Monday, 10 August 2020

অনির ডাইরি ৯ই অগস্ট,২০২০

 তুমি বললে, “চলো যাবে?” একপায়ে খাড়া আমি। বড় দিশেহারা সময়, বড় দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি। মোবাইলের ওপারে বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধ। বড় পুরু হয়ে উঠছে ত্বক, ভোঁতা হয়ে আসছে অনুভূতির দল। কোন অনাম্নী অঙ্গনা যেন কোথায় ঢেলেছে বিষ, কোন হতভাগ্য চলচ্চিত্রাভিনেত্রীর জন্য নাকি কলঙ্কিত আজি সমগ্র বঙ্গনারী সমাজ। ফুঁসে উঠছে বঙ্গ পুং আর নারীর দল। ঝড়ে উড়ছে শুকনো পাতা। ব্যক্তিগত ভাবে এসব কুবাক্যে খুব একটা প্রভাবিত হই না যদিও, জনরোষ দেখে  প্রাথমিক ভাবে মনে হল, বেচারী নির্ঘাত কোন বঙ্গতনয়ার চোখে হারিয়েছে প্রিয়তম পুরুষ। অথবা কোন বঙ্গপুঙ্গব ভেঙে খানখান করেছে মেয়েটার হৃদয়। আগুন জ্বললে ধোঁয়া তো উঠবেই। তবুও উত্তপ্ত জনপোস্টে প্রলোভিত হয়ে, চুপিচুপি দেখে এলাম আমিও, অনাম্নী অঙ্গনার সাধের দেওয়াল জোড়া বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছড়াছড়ি। মনে হল ভারি অঙ্কের মানহানির মামলা ঢুকে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়, এনারা অর্থের মূল্য আমাদের থেকে ঢের বেশী বোঝেন। বলেও দেখলাম জনাকয়েক মিডিয়া ফাটানো নরনারীকে। পরিণাম কি না জানি না, আজকাল আর খুঁজে পাচ্ছিনা আসল পোস্টটা। বাজারে স্ক্রিনশটের ছড়াছড়ি থাকলেও, ওণার দেওয়ালের আসল পোস্টটা গেল কোথায়? তোমাকে শোনালাম আমার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, তুমি বললে, “হুঁ।” 

এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে, আড়াই নম্বর দিয়ে গলে গাড়ি উঠল যশোর রোডে। রোজই তো যাই এই রাস্তা ধরে, তবুও এমন ঝকঝক করে না তো। আকাশটা যেন ধুয়ে মুছে তকতকে, ইতিউতি লুকোচুরি খেলছে পেঁজা তুলোর মত মেঘের দল। এই আধা লকডাউনে বেশ ফাঁকা বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে। দুপাশে সারি সারি চায়ের দোকান। এদের চা বেশ সুস্বাদু। পাশাপাশি কাঁচের বয়ামে রাখা হরেক রকম বিস্কুট। সস্তা ক্রীম রোল। গোল গোল নকল মতিচুরের লাড্ডু। রাস্তায় পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে, মাটির ভাঁড়ে আগুন গরম দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট- পাশের রাজপথ দিয়ে আলোকগতিতে ছুটবে জীবন। জানতে চাইলাম খাবে? নিরুত্তর রইলে তুমি, দুচোখে ঝলসে উঠল কি জানি কি অনুভূতি । রাজপথের ধারে বসতি গড়েছে একদল বাঞ্জারা, দেদার পড়ে আছে, রামধনুরঙ হাতে গড়া ঘরসাজানোর সরঞ্জাম। দুদণ্ড জিরোই এথা, নারাজ তুমি। 

অন্যদিন নিবেদিতা সেতু ধরে ঝটিতি পেরিয়ে যাই নদী, আপিস যাবার পথে দুদণ্ড দাঁড়ায় বাপি, জানলার কাঁচের ওপারে ভেসে ওঠে দক্ষিণেশ্বরীর মন্দিরের সুদৃশ্য চূড়া। এপারে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মায়ের ব্যগ্র মুখখানি। দুহাত কপালে ঠেকায় মা, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে পিছনে এসে দাঁড়ায় বাবা। সেই মাঝ মার্চ থেকে গৃহবন্দী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এভাবেই হোক না মানসভ্রমণ। আজ বিবেকানন্দ সেতু ধরলে তুমি। দক্ষিণেশ্বর ইস্টিশনের পাশ দিয়ে, দূরে স্কাইওয়াক দেখতে দেখতে সাঁ করে বেঁকে গেল গাড়ি। দূর থেকে ইস্টিশনটা মায়ের মন্দির বলে ভ্রম হয় জানো,  প্রণামও করেন অনেকে। মা তো সর্বত্র বিরাজমানা, সমস্যা কোথায়? 

হ্যাঁ গো, তোমার মনে পড়ে? এই বালি ব্রীজের ওপরেই একবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল গাড়ি। সুদূর খড়্গপুর থেকে, প্রায় সংসার গুটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ফিরছিলাম আমরা। তুত্তুরীর আগমনে তখন বাকি কেবল এক পক্ষ। আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, পরদিনই  ভোর ৭টা ১০এর খড়্গপুর লোকালে ফিরে যাবে তুমি। বনেট খুলে খুটখাট করছিল ড্রাইভার, আর আমরা মোহিত হয়ে দেখছিলাম ডুবন্ত লাল বলের মত সূর্যটাকে। গঙ্গার পানিতে মাখামাখি সোহাগী আবির। সেই আবির ছড়িয়ে গেল মন্দিরের খাঁজে খাঁজে। কিছু কিছু মুহূর্ত বুঝি মোছে না হৃদয় হতে-  এবারও তুমি নিরুত্তর। হয়তো মৌখিকভাবে প্রশ্নটাই করিনি আমি। কিছু কিছু প্রশ্ন নিরুচ্চারিত থাকাই শ্রেয়। বাতাসে মিশে থাকে তার উত্তর। 

গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরেছি আমরা। বালি ছাড়িয়ে উত্তরপাড়া। সরু রাজপথের একদিকে চকচকে নব্য-প্রাচীন অট্টালিকা সমূহ, অপর পারে চিকচিকে গঙ্গা। ইতিহাস শোনাও তুমি, অবিভক্ত বাংলার প্রথম পৌরসভার গপ্প। স্থানীয় জমিদার, বাবু জয়কৃষ্ণ মুকুজ্জের উদ্যোগে ১৬৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভা। ১৮৫১ সালেই কোম্পানীর কাছে আবেদন করেছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ। হোক না ক্ষুদ্রিকা, তবুও প্রিয় নগরে গড়ে উঠুক পৌরসভা। সে আবেদন নাকচ হলেও দমেননি বাবু জয়কৃষ্ণ আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা। অবশেষে দুবছর পর মেলে অনুমোদন। পৌরসভার গাত্রে খোদিত সন-তারিখ সেই শুভক্ষণের।  ১৮৫৩ সালের ১৪ই এপ্রিল। পৌরভবনের গাত্রে শোভা পায় আরো এক মহামানবের স্থিরচিত্র। বাবু সুভাষ চন্দ্র বোস। সন ১৯৩৮। তৎকালীন পৌরসভার আমন্ত্রনে পদধূলিধন্য করেছিলেন এই পৌরভবন। কৌচে আসীন হবু নেতাজী, পরিবৃত গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ দ্বারা। ধুতি-চাদর পরিহিত বিগলিত হাসিমুখ একদল বাঙালী, যারা গঠন করেছিলেন তৎকালীন বোর্ড।  

ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের জন্মপ্রেম, ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই আমরা। গাড়ি ছুটে চলে রাজপথ ধরে, সচেতন ভাবে আমরা এড়িয়ে যাই কেন্দ্র-রাজ্য-রাজনীতি-লকডাউন জাতীয় শব্দাবলী। এই সব শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অশোকবাবু। উনি অত্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ব্যক্তি। আণ্ডারপাসে বড় বড় গর্ত এইটুকু বলার অপরাধে প্রায় আধঘন্টা ধরে যাবতীয় দপ্তরের মুণ্ডপাত করলেন উনি। অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে হল আরেক দফা মুণ্ডপাত।  মানুষটি সাধাসিধে বটে, তবে স্বভাবে ঘোরতর তর্কবাগীশ বাঙালী।

ধাড়সা বাসস্ট্যাণ্ডের উল্টোদিকে আহমেদ সাহেবের চেম্বার। ওণার ওপর বড় ভরসা শ্বশুর মশাইয়ের। কি যেন নার্ভ শুকিয়ে আসছে ওণার, পরিণামে পায়ের পাতায় ধরে অসহ্য জ্বলন। কলকাতার নামীদামী ডাক্তারকুল বলেই দিয়েছে, “এ ব্যামোর কোন ওষুধ নেই।” প্রাণঘাতী তো নয়, শুধু জ্বলুনী টুকুই যা সইতে হবে। আহমেদ সাহেবের ওষুধে কম থাকে জ্বালা। বৃদ্ধ নিজেই আসছিল, ওষুধ আনতে। কোন মতে ধরে বেঁধে আটকানো গেছে তাঁকে। একফালি বারন্দায় পাশাপাশি বসে আছি আমরা, সহৃদয় ডাক্তারবাবু ভিতরে গেছেন ওষুধ আনতে। ঘড়ি বলে সাড়ে বারো। পাশের পুকুরে ঝিলিক মারে মধ্যগগনের যুবক তপন। গুনগুন করে গান গাইছি আমি, তুমি বললে, “হাওড়া যাবে?”

অশোকবাবু বললেন, “বাড়ি যাবেন না এজ্ঞে?” বাড়িই তো। তিন দশক কাটানো বাড়ি। আমার শহর। বেলুড় মঠের পাশ কাটিয়ে, লিলুয়া আইনক্স ছাড়িয়ে গাড়ি ঢোকে ঘুষুড়িতে। জানো, এখানেই কোথায় যেন বেশ কয়েকটা অনুপম পোড়া মাটির মন্দির আছে।বলেছিলাম না তোমাকে, কার সাথে যেন দেখতে এসেছিল সঞ্চিতা। সে অনেককাল আগের কথা। ছবি দেখে নেশা ধরেছিল। যতবার বলেছি তোমাদের, অট্টহাস্য করেছ তোমরা। ঘিঞ্জি বাজার এলাকা। সেখানে মন্দির বিরল নয় বটে, তবে দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটার মন্দির? পথ দেখায়নি সঞ্চিতাও। স্বপ্নময় দেউল বোধহয় স্বপ্নেই দেখা। গাড়ি ঢোকে শালকে। একমনে বলে যাও তুমি, এখানেই কোথায় যেন ছিল মায়া সিনেমা। তোমার মা-মাসিদের একমাত্র বিনোদনস্থল। মাসিদের সাথে আশা ও ভালোবাসা দেখতে গিয়েছিল ছোট্ট তুতাই। প্রসেনজিৎ আর দীপিকা। পাডুকোন নয়, চিকলিয়া। আগে বাঁদিকে বাঁধাঘাট লঞ্চঘাট। কতবার কলকাতা থেকে লঞ্চ পেরিয়ে এপাড়ে এসেছেন তোমার বাবা-মা। ডানে হরগঞ্জ বাজার। ঐ বাজারেরই শাড়িজামা পরে বড় হয়ে উঠেছেন ওণারা। এদিকে গেলেই মায়ের স্কুল, ঊষাঙ্গিনী বালিকা বিদ্যালয়। ওদিকে বাবাদের  শালকিয়া অ্যাংলো-স্যানস্ক্রীট হাইস্কুল। এই তো তোমাদের বাড়ির গলি। কেউ থাকে না আর এখানে। ভাবুক হয়ে পড় তুমি। খুঁজতে থাকো, গলির মুখের চা-লস্যির দোকানটা। খোঁজ সেই রোয়াকগুলো, যেখানে বসত ফুলকাকা থেকে ছোটেকাকাদের আড্ডা। সেই আড্ডাবাজ ছেলেগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল। পৌনে দুটোর রোদে খটখটে শুকনো মরা গলি। উদাস হয়ে পড় তুমি, আর একটু চেপে ধরি তোমার নরম হাতের পাঞ্জা, একসাথে আরেকবার খুঁজতে থাকি, লুকানো শিকড়বাকড় গুলো। খালি চোখে ধরা যায় না, কিন্তু তবুও তারা থেকে যায়। থেকে যায় আমাদের সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে। খুঁজলেই পাবো জানি। হয়তঃ পেয়ে যাব আমার হারানো ভাঙা দেউলগুলোও- জীবন বড় বিচিত্র, কিছুই হারায় না।  লুকিয়ে থাকে আলোআঁধারীর নক্সার মাঝে।

No comments:

Post a Comment