Thursday 24 September 2020

অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

 অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০


বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বালি ব্রীজ, একদিনে তিনজনে ঘর ছেড়ে হয়েছি বার- ।  অন্যান্য দিনে অসভ্যের মত ট্রাফিক জ্যাম হয় এই পথে, আজ রবিবার, সদ্য বিগত হয়েছে মধ্যাহ্ন, তাই বোধহয় যানজট কিছুটা ভদ্রোচিত। জানলার বাইরে টলটলে নীলাকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা, কাঁচ নামালেই অল্পস্বল্প জোলো বাতাস । “একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না” বলল শৌভিক। বিবেকানন্দ সেতুতে উঠে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চূড়া লক্ষ্য করে প্রণতি জানাতে না জানাতেই, অাবছায়া জানলার কাঁচ। 

ধূলাগড় টোলে, একপিঠের মূল্য ১০৫টাকা। ফিরব তো এই পথেই, তবুও দুপিঠের টোল কাটে না ওরা। টোল প্লাজার হাল্কা যানজট কাটতেই,ফাঁকা রাজপথ। গাড়ি দৌড়য় একশ কিলোমিটার গতিতে। উল্টোদিকে ছুটে যেতে থাকে, বাউরিয়া, চেঙ্গাইল, ফুলেশ্বর। উলুবেড়িয়ায় সামান্য দেরী হয় জট কাটতে, তারপর আসে বীরশিবপুর, বাগনান। দেউল্টি আসার সাথে সাথেই রাজপথ ছেড়ে বাঁদিকে নেমে যাই আমরা। তারপর ডানদিকে বাঁকলেই, রবিবার দুপুরের মরা বাজার। বাজারের সীমানায় মস্ত সাইনবোর্ড, সামতাবেড় শরৎবাবুর কুঠী ঐ পথেই। 


বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পথের ওপরেই ওণার দ্বিতল কুঠী বাড়ি। চতুর্দিক টালির চাল দেওয়া বারন্দা দিয়ে ঘেরা। নিকানো তকতকে আঞিনা। আঙিনা ঘিরে যতনচর্চিত বাগিচা। আছে ওণার স্বহস্তে রোপিত পেয়ারা গাছ, ঝড়ে উপড়ে গেছে গোড়া, সংরক্ষিত শুধু শুষ্ক কাণ্ডখানি। ১৯২৬থেকে ১৯৩৮, দীর্ঘ একযুগ কাটিয়েছেন এই গৃহে। তখন নাকি সীমান্ত পাঁচিল স্পর্শ করে খলবলিয়ে বয়ে যেত রূপনারায়ণ নদ। এখন সরে গেছে বেশ কিছুটা দূরে।   তিনি তখন হাওড়া জেলা কংগ্রেসের বড় নেতা। কত তাবড় তাবড় বিপ্লবীর পদধূলিধন্য এই গৃহ। রাতের বেলা এসে মিটিং করে গেছেন খোদ নেতাজী। সবুজ শিকলাগানো দরজায় ঝুলছে তালা, সাড়ে তিনটের আগে খুলবে না। দরজার উল্টোদিকেই এক শান বাঁধানো পুকুর। এই পুকুরেই কার্তিক-গণেশের বাস ছিল বলে জনশ্রুতি। 

ঘড়িতে সোয়া তিন, এরই মধ্যে ভিড় জমেছে ভালোই। অনেক মানুষ আসে দেখতে। লকডাউন তথা করোণার আতঙ্কে জনজোয়ারে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লেও মন্দ কিছু নয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়ে থেকে সীমান্ত প্রাচীরের গা বরাবর চললেই সামনে শ্যামল ধানক্ষেত, ক্ষেতের ওপারে চিকচিক করছে নদ। ক্ষেতের পাশ দিয়ে নদের ধারে যাবার রাস্তা ঢালাই হয়েছে পঞ্চায়েতের সৌজন্যে। পথের ধারে লাল ক্রোটন আর চায়না টগর গাছের সমারোহ। ফুটে আছে গুড়ি গুড়ি সাদা ফুল। বড় বড় নোটিশ টাঙানো, আবর্জনা ফেলবেন না। ভ্যাট ব্যবহার করুন। পচনশীল আর অপচনশীল আবর্জনার জন্য আলাদা রঙের ভ্যাটও রাখা আছে। তবুও পড়ে আছে শিখর জাতীয় গুটকার প্যাকেট। নদের পাড় বরাবর আছে অনেকগুলি বাঁধানো বসার জায়গা। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। পার বরাবর কাশ ফুটেছে। ওপাড়ে কোলাঘাট থার্মাল থেকে ভুসভুস করে বের হচ্ছে সাদা ধোঁয়া। আয়নার মত নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের দল, মুখ দেখতে নামছে নদের বুকে। গুটি কয়েক আগন্তুকের ক্ষণিক উচ্ছাস ছাড়া এপাড়ে বিরাজমান  অখণ্ড নীরবতা। 

শরৎবাবুর কুঠীতে ঢুকতে কাটতে হয়না কোন টিকিট। যে বয়স্ক কেয়ারটেকার ঘুরিয়ে দেখান, উনি শুধু দাবী করেন, যদি কিছু খুশি হয়ে দিয়ে আসেন। জুতো খুলে উঠতে হয় দাওয়ায়। লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে। বাঁদিকের ঘরে রাখা ওণার আরাম কেদারা। পাশের ঘরে পাতা ফরাশ, রাখা তাকিয়া। ওণার গড়গড়া। লণ্ঠন। বাতিদান আরও কত কি। ঐ লণ্ঠনের অালোয় নাকি কোন এক রাতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় বসেছিলেন কথাশিল্পী আর নেতাজী। কি কথা হয়েছিল, জানে শুধু সময়, আর জানে বোবা লণ্ঠন। ভিতর দিকে আছে শস্যের গোলা। ছিল এক রসুইঘর, যা আটাত্তরের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়েছে। শূণ্য ভিত আজও বিদ্যমান। 

কাঠের রেলিং দেওয়া লাল সিমেন্টের সিঁড়ি নিয়ে যায় দোতলা। দোতলায়ও চারদিকে ঘিরে আছে বারন্দা। বারন্দা থেকে রূপার পাতের মত লাগে নদীকে দেখতে। দোতলাতেই ছিল তাঁর শয়নকক্ষ। আছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। ওণার নাতি জয় বাবু বোধহয় বর্তমান মালিক। বুড়ো কেয়ারটেকার তো তাই শোনাল- 

ওণার কুঠী থেকে অল্পদূরেই আছে সাড়ে  তিনশ বছরের পুরাতন মেল্ল্যকের মদনগোপাল জীউ এর মন্দির। দীর্ঘদিনের অযতনে নষ্ট হতে বসা, আটচালা পোড়া মাটির মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। সামতাবেড় থেকে গাড়িতে লাগে মিনিট দশ। পদব্রজে আরো একটু  বেশী সময় লাগবে হয়তো, তবে রাস্তাটা পায়েচলার পক্ষেই অধিক সুগম। ইঁটপাতা সরু রাস্তা, রাস্তার একপাশে কোথাও জনবসতি, কোথায় বা শুধুই ঝোপজঙ্গল।  অপরদিকে সবুজ ধানক্ষেত, গোচারণভূমি আর পুকুর। বড়ই মনোরম এই পথ। বাঁধের ধারে গাঁয়ের দুর্গামণ্ডপ, প্রস্তুত দেবীর কাঠামো। তারওপর পড়েছে মাটি। বাঁধের ওপর গাড়ি ছেড়ে বাকিটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সরু পায়ে চলা পথের ধারে ফলে আছে কয়েৎবেল। ধরেছে বাতাবি লেবু। পুকুরের ধারে চরছে ছাগল ছানা। আর এদের সবাইকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেলে হঠাৎ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সাড়ে তিনশ বছরের বুড়ো মন্দির। বুড়ো বললাম কি, তার শরীরে এখনও ঢলঢল করছে যৌবন।

ফেরার সময় ঝক্কি অনেক কম। আবার সেই পানা পুকুর, ছাগলছানা, বাতাবি লেবু, তেঁতুল আর কয়েতবেল গাছের তলা দিয়ে এসে উঠতে হয় বটে বাঁধে। এখান থেকে একটা সরু রাস্তা সোজা এসে ওঠে বম্বে রোডে। শুধু যদি মন্দির দেখতে চান, ওই রাস্তা ধরে যাওয়াই বোধহয় সহজ হবে। তবে মনে রাখবেন, ওখানে নেট থাকে না, জিপিএস কোন কাজে আসে না। স্থানীয় মানুষই ভরসা।

                  শরৎবাবুর কুঠী

লাল প্রাকারের এপার থেকে - বার্মিজ স্টাইলে লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বন্ধ খিড়কি দুয়ার থেকে শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বারান্দা থেকে দূরে রূপনারায়ণ নদ

এই পুকুরেই বাস ছিল কার্তিক আর গনেশ চন্দ্রের, সৌজন্য রামের সুমতি

নিঃসঙ্গ রূপনারায়ণ নদ, দেউল্টি

মদনগোপাল জীউ এর মন্দির মেল্ল্যক

©Anindita&ShouvikBhattacharya


তুত্তুরী উবাচ


তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর, ২০২০


 👩🏻- একি রে! তোর হাতে এত মৌরি লাগল কি করে?

👧🏻- ঐ হাতটা ধুয়ে এসে, তুলে খেতে গিয়ে লেগে গেছে মা। 

👩🏻- হাত দিয়ে তুলেছ? ছি ছি,  চামচ দিয়ে তুলবে তো? 

👧🏻- (ভয়ে ভয়ে) চামচ দেখতে পাইনি তো?

👩🏻-চোখের সামনেই তো রাখা ছিল, বাবা- আমি নিলাম, আর তুমিই পেলে না?

👧🏻-ও হ্যাঁ, তাই তো! সত্যি মা,  হেঁ হেঁ, আমি একটা কুতকুতে হোঁদল। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেয়ে) কি অসাধারণ আত্মবিশ্লেষণ। আহাঃ।

👧🏻-( উৎফুল্ল স্বরে) আর তুমি হলে, জ্যান্ত ছানাওয়ালা পান্তু। ঐ যে দাদু 👴🏻 আমায় প্রায়ই ডাকে না,‘পান্তুর জ্যান্ত” বলে।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে সেপ্টেম্বর,২০২০

👨🏻-(বাবা, ওষুধের বাক্স গোছাতে গোছাতে) আচ্ছা এই নরফ্লক্সটার ডেট ওভার হয়ে গেছে। এটা ফেলে দে। 

👧🏻-এ বাবা! এতো এক পাতা নতুন ওষুধ গো! এটা ফেলে দেবে?

👨🏻-(বাবা হাসি চেপে) এটা পেট খারাপের ওষুধ, তোদের হয়নি কেন? 

👧🏻- না বাবা, ফেলো না। এগুলো গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় দিয়ে দেবে মা। এই মা, একটু গুগল করে দেখো তো, গাছের গোড়ায় নরফ্লক্সের গুঁড়ো দিলে কি হয়?

👨🏻-( বাবা, খুকখুক করে হাসতে হাসতে) কি আর হয়? গাছের ইয়ে বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের গাছের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মা তোকে আর আস্ত রাখবে? তুই বরং ওটা ফেলেই আয়।

তুত্তুরী উবাচ, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২০

👩🏻-(মা, কেজো স্বরে) অনেক বেলা হয়েছে, এবার একটু পড়তে বসো, না? 

👧🏻-(কয়েক মুহূর্ত পড়ার নাটক করে) চোখে অন্ধ, মুখে গন্ধ। মা তুমি এমন কাউকে চেন?

👩🏻- (মা হতভম্ব হয়ে) না তো? কেন?

👧🏻-এই একটু মনে হল। তোমার মোবাইলটা দাও তো দেখি, ধৃতরাষ্ট্রের মুখে দুর্গন্ধ ছিল না? 

👩🏻- (মা বিরক্ত হয়ে) যত ফালতু কথা, কি পড়ার সময়ই মনে পড়ে?

👧🏻- ( আরো খানিকক্ষণ নীরবে বইয়ের পাতা উল্টে) মা, পরের দিন যখন কুট্টুসের 🐕 সাথে দেখা হবে, কাকিমাকে ভিডিও কল করব, কেমন? কাকিমা কুট্টুসকে দেখতে চেয়েছে। 

👩🏻-(মা, আরো ক্রুদ্ধ স্বরে) যত বাজে কথা। কাকিমা মোটেই এমন কিছু বলেনি। আমি জানি। 

👧🏻-(আহ্লাদী সুরে) কাকিমা বলেনি তো। আমিই কাকিমাকে বলেছি, পরের দিন কুট্টুস দেখাব। কুট্টুসের কাণ্ডকারখানা শুনে কাকিমা তো হেসেই খুন। জানো তো মা, কুট্টুস এত ভালো, ওকে কামড়ে দিলেও কিছু বলে না। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) মানে? তুই কুট্টুসকে কামড়ে দেখেছিস নাকি?

👧🏻-( আহ্লাদী সুরে) হ্যাঁ তো। ও বারবার আমায় কামড়াচ্ছিল, তাই বললাম, “আমিও কামড়াতে পারি দেখবি?” বলে ওর কানে কট করে কামড়ে দিলাম। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) কি সর্বনাশ! এষা পিসি জানে? তুই তার কুতুয়াকে কামড়েছিস?

👧🏻-(দুষ্টু স্বরে) না বোধহয়। তোমরা তখন গল্প করছিলে।

👩🏻-(মা, মনখারাপী সুরে) জানতে পারলে, আর আসবে না এষা পিসিরা। তুই ওদের কুতুয়াকে কামড়েছিস- 

👧🏻-(আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে) আরে না না। ওরা কিছু বলবে না। আমি কুট্টুসের পিঠের ওপর বসে ক্যাসল স্টোরি খেললাম। তারপর ওর চোখে আলো ফেললাম, তারপর ওর সঙ্গে ভৌ ভৌ করে গল্প করলাম, তারপর ও আমায় কামড়াল, আমিও- 

👩🏻-(মা, অবসন্ন সুরে) থাক মা। তুমি ঐসবই করো। পড়াশোনা আর করে কি লাভ? আর করতে হবে না। 

👧🏻-(তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বইখাতা বন্ধ করে) হ্যাঁ মা। চলো গরু চরাই।🐄

অনির ডাইরি ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২০

 


এনআরসির নাম শুনেই পুরানো মাসি যেন কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল অবশ্য, “দ্যাশে যাইতেছি বওদি। সেখেনে অনেক কাজ আছে জানো। কবে ফিরব জানি না। আর কি কইব বলো? সবই আমার কপাল!” তা সে অনেককাল আগের কথা, তখনও শীতের আমেজে ভাসছে নগর কলিকাতা। মাসির কপালের ভরসায় বসে রইলাম, বেশ কিছু দিন। ফোন করলাম বেশ কয়েকবার, কিছুই হল না ওপাশে। উল্টে গম্ভীর গলায় ফিরিঙ্গী ভাষায়, জনৈকা মেসিনকণ্ঠী আমাকে বেশ খানিকটা ধমকে নিলেন। 

আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে কাজের মাসি খুব দুর্লভ কিছু না।  নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে, এমন অনেক মাসির নম্বর থাকে, বললেই গুটি কয়েককে পাঠিয়ে দেয়। নতুন মাসিকে তেমন ভাবেই পাওয়া। সদ্য বইতে শুরু করেছে বাসন্তী হাওয়া, মাসি এসে নাড়লেন কড়া। প্রথম দিন এসেছিলেন রাত আটটা নাগাদ, কথাবার্তা পাকা করতে। সেদিনই শুনলাম, মাসি বিধবা। আবাসনের পিছনের গলিতেই মাসির বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে রিক্সা টানে, তার বাড়িতেই থাকে মাসি। ছোট ছেলে রদ্দিওয়ালা। পাশেই থাকে।  মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতে, জামাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। সবই বেশ ভালো, বেতনেও পুষিয়ে গেল। দুবার আসা নিয়েও টালবাহানা করল না মাসি। বুঝিয়ে দিলাম, আমি বাড়ি থাকি না।  আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ির গিন্নী বলতে মেয়ের মাসি, তার সঙ্গে ঝামেলা না বাঁধে। 


পরদিন ভোর ভোর কাজে এল মাসি, দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি,পিছন পিছন এসেছে একটি ফুটফুটে বালিকা। সাগ্রহে জানতে চাইলাম, “মাসি এটা কে গো?” জবাব পেলাম মাসির নাতনী। ভেবেছিলাম ওণার জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্রের কন্যা, পরে বুঝলাম, আসলে দৌহিত্রী। মেয়েটি প্রায় আমার তুত্তুরীরই বয়সী, বছর আট- নয়। বেশ শান্ত, ভীরু ভীরু চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ওর সামনে যে প্রশ্নটা করতে পারলাম না, তা হল, “তবে যে মাসি বলেছিলে, মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছে, বছর দুয়েক হবে?”প্রশ্ন করতে হল না, বাসন মাজতে মাজতে মাসি নিজে থেকেই বলল, ফিসফিস করে, “এটা ওর পথম পক্ষের মেয়ে গো বৌদি। অল্প বয়সে একটু, ঐ যা হয় আরকি-। পাড়ারই ছেলে সে-। ভিভোস হয়ি গেছে,বুঝলে। ওর বাপও বিয়ে করি নিয়েছে। তার তো ছেইলেপিইলেও হয়ে গেছে, ও আমার কাছেই থাকে”।  মেয়েটি তখন তুত্তুরীর সাথে বসে ওর পুতুলগুলো নিয়ে ঘাঁটছে, মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল, আহা রে। বেচারা। 


মাসি একদিন ছুটি চাইল, জানাল ফুল্কির জন্মদিন। ফুল্কি মাসির দৌহিত্রী। ফুল্কির জন্মদিন বলে কথা, ছুটি দেবে না, এত সাহস কার? পরের দিন মাসি একাই কাজে এল, জানাল আগের রাতে ফুল্কি খুব ক্লান্ত ছিল, আজ আর উঠতে পারেনি। তুত্তুরী সাগ্রহে জানতে চাইল, ফুল্কি কি কি খেল, কি কি পেল-। মাসি ঝাঁট দিতে দিতে শোনাল, একটা পুতুল কিনে দিয়েছে। তার সামনে ফুল্কি যাই বলছে, সেও অমনি ঘুরিয়ে বলছে। ফুল্কি খুব খুশি, তবে মাসির পুত্র তথা পুত্রবধূ বেশ রুষ্ট, বড় দাম পুতুলটার কি না-। জানতে চাইলাম ওর বাবা-মা কি দিল? বাবার প্রসঙ্গে মাসি মুখবিকৃতি করল, জানাল, দুপুরের খাবারটা ঠাকুমা ডেকে খাইয়েছে। একটা জামাও দিয়েছে। আর মা? মাসি মাথা নীচু করে ঝুলো ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ওর মা আর আসতে পারেনি। আমার জামাই সন্ধ্যেবেলা এসে কিছু দিয়ে গেছে।’ টুকটাক উপহার আর কি। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, সৎ মেয়ের জন্মদিনে কে আর অমন আপিস ফেরৎ উপহার নিয়ে আসে?সত্যি হয়তো, তবুও সদ্য পরিচিত এক শিশুকন্যার জন্য, কে জানে না, কোন অব্যক্ত বেদনায় বিধুর হয়ে উঠল এক মায়ের হৃদয়।


তারপর তো লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেল মাসির আসাযাওয়া। মাসে একবার লুকিয়ে এসে বেতন নিয়ে যেত মাসি, প্রতিবারই মুণ্ডপাত করে যেত লকডাউন নামক বস্তুটির। “আর কদ্দিন এমন চলবে বল দিকি বউদি। আমার নেহাৎ উপায় নেই, তাই আসি মাইনা নিতে, বিশ্বাস করো বউদি। নইলে গতরে না খেটে পয়সা নিতে আমার ঘেন্না করে-”। প্রতিবারই ফুল্কির খবর নিতাম আমরা। শুনতাম ফুল্কি ভালো আছে। শুধু বাড়িতে থেকে একটু বদমেজাজী হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই দিদার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে- বুঝতাম ওগুলো দিদার সোহাগী ব্যাজস্তুতি মাত্র।  


তারপর এল আনলক ডাউন। আবার কাজে আসতে শুরু করল মাসি। তবে ফুল্কি আর আসে না। বাচ্ছা মানুষ, যদি ইনফেকশন ধরে যায়, তাই আনত না মাসি। তারওপর ফুল্কির লেখাপড়াও তো আছে। পাড়াতেই এক দিদিমণির কাছে ভর্তি করিয়েছে মাসি, নিজের বলত, ‘আমি মুক্কু মেয়েমানুষ, ওর মা তো বারো কেলাশের পরীক্ষাই দিল না। পালিয়ে গিয়ে বে করল- ও যদি তোমাদের মত পাশটাস দিয়ে কিছু করে’। ইতিমধ্যে ফুল্কির মা সরে গিয়েছে আরো দূরে, তার বর কর্মসূত্রে বদলী হয়ে গেছে সুদূর দক্ষিণ শহরতলীতে। কর্মস্থলের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে কপোতকপোতী। এসেছে সুখের খবর, পুনরায় সন্তানসম্ভবা ফুল্কির মা। এর আগে একবার মিসক্যারেজ হয়েছিল, তাই এবার ওরা ভীষণ সতর্ক এবং সাবধানী। সীমিত আয়ে বড় ডাক্তার দেখায় জামাই। ফুল্কির মাকে কায়িক পরিশ্রম যাতে না করতে হয়, বাসনমাজা-ঘরপোঁছার মাসি রেখেছে জামাই বলতে বলতে চিকচিক করে ওঠে মাসির চোখ। ‘এমনকি রান্নাটুকুও করতে দেয় না সবসময় বুঝলে বউদি’ প্রগলভ হয়ে বলে মাসি। 


এই তো গত সপ্তাহের কথা, সেদিন বোধহয় শনিবার।  দুপুরবেলা, অন্য কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে, যেকটা বাসন পড়েছে মাজতে এসেছে মাসি, বাসনের ঠুকঠাকের মাঝেই ফোন।  ঘাড়ে ফোনটা রেখে মাথা হেলিয়ে কথা বলে চলে মাসি। একই সাথে চলে হাত আর মুখ, এটা বেশ পরিচিত দৃশ্য। অন্য বাড়ি থেকে ফোন করে, ছেলেমেয়েরাও করে, ফুল্কি ফোন করে টুকটাক বায়না করে- সেদিন মাসির গলা দেখি ক্রমেই চড়ছে, তর্ক বা বাদানুবাদ চলল, বেশ খানিকক্ষণ। তারপর মাসি কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে উগরে দিল একরাশ নালিশ। ‘মেয়েটা ফোন করে ট্যাকা চাইছে বউদি। ওর ওষুধপত্তরের অনেক দাম। জামাইটা একা একা আর কত টানিবে? সবই বুঝি বউদি। কিন্তু আমিই বা কোথা পাই বলোতো-’। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন বাদল মুখে ফিরে গেল মাসি, পরদিন আবার দেখি মেঘ কেটে গেছে। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, ‘জামাই আমার বড় ভালো গো বউদি। কাল রাতে বাড়ি ফিরে সবশুনেই আমায় ফোন করেছিল, জানাল ট্যাকাপয়সা কিছু চায় না। ওর যা আছে তাতেই ওর ছেলে ভালো করে হয়ে যাবে। চিন্তা করতে নিষেধ করিছে। শুধু বলছে, কটা দিন যদি গিয়ে থেকে আসি, এই সময় মেয়েটাকে একটু যত্নআত্তি-’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাসি, ‘করতে পারলে তো ভালোই, বলো বউদি? তবে আমি চলে গেলে, ফুল্কিটার যে কি হবে? ওকে কে দেখবে?’ বলতে বলতে আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে মাসি। 

কাজটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল মাসি, মেয়ে বড় অশান্তি করছে, একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, আবার যদি কিছু হয়? বাড়িতে একজন গিন্নিবান্নি কেউ না থাকলে হয়? মাসির ছেলেবউদেরও তাই মত, বুড়ি কটা মাস মেয়ের কাছে থেকে আসুক- আর ফুল্কি? শেষ মাইনেটা হাত পেতে নিয়ে টকটকে লাল জবা ফুলের মত চোখদুটোর ওপর নোংরা আঁচল চেপে ধরা গলায় মাসি বলল,  “ওর বাপের বাড়ির লোকজন তো পাশেই থাকে-।ওরা রাখবে। ফেলে তো আর দেবে না। আর দিলে দেবে, আমি আর কি করব বউদি?রোজের এই অশান্তি আর ভালোলাগে না। কেন যে এত মায়া পড়ে যায় এদের ওপর, সেই তো গতর খাটাব, তবে দুটো খেতে পাব-”।

Sunday 20 September 2020

মধ্য রাতে মন খারাপে -


রাত এখন অনেক, পশ্চিশ আকাশে ঢলঢল সোহাগী চাঁদ। 

বড্ড গরম আজ, ঘুমন্ত চরাচর, অাঁধার ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে গুটি কয় জোনাকি। 

ভাবছি তোমার সিক্রেট মেসেজ পাঠাই, ‘তুমি কি এখনও আমায়_ _?‘ 

দূর কেন যে খামোকা এসব ভাবি? 

সেই যে, সেদিন সান্ধ্য মেঘ বয়ে এনেছিল তোমার মেসেজ, ‘.’। 

হ্যাঁ গো, ফুল স্টপ মানে কি? সব শেষ? 

নাকি শেষের পর, নতুন করে শুরু? 

কে জানে? অনেক পরে শুনেছিলাম, পরদিন গায়ে হলুদ রঙ মেখেছিলে তুমি- 

ফিকে হয়েছে কি সেই হলুদের রঙ, অথবা হয়েছে আরো প্রগাঢ়-

কে জানে? মন শুধু চায়, লুকিয়ে,সবার অলক্ষ্যে, একবার, শুধু একবার, ফুসফুসে ভরে নিতে, তোমার ঘেমো,মেঠো ঘ্রাণ-

“হ্যাঁ গো, তুমি কি, কখনও? মিথ্যে মিথ্যেই সই-? বলো না গো? প্লিজ। প্লিইইইইজ-”

Saturday 5 September 2020

অনির ডাইরি, ৫ই সেপ্টম্বর, ২০২০

 





সপ্তাহান্তেও কি যে অসভ্যের মত ভিড় পথেঘাটে। ট্রেন না চলার মাসুল গুনছে রাজপথ। দেহ রেখেছে হাওড়া আর হুগলী জেলার সংযোগ রক্ষাকারী মাইতি পাড়া ব্রীজ। বিগত চার বছর ধরে জ্বালিয়ে খাচ্ছে ডানকুনি সংলগ্ন এই সেতু।  আর এখন তো যানবাহনের অত্যাচার আরো অনেকবেশী। জীবিকার টানে প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বাইক ছুটে চলেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহানগরের পানে। পরিসংখ্যান কি বলে জানি না, তবে যাওয়া-আসার মাঝে অন্তত গোটা দুই দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করি রোজই। শুধু যে বাইকগুলি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় তা নয়, যত্রতত্র মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ট্রাক, কে জানে কাকে বাঁচাতে ডিভাইডারে উঠে পড়ে- আজ দেখি রাজপথে টাল খেয়েছে পটল বোঝাই গাড়ি। স্টিয়ারিং থামিয়ে বাপি বলল, “কত লোকে পটল তুলছে ম্যাডাম-”। ক্রুদ্ধ স্বরে বলি, “যার ইচ্ছে তুলুক। তোমার আর পটল তুলে কাজ নেই। ”


বেলা বাড়ছে, এগারোটা নাগাদ মহেশ্বরপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা চঞ্চল আর কৌশিকের। আমার দুই আদুরে ইন্সপেক্টর। ইন্সপেকশনে যাব তিনজনে মিলে, সারপ্রাইজ ইন্সপেকশন। পটল-জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি উঠল দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে। মাখনের মত মসৃণ ছিল কিছুকাল আগেও, করোনার অত্যাচারে তরুণ ওম পুরীর গালের মত চেহারা হয়েছে।  


মহেশ্বপুরের কাছেই আছে একটি আন্তর্জাতিক স্তরের ব্রুয়ারি। ধনিয়াখালীর প্রচুর মানুষ কাজ করে ওখানে। বিভিন্ন শ্রম আইন তথা শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্যায় ওণারা প্রায়ই যোগাযোগ করেন আমাদের সাথে। কাকতালীয় ভাবে ওণাদের নতুন অধিকর্তা আবার আমাদের পাড়ার ছেলে। সদ্য জয়েন করেছে, অন্য নামী ব্রুয়ারি থেকে-। ফাঁকা থাকলে ব্রুয়িং সম্পর্কে নানা গল্প শুনিয়ে যান ওণারা। মল্টটা আসে বিদেশ থেকে। দিশী খুদের সাথে, বিলাইতি মল্ট মিশিয়ে পচিয়ে তৈরী হয় বিয়র। এক্সাইজ ডিউটি বেড়ে যাওয়ায় বিগত বছর থেকে খুব চাপে ছিলেন ওণারা। কমছিল বিক্রি। এই প্রসঙ্গে ওণারা নিজেরাই বলতেন, “এত দাম দিয়ে বীয়র কেন খাবে মানুষ, দামী হুইস্কি খাবে-”। 


স্ট্রং বিয়রের থেকে লাইট বিয়র কেন ভালো, সেই প্রসঙ্গেও লম্বা লেকচার দিয়েছিলেন বটে, আমি যথারীতি ভুলে মেরেছি। তবে ওণাদের ব্রাণ্ড আমার বর এবং বন্ধুবান্ধবদের ভয়ানক প্রিয়। ব্রহ্মদেশে বেড়াতে গিয়ে জনৈক মায়নমার বিয়র খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, পরে যেদিন ওণারা দেখা করতে এলেন, কথায় কথায় শোনালাম ব্রহ্মদেশী বিয়রের গল্প, ভাবলাম চমকে যাবেন হয়তো। ভদ্রলোক মুচকি হেসে জানালেন, মায়নমার বিয়রও আসলে ওণাদের কোম্পানীরই তৈরী। 


আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম বিশাল বন্ধ গেটের সামনে, মাস্ক  ফেসশিল্ড পরা নিরাপত্তা রক্ষী এসে ড্রাইভারের তাপমাত্রা মাপল। মুণ্ডু গলালাম, কাঁচ নামিয়ে, ইশারায় জানাল দরকার নেই। কাঁচ উঠিয়ে গোটা গাড়িতে স্যানিটাইজার স্প্রে করা হল। বিশাল সাজানো কমপ্লেক্স। খবর পেয়ে ছোট বড় সাহেবরা দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশেপশনে। ইন্সপেক্টর সাহেবরা তাঁদের সাথে কাজের কথা বলতে লাগলেন, আমার নজর কাড়ল রিশেপসনে রাখা সুদৃশ্য অ্যাকোয়ারিয়ামটি। ভিতরে জাম্বো সাইজের গুটি কয় মাছ কেবল। যাদের কারো রঙ সোনালী কমলা, কারো কাঁচা হলুদ। তাঁরাও এগিয়ে এল আমায় দেখতে, অবাক হয়ে দেখলাম, দুই চোখের মাঝে একটি সুস্পষ্ট নাক বিদ্যমান। পিছন থেকে জনৈক অধিকর্তা জানালেন এই মাছের নাম প্যারট ফিশ।


 অ্যাকোরিয়াম তো আমাদের আপিসেও একখানা আছে, ভেসে বেড়ায় গুটি কয় লাল-কালো-হলুদ মাছ। নিয়মিত শ্যাওলা পরিষ্কার করে রমেশ। সকাল বিকাল খাবার দেয় অজিত দা। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাথাতেই পেপসির খালি বোতলে রাখা, দুর্গন্ধী গুলি, ঐ খায় আমাদের মাছ। কিন্তু এমন সুন্দর মোটু মাছ তো আমাদের নেই। কৌশিককে জানালাম, এমন মাছ আমাদেরও চাই। জবাব পেলাম ঐ মাছের দাম সাত থেকে আটশত টাকা। তাও পুঁচকে হবে। ধেড়ে হতে লাগবে দু-তিন বছর। অত দিন থোড়াই এই শহরে থাকব আমি- 


মনখারাপী মন নিয়ে ফ্যাক্টরীতে ঢুকলাম। ওণারা জানতে চাইলেন সেফটি শ্যু চাই কিনা। যদি পায়ে কিছু লেগে টেগে যায়। প্রায় দেড় তলা হিলতোলা জুতো পরি, ওসবে ভয় পাই না। 

ফ্যাক্টরীর ভিতরটা বিশাল, তুলনায় শ্রমিক খুব কম। কোভিডের জন্য খুব অল্প সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কাজ চলছে, খুব ভয়ে থাকেন ওণারা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “আপনারা তো অ্যালকোহল বানান, কোভিডকে আপনাদের কি ভয়?” ওণারা হেসে জবাব দিলেন বীয়রে অ্যালকোহল এমনিতেই কম থাকে। ওতে কোভিডের টিকিও বাঁকে না।


 ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন পুরো প্ল্যান্ট। মল্ট আর খুদ আলাদা আলাদা মেশিনে ঝাড়াই-বাছাই হয়। ধুলো- কাঁকড়, টুকরো লোহা বা ধাতু যদি থাকে, তা বেছে ফেলে, তার সাথে ইস্ট পচানো হয়। তারপর ছাঁকাই হয়। মাঝে আরো অনেক কিছু হয় বটে, সব ভুলে মেরেছি যথারীতি। তবে এটুকু মনে আছে, যেখানে পচাই হয়,বিটকেল গন্ধ মাইরি। পুরোটাই অটোমেটেড প্রসেস, সেটাও দেখালেন ওণাদের অপারেটর।  দেখালেন কোভিড রুখতে কত কিছু করেছেন ওণারা। থার্মাল চেকিং, স্যানিটাইজার, সকাল-দুপুরে মাস্ক পাল্টানো ছাড়াও, উড়িয়ে দিয়েছেন সব দরজার হাতল। ওখানে সব দরজা পা দিয়ে খোলা হয়। বসিয়েছেন সেন্সরড স্যানিটাইজার ডিসপেন্সার। তলায় হাত পাতলেই ঝরে পড়ছে সুগন্ধী তরল। অফিস বাস এবং ক্যান্টিনে মার্কা করা আছে, যাতে কেউ পাশাপাশি না বসে। এমনকি হাত ধোবার জায়গাতেও কল খুলে ফেলা হয়েছে। বদলে বসানো আছে পাম্প। পায়ের চাপ দিলেই ঝরবে জল। ওনাদের ব্যবস্থাপনা দেখে রীতিমত সমীহ হচ্ছিল। 


ইন্সপেকশন সেরে বেরিয়ে আসার সময় ওণারা দুঃখ করলেন, পরিস্থিতি যদি আগামী কালও স্বাভাবিক হয়ে যায়,তাও এবছর মাত্র ১২-২০শতাংশ ব্যবসা হবে। লাভ তো ছেড়েই দিন। জানালেন এটা শুধু বাংলা নয়, সারা ভারত তথা বিশ্বের চিত্র। একধাক্কায় প্রায় দেড় থেকে দুই দশক পিছিয়ে গেছে পৃথিবী। 


বেরিয়ে এলাম মধ্যাহ্নে। পরবর্তী গন্তব্যস্থল কাকগাছির আরেকটি ফ্যাক্টরী। এখানে প্যাকোজিং এর কাগজ আর কার্ডবোর্ডের বাক্স তৈরী হয়। না থার্মাল গান ঠেকালো নিরাপত্তা রক্ষী, না কেউ জানতে চাইল কি চাই-। বিশাল কারখানার শেডে গরগর করে চলছে মেশিন, বের হচ্ছে করোগেটেড কাগজ। যাঁরা কাজ করছেন, না আছে তাঁদের মুখে মাস্ক, না আছে কোন সামাজিক দূরত্ব। দুই ইন্সপেক্টর সাহেব প্রবল হম্বিতম্বি করাতে কোথা থেকে যেন নোংরা রুমাল বার করে মুখে জড়ালো কয়েকজন। বাকিরা দৌড়ল বড় সাহেবকে ডাকতে। যিনি এলেন তিনি এসেই হাউমাউ জুড়লেন। “সব ব্যাটাকে মাস্ক দেওয়া হয়েছে। কেউ পরে না। দেখুন না স্যার-।”চঞ্চল ধমকালো, তা সেই মাস্কগুলো কই? স্যানিটাইজারই বা কই, ম্যানেজার বাবু দৌড়লেন স্যানিটাইজারের বোতল আনতে, রাগতে গিয়েও কেন জানি না, হেসে ফেললাম, আন্তর্জাতিক কোম্পানীর চকচকে ব্যাপার তো বিরলতম দৃশ্য, এই না হলে আমার দেশ।

Thursday 3 September 2020

অনির ডাইরি, ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ (তুত্তুরীর দিনলিপি)

 


আপিস থেকে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকেই মস্ত বড় লিস্টটা ধরিয়ে দিল তুত্তুরী। সারাদিন ধরে, দীর্ঘ ভাবনাচিন্তা করে লিখেছে আর কেটেছে। বিষয়, আসন্ন পুজোয় কি কি খাবে, আর কি কি করবে। যার মধ্যে নাগরদোলাটা তৎক্ষণাৎ বাতিল হল। কেন? ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল তুত্তুরী। জানালাম, নাগরদোলা হল, সংক্রমণের আঁতুরঘর। পরের প্রশ্ন, আবার “কেন? আমরা তো আলাদা চেয়ারে বসব।” উত্তরে ধৈর্য ধরে বোঝাতে উদ্যত হই, আমাদের আগে, পরে কত লোক ঐ চেয়ারে বসবে। ওরা কি স্যানিটাইজ করে বসতে দেবে আমাদের? কচু। ঘেঁচু এবং ঘন্টা। চোখ গোলগোল করে তাজ্জব স্বরে বলে ওঠে কন্যা, “বাপরেঃ। পোঁ ইয়ে মানে পশ্চাৎদেশ দিয়েও সংক্রমণ হয়?” হাসব না স্যারিডন খাব বুঝতে পারি না। তবুও বোঝাই, বসার চেয়ার নয়,ধরার রডটা বেশী বিপজ্জনক ইত্যাদি,প্রভৃতি। 

নাগরদোলা বাদ গেল বটে, টিকে রইল বেলুন। ষড়যন্ত্রের সুরে, “দাদার থেকে, আমার বেলুনটা যেন বড় হয়-”। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বাবু, আগামী নভেম্বরে টিন এজে পদার্পণ করবেন। বয়সের তুলনায়, তিনি ভয়ানক সাদাসিধে, হাবলা-গোবলা বটে,তবে বেলুনে তাঁর ছিঁটেফোঁটাও উৎসাহ নেই। তবুও- 


নাগরদোলা-বেলুনের পর শুরু হল, প্রস্তাবিত খাদ্যতালিকা, যা দুই ভাইবোনকে খাওয়াতে হবে, সূত্রপাত হল, বুড়ির মাথার পাকা চুল দিয়ে। চিনতে পারলেন না তো। যাকে পরিশীলিত ফিরিঙ্গী ভাষায় কয়, কটন ক্যাণ্ডি বা ক্যাণ্ডি ফ্লজ। আচ্ছা এরপর পর্যায়ক্রমে আসছে ফুচকা, চটপটি, এগ এবং চিকেন রোল, হাওড়া ময়দানের মাটির ভাঁড়ে পুরু মালাই দেওয়া লস্যি, মামমাম (দিদা) এর হাতে বানানো চাম্মিন (চাউমিন), কস্তুরীর লাল ক্ষীরের মত দই, চাউমিন এর পুর দেওয়া সিঙারা, শেঠ সুইটসের কালো গজা, অন্নপূর্ণার কেঁদো কেঁদো জিলিপি- 


ফর্দ শেষ হতে বোধহয় আরো সময় লাগত, যদি না, মোক্ষম সময়ে, শৌভিক তার মোবাইলটা না বাড়িয়ে দিত, “দ্যাখ, বুজুর জন্য আমার ভিডিও সাজেশনে কি এসেছে-”। 

এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায়শই ঘ্যানঘ্যান করে আমার বর। বাপ-মেয়ে দুজনেই ইউটিউবের চরম অনুরাগী। আমার ফোন নিয়ে পড়াশোনা চালায় বটে, মাঝেসাঝে বন্ধুরা ভিডিওকল করলে,উৎফুল্ল চিত্তে বার্তালাপও করে, তবে এসব আব্দার আমার কাছে চলে না। বাবুজী স্বয়ং সোহাগ করে ফোনটা তুলে দেয় মেয়ের হাতে, তারপর শুরু হয় ঘ্যানঘ্যান- “আর আমি কোনদিন ওকে মোবাইল দেব না। কি সব দেখে বেড়ায়, উল্টোপাল্টা চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে। তারপর সেগুলো আমার সাজেশনে আসতে থাকে।” 


খুব বেশী উল্টোপাল্টা দেখে না তুত্তুরী, জনৈক প্যারট দীপঙ্করের বিরাট অনুরাগী। মাঙ্কা বলে এক বকবকে কাকাতুয়া আছে, প্যারট দীপঙ্করের, ভারী দাম্ভিক। নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই বলে না সে, তবুও তুত্তুরী তার জন্য পাগলপারা। সারাদিন “মাঙ্কা-মাঙ্কা” করে মাঙ্কার ভাষায় কথা বলে চলে। 


এছাড়া জনৈক ’গ্রাণ্ডপা‘র প্রতিও অনুরাগ জন্মেছে তুত্তুরীর। গ্রাণ্ডপা অবশ্য মারা গেছেন, তবে তাঁর চ্যানেলটি আছে। তিনি জীবিত অবস্থায়, স্বহস্তে রেঁধে পথশিশুদের নানা সুখাদ্য ভক্ষণ করাতেন। আধো আধো স্বরে জানাতেন কি ভাবে রাঁধছেন- তিনি মারা যেতে বেশ কিছুদিন কেঁদেছিল তুত্তুরী। বারবার বুড়ো বুড়ো উচ্ছারণে আধো আধো ইংলিশে গ্রাণ্ডপাকে নকল করে দেখাত, “লাভিং-শেয়ারিং-কেয়ারিং- দিজ ইজ মাই ফ্যামিলি।” গ্রাণ্ডপার তনয় সম্প্রতি চ্যানেলটি নতুন করে চালাচ্ছে। 

এছাড়া তুত্তুরী দেখে খুচখাচ কার্টুন আর চরম বোকাবোকা ধাঁধা। যেমন পাঁচটা বাচ্ছা বা গর্ভবতী মহিলার ছবি দেওয়া থাকে, তার তলায় লেখা থাকে, “এদের মধ্যে কে ভূত?” লোভে পড়ে আমি একবার দেখেছিলাম, যার ছাওয়া পড়ছে না, সেই ভূত বলে,হো হো করে হেসেছিল ভাষ্যকার। এত রাগ হয়েছিল- 


তুত্তুরী শুধু দেখে তাই নয়, শৌভিকের চরম বিরাগজনক হওয়া সত্ত্বেও এই সাংঘাতিক বোকা বোকা জিনিসগুলো লাইক করে। মাঝেসাঝে, ধাঁধার উত্তরগুলি কমেন্টও করে। এই নিয়ে নিত্য চুলোচুলি  আমাদের সংসারে। তবে আজকে স্ক্রীণে যা দেখলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদয়। এসব কি দেখছে আজকাল? 

আমার হতভম্ব দশা থেকে ফুলে ফুলে হাসছে শৌভিক, আর তুত্তুরী ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। কি? কি এসেছে বাবার ভিডিও সাজেশনে। বেশ খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আর শৌভিকের হাসি দেখে বুঝলাম, ওটি  আদতে, “গর্ভবতী চুড়েল”। যিনিই বঙ্গানুবাদ করেছেন, তাঁর খুরে খুরে নমস্কার। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মরলে আপনার কোমরে দড়ি পড়ত- উফঃ। যত্ত আপদের দল। 

পুনশ্চ তুত্তুরী দেখে-টেখে জানাল, যে ওগুলো ও ছোটবেলায় দেখত। এখন আর দেখে না। আপাততঃ শুধুই “মাঙ্কা-মাঙ্কা”।

Tuesday 11 August 2020

শুভ জন্মদিন (জন্মাষ্ঠমী ২০১৯)


শুভ জন্মদিন- 

সারা দেহ জুড়ে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে যেন শত সহস্র তপ্ত শলাকা। তীব্র বেদনায় ছটফট করতে করতে চোখ খুললেন তিনি। চোখ খোলা মাত্রই ধড়ফড় করে উঠে বসতে গেলেন কেশব, পারলেন না। পদতল থেকে কোমর পর্যন্ত তীব্র বেদনায় অসাড়। দাঁতে দাঁত চেপে উঠে আসা আর্ত চিৎকারকে পুনরায় গিলে ফেললেন তিনি। যদিও তিনি ক্ষত্রিয় নন, তবে দীর্ঘদিন ক্ষত্রিয় সাহচর্যে থাকার ফলে, তুচ্ছ শারীরিক বেদনায় কাতর হওয়া তাঁর ধাতে নেই। যাতনায় কাতর হয় নারী, পুরুষের পক্ষে তা অত্যন্ত অগৌরবের। পুরুষ তো সিংহ।

পুনরায় শুয়ে পড়ে, কিছুটা ধাতস্ত হয়ে চোখ খুলে হতবাক হয়ে গেলেন কেশব। এ কোথায় শুয়ে আছেন তিনি? কোথায় তাঁর দুগ্ধফেননিভ পুষ্পসুরভিত সুকোমল শয্যা? কোথায় তাঁর অনুপম কারুকার্য খচিত দারুপালঙ্ক? কোথায় শ্বেতশুভ্র স্বচ্ছ চন্দ্রাতপ? কোথায় পটে আঁকা ছবির মত, মাধবীলতা শোভিত বাতায়ন, হুড়মুড় করে ঢুকে আসা সমুদ্র পবন, কোথায়ই দেবী লক্ষ্মীস্বরূপা রাজ্ঞী রুক্ষ্মিণী? বিগত রাতেও তো শুয়েছিলেন পাশাপাশি-  

আর এখন? একাকী শুয়ে আছেন কেশব, চন্দ্রাতপের পরিবর্তে মাথার উপর ঘোলাটে নীল আকাশ, আর বুড়ো বনস্পতির দল। দারুপালঙ্ক তথা সুকোমল শয্যার পরিবর্তে পিঠের তলায় অনুভব করলেন বালি আর কাঁকর। ভয় জাগানো অখণ্ড নীরবতায় আচ্ছন্ন চরাচর। পুনরায় উঠে বসার চেষ্টা করলেন কেশব, উঠতে তাঁকে হবেই, বের হতে হবে এই গভীর অটবী থেকে। ফিরে যেতে হবে প্রিয়জনদের মাঝে, কোন মতে দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে ঘাড়টাকে তুলতে পারলেও, উঠে বসতে পারলেন না তিনি। অসহ্য দৈহিক বেদনায়, মানসিক উদ্বেগে, অজ্ঞাতেই গণ্ড বেয়ে ঝরে পড়ল দুই ফোঁটা অশ্রু।  

“এ কি কেশব, তুমি কাঁদছ?” পেলব রমণী কন্ঠে চমকে উঠলেন কেশব। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কে? কে ইনি? বড় পরিচিত, বড় সুমধুর এই কণ্ঠস্বর। “দেবী?” কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন কেশব, বাকি কথা বলার আগেই অনুভব করলেন, কপালে কার স্নেহস্পর্শ। জুড়িয়ে গেল, সব বেদনা। তপ্ত শলাকাদের উপর দিয়ে যেন বয়ে গেল হিমশীতল জলধারা। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলেন কেশব।  সম্মুখে এক বয়স্কা অভিজাত নারী। সদ্য প্রস্তুত নবনীর মত গাত্র বর্ণ, আকর্ণবিস্তৃত হাল্কা নীলচে দুই চোখ, খড়গনাসা, তিরতিরে ওষ্ঠাধর। করবিবন্ধিত অযত্নলালিত পক্ক কেশরাজি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। নিরাভরণ। রঞ্জিত সীমন্ত। নারীর দুই নয়নে মৃদু কৌতুক। করজোড়ে প্রণাম জানালেন কেশব। বড় মোহময়ী এই নারী, বড়ই ব্যক্তিত্বময়ী। “ কে আপনি দেবী?” পুনরায় প্রশ্ন করলেন কেশব।

দুই নীলচে নয়নে উপচে পড়ল চাপা হাসি, “সে কি কেশব? চিনতে পারলে না? কতদিন আর, মাত্র তিন দশক আগেও দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে। অবশ্য, এই রূপে, এই গভীর অটবির মাঝে কখনও দেখা হয়নি।“ কেশবের মাথায় নামছে গভীর কুয়াশা। কে এই নারী? তিন দশক আগেও যার সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ হত? রমণী হেসে উঠলেন সশব্দে, “আচ্ছা এবার দেখো তো? চিনতে পারো কি না?” শুভ্র উত্তরীয় থেকে ছিঁড়ে নিলেন খানিকটা বস্ত্রখন্ড, বেঁধে নিলেন দুই পদ্মাক্ষীর উপর, পলকে আঁতকে উঠলেন কেশব, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলেন নারীর ধুলিমলিন চরণদ্বয়, হ্যাঁ তিন দশক, তিন দশক আগেই তো দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল এক রুধির সিক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। দেখা হয়েছিল অগুনতি প্রজ্বলিত গণচিতার সম্মুখে।যেখানে পচাগলা শবের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল শৃগাল-কুক্কুরদের সাথে শোকাকুলা সদ্য স্বামী-সন্তানহারা ক্রন্দসী রমণীকুল। সেখানেই নিজের অন্ধস্বামীর হাত ধরে, মৃত পুত্র-পৌত্র-দৌহিত্রদের শব খুঁজে বেরাচ্ছিলেন ইনি, চোখ বাঁধা থাকা সত্ত্বেও শুধু স্পর্শ দিয়ে কিভাবে যে ইনি চিনতে পারছিলেন আপন সন্তান-সন্ততিদের, এ এক দুর্বোধ্য রহস্য। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন, তারপর অন্ধ স্বামীর হাতটা টেনে স্পর্শ করাচ্ছিলেন শবের গাত্র, দিচ্ছিলেন পরিচয়। ককিয়ে উঠছিলেন বৃদ্ধ রাজা। তৎক্ষণাৎ আলিঙ্গনাবদ্ধ করছিলেন বৃদ্ধকে, দিচ্ছিলেন মৃদু সান্ত্বনা। মৃত্যুর ধ্বংসলীলার মধ্যেও বড় মধুর ছিল সে দৃশ্য। বড় মর্মস্পর্শী।

 স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল, কেশবের বুক থেকে, দেবী গান্ধারী মারা গেছেন, প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে, তাঁর সাথে এই বনানীর মাঝে সাক্ষাৎ হবার অর্থ একটাই, স্বপ্নে আছেন কেশব। আর স্বপ্ন আর কতক্ষণই বা টিকবে, এখুনি আলিঙ্গন করবেন নিদ্রাতুরা দেবী রুক্ষ্মিণী, এখুনি ভাঙবে এই ঘুম। 

হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলেন দেবী গান্ধারী, “এটা স্বপ্ন নয় কেশব। এটা ঘোরতর বাস্তব।” হাসি মুখে তাকালেন কেশবও। সেই ভুবনমোহিনী হাসি, যা ভুলিয়ে দেয়, সব ব্যথা, বেদনা, উষ্মা। “সামান্য শারীরিক যাতনা, সামান্য প্রিয়জন বিচ্ছেদেই কাঁদছিলে কেশব? আর আমি যখন সেদিন কাঁদছিলাম, আমি যখন স্পর্শ করছিলাম, একের পর এক মৃত শবের সারি, শিশুর মত কাঁদছিল আমার প্রিয়তম স্বামী, দৌড়ে গিয়েছিলাম তোমার কাছে নালিশ করতে, ‘একটাকে তো ছাড়তে পারতে? নাহয় ভিক্ষাই দিতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে’ তোমার মনে আছে কেশব? জবাবে কেমন হেসে উঠে ছিলে তুমি? কেন কেশব? কেন হেসেছিলে? সন্তানহারা বৃদ্ধার হাহাকারে কি এমন  কৌতুক ছিল কেশব?” নিরুত্তর রইলেন কেশব, নত হয়ে এল মাথা, আপন মনে বলে উঠলেন, বৃদ্ধা, “বড় ভালবেসেছিলাম তোমায় কেশব, বড় বিশ্বাস করতাম, নির্ভর করতাম। এ যাতনা তোমার থেকে স্বপ্নাতীত-”। 

“ভুল করেছিলেন, জানেন না, ওকে ভালবাসলে যাতনা অবধারিত। কি গোপাল তাই তো?“ বলে উঠলেন আরেক রমণী। বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণার জলতরঙ্গ উঠল কেশবের, সামনে উবু হয়ে বসলেন যে সজলনয়না রমণী, তাঁর বয়স বেশী না। বর্তমান কেশবের থেকে অনেক অনেক কম। মাঝারী উচ্চতা, মাঝারী গঠন, ঢলঢলে স্নেহমাখা দুই বেদনাতুর চোখ, কপালে অভিমানের গভীর ভাঁজ। এনার সাথে অন্তিম দেখা যেন কবে হয়েছিল? বোধহয় বিগত শতকে, যেদিন চলে আসছিলেন দুই ভাই বৃন্দাবন ছেড়ে, আকুলিবিকুলি কান্না জুড়েছিলেন এই রমণী, “না।না। না। যেতে দেব না। আজ তোমরা বলবে, ও আমার গর্ভজাত সন্তান নয়, আর আমি মেনে নেব? কে বলেছে আমি মৃতবৎসা? ও তো আমারই পুত্র? দেখো? দেখো? অবিকল আমার মত দেখতে, কাল অবধি তো তোমরাই বলতে গো, মাতৃমুখী ছেলে আমার, খুব সুখী হবে, আর আজ বললেই হল না কি? যে আমি ওর পালিকা মাতা? বুকে করে মানুষ করেছি আমি, রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি, অযথা ওর অমঙ্গল আশঙ্কায় ছটফট করেছি আমি, নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়েছি আমার গোপালের মুখে, তখন কোথায় ছিল তোমাদের ঐ রাজকন্যা দেবকী, আর আজ এলেন অধিকার সাব্যস্ত করতে, ওনার ছেলে?” কথা দিয়েছিলেন কেশব, জন্মদাতা মাতাপিতাকে কারাগারের বাঁধন থেকে মুক্ত করেই ফিরে আসবেন, তাঁর আসল মায়ের কোলে। হ্যাঁ আসল মা, আজও দেবী যশোদাকেই আসল মা বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কেশব।


পর্ব-২

কপালে করাঘাত করে কাঁদছেন জননী যশোদা, ঠিক যেমন করে কেঁদেছিলেন, যখন শিশু গোপালকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, মথুরা থেকে আগতা সুন্দরী দাসী পূতনা। মেরেই ফেলত হয়তো, যদি স্নেহান্ধ মাতা যশোদা দৌড়ে না আসতেন আরেকটি বার প্রাণাধিক গোপালের মস্তকচুম্বন করতে। প্রায়ই এইটা করত মাতা। একা ছাড়তেনই না গোপালকে, পূতনাও জানত, সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বহুদিন, তারপর সময়বুঝে আক্রমণ করেছিল নিদ্রিত গোপালকে। দুই হাতে চেপে ধরেছিল কচি শ্বাসনালী, ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠতে চেয়েছিল গোপাল, পারেনি। গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরোয়নি, ক্রমশঃ কমে আসছিল প্রাণশক্তি, নীল হয়ে উঠছিল যশোদার দুলাল। আচমকা চিলের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতা যশোদা, পূতনা অভিজ্ঞ গুপ্তচর, রীতিমত রণপটীয়সী। ছাপোষা গৃহবধূ যশোদা তার সাথে পারে কখনও? কোনমতে গোপালকে বুকে তুলে নিয়ে ছুটে পালাতে গিয়েছিল মাতা, পিছন থেকে চুলের মুঠি ধরে প্রাকারে মাথা ঠুকে দিয়েছিল পূতনা। একবার নয়। অগুনতি বার। মস্তক থেকে নেমেছিল রুধির ধারা, প্রবেশ করেছিল মাতার দুই চোখে, অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলেন মাতা যশোদা, তাও ছাড়েননি আদরের গোপালকে। জননীর বিকৃত ললাট আজও তার সাক্ষ্য বহন করে। 

   তারপর যতবার হামলা হয়েছে গোপালের ওপর, ললাটে করাঘাত করে, কেঁদে ভাসিয়েছেন জননী যশোদা। পুত্রের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কত যে উপবাস করতেন জননী, গোপালের নামে কোন কুকথা সহ্যই হত না জননীর। কোন ব্রজবাসী গোপালের নামে অভিযোগ জানাতে আসত, ঠিক এমনি করেই ললাটে করাঘাত করে কাঁদতেন জননী। “কেউ আমার গোপালকে দেখতে পারে না গো। মিথ্যি মিথ্যি নালিশ করে খালি।” ঠিক এমনি করেই কাঁদছিলেন জননী, যখন মথুরার দিকে গড়িয়ে ছিল গোপালের রথের চাকা। “ও গোপাল, যাস নে বাবা, যাস নে। মোরা ছাপোষা গোপালক, ওরা কুহকিনী। তোর চোখে কেমনি মায়াঞ্জন লাগিয়েছে দেখ-। যাসনে বাপ। যাসনে। আমি যে তোকে ছেড়ে বাঁচব না বাপ। বুড়ি মাটাকে ছেড়ে যাসনে। নাহলে আমাকেও নে চল বাপ-।”

“সেই যে গেলি গোপাল, বুড়ি মা টার একটা সংবাদও নিলি না? আমার শরীরের ভিতর তোকে পালন করিনি, এই কি আমার অপরাধ? নাকি আমি সামান্যা নারী, শরীরে রাজরক্ত নেই, এই আমার অপরাধ?” 

গলার কাছে দলা পাকানো অসহ্য বেদনা, দু চোখে অঝোর ধারাপাত নিয়ে দ্রুত আলিঙ্গন করতে গেলেন কেশব, “মাতা-”। কিন্তু কোথায় মাতা? কেউ নেই সামনে, যতদূর দৃষ্টি যায়, নির্জন বনানী। পাখি গুলিও বুঝি ভুলেছে কুজন। “মাতাঃ” চিৎকার করে উঠলেন কেশব, না,না,না আর হারাবেন না মাতাকে, মাতা বহুবার বলেছেন, কিন্তু কেশব কখনও বলে উঠতে পারেনি, আজ বলবেই, “বড় ভালোবাসি মাতা তোমায়, সেদিনও বাসতাম। আজও বাসি। আমৃত্যু তোমার গোপাল শুধু তোমাকেই  ভালোবাসবে। জীবন বড় দ্রুত দৌড়েছিল মাতা, ইচ্ছা আর কর্তব্যবোধে বেঁধেছিল তীব্র লড়াই, তোমার গোপাল, কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারেনি মাতা। তুমিই তো শিক্ষা দিয়েছিলে মাতা। গোপাল কোনদিন তোমায় ভোলেনি, এক দন্ডের জন্যও না। দেবী দেবকীকে শ্রদ্ধা করলেও, কখনও ভালবাসতে পারিনি মা, তোকে ছেড়ে কাউকে ভালবাসতে পারিনি মা।” কিন্তু মাতা কোথায়? নিশ্চয় এদিক ওদিকেই কোথাও আছেন মাতা, লুকিয়ে পড়েছেন কোন বৃক্ষের আবডালে, এভাবে এই নির্জন বনানীর মাঝে কখনও গোপালকে ছেড়ে যেতে পারেন না মাতা। উঠে দাঁড়াতে গেলেন কেশব, খুঁজে বার করতেই হবে মাতাকে। কিন্তু কোমর থেকে নীচের অংশে কোন সাড় নেই যে, আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন কেশব, আবার ব্যর্থ হলেন। এভাবে মাতাকে হারাতে পারেন না কেশব, বড় দুখিনী মাতা, তাঁকে খুঁজে বার করতেই হবে, জানাতেই হবে কেশবের মনের কথা। রুক্ষ বালি-কাঁকরের ওপর দিয়ে ঘষটে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কেশব- চিৎকার করে উঠলেন মাতাঃ-।

“কাকে খুঁজছ, বনমালী? দেবী যশোদাকে?” রিনরিনে এ নারী কণ্ঠ, বড় চেনা, দমবন্ধ হয়ে এল কেশবের, অসহ্য বেদনায় ফেটে পড়তে চাইল বুঝি হৃদপিণ্ড। অজান্তে বন্ধ হয়ে এল দুই আঁখি। একি স্বপ্ন? না সত্যি? যদি স্বপ্নও হয়, এ স্বপ্ন যেন কখনও না ভাঙে। রমণী বলে উঠল, “তুমি চলে যাবার পর, বেশী দিন বাঁচতে হয়নি মাতা যশোদাকে। তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে অকালেই হারিয়ে ফেলেছিলেন দৃষ্টিশক্তি, তারপর একদিন সকলের অজান্তে চলে গেলেন, শুনেছি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তোমাকে খুঁজে ছিলেন দেবী যশোদা।” তারপর দীর্ঘ নীরবতা। নীরবতাও এমন বাঙময় হয়, ইতিপূর্বে জানতেন না কেশব। ইচ্ছে করছে শিশুদের মত ডুকরে ডুকরে কাঁদতে। ইচ্ছে করছে, দৌড়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করতে প্রিয়তম নারীকে, কেশবের প্রথম প্রেম, রাধারানী!


পর্ব- ৩

সাহস হচ্ছে না নয়ন মেলার, তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করছে,যদি জননীর মত হারিয়ে যান রাধারানীও। মুদ্রিত নয়নেও অনুভব করছেন, সামনেই হাঁটু মুড়ে বসে আছে রাধারানী, ঠিক যেমন করে  বসত, বৃন্দাবনের মধুর দিনগুলিতে। রাধারানীর তপ্ত নিশ্বাস স্পর্শ করছে, কেশবের চিবুক। আনমনে কিছু ভাবছে রাধারানী। অভিমান হলে এমনই করত, কয়েক মুহূর্ত না কি কয়েক যুগ কেটে গেল, জানেন না কেশব, কথার পর জমছে কথা, কিন্তু বলতে পারছেন না বনমালী, দুষ্ঠ শুষ্ক জিহবা যেন ষড়যন্ত্র করেছে ওষ্ঠ আর অধরের সাথে, আর বলবেনই বা কি? মার্জনা চাইবেন? এতগুলি বৎসর পার করে? বলতে পারবেন কি কেশব, যে রাধারানীর প্রতি তাঁর সেই দুর্দম-দুর্মর প্রেম আজও অটুট। কেশবের হৃদয়ের গভীর-গোপন প্রকোষ্ঠে বাস করেন শুধুই রাধারানী। প্রিয়তমা মহিষীদের সপ্রেম সাহচর্য, অর্জুন তথা সখী কৃষ্ণার উষ্ণ বন্ধুত্ব, অনুগত মুগ্ধ স্তাবকদের স্তুতি কিছুই ততটা গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে না কেশবকে, যে ভাবে ছুঁয়ে থাকেন রাধারানী। দেবী রুক্ষ্মিণী ছাড়া কেউ জানে না,  কেউ অনুভব করেনি, কেশবের হৃদয়ের গোপন ব্যথা। বললে কি বিশ্বাস করবেন রাধারানী? 

“একটিবারও তাকালে না, একটি প্রিয়সম্বোধন পর্যন্ত করলে না, শৈশবের সখীকে?  ব্রজবাসীদের মত তুমিও তাহলে মুখ ফিরিয়ে নিলে বনমালী? আচ্ছা আমরা দুজনেই তো একই দোষে দুষ্ঠ বনমালী, তাহলে যে সমাজ তোমার অর্চনা করে, তারাই কেন আমায় কলঙ্কিনী বলে সম্বোধন করে বনমালী? আমার দেহে রাজরক্ত নেই বলে? আমি মূর্খ গোপিনী বলে? নাকি আমি নারী বলে? তুমি তো চলে গেলে বনমালী রাজরথে চড়ে মথুরা, একটি বার ফিরেও তাকালে না, অভাগীর দিকে, তোমার অবর্তমানে আরও কয়েকজন এসেছিল রাধারানীর নাগর হতে-।” আর সইতে পারলেন না কেশব, দুহাতে কান চেপে ধরলেন কেশব, রাধারানীর মধু ঝরা কণ্ঠ যেন তপ্ত শলাকার মত, প্রবেশ করতে লাগল কর্ণকুহরে।

“ওমা, কানে হাত দিলে কেন গো? তাই তো হয়, অভিসারিকা, পরপুরুষ অনুগামিনী নারী মানেই তো বহুভোগ্যা। সমাজ তো তাই মনে করে বনমালী, প্রথম কিছুদিন তোমার ভয়ে তারা সাহস পায়নি, তারপর লুকিয়ে আসতে লাগল প্রস্তাব। যে সখীরা এককালে তোমার প্রেম সম্ভাষণ বহন করে আনত, তাদের হাতেই আসতে লাগল, কামুক পুরুষদের অভিসারের প্রস্তাব। জানো আর্যাবর্ত্য থেকেও ছুটে এসেছিল জনা কয়েক রাজপুরুষ, ‘কে সেই রমণী, যার প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং কেশব’। তাঁরা আসত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে, আর আমি ছুটে যেতাম তোমার সংবাদ পাবার আশায়। নির্বোধ মূর্খ রাধারানী। সতী লক্ষ্মী গোপিনীরা পরামর্শ দিয়েছিল, দড়ি-কলসি নিয়ে যমুনার কালো জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সে চেষ্টাও করেছিলাম জানো, পারিনি বনমালী। কেবলই মনে হত, আমি চলে যাবার পর, যদি তুমি আসো, তাহলে কি হবে? মাতা যশোদাও তো নেই, আমিও যদি না থাকি, বড় দুঃখ পাবে আমার বনমালী। দেবী রুক্ষ্মিণীর সাথে তোমার বিবাহের সুসংবাদ পেয়েছিলাম, বহুদিন পর, সংবাদ পেয়েছিলাম, দেবী কৃষ্ণার সাথে তোমার সখ্যেরও। দুষ্ঠ দুঃশাসন যখন পরিপূর্ণ সভাগৃহে বিবস্ত্র করতে উদ্যত হয়েছিল, দেবী কৃষ্ণাকে, কি ভাবে নিজের উত্তরীয় জড়িয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলে তুমি বনমালী, চারণ কবিদের গানে গানে শুনেছিলাম সে গল্পও। গর্ব হয়েছিল খুব। এভাবেই বেঁচে ছিল রাধারানী জানো। তোমার কথায়, তোমার গানে। আর তারপর, তারপর একদিন বন্ধ হয়ে গেল সব গল্প, শুনলাম, তুমি সপরিবারে মথুরা ছেড়ে চলে গেছ, বহু বহু দূর দ্বারকা। দপ করে নিভে গেল সব আলো, যমুনার কালো শীতল জল, ডেকেছিল সেদিন-। যেতে গিয়েও পারেনি রাধারানী, যদি ফিরে আসে বনমালী-, কি মূর্খ, কি মূর্খ ছিলাম বল। হতভাগিনী মূর্খ রাধারানী।”

আর পারলেন না কেশব, দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে গেলেন প্রিয়তমা রাধারানীকে, অসীম শূন্যতা ছাড়া কিছুই ধরতে পারলেন না কেশব, খিলখিল করে হেসে উঠল কেউ, হতভম্ব হয়ে নয়ন উন্মোচন করে দেখেন সামনেই বসে আছে এক বালিকা, কতই বা বয়স হবে, সদ্য বসতে শিখেছে হয়তো। এই গভীর অরণ্যে এই শিশুটি কোথা থেকে এল, কর্তব্যপরায়ণ কেশবের কপালে পড়ল গভীর খাঁজ। বালিকাটি অবশ্য দিব্যি খুশির মেজাজে আছে, খিলখিল করে হেসেই চলেছে। মানসিক বেদনাকে সংযত করে, কেশব প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে কন্যা? এই অরণ্যে কি করে এলে মাতা?” 

“ কন্যা, বালিকা, মাতা- এসব কি বলছ কেশব? আমরা তো সমবয়সী। একই সাথে জন্মেছিলাম দোঁহে। কেন তুমি জানো না?” স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল শিশুকন্যা।  


পর্ব-৪

মস্তিকের কোষে কোষে নামছে অসীম ধোঁয়াশা। তীব্র মনোবেদনায় ফেটে পড়তে চাইছে হৃদয়। এ হৃদয় তো কোন দুর্বল পুরুষের হৃদয় নয়। তাহলে? কণ্ঠমূলে এমন অসীম বেদনা কেন? কেন ঝাপসা দুই আঁখি। দুই চোখে তার সীমাহীন কৌতুক নিয়ে নীরবে তাকিয়ে আছে সম্মুখস্থ শিশুকন্যা,  না জানি কত শত-সহস্র বৎসর ধরে। বড় সুমিষ্ট মুখখানি। তপ্তকাঞ্চনবর্ণা নন, তবে গৌরবর্ণা, ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঢেউ খেলানো ঘোরকৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ। বড় চেনা এই মুখ। বিশেষতঃ ঐ ভ্রুকুটি খুবই পরিচিত, খুব আপন, কারো সাথে যেন বড় বেশী মিল-। প্রায় মুছতে বসা স্মৃতির পাতায়, কোথায় যেন লুকিয়ে আছে মেয়েটি। “কন্যা, তোমার মাতা-পিতা কোথায়? এই গভীর বনানীর মাঝে, কে ছেড়ে গেছে তোমায়?”

“তুমি আমায় চিনতে পারছ না কেশব?” খিলখিল করে হেসে উঠল রহস্যময়ী বালিকা। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁক পাড়ল, “মাতা, পিতা”। সুবিশাল মহীরূহের পিছন থেকে যাঁরা বেরিয়ে এলেন, তাঁদের দেখে মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কেশবের হৃদপিণ্ড। 

সস্নেহে শিশুকে কোলে তুলে নিলেন মাতা যশোদা, স্নেহচুম্বনে ভরিয়ে দিলেন শিশুর লালচে ওষ্ঠাধর। এই যশোদা নেহাতই তরুণী, পাশে হাস্যমুখে যিনি দণ্ডায়মান তাঁর সমস্ত মনোযোগ শিশুকন্যার উপর,ফিরেও তাকালেন না সাধের গোপালের দিকে। বরাবরই কিছুটা দূরত্ব রেখেই মিশেছেন নন্দলাল। মাতা যশোদার মত অনাবিল ছিল না ওণার স্নেহ। নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়নতার অভাব না থাকলেও, কোথায় যেন মিশে ছিল সম্ভ্রম মেশানো দূরত্ব। অন্যান্য পিতাদের মত কখনই শাসন করেননি নন্দলাল। কখনই চোখে রাখেননি চোখ, সামনাসামানি হলেও নত করে রাখতেন মস্তক। নির্বাক হয়ে পূরণ করতেন কেশবের তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাহিদা। এমনকি মাতা যশোদা শাসন করলেও, আপত্তি জানাতেন নন্দলাল। কারণটা বুঝতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলি বছর- 


 নীলাভ হলাহলের মত, তীব্র ঈর্ষার বিষ ছড়িয়ে পড়ল শোকস্তব্ধ কেশবের শিরাউপশিরায়। নন্দলালে ঔরসে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেননি, এটা তাঁর দুর্ভাগ্য। তাই বলে অন্য ভাগীদার মেনে নেবেন না কেশব। যে যাই বলুক,তিনি,  তিনিই এনাদের একমাত্র সন্তান। এনাদের যাবতীয় স্নেহ-মায়া- ভালোবাসার একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী।  

এই কন্যা কে? কোথায় ছিল এতকাল?  “মাতা- পিতা” বলে হেঁকে উঠলেন কেশব। তাঁর অার্ত কন্ঠ হাহাকারের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল সমগ্র বনানী জুড়ে। 

“তুমি আমায় চিনতে পারছ তো কেশব? একই সাথে জন্ম আমাদের, যমুনার এপারে-ওপারে। প্রসববেদনায় কাতর মাতা সাময়িক ভাবে হারিয়ে ছিলেন সংজ্ঞা। তাঁর ক্রোড় থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় আমায়। বড় ভীরু ছিল আমার পিতা। আদর্শ প্রজা। বড় বিশ্বাস, বড় ভক্তি করতেন তোমার পিতাকে। তোমার পিতা আশ্বাস দিয়েছিলেন, কটা দিনের ব্যাপার মাত্র। সিংহাসনের ওপর যেহেতু নারীর অধিকার স্বীকৃত নয়, তাই কন্যাসন্তানকে কখনই দাবীদার হিসেবে দেখবেন না যুবরাজ কংস। সবই আপ্তবাক্য ছিল হে কেশব। সবই আপ্তবাক্য ছিল। পিতা বুঝেও আপত্তি করার সৎসাহস জোটাতে পারেননি।  যুবরাজ কংস, বিকৃত মস্তিষ্ক হলেও নির্বোধ ছিলেন না। আরে এতো সোজা হিসেব কেশব, ধরো আমি সিংহাসন দাবী না করতে পারলেও, কাল আমার হবু স্বামী তো করবেই, অথবা পরশু আমার প্রথম পুত্র? তবুও স্তোকবাক্য দিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয়,তোমাদের প্রাসাদে। তোমার জননী, দেবী দেবকী, তোমার শোকে মূহ্যমানা।  ক্ষণিকের জন্যও আমায় জড়িয়ে ধরেননি বক্ষে। একটি বারের জন্যও ওষ্ঠে ধরেননি অমৃতধারা।  ক্ষুধার্ত, প্রবল বর্ষণে, সিক্ত আমি থরথর করে কাঁপছিলাম, দুই নিদ্রাতুর আঁখি খুঁজে বেড়াচ্ছি মাতাকে। আমার স্নেহময়ী জন্মদাত্রী। কোথায় তিনি? ডুগরে কেঁদে উঠলাম আমি, “মাতা- মাতা- মাতা। ”ছাপোষা গোপালকের শিশুকন্যার আর্তনাদ ধ্বনিত হল তোমাদের প্রাসাদ জুড়ে। ঘোষিত হল যুবরাজ কংসের আগমনবার্তা। পলকে আমায় বক্ষে ধারণ করলেন তোমার জননী। তাঁর হৃদয়জুড়ে শুধুই তুমি কেশব। তোমার মঙ্গলাকাঙ্খায় থরথর তাঁর হৃদয়। কি নিপুণ অভিনয়টাই না করলেন তিনি। যুবরাজ কংস যখন চেপে ধরলেন আমার ক্ষুদ্র শ্বাসনালী,নীল বর্ণ ধারণ করল আমার মুখমণ্ডল কেমন আছাড়িপিছাড়ি কান্নাটাই না কাঁদলেন তিনি। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তোমার পিতাও। এমন তো কতই হয়। রাজার দুলালের প্রাণ বাঁচাতে নাহয় ঝরলই খানিক রক্ত। দীন গোপালকের কন্যার প্রাণের আর কি মূল্য আছে? অন্তিম মুহূর্তেও আমার জননীকেই খুঁজেছিলাম আমি কেশব-”।  


আর সইতে পারলেন না কেশব, আগাছা ভরা অরণ্যের মাটিতে ঠুকতে থাকলেন মস্তক। “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। নিজের প্রাণ দিয়েও যদি ফিরিয়ে দিতে পারতাম তোমার জীবন- । ” “একি কেশব, তুমি কাঁদছ?” রাজ্ঞী রুক্ষিণীর পেলব স্পর্শে ঝটিতি ভেঙে গেল নিদ্রা। চোখ খুললেন কেশব, পূব আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে হাল্কা লালিমা, বাতায়ন পথে ভেসে আসছে আরামদায়ক পুষ্প সুরভিত জোলো সামুদ্রিক বাতাস। মাথার উপর স্বচ্ছ দুগ্ধফেননিভ চন্দ্রাতপ। আপন দারুপালঙ্কে শায়িত আছেন কেশব। সুগন্ধী মিশ্রিত ঘিয়ের প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। আধো অন্ধকারেও ভাস্বর রাজ্ঞী রুক্ষিণীর অনুপম রূপ। উদ্বিগ্না রাঞ্জী পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “কেশব? কাঁদছ কেন কি হয়েছে?” জবাব দিতে পারলেন না কেশব, নীরবে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন প্রিয় মহিষীকে, তারপর তাঁর কর্ণকুহরে ফিসফিস করে বললেন, “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। ” বাতায়নের ওপারে ঘোর অন্ধকার আকাশের বুকে তখন আঁকিবুকি কাটছে ঊষার লালিমা। ফুটে উঠছে একরাশ চেনা মুখ, যাদের চেনেন শুধু কেশব আর চেনে প্রকৃতি। বেদনার্ত প্রতিটি মুখ, ভ্রুকুটিতে লুকানো একরাশ অভিমান, আর হৃদয়ে শুধুই প্রেম। কৃষ্ণ প্রেমে ভাস্বর প্রতিটি চরিত্রের ওষ্ঠাধরে একটিই প্রার্থনা। ভালো থেকো কেশব। শুভ জন্মদিন।