনল,বাইরে কোথাও আগুন লেগেছে। 

কখন খাওয়া মিটে গেছে। তুহিন,সুকন্যা, অঙ্কন,হীরা আর আমি ছাঁটাই করা সবুজ ঘাসের চাতালে পা ঝুলিয়ে বসেছি। মুর্শিদাবাদ আর দক্ষিণ ২৪পরগণা কাজের কথা শুরু করেছিল বটে, জলপাইগুড়ি,পুরুলিয়া আর হুগলীর, রণং দেহী মূর্তি দেখে ক্ষান্ত দিয়েছে। কাল করবে বলছে। কাল আবার সাতসকালে যোগাভ্যাস আছে। রথীনদা তিনবার বলল,“যোগায় হব না। তুই জিমে যা। ”নেহাৎ সিনিয়র। তাই ফোটো তো বলেই বাকিটা হজম করলাম। যা হবে দেখা যাবে কাল, আপাততঃ আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। আপনাদের মধ্যে যে বা যাঁরা আজ বিষম খেয়েছেন, জানবেন এই পাঁচ মূর্তিই দায়ী। চুপি চুপি একটা কথা বলি, আমরা কেবল তাদের নিয়েই হাসাহাসি করছিলাম, যাদের আমরা ঘোরতর পছন্দ করি-


অনির ডাইরি ২৪শে জুলাই, ২০১৯

(এটিআই এর গপ্প, দিবস- ৪)

ক্লাশ শেষে কদম ইয়ে বাতাবি লেবু তলায়-

তৃতীয় দিনের উপান্তে। ভোর ছটায় অ্যালর্ম দিয়ে উঠে, রুমে রাখা কেটলিতে চা/কফি বানিয়ে, দু চুমুক টেনেই দৌড়।একটু দেরী হলেই দমাদ্দুম দরজা পেটায় আপদ গুলো।  হীরার, যে কি না ইমোশনাল ইনটেলিজেন্সের ক্লাশে পরিচয় দিল,“রিলাক্সিং হীরালাল” বলে, উৎসাহ সব থেকে বেশী। দাঁড়া বাপ, ঘরে চাবিটাতো লাগাতে দিবি। ল্যাপটপ-মোবাইল-মানি ব্যাগ সব ছড়িয়ে আছে, পুঁচকে স্টাডি টেবলে। বাতানুকূল যন্ত্রটাতো বন্ধ করতে হবে। যেটার দৌলতে বিগত দুরাত ভালো ঘুমই হয়নি। হয় কাঁপিয়ে মেরেছে নয়তো ঘামিয়ে ছেড়েছে। তারওপর তেনাদের ভয় তো আছেই। আতঙ্কে টিউবলাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছি। পাশের ঘরেই সুকন্যা, মাঝে মাঝেই প্রবল উদ্গত ইচ্ছা দরজা পেটানোর। কোন মতে দমন করেছি। যদিও সুকন্যা খোলাখুলি অনুমতি দিয়েই রেখেছে,ভয় পেলেই চলে যেতে। একই ডালের পাখি কি না, কেন যে আমরা ভূতের গল্প পড়ি বা সিনেমা দেখি কে জানে?


গুরুজী শ্রী বিন্দু চৈতন্য, সাড়ে ছটার আগেই চলে আসেন। নতুন হস্টেল থেকে বেরিয়ে, বকুল বীথি টপকে দূরে সাততলা নব্য বিল্ডিংএর তিনতলায় সুবিশাল বাতানুকূল ঘরে সাজানো আছে রঙবরঙের যোগা ম্যাট। সিনিয়র দাদারা বদমাশী করে সামনের ম্যাট গুলো ফাঁকা রাখেন। বাইরে জুতো খুলে দরজা ঠেলে ঢুকলেই, পার্থদা চিৎকার জোড়েন,‘এই আমি সাড়ে ছটায় এসেই অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে নিয়েছি। এত দেরী কেন?দেরী করেছিস। সামনে বস। ” ঠিক যেমন আমি আর সুকন্যা আমাদের জুনিয়র চেওয়াংকে বলি,“এই তুই সামনে যা। পিছন দিকের ম্যাটটা ছাড়। ” কে সামনে বসে মুর্গী হবে? গুরুজী এসেই শুরু করেন,“ সারি তানাও, সারে স্ট্রেস তো ভুল যাইয়ে। আপনি সারে মাসলস্ কো ঢিলা ছোড়িয়ে। কহি কোই দাবাও নেহি। কোন তানাও নেই।  ওম শান্তি। আঁখে বন্ধ করলিজিয়ে ” দুচোখ বন্ধ করে, কানে বাজে গুরুজীর মৃদুমন্দ সুরেলা কণ্ঠধ্বনি- পায়ের পেশী ঢিলা করুন। হাঁটু। কোমর। পিঠ। মুখের পেশী ঢিলা করুন। নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর ধ্যান দিন। চোখ খুলবেন না। একাগ্রচিত্তে শোনার চেষ্টা করুন,দূর থেকে ভেসে আসা সুক্ষ ধ্বনি। 


ধ্যান উপান্তে, একঘন্টা যোগ ব্যায়াম আর মিনিট পনেরোর প্রাণায়ামের পর ছুটি। গতকাল মাত্রাতিরিক্ত অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ঢুঁ মেরেছিলাম জিমে। ট্রেড মিলে সকাল সন্ধ্যা হাঁটা আর ক্লাশ শেষে বেশ কয়েকবার এটিআইয়ে চক্কর কাটার পরিণাম, গতকাল থেকে আর ঘুম ছাড়ছেই না। 


ঠিক সাড়ে আটটায় প্রাতঃরাশ সেরে, দৌড়তে হয়, যে যার ঘরে। স্নান টান করে ফুল বাবু সেজে দশটার মধ্যে ক্লাশে। আজ মিনিট দশেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়। বাইরেই টহল দিচ্ছিলেন কোর্স কোঅর্ডিনেটর স্বয়ং।  যেতেই ক্যাঁক করে পাকড়াও করল সুমিতাদি, দশ মিনিট লেট? দেখ আজ তোদের সবকিছুই পিছিয়ে যাবে। টানা সাড়ে পাঁচটা অবধি ক্লাশ,মাঝে দুবার চা আর একবার লাঞ্চের বিরতির পর, শেষ বিকালে প্রজাপিতা ব্রহ্মকুমারীরা যখন স্ট্রেস ম্যানেজ করার কলাকৌশল শিখিয়ে বিদায় নিলেন, কতজনের হৃদয়ে যে ডানা মেলছিল প্রজাপতির দঙ্গল। বাইরের খোলা হাওয়া, আর ইতিউতি জটলা পাকিয়ে আড্ডাটাই তখন অক্সিজেন। বিগত তিন দিন ভেঙে গড়ে দিয়েছে অনেক বরফের প্রাচীর। সিনিয়র-জুনিয়র বিভেদ ভেঙেচুরে তাই তো আমরা প্রবল চিৎকার জুড়ি,“ও রথীনদা। কোথা যাও? নবা, ক্লাশ শেষ বাপ। এবার হোস্টেলে ফের। কোথা যাস?হোস্টেলের পথ ওটা নয়।” তুহীন ছবিগুলো তুলে দিল বটে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে সম্মত হলনা। তিনদিন একই জামা পরে কেউ ছবি তোলে নাকি?

Tuesday 26 October 2021

অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১


‘নমস্কার, আমি প্রদীপ ব্যানার্জী বলছি, INTTUC থেকে-’ জনৈক বৃদ্ধের গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল মুঠো ফোনের ওপার হতে। ‘শুনলাম আপনার ট্রেন অবরোধে আটকে আছে, আমরা অপেক্ষা করছি, আপনার জন্য-’।  


সেই সকাল সাড়ে নটা থেকে আটকে আছে আমার ট্রেন, এখন পাক্কা সাড়ে এগারো। সহযাত্রী শিক্ষিকাদের মুঠোফোনে ভেসে আসা ছুটকোছাটকা খবর জানিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি বেশ জটিল। জব্বর হাঙ্গামা বেঁধেছে সোদপুর স্টেশনে। হাতাহাতি-লাথালাথি-পেটাপিটি সবই চলছে, চলছে না শুধু হতভাগা ট্রেনটা। সাড়ে এগারোটা থেকেই ডেকেছিলাম মিটিংটা। কখন পৌঁছাব কে জানে?


সাল ২০১৭। মাসটা বোধহয় জুলাই বা আগস্ট।কামরার বাইরে চোখ ঝলসানো রোদ। আর ভিতরে বইছে ঘামের বন্যা। তেমনি দমচাপা ভিড়। আপদের দল, অবরোধকারীগুলোর জন্য মানসম্মান আর রইল না। এমনিতেই আমার কাছে মিটিং করায় আপত্তি ছিল ওদের, বরাবরই এই মিটিং নাকি চন্দননগর আপিসে হয়। আমার স্তরে নয়, বড় সাহেবের টেবিলে হয় ওদের যাবতীয় বিবাদের মিমাংসা। এটাই নাকি এখানকার দস্তুর, আমার আপিসের কাজ শুধু ফাইলটা তোলা। আর এখানেই ঘোর আপত্তি আমার। আমার এলাকার সামান্যতম সমস্যা নিয়ে কেন সবকথায় ওপরওয়ালাকে বিব্রত করব? চেষ্টা তো করে দেখি, নাহলে তো বড় সাহেব আছেনই। মিটিং ডাকার দিনই শুনেছিলাম,জনৈক প্রদীপ বাবু আসবেন নাকি মিটিং করতে, সেই ভদ্রলোকই ফোন করেছিলেন একটু আগে। 


আপিস ঢুকতে সাড়ে বারোটা পার, ঢুকে দেখি চেম্বারের বাইরে বা বলা যেতে পারে, বুড়ো কালেক্টরেটের বারন্দায় পেতে রাখা চেয়ারে শ্রমিক পরিবৃত হয়ে বসে আছেন জনৈক কৃশকায় বৃদ্ধ। টকটকে ফর্সা রঙ, রোদে পুড়ে তামাটে, প্রশস্ত কপাল, খড়্গনাসা। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। একেবারে যেন নমকহালাল সিনেমার ডাকসাইটে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। 


মিটিং শুরু হতেই বুঝলাম, চেহারা যতই সিড়িঙ্গে হোক, বৃদ্ধের দাপট প্রবল। হাতে অদৃশ্য ছড়ি নিয়ে ঘোরেন বৃদ্ধ, যা সমানতালে বর্ষিত হয় কখনও মালিকপক্ষ, কখনও বা শ্রমিকপক্ষের মাথায়। উনিই বিচারক, উনিই জুরি এবং উনিই ফাঁসুড়ে। আর একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম, আমার মাথার ওপর ছড়ি মারার বা ছড়ি ঘোরানোর কোন চেষ্টা করলেন না। বরং আমার মতামত যথোচিত গুরুত্ব সহকারে শুনলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে মেনেও নিলেন। 


মিটিং চলাকালীনই বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বিবাদ মিটলে আমার ঘরেই মিটবে। সময় হয়তো লাগবে, তবে মিটে যাবে। সে তো সব শ্রমিক বিক্ষোভ মিটতেই সময় লাগে। মিটিং শেষের চায়ের সাথে টুকটাক খেজুরে গল্প হল, দেখলাম উনি আমাদের দপ্তর সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। দপ্তর মানে আমার ক্ষুদ্র চুঁচুড়া নয়, সমগ্র শ্রম কমিশনারেট সম্পর্কেই উনি সচেতন। অনেক সিনিয়র স্যার/ম্যাডামদের উনি নামে চেনেন এবং নাম ধরে ডাকেন। নাঃ নেতাসুলভ তাচ্ছিল্য নয়, বরং সহকর্মী সুলভ অধিকারবোধ থেকে নাম করছেন উনি, শুনতে শুনতে ভির্মি খেলাম,সর্বনাশ ইনি কি আমাদের অসংগঠিত শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রদীপ ব্যানার্জী নাকি? যাঁর বোর্ডের টাকায় আমাদের এত রমরমা? প্রতিবছর মেলার কার্ডে ছাপা হয় যাঁর নাম। তাহলে তো তাঁর মর্যাদা যে কোন রাষ্ট্র মন্ত্রীর সমতুল। অন্য এক বোর্ডের চেয়ারম্যান বিগত মেলায় খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, কার্ডে ওণার নাম স্থানীয় বিধায়কের নামে নীচে লেখাতে।


 ইনি যদি সত্যিই সেই প্রদীপ ব্যানার্জী হন, তাহলে তো এণার যথোপযুক্ত  খাতির করিনি আমি। কথাটা বলাতে দেখলাম প্রভূত আমোদিত হলেন বৃদ্ধ। সেই শুরু, এরপরও বিগত বছর পাঁচেকে অগণিত বার এসেছেন বৃদ্ধ, মিটিং শেষে বসেছে জমাটি আড্ডা। শুনিয়েছেন নকশাল জীবনের কথা, যথার্থই তৃণমূল স্তর থেকে শ্রমিক রাজনীতি করে আসছেন ভদ্রলোক। প্রথম জীবনে এয়ারফোর্সে পাইলটের চাকরী পেয়েও ছেড়ে দেন। জানিয়েছেন আগুনে সত্তরের অত্যাচার কি ভাবে ভেঙেছে ওণার স্বাস্থ্য। কিছুদিন আগেও নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে, ডাক্তার বলেছেন বিশ্রাম নিতে, নেননি উনি। শোনেননি কারো কথা। শুধু নিজ স্ত্রীকে সামান্য ভয় পান বৃদ্ধ। সে আর কে না পায়?


 ২০২০র  লকডাউন সবে আংশিক উঠেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বয়লার পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গেল এক শ্রমিক, আহত জনা চার।কারখানার গেটে ঝুলল বিশাল তালা। প্রদীপ বাবুর উপস্থিতিতে আমার চেম্বারে ঘন্টার পর ঘন্টা চলল মিটিং, বয়লার আধিকারিককে দিয়ে চেক করিয়ে, বয়লার সারিয়ে, পুলিশ তথা জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে, ভীত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বুঝিয়ে, মালিককে চমকে, মৃতের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার এবং ক্ষতিপূরণ, পদোন্নতির ব্যবস্থা করিয়ে খোলা হল সেই কোম্পানি। একাই বল-ব্যাট-ফিল্ডিং করে গেলেন প্রদীপ বাবু। মাঝে মাঝে মুখখোলা ছাড়া কিছু করতেই হল না আমায়- 


কারখানা খোলার মিষ্টি দিতে আসার সাথে সাথে নতুন দাবী সনদ দিয়ে গেল শ্রমিকপক্ষ। আমার ঘরে স্বাক্ষর হওয়া সেই দাবীপত্রের পূর্ণ হয়েছে তিনটি বৎসর। এবার নতুন চার্টার অব ডিমান্ডের পালা। ভাবলাম এ আর এমন কি কথা, প্রদীপ বাবু আছেন তো। বললামও সে কথা। উনি জানালেন, ‘দাঁড়ান আগে নির্বাচনটা মিটতে দিন।’ শুনলাম বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় প্রচারের দায়িত্ব পড়েছে ওণার। বেশ তাই হোক। 


নির্বাচন মিটল,ক্ষমতায় ফিরল ওণার দল। শুধু ফিরলেন না প্রদীপ বাবু। রাতারাতি শেষ হয়ে গেল সব। হাহাকার ভরা সুরে ফোন করে শ্রমিক থেকে মালিকপক্ষ, ‘শুনেছেন ম্যাডাম। আমাদের প্রদীপ বাবু চলে গেলেন’। 


দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়। শৌভিকের বদলীর খবর আসে, আমাদের পুরাতন বদলীর নির্দেশনামা বাতিল হয়ে নতুন অর্ডার মক্সো হয়। বন্দরের কাল হয়ে আসে শেষ। এমন সময় এসে হাজির হয় গুটি কয়েক শ্রমিক, ‘যাবার আগে আমাদের কেসটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম।’ ফোন করেন মালিকও,‘শুনলাম আপনিও চলে যাবেন। প্রদীপবাবুও নেই। একটু ঝামেলাটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম-’। 


বেশ বসলাম ঝামেলা মেটাতে। গড়ালো আলোচনা,হল তর্কবিবাদ। শুনতে শুনতে, বকতে-বকতে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল আমার পাশে রাখা তোয়ালে ঢাকা ফাঁকা চেয়ারটায়। প্রদীপ বাবুর ঢঙে ছড়ি ঘোরানো, ছড়ি পেটানোর চেষ্টা করলাম, বার তিনেক হুমকিও দিলাম, ‘সবকটাকে দূর করে দেব আমার চেম্বার থেকে। ’ একটা কথাও শুনল না কেউ।  উল্টে জনৈক রগচটা শ্রমিক, ৩২পাটি দেখিয়ে বলল, ‘বের করে দিলেও যাব নাকো। এই আপনার ঘরের বাইরেই বসে থাকব। ’ 


যাই হোক, শেষ পর্যন্ত প্রদীপ বাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে, এবারেও মীমাংসা হল আমার টেবিলেই। সাক্ষরিত হল ত্রিপাক্ষিক চুক্তিপত্র। যা বলবৎ থাকবে আগামী তিনটি বছর।  শতকরা ১১শতাংশ হারে মাইনে বাড়ল সবার, এরওপর আরও ৮৫০টাকা করে মাইনে বাড়বে প্রতিবছর, পরবর্তী দাবীসনদ না পেশ করা পর্যন্ত। বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল শতকরা ২ শতাংশ হারে।  ক্যাজুয়াল কর্মীদের একাংশকে পার্মানেন্ট করার লিখিত প্রতিশ্রুতিও দিল মালিকপক্ষ। আজ চুঁচুড়া ছেড়ে যাবার আগের দিন, প্রদীপবাবুর নিজের হাতে বানানো, দাবীসনদ, কার্যকর করার মাধ্যমেই আমরা শ্রদ্ধা জানালাম ওণার স্মৃতির প্রতি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন প্রদীপবাবু। শ্রম দপ্তরের দীর্ঘ পনেরো বছরের চাকরী জীবনে আপনার মত নেতা আমি দ্বিতীয় কাউকে পাইনি।

Friday 22 October 2021

অনির ডাইরি ৫ই অক্টোবর,১৯৯২

 

‘তোমরা সবাই পান্তা খাবে, আর আমার জন্য লুচি?’ যাকে প্রশ্নটা করল ঝুমি, তাঁর পরণে সাদা থান, মাথায় ঘোমটা, আর মুখে একগাল অমায়িক হাসি।পুরী লেখা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে গতরাত থেকে ভেজানো আছে লাল চালের ভাত। সামান্য ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে নির্ঘাত আজ তা থেকে। খেলে দারুণ ভালো ঘুম হয় বলে শুনেছি। গাঁয়ের লোক এমন এক থাল ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে মাঠে চাষ করতে বা চাষবাসের তত্ত্বাবধান করতে। এখুনি অ্যালুমিনিয়ামের শানকিগুলোতে ভাগাভাগি হয়ে যাবে জল সমেত অমৃত। তার সাথে মিশবে ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা ঘানিভাঙা সর্ষের তেল, আধখানা বা চারটুকরো করা পেঁয়াজ, মটমটে কাঁচালঙ্কা। নিকানো উঠোনের তুলসী তলায় হয়ে আছে পুঁচকে লঙ্কা গাছ, লাল সবুজ একরাশ লঙ্কার চাপে নুয়ে পড়েছেন তিনি। তার থেকে ভেঙে অানা হবে দুচারটে। মিশবে খেতের ছোলা ভাঙানো ছাতু, ঘরে ভাজা আউশ চালের মুড়ি। আর মিশবে নরম নরম মুসুর ডালের বড়া। ছোট ছোট দানার আধকুটো করা ঘরের খেতের ডাল, জলে ভিজিয়ে রাখা আছে, উনুন পাড়ে শিল পেতে বাটা হবে। একটু জলজলে করে বেটে তার সাথে পেঁয়াজ, লঙ্কাকুচি মিশিয়ে চাপড়া করে ঢেলে দেওয়া হবে গরম তেলে। পুড়তে থাকা পাটকাঠির ধিকি ধিকি আগুনে লোহার কড়ায় ভাজা সে বড়ার সোয়াদ আর গন্ধ অতুলনীয়। ওপরটা মুচমুচে আর ভিতরটা নরম তুলতুলে। 


এইসব মিশিয়ে যে সুখাদ্যটি প্রস্তুত হবে তাই দিয়েই প্রাতঃরাশ সারবে এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা। শুধু কলকাতা থেকে আগত জামাই আর নাতিনাতনীদের জন্যই তৈরী হয়েছে ফুলকো লুচি আর আলুর তরকারী। সাথে গঙ্গাপাড়ের নারান দাসের দোকানের রসগোল্লা। মনখারাপ করে বারান্দায় এসে বসলাম। বারান্দা নামে পরিচিত হলেও আসলে দাওয়া বা রোয়াক। দোতলা মাটির বাড়ির বাইরের দিকের দাওয়াটাকে এরা বলে বারান্দা। বারান্দায় এসে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়, বারন্দার একদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নারকেল গাছ। ফি বছর ঝড়ে তাঁরা টালি ভাঙেন। 


অপরদিকে বিশাল বাগান। বাগান ভর্তি কত যে গাছ, সব দিদার নিজের হাতে লাগানো। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে বড় জলদি বাড়ে গাছপালা। মস্ত পিটুলি গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে উঠে গেছে প্রায় চারতলা বাড়ির সমান, পাশেই একখান সজনে ডাঁটার গাছ, বেঁটে বেঁটে গোটা কয়েক নারকেল গাছ, সুবিশাল একটা জাম গাছ, যা হয়তো লম্বায় আর কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাবে পিটুলি গাছটাকে। তবে আড়ে পিটুলি গাছটাকে ধরতে লাগবে আরো অনেকদিন। হনুমানদের আড্ডাখানা এই গাছটা। পাকা জামের লোভে আসেন তেনারা। জাম খান আর বীজগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেন দিদার বাগানে। এছাড়াও আছে কাগজি লেবুর গাছ, অনেকগুলো পেঁপে গাছ,হলুদ কল্কে আর সাদা টগর ফুলের গাছ আর বাগানের সীমানা বরাবর বাসক ফুলের গাছ।


 বাসক ফুল ফোটে ঝুড়িঝুড়ি, কে যেন শিখিয়েছিল সম্ভবতঃ মায়ের কোন তুতো বোন, ফুটে থাকা বাসক ফুল তুলে, সবুজ বৃতিটা ছিঁড়ে ফেলে দলমণ্ডলের পিছনের অংশটা মুখে পুরে সুড়ুৎ করে টানলেই মুখ ভরে যায় মিষ্টি বাসক ফুলের মধুতে। ওটা যে মধু নয় মকরন্দ বা নেক্টার তা শিখতে তখনও বাকি অনেকদিন। কল্কে ফুলের মকরন্দও দারুণ খেতে তবে লাল পিঁপড়েদের সাথে লড়াই করে উদ্ধার করতে হয় তা। গাছ থেকে ঝড়ে পড়া কল্কে ফুলের মকরন্দ চুষতে গিয়ে একে তো লাল পিঁপড়ের কামড়ে ঠোঁট ফুলিয়েছি তারওপর উদোম কানমলা খেয়েছি বড়দার কাছে। একটাই ভালো কথা যে রামনগরে এসে মা কিছু বলে না, সারাদিন কি করছি, কি খাচ্ছি, কার সাথে কোথায় যে ঘুরছি হদিশই রাখে না মা। বছর ঘুরলে একবার বাপের বাড়ি আসে কি না, চুটিয়ে উপভোগ করে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে নেয় গ্রামবাংলার যাবতীয় রূপরস গন্ধ। 


এবছর বড়দা ছাড়া বাকি দাদারা কেউ আসেনি। ফলে পুজোটা বেশ নিস্তরঙ্গ কাটছে আমার। গল্প করার, খুনসুটি করার, হাতাহাতি করার কেউ নেই। বড়রা ব্যস্ত তাদের জগতে। শহরের পুজো আর জাঁকজমক ফেলে এই নিবান্দা নিস্তব্ধপুরীতে আসতে কারো ভালো লাগে? তারওপর এরা আমায় পান্তাও খেতে দেয় না। শুকনো মুখে লুচি চিবাচ্ছি, গায়ে একটা নরম স্পর্শ হয়ে লাগল, নাকে তামুক পাতার হাল্কা সৌরভ। একটা ছোট বাটিতে চাট্টি মুড়ি নিয়ে এসেছে দিদা, ভুলে গিয়েছিলাম দিদা তো পান্তা খাবে না। কায়স্থ বাড়ির বিধবা বড়গিন্নী, নিরামিষাশী তো বটেই ভাতও দিনে একবেলা কেবল খায় দিদা। মায়ের মুখে শোনা, কোনদিনই তেমন আমিশাষী ছিল না দিদা, তবে পেঁয়াজ খেতে বড় ভালোবাসত। ভাতের সাথে একটুকরো পেঁয়াজ থাকলেই খাওয়া হয়ে যেত দিদার। ছোটদাটা ঠিক দিদার মতই হয়েছে, সকাল বিকেল একটুকরো পেঁয়াজ চাইই ওর। মাঝে প্রোটিনের অভাবে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দিদা, মরেই যেত যদি না ডাক্তারের পরামর্শে প্রোটিনেক্স খাওয়ানো হত। দিদার মশলার আলমারি ভর্তি নতুন পুরাতন এমনকি মরচে ধরে যাওয়া প্রোটিনেক্সের টিন। যে জিনিসটা দুধে গুললে এমন অমৃত,সেটা একবার লুকিয়ে কাঁচা খেতে গিয়েছিলাম আমি। কি তেঁতো, বাপস্।  উচ্ছে করলাও ওর থেকে কম তেঁতো হয়। 


আমি লুচি খাচ্ছি, পাশে বসে মুড়ি চিবোচ্ছে দিদা, মাঝে মাঝে বলছে, ‘চাট্টি মুড়ি খাবে? ও ঝুমি? খাও না? ’ দিদারা বোধহয় এমনিই হয়। এত ভালো,এমন মিষ্টি, নরম তুলোর বলের মত-- শুধু বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় আর যাবার সময় রেখে যায় একরাশ দমচাপা কষ্ট, আর উপলব্ধি, ‘আর কেউ কখনও এমন ভালোবাসবে না। আর কেউ কখনও কেউ এমন রসোগোল্লার রসে চুবিয়ে ডাকবে না, 'ঝুমি'।


 দাও তোমার থেকে একগাল মুড়িই খাই দিদা, তবে দুটো শর্ত আছে তোমাকেও কিন্তু আমার থেকে দু-একটা লুচি খেতে হবে।তারজন্য অম্বল বাঁধালে বা এঁটো খাইয়েছি বলে মা এসে চিৎকার করলে বা ঠ্যাঙাতে এলে বাঁচাতেও হবে তোমায়। আর হ্যাঁ আরো অনেকদিন থাকতে হবে আমার সাথে-  অনেএএএএএএএএএএক অনেএএএএএএএএএক দিন। ইলেক্ট্রিকের তারে বসা ফিঙের মত ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যেও না যেন- প্লিজ।