এমনিতে যে নিজের আকৃতি বা প্রকৃতি নিয়ে অভাববোধ তো দূরের কথা, বরং আয়নার ওপারের মেয়েটাকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি। দেমাকী, মাটিতে পা পড়ে না ইত্যাদিও বলতে পারেন। তীব্র বিবাহপ্রীতি ছাড়াও, এই ব্যাপারটা “জব উই মেট”এর গীতের সঙ্গে আমার দারুণ মেলে, ঐ যে, কি বলে না, আমি হলাম, নিজের সবথেকে ফেভারিট-।
এইটুকু তো জীবন, জগত বা তার অধিবাসীদের নিয়ে মাথা ঘামাই কখন? দাড়িবুড়ো এক্কেবারে মনের কথাই বলে গেছেন, “আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল-”। পারিবারিক দিক থেকেও এ ব্যাপারে রীতিমত সৌভাগ্যশালিনী বলতে পারেন, অাশৈশব যখনই কেউ বর্ধিত ওজন নিয়ে সুচিন্তিত বিশেষজ্ঞ মতামত পেশ করেছে,সপাটে ব্যাট চালিয়ে স্টেডিয়ামের পার করে দিয়েছে বাবা। বাবার মতে, আমার দৈহিক ব্যাস, বাবার ব্যাঙ্কব্যালেন্সের পরিচায়ক। আরেঃ হোক না খণ্ডহর, তবুও তো কড়িবরগা ওয়ালা বাড়ির মেয়ে আমি, মানছি তালপুকুর, ঘটি ডোবে না, কিন্তু সুখের দিনে তো ডুবত রে ভাই। ঘটি-কলসী সবই ঢুবত। সেই বাড়ির মেয়েকে দেখে বোঝা যাবে না? অস্বীকার করব না, চাটুজ্জে থেকে ভট্টচায বাড়িতে এসেও, কখনও বদলায়নি ঘরোয়া পরিস্থিতি।
তবুও, যতই প্রিয়পুরুষদের ঢাল-তরোয়াল থাকুক, ফাঁকফোকর পেলেই হিতোপদেশ জুটেছে শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে। যদি ফেটে যাই, আহাঃ ওণাদের চিন্তা কি কম? আর পাঁচটা স্থূলকায় ছেলে/মেয়ের মতই, সেই কোন শৈশব থেকেই তৈরী হয়েছে মানসিক দূরত্ব, গড়ে উঠেছে জন্মশত্রুতা ঘি-মাখন জাতীয় সুস্বাদু স্নেহপদার্থের সাথে। সবই যে ফ্যাটে লটপট, ঘোর নিষিদ্ধ। ঘুষের মাল,গোপন রোগ বা লুকানো প্রেমের মত গভীর আকর্ষণ থাকলেও,প্রকাশ্যে আস্বাদ নেওয়ার সৎসাহস মোটেই ছিল না। শুধু দেখবি আর জ্বলবি টাইপ ব্যাপার আর কি। গরম ভাতে এক চামচ গাওয়া ঘি, বা টোস্টের ওপর পুরু নোনতা মাখনের প্রলেপ দিলেই, মনের মধ্যে যেন ঝপাঝপ সার্চ লাইটের মত জ্বলে উঠত জোড়া জোড়া চোখ। ঘুরিয়েফিরিয়ে একই কথা বলে যেত আমার মন, - “ না। না এবং না। একদম না।” অথবা “ “ফেটে যাব বোধহয়” অথবা “হার্টের ব্যামো হবে নির্ঘাত। অকালে টেঁসে যাই যদি, স্যালাড খাই বরং।”
স্যালাড-ডায়েটিং এগুলো শুনতে বেশ সোজা-সরল, আদতে কিন্তু ব্যাপারগুলো ভয়ানক রকম জটিল। দুদিন-তিনদিন একসপ্তাহ চলেই যায়- শশা, টমেটো, পেঁয়াজের ভরসায়, তারপরই জিভে পড়তে থাকে চড়া। মুষড়ে পড়ে হৃদয়, সেই সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ খাবারের জন্য, যা এই সমাজ ছাপ্পা মেরে নিষেধ করে ভারী চেহারার অধিকারীদের জন্য। সচেতন- অচেতন- অবচেতনে বড় বেশী বঞ্চিত বোধ হয় নিজেকে। ঈশ্, স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়েই যদি বিনা অপরাধবোধে খাওয়া যেত ঘি আর মাখন অথবা যা ভালোবাসি তাই। মাস দুয়েক আগেও, এটাই ছিল দিবাস্বপ্ন-
এই সময় কোন এক ওয়েলনেস গ্রুপে প্রথম ভার্চুয়াল পরিচয় ডঃ বার্গের সাথে। ডঃ এরিক বার্গ। নামী ভিডিওব্লগার এবং পুষ্টিবিশেষজ্ঞ। ওণার বিভিন্ন ভিডিওতে পোস্ট করা মন্তব্যাবলী পড়লে ওণাকে মসীহা বলেও ভ্রম হতে পারে-
ডঃ বার্গ বললেন, কে বলেছে ফ্যাট বর্জনীয়। ফ্যাট শুধু রসনার পক্ষেই অমৃতসম নয়, আমাদের শরীরের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পৌষ্টিক উপাদান। ফ্যাট খেলেই ক্লগড্ আর্টারিজ বা হৃদরোগ হবেই, এটা কিন্তু ঠিক নয়। বরং ফ্যাটে আছে জরুরী পোষণ। আরে মশাই, ফ্যাটই যদি না খান, তাহলে ফ্যাটে দ্রব ভিটামিন যেমন A,D,K কি করে আত্তিকরণ করবে আপনার দেহ? আর যতই ক্যালসিয়াম খান, ভিটামিন D যদি আপনার দেহে সংশ্লেষিত না হয়, তাহলে ঐ ক্যালসিয়ামকে কাজে লাগাবেন কি করে?
শুধু তাই না, আমাদের মস্তিষ্কেরও মূল উপাদান ফ্যাট। স্নায়ুতন্তুকে ঘিরে রয়েছে যে আস্তরণ, যার পোশাকী নাম মায়োলিন শিদ্ তারও মূল উপাদান ফ্যাট। ফার্টিলিটি, স্মরণশক্তি,কগনিটিভ সেন্স, স্ট্রেস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ হর্মোনসমূহ, তাদের অনেকগুলিই সংশ্লেষিত হয় ফ্যাটের উপস্থিতিতে। বাইরের আঘাত থেকে আপনাকে রক্ষা করার জন্য, ত্বকের নীচে যে কুশন তাও ফ্যাট দিয়েই তৈরী। ফ্যাট বাড়ায় অনাক্রম্যতা অর্থাৎ ইমিউনিটি।
আমাদের জন্য ফ্যাট এত জরুরী বলেই, শরীর যত্ন করে জমিয়ে রাখে ফ্যাট। তাই ফ্যাট কমানো ব্যাপারটা হল প্রকৃতিবিরদ্ধ, যাকে বলে, অ্যান্টি- সারভাইভাল। যত আপনি ফ্যাট কমাতে কমাবেন ক্যালোরি, যত কড়া হবে আপনার ডায়েটিং, ততোই আতঙ্কিত হয়ে উঠবে আপনার দেহ। আরও, আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরবে শরীরের সমস্ত ফ্যাট। আপনি যেমন শুরু করবেন ডায়েটিং, শরীরও তেমনি পাল্লা দিয়ে কমাতে থাকবে বিপাক অর্থাৎ মেটাবলিজমের হার। যত কঠোর ডায়েট, ততোই কম মেটাবলিজম। যত দীর্ঘ ডায়েট,ততোই ধীমে মেটাবলিজম। যা খাবেন সবটুকুই তখন সঞ্চয় করে রাখবে শরীর। উপরন্তু আরও বেশী খাবার জন্য তাড়না দিতে থাকবে আপনাকে। পরিণাম- বেড়ে যাবে খিদে আর লোভ। কষ্ট করতেই থাকবেন, কেষ্ট থাকবে অধরাই। আর কষ্ট করা ছেড়ে দিলেই, আবার দ্বিগুণ গতিতে যথা পূর্বম্। তাই আত্মবঞ্চনা ছাড়ুন। ক্যালরি মেপে খাবেন না। খান পেট ভরিয়ে, মন ভরিয়ে। যাতে প্রোটিন-ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট তিনটিই সুষম ভাবে প্রবেশ করতে পারে আপনার পাচনতন্ত্রে। শরীরের সাথে গড়ে তুলুন সৌহার্দ্য।
ডঃ বার্গের মতে, দেহে মেদ জমার জন্য মূল কালপ্রিট হল যে হর্মোন, তার নাম ইনস্যুলিন। দেহে ফ্যাট সঞ্চিত হয় ইনস্যুলিনের নির্দেশে, আবার ফ্যাট বার্নিংএও বাধা দেয় ইনস্যুলিন। মোদ্দা কথা ইনস্যুলিনের উপস্থিতিতে ফ্যাট কমানো, অলীক কল্পনা মাত্র।
যতবার খাবেন, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ততোবারই ক্ষরিত হবে ইনসুলিন। ঐযে দিনে ছবার/আটবার খাওয়া- ঐ গপ্প ভুলে যান। খাবেন, শুধু মাত্র খিদে পেলে তবেই। ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ আর ডিনারে যদি সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন ভোজনবিলাস, আপনাকে ঠেকায় কে?
আর একটা কথা, কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বাড়িয়ে দেয় ইনস্যুলিনের ক্ষরণ। তাই কার্বস কমিয়ে বাড়ান প্রোটিন আর ফ্যাট। ঘিটা খান, ভাতটা কমান। মাখন বা মেয়োনিজটা খান, পাউরুটিটা ছেড়েই দেখুন না। আর যাই খান, ফুল ফ্যাট ভার্সানটাই খান, ফ্যাট ফ্রি বা লোফ্যাট কিছু জিভে দেবেন না প্লিজ।
মাসখানেক ধরে ওণার কথা মত খাবারে ফিরিয়ে এনেছি ফ্যাট। মাখন, ঘি, চীজ,মেয়োনিজ, ডিমের কুসুম সবই খাচ্ছি। আমি বিশেষজ্ঞ নই, শুধু মাত্র নিজের অভিজ্ঞতাটুকু ভাগ করে নিতে পারি মাত্র, কারণ পর্দার আড়ালে আমার মত দোদুল্যমানতার- দুষ্টচক্রের শিকার আরও অনেকেই। যাঁরা মনকে কোতল করে, সমাজের কথা শুনে হালদুরস্ত থাকার চেষ্টা করেন, আর আত্মবঞ্চনায় ভোগেন- তাঁদের বলি আমি ভালো আছি। ওজন কমেছে বলে দাবী করব না, তবে বাড়েনি। গা-হাতপায়ে লুকানো নানা ব্যথাবেদনারা গা ঢাকা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। মাঝরাতে আর ডাক পাঠায় না রেফ্রিজারেটরে লুকানো চকলেট। মোটামুটি খুশিখুশিই থাকি, সদ্য করোনা থেকে উঠেছি, তবুও পরিশ্রম করতে ক্লান্তি লাগে না। মুখে ক্রীম/ময়েশ্চারাইজার না মাখলেও তেলতেল চকচকে থাকে মুখটা। হয়তো সবই মনের ভুল, তবে চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়েছে হাতের নখগুলির, কিছুকাল আগেই এতই নরম হয়ে পড়েছিল, যে সামান্য চাপেই মুটমুটিয়ে ভেঙে যেত সবাই। বহুবার ক্যালসিয়ামের ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু, যতদিন খেয়েছি, ইতরবিশেষ উন্নতি হয়েছে হয়তো। তারপরই আবার ধরেছে ফাটল। আজকাল আর সেই সমস্যা নেই। কারণটা বুঝতে লাগল এতদিন।
এই আর কি, ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। আনন্দে বাঁচুন।
No comments:
Post a Comment