Tuesday, 11 August 2020

শুভ জন্মদিন (জন্মাষ্ঠমী ২০১৯)


শুভ জন্মদিন- 

সারা দেহ জুড়ে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে যেন শত সহস্র তপ্ত শলাকা। তীব্র বেদনায় ছটফট করতে করতে চোখ খুললেন তিনি। চোখ খোলা মাত্রই ধড়ফড় করে উঠে বসতে গেলেন কেশব, পারলেন না। পদতল থেকে কোমর পর্যন্ত তীব্র বেদনায় অসাড়। দাঁতে দাঁত চেপে উঠে আসা আর্ত চিৎকারকে পুনরায় গিলে ফেললেন তিনি। যদিও তিনি ক্ষত্রিয় নন, তবে দীর্ঘদিন ক্ষত্রিয় সাহচর্যে থাকার ফলে, তুচ্ছ শারীরিক বেদনায় কাতর হওয়া তাঁর ধাতে নেই। যাতনায় কাতর হয় নারী, পুরুষের পক্ষে তা অত্যন্ত অগৌরবের। পুরুষ তো সিংহ।

পুনরায় শুয়ে পড়ে, কিছুটা ধাতস্ত হয়ে চোখ খুলে হতবাক হয়ে গেলেন কেশব। এ কোথায় শুয়ে আছেন তিনি? কোথায় তাঁর দুগ্ধফেননিভ পুষ্পসুরভিত সুকোমল শয্যা? কোথায় তাঁর অনুপম কারুকার্য খচিত দারুপালঙ্ক? কোথায় শ্বেতশুভ্র স্বচ্ছ চন্দ্রাতপ? কোথায় পটে আঁকা ছবির মত, মাধবীলতা শোভিত বাতায়ন, হুড়মুড় করে ঢুকে আসা সমুদ্র পবন, কোথায়ই দেবী লক্ষ্মীস্বরূপা রাজ্ঞী রুক্ষ্মিণী? বিগত রাতেও তো শুয়েছিলেন পাশাপাশি-  

আর এখন? একাকী শুয়ে আছেন কেশব, চন্দ্রাতপের পরিবর্তে মাথার উপর ঘোলাটে নীল আকাশ, আর বুড়ো বনস্পতির দল। দারুপালঙ্ক তথা সুকোমল শয্যার পরিবর্তে পিঠের তলায় অনুভব করলেন বালি আর কাঁকর। ভয় জাগানো অখণ্ড নীরবতায় আচ্ছন্ন চরাচর। পুনরায় উঠে বসার চেষ্টা করলেন কেশব, উঠতে তাঁকে হবেই, বের হতে হবে এই গভীর অটবী থেকে। ফিরে যেতে হবে প্রিয়জনদের মাঝে, কোন মতে দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে ঘাড়টাকে তুলতে পারলেও, উঠে বসতে পারলেন না তিনি। অসহ্য দৈহিক বেদনায়, মানসিক উদ্বেগে, অজ্ঞাতেই গণ্ড বেয়ে ঝরে পড়ল দুই ফোঁটা অশ্রু।  

“এ কি কেশব, তুমি কাঁদছ?” পেলব রমণী কন্ঠে চমকে উঠলেন কেশব। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কে? কে ইনি? বড় পরিচিত, বড় সুমধুর এই কণ্ঠস্বর। “দেবী?” কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন কেশব, বাকি কথা বলার আগেই অনুভব করলেন, কপালে কার স্নেহস্পর্শ। জুড়িয়ে গেল, সব বেদনা। তপ্ত শলাকাদের উপর দিয়ে যেন বয়ে গেল হিমশীতল জলধারা। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলেন কেশব।  সম্মুখে এক বয়স্কা অভিজাত নারী। সদ্য প্রস্তুত নবনীর মত গাত্র বর্ণ, আকর্ণবিস্তৃত হাল্কা নীলচে দুই চোখ, খড়গনাসা, তিরতিরে ওষ্ঠাধর। করবিবন্ধিত অযত্নলালিত পক্ক কেশরাজি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। নিরাভরণ। রঞ্জিত সীমন্ত। নারীর দুই নয়নে মৃদু কৌতুক। করজোড়ে প্রণাম জানালেন কেশব। বড় মোহময়ী এই নারী, বড়ই ব্যক্তিত্বময়ী। “ কে আপনি দেবী?” পুনরায় প্রশ্ন করলেন কেশব।

দুই নীলচে নয়নে উপচে পড়ল চাপা হাসি, “সে কি কেশব? চিনতে পারলে না? কতদিন আর, মাত্র তিন দশক আগেও দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে। অবশ্য, এই রূপে, এই গভীর অটবির মাঝে কখনও দেখা হয়নি।“ কেশবের মাথায় নামছে গভীর কুয়াশা। কে এই নারী? তিন দশক আগেও যার সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ হত? রমণী হেসে উঠলেন সশব্দে, “আচ্ছা এবার দেখো তো? চিনতে পারো কি না?” শুভ্র উত্তরীয় থেকে ছিঁড়ে নিলেন খানিকটা বস্ত্রখন্ড, বেঁধে নিলেন দুই পদ্মাক্ষীর উপর, পলকে আঁতকে উঠলেন কেশব, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলেন নারীর ধুলিমলিন চরণদ্বয়, হ্যাঁ তিন দশক, তিন দশক আগেই তো দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল এক রুধির সিক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। দেখা হয়েছিল অগুনতি প্রজ্বলিত গণচিতার সম্মুখে।যেখানে পচাগলা শবের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল শৃগাল-কুক্কুরদের সাথে শোকাকুলা সদ্য স্বামী-সন্তানহারা ক্রন্দসী রমণীকুল। সেখানেই নিজের অন্ধস্বামীর হাত ধরে, মৃত পুত্র-পৌত্র-দৌহিত্রদের শব খুঁজে বেরাচ্ছিলেন ইনি, চোখ বাঁধা থাকা সত্ত্বেও শুধু স্পর্শ দিয়ে কিভাবে যে ইনি চিনতে পারছিলেন আপন সন্তান-সন্ততিদের, এ এক দুর্বোধ্য রহস্য। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন, তারপর অন্ধ স্বামীর হাতটা টেনে স্পর্শ করাচ্ছিলেন শবের গাত্র, দিচ্ছিলেন পরিচয়। ককিয়ে উঠছিলেন বৃদ্ধ রাজা। তৎক্ষণাৎ আলিঙ্গনাবদ্ধ করছিলেন বৃদ্ধকে, দিচ্ছিলেন মৃদু সান্ত্বনা। মৃত্যুর ধ্বংসলীলার মধ্যেও বড় মধুর ছিল সে দৃশ্য। বড় মর্মস্পর্শী।

 স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল, কেশবের বুক থেকে, দেবী গান্ধারী মারা গেছেন, প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে, তাঁর সাথে এই বনানীর মাঝে সাক্ষাৎ হবার অর্থ একটাই, স্বপ্নে আছেন কেশব। আর স্বপ্ন আর কতক্ষণই বা টিকবে, এখুনি আলিঙ্গন করবেন নিদ্রাতুরা দেবী রুক্ষ্মিণী, এখুনি ভাঙবে এই ঘুম। 

হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলেন দেবী গান্ধারী, “এটা স্বপ্ন নয় কেশব। এটা ঘোরতর বাস্তব।” হাসি মুখে তাকালেন কেশবও। সেই ভুবনমোহিনী হাসি, যা ভুলিয়ে দেয়, সব ব্যথা, বেদনা, উষ্মা। “সামান্য শারীরিক যাতনা, সামান্য প্রিয়জন বিচ্ছেদেই কাঁদছিলে কেশব? আর আমি যখন সেদিন কাঁদছিলাম, আমি যখন স্পর্শ করছিলাম, একের পর এক মৃত শবের সারি, শিশুর মত কাঁদছিল আমার প্রিয়তম স্বামী, দৌড়ে গিয়েছিলাম তোমার কাছে নালিশ করতে, ‘একটাকে তো ছাড়তে পারতে? নাহয় ভিক্ষাই দিতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে’ তোমার মনে আছে কেশব? জবাবে কেমন হেসে উঠে ছিলে তুমি? কেন কেশব? কেন হেসেছিলে? সন্তানহারা বৃদ্ধার হাহাকারে কি এমন  কৌতুক ছিল কেশব?” নিরুত্তর রইলেন কেশব, নত হয়ে এল মাথা, আপন মনে বলে উঠলেন, বৃদ্ধা, “বড় ভালবেসেছিলাম তোমায় কেশব, বড় বিশ্বাস করতাম, নির্ভর করতাম। এ যাতনা তোমার থেকে স্বপ্নাতীত-”। 

“ভুল করেছিলেন, জানেন না, ওকে ভালবাসলে যাতনা অবধারিত। কি গোপাল তাই তো?“ বলে উঠলেন আরেক রমণী। বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণার জলতরঙ্গ উঠল কেশবের, সামনে উবু হয়ে বসলেন যে সজলনয়না রমণী, তাঁর বয়স বেশী না। বর্তমান কেশবের থেকে অনেক অনেক কম। মাঝারী উচ্চতা, মাঝারী গঠন, ঢলঢলে স্নেহমাখা দুই বেদনাতুর চোখ, কপালে অভিমানের গভীর ভাঁজ। এনার সাথে অন্তিম দেখা যেন কবে হয়েছিল? বোধহয় বিগত শতকে, যেদিন চলে আসছিলেন দুই ভাই বৃন্দাবন ছেড়ে, আকুলিবিকুলি কান্না জুড়েছিলেন এই রমণী, “না।না। না। যেতে দেব না। আজ তোমরা বলবে, ও আমার গর্ভজাত সন্তান নয়, আর আমি মেনে নেব? কে বলেছে আমি মৃতবৎসা? ও তো আমারই পুত্র? দেখো? দেখো? অবিকল আমার মত দেখতে, কাল অবধি তো তোমরাই বলতে গো, মাতৃমুখী ছেলে আমার, খুব সুখী হবে, আর আজ বললেই হল না কি? যে আমি ওর পালিকা মাতা? বুকে করে মানুষ করেছি আমি, রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি, অযথা ওর অমঙ্গল আশঙ্কায় ছটফট করেছি আমি, নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়েছি আমার গোপালের মুখে, তখন কোথায় ছিল তোমাদের ঐ রাজকন্যা দেবকী, আর আজ এলেন অধিকার সাব্যস্ত করতে, ওনার ছেলে?” কথা দিয়েছিলেন কেশব, জন্মদাতা মাতাপিতাকে কারাগারের বাঁধন থেকে মুক্ত করেই ফিরে আসবেন, তাঁর আসল মায়ের কোলে। হ্যাঁ আসল মা, আজও দেবী যশোদাকেই আসল মা বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কেশব।


পর্ব-২

কপালে করাঘাত করে কাঁদছেন জননী যশোদা, ঠিক যেমন করে কেঁদেছিলেন, যখন শিশু গোপালকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, মথুরা থেকে আগতা সুন্দরী দাসী পূতনা। মেরেই ফেলত হয়তো, যদি স্নেহান্ধ মাতা যশোদা দৌড়ে না আসতেন আরেকটি বার প্রাণাধিক গোপালের মস্তকচুম্বন করতে। প্রায়ই এইটা করত মাতা। একা ছাড়তেনই না গোপালকে, পূতনাও জানত, সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বহুদিন, তারপর সময়বুঝে আক্রমণ করেছিল নিদ্রিত গোপালকে। দুই হাতে চেপে ধরেছিল কচি শ্বাসনালী, ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠতে চেয়েছিল গোপাল, পারেনি। গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরোয়নি, ক্রমশঃ কমে আসছিল প্রাণশক্তি, নীল হয়ে উঠছিল যশোদার দুলাল। আচমকা চিলের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতা যশোদা, পূতনা অভিজ্ঞ গুপ্তচর, রীতিমত রণপটীয়সী। ছাপোষা গৃহবধূ যশোদা তার সাথে পারে কখনও? কোনমতে গোপালকে বুকে তুলে নিয়ে ছুটে পালাতে গিয়েছিল মাতা, পিছন থেকে চুলের মুঠি ধরে প্রাকারে মাথা ঠুকে দিয়েছিল পূতনা। একবার নয়। অগুনতি বার। মস্তক থেকে নেমেছিল রুধির ধারা, প্রবেশ করেছিল মাতার দুই চোখে, অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলেন মাতা যশোদা, তাও ছাড়েননি আদরের গোপালকে। জননীর বিকৃত ললাট আজও তার সাক্ষ্য বহন করে। 

   তারপর যতবার হামলা হয়েছে গোপালের ওপর, ললাটে করাঘাত করে, কেঁদে ভাসিয়েছেন জননী যশোদা। পুত্রের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কত যে উপবাস করতেন জননী, গোপালের নামে কোন কুকথা সহ্যই হত না জননীর। কোন ব্রজবাসী গোপালের নামে অভিযোগ জানাতে আসত, ঠিক এমনি করেই ললাটে করাঘাত করে কাঁদতেন জননী। “কেউ আমার গোপালকে দেখতে পারে না গো। মিথ্যি মিথ্যি নালিশ করে খালি।” ঠিক এমনি করেই কাঁদছিলেন জননী, যখন মথুরার দিকে গড়িয়ে ছিল গোপালের রথের চাকা। “ও গোপাল, যাস নে বাবা, যাস নে। মোরা ছাপোষা গোপালক, ওরা কুহকিনী। তোর চোখে কেমনি মায়াঞ্জন লাগিয়েছে দেখ-। যাসনে বাপ। যাসনে। আমি যে তোকে ছেড়ে বাঁচব না বাপ। বুড়ি মাটাকে ছেড়ে যাসনে। নাহলে আমাকেও নে চল বাপ-।”

“সেই যে গেলি গোপাল, বুড়ি মা টার একটা সংবাদও নিলি না? আমার শরীরের ভিতর তোকে পালন করিনি, এই কি আমার অপরাধ? নাকি আমি সামান্যা নারী, শরীরে রাজরক্ত নেই, এই আমার অপরাধ?” 

গলার কাছে দলা পাকানো অসহ্য বেদনা, দু চোখে অঝোর ধারাপাত নিয়ে দ্রুত আলিঙ্গন করতে গেলেন কেশব, “মাতা-”। কিন্তু কোথায় মাতা? কেউ নেই সামনে, যতদূর দৃষ্টি যায়, নির্জন বনানী। পাখি গুলিও বুঝি ভুলেছে কুজন। “মাতাঃ” চিৎকার করে উঠলেন কেশব, না,না,না আর হারাবেন না মাতাকে, মাতা বহুবার বলেছেন, কিন্তু কেশব কখনও বলে উঠতে পারেনি, আজ বলবেই, “বড় ভালোবাসি মাতা তোমায়, সেদিনও বাসতাম। আজও বাসি। আমৃত্যু তোমার গোপাল শুধু তোমাকেই  ভালোবাসবে। জীবন বড় দ্রুত দৌড়েছিল মাতা, ইচ্ছা আর কর্তব্যবোধে বেঁধেছিল তীব্র লড়াই, তোমার গোপাল, কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারেনি মাতা। তুমিই তো শিক্ষা দিয়েছিলে মাতা। গোপাল কোনদিন তোমায় ভোলেনি, এক দন্ডের জন্যও না। দেবী দেবকীকে শ্রদ্ধা করলেও, কখনও ভালবাসতে পারিনি মা, তোকে ছেড়ে কাউকে ভালবাসতে পারিনি মা।” কিন্তু মাতা কোথায়? নিশ্চয় এদিক ওদিকেই কোথাও আছেন মাতা, লুকিয়ে পড়েছেন কোন বৃক্ষের আবডালে, এভাবে এই নির্জন বনানীর মাঝে কখনও গোপালকে ছেড়ে যেতে পারেন না মাতা। উঠে দাঁড়াতে গেলেন কেশব, খুঁজে বার করতেই হবে মাতাকে। কিন্তু কোমর থেকে নীচের অংশে কোন সাড় নেই যে, আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন কেশব, আবার ব্যর্থ হলেন। এভাবে মাতাকে হারাতে পারেন না কেশব, বড় দুখিনী মাতা, তাঁকে খুঁজে বার করতেই হবে, জানাতেই হবে কেশবের মনের কথা। রুক্ষ বালি-কাঁকরের ওপর দিয়ে ঘষটে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কেশব- চিৎকার করে উঠলেন মাতাঃ-।

“কাকে খুঁজছ, বনমালী? দেবী যশোদাকে?” রিনরিনে এ নারী কণ্ঠ, বড় চেনা, দমবন্ধ হয়ে এল কেশবের, অসহ্য বেদনায় ফেটে পড়তে চাইল বুঝি হৃদপিণ্ড। অজান্তে বন্ধ হয়ে এল দুই আঁখি। একি স্বপ্ন? না সত্যি? যদি স্বপ্নও হয়, এ স্বপ্ন যেন কখনও না ভাঙে। রমণী বলে উঠল, “তুমি চলে যাবার পর, বেশী দিন বাঁচতে হয়নি মাতা যশোদাকে। তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে অকালেই হারিয়ে ফেলেছিলেন দৃষ্টিশক্তি, তারপর একদিন সকলের অজান্তে চলে গেলেন, শুনেছি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তোমাকে খুঁজে ছিলেন দেবী যশোদা।” তারপর দীর্ঘ নীরবতা। নীরবতাও এমন বাঙময় হয়, ইতিপূর্বে জানতেন না কেশব। ইচ্ছে করছে শিশুদের মত ডুকরে ডুকরে কাঁদতে। ইচ্ছে করছে, দৌড়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করতে প্রিয়তম নারীকে, কেশবের প্রথম প্রেম, রাধারানী!


পর্ব- ৩

সাহস হচ্ছে না নয়ন মেলার, তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করছে,যদি জননীর মত হারিয়ে যান রাধারানীও। মুদ্রিত নয়নেও অনুভব করছেন, সামনেই হাঁটু মুড়ে বসে আছে রাধারানী, ঠিক যেমন করে  বসত, বৃন্দাবনের মধুর দিনগুলিতে। রাধারানীর তপ্ত নিশ্বাস স্পর্শ করছে, কেশবের চিবুক। আনমনে কিছু ভাবছে রাধারানী। অভিমান হলে এমনই করত, কয়েক মুহূর্ত না কি কয়েক যুগ কেটে গেল, জানেন না কেশব, কথার পর জমছে কথা, কিন্তু বলতে পারছেন না বনমালী, দুষ্ঠ শুষ্ক জিহবা যেন ষড়যন্ত্র করেছে ওষ্ঠ আর অধরের সাথে, আর বলবেনই বা কি? মার্জনা চাইবেন? এতগুলি বৎসর পার করে? বলতে পারবেন কি কেশব, যে রাধারানীর প্রতি তাঁর সেই দুর্দম-দুর্মর প্রেম আজও অটুট। কেশবের হৃদয়ের গভীর-গোপন প্রকোষ্ঠে বাস করেন শুধুই রাধারানী। প্রিয়তমা মহিষীদের সপ্রেম সাহচর্য, অর্জুন তথা সখী কৃষ্ণার উষ্ণ বন্ধুত্ব, অনুগত মুগ্ধ স্তাবকদের স্তুতি কিছুই ততটা গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে না কেশবকে, যে ভাবে ছুঁয়ে থাকেন রাধারানী। দেবী রুক্ষ্মিণী ছাড়া কেউ জানে না,  কেউ অনুভব করেনি, কেশবের হৃদয়ের গোপন ব্যথা। বললে কি বিশ্বাস করবেন রাধারানী? 

“একটিবারও তাকালে না, একটি প্রিয়সম্বোধন পর্যন্ত করলে না, শৈশবের সখীকে?  ব্রজবাসীদের মত তুমিও তাহলে মুখ ফিরিয়ে নিলে বনমালী? আচ্ছা আমরা দুজনেই তো একই দোষে দুষ্ঠ বনমালী, তাহলে যে সমাজ তোমার অর্চনা করে, তারাই কেন আমায় কলঙ্কিনী বলে সম্বোধন করে বনমালী? আমার দেহে রাজরক্ত নেই বলে? আমি মূর্খ গোপিনী বলে? নাকি আমি নারী বলে? তুমি তো চলে গেলে বনমালী রাজরথে চড়ে মথুরা, একটি বার ফিরেও তাকালে না, অভাগীর দিকে, তোমার অবর্তমানে আরও কয়েকজন এসেছিল রাধারানীর নাগর হতে-।” আর সইতে পারলেন না কেশব, দুহাতে কান চেপে ধরলেন কেশব, রাধারানীর মধু ঝরা কণ্ঠ যেন তপ্ত শলাকার মত, প্রবেশ করতে লাগল কর্ণকুহরে।

“ওমা, কানে হাত দিলে কেন গো? তাই তো হয়, অভিসারিকা, পরপুরুষ অনুগামিনী নারী মানেই তো বহুভোগ্যা। সমাজ তো তাই মনে করে বনমালী, প্রথম কিছুদিন তোমার ভয়ে তারা সাহস পায়নি, তারপর লুকিয়ে আসতে লাগল প্রস্তাব। যে সখীরা এককালে তোমার প্রেম সম্ভাষণ বহন করে আনত, তাদের হাতেই আসতে লাগল, কামুক পুরুষদের অভিসারের প্রস্তাব। জানো আর্যাবর্ত্য থেকেও ছুটে এসেছিল জনা কয়েক রাজপুরুষ, ‘কে সেই রমণী, যার প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং কেশব’। তাঁরা আসত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে, আর আমি ছুটে যেতাম তোমার সংবাদ পাবার আশায়। নির্বোধ মূর্খ রাধারানী। সতী লক্ষ্মী গোপিনীরা পরামর্শ দিয়েছিল, দড়ি-কলসি নিয়ে যমুনার কালো জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সে চেষ্টাও করেছিলাম জানো, পারিনি বনমালী। কেবলই মনে হত, আমি চলে যাবার পর, যদি তুমি আসো, তাহলে কি হবে? মাতা যশোদাও তো নেই, আমিও যদি না থাকি, বড় দুঃখ পাবে আমার বনমালী। দেবী রুক্ষ্মিণীর সাথে তোমার বিবাহের সুসংবাদ পেয়েছিলাম, বহুদিন পর, সংবাদ পেয়েছিলাম, দেবী কৃষ্ণার সাথে তোমার সখ্যেরও। দুষ্ঠ দুঃশাসন যখন পরিপূর্ণ সভাগৃহে বিবস্ত্র করতে উদ্যত হয়েছিল, দেবী কৃষ্ণাকে, কি ভাবে নিজের উত্তরীয় জড়িয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলে তুমি বনমালী, চারণ কবিদের গানে গানে শুনেছিলাম সে গল্পও। গর্ব হয়েছিল খুব। এভাবেই বেঁচে ছিল রাধারানী জানো। তোমার কথায়, তোমার গানে। আর তারপর, তারপর একদিন বন্ধ হয়ে গেল সব গল্প, শুনলাম, তুমি সপরিবারে মথুরা ছেড়ে চলে গেছ, বহু বহু দূর দ্বারকা। দপ করে নিভে গেল সব আলো, যমুনার কালো শীতল জল, ডেকেছিল সেদিন-। যেতে গিয়েও পারেনি রাধারানী, যদি ফিরে আসে বনমালী-, কি মূর্খ, কি মূর্খ ছিলাম বল। হতভাগিনী মূর্খ রাধারানী।”

আর পারলেন না কেশব, দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে গেলেন প্রিয়তমা রাধারানীকে, অসীম শূন্যতা ছাড়া কিছুই ধরতে পারলেন না কেশব, খিলখিল করে হেসে উঠল কেউ, হতভম্ব হয়ে নয়ন উন্মোচন করে দেখেন সামনেই বসে আছে এক বালিকা, কতই বা বয়স হবে, সদ্য বসতে শিখেছে হয়তো। এই গভীর অরণ্যে এই শিশুটি কোথা থেকে এল, কর্তব্যপরায়ণ কেশবের কপালে পড়ল গভীর খাঁজ। বালিকাটি অবশ্য দিব্যি খুশির মেজাজে আছে, খিলখিল করে হেসেই চলেছে। মানসিক বেদনাকে সংযত করে, কেশব প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে কন্যা? এই অরণ্যে কি করে এলে মাতা?” 

“ কন্যা, বালিকা, মাতা- এসব কি বলছ কেশব? আমরা তো সমবয়সী। একই সাথে জন্মেছিলাম দোঁহে। কেন তুমি জানো না?” স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল শিশুকন্যা।  


পর্ব-৪

মস্তিকের কোষে কোষে নামছে অসীম ধোঁয়াশা। তীব্র মনোবেদনায় ফেটে পড়তে চাইছে হৃদয়। এ হৃদয় তো কোন দুর্বল পুরুষের হৃদয় নয়। তাহলে? কণ্ঠমূলে এমন অসীম বেদনা কেন? কেন ঝাপসা দুই আঁখি। দুই চোখে তার সীমাহীন কৌতুক নিয়ে নীরবে তাকিয়ে আছে সম্মুখস্থ শিশুকন্যা,  না জানি কত শত-সহস্র বৎসর ধরে। বড় সুমিষ্ট মুখখানি। তপ্তকাঞ্চনবর্ণা নন, তবে গৌরবর্ণা, ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঢেউ খেলানো ঘোরকৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ। বড় চেনা এই মুখ। বিশেষতঃ ঐ ভ্রুকুটি খুবই পরিচিত, খুব আপন, কারো সাথে যেন বড় বেশী মিল-। প্রায় মুছতে বসা স্মৃতির পাতায়, কোথায় যেন লুকিয়ে আছে মেয়েটি। “কন্যা, তোমার মাতা-পিতা কোথায়? এই গভীর বনানীর মাঝে, কে ছেড়ে গেছে তোমায়?”

“তুমি আমায় চিনতে পারছ না কেশব?” খিলখিল করে হেসে উঠল রহস্যময়ী বালিকা। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁক পাড়ল, “মাতা, পিতা”। সুবিশাল মহীরূহের পিছন থেকে যাঁরা বেরিয়ে এলেন, তাঁদের দেখে মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কেশবের হৃদপিণ্ড। 

সস্নেহে শিশুকে কোলে তুলে নিলেন মাতা যশোদা, স্নেহচুম্বনে ভরিয়ে দিলেন শিশুর লালচে ওষ্ঠাধর। এই যশোদা নেহাতই তরুণী, পাশে হাস্যমুখে যিনি দণ্ডায়মান তাঁর সমস্ত মনোযোগ শিশুকন্যার উপর,ফিরেও তাকালেন না সাধের গোপালের দিকে। বরাবরই কিছুটা দূরত্ব রেখেই মিশেছেন নন্দলাল। মাতা যশোদার মত অনাবিল ছিল না ওণার স্নেহ। নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়নতার অভাব না থাকলেও, কোথায় যেন মিশে ছিল সম্ভ্রম মেশানো দূরত্ব। অন্যান্য পিতাদের মত কখনই শাসন করেননি নন্দলাল। কখনই চোখে রাখেননি চোখ, সামনাসামানি হলেও নত করে রাখতেন মস্তক। নির্বাক হয়ে পূরণ করতেন কেশবের তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাহিদা। এমনকি মাতা যশোদা শাসন করলেও, আপত্তি জানাতেন নন্দলাল। কারণটা বুঝতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলি বছর- 


 নীলাভ হলাহলের মত, তীব্র ঈর্ষার বিষ ছড়িয়ে পড়ল শোকস্তব্ধ কেশবের শিরাউপশিরায়। নন্দলালে ঔরসে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেননি, এটা তাঁর দুর্ভাগ্য। তাই বলে অন্য ভাগীদার মেনে নেবেন না কেশব। যে যাই বলুক,তিনি,  তিনিই এনাদের একমাত্র সন্তান। এনাদের যাবতীয় স্নেহ-মায়া- ভালোবাসার একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী।  

এই কন্যা কে? কোথায় ছিল এতকাল?  “মাতা- পিতা” বলে হেঁকে উঠলেন কেশব। তাঁর অার্ত কন্ঠ হাহাকারের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল সমগ্র বনানী জুড়ে। 

“তুমি আমায় চিনতে পারছ তো কেশব? একই সাথে জন্ম আমাদের, যমুনার এপারে-ওপারে। প্রসববেদনায় কাতর মাতা সাময়িক ভাবে হারিয়ে ছিলেন সংজ্ঞা। তাঁর ক্রোড় থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় আমায়। বড় ভীরু ছিল আমার পিতা। আদর্শ প্রজা। বড় বিশ্বাস, বড় ভক্তি করতেন তোমার পিতাকে। তোমার পিতা আশ্বাস দিয়েছিলেন, কটা দিনের ব্যাপার মাত্র। সিংহাসনের ওপর যেহেতু নারীর অধিকার স্বীকৃত নয়, তাই কন্যাসন্তানকে কখনই দাবীদার হিসেবে দেখবেন না যুবরাজ কংস। সবই আপ্তবাক্য ছিল হে কেশব। সবই আপ্তবাক্য ছিল। পিতা বুঝেও আপত্তি করার সৎসাহস জোটাতে পারেননি।  যুবরাজ কংস, বিকৃত মস্তিষ্ক হলেও নির্বোধ ছিলেন না। আরে এতো সোজা হিসেব কেশব, ধরো আমি সিংহাসন দাবী না করতে পারলেও, কাল আমার হবু স্বামী তো করবেই, অথবা পরশু আমার প্রথম পুত্র? তবুও স্তোকবাক্য দিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয়,তোমাদের প্রাসাদে। তোমার জননী, দেবী দেবকী, তোমার শোকে মূহ্যমানা।  ক্ষণিকের জন্যও আমায় জড়িয়ে ধরেননি বক্ষে। একটি বারের জন্যও ওষ্ঠে ধরেননি অমৃতধারা।  ক্ষুধার্ত, প্রবল বর্ষণে, সিক্ত আমি থরথর করে কাঁপছিলাম, দুই নিদ্রাতুর আঁখি খুঁজে বেড়াচ্ছি মাতাকে। আমার স্নেহময়ী জন্মদাত্রী। কোথায় তিনি? ডুগরে কেঁদে উঠলাম আমি, “মাতা- মাতা- মাতা। ”ছাপোষা গোপালকের শিশুকন্যার আর্তনাদ ধ্বনিত হল তোমাদের প্রাসাদ জুড়ে। ঘোষিত হল যুবরাজ কংসের আগমনবার্তা। পলকে আমায় বক্ষে ধারণ করলেন তোমার জননী। তাঁর হৃদয়জুড়ে শুধুই তুমি কেশব। তোমার মঙ্গলাকাঙ্খায় থরথর তাঁর হৃদয়। কি নিপুণ অভিনয়টাই না করলেন তিনি। যুবরাজ কংস যখন চেপে ধরলেন আমার ক্ষুদ্র শ্বাসনালী,নীল বর্ণ ধারণ করল আমার মুখমণ্ডল কেমন আছাড়িপিছাড়ি কান্নাটাই না কাঁদলেন তিনি। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তোমার পিতাও। এমন তো কতই হয়। রাজার দুলালের প্রাণ বাঁচাতে নাহয় ঝরলই খানিক রক্ত। দীন গোপালকের কন্যার প্রাণের আর কি মূল্য আছে? অন্তিম মুহূর্তেও আমার জননীকেই খুঁজেছিলাম আমি কেশব-”।  


আর সইতে পারলেন না কেশব, আগাছা ভরা অরণ্যের মাটিতে ঠুকতে থাকলেন মস্তক। “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। নিজের প্রাণ দিয়েও যদি ফিরিয়ে দিতে পারতাম তোমার জীবন- । ” “একি কেশব, তুমি কাঁদছ?” রাজ্ঞী রুক্ষিণীর পেলব স্পর্শে ঝটিতি ভেঙে গেল নিদ্রা। চোখ খুললেন কেশব, পূব আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে হাল্কা লালিমা, বাতায়ন পথে ভেসে আসছে আরামদায়ক পুষ্প সুরভিত জোলো সামুদ্রিক বাতাস। মাথার উপর স্বচ্ছ দুগ্ধফেননিভ চন্দ্রাতপ। আপন দারুপালঙ্কে শায়িত আছেন কেশব। সুগন্ধী মিশ্রিত ঘিয়ের প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। আধো অন্ধকারেও ভাস্বর রাজ্ঞী রুক্ষিণীর অনুপম রূপ। উদ্বিগ্না রাঞ্জী পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “কেশব? কাঁদছ কেন কি হয়েছে?” জবাব দিতে পারলেন না কেশব, নীরবে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন প্রিয় মহিষীকে, তারপর তাঁর কর্ণকুহরে ফিসফিস করে বললেন, “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। ” বাতায়নের ওপারে ঘোর অন্ধকার আকাশের বুকে তখন আঁকিবুকি কাটছে ঊষার লালিমা। ফুটে উঠছে একরাশ চেনা মুখ, যাদের চেনেন শুধু কেশব আর চেনে প্রকৃতি। বেদনার্ত প্রতিটি মুখ, ভ্রুকুটিতে লুকানো একরাশ অভিমান, আর হৃদয়ে শুধুই প্রেম। কৃষ্ণ প্রেমে ভাস্বর প্রতিটি চরিত্রের ওষ্ঠাধরে একটিই প্রার্থনা। ভালো থেকো কেশব। শুভ জন্মদিন।

No comments:

Post a Comment