সপ্তাহান্তেও কি যে অসভ্যের মত ভিড় পথেঘাটে। ট্রেন না চলার মাসুল গুনছে রাজপথ। দেহ রেখেছে হাওড়া আর হুগলী জেলার সংযোগ রক্ষাকারী মাইতি পাড়া ব্রীজ। বিগত চার বছর ধরে জ্বালিয়ে খাচ্ছে ডানকুনি সংলগ্ন এই সেতু। আর এখন তো যানবাহনের অত্যাচার আরো অনেকবেশী। জীবিকার টানে প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বাইক ছুটে চলেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহানগরের পানে। পরিসংখ্যান কি বলে জানি না, তবে যাওয়া-আসার মাঝে অন্তত গোটা দুই দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করি রোজই। শুধু যে বাইকগুলি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় তা নয়, যত্রতত্র মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ট্রাক, কে জানে কাকে বাঁচাতে ডিভাইডারে উঠে পড়ে- আজ দেখি রাজপথে টাল খেয়েছে পটল বোঝাই গাড়ি। স্টিয়ারিং থামিয়ে বাপি বলল, “কত লোকে পটল তুলছে ম্যাডাম-”। ক্রুদ্ধ স্বরে বলি, “যার ইচ্ছে তুলুক। তোমার আর পটল তুলে কাজ নেই। ”
বেলা বাড়ছে, এগারোটা নাগাদ মহেশ্বরপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা চঞ্চল আর কৌশিকের। আমার দুই আদুরে ইন্সপেক্টর। ইন্সপেকশনে যাব তিনজনে মিলে, সারপ্রাইজ ইন্সপেকশন। পটল-জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি উঠল দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে। মাখনের মত মসৃণ ছিল কিছুকাল আগেও, করোনার অত্যাচারে তরুণ ওম পুরীর গালের মত চেহারা হয়েছে।
মহেশ্বপুরের কাছেই আছে একটি আন্তর্জাতিক স্তরের ব্রুয়ারি। ধনিয়াখালীর প্রচুর মানুষ কাজ করে ওখানে। বিভিন্ন শ্রম আইন তথা শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্যায় ওণারা প্রায়ই যোগাযোগ করেন আমাদের সাথে। কাকতালীয় ভাবে ওণাদের নতুন অধিকর্তা আবার আমাদের পাড়ার ছেলে। সদ্য জয়েন করেছে, অন্য নামী ব্রুয়ারি থেকে-। ফাঁকা থাকলে ব্রুয়িং সম্পর্কে নানা গল্প শুনিয়ে যান ওণারা। মল্টটা আসে বিদেশ থেকে। দিশী খুদের সাথে, বিলাইতি মল্ট মিশিয়ে পচিয়ে তৈরী হয় বিয়র। এক্সাইজ ডিউটি বেড়ে যাওয়ায় বিগত বছর থেকে খুব চাপে ছিলেন ওণারা। কমছিল বিক্রি। এই প্রসঙ্গে ওণারা নিজেরাই বলতেন, “এত দাম দিয়ে বীয়র কেন খাবে মানুষ, দামী হুইস্কি খাবে-”।
স্ট্রং বিয়রের থেকে লাইট বিয়র কেন ভালো, সেই প্রসঙ্গেও লম্বা লেকচার দিয়েছিলেন বটে, আমি যথারীতি ভুলে মেরেছি। তবে ওণাদের ব্রাণ্ড আমার বর এবং বন্ধুবান্ধবদের ভয়ানক প্রিয়। ব্রহ্মদেশে বেড়াতে গিয়ে জনৈক মায়নমার বিয়র খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, পরে যেদিন ওণারা দেখা করতে এলেন, কথায় কথায় শোনালাম ব্রহ্মদেশী বিয়রের গল্প, ভাবলাম চমকে যাবেন হয়তো। ভদ্রলোক মুচকি হেসে জানালেন, মায়নমার বিয়রও আসলে ওণাদের কোম্পানীরই তৈরী।
আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম বিশাল বন্ধ গেটের সামনে, মাস্ক ফেসশিল্ড পরা নিরাপত্তা রক্ষী এসে ড্রাইভারের তাপমাত্রা মাপল। মুণ্ডু গলালাম, কাঁচ নামিয়ে, ইশারায় জানাল দরকার নেই। কাঁচ উঠিয়ে গোটা গাড়িতে স্যানিটাইজার স্প্রে করা হল। বিশাল সাজানো কমপ্লেক্স। খবর পেয়ে ছোট বড় সাহেবরা দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশেপশনে। ইন্সপেক্টর সাহেবরা তাঁদের সাথে কাজের কথা বলতে লাগলেন, আমার নজর কাড়ল রিশেপসনে রাখা সুদৃশ্য অ্যাকোয়ারিয়ামটি। ভিতরে জাম্বো সাইজের গুটি কয় মাছ কেবল। যাদের কারো রঙ সোনালী কমলা, কারো কাঁচা হলুদ। তাঁরাও এগিয়ে এল আমায় দেখতে, অবাক হয়ে দেখলাম, দুই চোখের মাঝে একটি সুস্পষ্ট নাক বিদ্যমান। পিছন থেকে জনৈক অধিকর্তা জানালেন এই মাছের নাম প্যারট ফিশ।
অ্যাকোরিয়াম তো আমাদের আপিসেও একখানা আছে, ভেসে বেড়ায় গুটি কয় লাল-কালো-হলুদ মাছ। নিয়মিত শ্যাওলা পরিষ্কার করে রমেশ। সকাল বিকাল খাবার দেয় অজিত দা। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাথাতেই পেপসির খালি বোতলে রাখা, দুর্গন্ধী গুলি, ঐ খায় আমাদের মাছ। কিন্তু এমন সুন্দর মোটু মাছ তো আমাদের নেই। কৌশিককে জানালাম, এমন মাছ আমাদেরও চাই। জবাব পেলাম ঐ মাছের দাম সাত থেকে আটশত টাকা। তাও পুঁচকে হবে। ধেড়ে হতে লাগবে দু-তিন বছর। অত দিন থোড়াই এই শহরে থাকব আমি-
মনখারাপী মন নিয়ে ফ্যাক্টরীতে ঢুকলাম। ওণারা জানতে চাইলেন সেফটি শ্যু চাই কিনা। যদি পায়ে কিছু লেগে টেগে যায়। প্রায় দেড় তলা হিলতোলা জুতো পরি, ওসবে ভয় পাই না।
ফ্যাক্টরীর ভিতরটা বিশাল, তুলনায় শ্রমিক খুব কম। কোভিডের জন্য খুব অল্প সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কাজ চলছে, খুব ভয়ে থাকেন ওণারা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “আপনারা তো অ্যালকোহল বানান, কোভিডকে আপনাদের কি ভয়?” ওণারা হেসে জবাব দিলেন বীয়রে অ্যালকোহল এমনিতেই কম থাকে। ওতে কোভিডের টিকিও বাঁকে না।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন পুরো প্ল্যান্ট। মল্ট আর খুদ আলাদা আলাদা মেশিনে ঝাড়াই-বাছাই হয়। ধুলো- কাঁকড়, টুকরো লোহা বা ধাতু যদি থাকে, তা বেছে ফেলে, তার সাথে ইস্ট পচানো হয়। তারপর ছাঁকাই হয়। মাঝে আরো অনেক কিছু হয় বটে, সব ভুলে মেরেছি যথারীতি। তবে এটুকু মনে আছে, যেখানে পচাই হয়,বিটকেল গন্ধ মাইরি। পুরোটাই অটোমেটেড প্রসেস, সেটাও দেখালেন ওণাদের অপারেটর। দেখালেন কোভিড রুখতে কত কিছু করেছেন ওণারা। থার্মাল চেকিং, স্যানিটাইজার, সকাল-দুপুরে মাস্ক পাল্টানো ছাড়াও, উড়িয়ে দিয়েছেন সব দরজার হাতল। ওখানে সব দরজা পা দিয়ে খোলা হয়। বসিয়েছেন সেন্সরড স্যানিটাইজার ডিসপেন্সার। তলায় হাত পাতলেই ঝরে পড়ছে সুগন্ধী তরল। অফিস বাস এবং ক্যান্টিনে মার্কা করা আছে, যাতে কেউ পাশাপাশি না বসে। এমনকি হাত ধোবার জায়গাতেও কল খুলে ফেলা হয়েছে। বদলে বসানো আছে পাম্প। পায়ের চাপ দিলেই ঝরবে জল। ওনাদের ব্যবস্থাপনা দেখে রীতিমত সমীহ হচ্ছিল।
ইন্সপেকশন সেরে বেরিয়ে আসার সময় ওণারা দুঃখ করলেন, পরিস্থিতি যদি আগামী কালও স্বাভাবিক হয়ে যায়,তাও এবছর মাত্র ১২-২০শতাংশ ব্যবসা হবে। লাভ তো ছেড়েই দিন। জানালেন এটা শুধু বাংলা নয়, সারা ভারত তথা বিশ্বের চিত্র। একধাক্কায় প্রায় দেড় থেকে দুই দশক পিছিয়ে গেছে পৃথিবী।
বেরিয়ে এলাম মধ্যাহ্নে। পরবর্তী গন্তব্যস্থল কাকগাছির আরেকটি ফ্যাক্টরী। এখানে প্যাকোজিং এর কাগজ আর কার্ডবোর্ডের বাক্স তৈরী হয়। না থার্মাল গান ঠেকালো নিরাপত্তা রক্ষী, না কেউ জানতে চাইল কি চাই-। বিশাল কারখানার শেডে গরগর করে চলছে মেশিন, বের হচ্ছে করোগেটেড কাগজ। যাঁরা কাজ করছেন, না আছে তাঁদের মুখে মাস্ক, না আছে কোন সামাজিক দূরত্ব। দুই ইন্সপেক্টর সাহেব প্রবল হম্বিতম্বি করাতে কোথা থেকে যেন নোংরা রুমাল বার করে মুখে জড়ালো কয়েকজন। বাকিরা দৌড়ল বড় সাহেবকে ডাকতে। যিনি এলেন তিনি এসেই হাউমাউ জুড়লেন। “সব ব্যাটাকে মাস্ক দেওয়া হয়েছে। কেউ পরে না। দেখুন না স্যার-।”চঞ্চল ধমকালো, তা সেই মাস্কগুলো কই? স্যানিটাইজারই বা কই, ম্যানেজার বাবু দৌড়লেন স্যানিটাইজারের বোতল আনতে, রাগতে গিয়েও কেন জানি না, হেসে ফেললাম, আন্তর্জাতিক কোম্পানীর চকচকে ব্যাপার তো বিরলতম দৃশ্য, এই না হলে আমার দেশ।
No comments:
Post a Comment