Monday 10 August 2020

অনির ডাইরি ৯ই অগস্ট,২০২০

 তুমি বললে, “চলো যাবে?” একপায়ে খাড়া আমি। বড় দিশেহারা সময়, বড় দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি। মোবাইলের ওপারে বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধ। বড় পুরু হয়ে উঠছে ত্বক, ভোঁতা হয়ে আসছে অনুভূতির দল। কোন অনাম্নী অঙ্গনা যেন কোথায় ঢেলেছে বিষ, কোন হতভাগ্য চলচ্চিত্রাভিনেত্রীর জন্য নাকি কলঙ্কিত আজি সমগ্র বঙ্গনারী সমাজ। ফুঁসে উঠছে বঙ্গ পুং আর নারীর দল। ঝড়ে উড়ছে শুকনো পাতা। ব্যক্তিগত ভাবে এসব কুবাক্যে খুব একটা প্রভাবিত হই না যদিও, জনরোষ দেখে  প্রাথমিক ভাবে মনে হল, বেচারী নির্ঘাত কোন বঙ্গতনয়ার চোখে হারিয়েছে প্রিয়তম পুরুষ। অথবা কোন বঙ্গপুঙ্গব ভেঙে খানখান করেছে মেয়েটার হৃদয়। আগুন জ্বললে ধোঁয়া তো উঠবেই। তবুও উত্তপ্ত জনপোস্টে প্রলোভিত হয়ে, চুপিচুপি দেখে এলাম আমিও, অনাম্নী অঙ্গনার সাধের দেওয়াল জোড়া বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছড়াছড়ি। মনে হল ভারি অঙ্কের মানহানির মামলা ঢুকে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়, এনারা অর্থের মূল্য আমাদের থেকে ঢের বেশী বোঝেন। বলেও দেখলাম জনাকয়েক মিডিয়া ফাটানো নরনারীকে। পরিণাম কি না জানি না, আজকাল আর খুঁজে পাচ্ছিনা আসল পোস্টটা। বাজারে স্ক্রিনশটের ছড়াছড়ি থাকলেও, ওণার দেওয়ালের আসল পোস্টটা গেল কোথায়? তোমাকে শোনালাম আমার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, তুমি বললে, “হুঁ।” 

এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে, আড়াই নম্বর দিয়ে গলে গাড়ি উঠল যশোর রোডে। রোজই তো যাই এই রাস্তা ধরে, তবুও এমন ঝকঝক করে না তো। আকাশটা যেন ধুয়ে মুছে তকতকে, ইতিউতি লুকোচুরি খেলছে পেঁজা তুলোর মত মেঘের দল। এই আধা লকডাউনে বেশ ফাঁকা বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে। দুপাশে সারি সারি চায়ের দোকান। এদের চা বেশ সুস্বাদু। পাশাপাশি কাঁচের বয়ামে রাখা হরেক রকম বিস্কুট। সস্তা ক্রীম রোল। গোল গোল নকল মতিচুরের লাড্ডু। রাস্তায় পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে, মাটির ভাঁড়ে আগুন গরম দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট- পাশের রাজপথ দিয়ে আলোকগতিতে ছুটবে জীবন। জানতে চাইলাম খাবে? নিরুত্তর রইলে তুমি, দুচোখে ঝলসে উঠল কি জানি কি অনুভূতি । রাজপথের ধারে বসতি গড়েছে একদল বাঞ্জারা, দেদার পড়ে আছে, রামধনুরঙ হাতে গড়া ঘরসাজানোর সরঞ্জাম। দুদণ্ড জিরোই এথা, নারাজ তুমি। 

অন্যদিন নিবেদিতা সেতু ধরে ঝটিতি পেরিয়ে যাই নদী, আপিস যাবার পথে দুদণ্ড দাঁড়ায় বাপি, জানলার কাঁচের ওপারে ভেসে ওঠে দক্ষিণেশ্বরীর মন্দিরের সুদৃশ্য চূড়া। এপারে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মায়ের ব্যগ্র মুখখানি। দুহাত কপালে ঠেকায় মা, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে পিছনে এসে দাঁড়ায় বাবা। সেই মাঝ মার্চ থেকে গৃহবন্দী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এভাবেই হোক না মানসভ্রমণ। আজ বিবেকানন্দ সেতু ধরলে তুমি। দক্ষিণেশ্বর ইস্টিশনের পাশ দিয়ে, দূরে স্কাইওয়াক দেখতে দেখতে সাঁ করে বেঁকে গেল গাড়ি। দূর থেকে ইস্টিশনটা মায়ের মন্দির বলে ভ্রম হয় জানো,  প্রণামও করেন অনেকে। মা তো সর্বত্র বিরাজমানা, সমস্যা কোথায়? 

হ্যাঁ গো, তোমার মনে পড়ে? এই বালি ব্রীজের ওপরেই একবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল গাড়ি। সুদূর খড়্গপুর থেকে, প্রায় সংসার গুটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ফিরছিলাম আমরা। তুত্তুরীর আগমনে তখন বাকি কেবল এক পক্ষ। আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, পরদিনই  ভোর ৭টা ১০এর খড়্গপুর লোকালে ফিরে যাবে তুমি। বনেট খুলে খুটখাট করছিল ড্রাইভার, আর আমরা মোহিত হয়ে দেখছিলাম ডুবন্ত লাল বলের মত সূর্যটাকে। গঙ্গার পানিতে মাখামাখি সোহাগী আবির। সেই আবির ছড়িয়ে গেল মন্দিরের খাঁজে খাঁজে। কিছু কিছু মুহূর্ত বুঝি মোছে না হৃদয় হতে-  এবারও তুমি নিরুত্তর। হয়তো মৌখিকভাবে প্রশ্নটাই করিনি আমি। কিছু কিছু প্রশ্ন নিরুচ্চারিত থাকাই শ্রেয়। বাতাসে মিশে থাকে তার উত্তর। 

গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরেছি আমরা। বালি ছাড়িয়ে উত্তরপাড়া। সরু রাজপথের একদিকে চকচকে নব্য-প্রাচীন অট্টালিকা সমূহ, অপর পারে চিকচিকে গঙ্গা। ইতিহাস শোনাও তুমি, অবিভক্ত বাংলার প্রথম পৌরসভার গপ্প। স্থানীয় জমিদার, বাবু জয়কৃষ্ণ মুকুজ্জের উদ্যোগে ১৬৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভা। ১৮৫১ সালেই কোম্পানীর কাছে আবেদন করেছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ। হোক না ক্ষুদ্রিকা, তবুও প্রিয় নগরে গড়ে উঠুক পৌরসভা। সে আবেদন নাকচ হলেও দমেননি বাবু জয়কৃষ্ণ আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা। অবশেষে দুবছর পর মেলে অনুমোদন। পৌরসভার গাত্রে খোদিত সন-তারিখ সেই শুভক্ষণের।  ১৮৫৩ সালের ১৪ই এপ্রিল। পৌরভবনের গাত্রে শোভা পায় আরো এক মহামানবের স্থিরচিত্র। বাবু সুভাষ চন্দ্র বোস। সন ১৯৩৮। তৎকালীন পৌরসভার আমন্ত্রনে পদধূলিধন্য করেছিলেন এই পৌরভবন। কৌচে আসীন হবু নেতাজী, পরিবৃত গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ দ্বারা। ধুতি-চাদর পরিহিত বিগলিত হাসিমুখ একদল বাঙালী, যারা গঠন করেছিলেন তৎকালীন বোর্ড।  

ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের জন্মপ্রেম, ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই আমরা। গাড়ি ছুটে চলে রাজপথ ধরে, সচেতন ভাবে আমরা এড়িয়ে যাই কেন্দ্র-রাজ্য-রাজনীতি-লকডাউন জাতীয় শব্দাবলী। এই সব শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অশোকবাবু। উনি অত্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ব্যক্তি। আণ্ডারপাসে বড় বড় গর্ত এইটুকু বলার অপরাধে প্রায় আধঘন্টা ধরে যাবতীয় দপ্তরের মুণ্ডপাত করলেন উনি। অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে হল আরেক দফা মুণ্ডপাত।  মানুষটি সাধাসিধে বটে, তবে স্বভাবে ঘোরতর তর্কবাগীশ বাঙালী।

ধাড়সা বাসস্ট্যাণ্ডের উল্টোদিকে আহমেদ সাহেবের চেম্বার। ওণার ওপর বড় ভরসা শ্বশুর মশাইয়ের। কি যেন নার্ভ শুকিয়ে আসছে ওণার, পরিণামে পায়ের পাতায় ধরে অসহ্য জ্বলন। কলকাতার নামীদামী ডাক্তারকুল বলেই দিয়েছে, “এ ব্যামোর কোন ওষুধ নেই।” প্রাণঘাতী তো নয়, শুধু জ্বলুনী টুকুই যা সইতে হবে। আহমেদ সাহেবের ওষুধে কম থাকে জ্বালা। বৃদ্ধ নিজেই আসছিল, ওষুধ আনতে। কোন মতে ধরে বেঁধে আটকানো গেছে তাঁকে। একফালি বারন্দায় পাশাপাশি বসে আছি আমরা, সহৃদয় ডাক্তারবাবু ভিতরে গেছেন ওষুধ আনতে। ঘড়ি বলে সাড়ে বারো। পাশের পুকুরে ঝিলিক মারে মধ্যগগনের যুবক তপন। গুনগুন করে গান গাইছি আমি, তুমি বললে, “হাওড়া যাবে?”

অশোকবাবু বললেন, “বাড়ি যাবেন না এজ্ঞে?” বাড়িই তো। তিন দশক কাটানো বাড়ি। আমার শহর। বেলুড় মঠের পাশ কাটিয়ে, লিলুয়া আইনক্স ছাড়িয়ে গাড়ি ঢোকে ঘুষুড়িতে। জানো, এখানেই কোথায় যেন বেশ কয়েকটা অনুপম পোড়া মাটির মন্দির আছে।বলেছিলাম না তোমাকে, কার সাথে যেন দেখতে এসেছিল সঞ্চিতা। সে অনেককাল আগের কথা। ছবি দেখে নেশা ধরেছিল। যতবার বলেছি তোমাদের, অট্টহাস্য করেছ তোমরা। ঘিঞ্জি বাজার এলাকা। সেখানে মন্দির বিরল নয় বটে, তবে দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটার মন্দির? পথ দেখায়নি সঞ্চিতাও। স্বপ্নময় দেউল বোধহয় স্বপ্নেই দেখা। গাড়ি ঢোকে শালকে। একমনে বলে যাও তুমি, এখানেই কোথায় যেন ছিল মায়া সিনেমা। তোমার মা-মাসিদের একমাত্র বিনোদনস্থল। মাসিদের সাথে আশা ও ভালোবাসা দেখতে গিয়েছিল ছোট্ট তুতাই। প্রসেনজিৎ আর দীপিকা। পাডুকোন নয়, চিকলিয়া। আগে বাঁদিকে বাঁধাঘাট লঞ্চঘাট। কতবার কলকাতা থেকে লঞ্চ পেরিয়ে এপাড়ে এসেছেন তোমার বাবা-মা। ডানে হরগঞ্জ বাজার। ঐ বাজারেরই শাড়িজামা পরে বড় হয়ে উঠেছেন ওণারা। এদিকে গেলেই মায়ের স্কুল, ঊষাঙ্গিনী বালিকা বিদ্যালয়। ওদিকে বাবাদের  শালকিয়া অ্যাংলো-স্যানস্ক্রীট হাইস্কুল। এই তো তোমাদের বাড়ির গলি। কেউ থাকে না আর এখানে। ভাবুক হয়ে পড় তুমি। খুঁজতে থাকো, গলির মুখের চা-লস্যির দোকানটা। খোঁজ সেই রোয়াকগুলো, যেখানে বসত ফুলকাকা থেকে ছোটেকাকাদের আড্ডা। সেই আড্ডাবাজ ছেলেগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল। পৌনে দুটোর রোদে খটখটে শুকনো মরা গলি। উদাস হয়ে পড় তুমি, আর একটু চেপে ধরি তোমার নরম হাতের পাঞ্জা, একসাথে আরেকবার খুঁজতে থাকি, লুকানো শিকড়বাকড় গুলো। খালি চোখে ধরা যায় না, কিন্তু তবুও তারা থেকে যায়। থেকে যায় আমাদের সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে। খুঁজলেই পাবো জানি। হয়তঃ পেয়ে যাব আমার হারানো ভাঙা দেউলগুলোও- জীবন বড় বিচিত্র, কিছুই হারায় না।  লুকিয়ে থাকে আলোআঁধারীর নক্সার মাঝে।

Saturday 8 August 2020

অনির ডাইরি ৮ই আগস্ট, ২০২০


তুত্তুরী বলল, “তোমার বাড়ি যাব। ডাকাতী করতে। ” পাপাই (নামটা না হয় পাল্টেই দিলাম) একগাল হেসে বলল, “কিন্তু তুত্তুরী মা, আমার বাড়িতে তো কুকুর আছে-”। “ বুঝলে না তো, তোমার কুতুয়াটাকেই তো চুরি করতে যাব।” কুতুয়া অর্থাৎ শ্রীমান (নাকি শ্রীমতী) শ্যাডো তখন ব্যস্ত পাশের বিল্ডিং এর গেটের ফাঁকে পুঁচকে নাকটা গলাতে। কুচকুচে কালো একরাশ উমনোঝুমনো লোমে  ইদানিং ধরেছে গাঢ় কফি রঙের ছোপ। তাই নিয়ে পাপাই আর ওর বউয়ের আফশোসের অন্ত নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই কোথায় যেন মোজাম্মেল সাহেবের চেম্বার। পাপাইয়ের চোখে উনি ঈশ্বর। পেশায় কুতুয়াদের সার্জন, উনিই ছোট থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্যাডোকে। শ্যাডোর আসল মালকিন পেশায় ছিল বারগার্ল। প্রতিসন্ধ্যায় হাইরোডের ধারে কোন বারে নাচতে যেত মেয়েটি। একলা ফ্ল্যাটে গলায় দড়ি বেঁধে রেখে যেত মাত্র কয়েকদিন (নাকি মাসখানেকের) বয়সের শ্যাডোকে। শখ করে কিনে তো ছিল, পোষার ক্ষমতা ছিল না। আর পুষবেই বা কখন? সারারাত মেহনত করে, কাক না ডাকা প্রভাতে ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া দেহে ঘুমিয়ে পড়ত মেয়েটি। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা গড়িয়ে যেত মধ্যাহ্ন। তারমধ্যেই যতটা পারত দেখভাল করত- অসুস্থ হয়ে পড়ছিল শ্যাডো, তখন অবশ্য শ্যাডো নামটা হয়নি। এরই মধ্যে কোন একটা ছুটির দিনে পাপাই আর ওর বউকে নিমন্ত্রণ করেছিল শ্যাডোর পুরাতন মালকিন। পাপাইয়ের ছোটবেলার বান্ধবী।ততোদিনে শ্যাডোর লোম ঝরেছে, গা ভর্তি ঘা। তবুও ঐ অবস্থাতেও পাপাইয়ের বউকে দেখে, তার কোলে উঠে পড়েছিল শ্যাডো। ঘেয়ো শ্যাডোকে কোলে নিয়েই সোনালী বলেছিল, “একে আর ফেরৎ দেবো না কিন্তু। ” পরে বহুবার বলেছে পাপাই, “জানেন তো ম্যাডাম, সোনালী বলেছে বলে, পুরো দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম ওকে। দেখেছেন তো, কেমনি কুচকুচে কালো রঙ, অন্ধকারে দেখাই যায় না। তাই ওর নাম রেখেছিলাম শ্যাডো।  ” 

কিনে তো নিল, কিন্তু শ্যাডো যে বড় অসুস্থ। তখনই মোজাম্মেল সাহেবের কাছে আসা। ওণার ওষুধ ছাড়া খায়ই না শ্যাডো। মুস্কিল হল এই লকডাউনে আর বসছেন না ডঃ মোজাম্মেল। ফলতঃ চুঁচুড়ারই কোথা থেকে যেন নৈমিত্তিক কি একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে শ্যাডোকে। পাপাই বলে, “কি ব্যথা হয়েছিল ওর দুই পায়ে ম্যাডাম। দুরাত নাড়াতে পারেনি।” তারপর থেকেই নাকি, শ্যাডোর পশ্চাৎদেশের কালো রঙের রোমগুলো খয়েরী হতে বসেছে। শ্যাডো বাবুর অবশ্য কোন হেলদোল নেই তাতে। তিনি দিব্যি আছেন। সারা দিন ঘুমান। সারা রাত জাগেন।  মাঝেমাঝে আমার গাড়িতে উঠে আমায় বাড়িতে ছাড়তে আসেন। উদ্দেশ্য তুত্তুরী দিদির সাথে মোলাকাৎ। তুত্তুরী দিদিও আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে উদগ্র প্রতীক্ষা নিয়ে। শ্যাডোকে পেলেই সটান কোলে। ওমনি কুচকুচে নখ দিয়ে খুরখুর করে আঁচড়ে দেয় শ্যাডো। তাতে যে লাগে তা নয়, তবে বেদম হাসি পায়। ওমনি গদাম করে ছেড়ে দেয় তুত্তুরী। ঠিক সময় মত ক্যাচ লুফে নেয় সোনালী। নইলে চোট লাগতে পারে না,ছোট্ট বেবিটার। 

বেবিই তো। নিজে খেতেও পারে না, এমন ঢ্যাঁড়শ বেবি। সোনালী স্বহস্তে চটকে মুখে পুরে দেয়, তবে তিনি চিবোন। বড় বেশী আরাম প্রিয় বেবি, সোনালী বলে, “জানেন ম্যাডাম, খানিক দৌড়োদৌড়ি করেই উনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন আমাদের বাসন মাজার জায়গায় যে জলের গামলাটা রাখা থাকে, তার মধ্যে পেট ডুবিয়ে বসে থাকেন উনি। তারপর পেট জুড়োলে, ঐ ভিজে গায়ে গোটা বাড়ি, দালান ঘুরে বেড়ায় আর গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝাড়ে। আমি যেই রেগে গিয়ে বলি, এক চড় মারব, অমনি সটান খাটের তলায় ঢুকে বসে থাকে। ততোক্ষণ বেরোয় না, যতক্ষণ  না ওর বাবা আসছে। ” 

এহেন পাপাই-সোনালী আর শ্যাডোর সাদা-কালো-সোনালী দুনিয়ায় কিছুদিন আগে ঢুকেছিল এক অন্য ভাগীদার। কোথা থেকে যেন এক অসুস্থ কুতুয়াকে ধরে এনেছিল পাপাই। জাতে ল্যাব্রাডর। কিন্তু অনাথ। প্রথম মালিকের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। দ্বিতীয় যার কাছে থাকত, সে বছর খানেক শুধু বিরিয়ানি খাইয়েছে। নিজেও খেয়েছে, কুতুয়াকেও খাইয়েছে। ফলতঃ রীতিমত হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছিল কুতুয়াটার। প্রসাবে বেরোচ্ছিল লাল রক্ত। কালেক্টরেটের ড্রাইভারদের মুখে শুনে, আমাকে বাড়ি পৌঁছে ফেরার পথে সটান সেই বাড়ি গিয়ে হাজির নয় পাপাই। তারা তো এককথায় রাজি কুতুয়া হস্তান্তরে। ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। পাপাই বলে, “এমন লক্ষ্মী কুকুর ম্যাডাম, গলার দড়িটা ধরে টানলাম, চুপচাপ আমার পিছু পিছু চলে এসে টোটোয় উঠে পড়ল।” বাড়ি পৌঁছতে, শ্যাডোর চিৎকার দেখে কে? কে এলো রে ভাগীদার। 

নতুন অতিথির নাম রাখা হল জন্টি। তার জন্য ডাব আনা হল। শ্যাডো শুধু দুধভাত বা জল দিয়ে চটকানো রুটি বা ডিম সিদ্ধ খেয়েও কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন। এর জন্য নিয়মিত রান্না করতে হত। অফিস ফেরৎ দুটুকরো হলেও মাছ কিনে আনতে হত পাপাইকে, ভেজে শুধু সিদ্ধ ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে, “কি সুন্দর তৃপ্তি করে খেয়ে নেয় ম্যাডাম, দেখলেও চোখে জল আসে।” খাওয়া বা শ্যাডোর হিংসুটে ধমকধামকের থেকেও বড়, বলা যায় সবথেকে সমস্যা হত জন্টি যখন বড়কাজটা করে ফেলত। সোনালী বলে, “শ্যাডোর তো সব আমিই করি বলুন। ওর ধাতও বুঝি।  কিন্তু জন্টি যখন করেছিল আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। কি গন্ধ!”  পাপাই আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেয়, “ছোট বাচ্ছার গু আর বড় মানুষের পাইখানা যেমন। বুঝলেন কি না-”। 

ইত্যবসরে সংসারেও ঘনায় নানা অশান্তি। শাশুড়ী এবং মাসি শাশুড়ীর হাতে দুদফা মার খায় সোনালী। প্রথম বার শুধু কয়োকগাছা কেশ উৎপাটনেই সীমাবদ্ধ থাকে ব্যাপারটা। দ্বিতীয় দফায় মেরে ফাটিয়ে দেয় মাথা। হাসপাতাল থেকে যখন ভীত আতঙ্কিত স্বামী-স্ত্রী আমায় ফোন করে, বলি তৎক্ষণাৎ থানায় যেতে। ধারণা ছিল, থানায় গেলেই, বধূ নির্যাতনের নালিশ দাখিল করলেই, সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাস্তবে দেখলাম, আমিই ভুল ছিলাম। কোন ব্যবস্থা তো নেওয়া হলই না। উল্টে থানার জনৈক বাবু সোনালীকে বলল, “এত ভিড়ের মধ্যে এসব কথা আলোচনা করা যায় না। আমি তো একাই থাকি, আমার কোয়ার্টারে চলে আসুন বরং।” শুনে ওর থেকেও বেশী অসহায় বোধ করেছিলাম আমি। কি করি? কি ভাবে বাঁচাই মেয়েটাকে। সদ্য গেছে আমফান। জেলা প্রশাসন চরম ব্যস্ত ত্রাণের কাজে। ওদিকে নৈমিত্তিক অত্যাচার আর অশান্তি  বেড়েই চলে বাড়িতে। যোগাযোগ করি পরিচিতি নামক এনজিওর সাথে। ওরা এই ধরণের নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়। কর্ণধার শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটকের সাথে যোগাযোগ চন্দননগরের বড় সাহেবের মাধ্যমে। প্রথম যখন ফোন করি, অঞ্চিতাদি ওয়েবইনারে ব্যস্ত ছিলেন। বাইরে ঘোর লকডাউন, তারই মধ্যে আমার চেম্বারে বসে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। থানার বাবুর কণ্ঠ স্পিকার ফোনের দৌলতে সারা আপিস শুনেছে। ওয়েবইনার মিটতেই  অঞ্চিতাদির ফোন, প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, ‘বরটা কি বলছে?’ জানালাম বরটা নিজেও ভোম্বল হয়ে বসে আছে আমার ঘরে। নেহাত কাঁদলেই সবকটাকে দূর করে দেব বলে ভয় দেখিয়েছি তাই-। অঞ্চিতাদির কথা শুনে বুঝলাম, এই ধরণের বধূ নির্যাতনের কেসে যদি বরের সমর্থন থাকে, তাহলে অর্ধেকটা যুদ্ধ জেতাই হয়ে গেছে। বাকিটার জন্য নিয়োগ করা হল,ওণাদেরই এক সদস্যকে। লকডাউন, ট্রেন চলছে না, ফলে সশররীরে হয়তো আসতে পারেনি, তবুও বলতে বাধ্য যে,শুভ্রা নামক মেয়েটি, নিয়মিত শুধু সোনালী আর পাপাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছে তাই নয়, বাড়িয়ে গেছে ওদের মনোবল। নিজে কথা বলেছে থানায়। ওর নির্দেশমত চিঠির পর চিঠি নিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে সোনালী। 

এই টালমাটাল অবস্থায় একদিন পাপাই বলল, “জন্টিকে কাউকে দিয়ে দেব ম্যাডাম। এইভাবে হয় না। এত মনমেজাজ খারাপ আমাদের। অধিকাংশ দিন রান্নাই হয় না। অন্তত মাস দুয়েকের জন্য হলেও দিয়ে দেব। ” বাড়িতে এসে জানালাম, ‘ভাবছি আমিই নিয়ে আসব ধেড়ে কুতুয়াটাকে-”। তুত্তুরী লাফাতে লাগল ধেইধেই। “জন্মদিনে কুতুয়া পাব।” মাসিও গররাজি হল। দুইটা মাসের তো ব্যাপার। শৌভিক একেবারে অনড়। “আমি জানি, এই বাড়িতে কেউ এলে সব দায় আমারই হবে। তোরা তো মা-মেয়ে,কুতুয়ার পটি দেখেই অজ্ঞান হয়ে যাবি। তারপর তাকে ফেলবে কে? আর সকালবেলা কুতুয়াটাকে নিয়ে যখন হাঁটতে বা ইয়ে করাতে নিয়ে যেতে হবে, আবাসনের নেড়িগুলো তেড়ে আসবে? তোরা মা-মেয়ে হা-হা করে কুতুয়া ফেলে ছুটে পালিয়ে আসবি। আমার সব দেখা আছে। আমি নেই। কুতুয়া আনলে আমি গৃতত্যাগী হব। ”কথাগুলো যে খুব ভুল, তা জোর গলায় বলতে পারলাম না। তারওপর তখনও জানি না, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অতিমারিতে আক্রান্ত হতে চলেছি আমরা মা আর মেয়ে। 

আপাততঃ একটা ভালো বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে জন্টির। থানার বাবুকে টাইট দেওয়া গেছে। অন্য বাবু অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে নিয়েছেন সোনালীর কেস। কড়কে দিয়েছেন শাশুড়ী এবং তার বোন- বোনপো- বোনঝিকে। আদালত খুললে কেসও উঠবে। পরের সন্তানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া বা চারজন মিলে একটি মেয়েকে মারধর করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুভ্রা তথা পরিচিতি এখনও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে।

 জন্টি আপাততঃ খুব ভালো আছে।  আর ফিরছে না। একথা অনস্বীকার্য যে জন্টি বিদেয় হতে সবথেকে খুশি শ্যাডো। একলা রাজকুমার(ঈ)। মানসিক ভারমুক্ত সোনালী আজকাল আমায় বারবার বলে, “জন্টিকে নেননি, খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। নিলেও ছোট কুতুয়া নেবেন, কেমন? বড় কুতুয়ার পটি- ম্যাগো। ওয়াক থুঃ। ” শুনতে শুনতে ঘরের একজনের কথা মনে পড়ে যায়, সাধে কি বলে গরীবের কথা, বাসি হলে-

Sunday 2 August 2020

একরাশ যাচ্ছেতাই ইচ্ছেডানা-


এমনিতে যে নিজের আকৃতি বা প্রকৃতি নিয়ে অভাববোধ তো দূরের কথা, বরং আয়নার ওপারের  মেয়েটাকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি। দেমাকী, মাটিতে পা পড়ে না ইত্যাদিও বলতে পারেন। তীব্র বিবাহপ্রীতি ছাড়াও, এই ব্যাপারটা “জব উই মেট”এর গীতের সঙ্গে আমার দারুণ মেলে, ঐ যে, কি বলে না, আমি হলাম, নিজের সবথেকে ফেভারিট-। 
এইটুকু তো জীবন, জগত বা তার অধিবাসীদের নিয়ে  মাথা ঘামাই কখন? দাড়িবুড়ো এক্কেবারে মনের কথাই বলে গেছেন, “আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল-”। পারিবারিক দিক থেকেও এ ব্যাপারে রীতিমত সৌভাগ্যশালিনী বলতে পারেন, অাশৈশব যখনই কেউ বর্ধিত ওজন নিয়ে সুচিন্তিত বিশেষজ্ঞ মতামত পেশ করেছে,সপাটে ব্যাট চালিয়ে স্টেডিয়ামের পার করে দিয়েছে বাবা। বাবার মতে, আমার দৈহিক ব্যাস, বাবার ব্যাঙ্কব্যালেন্সের পরিচায়ক। আরেঃ হোক না খণ্ডহর, তবুও তো কড়িবরগা ওয়ালা বাড়ির মেয়ে আমি, মানছি তালপুকুর, ঘটি ডোবে না, কিন্তু সুখের দিনে তো ডুবত রে ভাই। ঘটি-কলসী সবই ঢুবত। সেই বাড়ির মেয়েকে দেখে বোঝা যাবে না? অস্বীকার করব না, চাটুজ্জে থেকে ভট্টচায বাড়িতে এসেও, কখনও বদলায়নি ঘরোয়া পরিস্থিতি।

তবুও, যতই প্রিয়পুরুষদের ঢাল-তরোয়াল থাকুক, ফাঁকফোকর পেলেই হিতোপদেশ জুটেছে শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে। যদি ফেটে যাই, আহাঃ ওণাদের চিন্তা কি কম? আর পাঁচটা স্থূলকায় ছেলে/মেয়ের মতই, সেই কোন শৈশব থেকেই তৈরী হয়েছে মানসিক দূরত্ব, গড়ে উঠেছে জন্মশত্রুতা ঘি-মাখন জাতীয় সুস্বাদু স্নেহপদার্থের সাথে। সবই যে ফ্যাটে লটপট, ঘোর নিষিদ্ধ। ঘুষের মাল,গোপন রোগ বা লুকানো প্রেমের মত গভীর আকর্ষণ থাকলেও,প্রকাশ্যে আস্বাদ নেওয়ার সৎসাহস মোটেই ছিল না।  শুধু দেখবি আর জ্বলবি টাইপ ব্যাপার আর কি। গরম ভাতে এক চামচ গাওয়া ঘি, বা টোস্টের ওপর পুরু নোনতা মাখনের প্রলেপ দিলেই, মনের মধ্যে যেন ঝপাঝপ সার্চ লাইটের মত জ্বলে উঠত জোড়া জোড়া চোখ। ঘুরিয়েফিরিয়ে একই কথা বলে যেত আমার মন, - “ না।  না এবং না। একদম না।”  অথবা “ “ফেটে যাব বোধহয়” অথবা “হার্টের ব্যামো হবে নির্ঘাত। অকালে টেঁসে যাই যদি, স্যালাড খাই বরং।” 
স্যালাড-ডায়েটিং এগুলো শুনতে বেশ সোজা-সরল, আদতে কিন্তু ব্যাপারগুলো ভয়ানক রকম জটিল। দুদিন-তিনদিন একসপ্তাহ চলেই যায়- শশা, টমেটো, পেঁয়াজের ভরসায়, তারপরই জিভে পড়তে থাকে চড়া। মুষড়ে পড়ে হৃদয়, সেই সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ খাবারের জন্য, যা এই সমাজ ছাপ্পা মেরে নিষেধ করে ভারী চেহারার অধিকারীদের জন্য। সচেতন- অচেতন- অবচেতনে বড় বেশী বঞ্চিত বোধ হয় নিজেকে। ঈশ্, স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়েই যদি বিনা অপরাধবোধে খাওয়া যেত ঘি আর মাখন অথবা যা ভালোবাসি তাই। মাস দুয়েক আগেও, এটাই ছিল দিবাস্বপ্ন-

এই সময় কোন এক ওয়েলনেস গ্রুপে প্রথম ভার্চুয়াল পরিচয় ডঃ বার্গের সাথে। ডঃ এরিক বার্গ।  নামী ভিডিওব্লগার এবং পুষ্টিবিশেষজ্ঞ। ওণার বিভিন্ন ভিডিওতে পোস্ট করা মন্তব্যাবলী পড়লে ওণাকে মসীহা বলেও ভ্রম হতে পারে-
ডঃ বার্গ বললেন, কে বলেছে ফ্যাট বর্জনীয়। ফ্যাট শুধু রসনার পক্ষেই অমৃতসম নয়, আমাদের শরীরের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পৌষ্টিক উপাদান। ফ্যাট খেলেই ক্লগড্ আর্টারিজ বা হৃদরোগ হবেই, এটা কিন্তু ঠিক নয়। বরং ফ্যাটে আছে জরুরী পোষণ। আরে মশাই, ফ্যাটই যদি না খান, তাহলে ফ্যাটে দ্রব ভিটামিন যেমন A,D,K কি করে আত্তিকরণ করবে আপনার দেহ? আর যতই ক্যালসিয়াম খান, ভিটামিন D যদি আপনার দেহে সংশ্লেষিত না হয়, তাহলে ঐ ক্যালসিয়ামকে কাজে লাগাবেন কি করে?
শুধু তাই না, আমাদের মস্তিষ্কেরও মূল উপাদান ফ্যাট। স্নায়ুতন্তুকে ঘিরে রয়েছে যে আস্তরণ, যার পোশাকী নাম মায়োলিন শিদ্ তারও মূল উপাদান ফ্যাট। ফার্টিলিটি, স্মরণশক্তি,কগনিটিভ সেন্স, স্ট্রেস  ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ হর্মোনসমূহ, তাদের অনেকগুলিই সংশ্লেষিত হয় ফ্যাটের উপস্থিতিতে। বাইরের আঘাত থেকে আপনাকে রক্ষা করার জন্য, ত্বকের নীচে যে কুশন তাও ফ্যাট দিয়েই তৈরী। ফ্যাট বাড়ায় অনাক্রম্যতা অর্থাৎ ইমিউনিটি।
আমাদের জন্য ফ্যাট এত জরুরী বলেই, শরীর যত্ন করে জমিয়ে রাখে ফ্যাট। তাই ফ্যাট কমানো ব্যাপারটা হল প্রকৃতিবিরদ্ধ, যাকে বলে, অ্যান্টি- সারভাইভাল। যত আপনি ফ্যাট কমাতে কমাবেন ক্যালোরি, যত কড়া হবে আপনার ডায়েটিং, ততোই আতঙ্কিত হয়ে উঠবে আপনার দেহ। আরও, আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরবে শরীরের সমস্ত ফ্যাট। আপনি যেমন শুরু করবেন ডায়েটিং, শরীরও তেমনি পাল্লা দিয়ে কমাতে থাকবে বিপাক অর্থাৎ মেটাবলিজমের হার। যত কঠোর ডায়েট, ততোই কম মেটাবলিজম। যত  দীর্ঘ ডায়েট,ততোই ধীমে মেটাবলিজম। যা খাবেন সবটুকুই তখন সঞ্চয় করে রাখবে শরীর। উপরন্তু আরও বেশী খাবার জন্য তাড়না দিতে থাকবে আপনাকে। পরিণাম- বেড়ে যাবে খিদে আর লোভ। কষ্ট করতেই থাকবেন, কেষ্ট থাকবে অধরাই। আর কষ্ট করা ছেড়ে দিলেই, আবার দ্বিগুণ গতিতে যথা পূর্বম্। তাই আত্মবঞ্চনা ছাড়ুন। ক্যালরি মেপে খাবেন না। খান পেট ভরিয়ে, মন ভরিয়ে। যাতে প্রোটিন-ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট তিনটিই সুষম ভাবে প্রবেশ করতে পারে আপনার পাচনতন্ত্রে। শরীরের সাথে গড়ে তুলুন সৌহার্দ্য।
ডঃ বার্গের মতে, দেহে মেদ জমার জন্য মূল কালপ্রিট হল যে হর্মোন, তার নাম ইনস্যুলিন। দেহে ফ্যাট সঞ্চিত হয় ইনস্যুলিনের নির্দেশে, আবার ফ্যাট বার্নিংএও বাধা দেয় ইনস্যুলিন। মোদ্দা কথা ইনস্যুলিনের উপস্থিতিতে ফ্যাট কমানো, অলীক কল্পনা মাত্র।
যতবার খাবেন, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ততোবারই ক্ষরিত হবে ইনসুলিন। ঐযে দিনে ছবার/আটবার খাওয়া- ঐ গপ্প ভুলে যান। খাবেন, শুধু মাত্র খিদে পেলে তবেই।  ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ আর ডিনারে যদি সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন ভোজনবিলাস,  আপনাকে ঠেকায় কে?
আর একটা কথা, কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বাড়িয়ে দেয় ইনস্যুলিনের ক্ষরণ। তাই কার্বস কমিয়ে বাড়ান প্রোটিন আর ফ্যাট। ঘিটা খান, ভাতটা কমান। মাখন বা মেয়োনিজটা খান, পাউরুটিটা ছেড়েই দেখুন না। আর যাই খান, ফুল ফ্যাট ভার্সানটাই খান, ফ্যাট ফ্রি বা লোফ্যাট কিছু জিভে দেবেন না প্লিজ।

মাসখানেক ধরে ওণার কথা মত খাবারে ফিরিয়ে এনেছি ফ্যাট।  মাখন, ঘি, চীজ,মেয়োনিজ, ডিমের কুসুম সবই খাচ্ছি। আমি বিশেষজ্ঞ নই, শুধু মাত্র নিজের অভিজ্ঞতাটুকু ভাগ করে নিতে পারি মাত্র, কারণ পর্দার আড়ালে আমার মত দোদুল্যমানতার- দুষ্টচক্রের শিকার আরও অনেকেই। যাঁরা মনকে কোতল করে, সমাজের কথা শুনে হালদুরস্ত থাকার চেষ্টা করেন, আর আত্মবঞ্চনায় ভোগেন- তাঁদের বলি আমি ভালো আছি। ওজন কমেছে বলে দাবী করব না, তবে বাড়েনি। গা-হাতপায়ে লুকানো নানা ব্যথাবেদনারা গা ঢাকা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। মাঝরাতে আর ডাক পাঠায় না রেফ্রিজারেটরে লুকানো চকলেট। মোটামুটি খুশিখুশিই থাকি, সদ্য করোনা থেকে উঠেছি, তবুও পরিশ্রম করতে ক্লান্তি লাগে না। মুখে ক্রীম/ময়েশ্চারাইজার না মাখলেও তেলতেল চকচকে থাকে মুখটা। হয়তো সবই মনের ভুল, তবে চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়েছে হাতের নখগুলির, কিছুকাল আগেই এতই নরম হয়ে পড়েছিল, যে সামান্য চাপেই মুটমুটিয়ে ভেঙে যেত সবাই। বহুবার ক্যালসিয়ামের ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু, যতদিন খেয়েছি, ইতরবিশেষ উন্নতি হয়েছে হয়তো। তারপরই আবার ধরেছে ফাটল। আজকাল আর সেই সমস্যা নেই। কারণটা বুঝতে লাগল এতদিন।
এই আর কি, ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। আনন্দে বাঁচুন।

Sunday 12 July 2020

তুত্তুরীর রূপকথারা-



“মেলা বসাবে তুত্তুরী, রথের মেলা। মা যেমন বসায় শ্রমিক মেলা, ঠিক তেমনি। কোন এক পাহাড়ের কোলে, ছলছলে কোন নদীর তীরে, ঘন সবুজ গাছপাতায় মোড়া কোন উপত্যকায় বসবে তুত্তুরীর রথের মেলা। উপত্যকাকে ঘিরে বাস করে অনেক দীনদরিদ্র মানুষ, জঙ্গল থেকে কাঠকুটো জোগাড় করে, কখনও বা বুনো শুয়োর শিকার করে চলে তাদের সংসার। তাদের নিয়ে, তাদের জন্যই মেলা বসাবে শ্রীমান তুত্তুরী।
ঝড়ে উপড়ে পড়া জংলী গাছ দিয়ে তৈরী হবে রথ, তিনতিনটে রথ-  কাঠ কি কম পড়িতেছে? চিন্তা নেই, বিগত দুর্গাপুজোয় যখন দাদু-মামমাম আর তুত্তুরী গিয়ে পৌঁছেছিল স্বপ্নময় উপত্যকায়,তখন বসতি স্থাপন করার জন্য সাফ করা হয়েছিল অকিঞ্চিৎ জঙ্গল। সেই সব কাঠ যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে মামমাম।আর উপত্যকার অধিবাসীদের জন্য অবারিত দাদুর তুত্তুরী ভিলা।
তৈরি হওয়া রথগুলিকে টানতে টানতে চিত্রকরদের কাছে দিয়ে আসে তুত্তুরী। বারেঃ রঙ করতে হবে তো?  ওদিকে মাটির পুতুল গড়িয়েরা বানাতে শুরু করল হাত কাটা তিন ভাইবোন। মাঝে মাঝেই নজরদারী করে আসে তুত্তুরী, উৎসাহের আতিশয্যে ব্যাটারা আবার হাত-পা না বানিয়ে বসে-
এমনি একদফা পর্যবেক্ষণ করে ফিরছিল দাদু আর তুত্তুরী, চতুর্দিকে শালপ্রাংশু মহাভুজের সারি মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা পথের ওপর আড়ামোড়া ভাঙা কচি মেঘের দল, গল্প বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে দাদু পাশাপাশি তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে মন্ত্রমুগ্ধ তুত্তুরী, আচমকা কি যে হল, চেনা পথটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল- আর তুত্তুরী সবিস্ময়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পোড়ো মন্দির। কোন মান্ধাতার আমলে তৈরি কে জানে, কত বছর কোন জনমনিষ্যির পা পড়েনি কে জানে। মন্দিরের চালের ওপর গজিয়ে উঠছে বিশাল বটের চারা। যার মোটা মোটা শিকড় আর ঝুড়ি নেমেছে মন্দিরের গা বেয়ে। মন্দিরের ভাঙা দুয়ার। ভিতরে শূণ্য বেদীতে লেপা আছে কবেকার সিঁদুর- তুত্তুরী চিৎকার করে উঠল, “ইউরেকা! পেয়েছি দাদু। পেয়েছি। মাসির বাড়ি পেয়েছি। এই বেদীতেই বসাব মাসির মূর্তি।” এই অবধি শুনেই বিষম খায় মাসি। চোখ গোলগোল করে ধমকে ওঠে তুত্তুরী, “আহঃ তুমি নয়। জগন্নাথদেবের মাসি। ”
ওদিকে তুত্তুরীর উপত্যকায়, তৈরি হতে থাকে মাসির মূর্তি। মামমামকে (দিদা) নিয়ে দূরের ছোট্ট শহরে পৌঁছয় তুত্তুরী। গয়না গড়াতে হবে যে। জগন্নাথ-বলরাম আর সুভদ্রার জন্য এই মোটা মোটা সোনার হার আর সুভদ্রার নাকের নথ। মাসির জন্য কিছু বানাবি না, প্রশ্ন করে মামমাম, “নাঃ। মাসি তো গরীব। জঙ্গলে থাকে। ঝুটো গয়না পরে মাসি।”

দেখতে দেখতে এসে যায় রথের দিনটা। তার আগের রাতে সমগ্র উপত্যকা জুড়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য চালা দোকান। কি নেই তাতে, খাবার-দাবার- এই অবধি বলেই থামে তুত্তুরী, “খাবার স্টলে থাকবে খাজা, জিলিপি,পেরাকি,রসগোল্লা আর লবঙ্গলতিকা। আর থাকবে কাঠি বরফ আর কুলফির দোকান।”। এছাড়া থাকবে অনেকজন গ্যাসবেলুনওয়ালা। তারা সবাই জোকারের মত ঝলঝলে পোশাক পরে, সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াবে মেলাময়। প্রতিটি সাইকেলের সামনে বাঁধা থাকবে চৌকো গ্যাসের ট্যাঙ্ক আর সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা থাকবে বিভিন্ন আকৃতির গ্যাসবেলুন। গ্যাসবেলুনের দামও বেঁধে দিয়েছে তুত্তুরী, ১টাকায় ১টা। আর কুলফি/ কাঠি বরফের দাম ১টাকায় ২টো। বাচ্ছারা যাতে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারে রথের মজা। আর থাকবে বাঁশ, কাঠ আর মাটির পুতুলের দোকান। থাকবে তালপাতার বাঁশি,ঢোল আর ঢুগঢুগি। থাকবে কাঁচের রেশমি চুড়ি, ঝুটো গয়নার দোকান। বিক্রি হবে নানা ধরণের কলম আর সাবানের বুদবুদ তৈরির খেলনা। থাকবে নাগরদোলা, মেরি-গো-রাউণ্ড আর টয় ট্রেন। ছলছলে নদীর সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটবে খেলনা ট্রেন। গন্তব্য মাসির বাড়ি।
রথের দিন সকাল থেকেই যাতে বাচ্ছারা চুটিয়ে আনন্দ করতে পারে,সেদিকে কড়া নজর রাখে তুত্তুরী। তুত্তুরীর নির্দেশে উপত্যকাবাসী নিঃসহায় বিধবারা সানন্দে বানিয়ে ফেলে রসগোল্লার পাহাড়। বিশাল বিশাল পাত্রে টগবগ করে ফোটে রস, ছপাছপ ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁচা রসগোল্লার দল। তুত্তুরী ভিলার সামনে এসে পৌঁছয় তিন তিনটে রথে সওয়ার তিন ভাইবোন। এসে পৌঁছয় ফুল আর গয়না। রথের দিন সকাল আটটা থেকে রথ সাজাতে বসে মামমাম। হাঁটুর ব্যথা তাই ওপরে তো উঠতে পারবে না, তাই উপত্যকাবাসী তুত্তুরীর বন্ধুরা এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। ফুলে ফুলে অপরূপ সেজে ওঠে তিন ভাইবোনের বাহন। ঘনিয়ে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ, তিন ভাইবোনের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল সোনার কণ্ঠহার। সুভদ্রার নাকে ঝোলে নোলক। কুচানো ফুলের সাজি নিয়ে রথে চাপে পাণ্ডাবেশী কুচোকাচার দল। তুত্তুরী নিজে ওঠে সুভদ্রার রথে। শুরু হয় তুত্তুরীর রথের মাসির বাড়ি যাত্রা। উপত্যকা জুড়ে বয়ে যায় আনন্দধারা- পথের ধারে সমবেত হয় হাসিখুশি উপত্যকাবাসী। পিঁ পিঁ করে বেজে ওঠে তালপাতার বাঁশি, প্রত্যুত্তরে শিলাবৃষ্টির মত রথের ওপর থেকে ধেয়ে আসে ফুলের কুচি আর বাতাসা। হুড়োহুড়ি লেগে যায় কুচোকাচাগুলোর মধ্যে। খিলখিলিয়ে ওঠে তুত্তুরীর উপত্যকা-”
✍🏼©তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা ভট্টাচার্য

তুত্তুরী উবাচ ১২ই জুলাই, ২০২০



👧🏻-খুব ভুল করেছে, কাজটা।
👩🏻-অ্যাঁ? কে? কি?
👧🏻-আমাদের ম্যামেরা খুব ভুল করেছে। লকডাউন মানে সব বন্ধ। পড়াশোনাও বন্ধ থাকা থাকার কথা। ছুটি মানে ছুটি। তা নয়, ম্যামেরা গ্রুপ খুলেছে, আর রোজ পড়াশোনা করাচ্ছে। আমাদের কাছে তো ম্যামের নম্বর ছিল না, তাহলে ম্যাম আমাদের নম্বর পেল কোথা থেকে?
👩🏻-পড়তে বসালেই যত উদ্ভট চিন্তা আসে তোর মাথায়?
👧🏻-মা, জানো তো, বাবা হল কেসিয়াস আর তুমি না পাক্কা ব্রুটাস।
👩🏻-বাবা রে! আর তুমি কে মা? জুলিয়াস সিজার?

Monday 6 July 2020

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই,২০২০



বেশ কিছুদিন আগের কথা, করোণা তখনও মেলেনি ডানা। চীনে কি সব ঝকমারি বিমারি হচ্ছে বটে, আঁতেল বন্ধুবান্ধব এবং আমার বর সেটা নিয়ে বেশ গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনাও করছে, তবে তার ছাপ পড়েনি আমার চুঁচুড়ায়। ভর দুপুর নিজের চেম্বারে বসে কাজ করছি, সন্ত্রস্ত পায়ে মেয়েটা ঢুকল। সন্ত্রস্ত হয়ে জানাল আমার সাথে একটু একা কথা বলতে চায়। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার চেম্বারের কাঁচের ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মেরে গেছে, সবসময়ই ঘর ভর্তি ছিল।
একা একা কি কথা রে? জানতে চাইলাম। হাত কচলে বলল,“অমুক তারিখে আমাকে একটু অর্ডার করে ডেকে নেবেন?” মানে? খামোকা অর্ডার করে ডাকার কি আছে, ওরা তো এমনিতেই আসে, যখন কাজ থাকে। আজও তো এসেছে। বেশ খানিকক্ষণ মাথা নত করে বসে থাকল মেয়েটা, দেরী হয়ে যাচ্ছে পরের মিটিংএ। এখনও হয়নি টিফিন। সুজয় বাবু দুবার মুণ্ডু গলিয়ে গেলেন, ঘুঘনি তৈরি, বললেই রুটি সেঁকে দিয়ে যাবে। মেয়েটা আর ওঠেই না। বললাম, “ আচ্ছা সে একটা হাবিজাবি মিটিং ডেকে দেব খন। তুমি এমনি এসে ঘুরে যেও। ” বলতে বলতে থমকে গেলাম, মেয়েটার কাজল চোখে তখন আষাঢ়ের মেঘ। টুসকি মারলেই ঝরে পড়বে ঘন বর্ষার ধারা। এবার ঘাবড়ে যাবার পালা আমার, ব্যাপার কি?
বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা, বাঁহাতে দরজার বাইরের লাল আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম, এই মুহূর্তে কেউ মাথা গলালে বড় বাজে হবে। মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আমার শ্বশুরবাড়ি খুব খারাপ ম্যাডাম। ” এ আর নতুন কথা কি? শতকরা ৯৮জন মেয়েই এই কথা বলে। যত মহিলা ক্ষমতায়নের কর্মশালা করেছি,সবেতেই সব ছাপিয়ে উঠে আসেন শাশুড়ী মা। বন্ধুদের অাড্ডাতেও সেলিব্রিটি গুটি কয়েক বন্ধুর শাশুড়ী মা। ওরা শাশুড়ী চর্চা না করলে বরং চিন্তা হয়, শরীর টরীর বিগড়াল না তো? সেই ভাবেই হেসে উড়িয়ে দিতে গেলাম- তাতে ফোঁপানী বেড়ে গেল মারাত্মক।
“না ম্যাডাম, আমার শাশুড়ী মা নেই। আমার বর যখন কলেজে পড়ত তখনই মারা গেছেন। আমার ভাসুর আমার বরের থেকে অনেকটাই বড়, ওর বৌদিই ছিল বাড়ির গিন্নী।“ বাঙালীর আরেক সমস্যা এই বৌদি। নির্ঘাত ক্ষমতায়নের লড়াই। মেয়েটা তখনও কেঁদে চলেছে, “জানেন ম্যাডাম, আমার ভাশুর তেমন কিছুই করত না। আমার বরই বড় হয়ে চাকরী পেয়ে লোন নিয়ে বাড়িটা তৈরী করে। আমার শ্বশুর মশাই ওপার থেকে এসেছিলেন তো, আজন্ম ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। ওণার একটাই স্বপ্ন ছিল, নিজের ভিটেতে শেষ নিশ্বাস ফেলবেন। তাই আর কি-”।
দুজনেই চুপচাপ বসে আছি, ঘরঘর করে ঘুরছে দেওয়ালে লাগানো পাখা দুটো। কাঁচের কাগজ চাপার তলা থেকে উড়ে যেতে চাইছে একদিস্তা নানা সরকারী কাগজ। জানতে চাইলাম “জল খাবে?” ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাল মেয়েটা। ওড়নায় নাক-চোখ মুছে এতক্ষণে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল-“জানেন ম্যাডাম ওরা চায়নি আমাদের বিয়েটা হোক। আমাকে দেখতে এসেই নাকচ করে গিয়েছিল ওরা। আমার মায়েরও পছন্দ হয়নি ওর বৌদির হাবভাব। বড় বেশী ক্যাটক্যাটে কথা ওণার। পরে শুনেছি ওরা এটাই করত। ওরা আসলে চায়নি আমার বরের আদৌ বিয়ে হয়। বেশ কয়েকবার নানা ছুঁতোনাতায় অনেকগুলো সম্বন্ধ নাকচ করায়, ওর সহকর্মীদের সন্দেহ হয়। আমার বেলাতেও ওরাই ফোন করেছিল আমার বাবাকে। বাড়ির লোকের অপছন্দ হলেও, ওর পছন্দ হয়েছিল আমায়। মা অবশ্য নিষেধ করেছিল- কিন্তু-”।
ঘরঘরে পাখার হাওয়া আবার এলোমেলো করে দেয় সব কথা। নীরবতাও হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। বুঝি মেয়েটির অপছন্দ ছিল না পাত্র। উভয় পক্ষের সম্মতিতে ভেঙে পড়ে প্রতিবন্ধতার পাঁচিল। কিছুটা দম নিয়ে, ব্যাগ থেকে একটা ছোট বোতল বার করে দু ঢোঁক জল খায় মেয়েটা। আমিও বেল বাজিয়ে বলি,টিফিনটা দিয়ে যেতে-।
কুচি কুচি কাঁচা লঙ্কা ছড়ানো আগুন গরম রুটি-ঘুঘনীর সাথে গড়ায় কিস্যা। মেয়েটি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বরের গল্প করতে থাকে, বলতে বলতে আবার বেজে ওঠে বেসুরো ভায়োলিন। “জানেন ম্যাডাম আমার শ্বশুর মশাই প্রথম দিকে আমাকে একেবারেই মেনে নেননি। বাড়ির অমত থাকা সত্ত্বেও ওণার ছেলে নিয়ম ভেঙে আমায় ঘরে এনেছে এই অভিযোগ প্রায়ই করতেন। বলতেন, যারা বাড়ির মতের বিরুদ্ধে যায়, তারা কখনও সুখী হয় না। কিন্তু আমরা তো সুখী হয়েছি ম্যাডাম। খুব সুখী আমরা একে অপরকে পেয়ে।” কেমন যেন গুলিয়ে যায় মাথা। তাহলে সমস্যাটা কি?
মেয়েটা বলে চলে, “ আমাদের যখন বিয়ে হয়, তখন একতলাটা খুব সাজানো গোছানো ছিল। দোতলাটা আধখেঁচড়া পড়ে ছিল। কিন্তু আমার ভাশুর আর জা জোর করে আমাদের দোতলায় থাকতে বাধ্য করে। কি কথা শোনাত ম্যাডাম। জানেন না। উঠতে বসতে খোঁটা দিত। ভালো করে খেতেও দিত না ম্যাডাম”। আবার হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। আবার জ্বালিয়ে দিলাম দরজার বাইরের লাল বাতি। মহাজ্বালায় পড়েছি তো-
“যখন কনসিভ করলাম ম্যাডাম, কতদিন না খেয়ে পঞ্চায়েত আপিসে গেছি কাজ করতে আপনি জানেন না। ইচ্ছে করে আমায় খেতে দিত না। চাইত না আমার পেটেরটা বাঁচুক। যা দু পয়সা পেতাম রাস্তায় যা পেতাম কিনে খেতাম ম্যাডাম-”। সুজয় বাবুর রুটি হঠাৎ বড় বেসোয়াদ লাগল। এদের বড় ভালোবাসি। সব সাব স্টাফ, এজেন্ট-এসএলও যাদের সাথেই নিয়মিত দেখা হয়,সবাইকেই ভালোবাসি। যখন ধমকাই, জ্ঞানশূণ্য হয়েই ধমকাই। কাঁদিয়েও ছাড়ি অবস্থাবিশেষে। তবে তার স্থায়িত্ব বড় জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট। বাকি সময়টা যতটা পারি ভালোবাসি। এরাও বাসে, সব গোপন কথা অকপট ভাবে উন্মুক্ত করে যায় আমার ঘরের চার দেওয়ালের ভিতর। সব মিলিয়ে কেটে যায় টক-ঝাল-মিষ্টি দিনগুলো, আপিসে আসতে কখনও বিরক্তি লাগে না, না আমার- না এদের। আজ সম্পূর্ণ অন্য কারণে কাঁদতে দেখে বড় কষ্ট হচ্ছে,। এ এমন কারণ যার সমাধান এদের ম্যাডামের হাতে নেই।
“জানেন ম্যাডাম, ঐ অবস্থায় আমাদের ওরা আলাদা করে দিল। অজুহাত দেখাল, আমি কাজে বেরোই কি না, আমার বাচ্ছা হলে ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে আমি বাইরে হাওয়া খেতে যাব- সেসব হবে না। জানত শ্বশুরমশাই আমাকে দেখতে পারেন না, তাও তাঁকে ঠেলে দিল আমাদের ঘাড়ে। ওণাকেও তুলে দিল দোতলায়। অর্ধেক জানলায় পাল্লা বসেনি। দালানের মেজে হয়নি, ঘরগুলো সব প্লাস্টারও হয়নি। তারমধ্যেই আমরা তিনজন থাকতে বাধ্য হলাম। ঐ ঢাউস পেট নিয়ে সব কাজ করতে হত ম্যাডাম। বাপের বাড়িতে গিয়ে যে থাকব এরা বাপছেলে তো ভুখা মরবে। একতলা থেকে বালতি করে জল টেনে আনতে হত জানেন ম্যাডাম। একদিন এমনি জল আনতে গেছি, ওরা দুজনে চলে এল ঝগড়া করতে।” একটু দম নিয়ে বলল মেয়েটা,“আমার গায়ে সেদিন ওরা হাতও তুলেছিল ম্যাডাম। আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল-”।
সে কি? থানায় জানাওনি? ৪৯৮এ? মৃদু হেসে ওঠে মেয়েটা। “জানিয়েছিলাম তো ম্যাডাম। কিছুই হয়নি। হাসপাতালের কাগজের কপিও দিয়েছিলাম। লেখা ছিল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে আমার বাচ্ছাটা। নইলে হয়তো দুজনেই-। থানা থেকে বলে মিটমাট করে নিন। আমার বরও হয়তো নিমরাজি ছিল, বাড়ির কলঙ্ক বাইরে-”।
সত্যি মাইরি। মারাটা কলঙ্ক না। নালিশ করাটা কলঙ্ক। মেয়েটা বলে,“শুধু আমার মা। বেঁকে বসে আমার মা। মা বলেছিল, ‘আমি কোনদিন হাত তুলিনি আমার মেয়ের ওপর। কোন সাহসে হাত তোলে ওরা?’ আমরা ঐ বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠি। উকিলের কাছে যাই, আদালতে কেসও ওঠে ম্যাডাম। ওরা অামার বরের সাথে যোগাযোগ করে চাপ দেয় কেসটা তুলে নিতে হবে। শ্বশুরমশাই অবধি বলেছিলেন-ওসব একটু আধটু। তাই বলে ঘরের কেচ্ছা কেউ আদালতে টানে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কেস তুলতেও গেছিলাম। আমার উকিল যদিও আপত্তি করেছিলেন।  জজ সাহেব একজন মহিলা ছিলেন। উনি আমার মুখে শুনতে চান। আমায় কাঠগোড়াতে তোলা হয়। আমাকে জজ ম্যাডাম নিজে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি স্বেচ্ছায় কেস তুলছেন? কেন?’ আমি না কিছু বলতে পারিনি। শুধু বারবার মনে পড়ছিল, ওরা আমার গায়ে হাত তুলেছিল। ওরা আমায় ঐ অবস্থায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। আমার বাচ্ছাটা মরে যেত আরেকটু হলে-। এই সব ভেবে কি না জানি না,আমি একটা কথাও বলতে পারিনি, খালি টপটপ করে জল পড়ছিল চোখ দিয়ে। জজ ম্যাডাম তখন আমার বরকে ধমকান। বলেন কেস তোলার জন্য আমায় না চাপ দেয়-”।
তারপর? তারপর শুনলাম কেস চলছে, অনেক বছর ধরেই চলছে। সামনেই একটা ডেট আছে। যেদিন মেয়েটা ওকে আমার আপিসে ডেকে নেবার আর্জি নিয়ে এসেছে, ঐ দিনই ওর কেসের ডেট। তবে? ঐ দিন তো ওর আদালতে থাকার কথা, খামোখা আমার আপিসে আসতে চাইছে কেন? “ ওরা আবার কেস তুলে নেবার জন্য চাপাচাপি করছে ম্যাডাম। আমার বরের আপিসে গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে। ওদের মেয়েটা একটা সরকারী চাকরী পেয়েছে। আমি কেসটা না তুললে তো আর জয়েন করতে পারবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনেই আটকে যাবে। ” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,“তুমি ঐ মেয়েটা মানে তোমার ভাশুরঝির নামেও নালিশ করেছিলে নাকি? ও কি করেছিল?” জবাব পেলাম, “ও দাঁড়িয়ে ভিডিও তুলছিল ম্যাডাম। ওর বাবা মা আমায় পেটাচ্ছিল আর ও ভিডিও তুলছিল। আমি কেস তুলতে চাই না ম্যাডাম। এখনই চাই না। একটি বারও ক্ষমা চায়নি ওরা। একটি বারও কোনদিন আমায় কাকিমা বলে সম্বোধন করেনি মেয়েটা। আমার বর সবই বোঝে,কিন্তু রক্তের সম্পর্ক তো। জলের থেকেও ঘন। ও চায় আমি কেস তুলেনি। উকিল বাবু বললেন, আপনি যদি চিঠি করে ডাকেন, তাহলে সাপও মরবে- আর।”
নাঃ আর কথা বাড়াই নি। একটা মামুলী চিঠি করতে আর কতক্ষণ। তারপর যথারীতি কেটে গেছে অনেকগুলি  দিন। শুনলাম শেষ পর্যন্ত কেসটা তুলেই নিয়েছে মেয়েটা। ওরা আর ফিরে যায়নি ঐ বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতেই থাকে। ভাবছে বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। তবে যতদিন বৃদ্ধ জীবিত আছেন- ততোদিন না। ভাড়া বাড়িতে বাবা-বউ আর বাচ্ছা নিয়ে সংসার সাজিয়েও, নিজের ভিটেয় বৃদ্ধের শেষ নিশ্বাস ফেলার স্বপ্নটা পূরণ করার স্বপ্ন আজও দেখে চলে ওরা।
✍🏼©Anindita Bhattacharya

Sunday 5 July 2020

অনির ডাইরি ৪ঠা জুলাই, ২০২০


আনলক ডাউন শুরু হতে তখনও বাকি বেশ কয়েকটা সপ্তাহ, ঘোরতর গৃহবন্দী ভারতবর্ষ। মাঝ সপ্তাহেও জনশূন্য আমাদের চুঁচুড়ার আপিসপাড়া। হাতে গোণা কর্মী নিয়ে ভর দুপুরেও বুড়ো কালেক্টরেটটা যেন হানাবাড়ি।
এমনই এক দুপুরে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিলেন বাপন বাবু (নামটা পাল্টে দিলাম)। এসেছিলেন মহকুমা শাসকের কাছে নালিশ ঠুকতে। তিন মাস হয়ে গেল, বেতন পাননি। রীতিমত ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক, জরুরী পরিষেবা দেন উনি, ধরে নিন কোন পঞ্চায়েতে জল সংক্রান্ত কোন কাজ করেন। ঘোরতর লকডাউনের মধ্যেও তিনমাস কাজ করে গেছেন অনর্গল। অথচ পাননি মজুরী। সংসারে নিত্য অনটন, বাড়িতে অসুস্থ সন্তান- বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
কান্না আর ফোঁপানি থামাতে বেশ বেগ পেতে হল। পর্যায়ক্রমে সুজয় বাবুর ঘোর কালো চা আর বাতানুকূল যন্ত্রের হাওয়া খাইয়ে খানিকটা শান্ত করার পর দেখতে চাইলাম কাগজপত্র কি আছে। 
ওণার গলায় ঝোলানো জনৈক সরকারী দপ্তরের আইকার্ড। কিন্তু বাকি কাগজপত্র তেমন উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। সবই ঐ দপ্তর থেকে পঞ্চায়েতের কোন কমিটির সাথে পত্রালাপ- অর্ডার ইত্যাদি। কোথাও ওণার নাম নেই। শুনে বুঝতে পারলাম, জলসম্পদ সম্পর্কিত কোন পরিকাঠামো নির্মাণ করার পর, বাপন বাবু সমেত সমস্ত দায়িত্ব পঞ্চায়েতের কমিটির হাতে তুলে দিয়েছে সরকারী দপ্তর। টাকাপয়সা এখনও তাঁরাই দেন বটে, ব্যবস্থাপনাটা দেখে কমিটি।

মাসে ২৮দিন কাজ করেন বাপন বাবু, ফেব্রুয়ারি মাস অবধি ঠিকঠাক বেতনও পেয়েছেন। মার্চে লকডাউন ঘোষণা হওয়াতে বিলম্বিত হয়ে পড়ে বেতন। অনটনের সংসার।  উনি লকডাউনের মাঝেই নিয়ম করে তাগাদা দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে ওণার কন্যা, একে অর্থাভাব তায় ওণার আবেদনে কেউ কর্ণপাত করছে না দেখে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেতনের অনুরোধ জানান ওণার স্ত্রী।
এখান থেকেই শুরু হয় মূল সমস্যা। ঘরের মেয়েছেলে কেন ফোন করে টাকা চাইবে? এই নিয়ে যৎপরনাস্তি ভর্ৎসনা  করে ভাগিয়ে দেওয়া হয় ওণাকে।
সেই থেকে বেতনের দাবীতে নানা আপিসে ঘুরছেন উনি। আজ এসেছেন মহকুমা শাসকের কাছে ফরিয়াদ জানাতে।
যেহেতু সমস্যাটা  বেতন সম্পর্কিত, তাই মহকুমা শাসকের কাছে যাবার আগে দিন দশেক সময় চেয়েনিলাম।  লকডাউনে বন্ধ পোস্টাফিস, অগত্যা মেইলই ভরসা। আমাদের ইন্সপেক্টর নির্মলের এলাকা, ওর মাধ্যমেই পঞ্চায়েতের মেইল আইডি যোগার করে ওণার আবেদনের কপিটা পাঠানো হল। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকেও জানানো হল ব্যাপারখানা। সাথে মূখ্য সচীবের নির্দেশ, লকডাউনের বেতন অবশ্যই দিতে হবে। আর এ বেচারা তো নিয়মিত কাজ করেছে।

দিন দুয়েকের মধ্যেই জবাব পেলাম।  পঞ্চায়েতের তরফ থেকে জানানো হল, ওণার চেক তৈরি আছে। উনি নিয়ে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়। ওণাকে জানানো হল- ভাবলাম যাক ঝামেলা মিটল তাহলে। পরের দিন আবার এসে হাজির বাপন বাবু। চেকটা নেননি উনি। কেন রে?

শুনলাম ওণার যা প্রাপ্য তার থেকে অনেক কম টাকা ধার্য করা হয়েছে ওণার জন্য। ফেব্রুয়ারী মাসেও যিনি বেতন পেয়েছেন বারো হাজার টাকারও বেশী, সেখানে আমার চিঠির গুঁতোয় বর্তমানে ওণার জন্য ধার্য হয়েছে তিন মাসে থোক ১৪হাজার। এতো মহা জ্বালা। আনলক ডাউন শুরু হওয়া অবধি আর অপেক্ষা করা গেল না, তার আগেই ডাকতে হল মিটিং। কমিটি এবং দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব উভয়কেই অনুরোধ করা হল কাউকে পাঠান। দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনে এসে হাজির হলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র সাহেব। পাত্তা নেই পঞ্চায়েতের কমিটির। এদিকে বাপন বাবু রোজই এসে বসে থাকেন আমাদের দপ্তরে। দেখতে পেলেই সামাজিক দূরত্ব ভেঙে ধরতে আসেন পা। সংসার চলছে না। মেয়ে অসুস্থ। নিজেই বলেন, “মাথার ঠিক নেই ম্যাডাম।”
প্রথম মিটিং ব্যর্থ হলেও দেখলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাপন বাবুর প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ওণারা শ্রম কমিশনারেটের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করতে চান, কিন্তু ফেঁসে আছেন নিয়মের গেরোতে।

দ্বিতীয় মিটিং ডাকা হল। এবার এলেন জনৈক পদাধিকারী খোদ। জানালেন উনি ব্যস্ত মানুষ,পকেটে বিডিও সাহেবের ডাকা মিটিং এর চিঠি, জরুরী মিটিং ফেলে এসেছেন একটা পেটি ব্যাপার নিয়ে বারবার আমরা গুঁতো মারছি তাই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এবং আমার যুগপৎ ধমকে একটু থমকে গেলেন অবশ্য। ভেবেচিন্তে জানালেন, বাপন বাবুর বেতন কত হওয়া উচিৎ তা ওণারা জানেন না। জানলে মিটিয়ে দেবেন বটে। ঠিক হল একটা চিঠি করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানিয়ে দিলেই ওণারা সেই মত দিয়ে দেবেন।
বাপন বাবুকে বলা হল, দিন দশেক ধৈর্য্য ধরুন। হয়েই যাবে এবার। দিন কয়েকের মধ্যেই মজুরীর চিঠিও করে দিলেন মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। একেবারে আমার বলে দেওয়া বয়ানে, শ্রমদপ্তরের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরী মেনে। ভাবলাম মিটেই গেল কেসটা। একটা সংসার অন্তত বাঁচল আমাদের ধমক-ধামকে।

ও হরি। এক সপ্তাহ বাদে নির্মলের ফোন, “ম্যাডাম, লোকটা রোজ ফোন করে কান্নাকাটি  করছে। বেতন তো দেয়ই নি। উল্টে ধমকাচ্ছে শ্রম কমিশনারের ক্ষমতা নেই, পঞ্চায়েতের ব্যাপারে নাক গলায়। দেখে নেব, কেমন করে বেতন পাও তুমি। ” ধমকের কথা শুনে মজা লেগেছিল, সাহস থাকলে আমার সামনে এসে বলে যেত -।
কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে না দিলে এবার কি করব? বেসরকারী সংস্থান হলে,সোজা ইন্সপেক্টর পাঠিয়ে তুলে আনাতাম খাতাপত্র। গুনে গুনে প্রতিটা শ্রম আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায় কেস দেবার ভয় দেখাতাম হয়তো, কিন্তু সরকারে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কেস করা এত্ত সোজা নয়। অনুমতি লাগে অনেক উচ্চ মহল থেকে, যা প্রায় কখনই আসে না। এমনি একখানি কেসের আবেদন করে নির্মল আর আমি বসে আছি বছর দেড়েক। ততোদিনে তো লোকটা সপরিবারে আত্মঘাতী হবে। অন্তত মুখে তো তাই বলছে।
পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে কি শ্রম আইনে ইন্সপেকশন বা কেস করব আমরা? ওপরতলার সমর্থন ছাড়া ব্যাপারটায় এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অবশেষে বড় সাহেবের শরণাপন্ন  হলাম আমরা। স্যার অর্ধেকটা শুনেই জারি করলেন ফরমান, “অত ভাবার দরকার নেই। ইন্সপেকশন করাও এবং পে কেস ঠুকে দাও।”

যুগ্ম ইন্সপেকশনে পাঠানো হল, আমার দুই তুখোড় ইন্সপেক্টর নির্মল আর সঞ্চিতাকে, আগের দিন বদ্ধ কামরায় তিন মাথা এক হয়ে ঠিক করা হল, কি ভাবে এগোবে ওরা। কে যেন ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে নির্মলকে জনৈক দাদার নামে-

দিদির জমানায়, দাদাদের অত ডরাই না আমরা, তবে সামান্য বেচাল হলে কেসটা কেঁচে গণ্ডুষ হবে। নির্মল আর সঞ্চিতার মাখন মার্কা ভয় দেখানোতেই হয়তো অবশেষে ওনারা রাজি হলেন বেতন দিতে। গত শুক্রবার তিন মাসের বেতন একসাথে পেয়েই ছুটে এসেছিলেন বাপন বাবু। বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন স্যারের উপস্থিতিতে, জানতে চাইলাম, “চেকে আপনার নামটা ঠিক লিখেছে তো?” উনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “তা তো দেখিনি ম্যাডাম। পেয়েই ছুটে এসিছি আপনার কাছে। যদি আপনার সাথে না দেখা হয়- সেই টেনশনে আর নামের বানানটা দেখা হয়নি। এখন দেখলে হবে ম্যাডাম?” ফাইলটা ক্লোজ করতে করতে জানালাম, তা দেখুন আর একটা ছবি না তুলে যাবেন না যেন- এই ছবিগুলোই আমাদের ট্রফি। আর এই ট্রফি কখনই জেতা যায় না যদি না টিমে খেলা হয়- আর বড় সাহেব থেকে আমি হয়ে সুকন্যা ঘুরে নির্মল-সঞ্চিতা আমাদের টিমটাই যে ছিল জবরদস্ত। ছবিতে নির্মলের সাথে বাপন বাবু।

পুনশ্চঃ- সুকন্যার নামটা কেন করলাম? আমাকে যাবতীয় আইনি বদবুদ্ধি কে দেয় বলুন তো? নামটা উহ্যই থাক বরং।