আপিস থেকে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকেই মস্ত বড় লিস্টটা ধরিয়ে দিল তুত্তুরী। সারাদিন ধরে, দীর্ঘ ভাবনাচিন্তা করে লিখেছে আর কেটেছে। বিষয়, আসন্ন পুজোয় কি কি খাবে, আর কি কি করবে। যার মধ্যে নাগরদোলাটা তৎক্ষণাৎ বাতিল হল। কেন? ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল তুত্তুরী। জানালাম, নাগরদোলা হল, সংক্রমণের আঁতুরঘর। পরের প্রশ্ন, আবার “কেন? আমরা তো আলাদা চেয়ারে বসব।” উত্তরে ধৈর্য ধরে বোঝাতে উদ্যত হই, আমাদের আগে, পরে কত লোক ঐ চেয়ারে বসবে। ওরা কি স্যানিটাইজ করে বসতে দেবে আমাদের? কচু। ঘেঁচু এবং ঘন্টা। চোখ গোলগোল করে তাজ্জব স্বরে বলে ওঠে কন্যা, “বাপরেঃ। পোঁ ইয়ে মানে পশ্চাৎদেশ দিয়েও সংক্রমণ হয়?” হাসব না স্যারিডন খাব বুঝতে পারি না। তবুও বোঝাই, বসার চেয়ার নয়,ধরার রডটা বেশী বিপজ্জনক ইত্যাদি,প্রভৃতি।
নাগরদোলা বাদ গেল বটে, টিকে রইল বেলুন। ষড়যন্ত্রের সুরে, “দাদার থেকে, আমার বেলুনটা যেন বড় হয়-”। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বাবু, আগামী নভেম্বরে টিন এজে পদার্পণ করবেন। বয়সের তুলনায়, তিনি ভয়ানক সাদাসিধে, হাবলা-গোবলা বটে,তবে বেলুনে তাঁর ছিঁটেফোঁটাও উৎসাহ নেই। তবুও-
নাগরদোলা-বেলুনের পর শুরু হল, প্রস্তাবিত খাদ্যতালিকা, যা দুই ভাইবোনকে খাওয়াতে হবে, সূত্রপাত হল, বুড়ির মাথার পাকা চুল দিয়ে। চিনতে পারলেন না তো। যাকে পরিশীলিত ফিরিঙ্গী ভাষায় কয়, কটন ক্যাণ্ডি বা ক্যাণ্ডি ফ্লজ। আচ্ছা এরপর পর্যায়ক্রমে আসছে ফুচকা, চটপটি, এগ এবং চিকেন রোল, হাওড়া ময়দানের মাটির ভাঁড়ে পুরু মালাই দেওয়া লস্যি, মামমাম (দিদা) এর হাতে বানানো চাম্মিন (চাউমিন), কস্তুরীর লাল ক্ষীরের মত দই, চাউমিন এর পুর দেওয়া সিঙারা, শেঠ সুইটসের কালো গজা, অন্নপূর্ণার কেঁদো কেঁদো জিলিপি-
ফর্দ শেষ হতে বোধহয় আরো সময় লাগত, যদি না, মোক্ষম সময়ে, শৌভিক তার মোবাইলটা না বাড়িয়ে দিত, “দ্যাখ, বুজুর জন্য আমার ভিডিও সাজেশনে কি এসেছে-”।
এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায়শই ঘ্যানঘ্যান করে আমার বর। বাপ-মেয়ে দুজনেই ইউটিউবের চরম অনুরাগী। আমার ফোন নিয়ে পড়াশোনা চালায় বটে, মাঝেসাঝে বন্ধুরা ভিডিওকল করলে,উৎফুল্ল চিত্তে বার্তালাপও করে, তবে এসব আব্দার আমার কাছে চলে না। বাবুজী স্বয়ং সোহাগ করে ফোনটা তুলে দেয় মেয়ের হাতে, তারপর শুরু হয় ঘ্যানঘ্যান- “আর আমি কোনদিন ওকে মোবাইল দেব না। কি সব দেখে বেড়ায়, উল্টোপাল্টা চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে। তারপর সেগুলো আমার সাজেশনে আসতে থাকে।”
খুব বেশী উল্টোপাল্টা দেখে না তুত্তুরী, জনৈক প্যারট দীপঙ্করের বিরাট অনুরাগী। মাঙ্কা বলে এক বকবকে কাকাতুয়া আছে, প্যারট দীপঙ্করের, ভারী দাম্ভিক। নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই বলে না সে, তবুও তুত্তুরী তার জন্য পাগলপারা। সারাদিন “মাঙ্কা-মাঙ্কা” করে মাঙ্কার ভাষায় কথা বলে চলে।
এছাড়া জনৈক ’গ্রাণ্ডপা‘র প্রতিও অনুরাগ জন্মেছে তুত্তুরীর। গ্রাণ্ডপা অবশ্য মারা গেছেন, তবে তাঁর চ্যানেলটি আছে। তিনি জীবিত অবস্থায়, স্বহস্তে রেঁধে পথশিশুদের নানা সুখাদ্য ভক্ষণ করাতেন। আধো আধো স্বরে জানাতেন কি ভাবে রাঁধছেন- তিনি মারা যেতে বেশ কিছুদিন কেঁদেছিল তুত্তুরী। বারবার বুড়ো বুড়ো উচ্ছারণে আধো আধো ইংলিশে গ্রাণ্ডপাকে নকল করে দেখাত, “লাভিং-শেয়ারিং-কেয়ারিং- দিজ ইজ মাই ফ্যামিলি।” গ্রাণ্ডপার তনয় সম্প্রতি চ্যানেলটি নতুন করে চালাচ্ছে।
এছাড়া তুত্তুরী দেখে খুচখাচ কার্টুন আর চরম বোকাবোকা ধাঁধা। যেমন পাঁচটা বাচ্ছা বা গর্ভবতী মহিলার ছবি দেওয়া থাকে, তার তলায় লেখা থাকে, “এদের মধ্যে কে ভূত?” লোভে পড়ে আমি একবার দেখেছিলাম, যার ছাওয়া পড়ছে না, সেই ভূত বলে,হো হো করে হেসেছিল ভাষ্যকার। এত রাগ হয়েছিল-
তুত্তুরী শুধু দেখে তাই নয়, শৌভিকের চরম বিরাগজনক হওয়া সত্ত্বেও এই সাংঘাতিক বোকা বোকা জিনিসগুলো লাইক করে। মাঝেসাঝে, ধাঁধার উত্তরগুলি কমেন্টও করে। এই নিয়ে নিত্য চুলোচুলি আমাদের সংসারে। তবে আজকে স্ক্রীণে যা দেখলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদয়। এসব কি দেখছে আজকাল?
আমার হতভম্ব দশা থেকে ফুলে ফুলে হাসছে শৌভিক, আর তুত্তুরী ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। কি? কি এসেছে বাবার ভিডিও সাজেশনে। বেশ খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আর শৌভিকের হাসি দেখে বুঝলাম, ওটি আদতে, “গর্ভবতী চুড়েল”। যিনিই বঙ্গানুবাদ করেছেন, তাঁর খুরে খুরে নমস্কার। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মরলে আপনার কোমরে দড়ি পড়ত- উফঃ। যত্ত আপদের দল।
পুনশ্চ তুত্তুরী দেখে-টেখে জানাল, যে ওগুলো ও ছোটবেলায় দেখত। এখন আর দেখে না। আপাততঃ শুধুই “মাঙ্কা-মাঙ্কা”।
No comments:
Post a Comment